বিচিত্র গল্প (দ্বিতীয় ভাগ)/মুক্তির উপায়
মুক্তির উপায়।
১
ফকিরচাঁদ বাল্যকাল হইতেই গম্ভীরপ্রকৃতি। বৃদ্ধসমাজে তাহকে কখনই বেমানান্ দেখাইত না। ঠাণ্ডা জল, হিম, এবং হাস্য পরিহাস তাহার একেবারে সহ্য হইত না। একে গম্ভীর তাহাতে বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময়েই মুখমণ্ডলের চারিদিকে কালো পশমের গলাবন্ধ জড়াইয়া থাকাতে তাহাকে ভয়ঙ্কর উঁচুদরের লোক বলিয়া বোধ হইত। ইহার উপরে, অতি অল্প বয়সেই তাহার ওষ্ঠাধর এবং গণ্ডস্থল প্রচুর গোঁফ দাড়িতে আচ্ছন্ন হওয়াতে সমস্ত মুখের মধ্যে হাস্যবিকাশের স্থান আর তিল মাত্র অবশিষ্ট রহিল না।
স্ত্রী হৈমবতীর বয়স অল্প এবং তাহার মন পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ নিবিষ্ট। সে বঙ্কিম বাবুর নভেল পড়িতে চায় এবং স্বামীকে ঠিক দেবতার ভাবে পূজা করিয়া তাহার তৃপ্তি হয় না। সে একটুখানি হাসিখুসি ভালবাসে; এবং বিকচোন্মুখ পুষ্প যেমন বায়ুর আন্দোলন এবং প্রভাতের আলোকের জন্য ব্যাকুল হয়, সেও তেমনি এই নব যৌবনের সময় স্বামীর নিকট হইতে আদর এবং হাস্যামোদ যথাপরিমাণে প্রত্যাশা করিয়া থাকে। কিন্তু স্বামী তাহাকে অবসর পাইলেই ভাগবত পড়ায়, সন্ধ্যাবেলায় ভগবদগীতা শুনায়, এবং তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশে মাঝে মাঝে শারীরিক শাসন করিতেও ত্রুটি করে না। যে দিন হৈমবতীর বালিশের নীচে হইতে “কৃষ্ণকান্তের উইল” বাহির হয় সে দিন উক্ত লঘুপ্রকৃতি যুবতীকে সমস্ত রাত্রি অশ্রুপাত করাইয়া তবে ফকির ক্ষান্ত হন। একে নভেল পাঠ তাহাতে আবার পতিদেবকে প্রতারণা! যাহা হউক্ অবিশ্রাম আদেশ অনুদেশ উপদেশ ধর্ম্মনীতি এবং দণ্ডনীতির দ্বারা অবশেষে হৈমবতীর মুখের হাসি, মনের সুখ এবং যৌবনের আবেগ একেবারে নিষ্কর্ষণ করিয়া ফেলিতে স্বামীদেবতা সম্পূর্ণ কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন।
কিন্তু, অনাসক্ত লোকের পক্ষে সংসারে বিস্তর বিঘ্ন। পরে পরে ফকিরের এক ছেলে এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করিয়া সংসারবন্ধন বাড়িয়া গেল। পিতার তাড়নায় এতবড় গম্ভীরপ্রকৃতি ফকিরকেও আপিসে আপিসে কর্ম্মের উমেদারীতে বাহির হইতে হইল, কিন্তু কর্ম্ম জুটিবার কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না।
তখন তিনি মনে করিলেন বুদ্ধদেবের মত আমি সংসার ত্যাগ করিব। এই ভাবিয়া একদিন গভীর রাত্রে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেলেন।
২
মধ্যে আর একটি ইতিহাস বলা আবশ্যক।
নবগ্রামবাসী যষ্ঠিচরণের এক ছেলে। নাম মাখনলাল। বিবাহের অনতিবিলম্বে সন্তানাদি না হওয়াতে পিতার অনুরোধে এবং নূতনত্বের প্রলোভনে আর একটি বিবাহ করেন। এই বিবাহের পর হইতে যথাক্রমে তাঁহার উভয় স্ত্রীর গর্ভে সাতটি কন্যা এবং একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করিল।
মাখন লোকটা নিতান্ত সৌখীন এবং চপল প্রকৃতি, কোন প্রকার গুরুতর কর্ত্তব্যের দ্বারা আবদ্ধ হইতে নিতান্ত নারাজ। একে ত ছেলেপুলের ভার, তাহার পরে যখন দুই কর্ণধার দুই কর্ণে ঝিঁকা মারিতে লাগিল তখন নিতান্ত অসহ্য হইয়া সেও একদিন গভীর রাত্রে ডুব মারিল।
বহুকাল তাহার আর সাক্ষাৎ নাই। কখন কখন শুনা যায়, এক বিবাহে কিরূপ সুখ তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে কাশীতে গিয়া গোপনে আর একটি বিবাহ করিয়াছে; শুনা যায়, হতভাগ্য কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করিয়াছে। কেবল দেশের কাছাকাছি আসিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার মন উতলা হয়, ধরা পড়িবার ভয়ে আসিতে পারে না।
৩
কিছু দিন ঘুরিতে ঘুরিতে উদাসীন ফকিরচাঁদ নবগ্রামে আসিয়া উপস্থিত। পথপার্শ্ববর্তী এক বটবৃক্ষতলে বসিয়া নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন “আহা, বৈরাগ্যমেবাভয়ং। দারা পুত্র ধন জন কেউ কারো নয়। কা তে কান্তা কস্তে পুত্রঃ।” বলিয়া এক গান জুড়িয়া দিলেন।
শােনরে শােন্, অবােধ মন!
শােন্ সাধুর উক্তি কিসে মুক্তি
সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ!
ভবের শুক্তি ভেঙ্গে মুক্তি-মুক্তা কর অন্বেষণ!
ওরে ও ভােলা মন, ভােলা মন রে!
সহসা গান বন্ধ হইয়া গেল। “ও কে ও! বাবা দেখচি! সন্ধান পেয়েছেন বুঝি! তবেই ত সর্ব্বনাশ! আবার ত সংসারের অন্ধকূপে টেনে নিয়ে যাবেন! পালাতে হল।”
ফকির তাড়াতাড়ি নিকটবর্তী এক গৃহে প্রবেশ করিলেন। বৃদ্ধ গৃহস্বামী চুপচাপ্ বসিয়া তামাক টানিতেছিল। ফকিরকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল “কেহে তুমি?”
ফকির। বাবা, আমি সন্ন্যাসী।
বৃদ্ধ। সন্ন্যাসী! দেখি দেখি বাবা, আলােতে এস দেখি!
এই বলিয়া আলােতে টানিয়া লইয়া ফকিরের মুখের পরে ঝুঁকিয়া বুড়া মানুষ বহু কষ্টে যেমন করিয়া পুঁথি পড়ে তেমনি করিয়া ফকিরের মুখ নিরীক্ষণ করিয়া বিড়্ বিড়্ করিয়া বকিতে লাগিল।
“এই ত আমার সেই মাখনলাল দেখচি! সেই নাক, সেই চোখ, কেবল কপালটা বদলেচে, আর সেই চাঁদমুখ গোঁফে দাড়িতে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেচে!” বলিয়া বৃদ্ধ সস্নেহে ফকিরের শ্মশ্রুল মুখে দুই একবার হাত বুলাইয়া লইল, এবং প্রকাশ্যে কহিল “বাবা, মাখন!”
বলা বাহুল্য বৃদ্ধের নাম যষ্ঠিচরণ।
ফকির। (সবিস্ময়ে) মাখন! আমার নাম ত মাখন নয়। পূর্ব্বে আমার নাম যাই থাক্, এখন আমার নাম চিদানন্দ স্বামী। ইচ্ছা হয় ত পরমানন্দও বলতে পার।
যষ্ঠি। বাবা, তা এখন আপনাকে চিঁড়েই বল আর পরমান্নই বল, তুই যে আমার মাখন, বাবা সে ত আমি ভুলতে পারব না!—বাবা, তুই কোন্ দুঃখে সংসার ছেড়ে গেলি! তোর কিসের অভাব! দুই স্ত্রী; বড়টিকে না ভাল বাসিস্ ছোটটি আছে। ছেলে পিলের দুঃখও নেই। শত্রুর মুইে ছাই দিয়ে সাতটি কন্যে, একটি ছেলে। আর আমি বুড়ো বাপ ক’দিনই বা বাঁচব, তোর সংসার তোরই থাক্বে!
ফকির একেবারে আঁৎকিয়া উঠিয়া কহিল “কি সর্ব্বনাশ! শুনলেও যে ভয় হয়!”
এতক্ষণে প্রকৃত ব্যাপারটা বোধগম্য হইল। ভাবিল, মন্দ কি, দিন দুই বৃদ্ধের পুত্রভাবেই এখানে লুকাইয়া থাকা যাক্, তাহার পরে সন্ধানে অকৃতকার্য্য হইয়া বাপ চলিয়া গেলেই এখান হইতে পলায়ন করিব।
ফকিরের নিরুত্তর দেখিয়া বৃদ্ধের মনে আর সংশয় রহিল না। কেষ্টা চাকরকে ডাকিয়া বলিল “ওরে ও কেষ্টা, তুই সকলকে খবর দিয়ে আয়গে, আমার মাখন ফিরে এসেছে।”
৫
দেখিতে দেখিতে লোকে লোকারণ্য। পাড়ার লোকে অধিকাংশই বলিল সেই বটে, কেহ বা সন্দেহ প্রকাশ করিল। কিন্তু বিশ্বাস করিবার জন্যই লোকে এত ব্যগ্র, যে, সন্দিগ্ধ লোকদের উপরে সকলে হাড়ে চটিয়া গেল। যেন তাহারা ইচ্ছাপূর্ব্বক কেবল রসভঙ্গ করিতে আসিয়াছে; যেন তাহারা পাড়ার চৌদ্দ অক্ষরের পয়ারকে সতের অক্ষর করিয়া বসিয়া আছে, কোন মতে তাহাদিগকে সংক্ষেপ করিতে পারিলেই তবে প।ড়াশুদ্ধ লোক আরাম পায়; তাহারা ভূতও বিশ্বাস করে না, ওঝাও বিশ্বাস করে না, আশ্চর্য্য গল্প শুনিয়া যখন সকলের তাক্ লাগিয়া গিয়াছে তখন তাহারা প্রশ্ন উত্থাপন করে। একপ্রকার নাস্তিক বলিলেই হয়। কিন্তু ভূত অবিশ্বাস করিলে ততটা ক্ষতি নাই, তাই বলিয়া বুড়া বাপের হারা ছেলেকে অবিশ্বাস করা যে নিতান্ত হৃদয়-হীনতার কাজ। যাহা হউক্, সকলের নিকট হইতে তাড়না খাইয়া সংশয়ীর দল থামিয়া গেল।
ফকিরের অতি ভীষণ অটল গাম্ভীর্য্যের প্রতি ভ্রূপেক্ষমাত্র করিয়া পাড়ার লোকেরা তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল—“আরে আরে, আমাদের সেই মাখন আজ ঋষি হয়েছেন, তপিস্বি হয়েচেন! চিরটা কাল ইয়ার্কি দিয়ে কাটালে আজ হঠাৎ মহামুনি জামদগ্নি হয়ে বসেচেন।”
কথাটা উন্নতচেতা ফকিরের অত্যন্ত খারাপ লাগিল, কিন্তু নিরুপায়ে সহ্য করিতে হইল। একজন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল “ওরে মাখন, তুই কুচকুচে কালো ছিলি রংটা এমন ফর্সা করলি কি করে?”
ফকির উত্তর দিল “যোগ অভ্যাস করে।”
সকলেই বলিল “যোগের কি আশ্চর্য্য প্রভাব!”
একজন উত্তর করিল “আশ্চর্য্য আর কি! শাস্ত্রে আছে, ভীম যখন হনুমানের লেজ ধরে তুল্তে গেলেন কিছুতেই তুলতে পারলেন না। সে কি করে’ হ’ল? সে ত যোগবলে!”
এ কথা সকলকেই স্বীকার করিলে হইল।
হেনকালে ষষ্ঠিচরণ আসিয়া ফকিরকে বলিল “বাবা একবার বাড়ির ভিতরে যেতে হচ্ছে।”
এ সম্ভাবনাটা ফকিরের মাথায় উদয় হয় নাই—হঠাৎ বজ্রাঘাতের মত মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া, পাড়ার লোকের বিস্তর অন্যায় পরিহাস পরিপাক করিয়া অবশেষে বলিল “বাবা, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি আমি অন্তঃপুরে ঢুকতে পারব না।”
যষ্ঠিচরণ পাড়ার লোকদের সম্বোধন করিয়া বলিল “তা হ’লে আপনাদের একবার গা তুল্তে হচ্চে। বৌমাদের এইখানেই নিয়ে আসি। তাঁরা বড় ব্যাকুল হয়ে আছেন।”
সকলে উঠিয়া গেল। ফকির ভাবিল এইবেলা এখান হইতে এক দৌড় মারি। কিন্তু রাস্তায় বাহির হইলেই পাড়ার লোক কুকুরের মত তাহার পশ্চাতে ছুটিবে ইহাই কল্পনা করিয়া তাহাকে নিস্তব্ধ ভাবে বসিয়া থাকিতে হইল।
যেম্নি মাখনলালের দুই স্ত্রী প্রবেশ করিল ফকির অম্নি নতশিরে তাহাদিগকে প্রণাম করিয়া কহিল “মা আমি তোমাদের সন্তান!”
অম্নি ফকিরের নাকের সম্মুখে একটা বালা-পরা হাত খড়্গের মত খেলিয়া গেল এবং একটি কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে বাজিয়া উঠিল “ওরে ও পোড়াকপালে মিন্সে, তুই মা বল্লি কা’কে!”
অম্নি আর একটি কণ্ঠ আরো দুই সুর উচ্চে পাড়া কাঁপাইয়া ঝঙ্কার দিয়া উঠিল “চোখের মাথা খেয়ে বসেছিস তোর মরণ হয় না!”
নিজের স্ত্রীর নিকট হইতে এরূপ চলিত বাঙ্গলা শোনা অভ্যাস ছিল না সুতরাং একান্ত কাতর হইয়া ফকির যোড়হস্তে কহিল “আপনারা ভুল বুঝচেন আমি এই আলোতে দাঁড়াচ্চি আমাকে একটু ঠাউরে দেখুন!”
প্রথম ও দ্বিতীয় পরে পরে কহিল “ঢের দেখেছি! দেখে দেখে চোখৃ ক্ষয়ে’ গেছে। তুমি কচি খোকা নও, আজ নতুন জন্মাও নি। তোমার দুধের দাঁত অনেক দিন ভেঙ্গেছে। তোমার কি বয়সের গাছপাথর আছে। তোমায় যম ভুলেচে বলে কি আমরা ভুল্ব?”
এরূপ একতরফা দাম্পত্য আলাপ কতক্ষণ চলিত বলা যায় না—কারণ ফকির একেবারে বাক্শক্তিরহিত হইয়া নতশিরে দাঁড়াইয়া ছিল। এমন সময় অত্যন্ত কোলাহল শুনিয়া এবং পথে লোক জমিতে দেখিয়া ষষ্ঠিচরণ প্রবেশ করিল।
বলিল “এত দিন আমার ঘর নিস্তব্ধ ছিল, একেবারে টুঁশব্দ ছিল না! আজ মনে হচ্চে বটে আবার মাখন ফিরে এসেচে!”
ফকির করযোড়ে কহিল “মশায়, আপনার পুত্রবধূদের হাত থেকে আমাকে রক্ষে করুন!”
ষষ্ঠি। বাবা, অনেক দিন পরে এসেছ তাই প্রথমটা একটু অসহ্য বোধ হচ্চে। তা, মা, তোমরা এখন যাও! বাবা মাখন ত এখন এখানেই রইলেন; ওঁকে আর কিছুতেই যেতে দিচ্চি নে।
ললনাদ্বয় বিদায় হইলে ফকির যষ্ঠিচরণকে বলিল “মশায়, আপনার পুত্র কেন যে সংসার ত্যাগ করে’ গেছেন তা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারচি। মশায় আমার প্রণাম জান্বেন, আমি চল্লেম।”
বৃদ্ধ এম্নি উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন উত্থাপন করিল যে পাড়ার লোক মনে করিল মাখন তাহার বাপকে মারিয়াছে। তাহারা হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। সকলে আসিয়া ফকিরকে জানাইয়া দিল এমন ভণ্ডতপস্বিগিরি এখানে খাটিবে না। ভালমানুষের ছেলের মত কাল কাটাইতে হইবে। একজন বলিল “ইনি ত পরমহংস নন্ পরম বক।” গাম্ভীর্য্য গোঁফদাড়ি এবং গলাবন্ধের জোরে ফকিরকে এমন সকল কুৎসিত কথা কখন শুনিতে হয় নাই। যাহা হউক্ লোকটা পাছে আবার পালায় পাড়ার লোকেরা অত্যন্ত সতর্ক রহিল। স্বয়ং জমিদার ষষ্ঠিচরণের পক্ষ অবলম্বন করিল।
৬
ফকির দেখিল এম্নি কড়া পাহারা যে, মৃত্যু না হইলে ইহারা ঘরের বাহির করিবে না। একাকী ঘরে বসিয়া গান গাহিতে লাগিল—
শোন্ সাধুর উক্তি কিসে মুক্তি
সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ।
বলা বাহুল্য, গানটার আধ্যাত্মিক অর্থ অনেকটা ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে।
এমন করিয়াও কোনমতে দিন কাটিত। কিন্তু মাখনের আগমন সংবাদ পাইয়া দুই স্ত্রীর সম্পর্কের এক ঝাঁক শ্যালা ও শ্যালী আসিয়া উপস্থিত হইল।
তাহারা আসিয়াই প্রথমতঃ ফকিরের গোঁফ দাড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল—তাহারা বলিল এ ত সত্যকার গোঁফ দাড়ি নয়, ছদ্মবেশ করিবার জন্য আঠা দিয়া জুড়িয়া আসিয়াছে।
নাসিকার, নিম্নবর্ত্তী গুম্ফ ধরিয়া টানাটানি করিলে ফকিরের ন্যায় অত্যন্ত মহৎ লোকেরও মাহাত্ম্য রক্ষা করা দুষ্কর হইয়া উঠে। ইহা ছাড়া কানের উপর উপদ্রবও ছিল; প্রথমতঃ মলিয়া, দ্বিতীয়তঃ এমন সকল ভাষা প্রয়োগ করিয়া যাহাতে কান না মলিলেও, কান লাল হইয়া উঠে।
ইহার পর ফকিরকে তাহারা এমন সকল গান ফর্মায়েস্ করিতে লাগিল, আধুনিক বড় বড় নুতন পণ্ডিতেরা যাহার কোনরূপ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করিতে হার মানেন। আবার নিদ্রাকালে তাহারা ফকিরের স্বল্পাবশিষ্ট গণ্ডস্থলে চুনকালী মাখাইয়া দিল, আহারকালে কেসুরের পরিবর্ত্তে কচু, ডাবের জলের পরিবর্ত্তে হুঁকার জল, দুধের পরিবর্ত্তে পিঠালি গোলার অয়োজন করিল, পিঁড়ার নীচে সুপারি রাখিয়া তাহাকে আছাড় খাওয়াইল, লেজ বানাইল এবং সহস্র প্রচলিত উপায়ে ফকিরের অভ্রভেদী গাম্ভীর্য্য ভূমিসাৎ করিয়া দিল।
ফকির রাগিয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া ঝাঁকিয়া হাঁকিয়া কিছুতেই উপদ্রবকারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করিতে পারিল না। কেবল সর্ব্বসাধারণের নিকট অধিকতর হাস্যাস্পদ হইতে লাগিল। ইহার উপরে আবার অন্তরাল হইতে একটি মিষ্ট কণ্ঠের উচ্চহাস্য মাঝে মাঝে কর্ণগোচর হইত; সেটা যেন পরিচিত বলিয়া ঠেকিত এবং মন দ্বিগুণ অধৈর্য্য হইয়া উঠিত।
পরিচিত কণ্ঠ পাঠকের অপরিচিত নহে। এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ষষ্ঠিচরণ কোন এক সম্পর্কে হৈমবতীর মামা। বিবাহের পর শাশুড়ির দ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পিতৃমাতৃহীনা হৈমবতী মাঝে মাঝে কোন-না-কোন কুটুম্ব বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করিত। অনেক দিন পরে সে মামার বাড়ি আসিয়া নেপথ্য হইতে এক পরম কৌতুকাবহ অভিনয় নিরীক্ষণ করিতেছে। তৎকালে হৈমবতীর স্বাভাবিক রঙ্গপ্রিয়তার সঙ্গে প্রতিহিংসা প্রবৃত্তির উদ্রেক হইয়াছিল কি না চরিত্রতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা স্থির করিবেন, আমরা বলিতে অক্ষম।
ঠাট্টার সম্পর্কীয় লোকেরা মাঝে মাছে বিশ্রাম করিত কিন্তু স্নেহের সম্পর্কীয় লোকদের হাত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। সাত মেয়ে এবং এক ছেলে তাঁহাকে একদণ্ড ছাড়ে না। বাপের স্নেহ অধিকার করিবার জন্য তাহাদের মা তাহাদিগকে অনুক্ষণ নিযুক্ত রাখিয়াছিল। দুই মাতার মধ্যে আবার রেষারেষি ছিল উভয়েরই চেষ্টা যাহাতে নিজের সন্তানই অধিক আদর পায়। উভয়েই নিজ নিজ সন্তানদিগকে সর্ব্বদাই উত্তেজিত করিতে লাগিল—দুই দলে মিলিয়া পিতার গলা জড়াইয়া ধরা, কোলে বসা, মুখ চুম্বন করা প্রভৃতি প্রবল স্নেহব্যক্তি কার্য্যে পরস্পরকে জিতিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
বলা বাহুল্য ফকির লোকটা অত্যন্ত নির্লিপ্ত স্বভাব, নহিলে নিজের সন্তানদের অকাতরে ফেলিয়া আসিতে পারিত না; শিশুরা ভক্তি করিতে জানে না, তাহার সাধুত্বের নিকট অভিভূত হইতে শিখে নাই, এই জন্য ফকির শিশুজাতির প্রতি তিলমাত্র অনুরক্ত ছিল না, তাহা দিগকে তিনি কীট পতঙ্গের ন্যায় দেহ হইতে দূরে রাখিতে ইচ্ছা করিতেন। সম্প্রতি তিনি অহরহ শিশুপঙ্গপালে আচ্ছন্ন হইয়া বর্জ্জইস্ অক্ষরের ছোট বড় নোটের দ্বারা আদ্যোপান্ত সমাকীর্ণ ঐতিহাসিক প্রবন্ধের ন্যায় শোভমান হইলেন। তাহাদের মধ্যে বয়সের বিস্তর তারতম্য ছিল, এবং তাহারা সকলেই কিছু তাঁহার সহিত বয়ঃপ্রাপ্ত সভ্যজনোচিত ব্যবহার করিত না; শুদ্ধশুচি ফকিরের চক্ষে অনেক সময় অশ্রুর সঞ্চার হইত এবং তাহা আনন্দাশ্রু নহে।
পরের ছেলেরা যখন নানা সুরে তাঁহাকে বাবা বাবা করিয়া ডাকিয়া আদর করিত, তখন তাঁহার সাংঘাতিক পাশবশক্তি প্রয়োগ করিবার একান্ত ইচ্ছা হইত কিন্তু ভয়ে পারিতেন না। মুখ চক্ষু বিকৃত করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতেন।
৭
অবশেষে ফকির মহা চেঁচামেচি করিয়া বলিতে লাগিল, “আমি যাবই, দেখি আমাকে কে আটক করিতে পারে!”
তখন গ্রামের লোক এক উকীল আনিয়া উপস্থিত করিল। উকীল আসিয়া কহিল “জানেন আপনার দুই স্ত্রী।”
ফকির। আজ্ঞে এখানে এসে প্রথম জান্লুম।
উকীল। আর আপনার সাত মেয়ে এক ছেলে, তার মধ্যে দুটি মেয়ে বিবাহযোগ্যা।
ফকির। আজ্ঞে, আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন দেখতে পাচ্ছি।
উকীল। আপনার এই বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণের ভার আপনি যদি না নেন্ তবে আপনার অনাথিনী দুই স্ত্রী আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিবেন, পূর্ব্বে হ’তে বলে’ রাখলুম।
ফকির সব চেয়ে আদালতকে ভয় করিত। তাহার জানা ছিল উকীলর জেরা করিবার সময় মহাপুরুষদিগের মানমর্যাদা গাম্ভীর্য্যকে খাতির করে না— প্রকাশ্যে অপমান করে এবং খবরের কাগজে তাহার রিপোর্ট্ বাহির হয়; ফকির অশ্রুসিক্ত লোচনে উকীলকে বিস্তারিত আত্মপরিচয় দিতে চেষ্টা করিল—উকীল তাহার চাতুরীর, তাহার উপস্থিত বুদ্ধির, তাহার মিথ্যা গল্প রচনার অসাধারণ ক্ষমতার ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতে লাগিল। শুনিয়া ফকিরের আপন হস্ত পদ দংশন করিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল।
যষ্ঠিচরণ ফকিরকে পুনশ্চ পলায়নোদ্যত দেখিয়া শোকে অধীর হইয়া কঁদিতে লাগিল। পাড়ার লোকে তাহাকে চারিদিকে ঘিরিয়া অজস্র গালি দিতে লাগিল, এবং উকীল তাহাকে এমন শাসাইল যে তাহার মুথে আর কথা রহিল না।
ইহার উপর যখন আটজন বালক বালিকা গাঢ় স্নেহে তাহাকে চারিদিকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া তাহার শ্বাসরোধ করিবার উপক্রম করিল তখন অন্তরালস্থিত হৈমবতী হাসিবে ফি কাঁদিবে ভাবিয়া পাইল না।
ফকির অন্য উপায় না দেখিয়া ইতিমধ্যে নিজের পিতাকে একখানা চিঠি লিখিয়া সমস্ত অবস্থা নিবেদন করিয়াছিল। সেই পত্র পাইয়া ফকিরের পিতা হরিচরণ বাবু আসিয়া উপস্থিত। কিন্তু, পাড়ার লোক, জমিদার এবং উকীল কিছু তেই দখল ছাড়ে না!
এ লোকটি যে ফকির নহে মাখন, তাহারা তাহার সহস্র অকাট্য প্রমাণ প্রয়োগ করিল—এমন কি, যে ধাত্রী মাখনকে মানুষ করিয়াছিল সেই বুড়ীকে আনিয়া হাজির করিল। সে কম্পিত হস্তে ফকিরের চিবুক তুলিয়া ধরিয়া মুখ নিরীক্ষণ করিয়া তাহার দাড়ির উপরে দরবিগলিত ধারায় অশ্রুপাত করিতে লাগিল।
যখন দেখিল, তাহাতেও ফকির রাশ মানে না, তখন ঘোমটা টানিয়া দুই স্ত্রী আসিয়া উপস্থিত হইল। পাড়ার লোকেরা শশব্যস্ত হইয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেল। কেবল দুই বাপ, ফকির, এবং শিশুরা ঘরে রহিল।
দুই স্ত্রী হাত নাড়িয়া নাড়িয়া ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিল “কোন্ চুলোয় যমের কোন্ দুয়োরে যাবার ইচ্ছে হয়েছে?”
ফকির তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না সুতরাং নিরুত্তর হইয়া রহিল। কিন্তু ভাবে যেরূপ প্রকাশ পাইল তাহাতে যমের কোন বিশেষ দ্বারের প্রতি তাহার যে বিশেষ পক্ষপাত আছে এরূপ বোধ হইল না; আপাততঃ যে কোন একটা দ্বার পাইলেই সে বাঁচে, কেবল একবার বাহিরিতে পরিলেই হয়।
তখন আর একটি রমণীমূর্ত্তি গৃহে প্রবেশ করিয়া ফকিরকে প্রণাম করিল।
ফকির প্রথমে অবাক্ তাহার পরে আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া বলিল “এ যে হৈমবতী!”
নিজের অথবা পরের স্ত্রীকে দেখিয়া এত প্রেম তাহার চক্ষে ইতিপূর্ব্বে কখন প্রকাশ পায় নাই। মনে হইল মূর্ত্তিমতী মুক্তি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।
পরিশিষ্ট।
আর একটি লোক মুখের উপর শালমুড়ি দিয়া অন্তরাল হইতে দেখিতেছিল। তাহার নাম মাখনলাল। একটি অপরিচিত নিরীহ ব্যক্তিকে নিজপদে অভিষিক্ত দেখিয়া সে এত ক্ষণ পরম সুখানুভব করিতেছিল। অবশেষে যখন হৈমবতীকে উপস্থিত দেখিয়া বুঝিতে পারিল উক্ত নিরপরাধী ব্যক্তি তাহার নিজের ভগ্নীপতি, তখন দয়াপরতন্ত্র হইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল—না, আপনার লোককে এমন বিপদে ফেলা মহাপাতক। দুই স্ত্রীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, এ আমারি দড়ি, আমারি কলসী।
মাখনলালের এই অসাধারণ মহত্ব ও বীরত্বে পাড়ার লোক আশ্চর্য হইয়া গেল।