বিচিত্র প্রবন্ধ/অসম্ভব কথা

অসম্ভব কথা

এক যে ছিল রাজা।

 তখন ইহার বেশি কিছু জানিবার আবশ্যক ছিল না। কোথাকার রাজা, রাজার নাম কী, এ সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া গল্পের প্রবাহ বোধ করিতাম না। রাজার নাম শিলাদিত্য কি শালিবাহন, কাশী কাঞ্চি কমোজ কোশল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের মধ্যে ঠিক কোন্‌খানটিতে তাঁহার রাজত্ব, এ সকল ইতিহাস-ভূগোলের তর্ক আমাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ছিল;—আসল যে কথাটি শুনিলে অন্তর পুলকিত হইয়া উঠিত এবং সমস্ত হৃদয় এক মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুদ্বেগে চুম্বকের মত আকৃষ্ট হইত, সেটি হইতেছে-এক যে ছিল রাজা।

 এখনকার পাঠক যেন একেবারে কোমর বাঁধিয়া বসে। গোড়াতেই ধরিয়া লয় লেখক মিথ্যা কথা বলিতেছে। সেইজন্য অত্যন্ত সেয়ানার মত মুখ করিয়া জিজ্ঞাসা করে-“লেখক মহাশয়, তুমি যে বলিতেছ এক যে ছিল রাজা, আচ্ছা বলো দেখি, কে ছিল সেই রাজা!”

 লেখকেরাও সেয়ানা হইয়া উঠিয়াছে; তাহারা প্রকাণ্ড প্রত্নতত্ত্ব পণ্ডিতের মতো মুখমণ্ডল চতুর্গুণ মণ্ডলাকার করিয়া বলে, “এক যে ছিল রাজা, তাহার নাম ছিল অজাতশত্রু।”

 পাঠক চোখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করে, “অজাতশত্রু? ভালো, কোন্ অজাতশত্রু বলল দেখি?”।

 লেখক অবিচলিত মুখভাব ধারণ করিয়া বলিয়া যায়, “অজাতশত্রু ছিল তিন জন। একজন খৃষ্টজন্মের তিন সহস্র বৎসর পূর্ব্বে জন্মগ্রহণ করিয়া দুই বৎসর আটমাস বয়ঃক্রম কালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দুঃখের বিষয়, তাঁহার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ কোনো গ্রন্থেই পাওয়া যায়।” অবশেষে দ্বিতীয় অজাতশত্রু সম্বন্ধে দশজন ঐতিহাসিকের পশু বিভিন্ন মত সমালোচনা শেষ করিয়া যখন গ্রন্থের নায়ক তৃতীয় অজাতশত্রু পর্য্যন্ত আসিয়া পৌঁছায় তখন পাঠক বলিয়া উঠে, “ওরে বাস্‌রে, কী পাণ্ডিত্য! এক গল্প শুনিতে আসিয়া কত শিক্ষাই হইল! এ লোকটাকে আর অবিশ্বাস করা যাইতে পারে না! আচ্ছা লেখক মহাশয়, তার পরে কী হইল!”

 হায়রে হায়, মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে, অথচ পাছে কেহ নির্ব্বোধ মনে করে এ ভয়টুকুও ষোলো আনা আছে; এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই যে, সেই শেষকালটা ঠকে কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে।

 ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, “প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়ো না, তাহা হইলে মিথ্যা জবাব শুনিতে হইবে না।” বালক সেটি বোঝে, সে কোনো প্রশ্ন করে না। এইজন্য রূপকথার সুন্দর মিথ্যাটুকু শিশুর মতো উলঙ্গ, সত্যের মত সরল, সদ্য-উৎসারিত উৎসের মতো স্বচ্ছ—আর এখনকার দিনের সুচতুর মুখস্‌পরা মিথ্যা। কোথাও যদি তিলমাত্র ছিদ্র থাকে অম্‌নি ভিতর হইতে সমস্ত ফাঁকি ধরা পড়ে, পাঠক বিমুখ হয়; লেখক পালাইবার পথ পায় না।

 শিশুকালে আমরা যথার্থ রসজ্ঞ ছিলাম, এইজন্য যখন গল্প শুনিতে বসিয়াছি তখন জ্ঞানলাভ করিবার জন্য আমাদের তিলমাত্র আগ্রহ উপস্থিত হইত না, এবং অশিক্ষিত সরল হৃদয়টি ঠিক বুঝিত আসল, কথাটি কোনটুকু। আর এখনকার দিনে এত বাহুল্য কথাও বকিতে হয়, এত অনাবশ্যক কথারও অবশ্যক হইয়া পড়ে। কিন্তু অবশেষে সেই আসল কথাটিতে গিয়া দাঁড়ায়—এক যে ছিল রাজা।

 বেশ মনে আছে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ঝড়বৃষ্টি হইতেছিল। কলিকাতা সহর একেবারে ভাসিয়া গিয়াছিল। গলির মধ্যে একহাঁটু জল। মনে একান্ত আশা ছিল, আজ আর মাষ্টার আসিবে না। কিন্তু তবু তাঁহার আসার নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভীতচিত্তে পথের দিকে চাহিয়া বারান্দায় চৌকি লইয়া বসিয়া আছি। যদি বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিবার উপক্রম হয়, তবে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করি, হে দেবতা আর একটুখানি! কোনোমতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পার করিয়া দাও! তখন মনে হইত, পৃথিবীতে বৃষ্টির আর কোনো আবশ্যক নাই কেবল একটিমাত্র সন্ধ্যায় নগরপ্রান্তের একটিমাত্র ব্যাকুল বালককে মাষ্টারের করাল হস্ত হইতে রক্ষা করা ছাড়া। পুরাকালে কোনো একটি নির্ব্বাসিত যক্ষও তো মনে করিয়াছিল, আষাঢ়ে মেঘের বড়ো একটা কোনো কাজ নাই, অতএব রামগিরিশিখরের একটিমাত্র বিরহীর দুঃখকথা বিশ্বপার হইয়া অলকার সৌধ-বাতায়নে কোনো একটি বিরহিণীর কাছে লইয়া যাওয়া তাহার পক্ষে কিছুমাত্র গুরুতর নহে; বিশেষতঃ পথটি যখন এমন সুরম্য এবং তাহার হৃদয়বৈদনা এমন দুঃসহ।

 বালকের প্রার্থনামতে না হৌক, ধুমজ্যোতিঃসলিলমরুতের বিশেষ কোনো নিয়মানুসারে বৃষ্টি ছাড়িল না। কিন্তু হায় মাষ্টারও ছাড়িল না। গলির মোড়ে ঠিক সময়ে একটি পরিচিত ছাতা দেখা দিল-সমস্ত আশাবাষ্প এক মুহূর্ত্তে ফাটিয়া বাহির হইয়া আমার বুকটি যেমন পাঁজরের মধ্যে মিলাইয়া গেল। পরপীড়ন পাপের যদি যথোপযুক্ত শাস্তি থাকে তবে নিশ্চয় পরজন্মে আমি মাষ্টার হইয়া এবং আমার মাষ্টার মহাশয় ছাত্র হইয়া জন্মিবেন। তাহার বিরুদ্ধে একটি আপত্তি এই যে, আমাকে মাষ্টার মহাশয়ের মাষ্টার হইতে গেলে অতিশয় অকালে ইহসংসার হইতে বিদায় লইতে হয়—অতএব আমি তাঁহাকে অন্তরের সহিত মার্জ্জনা করিলাম।

 ছাতাটি দেখিবামাত্র ছুটিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলাম। মা তখন দিদিমার সহিত মুখোমুখী বসিয়া প্রদীপালোকে বিন্তি খেলিতেছিলেন। ঝুপ করিয়া একপাশে শুইয়া পড়িলাম। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইয়াছে?” আমি মুখ হাঁড়ির মতো করিয়া কহিলাম, “আমার অসুখ করিয়াছে, আজ আর আমি মাষ্টারের কাছে পড়িতে যাইব না।”

 আশা করি, অপ্রাপ্তবয়স্ক কেহ আমার এ লেখা পড়িবে না, এবং স্কুলের কোনো সিলেক্‌শন বহিতে আমার এ লেখা উদ্ভূত হইবে না। কারণ, আমি যে কাজ করিয়াছিলাম তাহা নীতিবিরুদ্ধ এবং সেজন্য কোনো শাস্তিও পাই নাই। বরঞ্চ আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল।

 মা চাকরকে বলিয়া দিলেন—“আজ তবে থাক, মাষ্টারকে যেতে ব’লে দে।”

 কিন্তু তিনি যেরূপ নিরুদ্বিগ্নচিত্তে বিন্তি খেলিতে লাগিলেন, তাহাতে, বেশ বুঝা গেল যে, মা তাঁহার পুত্রের অসুখের উৎকট লক্ষণগুলি মিলাইয়া দেখিয়া মনে মনে হাসিলেন; আমিও মনের সুখে বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া খুব হাসিলাম—আমাদের উভয়ের মন উভয়ের কাছে অগোচর রহিল না।

 কিন্তু সকলেই জানেন, এ প্রকারের অসুখ অধিকক্ষণ স্থায়ী করিয়া রাখা রোগীর পক্ষে বড়োই দুষ্কর। মিনিটখানেক না যাইতে যাইতে দিদিমাকে ধরিয়া পড়িলাম—দিদিমা একটা গল্প বলো। দুই চারিবার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। মা বলিলেন; “রোস্‌ বাছা, খেলাটা আগে শেষ কর!”

 আমি কহিলাম, “না মা, খেলা তুমি কাল শেষ কোরো, আজ দিদিমাকে গল্প বল্‌তে বলো না!”

 মা কাগজ ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, “যাও খুড়ি! উহার সঙ্গে এখন কে পারিবে!” মনে মনে হয়তো ভাবিলেন—আমার তো কাল মাষ্টার আসিবে না, আমি কালও খেলিতে পারি।

 আমি দিদিমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া একেবারে মশারির মধ্যে বিছানার উপরে গিয়া উঠিলাম। প্রথমে খানিকটা পাশ-বালিশ জড়াইয়া পা ছুঁড়িয়া নড়িয়াচড়িয়া মনের আনন্দ সম্বরণ করিতে গেল—তার পরে বলিলাম—গল্প বলো।

 তখনো ঝুপ্‌ঝুপ্‌ করিয়া বাহিরে বৃষ্টি পড়িতেছিল—দিদিমা মৃদুস্বরে আরম্ভ করিলেন—এক যে ছিল রাজা।

 তাহার এক রাণী। আঃ, বাঁচা গেল। সুয়ো এবং দুয়ো রাণী শুনিলেই বুকটা কাঁপিয়া উঠে—বুঝিতে পারি দুয়ো হতভাগিনীর বিপদের আর বড়ো বিলম্ব নাই। পূর্ব্ব হইতে মনে বিষম একটা উৎকণ্ঠা চাপিয়া থাকে।

 যখন শোনা গেল আর কোনো চিন্তার বিষয় নাই, কেবল রাজার পুত্র-সন্তান হয় নাই বলিয়া রাজা ব্যাকুল হইয়া আছে এবং দেবতার নিকট প্রার্থনা করিয়া কঠিন তপস্যা করিবার জন্য বনগমনে উদ্যত হইয়াছে, তখন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। পুত্রসন্তান না হইলে যে, দুঃখের কোন কারণ আছে তাহা আমি বুঝিতাম না। আমি জানিতাম যদি কিছুর জন্যে বনে যাইবার কখনো আবশ্যক হয় সে কেবল মাষ্টারের কাছ ইতে পালাইবার অভিপ্রায়ে।

 রাণী এবং একটি বালিকা-কন্যা ঘরে ফেলিয়া রাজা তপস্যা করিতে চলিয়া গেল। এক বৎসর দুই বৎসর করিয়া ক্রমে বারো বৎসর হইয়া যায়, তবু রাজার আর দেখা নাই।

 এদিকে রাজকন্যা ষোড়শী হইয়া উঠিয়াছে। বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু রাজা ফিরিল না।

 মেয়ের মুখের দিকে চায়, আর রাণীর মুখে অন্নজল রুচে না। আহা, আমার এমন সোনার মেয়ে কি চিরকাল আইবড়ো থাকিবে? ওগো আমি কী কপাল করিয়াছিলাম!

 অবশেষে রাণী রাজাকে অনেক অনুনয় করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন, আমি আর কিছু চাহি না, তুমি একদিন কেবল আমার ঘরে আসিয়া খাইয়া যাও।

 রাজা বলিলেন, আচ্ছা।

 রাণী তত সেদিন বহুযত্নে চৌষট্টি ব্যঞ্জন স্বহস্তে রাধিলেন এবং সমস্ত সোনার থালে ও রূপার বাটিতে সাজাইয়া চন্দন কাঠের পিঁড়ি পাতিয়া দিলেন! রাজকন্যা চামর হাতে করিয়া দাঁড়াইলেন।

 রাজা আজ বারো বৎসর পরে অন্তঃপুরে ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসিলেন। রাজকন্যা রূপে আলো করিয়া দাঁড়াইয়া চামর করিতে লাগিলেন।

 মেয়ের মুখের দিকে চায় আর খাওয়া হয় না। শেষে রাণীর দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, হাঁ গো রাণী, এমন সোনার প্রতিমা লক্ষ্মী-ঠাকুরুণটির মতো এ মেয়েটি কে গা? এ কাহাদের মেয়ে?

 রাণী কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, হা আমার পোড়া কপাল! উহাকে চিনিতে পারিলে না? ও যে তোমারি মেয়ে।

 রাজা বড়ো আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন—আমার সেই সেদিনকার এতটুকু মেয়ে আজ এত বড়োটি হইয়াছে?  রাণী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন— আর হইবে না? বলো কি, আজ বারো বৎসর হইয়া গেল!

 রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন—মেয়ের বিবাহ দাও নাই?

 রাণী কহিলেন—তুমি ঘরে নাই উহার বিবাহ কে দেয়? আমি কি নিজে পাত্র খুঁজিতে বাহির হইব?

 রাজা শুনিয়া হঠাৎ ভারি শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বলিলেন-রোসো, আমি কাল সকালে উঠিয়া রাজদ্বারে যাহার মুখ দেখিব তাহারই সহিত উহার বিবাহ দিয়া দিব।

 রাজকন্যা চামর করিতে লাগিলেন। তাঁহার হাতের বালাতে চুড়িতে ঠুংঠাং শব্দ হইতে লাগিল। রাজার আহার হইয়া গেল।

 পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়। বাহিরে আসিয়া রাজা দেখিলেন একটি ব্রাহ্মণের ছেলে রাজবাড়ির বাহিরে জঙ্গল হইতে শুক্‌না কাঠ সংগ্রহ করিতেছে। তাহার বয়স বছর সাত আট হইবে।

 রাজা বলিলেন, ইহারই সহিত আমার মেয়ের বিবাহ দিব। রাজার হুকুম কে লঙ্ঘন করিতে পারে! তখনি ছেলেটিকে ধরিয়া তাহারি, সহিত রাজকন্যার মালা বদল করিয়া দেওয়া হইল।

 আমি এই জায়গাটাতে দিদিমার খুব কাছে ঘেঁষিয়া গিয়া নিরতিশয় ঔৎসুক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম তার পরে? নিজেকে সেই সাত আট বৎসরের সৌভাগ্যবান্ কাঠকুড়নে ব্রাহ্মণের ছেলের স্থলাভিষিক্ত করিতে কি একটুখানি ইচ্ছা যায় নাই? যখন সেই রাত্রে ঝুপ্‌ঝুপ্‌ বৃষ্টি পড়িতেছিল, মিট্‌মিট্‌ করিয়া প্রদীপ জ্বলিতেছিল এবং গুন্‌গুন্ স্বরে দিদিমা মশারির মধ্যে গল্প বলিতেছিলেন, তখন কি বালকহৃদয়ের বিশ্বাসপরায়ণ রহস্যময় অনাবিষ্কৃত এক ক্ষুদ্র প্রান্তে এমন একটি সম্ভবপর ছবি জাগিয়া উঠে নাই যে, সে-ও একদিন সকাল বেলায় কোথায় এক রাজার দেশে রাজার দরজায় কাঠ কুড়াইতেছে, হঠাৎ একটি সোনার প্রতিমা লক্ষ্মীঠাকরুণটির মতো রাজকন্যার সহিত তাহার মালা বদল হইয়া গেল; মাথায় তাহার সিঁথি, কানে তাহার দুল, গলায় তাহার কণ্ঠী, হাতে তাহার কাঁকন, কটিতে তাহার চন্দ্রহার এবং আল্‌তাপরা দুটি পায় নূপুর ঝুম্‌ঝুম্ করিয়া বাজিতেছে!

 কিন্তু আমার সেই দিদিমা যদি লেখকজন্ম ধারণ করিয়া আজকালকার সেয়ানা পাঠকদের কাছে এই গল্প বলিতেন তবে ইতিমধ্যে তাঁহাকে কত হিসাব দিতে হইত? প্রথমতঃ রাজা যে বারো বৎসর বনে বসিয়া থাকে এবং ততদিন রাজকন্যার বিবাহ হয় না, একবাক্যে সকলেই বলিত ইহা অসম্ভব। সেটুকুও যদি কোনো গতিকে গোলেমালে পার হইয়া যাইত কিন্তু কন্যার বিবাহের জায়গায় বিষম একটা কলরব উঠিত। এক তো, এমন কখনো হয় না, দ্বিতীয়তঃ সকলেই আশঙ্কা করিত ব্রাহ্মণের ছেলের সহিত ক্ষত্রিয়-কন্যার বিবাহ ঘটাইয়া লেখক নিশ্চয়ই ফাঁকি দিয়া সমাজবিরুদ্ধ মত প্রচার করিতেছেন। কিন্তু পাঠকরা তেমন ছেলেই নয়, তাহারা তাহার নাতি নয় যে, সকল কথা চুপ করিয়া শুনিয়া যাইবে। তাহারা কাগজে সমালোচনা করিবে। অতএব একান্তমনে প্রার্থনা করি, দিদিমা যেন পুনর্ব্বার দিদিমা হইয়াই জন্মগ্রহণ করেন, হতভাগ্য নাতিটার মতো তাঁহাকে গ্রহদোষে যেন লেখক হইতে না হয়।

 আমি একেবারে পুলকিত কম্পান্বিত হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, তার পরে?

 দিদিমা বলিতে লাগিলেন-তার পরে রাজকন্যা মনের দুঃখে তাহার সেই ছোটো স্বামীটিকে লইয়া চলিয়া গেল।

 অনেক দূরদেশে গিয়া একটি বৃহৎ অট্টালিকা নির্ন্মাণ করিয়া সেই ব্রাহ্মণের ছেলেটিকে আপনার সেই অতি ক্ষুদ্র স্বামীটিকে, বড়ো যত্নে মানুষ করিতে লাগিল।  —আমি একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া পাশবালিশ আর একটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলাম, তার পরে?

 দিদিমা কহিলেন, তার পরে ছেলেটি পুঁথি-হাতে প্রতিদিন পাঠশালে যায়।

 এমনি করিয়া গুরুমহাশয়ের কাছে নানা বিদ্যা শিখিয়া ছেলেটি ক্রমে যত বড় হইয়া উঠিতে লাগিল ততই তাহার সহপাঠীরা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, ঐ যে সাতমহল বাড়িতে তোমাকে লইয়া থাকে সেই মেয়েটি তোমার কে হয়?

 ব্রাহ্মণের ছেলে তো ভাবিয়া অস্থির—কিছুতেই ঠিক করিয়া বলিতে পারে না মেয়েটি তাহার কে হয়। একটু একটু মনে পড়ে একদিন সকালে রাজবাড়ির দ্বারের সম্মুখে শুকনা কাঠ কুড়াইতে গিয়াছিল—কিন্তু সেদিন কী একটা মস্ত গোলেমালে কাঠকুড়ানো হইল না। সে অনেক দিনের কথা, সে কি কিছু মনে আছে? এমন করিয়া চারি-পাঁচ বৎসর যায়। ছেলেটিকে রোজই তাহার সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ঐ যে সাতমহলা বাড়িতে পরমারূপসী মেয়েটি থাকে ও তোমার কে হয়?

 ব্রাহ্মণ একদিন পাঠশালা হইতে মুখ বড়ো বিমর্ষ করিয়া আসিয়া রাজকন্যাকে কহিল, আমাকে আমার পাঠশালার পোড়োরা প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করে—ঐ সাতমহলা বাড়িতে যে পরমা সুন্দরী মেয়েটি থাকে সে তোমার কে হয়? আমি তাহার কোনো উত্তর দিতে পারি না। তুমি আমার কে হও বলো!

 রাজকন্যা বলিল, আজিকার দিন থাক্‌ সে কথা আর এক দিন বলিব।

 ব্রাহ্মণের ছেলে প্রতিদিন পাঠশালা হইতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমার কে হও?  রাজকন্যা প্রতিদিন উত্তর করে, সে কথা আজ থাক্ আর এক দিন বলিব। এম্‌নি করিয়া আরো চার পাঁচ বৎসর কাটিয়া যায়। শেষে ব্রাহ্মণ একদিন বড়ো রাগ করিয়া বলিল—আজ যদি তুমি না বলো তুমি আমার কে হও তবে আমি তোমার এই সাতমহলা বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইব।

 তখন রাজকন্যা কহিলেন—আচ্ছা কাল নিশ্চয়ই বলিব।

 পরদিন ব্রাহ্মণ-তনয় পাঠশালা হইতে ঘরে আসিয়াই রাজকন্যাকে বলিল—আজ বলিবে বলিয়াছিলে, তবে বলো?

 রাজকন্যা বলিলেন, আজ রাত্রে আহার করিয়া যখন তুমি শয়ন করিবে তখন বলিব।

 ব্রাহ্মণ বলিল—আচ্ছা। বলিয়া সূর্যাস্তের অপেক্ষায় প্রহর গণিতে লাগিল। এদিকে রাজকন্যা সোনার পালঙ্কে একটি ধবধবে ফুলের বিছানা পাতিলেন,—ঘরে সোনার প্রদীপে সুগন্ধ তেল দিয়া বাতি জ্বালাইলেন, এবং চুলটি বাঁধিয়া নীলাম্বরী কাপড়টি পরিয়া সাজিয়া বসিয়া প্রহর গণিতে লাগিলেন, কখন রাত্রি আসে।

 রাত্রে তাঁহার স্বামী কোনো মতে আহার শেষ করিয়া শয়নগৃহে সোনার পালঙ্কে ফুলের বিছানায় গিয়া শয়ন করিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, আজ শুনিতে পাইব এই সাতমহলা বাড়িতে যে সুন্দরীটি, থাকে সে আমার কে হয়।

 রাজকন্যা তাঁহার স্বামীর পাত্রে প্রসাদ খাইয়া ধীরে ধীরে শয়নগৃহে প্রবেশ করিলেন। আজ বহুদিন পরে প্রকাশ করিয়া বলিতে হইবে এই সাতমহলা অট্টালিকার একমাত্র অধীশ্বরী আমি তোমার কে হই।

 বলিতে গিয়া বিছানায় প্রবেশ করিয়া—কী দেখিলেন! ফুলের মধ্যে সাপ ছিল, তাঁহার স্বামীকে কখন দংশন করিয়াছে। স্বামীর মৃত দেহখানি মলিন হইয়া সোনার পালঙ্কে পুষ্পশয্যায় পড়িয়া আছে।

 —আমার যেন বক্ষঃস্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল! আমি রুদ্ধস্বরে, বিবর্ণমুখে জিজ্ঞাসা করিলাম—তার পরে কী হইল!

 দিদিমা বলিতে লাগিলেন-তার পরে—কিন্তু সে কথায় আর কাজ কী? সে যে আরো অসম্ভব! গল্পের প্রধান নায়ক সর্পাঘাতে মারা গেল, তবুও তার পরে? বালক তখন জানিত না, মৃত্যুর পরেও একটা তার পরে থাকিতে পারে বটে, কিন্তু সে তারপরের উত্তর কোনো দিদিমার দিদিমাও দিতে পারে না। বিশ্বাসের বলে সাবিত্রী মৃত্যুরও অনুগমন করিয়াছিলেন। শিশুরও প্রবল বিশ্বাস, এই জন্য সে মৃত্যুর অঞ্চল ধরিয়া ফিরাইতে চায়, কিছুতেই মনে করিতে পারে না যে, তাহার মাষ্টারবিহীন একসন্ধ্যাবেলাকার এত সাধের গল্পটি হঠাৎ একটি সর্পাঘাতেই মারা গেল! কাজেই দিদিমাকে সেই মহাপরিণামের চিরনিরুদ্ধ গৃহ হইতে গল্পটিকে আবার ফিরাইয়া আনিতে হয়। কিন্তু এত সহজে সেটি সাধন করেন, এমন অনায়াসে;—কেবল হয়তো একটা কলার ভেলায় ভাসাইয়া দিয়া গুটি দুই মন্ত্র পডিয়া মাত্র—যাহাতে সেই ঝুপ্‌ঝুপ্‌ বৃষ্টির রাত্রে স্তিমিত প্রদীপে বালকের মনে মৃত্যুর মূর্ত্তি অত্যন্ত অকঠোর হইয়া আসে, তাহাকে এক রাত্রের সুখনিদ্রার চেয়ে বেশি মনে হয় না। গল্প যখন ফুরাইয়া যায়, আরামে শ্রান্ত দুটি চক্ষু আপনি মুদিয়া আসে, তখন তো শিশুর ক্ষুদ্র প্রাণটিকে একটি স্নিগ্ধ নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ স্রোতের মধ্যে সুষুপ্তির ভেলায় করিয়া ভাসাইয়া দেওয়া হয়, তার পরে ভোরের বেলায় কে দুটি মায়ামন্ত্র পডিয়া তাহাকে এই জগতের মধ্যে জাগ্রৎ করিয়া তোলে!

 কিন্তু যাহার বিশ্বাস নাই, যে ভীরু এ সৌন্দর্য্যরসাস্বাদনের জন্যও এক ইঞ্চি পরিমাণ অসম্ভবকে লঙ্ঘন করিতে পরায়ুখ হয়, তাহার কাছে কোনো কিছুর আর তারপরে নাই, সমস্তই হঠাৎ অসময়ে এক অসমাপ্তিতে সমাপ্ত হইয়া গেছে। ছেলেবেলায় সাতসমুদ্র পার হইয়া মৃত্যুকেও লঙ্ঘন করিয়া গল্পের যেখানে যথার্থ বিরাম, সেখানে স্নেহময় সুমিষ্টস্বরে শুনিতাম—

আমার কথাটি ফুরোলো,
নটে গাছটি মুড়োলো।

 এখন বয়স হইয়াছে, এখন গল্পের ঠিক মাঝখানটাতে হঠাৎ থামিয়া গিয়া একটা নিষ্ঠুর কঠিন কণ্ঠে শুনিতে পাই—

আমার কথাটি ফুরোলো না,
নটে গাছটি মুড়োলো না।
কেনরে নটে মুড়োলি নে কেন,
তোর গরুতে -

 দুর হৌক গে, ঐ নিরীহ প্রাণীটির নাম করিয়া কাজ নাই, আবার কে কোন দিক হইতে গায়ে পাতিয়া লইবে।

 ১৩০০ আষাঢ়