বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/নবম অধ্যায়

নবম অধ্যায়।

লার্ড হেষ্টিংস গবর্ণমেণ্টের ভার গ্রহণ করিয়া দেখিলেন, নেপালীয়েরা ক্রমে ক্রমে ইঙ্গরেজদিগের অধিকৃত দেশ আক্রমণ করিয়া আসিতেছে। সিংহাসনারূঢ় রাজপরিবারেরা, একশত বৎসরের মধ্যে, যুদ্ধ জয় দ্বারা নেপালে আধিপত্য সংস্থাপন করিয়া, ক্রমে ক্রমে রাজ্য বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। লার্ডমিণ্টো বাহাদুরের অধিকার কালে নানা বিবাদ উপস্থিত হইয়াছিল। লার্ড হেষ্টিংস দেখিলেন, নেপালাধিপতির সহিত যুদ্ধ অপরিহার্য হইয়। উঠিয়াছে। তিনি প্রথমতঃ সন্ধিরক্ষার্থে যথোচিত চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু, নেপালেশ্বরের অসহনীয় প্রগল্ভতা দর্শনে, পরিশেষে, ১৮১৪ খৃঃ অব্দে, তাঁহাকে যুদ্ধ আরম্ভ করিতে হইল। প্রথম রণে কোন ফলোদয় হইল না। কিন্তু ১৮১৫ খৃঃ অব্দের যুদ্ধে ইঙ্গরেজদিগের সেনাপতি অক্টরলোনি বাহাদুর সম্পূর্ণ জয় লাভ করিলেন। তখন আপন রাজ্যের এক বৃহৎ অংশ পণদিয়া নেপালাধিপতিকে সন্ধি ক্রয় করিতে হইল।

 ভারতবর্ষের মধ্যভাগে পিণ্ডারী নামে একদল বহুসংখ্যক অশ্বারোহ দস্যু বাস করিত। অনেক বৎসরাবধি ঐ অঞ্চলের সমস্ত দেশ লুঠ করা তাহাদের ব্যবসায় হইয়া উঠিয়াছিল। পরিশেষে তাহারা ইঙ্গরেজদিগের অধিকার মধ্যে প্রবেশ করে। ঐ অঞ্চলের অনেক অনেক রাজা ও সামন্তেরা তাহাদিগের সম্পূর্ণ সহায়তা করিতেন। তাহারা পাঁচ শত ক্রোশের অধিক দেশ ব্যাপিয়া লুঠ করিত। তাহাদিগের নিবারণের নিমিত্ত ইঙ্গরেজদিগকে একদল সৈন্য রাখিতে হইয়াছিল। তাহাতে প্রতিবৎসর যে খরচা পড়িতে লাগিল, তাহা অত্যন্ত গুরুতর বোধ হওয়াতে পরিশেষে ইহাই অতি যুক্তিযুক্ত ও পরামর্শসিদ্ধ বোধ হইল, যে সর্ব্বদা এরূপ করা অপেক্ষা একবার এক মহোদ্যোগ করিয়া তাহাদিগকে নির্ম্মূল করা উচিত।

 অনন্তর লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুর, ডিরেক্টর সমাজের অনুমতি লইয়া, তিন রাজধানী হইতে বহুসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। পরে সংগৃহীত সৈন্য সকল, ক্রমে ক্রমে এই দুর্ব্বৃত্ত দস্যুদিগের বাসস্থান রোধ করিয়া, একে একে তাহাদিগের সকল দলকেই উচ্ছিন্ন করিল।

 ইঙ্গরেজদিগের সেনা পিণ্ডারীদিগের সহিত সংসক্ত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে নিযুক্ত আছে, এমত সময়ে পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ও হোলকার ইহাঁরা সকলে এককালে একপরামর্শ হইয়া এই আশয়ে ইঙ্গরেজদিগের প্রতিকুলবর্ত্তী হইয়া উঠিলেন, যে সকলেই একবিধ যত্ন করিলে ইঙ্গরেজদিগকে ভারতবর্ষ হইতে দুর করিয়া দিতে পারিব। কিন্তু ইহাঁরা সকলেই পরাজিত হইলেন। পেশোয়া ও নাগপুরের রাজা সিংহাসনচ্যুত হইলেন; তাঁহাদের রাজ্যের অধিকাংশ ইঙ্গরেজদিগের অধিকারভক্ত হইল। মারকুইস অব হেষ্টিংস বাহাদুর স্বয়ং এই সমস্ত ব্যাপার নির্ব্বাহ করেন; কিন্তু, দশ বৎসর পূর্ব্বে, এই রূপ যুদ্ধ কার্য্যের নিমিত্ত, মারকুইস অব ওয়েলেসলি ৰাহাদুরের রাজনীতিতে দোষোদ্ঘোষণ করিয়াছিলেন। পূর্ব্বোক্ত ব্যাপার নির্ব্বাহ কালে তাঁহার পয়ষট্টী বৎসর বয়ঃক্রম ছিল; তথাপি, তাদৃশ গুরুতর কার্য্য নির্ব্বাহ বিষয়ে যেরূপ বিবেচনা ও উৎসাহের অবশ্যকতা, তাহা সম্পূর্ণরূপে প্রদর্শন করিয়াছিলেন। পিণ্ডারী ও মহারাষ্ট্ৰীয়দিগের পরাক্রম একবারে লুপ্ত হইল এবং ইঙ্গরেজেরা ভারতবর্ষে সর্ব্বপ্রধান হইয়া উঠিলেন।

 লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুরের অধিকারের পূর্ব্বে প্রজাদিগকে বিদ্যা দান করিবার কোন অনুষ্ঠান হয় নাই। প্রজারা অজ্ঞানকুপে পতিত থাকিলে কোন কালে রাজ্য ভঙ্গের আশঙ্কা থাকে না; এই নিমিত্ত প্রজাদিগকে বিদ্যাদান করা রাজনীতিবিরুদ্ধ বলিয়াই পুর্ব্বে বিবেচিত হইত। কিন্তু লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুর, এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ করিয়া, কহিলেন যে ইঙ্গারেজের প্রজাদিগের মঙ্গলের নিমিত্তই ভারতবর্ষে রাজ্যাধিকার স্থাপন করিমাছেন; অতএব সর্ব্ব প্রযত্নে প্রজার সভ্যতা সম্পাদন করা ইঙ্গরেজদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। অনন্তর, তাঁহার আদেশানুসারে, স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপিত হইতে লাগিল।

 ১৮২৩ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, হেষ্টিংস ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করিলেন। তিনি, নয় বৎসর কাল গুরুতর পরিশ্রম করিয়া, কোম্পানির রাজ্য ও রাজস্বের ভূয়সী বৃদ্ধি ও ঋণ পরিশোধ করেন। ইহার পূর্ব্বে ইঙ্গরেজদিগের ভারতবর্ষীয় সাম্রাজ্যের এমত সমৃদ্ধি কদাপি দৃষ্ট হয় নাই। ধনাগার ধনে পরিপূর্ণ, এবং, সমুদায় ব্যয় সমাধা করিয়াও, বৎসরে প্রায় ছুই কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হইতে লাগিল।

 অতিশয় ক্ষমতাপন্ন রাজমন্ত্রী জর্জ ক্যানিঙ্গ, ভারতবর্ষীয় রাজকার্য্য বিষয়ে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ ছিলেন। লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুর কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে, তিনিই গবর্ণর জেনেরলের পদে অভিষিক্ত হইলেন।

 তাঁহার আসিবার সমুদার উদ্যোগ হুইয়াছে, এমত সময়ে, অন্য এক জন রাজমন্ত্রির মৃত্যু হওঁয়াতে, ইংলণ্ডে এক অতি প্রধান পদ শূন্য হইল এবং ঐ পদে তিনিই নিযুক্ত হইলেন। তখন ডিরেক্টরেরা লার্ড আমহর্ষ্ট বাহাদুরকে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া ভারতবর্ষে প্রেরণ করিলেন। এই মহাশয়, দশ বৎসর পূর্ব্বে, ইংলণ্ডেশ্বরের প্রতিনিধি হইয়া, চীনের রাজধানী পেকিন নগর গমন করিয়াছিলেন। তিনি, ১৮২৩ খৃঃ অব্দের ১লা আগষ্ট, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হয়েন। লার্ড হেস্টিংস বাহাদুরের প্রস্থান অবধি লার্ড আমহর্ষ্ট বাহাদুরের উপস্থিতি পর্য্যন্ত, কয়েক মাস কৌন্সিলের প্রধান মেম্বর জান আদম সাহেব গবর্ণর জেনেরলের কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন। তাঁহার অধিকার কালে, বিশেষ কার্য্যের মধ্যে, কেবল মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতার উচ্ছেদ হইয়াছিল।

 লার্ড আমহর্ষ্ট বাহাদুর কলিকাতায় পহুছিয়া দেখিলেন, ব্রহ্মদেশীয়েরা অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছে; অতএব অবিলম্বে তৎপ্রতীকারে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। ইঙ্গরেজেরা যে সময়ে বাঙ্গালা অধিকার করেন, ব্রহ্মদেশের তৎকালীন রাজা ও প্রায় সেই সময়েই আবার সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। পরে তিনি মণিপুর ও আসাম অনায়াসে জয় করেন এবং, সেই গর্ব্বে উদ্ধত হইয়া, মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে ক্রমে ক্রমে বাঙ্গালা দেশও জয় করিবেন। তিনি, ইঙ্গরেজদিগের সহিত সন্ধি সত্ত্বেও, তাহা উল্লঙ্ঘন করিয়া, কোম্পানির অধিকারভুক্ত কাচার ও আরাকান দেশে স্বীয় সৈন্য প্রেরণ করেন। আরাকান উপকূলে, টিকনাফ নদীর শিরোভাগে, শাপুরী নামে যে উপদ্বীপ আছে, ব্রহ্মেশ্বর তাহা অক্রমণ করিয়া, তথায় ইঙ্গরেজদিগের যে অল্প রক্ষক ছিল, তাহাদের বিনাশ করেন। আবায় দূত প্রেরণ করিয়া এরূপ অনুষ্ঠানের হেতু জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি অত্যন্ত গর্ব্বিত বাক্যে এই উত্তর দিলেন যে ঐ উপদ্বীপ আমার অধিকারে থাকিবেক; ইহার অন্যথা হইলে আমি বাঙ্গলা আক্রমণ করিব।

 এই সমস্ত অত্যাচার দেখিয়া গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, ১৮২৪ খৃঃ অব্দের ৫ই মে, ব্রহ্মাধিপতির সহিত যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ইঙ্গরেজেরা, ১১ই মে, ব্রহ্মরাজ্যে সৈন্য উত্তীর্ণ করিয়া রাঙ্গুণের বন্দর অধিকার করিলেন। তৎপরেই আসাম, আরাকান, ও মরগুই নামক উপকুল তাঁহাদের হস্তগত হইল। তদনন্তর ইঙ্গরেজ দিগের সেনা ক্রমে ক্রমে আবা রাজধানী অভিমুখে গমন করিল এবং প্রয়াণ কালে, বহুতর গ্রাম নগর অধিকার পূর্ব্বক, ব্রহ্মরাজের সেনাদিগকে পদে পদে পরাজিত করিল। ১৮২৬ খৃঃ অব্দের আরম্ভে, ইঙ্গরেজদিগের সেনা অমরপুরের অত্যন্ত প্রত্যাসন্ন হইলে, রাজা নিজ রাজধানী রক্ষার্থে ইঙ্গরেজদিগের প্রস্তাবিত পণেই সন্ধি করিতে সম্মত হইলেন। অনন্তর এক সন্ধি পত্র প্রস্তুত হইল; ঐ পত্র যান্দাবু সন্ধিপত্র নামে প্রসিদ্ধ আছে। ভদ্দ্বারা ব্রহ্মাধিপতি ইঙ্গরেজদিগকে মণিপুর, আসাম, আরাকান ও সমুদায় মার্ত্তাবান উপকুল প্রদান করিলেন এবং, যুদ্ধের ব্যয় ধরিয়া দিবার নিমিত্ত, এক কোটি টাকা দিতে সম্মত হইলেন।

 যৎকালে ব্রহ্মদেশীয়দিগের সহিত যুদ্ধ হইতেছিল, ঐ সময়ে ভরতপুরের অধিপতি দুর্জ্জনশালের সহিতও বিরোধ উপস্থিত হয়। তিনি, আপন ভ্রাতা মাধু সিংহের সহিত পরামর্শ করিয়া, নিজ পিতৃব্যপুত্ত্র অপ্রাপ্তব্যবহার বলবন্ত সিংহের হস্ত হইতে রাজ্যাধিকার গ্রহণ করিৰার উদ্যম করিয়াছিলেন। সর চার্লস মেটকাফ সাহেৰ দুর্জ্জনশালকে বুঝাইবার জন্য বিস্তর চেষ্টা পাইলেন; কিন্তু কোন ফলোদয় হইল না। তখন স্পষ্ট বোধ হইল, অস্ত্র গ্রহণ ব্যতিরেকে এ বিষয়ের মীমাংসা হইবেক না। বিশেষতঃ, এই স্থান অধিকার করা ইঙ্গরেজের অত্যন্ত আবশ্যক বিবেচনা করিয়াছিলেন। ১৮০৫ খৃঃ অব্দে, ইঙ্গরেজদিগের সেনাপতি লার্ড লেক ঐ স্থান রোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে অধিক সেনা ও সেনাপতির প্রাণ ৰিনাশ হয়। ফলতঃ, ইঙ্গরেজেরা ভারতবর্ষে যত নগর অবরোধ করিয়াছিলেন কুত্রাপিও এমত বিভ্রাট ঘটে নাই। ইঙ্গরেজের এপর্য্যন্ত যত দুর্গ অবরোধ করেন, তন্মধ্যে কেবল ভরতপুরের দুর্গই অধিকার করিতে পারেন নাই। ইহাতে সমুদায় ভারতবর্ষ মধ্যে এই জনরব হইয়াছিল, ইঙ্গরেজেরা এই দুর্গ কখনই অধিকার করিতে পারিবেন না। উহার চতুর্দ্দিকে অতি প্রশস্ত এক মৃন্ময় প্রাচীর এবং ঐ প্রাচীরের গোড়ায় এক বৃহৎ পরিখা ছিল।

 তৎকালে অনেক সৈন্য ব্রহ্মদেশীয় যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিলেও, বিংশতি সহস্র সৈন্য-ও এক শত কামান ভরতপুরের সম্মুখে অবিলম্বে সংগৃহীত হইল। ভারতবর্ষীয় সমুদায় লোক প্রগাঢ় ঔৎসুক্য সহকারে এই ব্যাপার নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ২৩এ ডিসেম্বর যুদ্ধারম্ভ হইল। ১৮২৬ খৃঃ অব্দের ১৮ই জানুয়ারি প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ লার্ড কম্বরমীর বাহাদুর ঐ স্থান অধিকার করিলেন। দুর্জ্জনশাল ইঙ্গরেজদিগের হস্তে পতিত হওয়াতে,তাঁহারা তাঁহাকে এলাহাবাদের দুর্গে প্রেরণ করিলেন।

 ১৮২৭ খৃঃ অব্দে, লার্ড আমহার্ষ্ট বাহাদুর পশ্চিমাঞ্চল যাত্রা করিয়া দিল্লীতে উপস্থিত হইলেন। তথায় বাদশাহের সহিত কোম্পানির ভারতবর্ষীয় সাম্রাজ্য বিষয়ক কথোপকথন উপস্থিত হওয়াতে, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর স্পষ্টরূপে তাঁহাকে কহিলেন, ইঙ্গরেজেরা আর এখন তৈমুরবংশীয়দিগের অধীন নহেন; সিংহাসন এক্ষণে তাঁহাদিগের হইয়াছে। দিল্লীর রাজপরিবারের এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া বিষাদ সমুদ্রে মগ্ন হইলেন। তাঁহারা ভাবিলেন মহারাষ্ট্ৰীয়দিগের নিকট অশেষ প্রকারে অপমানিত হইয়াছিলাম বটে,কিন্তু হিন্দুস্থানের বাদসাহ নাম অন্যথা হয় নাই; এক্ষণে রাজ্যাধিকার চিরকালের নিমিত্ত হস্তবহির্ভূত হইল। ইঙ্গরেজদিগের এই ব্যবহার ভারতবর্ষবাসি সমুদায় লোক অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন।

 লার্ড আমহার্ষ্ট বাহাদুর, উইলিয়ম বটরওয়ার্থ বেলি সাহেবের হস্তে গবর্ণমেণ্টের ভার সমর্পণ করিয়া, ১৮২৮ খৃঃ অব্দের মার্চ্চ মাসে, ইংলণ্ড গমন করিলেন। তাঁহার কর্ম্ম পরিত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত হইলে, লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক উক্ত পদের নিমিত্ত ডিরেক্টরদিগের নিকট আপন প্রার্থনা জানাইলেন। বিংশতি বৎসর পুর্ব্বে তিনি মান্দ্রাজে গবর্ণরের পদে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু, ডিরেক্টরের, কোন কারণ বশতঃ, উদ্ধত হইয়া অন্যায় করিয়া তাঁহাকে পদচ্যুত করেন। এক্ষণে তাঁহারা, উপস্থিত বিষয়ে তাঁহার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিয়া, ১৮২৭ সালে, গবর্ণর জেনেরলের কর্ম্মে নিযুক্ত করিলেন। ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক, যে তৎকালে ইংলণ্ডে এই প্রধান পদের উপযুক্ত তত্তুল্য ব্যক্তি অতি অল্প পাওয়া যাইত।

 লার্ড বেণ্টিক বাহাদুর, ১৮২৮ সালের ৪ঠা জুলাই, কলিকাতায় পহুছিলেন। ছয় বৎসর পূর্ব্বে, লার্ড হেষ্টিংসের অধিকারকালে, ভারতবর্ষের যে ধনাগার ধনে পরিপূর্ণ ছিল, ঐ সময়ে তাহা একবারে শূন্য হইয়াছিল। যেরূপ ঋণ হইয়াছিল শুনিলে ভয় হয়। আয় অপেক্ষা ব্যয় অনেক অধিক। এই নিমিত্ত, লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক ডিরেক্টরদিগের নিকট প্রতিজ্ঞা করেন আমি অবশ্যই ব্যয় লাঘব করিব। অতএব তিনি, কলিকাতায় পহুছিবার অব্যবহিত পরেই, রাজস্ব বিষয়ে দুই কমিটী স্থাপন করিলেন। তাহাদের কর্ম্ম এই যে, সিবিল ও মিলিটরি সম্পর্কে যে ব্যয় হইয় থাকে তাহার পরীক্ষা করিবেন, এবং তন্মধ্যে কি কমান যাইতে পারে তাহা দেখাইয়া দবেন।

 তাঁহারা যেরূপ পরামর্শ দিলেন, তদনুসারে সমুদায় কর্ম্মস্থনে ব্যয় লাঘব করা গেল। এইরূপ কর্ম্ম করিলে কাজে কাজেই সকলের অপ্রিয় হইতে হয়। লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক ব্যয় লাঘব করিয়া কোর্টের যে আদেশ প্রতিপালন করিলেন তাহাতে যাহাদের ক্ষতি হইল তাহারা তাঁহাকে বিস্তর গালি দিয়াছিল। ফলতঃ,ষে রাজকর্ম্মকারিকে রাজ্যের ব্যয় লাঘব করিবার ভার গ্রহণ করিতে হয়, তিনি কখনই তদানীন্তন লোকের নিকট সুখ্যাতি প্রত্যাশা করিতে পারেন না। সকলেই তাঁহার বিপক্ষ হইয়া চারি দিকে কোলাহল আরম্ভ করিল। তিনি, তাহাতে ক্ষুব্ধ বা চলচিত্ত না হইয়া, কেবল ব্যয় লাঘব ও ঋণ পরিশোধের উপায় দেখিতে লাগিলেন।

 অনেকবৎসরাবধি গবর্ণমেণ্ট সহগমন নিবারণার্থে অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছিলেন এবং, কত স্ত্রী সহমৃতা হয় ও দেশীয় লোকদিগেরই বা তদ্বিষয়ে কিরূপ অভিপ্রায়, ইহা নির্ণয় করিবার নিমিত্ত অনেক অনুসন্ধানও হইয়াছিল। রাজপুরুষের অনেকেই কহিয়াছিলেন যে দেশীয় লোকদিগের এবিষয়ে অত্যন্ত অনুরাগ আছে; ইহা রহিত করিলে অনর্থ ঘটিতে পারে। লার্ড উইলিয়ম ৰেণ্টিক, কলিকাতায় পহুছিয়া, এই বিষয় বিশিষ্ট রূপে বিবেচনা করিয়া দেখিলেন ইহা অনায়াসে রহিত করা যাইতে পারে। কৌন্সিলের সমুদায় সাহেবেরাও তাঁহার মতে সম্মত হইলেন। তদনন্তর, ১৮২৯ সালে ৪ঠা ডিসেম্বর, এক আইন জারী হইল; তদানুসারে ইঙ্গরেজদিগের অধিকার মধ্যে এই অবৈধ নিষ্ঠুর ব্যাপার এক বারেই রহিত হইয়া গেল।

 কতকগুলি ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি এই হিতানুষ্ঠানকে অহিত জ্ঞান করিলেন এবং, ইহা দ্বারা তাঁহাদের ধর্ম্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ হইল ইহা বলিয়া, গর্বর্ণর, জেনেরল বাহাদুরের নিকট এই প্রার্থনায় আবেদন করিলেন ষে ঐ আইন রদ করা যায়। লার্ড উইলিয়ম, এই ধর্ম্ম রহিত করিবার বহুবিধ দৃঢ়তর যুক্তি প্রদর্শনপূর্ব্বক, তাঁহাদের প্রর্থনা পত্র অগ্রাহ্য করিলেন। সেই সময়ে স্বারকানাথ ঠাকুর ও কালীনাথ রায় চৌধুরী প্রভৃতি আর কতকগুলি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি লার্ড-উইলিয়ম ৰেণ্টিক বাহাদুরকে এক ধন্যবাদ পত্র প্রদান করেন; তাহার মর্ম্ম এই যে আমরা শ্রীযুতের এই দয়ার কার্য্যে অনুগৃহীত হইয়া ধন্যবাদ করিতেছি।

 যাঁহারা সহগমনের পক্ষ ছিলেন তাঁহারা অবিলম্বে কলিকাতায় এক ধর্ম্মসভা স্থাপন, ও চাঁদা করিয়া বিস্তর অর্থ সংগ্রহ, করিলেন; এবং, এই বিধি পুনঃ স্থাপিত হয় এই প্রার্থনায়, ইংলণ্ডেশ্বরের নিকট দরখাস্ত দিবার নিমিত্ত একজন ইঙ্গরেজ উকীলকে ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু তথাকার রাজমন্ত্রিরা, সহগমনের অনুকুল যুক্তি সকল শ্রবণ করিয়া, পরিশেষে নিবারণ পক্ষই দৃঢ় করিলেন।, এয়োবিংশতি বৎসর অতীত হইল, সহমরণ রহিত হইয়াছে; এই দীর্ঘকাল মধ্যে প্রজাদিগের অসন্তোষের কোন লক্ষণ লক্ষিত হয় নাই। ফলতঃ,এক্ষণে এই নিষ্ঠুর ব্যবহার প্রায় সকলে বিস্মৃত হইয়াছেন। যদি ইহা ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত না থাকে তবে অনন্তরজাত পুরুষেরা, এরূপ ব্যবহার কখন প্রচলিত ছিল, ইহা প্রায় প্রত্যয় করিবেক না।

 ১৮৩১ সালে, বিচারালয়ের অনেক রীতির পরীবর্ত্ত হইতে আরম্ভ হইল। বাঙ্গালিরা এপর্য্যন্ত, যৎসামান্য বেতনে নিযুক্ত হইয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোকদ্দমার বিচার করিতেন। লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক, দেশীয় লোকদিগের নাম সম্ভ্রম বাড়াইবার নিমিত্ত, তাঁহাদিগকে উচ্চ বেতনে্ উচ্চ পদে নিযুক্ত করিতে মনস্থ করিলেন। এই বৎসরে মুন্সেফ ও সদরআমীনদিগের বেতন ও ক্ষমতার বৃদ্ধি হয় এবং উচ্চতর বেতনে অতি সম্ভ্রান্ত প্রধান সদরআমীনী পদ নূতন সংস্থাপিত হয়। দেওয়ানী বিষয়ে প্রধান সদর আমীনদিগের যথেষ্ট ক্ষমতা হইল। রেজিষ্টরের পদ ও প্রবিন্সলকোর্ট উঠিয়া গেল; কেবল দেশীয় বিচারকের ও জিলা জজের আদালত এবং সদর দেওয়ানী আদালত ৰজায় থাকিল। এই নূতন নিয়ম, বাইশ বৎসর হইল, প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। ইহার ফলিতার্থ এই যে, মোকদ্দমার প্রথম শ্রবণ ও তাহার নিষ্পত্তি করণের ভার দেশীয় বিচারকদিগের প্রতি অর্পিত হইয়াছে; আর ইঙ্গরেজ জজদিগের উপর কেবল আপীল শুনিবার ভার রহিয়াছে।

 লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক ফৌজদারী আদালতেরও অনেক সুরীতি করেন। পূর্ব্বে, দায়রার সাহেবেরা ছয় মাসে একৰার আদালত করিতেন; কিয়ৎকাল পরে, কমিসনর সাহেবেরা তিন মাসে এক বার। পরিশেষে এই হুকুম হইল যে সিবিল ও সেশন জজেরা প্রতি মাসে এক এক বার বৈঠক করবেন। তাহাতে, কয়েদী আসামী ও সাক্ষীদিগকে, অধিক দিন কয়েদ থাকিয়া, যে ক্লেশ পাইতে হইত, তাহার অনেক নিবারণ হইল। ফলতঃ, কার্য্যদক্ষ লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক বাহাদুরের অধিকার কালে নানা সুনিয়ম সংস্থাপিত হয়; সে সমুদায়েরই প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, দেশীয় লোকদিগের নাম সম্ভ্রম বাড়ে ও সুন্দররূপে রাজকার্য্য নির্ব্বাহ হয়।

 ১৮৩১ খৃঃ অব্দে, রাজা রামমোহন রায় ইংলণ্ড যাত্রা করেন। বাঙ্গালা দেশে অনেক কাল এতাদৃশ বিদ্বান ব্যক্তি দৃষ্ট হয়েন নাই। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং কোম্পানিসংক্রান্ত অনেক সম্ভ্রান্ত কর্ম্ম করিয়াছিলেন। তিনি সংস্কৃত, বাঙ্গালা, আরবি, পারসী, উর্দ্দু, হিব্রু, গ্রীক, লাটিন, ইঙ্গরেজী, ফরাসি, এই দশ ভাষায় সম্যক্ বুৎপন্ন এবং নানা বিদ্যা ও অসাধারণ বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন ছিলেন, এবং স্বদেশীয় লোকদিগকে, কাল্পনিক দেব দেবীর আরাধনা হইতে বিরত করিয়া, বেদান্তপ্রতিপাদ্য পরব্রহ্মের উপাসনাতে প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত, অশেষ প্রকারে যত্নবান্ হইয়াছিলেন। যে সকল ব্যক্তির সহিত তাঁহার মতের ঐক্য ছিল না তাঁহারাও তাঁহার আসামান্য গুণের প্রশংসা করিতেন। ফলতঃ, রামমোহন রায় একজন অসাধারণ মনুষ্য ছিলেন তাহার সন্দেহ নাই।

 পুর্বে্ব উল্লিখিত হইয়াছে যে লার্ড জামহার্ষ্ট বাহাদুরের সময়ে তৈমুরবংশীয়দের সাম্রাজ্যনিবন্ধন প্রাধান্য রহিত হয়। এক্ষণে সম্রাট্, অপহারিত মর্য্যাদায় উদ্ধার বাসনায় ইংলণ্ডে আপীল করিবার নিশ্চয় করিয়া, রাজা রামমোহন রায়কে উকীল স্থির করিলেন। পুর্ব্বতন কালে সমুদ্রযাত্রা স্বীকারে ভারতবর্য়ীয়দিগের নিন্দা ও অধর্ম হইত না; কিন্তু এক্ষণে কলিষুধে কোন ব্যক্তি জাহাজে গমন করিলে তাহাকে জাতিভ্রষ্ট হইতে হয়। কিন্তু রাজা রামমোহন রায় অসঙ্কুচিত চিত্তে জাহাজে আরোহণ পুর্ব্বক ইংলণ্ড যাত্রা করেন এবং; ভখায় উপস্থিত হইয়া, যার পর নাই সমাদর প্রাপ্ত হয়েন। তাঁহার এই যাত্রার প্রয়োজন সিদ্ধ হয় নাই। ইংণ্ডেশ্বর ত্রিশ বৎসরের অনুগ্রহদত্তবৃত্তিভোগা তৈমুররংশীয়দের আধিপত্যের পুনঃ স্থাপন বিষয়ে সম্মত হইলেন না। কিন্তু এই বংশের যে বৃত্তি নিরূপিত ছিল, রামমোহন রায় তাহার আর তিন লক্ষ টাকা বৃদ্ধির অনুমতি প্রাপ্ত হয়েন। তিনি স্বদেশ প্রত্যাগমলের পূর্ব্বেই দেহযাত্রা সম্বরণ করিয়াছেন, এবং ব্রিষ্টল নগরের সন্নিকৃষ্ট সমাধিক্ষেত্রে সন্নিবেশিত হইয়াছেন।

 ১৮৩৩ সাল অতিশয় দুর্ঘটনার বৎসর। যে সকল সওদাগরের হৌস কমবেশ পঞ্চাশ বৎসর চলিয়া আসিতেছিল এই বৎসরে সে সকল দেউলিয়া হইতে লাগিল। সর্ব্ব প্রথমে পামর কোম্পানির হৌস ১৮৩০ সালে বন্ধ হয়। আর পাঁচটার, তৎপরে ভিন চারি বৎসর পর্যন্ত কাজকর্ম্ম চলিয়াছিল; পরিশেষে তাহারাও দেউলিয়া হইয়া গেল। এই ব্যাপার ঘটাতে সর্ব্ব সাধারণ লোকের ষোল কোটি টাকা অপচয় হয়। তন্মধ্যে দেউলিয়াদিগের অবশিষ্ট সম্পত্তি হইতে দুই কোটি টাকাও আদায় হয় নাই।

 পুর্ব্ব মিয়াদ অতীত হইলে, ১৮৩৩ সাং কোম্পানি বাহাদুর পুনর্ব্বার বিংশতি বৎসরের নিমিত্ত সনন্দ পাইলেন। তদ্দ্বারা এতদ্দেশীয় রাজশাসনেম্ন আনেক বিষয় পরীবর্ত্ত হয়। কোম্পানিকে ভারতীবর্ষীয় বাণিজ্যে সর্ব্ব প্রকার সম্পর্ক পরিত্যাগ ও সমুদায় কুঠী বিক্রয় করিতে হইল। তৎপুর্ব্ব বিশ বৎসর বাণিজ্যের মধ্যে চীনদেশীয় বাণিজ্যই তাঁহাদিগের একমাত্র অবলম্বন ছিল, এক্ষণে তাহাও পরিত্যাগ করিতে হইল। ফলতঃ,দুই শত তেত্রিশ বৎসর পর্যন্ত তাঁহারা যে বণিগবৃত্তি করিয়া আসিতেছিলেন, তাহাতে একবারে নিঃসম্বন্ধ হইয়া ভারতবর্ষীয় রাজ্যশাসন বিষয়েই ব্যাপৃত হইতে হইল। কলিকাতায় এক বিধিদায়িনী সভা স্থাপনের অমুমতি হইল। এই নিয়ম হইল যে তাহাতে কৌন্সিলের নিয়মিত মেম্বরেরা, ও কোম্পানির কর্ম্মকর ভিন্ন আর এক জন মেম্বর, বৈঠক করিবেন। এই নূতন সভার কর্তব্য এই নিৰ্দ্ধারিত হইল যখন যেরূপ আৰশ্যক হইবেক ভারতবর্ষে তখন তদনুরূপ আইন প্রচলিত করিবেন এবং সুপ্রীমকোর্টের উপরি কর্তৃত্ব ও তথাকার বন্দোবস্ত করবেন। আর সমুদায় দেশের জন্যে এক আইন পুস্তক প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত লা কমিশন নামে এক সভা স্থাপিত হইল। গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর সমুদায় ভারতবর্ষের অদ্বিতীয় অধিপতি হইলেন; অন্যান্য রাজধানী তাঁহার অধীন হইল। ৰাঙ্গালার রাজধানী বিভক্ত হইয়া কলিকাতা ও আগ্রা এই দুই রাজধানী হইল। নূতন চার্টর দ্বারা এই সকল প্রধান প্রধান পরীবর্ত্ত হয়।

 লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক, প্রজাগণের বিদ্যা বৃদ্ধি বিষয়ে যত্নবান হইয়া ইঙ্গরেজী শিক্ষার বিশেষ উৎসাহ দিয়াছিলেন। ১৮১৩ সালে, পাৰ্লিমেণ্টের অনুমতি হয় যে প্রজাদিগের বিদ্যাদান বিষয়ে, রাজস্ব হইতে, প্রতি বৎসর এক লক্ষ টাকা দেওয়া যাইবেক। এই টাকার প্রায় সমুদায়ই সংস্কৃত ও আরবি বিদ্যা অনুশীলন বিষয়ে ব্যয়িত হইত। লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক ইঙ্গরেজী ভাষা অধ্যয়নে তদপেক্ষায় অধিক উপকার বিবেচনা করিয়া স্থানে স্থানে ইঙ্গরেজী বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিলেন। সেই সময়ে তিনি ইহাও আদেশ করেন যে গবর্ণমেণ্টসংস্থাপিত সংস্কৃত ও আরবি বিদ্যালয়ের যে সকল ছাত্র মাসিক বৃত্তি পাইতেছে তাহারা বহির্গত হইলে আর কাহাকেও নূতন বৃত্তি দেওয়া যাইৰেক না। তদবধি এতদ্দেশে ইঙ্গরেজী ভাষার বিশিষ্ট রূপ অমুশীলন হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

 লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক, দেশীয় লোকদিগের উইরোপীয় আয়ুর্ব্বিদ্যা শিক্ষা নিমিত্ত, কলিকাতায় মেডিকেল কালেজ নামক বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া, দেশের অশেষ মঙ্গল বিধান করিয়াছেন। ছাত্রদিগকে অস্ত্রচিকিৎসা ও অন্যান্য চিকিৎসায় নিপুণ করিবার নিমিত্ত যে ষে বিদ্যা শিক্ষার আবশ্যক সে সমুদায়ের পৃথক পৃথক অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন। এই বিদ্যালয় দ্বারা যে উপকার দর্শিয়াছে গণনা করিয়া তাহার শেষ করা যায় না।

 সকল ব্যক্তিই কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সঞ্চয় করিতে পারিবে এই অভিপ্রায়ে লার্ড উইলিয়ম ৰেণ্টিকের অধিকার সময়ে সেবিংসব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়। যদর্থে ইহা স্থাপিত হয় সম্পূর্ণরূপে তাহার ফল দর্শিয়াছে।

 লার্ড বেণ্টিক বাহাদুর পঞ্চোত্তরা মাশুল বিষয়েও মনোযোগ দিয়াছিলেন। বহুকালাবধি এই রীতি ছিল দেশের এক স্থান হইতে স্থানান্তরে কোন দ্রব্য লইয়া যাইতেহইলে মাশুল দিত্তে হইত। তদনুসারে কি জলপথ কি স্থলপথ সর্ব্বত্র এক এক পরমিটের ঘর স্থাপিত হয়। তথায় দ্রব্য সকল আটকাইয়া তদারক করিবার নিমিত্ত অনেক কর্ম্মকর নিযুক্ত হইযাছিল। গৰণমেণ্ট এইরূপ বাণিজ্যের ব্যাঘাত করিয়াও কর সংগ্রহ করিতেন। ঘরে নিযুক্ত কর্ম্মকরেরা যে স্থলে গবর্ণমেণ্টের মাশুল এক টাকা আদায় করিত সেখানে আপনারা নিজে অন্ততঃ দুই টাকা লইত। ফলতঃ, তাহারা প্রঙ্গার উপর এমত দারুণ অত্যাচার আরম্ভ করিয়াছিল যে এই ব্যাপারে অধিকৃত এক জন বিচক্ষণ ইউরোপীয় কর্ম্মকর যখার্থ বিবেচনা পূর্ব্বক এই ব্যাপারকে অভিসম্পাত নামে নির্দেশ করিয়াছিলেন।

 ইঙ্গরেজের যখন মুসলমানদিগের হস্ত হইতে রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করেন তখন এই ব্যাপার প্রচলিত ছিল এবং তাঁহারাও নিজে এ পর্য্যন্ত ইহা প্রচলিত রাখিয়াছিলেন। কিন্তু বিচক্ষণ লার্ড কর্ণওয়ালিস বাহাদুর এই ব্যাপারকে দেশের বিশেষ ক্ষতিকর বোধ করিয়া ১৭৮৮ সালে, এই নিয়ম একেবারে রহিত করেন এবং দেশের মধ্যে যেখানে যত পরমিটঘর ছিল পুনরায় বন্ধ করিয়া দেয়। ইহার তের বৎসর পরে গভর্নমেণ্ট কর সংগ্রহের সূচনা নূতন পন্থা করিতে উদ্যত হইয়া পুনর্ব্বার এই মাশুলের নিয়ম স্থাপন করেন। এক্ষণে লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক সি ই ট্রি বিলিয়ন সাহেবকে, এই বিষয়ের সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া রিপোর্ট করিতে আজ্ঞা দিলেন। পরে এই মাশুল উঠাইবার সদুপায় স্থির করিবার নিমিত্ত এককমিটী স্থাপন করিলেম। এই ব্যাপার উক্ত লার্ড ৰাহাদুরের অধিকারকালে রহিত হয় নাই; কিন্তু তিনি, ইহার প্রথম উদেবাগী ৰলিয়া, অশেষ প্রশংশা ভাজন হইতে পারেন।

 লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক, আপন অধিকারের প্রারম্ভাবধি, এতদ্দেশে সমুদ্রে ও নদ নদী মধ্যে বাষ্পনাবিক কর্ম্ম প্রচলিত করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। যাহাতে ইংলণ্ড ও ভারতবর্ষের সংবাদাদি মাসে মাসে উভয়ত্র পহুছিতে পারে তিনি সাধ্যানুসারে ইহার চেষ্টা ররিতে ক্রটি করেন নাই। কিন্তু ডিরেক্টরেরা এই বিষয়ে বিস্তর বাধা দিয়াছিলেন। তিনি বোম্বাই হইতে সুয়েজ পর্য্যন্ত পুলিন্দা লইয়া যাইবার নিমিত্ত বাস্পনৌকা নিযুক্ত করিয়াছিলেন তন্নিমিত্ত তাঁহারা তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করেন। যাহা হউক, লার্ড বেণ্টিক বাঙ্গালা ও পশ্চিমাঞ্চলের নদ নদীতে লৌহনির্ম্মত ৰাষ্প জাহাজ চালাইবার প্রণালী স্বীকারে তাঁহাদিগকে....। এই বিষয়,ইউরোপীয় ও এতদ্দেশীয়....পক্ষে, এক্ষণে বিলঙ্কণ উপকারক বোধ হইবেক এবং এমত ৰোধ হইতেছে যে এই ব্যাপার ইংলণ্ডে ও আমেরিকাতে যেমন আবশ্যক ও সচরাাচর হইয়া উঠিয়াছে, এতদ্দেশেও কালক্রমে সেইরূপ হইয়া উঠিবেক।

 ১৮৩৪ সালের মার্চ্চ মাসে, লার্ড উইলিয়ম বেণ্টিক বাহাদুরের অধিকার সমাপ্ত হয়। তাঁহার অধিকারকালে ভিন্ন দেশীয় নরপতিগণের সহিত যুদ্ধ নিবন্ধন — উদ্বেগ ছিল না। এক দিবসের নিমিত্তেও সন্ধি ও শান্তির ব্যাঘাত জন্মে নাই। তাঁহার অধিকার কাল কেবল প্রজাদিগের শ্রীবৃদ্ধিকল্পেই সঙ্কল্পিত হইয়াছিল।

সম্পূর্ন।