প্রথম দৃশ্য

[দৃশ্য-পরিচয়ঃ—ঋতু-কুঞ্জের এক পার্শ্ব—শুষ্ক লতাকুঞ্জ—শীতের রাত্রিশেষ—আর্ত্ত ধরিত্রীর মৃদু ক্রন্দন-ধ্বনি ভেসে আস্‌ছে—কালো ওড়নায় ঢাকা ঋতুরাজ নিশ্চিন্ত ঔদাস্যে বসে আছে আর শীতা নৃত্য-সহকারে তা’র জয়গান গাইছে।]

(গান)

ওগো ঋতুরাজ, হৃদয়-দেবতা!
কেন ধরণী কাঁদে গুমরি’?
পবনে রেশ তার উঠিল ভরি’।
কোথা তব বরাভয়? জাগো দেবতা,
ধ্বংসের বুকে আনো শুভ বারতা।
নিশিদিন কাঁদে ঐ ভীতা ধরণী,
ঐ মম জয়নাদ তূর্য্যধ্বনি।
শ্মশানের বুকে তুমি জাগো দেবতা,
ভাঙ্গো মায়াজাল, মৃত্যু স্থবিরতা,
জাগো ঋতুরাজ; জাগো দেবতা।

শীতা। (অট্টহাস্যে)—হাঃ, হাঃ, হাঃ, তুমি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলে মনে পড়ে রাজা!
রাজা। হাঁ, তুমি তার প্রতিশোধও কম নাও নি শীতা।
শীতা। প্রতিশোধ! হাঁ, নিয়েছি, তুমি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলে যে আমার আগমনে ধরার বুকে কোন স্পন্দন জাগ্‌বে না, তোমার সে অভিশাপ আমি ব্যর্থ কোরেছি, কিন্তু তৃপ্তি তা’তে কতটুকু পেয়েছি রাজা?
রাজা। কেন পাও না শীতা? আমার এ পরাজয়ের গ্লানি কি তোমায় কোন তৃপ্তি দেয় নি?
শীতা। আকস্মিক তৃপ্তি হয়ত পেয়েছিলাম, কিন্তু তা’র মূল্য কতটুকু? রমণীর সহজাত কোমলতা বিসর্জ্জন দিয়ে যে গৌরব আমি ক্রয় কোরেছি, পরে দেখলাম তা’র মূল্য কত হীন, কত হীন, রাজা।
রাজা। সত্যই কি তা’র কোনও মূল্য নাই শীতা?
শীতা। না রাজা, রমণীর কাছে তা’র কোনও মূল্যই নেই। চেয়েছিলাম তোমার মদালস আঁখির চাহনি, তোমার সুকোমল বাহুর আলিঙ্গন, কিন্তু পেলাম শুধু ঘৃণাভরা উপেক্ষা। এই উপেক্ষার আবর্জ্জনায় আমার ডালা সাজাতে হোল। কিন্তু কেন?
রাজা। কেন শীতা?
শীতা। (হঠাৎ)—রাজা তোমার দু’চোখে ছ’রকম ভাষা খেলে কেন?
রাজা। কই, আমি ত তা’র কোন আভাস পাই নি।
শীতা। বাধা দিওনা, বাধা দিও না,—যে ভাষা ফুটে ওঠে তোমার চোখে বসন্তের আগমনে, সে ভাষায় কি আমার আগমনী এক লহমার জন্যও তুমি গাইতে পারো না? আমার সারা জীবনের বিনিময়ে এই এক লহমা, এক লহমা, আমি ভিক্ষা চেয়ে নিচ্ছি।
রাজা। শীতা, বিশ্বাস করো, আমার প্রাণ তোমায় ভিক্ষা দেবার জন্য উন্মুখ, কিন্তু আমি নিতান্ত নিঃসহায়। যে ভাষা ফুটে ওঠে আমার চোখে বসন্তের আগমনে, সে ভাষা ত আমার নিজস্ব নয়, সে যে তা’রই দান; সে আবেগ শত চেষ্টায়ও আমি অসময়ে ফিরিয়ে আন্‌তে পারি না।
শীতা। কেন রাজা? কিসের অভাব আমার দেহে? উছল যৌবন আমার সারা অঙ্গ ছেয়ে আছে। কিসের অভাব আমার মনে? রক্তের নর্ত্তনে হিয়ার প্রত্যেক তন্ত্রীতে অলৌকিক শিহরণ লেগেছে। তাদের সাহচর্য্যে তোমার অনুভূতি নিশ্চল কেন?
রাজা। সবই তোমার আছে শীতা, কিন্তু কি জানি কিসের অভাবে মন আমার সাড়া দেয় না। যখনই মনে পড়ে, সত্যই তোমার ওপর একটা অবিচার কোরেছি, তখনই সবলে মনের বাঁধন কষে’ তোমায় ভালোবাসতে চেয়েছি, পারি নি। কিন্তু কেন জান? আমার মনের ভেতর যে মদন লুকিয়ে আছে, সে তোমার শিহরণ সইতে পারে না, তাই সে থাকে লুকিয়ে। নিজের অস্তিত্ব সে ভুলে যায়, তাই তার দেখা তুমি পাও না শীতা।
শীতা। তবু ভালো, অবিচার যে তুমি করেছো একথা স্বীকার করো।
রাজা। অস্বীকার কর্ব্বার দুর্ব্বলতা আমার নাই।
শীতা। কিন্তু রাজা, ধরণীর বুকে যে কলরোল আমি ধ্বনিয়ে তুলেছি, তা’রই বিরুদ্ধে তুমি প্রায়ই অভিযোগ করো। তুমি আমায় প্রতিনিয়তই স্মরণ করিয়ে দাও এ আমার অবিচার, তাই তা’র সংশোধন তুমি আমার কাছে প্রত্যাশা করে, নয় কি?
রাজা। ঠিক তা’ই শীতা।
শীতা। আর নিজের সৃষ্টি অবিচার বুঝি শাশ্বত হোয়ে থাকবে। চমৎকার!
রাজা। আমি তোমার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি শীতা।
শীতা। আর আমি তোমার নির্ম্মম হৃদয়-হীনতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি রাজা। আমার নির্ম্মমতা তোমারই সৃষ্টি। আমি এনেছি ধরার বুকে ক্ষণিকের দুঃস্বপ্ন, আর তুমি, তুমি আমার বুকে চিরন্তন দুঃস্বপ্নের ছবি এঁকে দিয়েছো। আমার মধ্যে নারীত্ব যা ছিল সব মুছে গিয়েছে তোমার অবিচারে। নারীর এর বাড়া দুঃসহ লজ্জা নেই রাজা।
রাজা। হাঁ, অভিযোগ কর্ব্বার যথেষ্ট কারণ তোমার আছে।

 [হঠাৎ সবুজ আলোয় ঋতুকুঞ্জ ছেয়ে গেল, ঋতুরাজের কালো ওড়না খসে’ গেল—সবুজ ঋতুকুঞ্জের মাঝে সবুজবেশে ঋতুরাজ—একটা অস্পষ্ট আনন্দরোল ভেসে এলো ও গান গাহিতে গাহিতে ঋতুদূতের প্রবেশ]

(গান)

নিশীতরাতের কাজল মায়ায় আজ্‌কে কাহার ফুলবাসর,
কাহার পরশ লাগ্‌লো বুকে, ভাঙ্গলো আমার নিদ্‌সায়র।
কোন্‌ রূপসী ঘোম্‌টা মুখে,
এলো রে ওই ধরার বুকে,
চপল আঁখির ললিত লীলায় করলো আমার মন কাতর।

[ঋতুদূতের প্রস্থান।

শীতা। এ কি হঠাৎ বুকের মাঝে অহেতুক শিহরণ জাগে কেন? ধরার বুকে এ কি উল্লাসকর গীতির প্লাবন? বুঝেছি, আমার সময় ফুরিয়েছে। বিদায়ের সময় চোখের জলে ফিরতে হোল রাজা, তোমার দুয়ার হোতে, কিন্তু আবার যখন আসবো তখন যেন অফুরন্ত আনন্দ আমার সাথী হোয়ে আসে।
রাজা। আশীর্ব্বাদ করি তোমার এ কামনা যেন সফল হয়।

[এক পার্শ্ব হইতে বসন্তরাণীর প্রবেশ, অপর পার্শ্ব হইতে শীতার প্রস্থান]

রাজা।

(গান)

ও আমার কল্পলোকের সুন্দরী,
ধরার বুকে নাম্‌লে তুমি আশার কানন মুঞ্জরি’।
ও আমার কল্পলোকের সুন্দরী।
ভুলিয়ে দিলে দুখের স্বপন সুখের ছবি আঁক্‌লে গো,
তাই ত তোমায় ধরার বুকে ভোম্‌রা বঁধু ডাক্‌ছে গো।
উঠ্‌লো জেগে সবুজ ধরা নবীন গানে গুঞ্জরি’।
ও আমার কল্পলোকের সুন্দরী।

বাসন্তিকা।

(গান)

গানের সুরে হোল সুরু আমার অভিযান,
সাঙ্গ হোয়ে গেলো এবার গভীর অভিমান।
ঐ দরদীর চোখের চাওয়ায়
ডাক দিলে আজ উতল হাওয়ায়
তাইত সখা, এলাম ছুটে গাইতে মিলন-গান।
আজ্‌কে বঁধু, তোমায় আমি কোরবো আমায় দান।