বিচিত্র গল্প (দ্বিতীয় ভাগ)/মহামায়া

মহামায়া।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

মহামায়া এবং রাজীবলোচন উভয়ে নদীর ধারে একটা ভাঙ্গা মন্দিরে সাক্ষাৎ করিল।

 মহামায়া কোন কথা না বলিয়া তাহার স্বাভাবিক গম্ভীর দৃষ্টি ঈষৎ ভর্ৎসনার ভাবে রাজীবের প্রতি নিক্ষেপ করিল। তাহার মর্ম্ম এই, তুমি কি সাহসে আজ অসময়ে আমাকে এখানে আহ্বান করিয়া আনিয়াছ? আমি এ পর্য্যন্ত তোমার সকল কথা শুনিয়া আসিতেছি বলিয়াই তোমার এতদুর স্পর্দ্ধা বাড়িয়া উঠিয়াছে?

 রাজীব একে মহামায়াকে বরাবর ঈষৎ ভয় করিয়া চলে তাহাতে এই দৃষ্টিপাতে তাহাকে ভারি বিচলিত করিয়া দিল— দুটা কথা গুছাইয়া বলিবে মনে করিয়াছিল, সে আশায় তৎক্ষণাৎ জলাঞ্জলি দিতে হইল। অথচ অবিলম্বে এই মিলনের একটা কোন কিছু কারণ না দেখাইলেও চলে না, তাই দ্রুত বলিয়া ফেলিল—“আমি প্রস্তাব করিতেছি, এখান হইতে পালাইয়া গিয়া আমরা দুজনে বিবাহ করি।”-রাজীবের যে কথাটা বলিবার উদ্দেশ্য ছিল সে কথাটা ঠিক বলা হইল বটে, কিন্তু যে ভূমিকাটি মনে মনে স্থির করিয়া আসিয়াছিল তাহার কিছুই হইল না। কথাটা নিতান্ত নীরস নিরলঙ্কার, এমন কি, অদ্ভুত শুনিতে হইল। নিজে বলিয়া নিজে থতমত থাইয়া গেল—আরও দুটো পাঁচটা কথা জুড়িয়া ওটাকে যে বেশ একটু নরম করিয়া আনিবে তাহার সামর্থ্য রহিল না। ভাঙ্গা মন্দিরে নদীর ধারে এই মধ্যাকালে মহামায়াকে ডাকিয়া আনিয়া নির্ব্বোধ লোকটা শুদ্ধ কেবল বলিল, চল আমরা বিবাহ করিগে!

 মহামায়া কুলীনের ঘরের কুমারী। বয়স চব্বিশ বৎসর। যেমন পরিপূর্ণ বয়স, তেমনি পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্য। যেন শরৎকালের রৌদ্রের মত কাঁচা সোনার প্রতিমা—সেই রৌদ্রের মতই দীপ্ত এবং নীরব এবং তাহার দৃষ্টি দিবালোকের ন্যায় উন্মুক্ত এবং নির্ভীক।

 তাহার বাপ নাই; বড় ভাই আছেন—তাঁহার নাম ভবানীচরণ চট্টোপাধ্যায়। ভাইবোন প্রায় এক প্রকৃতির লোক-মুখে কথাটি নাই কিন্তু এমনি একটা তেজ আছে যে, দিবা দ্বিপ্রহরের মত নিঃশব্দে দহন করে। লোকে ভবানীচরণকে অকারণে ভয় করিত।

 রাজীব লোকটা বিদেশী। এখানকার রেশমের কুঠির বড় সাহেব তাহাকে নিজের সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে। রাজীবের বাপ এই সাহেবের কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহার মৃত্যু হইলে সাহেব তাঁহার অল্পবয়স্ক পুত্রের ভরণপোষণের ভার নিজে লইয়া তাহাকে বাল্যাবস্থায় এই বামনহাটীর কুঠিতে লইয়া আসেন। আমি যে প্রাচীনকালের কথা বলিতেছি তখনকার সাহেবদের মধ্যে এরূপ সহৃদয়তা প্রায় দেখা যাইত। বালকের সঙ্গে কেবল তাহার স্নেহশীলা পিসি ছিলেন। ইহারা ভবানীচরণের প্রতিবেশীরূপে বাস করিতেন। মহামায়া রাজীবের বাল্যসঙ্গিনী ছিল এবং রাজীবের পিসির সহিত মহামায়ার সুদৃঢ় মেহবন্ধন ছিল।

 রাজীবের বয়স ক্রমে ক্রমে ষোল, সতের, আঠারো, এমন কি, উনিশ হইয়া উঠিল, তথাপি পিসির বিস্তর অনুরোধসত্ত্বেও সে বিবাহ করিতে চায় না। সাহেব বাঙ্গালীর ছেলের এরূপ অসামান্য সুবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া ভারি খুসি হইলেন; মনে করিলেন, ছেলেটি তাঁহাকেই আপনার জীবনের আদর্শস্থল করিয়াছে। সাহেব অবিবাহিত ছিলেন। ইতিমধ্যে পিসিরও মৃত্যু হইল।

 এদিকে সাধ্যাতীত ব্যয় ব্যতীত মহামায়ার জন্যও অনুরূপ কুলসম্পন্ন পাত্র জোটে না। তাহারও কুমারী-বয়স ক্রমে বাড়িতে লাগিল।

 পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য, যে, পরিণয়বন্ধন যে দেবতার কার্য্য তিনি যদিও এই নরনারীযুগলের প্রতি এ যাবৎ বিশেষ অনোযোগ প্রদর্শন করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু প্রণয়বন্ধনের ভার যাঁহার প্রতি তিনি এতদিন সময় নষ্ট করেন নাই। বৃদ্ধ প্রজাপতি যখন ঢুলিতেছিলেন, যুবক কন্দর্প তখন সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় ছিলেন।

 ভগবান কন্দর্পের প্রভাব ভিন্ন লোকের উপর ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়। রাজীব তাঁহার প্ররোচনায় দুটো চারটে মনের কথা বলিবার অবসর খুঁজিয়া বেড়ায়, মহামায়া তাহাকে সে অবসর দেয় না—তাহার নিস্তব্ধ গম্ভীর দৃষ্টি রাজীবের ব্যাকুল হৃদয়ে একটা ভীতির সঞ্চার করিয়া দেয়।

 আজ শতবার মাথার দিব্য দিয়া রাজীব মহামায়াকে এই ভাঙ্গা মন্দিরে আনিতে কৃতকার্য্য হইয়াছে। তাই মনে করিয়াছিল, যত কিছু বলিবার আছে আজ সব বলিয়া লইবে, তাহার পরে, হয়, আমরণ সুখ, নয়, আজীবন মৃত্যু। জীবনের এমন একটা সঙ্কটের দিনে রাজীব কেবল কহিল—“চল, তবে বিবাহ করা যাউক‍্।” এবং তার পরে বিস্মৃতপাঠ ছাত্রের মত থতমত খাইয়া চুপ করিয়া রহিল।

 রাজীব যে এরূপ প্রস্তাব করিবে মহামায়া যেন আশা করে নাই। অনেকক্ষণ তাই নীরব হইয়া রহিল।

 মধ্যাহ্ণকালের অনেকগুলি অনির্দ্দিষ্ট করুণধ্বনি আছে, সেইগুলি এই নিস্তব্ধতায় ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। বাতাসে মন্দিরের অর্দ্ধসংলগ্ন ভাঙ্গা কপাট এক একবার অত্যন্ত মৃদুমন্দ আর্ত্তস্বর সহকারে ধীরে ধীরে খুলিতে এবং বন্ধ হইতে লাগিল; মন্দিরের গবাক্ষে বসিয়া পায়রা বকম্-বকম্ করিয়া ডাকে, বাহিরে শিমুলগাছের শাখায় বসিয়া কাঠঠোক‍‍রা একঘেয়ে ঠক্ঠক্ শব্দ করে, শুষ্ক পত্ররাশির মধ্য দিয়া গিরগিটি সরু শব্দে ছুটিয়া যায়, হঠাৎ একটা উষ্ণবাতাস মাঠের দিক হইতে আসিয়া সমস্ত গাছের পাতার মধ্যে ঝর‍্ঝর্ করিয়া উঠে, এবং হঠাৎ নদীর জল জাগিয়া উঠিয়া ভাঙ্গা ঘাটের সোপানের উপর ছলাৎছলাৎ করিয়া আঘাত করিতে থাকে। এইসমস্ত আকস্মিক অলস শব্দের মধ্যে বহুদূর তরুতল হইতে একটি রাখালের বাঁশিতে মেঠো সুর বাজিতেছে। রাজীব মহামায়ার মুখের দিকে চাহিতে সাহসী না হইয়া মন্দিরের ভিত্তির উপর ঠেস্ দিয়া দাঁড়াইয়া একপ্রকার শ্রান্ত স্বপ্নাবিষ্টের মত নদীর দিকে চাহিয়া আছে।

 কিছুক্ষণ পরে মুখ ফিরাইয়া লইয়া রাজীব আর একবার ভিক্ষুকভাবে মহামায়ার মুখের দিকে চাহিল। মহামায়া মাথা নাড়িয়া কহিল—“না, সে হইতে পারে না।”

 মহামায়ার মাথা যেমনি নড়িল, রাজীবের আশাও অমনি ভূমিসাৎ হইয়া গেল। কারণ, রাজীব সম্পূর্ণ জানিত মহামায়ার মাথা মহামায়ার নিজের নিয়মানুসারেই নড়ে, আর কাহারও সাধ্য নাই তাহাকে আপন মতে বিচলিত করে। প্রবল কুলাভিমান মহামায়ার বংশে কতকাল হইতে প্রবাহিত হইতেছে—সে কি কখনো রাজীবের মত বংশজ ব্রাহ্মণকে বিবাহ করিতে সম্মত হইতে পারে! ভালবাসা এক এবং বিবাহ করা আর। যাহা হউক্, মহামায়া বুঝিতে পারিল তাহার নিজের বিবেচনাহীন ব্যবহারেই রাজীবের এতদূর স্পর্দ্ধা বাড়িয়াছে; তৎক্ষণাৎ সে মন্দির ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

 রাজীব অবস্থা বুঝিয়া তাড়াতাড়ি কহিল—“আমি কালই এদেশ হইতে চলিয়া যাইতেছি।”

 মহামায়া প্রথমে মনে করিয়াছিল যে, ভাবটা দেখাইবে— সে খবরে আমার কি আবশ্যক! কিন্তু পারিল না। পা তুলিতে গিয়া পা উঠিল না—শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করিল “কেন?”

 রাজীব কহিল, আমার সাহেব এখান হইতে সোনাপুরের কুঠিতে বদ‍্লি হইতেছেন, আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেছেন।

 মহামায়া আবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। ভাবিয়া দেখিল দুই জনের জীবনের গতি দুই দিকে—একটা মানুষকে চিরদিন নজরবন্দী করিয়া রাখা যায় না। তাই চাপা ঠোঁট ঈষৎ খুলিয়া কহিল—“আচ্ছা!” সেটা কতকটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাসের মত শুনাইল।

 কেবল এই কথাটুকু বলিয়া মহামায়া পুনশ্চ গমনোদ্যত হইতেছে—এমন সময় রাজীব চমকিয়া উঠিয়া কহিল—“চাটুয্যে মহাশয়!”

 মহামায়া দেখিল, ভবানীচরণ মন্দিরের অভিমুখে আসিতেছে, বুঝিল তাহাদের সন্ধান পাইয়াছে। রাজীব মহামায়ার বিপদের সম্ভাবনা দেখিয়া মন্দিরের ভগ্নভিত্তি দিয়া লাফাইয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিল। মহামায়া সবলে তাহার হাত ধরিয়া আটক করিয়া রাখিল। ভবানীচরণ মন্দিরে প্রবেশ করিলেন—কেবল একবার নীরবে নিস্তব্ধভাবে উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

 মহামায়া রাজীবের দিকে চাহিয়া অবিচলিত ভাবে কহিল, “রাজীব, তোমার ঘরেই আমি যাইব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও।”

 ভবানীচরণ নিঃশব্দে মন্দির হইতে বাহির হইলেন, মহামায়াও নিঃশব্দে তাঁহার অনুগমন করিল—আর রাজীব হত বুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল—যেন তাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

সেই রাত্রেই ভবানীচরণ একখানা লাল চেলি আনিয়া মহামায়াকে বলিলেন—এইটে পরিয়া আইস।

 মহামায়া পরিয়া আসিল। তাহার পর বলিলেন, “আমার সঙ্গে চল।”

 ভবানীচরণের আদেশ, এমন কি, সঙ্কেতও কেহ কখন অমান্য করে নাই। মহামায়াও না।

 সেই রাত্রে উভয়ে নদীতীরে শ্মশান অভিমুখে চলিলেন। শ্মশান বাড়ি হইতে অধিক দূর নহে। সেখানে গঙ্গাযাত্রীর ঘরে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করিয়াছিল। তাহারই শয্যাপার্শ্বে উভয়ে গিয়া দাঁড়াইলেন। ঘরের এক কোণে পুরোহিত ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিল, ভবানীচরণ তাহাকে ইঙ্গিত করিলেন। সে অবিলম্বে শুভানুষ্ঠানের আয়োজন করিয়া লইয়া প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল; মহামায়া বুঝিল এই মুমূর্ষর সহিত তাহার বিবাহ। সে আপত্তির লেশমাত্র প্রকাশ করিল না। দুইটি অদূরবর্ত্তী চিতার আলোকে অন্ধকারপ্রায় গৃহে মৃত্যুযন্ত্রণার আর্ত্তধ্বনির সহিত অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ মিশ্রিত করিয়া মহামায়ার বিবাহ হইয়া গেল।

 যে দিন বিবাহ তাহার পরদিনই মহামায়া বিধবা হইল। এই দুর্ঘটনায় বিধবা অতিমাত্র শোক অনুভব করিল না—এবং রাজীবও মহামায়ার অকস্মাৎ বিবাহসংবাদে যেরূপ বজ্রাহত হইয়াছিল, বৈধব্যসংবাদে সেরূপ হইল না। এমন কি, কিঞ্চিৎ প্রফুল্ল বোধ করিতে লাগিল। কিন্তু সে ভাব অধিক ক্ষণ স্থায়ী হইল না। দ্বিতীয় আর একটা বজ্রাঘাতে রাজীবকে একেবারে ভূপাতিত করিয়া ফেলিল। সে সংবাদ পাইল, শ্মশানে আজ ভারি ধুম। মহামায়া সহমৃতা হইতেছে।

 প্রথমেই সে ভাবিল,সাহেবকে সংবাদ দিয়া তাঁহার সাহায্যে এই নিদারুণ ব্যাপার বলপূর্ব্বক রহিত করিবে। তাহার পরে মনে পড়িল, সাহেব আজই বদ‍্লি হইয়া সোনাপুরে রওনা হইয়াছে—রাজীবকেও সঙ্গে লইতে চাহিয়াছিল কিন্তু রাজীর একমাসের ছুটি লইয়া থাকিয়া গেছে।

 মহামায়া তাহাকে বলিয়াছে “তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও।” সে কথা সে কিছুতেই লঙ্ঘন করিতে পারে না। আপাততঃ একমাসের ছুটি লইয়াছে, আবশ্যক হইলে দুই মাস, ক্রমে তিন মাস এবং অবশেষে সাহেবের কর্ম্ম ছাড়িয়া দিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া খাইবে, তবু চিরজীবন অপেক্ষা করিতে ছাড়িবে না।

 রাজীব যখন পাগলের মত ছুটিয়া হয় আত্মহত্যা, নয় একটা কিছু করিবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় সন্ধ্যাকালে মুষলধারায় বৃষ্টির সহিত একটা প্রলয়-বড় উপস্থিত হইল। এম‍্নি ঝড় যে, রাজীবের মনে হইল বাড়ি মাথার উপর ভাঙ্গিয়া পড়িবে। যখন দেখিল, বাহ্যপ্রকৃতিতেও তাহার অন্তরের অনুরূপ একটা মহাবিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে, তখন সে যেন কতকটা শান্ত হইল। তাহার মনে হইল, সমস্ত প্রকৃতি তাহার হইয়া একটা কোনরূপ প্রতিবিধান করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। সে নিজে যতটা শক্তিপ্রয়োগ করিতে ইচ্ছা করিত মাত্র কিন্তু পারিত না, প্রকৃতি আকাশপাতাল জুড়িয়া ততটা শক্তিপ্রয়োগ করিয়া কাজ করিতেছে।

 এমন সময়ে বাহির হইতে সবলে কে দ্বার ঠেলিল। রাজীব তাড়াতাড়ি খুলিয়া দিল। ঘরের মধ্যে আর্দ্রবস্ত্রে একটি স্ত্রীলোক প্রবেশ করিল, তাহার মাথায় সমস্ত মুখ ঢাকিয়া ঘোম‍্টা। রাজীব তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিল, সে মহামায়া।

 উচ্ছ্বসিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল-“মহামায়া, তুমি চিতা হইতে উঠিয়া আসিয়াছ?”

 মহামায়া কহিল “হাঁ! আমি তোমার কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, তোমার ঘরে আসিব। সেই অঙ্গীকার পালন করিতে আসিয়াছি। কিন্তু রাজীব, আমি ঠিক সে আমি নাই, আমার সমস্ত পরিবর্ত্তন হইয়া গিয়াছে। কেবল আমি মনে মনে সেই মহামায়া আছি। এখনো বল, এখনো আমার চিতায় ফিরিয়া যাইতে পারি। আর যদি প্রতিজ্ঞা কর কখনো আমার ঘোমটা খুলিবে না, আমার মুখ দেখিবে না— তবে আমি তোমার ঘরে থাকিতে পারি।”

 মৃত্যুর হাত হইতে ফিরিয়া পাওয়াই যথেষ্ট, তখন আর সমস্তই তুচ্ছজ্ঞান হয়। রাজীব তাড়াতাড়ি কহিল “তুমি যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া থাকিও—আমাকে ছাড়িয়া গেলে আর আমি বাঁচিব না।”

 মহামায়া কহিল “তবে এখনি চল—তোমার সাহেব যেখানে বদ‍্লি হইয়াছে সেইখানে যাই।”

 ঘরে যাহা কিছু ছিল সমস্ত ফেলিয়া রাজীব মহামায়াকে লইয়া সেই ঝড়ের মধ্যে বাহির হইল। এম‍্নি ঝড় যে দাঁড়ান কঠিন—ঝড়ের বেগে কঙ্কর উড়িয়া আসিয়া ছিটাগুলির মত গায়ে বিধিতে লাগিল। মাথার উপরে গাছ ভাঙ্গিয়া পড়িবার ভয়ে পথ ছাড়িয়া উভয়ে খোলা মাঠ দিয়া চলিতে লাগিল। বায়ুর বেগ পশ্চাৎ হইতে আঘাত করিল। যেন ঝড়ে লোকালয় হইতে দুইটা মানুষকে ছিন্ন করিয়া প্রলয়ের দিকে উড়াইয়া লইয়া চলিয়াছে।


তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গল্পটা পাঠকেরা নিতান্ত অমূলক অথবা অলৌকিক মনে করিবেন না। যখন সহমরণ-প্রথা প্রচলিত ছিল, তখন এমন ঘটনা কদাচিৎ মাঝে মাঝে ঘটিতে শুনা গিয়াছে।

 মহামায়ার হাত পা বাঁধিয়া তাহাকে চিতায় সমর্পণ করিয়া যথাসময়ে অগ্নিপ্রয়োগ করা হইয়াছিল। অগ্নিও ধূধূ করিয়া ধরিয়া উঠিয়াছে, এমন সময়ে প্রচণ্ড ঝড় ও মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। যাহারা দাহ করিতে আসিয়াছিল তাহার তাড়াতাড়ি গঙ্গাযাত্রীর ঘরে আশ্রয় লইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। বৃষ্টিতে চিতানল নিবিতে বিলম্ব হইল না। ইতিমধ্যে মহামায়ার হাতের বন্ধন ভস্ম হইয়া তাহার হাত দুটি মুক্ত হইয়াছে। অসহ্য দাহযন্ত্রণায় একটিমাত্র কথা না কহিয়া মহামায়া উঠিয়া বসিয়া পায়ের বন্ধন খুলিল। তাহার পর, স্থানে স্থানে দগ্ধ বস্ত্রখণ্ড গাত্রে জড়াইয়া উলঙ্গপ্রায় মহামায়া চিতা হইতে উঠিয়া প্রথমে আপনার ঘরে ফিরিয়া আসিল। গৃহে কেহই ছিল না, সকলেই শ্মশানে। প্রদীপ জ্বালিয়া একখানি কাপড় পরিয়া মহামায়া একবার দর্পণে মুখ দেখিল। দর্পণ ভূমিতে আছাড়িয়া ফেলিয়া একবার কি ভাবিল। তাহার পর মুখের উপর দীর্ঘ ঘোম‍্টা টানিয়া অদূরবর্ত্তী রাজীবের বাড়ি গেল। তাহার পর কি ঘটিল পাঠকের অগোচর নাই।

 মহামায়া এখন রাজীবের ঘরে, কিন্তু রাজীবের জীবনে সুখ নাই। অধিক নহে, উভয়ের মধ্যে কেবল একখানি মাত্র ঘোম‍্টার ব্যবধান। কিন্তু সেই ঘোম‍্টাটুকু মৃত্যুর ন্যায় চিরস্থায়ী, অথচ মৃত্যুর অপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক। কারণ, নৈরাশ্যে মৃত্যুর বিচ্ছেদ-বেদনাকে কালক্রমে অসাড় করিয়া ফেলে, কিন্তু এই ঘোম‍্টার বিচ্ছেদটুকুর মধ্যে একটি জীবন্ত আশা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত্তে পীড়িত হইতেছে।

 একে মহামায়ার চিরকালই একটা নিস্তব্ধ নীরব ভাব আছে, তাহাতে এই ঘোম‍্টার ভিতরকার নিস্তব্ধতা দ্বিগুণ দুঃসহ বোধ হয়। সে যেন একটা মৃত্যুর মধ্যে আবৃত হইয়া বাস করিতেছে। এই নিস্তব্ধ মৃত্যু রাজীবের জীবনকে আলিঙ্গন করিয়া প্রতিদিন যেন বিশীর্ণ করিতে লাগিল। রাজীব পূর্ব্বে যে মহামায়াকে জানিত তাহাকেও হারাইল এবং তাহার সেই আশৈশব সুন্দর স্মৃতিকে যে আপনার সংসারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিবে, এই ঘোম‍্টাচ্ছন্ন মূর্ত্তি চিরদিন পার্শ্বে থাকিয়া নীরবে তাহাতেও বাধা দিতে লাগিল। রাজীব ভাধিত, মানুষে মানুষে স্বভাবতই যথেষ্ট ব্যবধান আছে—বিশেষতঃ মহামায়া পুরাণ-বর্ণিত কর্ণের মত সহজ কবচধারী—সে আপনার স্বভাবের চারিদিকে একটা আবরণ লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহার পর মাঝে আবার যেন আর একবার জন্মগ্রহণ করিয়া আবার আরো একটা আবরণ লইয়া আসিয়াছে, অহরহ পার্শ্বে থাকিয়াও সে এত দুরে চলিয়া গিয়াছে যে, রাজীর যেন আর তাহার নাগাল পায় না— কেবল একটা মায়াগণ্ডীর বাহিরে বসিয়া অতৃপ্ত তৃষিত হৃদয়ে এই সূক্ষ্ম অথচ অটল রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে— নক্ষত্র যেমন প্রতিরাত্রি নিদ্রাহীন নির্নিমেষ নতনেত্রে অন্ধকার নিশীথিনীকে ভেদ করিবার প্রয়াসে নিম্ফলে নিশিযাপন করে।

 এমনি করিয়া এই দুই সঙ্গীহীন একক প্রাণী কতকাল একত্র যাপন করিল।

 একদিন বর্ষাকালে শুক্লপক্ষ দশমীর রাত্রে প্রথম মেঘ কাটিয়া চাঁদ দেখা দিল। নিস্পন্দ জ্যোৎস্না-রাত্রি সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে জাগিয়া বসিয়া রহিল। সে রাত্রে নিদ্রাত্যাগ করিয়া রাজীবও আপনার জানালায় বসিয়া ছিল। গ্রীষ্মক্লিষ্ট বন হইতে একটা গন্ধ এবং ঝিল্লির শ্রান্তরব তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিতেছিল। রাজীব দেখিতেছিল অন্ধকার তরুশ্রেণীর প্রান্তে শান্ত সরোবর একখানি মার্জ্জিত রূপার পাতের মত ঝক‍্ঝক্ করিতেছে। মানুষ এ রকম সময় স্পষ্ট একটা কোন কথা ভাবে কি না বলা শক্ত। কেবল তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ একটা কোন দিকে প্রবাহিত হইতে থাকে— বনের মত একটা গন্ধোচ্ছ্বস দেয়, রাত্রির মত একটা ঝিল্লিধ্বনি করে। রাজীব কি ভাবিল জানি না, কিন্তু তাহার মনে হইল আজ যেন সমস্ত পুর্ব্ব নিয়ম ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আজ বর্ষারাত্রি তাহার মেঘাবরণ খুলিয়া ফেলিয়াছে, এবং আজি কার এই নিশীথিনীকে সেকালের সেই মহামায়ার মত নিস্তব্ধ সুন্দর এবং সুগম্ভীর দেখাইতেছে। তাহার সমস্ত অস্তিত্ব সেই মহামায়ার দিকে একযোগে ধাবিত হইল।

 স্বপ্নচালিতের মত উঠিয়া রাজীব মহামায়ার শয়ন-মন্দিরে প্রবেশ করিল। মহামায়া তখন ঘুমাইতেছিল।

 রাজীব কাছে গিয়া দাঁড়াইল—মুখ নত করিয়া দেখিল—মহামায়ার মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু হায়, এ কি! সে চিরপরিচিত মুখ কোথায়? চিতানল-শিখা তাহার নিষ্ঠুর লেলিহান রসনায় মহামায়ার বামগণ্ড হইতে কিয়দংশ সৌন্দর্য্য একেবারে লেহন করিয়া লইয়া আপনার ক্ষুধার চিহ্ণ রাখিয়া গেছে।

 বোধ করি রাজীব চমকিয়া উঠিয়াছিল, বোধ করি একটা অব্যক্ত ধ্বনিও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া থাকিবে। মহামায়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিল—দেখিল সম্মুখে রাজীব। তৎক্ষণাৎ ঘোম‍্টা টানিয়া শয্যা ছাড়িয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজীব বুঝিল এইবার বজ্র উদ্যত হইয়াছে। ভূমিতে পড়িল—পায়ে ধরিয়া কহিল, “আমাকে ক্ষমা কর।”

 মহামায়া একটি উত্তরমাত্র না করিয়া মুহূর্ত্তের জন্য পশ্চাতে ফিরিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রাজীবের ঘরে আর সে প্রবেশ করিল না। কোথাও তাহার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই ক্ষমাহীন চিরবিদায়ের নীরব ক্রোধানল রাজীবের সমস্ত ইহজীবনে একটি সুদীর্ঘ দগ্ধচিহ্ণ রাখিয়া দিয়া গেল।