বাঙ্গলা ব্যাকরণ/রস
রস।
কোন বর্ণনা শ্রবণে বা পাঠে অথবা নাটকাদি দর্শনে মনে যে স্থিরতর অপূর্ব্ব ভাবোদয় হয়, ঐ স্থায়িভাবের নাম রস। রস নয় প্রকার। যথা; শৃঙ্গার (আদি), বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র ও শান্ত।
আদিরস।—নায়ক নায়িকার অনুরাগ বিষয়ক ভাবকে আদিরস বলে। আদিরস দ্বিবিধ; সম্ভোগ ও বিপ্রলম্ভ। নায়ক নায়িকার পরস্পর সম্মিলন স্থলে সম্ভোগ এবং পূর্ব্বরাগ মান প্রবাসাদি স্থলে বিপ্রলম্ভ ঘটিয়া থাকে। ক্রমশঃ উদাহরণ। সম্ভোগ যথা; “নারীর পরশ পেয়ে নিদ্রা হৈল ভঙ্গ। সিহরিল কলেবর মাতিল অনঙ্গ”॥ বিপ্রলম্ভ যথা; “কিবা রূপ কিবা গুণ কহিলেক ভাট। খুলিল মনের দ্বার না লাগে কপাট॥” ইত্যাদি।
বীররস।—দয়া ধর্ম্ম দান ও সংগ্রামাদিতে উৎসাহ বিষয়ক ভাবের নাম বীররস। যথা; “তোরে রাজা বধে যদি, রুধিরে বহাব নদী, বীরসিংহে সবংশে বধিয়া। তোরে পুনঃ বাঁচাইয়া, বিদ্যা দিব রাজ্য দিয়া, ভয় কিরে বিদ্যা-বিনোদিয়া।”
করুণরস।—ইষ্টনাশে বা অপ্রিয় সমাগমে যে শোক সঞ্চার হয়, তাহার নাম করুণরস। যথা; “হৃদয়বৃন্তে ফুটে যে কুসুম, তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয় ডোবে শোকসাগরে, মৃণাল যথা জলে, যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”
অদ্ভূতরস।—আশ্চর্য্য বিষয় দর্শনাদি জন্য যে বিস্ময়াত্মক ভাবের উদয় হয়, তাহাকে অদ্ভুতস বলে। যথা; “একিলো একিলো, একি কি দেখিলো, এ চাহে উহার পানে। দেব কি দানব, নাগ কি মানব, কেমনে এল এখানে।”
হাস্যরস।—বিকৃত আকার, বাক্য ও চেষ্টা দ্বারা যে রসোদয় হয়, তাহার নাম হাস্য রস। যথা; প্রশ্ন “দেখিতে সুন্দর বর দাদ্ সব গায়,” উত্তর “বিনা চক্রে শালগ্রাম শোভা নাহি পায়?”
ভয়ানক রস।—যাহা হইতে মনে ভয় জন্মে, তাহাকে ভয়ানক রস বলে। যথা; পলাইতে না পেয়ে ফাঁফর হৈলা হর। কহিতে লাগিলা কম্পবান্ কলেবর। তোমরা কে মোরে কহ পাইয়াছি ভয়। কোথা গেল মোর সতী বলহ নিশ্চয়।”
বীভৎস রস।—ঘৃণাজনক ভাবকে বীভৎস রস বলে। যথা; “সে রোগের পাশে বিশালউদর বসে উদর-পরতা; অজীর্ণ ভোজনদ্রব্য উগারি দুর্ম্মতি পুনঃ পুনঃ দুই হস্তে তুলিয়া গিলিছে সুখাদ্য।”
রৌদ্ররস।—ক্রোধজনক রসের নাম রৌদ্র। যথা; “বাজিল তুমুল রণ,—চাহিলা বিস্ময়ে দেব নর দোহা পানে; কাটিলা সৌমিত্রি শরজাল মুহুর্ম্মুহুঃ হুহুঙ্কার রবে! সবিস্ময়ে রক্ষােরাজ কহিলা, ‘বাখানি বীরপনা তোর আমি সৌমিত্রিকেশরি! শক্তিধারাধিক শক্তি ধরিস্ তুই; কিন্তু নাহি রক্ষা—আজি মোর হাতে’।”
শান্তরস—তত্ত্বজ্ঞানাদি জন্য যে শান্ত ভাব, তাহাকে শান্তরস কহে। যথা; তুমি কার কে তোমার করে বলরে আপন। মহামায়া নিদ্রা বশে দেখিছ স্বপন। নানা পক্ষী এক বৃক্ষে, নিশিতে বিহরে সুখে, প্রভাত হইলে তারা দশ দিকে ধায়, তেমতি জানিবে সব, অমাত্য বন্ধু বান্ধব, সময়ে পলাবে সবে কে করে বারণ।