বাঙ্গলা ব্যাকরণ/বর্ণজ্ঞান

বাঙ্গলা ব্যাকরণ।

যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকিলে, বাঙ্গলা ভাষা শুদ্ধ করিয়া লিখিতে ও কহিতে পারা যায়, তাহাকে বাঙ্গলা ব্যাকরণ কহে।

 বর্ণজ্ঞান, প্রকৃতি ও প্রত্যয় দ্বারা শব্দসাধন, পদপদার্থজ্ঞান এবং তদ্দ্বারা ভাষাবিজ্ঞানই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য।

 বাঙ্গলা ব্যাকরণ ছয় ভাগে বিভক্ত। যথা; বর্ণবিনির্ণয়, সন্ধি, শব্দ প্রকরণ, ধাতুপ্রকরণ, সমাস ও পদবিন্যাস প্রকরণ।


বর্ণ বিনির্ণয়।

 অ আ ক খ ইত্যাদি এক একটিকে বর্ণ কহে। সংপ্রতি বাঙ্গলা ভাষায় সমুদায়ে আটচল্লিশটি বর্ণ আছে। তন্মধ্যে বারটি স্বর ও ছত্রিশটি ব্যঞ্জন।

 যে সমুদায় বর্ণ স্বয়ং উচ্চারিত হইতে পারে, তাহাদিগকে স্বর বলে। যথা; অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯ এ ঐ ও ঔ।

 স্বর দ্বিবিধ; হ্রস্ব ও দীর্ঘ[১]। অ ই উ ঋ ৯ এই পাঁচটিকে হ্রস্ব স্বর বলে। তার আ ঈ ঊ এ ঐ ও ঔ এই সাতটিকে দীর্ঘ স্বর বলে। বঙ্গভাষায় ৠ ও ৡকারের ব্যবহার নাই। হ্রস্বের উচ্চারণ অপেক্ষা দীর্ঘের উচ্চারণে অধিক সময় লাগে। যথা; ই—, ঈ—

 অ আ ই ঈ, উ ঊ, ইহারা দুই দুইটি পরস্পর সমান স্বর; হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদ মাত্র।

 স্বরবর্ণ সকল বাঞ্জন বর্ণে যুক্ত হইলে তাহার অন্য আকৃতি হয়। যথা;

শুদ্ধস্বর
যুক্তস্বর




ি










 পূর্ব্বে বা পরে স্বরবর্ণ না থাকিলে ব্যঞ্জন বর্ণ উচ্চারিত হইতে পারে না। বাঙ্গলা বর্ণমালা পাঠ কালে প্রায় সকল ব্যঞ্জন বর্ণেই অকার যুক্ত থাকে। ব্যঞ্জন বর্ণ, যথা;— ক খ গ ঘ ঙ। চ ছ জ ঝ ঞ। ট ঠ ড (ড়) ঢ (ঢ়) ণ। ত থ দ ধ ন। প ফ ব ভ ম। য (য়) র ল ব। শ ষ স হ। ং ঃ ঁএই ছত্রিশটি বাঞ্জন বর্ণ[২]

 তন্মধ্যে ক অবধি ম পর্য্যন্ত স্পর্শ বর্ণ। য, র, ল, ব এই চারিটি অন্তঃস্থ বর্ণ। শ, ষ, স, হ এই চারিটি উষ্মবর্ণ। অনুস্বার ও বিসর্গ অযোগবাহ বর্ণ এবং চন্দ্রবিন্দু অনুনাসিক বর্ণ।

 স্পর্শবর্ণ সমুদয় পাঁচ বর্গে বিভক্ত। যথা: কবর্গ, চবর্গ, টবর্গ, তবর্গ ও পবর্গ। বর্গের বর্ণকে বগীয় বা বর্গ্য কহে।

উচ্চারণস্থান বিশেষে বর্ণের

বিশেষ বিশেষ নাম।

 অ আ হ ইহাদিগের উচ্চারণস্থান কণ্ঠ, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে কণ্ঠ্য বর্ণ কহে।

 ক খ গ ঘ ঙ ইহাদিগের উচ্চারণ স্থান জিহ্বামূল, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে জিহ্বামূলীয় কহে।

 ই ঈ চ ছ জ ঝ ঞ য শ ইহাদিগের উচ্চারণস্থান তালু, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে তালব্য কছে।

 ঋ ট ঠ ড ঢ ণ র ষ ইহাদিগের উচারণস্থান মূর্দ্ধা, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে মূর্দ্ধন্য কহে।

 ৯ ত থ দ ধ ন ল স ইহাদিগের উচ্চারণ স্থান দন্ত, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে দন্ত্য বলে।

 উ ঊ প ফ ব ভ ম ইহাদিগের উচ্চারণস্থান ওষ্ঠ, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে ওষ্ঠ্য বলে।

 ঐ ঐ ইহাদের উচ্চারণস্থান কণ্ঠ ও তালু, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে কণ্ঠ্যতালব্য বলে।

 ও ঔ ইহাদিগের উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ ও ওষ্ঠ, এই নিমিত্ত ইহাদিগকে কণ্ঠ্যৌষ্ঠ্য বলে।

 ব (অন্তঃস্থ) ইহার উচ্চারণস্থান দন্ত ও ওষ্ঠ, এই নিমিত্ত ইহাকে দন্ত্যৌষ্ঠ্য বলে।

 নাসিকা হইতে উচ্চারিত হয় বলিয়া, অনুস্বার ও চন্দ্রবিন্দুকে অনুনাসিক বলে। ঐরূপ ঙ ঞ ণ ন ম ইহারাও নাসিকা হইতে উচ্চারিত হয় বলিয়া ইহাদিগকে অনুনাসিকও বলে।

 বিসর্গ স্বরাশ্রিত; পূর্ব্ববর্তী স্বরের উচ্চারণস্থানই বিসর্গের উচ্চারণ স্থান। যথা; যশঃ, হবিঃ, বিষ্ণুঃ ইত্যাদি স্থলে বিসর্গ অ, ই, উ, এই কয় স্বরের পরবর্ত্তী হওয়াতে কণ্ঠ্য, তালব্য, ওষ্ঠ্য বলিয়া উক্ত হয়।

 ব্যঞ্জনবর্ণে অকার যুক্ত হইলে তাহার রূপের পরিবর্ত্ত হয় না। যথা; ক্-অ ক, চ্-অ চ, প্-অ প। কিন্তু অন্যান্য স্বরসংযোগে তাহার আকারের কিছু কিছু বৈলক্ষণ্য হয়। যথা; ক্-ই কি, ছ্-আ ছা, ফ্-উ ফু। যে ব্যঞ্জনে কোন মাত্র স্বর সংযোগ নাই, তাহার নীচে এই ্ চিহ্ন দেওয়া থাকে। ঐরূপ বর্ণকে হসন্ত বর্ণ বলে। যথা; ক্, খ্, ম্।

 মধ্যে স্বরবর্ণ না থাকিলে দুই অথবা তিন ব্যঞ্জন বর্ণ পরস্পর যুক্ত হইয়া যায়। এইরূপ অক্ষরকে যুক্তাক্ষর কছে। যুক্তাক্ষরে পূর্ব্ব বর্ণ উপরিস্থ ও পরবর্ণ নিম্নস্থ হইয়া থাকে। যথা; ক্-র ক্র, ব্-জ ব্জ। স্বর ব্যবধানে যথা; ক্ অ-র কর, জ্-অ-ন জন।

 ব্যঞ্জন বর্ণ পরস্পর সংযুক্ত হইলে কোন কোন স্থলে তাহার আকারের বৈলক্ষণ্য হইয়া থাকে। যথা; জ্-ঞ জ্ঞ, ক্-ত ক্ত।

 র কোন ব্যঞ্জন বর্ণের উপরিস্থ হইয়া যুক্ত হইলে এই আকার (অর্থাৎ রেফ) হইয়া যায়। এবং তাহার নিম্নস্থ কোন কোন বর্ণের দ্বিত্ব হয়। চ, ছ, জ, ত, থ, দ, ধ, ব, ম, য, ইহদিগেরই প্রায় দ্বিত্ব হইয়া থাকে। আর ছ, থ, ধ এই তিন বর্ণের দ্বিত্ব করিলে চ্ছ ত্থ দ্ধ হয়।

 ই, উ, ঋ, ৯ স্থানে যথাক্রমে এ, ও, অর্ অল্ আদেশকে গুণ কহে।

 অ, ই, উ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ স্থানে যথাক্রমে আ, ঐ, ঔ, আর্, ঐ, ঐ, ঔ, ঔ আদেশকে বৃদ্ধি কহে।[৩]


  1. হ্রস্ব দীর্ঘ ভিন্ন এক প্রকার প্লুত স্বর আছে। দূর হইতে আহ্বান, গান ও রোদন স্থলে উহার ব্যবহার হু স্থা থাকে।
  2. ড, ঢ য যদি শব্দের প্রথমাক্ষর কিম্বা অন্য বর্ণের সহিত সংযুক্ত না হয়, তবে উহারা ড় ঢ় য় বলিয়া উচ্চারিত হয়। যথা; জড়, দৃঢ়, নয়ন। অন্যত্র যথা; ডমরু, ঢক্কা, যখন, জাড্য, ন্যায্য ইত্যাদি। কিন্তু গ, জ ও ব সংযুক্ত ড প্রায়ই ড় বলিয়া উচ্চারিত হয়। যথা; খড়গ, ষড়্‌জ, ষড়্বিংশতি ইত্যাদি। আর য, পদের মধ্যে থাকিলেও কোন কোন স্থলে য় বলিয়া পঠিত হয় না। যথা; সরযূ, সংযোগ, উপযোগ ইত্যাদি।
  3. গুণ ও বৃদ্ধির লক্ষণে যে যে হ্রস্ব স্বর আছে, তাহার দীর্ঘের প্রতিও ঐ নিয়ম।