বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/পাখীর কথা
পাখীর কথা
এই পুস্তকে কয়েকটি মাত্র পাখীর বর্ণনা সন্নিবেশিত হইল। অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রায় ১২০০ রকমের পাখী আছে। আমাদের ভূতপূর্ব্ব শাসকরা আমাদের অন্য কোনও উপকার না করিলেও আমাদের দেশের অনেক প্রকার তথ্য সংগ্রহ করিয়া সাজাইয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তন্মধ্যে এ দেশের পাখীর বংশপরিচয় একটি। ভারত গভর্ণমেণ্টের অর্থানুকূল্যে এদেশের বিবিধ জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদির বিশদ বর্ণনা, শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি মুদ্রিত হইয়াছে। “ফণা অফ বৃটিশ ইণ্ডিয়া, বার্ডস” প্রথমে ব্ল্যানফোর্ড এবং ওট্স্ এই দুই মনীষী কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইয়া বাহির হয়। তারপর গত প্রথম মহাযুদ্ধের পর এই সুবৃহৎ গ্রন্থগুলির দ্বিতীয় সংস্করণ ষ্টুয়ার্ট বেকারের সম্পাদনায় বাহির হয়। প্রথম সংস্করণের শ্রেণীবিভাগের অনেক পরিবর্ত্তন ষ্টুয়ার্ট বেকার করেন।
ইহা ছাড়া বহু ইংরাজ লেখক এদেশের পাখী সম্বন্ধে গবেষণামূলক বহু পুস্তক লিখিয়া গিয়াছেন। অনেকে আবার অবৈজ্ঞানিক সাধারণ পাঠকের জন্য প্রাঞ্জল ভাষায় পাখীদের জীবনকাহিনী লিখিয়া গিয়াছেন। বাংলা ভাষায় বিশ্বভারতীর শিক্ষক জগদানন্দ রায় মহাশয় “বাংলার পাখী” নামে একটি পুস্তিকা ছেলেদের পাঠ্য হিসাবে মুদ্রিত করেন। বড় ও ছোট সকলের পাঠযোগ্য পুস্তক পাখী সম্বন্ধে আর কেহ রচনা করেন নাই।
আজ আমাদের দেশ স্বাধীন হইয়াছে এবং এ দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত করিতে হইবে। ইউরোপীয় জাতিদের অপরিসীম হিংসাত্মক ও লোভী মনোবৃত্তি তাহাদের তথাকথিত সভ্যতাকে শ্বাপদচরিত্রের রূপ দান করিয়াছে। সেইজন্য তাহারা মারণাস্ত্রের অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে সুপটু। যে জাতি তাহাদেরই মত অস্ত্রবলে বলীয়ান ও সামরিক বৃত্তিতে নিপুণ নহে, অধুনা জগতে সে জাতির স্বাধীন অস্তিত্বের কোনও মূল্য নাই। এশিয়া ভূখণ্ডের একমাত্র জাপানীরা শিক্ষাদ্বারা সামরিকবুদ্ধি প্রখর করিয়া তুলিয়াছিল।
ভারতবর্ষে আজ সামরিক, নাবিক ও অন্যান্য বিভাগে বহু সুদক্ষ লোকের প্রয়োজন হইবে; কিন্তু আমাদের ছেলেদের মধ্যে পর্য্যবেক্ষণ শক্তি যদি বৃদ্ধি না করা যায় তবে এই সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব হইবে। ইংরাজ এদেশে থাকিতে গত ত্রিশ বৎসরে শিক্ষাপদ্ধতিকে এমন একটা রূপ দান করিয়া গিয়াছে যে আমাদের ছেলেদের মধ্যে চপলতা বৃদ্ধি পাইয়াছে, চিন্তার গভীরতা হ্রাস পাইয়াছে। কেননা, বিদ্যালয়েও শিক্ষায়তনে শিক্ষার ভড়ংকে প্রাধান্য বেশী দেওয়া হইয়াছিল।
“নেচার ষ্টাডি” বা প্রকৃতি-পরিচয় এদেশের প্রত্যেক স্কুলের পাঠ্য মধ্যে স্থান পায়। কিন্তু এই দরিদ্র দেশে সহজে, অল্প খরচে অথচ যথেষ্ট আনন্দবর্দ্ধকভাবে প্রকৃতি-পরিচয় শিক্ষালাভের চেষ্টা নাই। পক্ষী পর্য্যবেক্ষণ যদি প্রতি বিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকায় স্থান পায় তবে, অল্প খরচে প্রত্যেক স্কুলেই ছেলেরা শুধু যে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তিতে শিক্ষিত হইতে পারে তাহা নহে, তাহাদের চিত্তের স্থৈর্য্য, চিন্তা করার শক্তি ও দৃষ্টির গভীরতা বৃদ্ধি পাইতে পারে।
অবশ্য এজন্য শিক্ষকদের শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। তজ্জন্য তাহাদিগকে জুওলজীতে ওস্তাদ হইতে হইবে না। বাংলা দেশে কৌতুহলী শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের জন্য পক্ষিতত্ত্ব সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক আতিশয্যবর্জ্জিত বই পাখী সম্বন্ধে নাই। এই পুস্তকটি সেই অভাব পূরণের একটা প্রয়াস মাত্র।
পাখীর শ্রেণীবিভাগের কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি। সাধারণভাবে যদি আমরা পাখীর শ্রেণীবিভাগ করিতে যাই তাহা হইলে হয়তো নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করিতে চেষ্টা করিব—
(১) মাঠের পাখী: এর মধ্যে আমরা সাদা বক, ফিঙ্গে, হুপো, নীলকণ্ঠ প্রভৃতি দেখিতে পাই। শালিক, কাককেও মাঠে দেখা যায়। গ্রামদেশে দাঁড়কাককে তো প্রায়ই দেখা যায়।
(২) গাছের পাখী: বসন্ত বাউরী, হলদে পাখী, হাঁড়িচাচা, কোকিল প্রভৃতি গাছে গাছেই থাকে। সুতরাং এদের গাছের পাখী বলিতে দোষ কি?
(৩) জলের পাখী: হাঁস, ডাহুক, জলপিপি, ডুবুরী, মাছরাঙা, খঞ্জন, কাদাখোঁচা এদের জলের উপর বা পাশেই দেখা যায়।
(৪) ঘরের পাখী: চড়ুই, কাক, পায়রা, দোয়েল, বুলবুল, শালিক—এরা আমাদের ঘরের আশে পাশে ঘুরিয়া বেড়ায় সুতরাং ঘরের পাখী বলিতে আপত্তি কেন হইবে?
(৫) শিকারী পাখী: বাজ, চিল, পেচক—প্রভৃতি আমিষভোজী পাখীকে শিকারী পাখী বলা যাইতে পারে।
কিন্তু এরূপ শ্রেণীবিভাগ কি খুব সঙ্গত হইবে? ধরুন, বুলবুল ও দোয়েল—এদের ঘরের পাখীও বলিতে পারি আবার বনের পাখীও বলিতে পারি। শালিক, ঘুঘু, কাক এদের ঘরের পাখী, বনের পাখী, মাঠের পাখী, তিনটাই বলা চলে। খঞ্জন জলের ধারের পাখী, মাঠেও চরে আবার আমাদের গৃহপ্রাঙ্গনেও আসিয়া বেশ হৃষ্টমনে চলাফেরা করে।
সুতরাং এই শ্রেণীবিভাগদ্বারা পাখীদের ঠিক কুলের পরিচয় পাওয়া যায় না। ছোট ছেলেদের শিক্ষাদান কালে অবশ্য এইরূপ একটা শ্রেণীবিভাগ করিয়া তাহাদের ঔৎসুক্য ও কৌতুহল জাগ্রত করিতে পারি। কিন্তু বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ করিতে হইলে আরও গভীরতর পার্থক্যগুলি বা শ্রেণীবিভাগের মূলসূত্রগুলির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করিতে হইবে।
এই পুস্তকে আপাতঃ দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন হইলেও কয়েকটি পাখীকে একই বংশের বলিয়া দুই এক স্থানে উল্লেখ করা হইয়াছে।
কাণাকূয়া পাখী দেখিতে বেশ বড় একটা দাঁড়কাকের আয়তনের। অনেকে একে কাকের গোত্রসম্ভূত বলিতে কুষ্ঠাবোধ করিবেন না। অথচ আমি ইহাকে কোকিলের মধ্যে স্থান দিয়াছি।
হাঁড়িচাচার বর্ণবৈচিত্র্য ও দীর্ঘ পুচ্ছ হইতে কে ইহাকে বায়সের জ্ঞাতি বলিয়া সন্দেহ করিবে? অথচ বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিভাগে —উভয়েই এক বংশের।
৺জগদানন্দ রায় মহাশয়ের যে পুস্তকের নাম করিয়াছি তাহাতে তিনি এ দেশে দুই রকমের কাঠঠোকরা আছে বলিয়া হুপোর নাম করিয়াছেন ও তাহার ছবি দিয়াছেন। বৈজ্ঞানিকের কাছে কিন্তু ইহারা বিভিন্ন পাখী।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিভাগের জন্য শরীরগঠনের উপর অধিকতর নির্ভর করেন। সুতরাং চোখে দেখিয়া কোনও পাখীর শ্রেণীবিচার করিতে হইলে, সূক্ষ্মদৃষ্টির প্রয়োজন হয়। এই কঠোর বিষয়টির এই পুস্তকে অবতারণা করিবার প্রয়োজন নাই। শ্রেণীবিভাগের মত জটীল বিষয় ছাড়িয়া দিলেও বিহঙ্গ জীবনের এমন কতকগুলি দিক আছে—যাহা অতীব রহস্যময়।
পাখী ওড়ে কি করিয়া? পাখী গান গায় কি জন্য? পাখীর বর্ণবৈচিত্র্য কি প্রকৃতির খেয়াল মাত্র? পাখীর প্রকৃতি কি সহজাত না শিক্ষানবিশীসাপেক্ষ? পাখীর দাম্পত্যজীবন কোন রীতি বা নীতি মানিয়া চলে? ইহারা কি প্রতি বৎসর নিজ নিজ সঙ্গী বা সঙ্গিনী গ্রহণ করে না,এক একজোড়া স্ত্রীপুরুষ সারাজীবনের জন্য মিলিত হয়? পাখীরা ঘুমায় কি করিয়া? গাছের ডালে বসিয়া যে সব পাখী নিদ্রা যায় তাহারা পড়িয়া যায় না কেন? শিশু ও বালকবালিকার কৌতুহলী মনে এই সব প্রশ্ন তুলিয়া তাহার সমাধান করিবার চেষ্টা করিলে তাহাদের শুধু যে আনন্দ দান করা হইবে তাহা নহে, তাহাদের চিত্তকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণক্ষম করিয়া তোলা যাইতে পারে।
উক্ত বহু প্রকারের সমস্যা ছাড়িয়া দিলেও—পাখীর জীবনের বিচিত্রতম ব্যাপার তাহার যাযাবরত্ব। সে এক ঋতুতে এক দেশে আসিয়া খায় দায়, গান করে আবার অন্য ঋতুতে কোনও কোনও পাখী ৩।৪ হাজার মাইল দূর দেশে যাইয়া বাসা রচনা করিয়া সন্তান উৎপাদন করে। ইহা বিহঙ্গ জীবনের আশ্চর্য্যতম ব্যাপার। মার্কিন দেশে পাখীর যাযাবরত্ব সম্বন্ধে গবেষণা ও পর্য্যবেক্ষণ যথেষ্ট হইয়াছে। ভারতবর্ষের পাখী সম্বন্ধে সামান্যই জ্ঞান আমাদের আছে।
মার্কিন দেশে জ্ঞানস্পৃহা অত্যন্ত তীব্র। এই নবীন জাতি নানা দিকে নিজেকে সমৃদ্ধ করিতে তৎপর, যাহার ফলে আজ সে বিশ্ব সাম্রাজ্য দাবী করিবার যোগ্যতা লাভ করিয়াছে। পাখীর যাবাবর জীবনের সম্যক গবেষণা ইহাদের মধ্যে হওয়ার আর একটা কারণ আছে। ইউরোপীয় দেশের অধিবাসী হইতেই আজ মার্কিনজাতি উদ্ভূত। ইউরোপীয়গণ কর্ত্তৃক মার্কিন আবিষ্কারের মূলে রহিয়াছে যাযাবর পাখী।
জগদ্বিখ্যাত পোত-পরিচালক কলাম্বস অঙ্ক কষিয়া ইউরোপের পশ্চিমে সমুদ্রপারে এক মহাদেশ আছে স্থির করিয়াছিলেন। বহুকষ্টে জাহাজ জোগাড় করিয়া তো তিনি অসীম সমুদ্রে ভাসিলেন। কিন্তু কিছুকাল পরে তাঁর অধীন নাবিক মাঝিমাল্লারা ঠিক করিল যে এই উন্মাদের পাল্লায় পড়িয়া তাদের মৃত্যুবরণ করিতে হইবে। তাহারা অনুনয় বিনয় করিল। বলিল—“দেশে ফিরিয়া চল—নহিলে এই অকূল সমুদ্রে স্রেফ প্রাণটাই হারাইব।” কলাম্বস তাহাদের ধৈর্য্য-ধারণ করিতে বলিলেন। কিন্তু মাসাবধি যাহারা জল ছাড়া কিছু দেখিতে পায় নাই—জাহাজের সঙ্কীর্ণ পরিসরের মধ্যে যারা বন্দী—টাট্কা আহারের অভাবে যারা ব্যাধিগ্রস্ত—তাহারা শুনিবে কেন? সুতরাং তাহারা ষড়যন্ত্র করিল কলাম্বসকে বন্দী অথবা প্রয়োজন হইলে হত্যা করিতে হইবে। এই সময় এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হইল কতকগুলি পাখীর আবির্ভাবে। পাখীগুলি জলচর নহে তাহা সকলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারিল। তাহাদের দেখিয়া নাবিকদের মনে আশা হইল যে শ্যামলতৃণশষ্পশোভিত ধরিত্রী নিশ্চয়ই সন্নিকটে। পোতাধ্যক্ষ তবে উন্মাদ নহে। তাহারা আবার আশায় উৎফুল্ল হইল। মার্কিন দেশের ইতিহাসলেখক ফ্র্যাঙ্ক চ্যাপম্যান বলেন যে, পাখীর সাহায্য না হইলে কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করা হইত না। আবার কলাম্বস আমেরিকা মহাদেশে যে পদার্পণ করিতে পারেন নাই, পশ্চিম দ্বীপপুঞ্জে যাইয়া উপস্থিত হইলেন,তাহাও পাখীদের জন্যই। প্রথম কয়েকদিন কতকগুলি পাখী জাহাজের মাস্তুলে ও পালের দড়িতে সকাল বেলা আসিয়া বসিত ও তাহাদের সঙ্গীতে জাহাজের মাঝিমাল্লাদের প্রাণে আনন্দসঞ্চার করিত। সন্ধ্যাবেলা তাহারা উড়িয়া চলিয়া যাইত। ধরিত্রীর দর্শন পাইবার তিন সপ্তাহ পূর্ব্বে পাখীরা উত্তর হইতে আসিত ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রয়াণ করিত। কলাম্বসের জাহাজ পশ্চিম মুখেই চালিত হইতেছিল। সহসা তাহার মনে হইল যে পাখীদের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থান নিশ্চয়ই আছে এবং পাখীরা যেদিকে যাইতেছে সেই দিকে গেলে ডাঙ্গা সুনিশ্চিত পাওয়া যাইবে। সুতরাং পাখীদের তিনি পাইলট বা জাহাজের দিগদর্শক হিসাবে গণ্য করিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে জাহাজ চালাইলেন এবং সাতদিন পরই তিনি এই বিধাতৃদত্ত পাইলটের সাহায্যে ডাঙ্গায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যদি তিনি সোজা পশ্চিম দিকেই চলিতেন তবে মেক্সিকোর ভূমিতে উপস্থিত হইতে পারিতেন।
চ্যাপম্যান সাহেব বলেন যে কতকগুলি পাখীর দক্ষিণাপথ যাত্রায় বেরমুডা দ্বীপপুঞ্জ হইতেছে একটা “ষ্টেশন” বা বিশ্রাম স্থান। এইসব পাখী মেক্সিকো উপসাগরে আসিয়া দক্ষিণপশ্চিমে বাহামা দ্বীপপুঞ্জ হইয়া তারপর আরও দক্ষিণে যায়। তাহাদের যাত্রাপথে কলম্বাসের জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হওয়ায় এই পাখীদের অনুসরণ করিয়া কলাম্বস বাহামা দ্বীপপুঞ্জে আসিয়া উপস্থিত হন। তিনি পালোস শহর হইতে ২৬শে সেপ্টেম্বর রওনা হইয়াছিলেন কিন্তু তিনি যদি আর দশদিন দেরি করিয়া রওনা হইতেন তবে আর পাখীর দর্শন পাইতেন না। কেননা তৎপূর্ব্বেই পাখীর শেষ ঝাঁক পার হইয়া চলিয়া যাইত এবং সেরূপ হইলে কলম্বাস নাবিকদের বিদ্রোহ থামাইতে পারিতেন না। ফলে হয়তো আমেরিকা আবিষ্কৃত হইত না—পৃথিবীর ইতিহাসও অন্যরূপ হইত।
কলাম্বস পাখীর সাহায্য লাভ করিয়া সার্থকতা লাভ করিলেন ও পৃথিবীর ইতিহাসের এক নূতন অধ্যায় রচনার ভিত্তি সৃষ্টি করিয়া দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর এক অধ্যায়ে একটি বিরাট ব্যর্থতা নিবারিত হইতে পারিত যদি দূরদেশগামী যাযাবর পাখীর চরিত্র অনুধাবণ করা হইত। নেপোলিয়ন যখন রুশ অভিযানে চলিয়াছেন, তখন শীতের প্রারম্ভে তিনি পোল্যাণ্ডে উপস্থিত হন। সেই সময় উত্তরাপথ ও সাইবেরিয়া হইতে বহু বিহঙ্গ পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের অভিযানে চলিয়াছে। নেপোলিয়নের কয়েকজন সহকর্ম্মী এই বিষয়ের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া নিদারুণ শীতের আগমন সম্বন্ধে সচেতন করেন। কিন্তু পাখীদের এই স্পষ্ট ইঙ্গিত অবহেলা করায় শুধু শীতের দ্বারাই পরাজিত হইয়া তাহাকে ফিরিতে হয়।ইউরোপের ইতিহাসেও নূতন অধ্যায় আরম্ভ হয়।
বহুপূর্বে কবি কালিদাসও কতকগুলি পাখীর যাযাবর-ধর্ম্ম লক্ষ্য করেন। রাজহংসের দেশভ্রমণ সম্বন্ধে তাঁহার কৌতুহল এতখানি উদ্দীপিত হইয়াছিল যে এই রাজহংস কোন পথে দুর্লঙ্ঘ্য হিমালয় পর্ব্বতমালা অতিক্রম করিয়া ভারতবর্ষে আগমন করে তাহার সন্ধান তিনি লইয়াছিলেন।
যদি আমরা আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে পক্ষিজীবনের আলোচনা আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত করিতে পারি তবে স্থানীয় পাখীর গমনাগমন যাতায়াতের পর্য্যবেক্ষণের চেষ্টার ফলে হয়তো এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহশীল কতকগুলি ব্যক্তির উদ্ভব হইবে এবং ভারতের পাখীদেরও গতিবিধি সম্বন্ধে বহু তথ্য আবিষ্কৃত হইবে।
যাযাবর পাখীরা শীতকালে এক দেশে থাকে এবং গ্রীষ্মকালে সে স্থান ছাড়িয়া বহুদূরদেশে গমন করে। এই যাতায়াত এক বিরাট প্রহেলিকা। এই পুস্তকে দুই একটি যাযাবর পাখী স্থান পাইয়াছে। উহাদের ছাড়া হংস, কাদাখোঁচা, মুনিয়া প্রভৃতি পাখীও শীতকালেই এদেশে আসে। এদেশে ও অন্য দেশেও পাখীদের গতিবিধি উত্তর দক্ষিণে হয়। তবে পূর্ব্ব-পশ্চিমে যাতায়াতও কোনও কোনও পাখী করে। নিউজীল্যাণ্ডে এক প্রকার দীর্ঘপুচ্ছ কটা রঙের কোকিল আছে যারা সেখান হইতে ফিজি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চলিয়া যায়।
অনেকগুলি পাখী দুই তিন হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে। দীর্ঘপাদ, দীর্ঘগ্রীব ফ্লামিঙ্গো পাখী সুদূর সাইবেরিয়া হইতে দক্ষিণ আফ্রিকায় যায়। পথে অবশ্য থামিতে থামিতে যায়। ভারতবর্ষেও ইহারা কিঞ্চিৎকাল অবস্থান করে। আমেরিকার স্বর্ণটিটিট্টিভও আলাস্কা হইতে হাওয়াই দ্বীপে দুইহাজার মাইল পথ একটানা উড়িয়া হাজির হয়।
একই প্রকারের পাখী একই সঙ্গে যাত্রা করে না। দলে দলে এরা রওনা হয়, কেহ আগে, কেহ পরে। এই দলগুলি সব সময় পারিবারিক দল হয় না। বিভিন্ন পরিবার একত্র হইয়া চলে। সব সময় যে জনকজননী পুত্রকন্যাদের সঙ্গে লইয়া আসে তাহাও নহে।
যাযাবর পাখীদের অনেকে রাত্রেই ভ্রমণ করে, দিনের বেলা ভূমিতে অবতরণ করিয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করে এবং বিশ্রাম করিয়া লয়। কতকগুলি আবার দিনেও ভ্রমণ করে। হাঁসকে রাত্রেই উড়িয়া যাইতে শোনা যায়। কতকগুলি পাখী রাত্রে উড়িয়া চলিবার সময় কণ্ঠধ্বনি করিতে করিতে চলে। বিহার প্রদেশে বাসকালে বহু রাত্রে হংসের কলকণ্ঠধ্বনি শয্যায় শায়িত অবস্থায় গভীর রাত্রে শ্রবণ করিয়া নিদ্রার আবেশে মনে হইয়াছে যেন কোনও স্বপ্নপুরী হইতে নৃত্যপরায়ণা অপ্সরীর নুপুরশিঞ্জিনী কানে ভাসিয়া আসিতেছে।
আর একটা কৌতুককর ব্যাপার এই যে বারবার পাখী একই স্থানে ফিরিয়া আসিয়া থাকে। আপনার ঘরের পাশে যে খঞ্জনদম্পতি সহসা আবির্ভূত হইয়া পুচ্ছনৃত্যে আপনাকে অভিবাদন করে, সে পূর্ব্ববৎসরও সেইখানেই হয়তো আসিয়াছিল—আবার পরবৎসরও আসিবে।
ফ্লামিঙ্গো পাখীকে দিনের বেলা পথ চলিতে দেখিয়াছি। একদিন সকাল আন্দাজ ৮টার সময় ওয়াল্টেয়ারে সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইয়া দেখি এক ঝাঁক ফ্লামিঙ্গো বলাকার মত সমুদ্রজলের ১০।১২ হাত উপর দিয়া দক্ষিণদিকে উড়িয়া চলিয়াছে। তীর হইতে তাহারা অর্দ্ধমাইল মাত্র দূরে ছিল। তাহারা সোজা সমুদ্রের উপর দিয়া উড়িয়া গেল। তীরের দিকে আসিতে দেখিলাম না।
মুনিয়া পাখীদের ঝাঁক আমি দিনের বেলাতেই লক্ষ্য করিয়াছি। মনুষ্যদৃষ্টি এড়াইয়া আকাশ পথে অতি উচ্চে খুব কম পাখীই যায়। এইরূপ ভ্রমণের সময় খুব বেশী দ্রুতগতিতে ইহারা চলে না। স্বাভাবিক উড়িবার গতিবেগই যথেষ্ট বলিয়া ইহারা মনে করে। ছোট ছোট গায়ক পাখীরা ঘণ্টায় কুড়ি মাইল বেগে সাধারণতঃ চলে। বড় পাখীরা ঘণ্টায় ৪০ মাইল পর্যন্ত চলিয়া থাকে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে হংস জাতীয় পাখীরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে গমন করে। কেবল পারাবতই একটু বেশী বেগে চলে, বিশেষ করিয়া “হোমিং” পারাবত—যাহাদিগকে সংবাদ আদান প্রদানে আজও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। গত মহাযুদ্ধের সময় বর্ম্মাপ্রান্তে লড়াইয়ের সময় পথভ্রষ্ট দুই একটি এরূপ পারাবতকে কেহ কেহ কলিকাতায় নিজগৃহে দেখিতে পাইয়াছিলেন।
বৈজ্ঞানিকের নীরস গবেষণা ছাড়িয়া দিলেও, পক্ষিজীবনের বিবিধ রহস্য সম্বন্ধে পর্য্যালোচনা শুধু যে আনন্দ বর্দ্ধন করে তাহা নহে, অবিকশিত চিত্তের রুদ্ধদুয়ারের ফাঁক দিয়া কিছু আলোকের রশ্মিপাত করিয়া মনের মণিকোঠার অন্ধকারও দূর করিতে পারে। যদি বাঙ্গলার ছাত্র ও অভিভাবকদের অল্প কয়েকজনের মনেও এই বিষয় কৌতুহল সঞ্চারিত হয়—তাহা হইলেই এ পুস্তিকা প্রকাশ সার্থক হইবে। এই পুস্তকে বর্ণিত পাখীদের এক এক জিলায় এক এক প্রকার চল্তি নাম আছে। ঐ সকল সংগ্রহ করিতে পারি নাই। সুরসিক পাঠক যদি আমাকে লিখিয়া জানান—ভবিষ্যত সংস্করণে তাহা স্বীকৃত হইবে।