বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/দোয়েল
বাংলার এমন নগর বা গ্রাম নাই যেখানে এই পাখী তার সুললিত সুরের ধারায় দিগ্মণ্ডল মুখরিত করিয়া রাখে না। ইহার দেহের বেশীর ভাগই উজ্জ্বল কুচকুচে কালো, দুইপাশের ডানার মাঝ বরাবর
দোয়েল একটি ফেনশুভ্র রেখা। বক্ষের নিম্নভাগ সম্পূর্ণ শুভ্র। পুচ্ছের আধোভাগের পতত্রগুলিও সাদা এবং যখন সে লেজটিকে ঊর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত করিয়া পাখার মত বিস্তৃত করে, তখন লেজের এই সাদা পতত্রগুলি স্পষ্ট দেখা যায়। দৈর্ঘ্য পাখীটি আট ইঞ্চির অধিক নহে, কিন্তু দেহের গঠন অতি সুঠাম। এর দেহের গঠনে এবং চালচলনে বেশ একটা লীলায়িত ছন্দ আছে। যখন সে পুচ্ছটিকে উচ্চে তুলিয়া গাছের ডালে কিংবা কোনও মাটির ঢিপির উপর অথবা ঘরের দাওয়ায় অসিয়া বসে,তখন মনে হয় সে সমস্ত বিশ্বচরাচরকে বলিতেছে—“আমার চাইতে সুন্দর কিছু দেখাও দেখি।” মানুষের সান্নিধ্যে সে বিচলিত হয় না এবং মনুষ্যাবাসের মধ্যেই বাস করিতে যেন সে পছন্দ করে।বাগানের অপ্রশস্ত পথে চলিতে চলিতে হয়তো দেখা যায় এই পাখী ঠিক পথের মাঝখানে ভূমির উপর বসিয়া কোনও কীটের স্বাদুতা পরীক্ষা করিতেছে। আপনাকে দেখিয়া সে নিঃশব্দে পাখা মেলিয়া উত্থান পূর্ব্বক অদূরে শাখাগ্রে যাইয়া বসিবে। শাখাটি খুব উঁচু নহে,হয়তো হাত বাড়াইলেই পাখীটিকে স্পর্শ করা যাইবে। সেখান হইতে কুঞ্চিত নয়নে আপনাকে লক্ষ্য করিবে। সমুখ দিয়া চলিয়া গেলে ত্রস্ত বা সঙ্কুচিত হইয়া পলাইবার চেষ্টা করিবে না। বাংলার পল্লীর স্থিরা প্রকৃতির বুকে এই ক্ষিপ্র, চঞ্চল পাখী তার চলাফেরার বিদুৎগতি দিয়া একটা সজীবতার সঞ্চার করে।
অতি প্রত্যুষে, সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে ব্রাহ্ম মুহূর্ত্তে সে নিবাসবৃক্ষ ত্যাগ করে। কোনও একটি উচ্চ বৃক্ষের সর্ব্বোচ্চ শাখার অগ্রভাগে বসিয়া গলা ছাড়িয়া সে উচ্ছ্বসিতভাবে প্রভাতবন্দনা করে। ইহার কণ্ঠস্বর সুদীর্ঘ শীষ,ধ্বনি খাদে আরম্ভ হইয়া ক্রমশঃ উচ্চগ্রামে উঠিয়া পুনরায় ধীরে ধীরে নামিয়া শেষ হয়। মাঝে মাঝে আসন পরিবর্তন করিয়া ঝাড়া দুই ঘণ্টা লহরীর উপর লহরী সুর ঢালিয়া চারিদিক ঝংকৃত করিয়া তোলে। প্রকৃতির বুকে বাংলা দেশে আমরা যত রকম পাখী দেখি তার মধ্যে ইহারই গান মাধুর্য্যে শ্রেষ্ঠতম বলিয়া স্বীকৃত। “শামা”কে বাদ দিলে দোয়েলই, শুধু বাংলার নহে,সমগ্র ভারতের গায়কপাখীদের মধ্যে প্রথম আসন অলঙ্কৃত করিতেছে। সঙ্গীতপারদর্শিতায় ও মধুরতায় “শামা”ই শ্রেষ্ঠ; তবে মুক্ত, স্বাধীন অবস্থায় শামার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় না, খাঁচার ভিতরেই শামার সঙ্গীত শ্রবণ করিবার সুযোগ আমাদের হইয়া থাকে। কেন না, শামা গভীর অরণ্য-নিবাসী। মনুষ্যাবাস হইতে বহু দূরে সে বাস করে।
সকালবেলা সমস্ত গ্রাম-প্রান্ত যখন বেশ কিছুক্ষণ রৌদ্রে স্নান করিয়াছে, তখনই সঙ্গীত থামাইয়া দোয়েল আহার অন্বেষণে মন দেয়। ভূমির উপর হইতেই এই পাখী আহার্য্য সংগ্রহ করে। বৃক্ষের উপর পত্রমধ্যে কিংবা শূন্যপথে সে খাদ্য সংগ্রহ করে না। এক একটা পাখীর খাদ্যসংগ্রহ করিবার স্থান ও রীতির প্রভেদ লক্ষ্য করিবার বিষয়। খাদ্য অন্বেষণে আমাদের প্রাঙ্গণে, ছাঁচতলায়, দাওয়ার নীচে আসিয়া আহার্য্য সংগ্রহ করিতে ইহা আদৌ সঙ্কোচ বোধ করে না।
কীট-পতঙ্গই ইহার একমাত্র ভোজ্য। শাকসব্জী ফলমূল ইহার মোটেই প্রিয় নহে। বেশীর ভাগ কীটভূক্ পাখীদের বিশেষত্ব এই যে তাহারা দলবদ্ধ হইয়া থাকিতে চায় না। ইহার কারণ ইহাই অনুমিত হয় যে প্রকৃতির খয়রাতী লঙ্গরখানায় কীটপতঙ্গের প্রাচুর্য্য সর্ব্বত্র সমান নয়। অনেকগুলি পাখী একত্র থাকিলে আহার্য্যের পরিমাণ শীঘ্র শীঘ্র নিঃশেষিত হইবে সেইজন্য বোধ হয় ইহারা দূরে দূরে থাকে। লক্ষ্য করিলেই বুঝা যাইবে যে বাগানের এক একটা অংশে যেন এক এক জোড়া দোয়েলের কায়েমীস্বত্ব। প্রত্যেক দম্পতির এক একটা তালুক—যার চৌহদ্দীও বেশ নিশানা করা আছে। একজন নিজ চৌহদ্দীর বাহিরে অন্যের এলাকায় ভুলিয়াও যায় না। ভৌগোলিক আত্মনিয়ন্ত্রণে ইহারা স্বভাবসিদ্ধ।
দোয়েল এত অমিশুক যে তার গৃহিণীর সঙ্গেও সম্বন্ধটা খুব ঘনিষ্ঠ নহে। ভর্ত্তার মেজাজ খুব ভাল করিয়া জ্ঞাত থাকায় দোয়েল-পত্নীও বেশ দূরে থাকে। কিন্তু পতিগতপ্রাণা দোয়েলজায়া পুরুষদোয়েলকে একেবারে ত্যাগ করিয়া যায় না, কিঞ্চিৎ ব্যবধান রক্ষা করিয়া সঙ্গে সঙ্গেই ফেরে। স্ত্রী-দোয়েলের দেহবর্ণে পুরুষদোয়েলের মত জৌলুস নাই। তবে স্ত্রী-পাখীর দেহের কালো অংশ ফিকে। দোয়েলজায়ার আদর বাড়িয়া যায় বসন্তকালে, কেন না সেই সময়টা প্রায় বেশীর ভাগ পাখীর মত এদেরও প্রজনন ঋতু। তখন দোয়েল মহাশয়ের মনে পড়ে যে সারা শীতকাল যে নীরব সঙ্গিনী ছায়ার মত পিছনে পিছনে ফিরিয়াছে তাহার মনোরঞ্জন করা কর্ত্তব্য। এবং তখন এই কর্ত্তব্যটি সে খুবই নিষ্ঠার সহিত পালন করে। কণ্ঠে তখন তার সুরের ধারা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে; শাখা হইতে শাখান্তরে উড়িয়া পুচ্ছখানি গর্ব্বভরে বিস্তার করিয়া বেড়ায়। জীবন-সঙ্গীর রূপলালিত্যে ও কণ্ঠমাধুর্য্যে আত্মহারা হইয়া নীড়োপবিষ্টা দোয়েলপত্নী ডিম ফুটানোর একঘেয়ে কাজের অবসাদ ভুলিয়া থাকে। পুরুষ দোয়েলই সুরসিদ্ধ, স্ত্রীপাখীটির কণ্ঠে ধ্বনি নাই।
স্ত্রী ও পুরুষ দোয়েল পরস্পরের জীবন-সঙ্গীই বটে। এক জোড়া পাখীর একটির মৃত্যু না ঘটিলে অপরটি আর অন্য সঙ্গী গ্রহণ করে না।—ইহা আমার শোনা কথা, নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ নহে।
বাগানের বৃক্ষশ্রেণীর নীচে যেখানে আলোছায়ার অনবরত লুকোচুরি চলে, সেইখানে দোয়েল সারাদিন বিচরণ করে। তাহার দেহের সাদাকালো বর্ণ সেই আলোছায়ার সঙ্গে খাপ খায়। চুপ করিয়া স্থিরভাবে যখন সে কোনও শাখাগ্রে বসিয়া থাকে, চট্ করিয়া সে নজরে ধরা পড়ে না। প্রকৃতি এইরূপেই তার সৃষ্ট জীবের জন্য শত্রুর হাত হইতে আত্মগোপনের ব্যবস্থা করিয়াছেন।
দিবসের পূর্ব্বাহ্নেই দোয়েলের কণ্ঠকাকলী উচ্চগ্রামে থাকে। দ্বিপ্রহর হইতেই কণ্ঠধ্বনি হ্রাস প্রাপ্ত হয়। কিন্তু যখন পশ্চিম আকাশে দিগন্তব্যাপী সোনালী সৌন্দর্য্য ছড়াইয়া সুর্য্য অস্তগামী হয়, তখন দোয়েল আবার উচ্চ বৃক্ষচুড়ে আরোহণ করিয়া তার তান সপ্তমে তুলিয়া অস্তরবির বিদায়বাণী গাহিয়া লয়। বসন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেই দোয়েলের কণ্ঠধ্বনির তীব্রতা থাকে। বর্ষান্তের সঙ্গে সঙ্গে তাহার কণ্ঠলালিত্য মন্দীভূত হইয়া আসে—শীতকালে তাহাকে ক্বচিৎ শোনা যায়। শীত যখন শেষ হয়, ধরণীর দুয়ারে বসন্ত যখন আবার জাগ্রত হইয়া উঠে, তখন দক্ষিণ হাওয়ার আভাসের সঙ্গে সঙ্গে দোয়েল সজাগ হইয়া উঠে। আবার তাহার সুরের মদিরায় প্রকৃতি হর্ষে ও আনন্দে বিহ্বল হইয়া পড়ে।
যদিও ইহারা অসামাজিক পাখী, দলবদ্ধ হইয়া থাকে না, তবু বসন্তের প্রারম্ভে অনেক সময় ইহাদিগকে দলবদ্ধভাবে কুস্তী প্রতিযোগিতায় রত দেখা যায়। এই সময় বাগানের একটা স্থানে কেহ ভূমির উপর, কেহ বা নিম্নশাখাগ্রে বসিয়া কলরব করিতে থাকে। মধ্যখানে, ভূমির উপর দুইটি দোয়েলকে জড়াজড়ি, ধ্বস্তাধ্বস্তি করিতে দেখা যায়। একটি পরাজিত হইলে সে দূরে সরিয়া গিয়া বিস্রস্ত পালকগুলিকে চঞ্চুদ্বারা বিন্যস্ত করিতে থাকে। বিজয়ী পাখীটির সঙ্গে অন্য একটি আসিয়া মল্লযুদ্ধে লাগিয়া যায়। দর্শক পাখীগুলি সোল্লাসে উৎসাহ দিতে থাকে। এইরূপ একটির পর একটি বলপরীক্ষা হইয়া গেলে সকলে গোলমাল করিতে করিতে নিজ নিজ নিবাসস্থানে প্রস্থান করে। কোনও কোনও লেখক মনে করেন যে এই প্রতিযোগিতা উদ্দেশ্যবিহীন ক্রীড়ামাত্র নহে। প্রজননঋতুর প্রারম্ভেই এরূপ হইয়া থাকে। অতএব কোনও পাখীর প্রেমলাভের জন্যই এইরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুষ্ঠান হয় এবং বিজয়ী পাখী বীর্য্যশুল্কে পত্নীগ্রহণ করে।
কীটভূক্ এই পাখী আমাদের বাগানের ফলমূল ও শাকসব্জীর অনিষ্টকর অনেক কীটপতঙ্গ দ্বারা উদরপূর্ত্তি করিয়া উদ্ভিদের নিরাপদে বৃদ্ধির সহায়তা করে। সুতরাং ইহার একটা ইকনমিক বা অর্থনৈতিক মূল্য আছে। ইহাকে বন্দী করা, নির্য্যাতন করা কিংবা ধ্বংস করার চেষ্টা মানুষের স্বার্থের প্রতিকূল।
সকাল-সন্ধ্যা কুটীর-পার্শ্ব হইতে যে আমাদের কর্ণে সুরধারা বর্ষিত করে তাহাকে খাঁচায় পুরিবার চেষ্টা না করাই ভাল। সাধারণতঃ কীটভুক্ পাখীকে খাঁচা-বন্দী করিয়া বাঁচানো যায় না। শামা কীটভুক পাখী হওয়া সত্ত্বেও খাঁচায় নিজেকে মানাইয়া লয়, কণ্ঠমাধুর্য্য তাহার নষ্ট হয় না। কিন্তু উচ্চবৃক্ষের অগ্রভাগে বসিয়া যাহার গান গাওয়া স্বভাব, খাঁচার সঙ্কীর্ণ পরিসরের মধ্যে তাহার গান স্বতঃস্ফূর্ত্ত হইতে পারে না। বোধ হয় সেই কারণেই পক্ষিপালকদের মধ্যে একে বন্দী করিয়া রাখিবার রেওয়াজ কম।
লোকালয়-বাসী এই পাখী মনুষ্যাবাসের কাছাকাছিই নিজ শাবকোৎপাদন কার্য্য সম্পন্ন কর। সুতরাং পাঠক ইচ্ছা করিলে ইহার নীড়-রচনা প্রভৃতি কার্য্য অনায়াসে লক্ষ্য করিতে পারেন। দেয়ালের গর্ত্তমধ্যে, বৃক্ষ-কোটরে বা চালের নীচে এরা বাসা রচনা করে। শুষ্ক তৃণ,সূক্ষ্ম শিকড়, তন্তু, পাখীর পালক প্রভৃতি দ্বারা গহ্বরের অভ্যন্তর আস্তৃত করিয়া তদুপরি ডিম্বরক্ষা করে। প্রায় ক্ষেত্রেই চার-পাঁচটি ডিম একটি বাসায় দেখা যায়। ডিমগুলির রং সবুজাভ শ্বেত; কদাচিৎ সবুজাভ হালকা নীল, রক্তাভ চিহ্ন-সমন্বিত। একজোড়া দোয়েল একবার যেখানে বাসা রচনা করে, প্রায়শঃ দেখা যায় প্রতি বৎসর তারা সেইখানেই ফিরিয়া আসিয়া সেই কোটরটি ব্যবহার করে—অন্য ঋতুতে আহার অন্বেষণে তাহারা যতদূরেই যাক। অবশ্য গ্রাম ছাড়িয়া তাহারা যায় না, কেন না ইহারা যাযাবর নহে।