বিচিত্র প্রবন্ধ/চিঠির টুক্রি
চিঠির টুক্রি
সেই পাগল কবি বেচারা দিন তিনেক এখানে ছিল। কথায়বার্ত্তায় হঠাৎ তাকে পাগল ব’লে চেনা যায় না। একটুখানির জন্যে ওর তার ছিঁড়ে গেছে অথচ হয়তো ওর যন্ত্রটি ভালো ক’রেই গড়া ছিল। আমাদের সকলের মধ্যেই একটা পাগল আছে, সে আমাদের সব দেখা ও ভাবার মধ্যে নিজের খেয়ালী রং মিশিয়ে দেয়, আমাদের ছবির মধ্যে নিজের তুলি বুলোয়, আমাদের গানের মধ্যে নিজের সুর লাগিয়ে বসে। ফলের মধ্যে আঁঠির কর্ত্তা হচ্চেন জ্ঞানী, তিনি তাকে পাকা রকমে পাহারা দেন, আর ফলের মধ্যেকার পাগল ব’সে ব’সে খামকা তার খোসার উপর রং মাখায়, যে-খোসা ফেলে দিতে হবে; তার শাঁসের মধ্যে রসের সাধনা করে যে-শাঁস দুদিনে যাবে নষ্ট হয়ে; তাতে পাগলের খেয়াল নেই। যে-পাগলের তুলি রং দিতে গিয়ে খোঁচা দিয়ে বসে, তাকে নিয়েই বিপদ। জীবনের মধ্যে পাগলের খোঁচা সম্পূর্ণ এড়ানো চলে না—এড়াতে পারলে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে দিনে ঘুমিয়ে তাসপাশা খেলে নিরাপদভাবে সংসারযাত্রা ক’রে নাতিনাৎনীর মুখ দেখে কোম্পানীর কাগজ জমিয়ে আয়ুটিকে বায়ুর ধাক্কা থেকে বাঁচিয়ে চলা যেতে পারত। সে আর হয়ে উঠল না।
কিছু খবর দেবার চেষ্টা করব। নইলে চিঠি বেশি ভারি হয়ে পড়ে। অনেকদিন থেকে চিঠিতে খবর চালান দেবার অভ্যাস চলে গেছে। এটা একটা ক্রটি। কেননা আমরা খবরের মধ্যেই বাস করি। যদি তোমাদের কাছে থাকতুম তাহোলে তোমরা আমাকে নানাবিধ খবরের মধ্যেই দেখতে, কী হোলো এবং কে এল এবং কী করলুম এইগুলোর মধ্যে গেঁথে নিয়ে তবে আমাকে স্পষ্ট ধরতে পারা যায়। চিঠির প্রধান কাজ হচ্ছে সেই গাঁথন সূত্রটিকে যথাসম্ভব অবিচ্ছিন্ন ক’রে রাখা। আমি যে বেঁচে বর্ত্তে আছি সেটা হোলো একটা সাধারণ তথ্য—কিন্তু সেই আমার থাকার সঙ্গে আমার চারিদিকের বিচিত্র যোগবিয়োগের ঘাতপ্রতিঘাতের দ্বারাই আমি বিশেষভাবে প্রত্যক্ষগোচর। এইজন্যেই চিঠিতে খবর দিতে হয়—দূরে থাকলে পরস্পরের মধ্যে সেই প্রত্যক্ষতাকে চালাচালি করবার দরকার হয়। প্রয়োজনটা বুঝি কিন্তু সত্যিকার চিঠি লেখার যে আর্ট সেটা খুইয়ে বসে আছি। তার কারণ হচ্ছে কাছে থাকলে তুমি আমাকে আমার চারিদিকের নব নব ব্যাপারের সঙ্গে মিলিয়ে যেমন ক’রে দেখতে, আমি নিজেকে তেমন ক’রে দেখিনে। অন্যমনস্ক স্বভাবের জন্যে আমি চারিদিককে বড়ো বেশি বাদ দিয়ে দেখি। সেইজন্যে যা ঘটে তা পরক্ষণেই ভুলে যাই—ঐতিহাসিকের মতো ঘটনাগুলোকে দেশকালের সঙ্গে গেঁথে রাখতে পারিনে। তার মুস্কিল আছে। তোমরা কেউ যখন আমার সম্বন্ধে কোনো নালিশ উপস্থিত করে তখন তোমাদের পক্ষের প্রমাণগুলোকে বেশ সুসম্বদ্ধ সাজিয়ে ধরতে পারো—আমার পক্ষের প্রমাণগুলো দেখি আমার আনমনা চিত্তের নানা ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি কেবল আমার ধারণা উপস্থিত করতে পারি। কিন্তু ধারণা জিনিষটা বহুবিস্তৃত প্রমাণের সম্মিলনে তৈরী। সে প্রমাণগুলোকে সপিনে দিয়ে সাক্ষ্যমঞ্চে আনা যায় না। যাদের ধারণাগুলো শনিগ্রহের মতো বহু প্রমাণমণ্ডলের দ্বারা সর্ব্বদাই পরিবেষ্টিত তাদের ধারণার সঙ্গে আমার ধারণার ঠোকাঠুকি হোলে আমার পক্ষেই দুর্ব্বিপাক ঘটে।
আমার মনটা স্বভাবতই নদীর ধারার মতো, চলে আর বলে একসঙ্গেই,—বোবার মতো অবাক হয়ে বইতে পারে না। এটা যে ভালো অভ্যাস তা নয়। কারণ মুছে ফেলবার কথাকে লিখে ফেললে তাকে খানিকটা স্থায়িত্ব দেওয়া হয়—যার বাঁচবার দাবী নেই সেও বাঁচবার জন্যে লড়তে থাকে। ডাক্তারী শাস্ত্রের উন্নতির কল্যাণে অনেক মানুষ খামকা বেঁচে থাকে প্রকৃতি যাকে বাঁচবার পরোয়ানা দিয়ে পাঠাননি—তারা জীবলোকের অন্ন ধ্বংস করে। আমাদের মনে যখন যা উপস্থিত হয় তার পাসপোর্ট বিচার না ক’রেই তাকে যদি লেখনরাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হয় তাহোলে সে গোলমাল ঘটাতে পারে। যে কথাটা ক্ষণজীবী তাকেও অনেকখানি আয়ু দেবার শক্তি সাহিত্যিকের কলমে আছে, সেটাতে বেশি ক্ষতি হয় না সাহিত্যে। কিন্তু লোক-ব্যবহারে হয় বই কি। চিন্তাকে আমি তাড়াতাড়ি রূপ দিয়ে ফেলি—সব সময়ে সেটা অযথা হয় তা নয়—কিন্তু জীবনযাত্রায় পদে পদে এই রকম রূপকারের কাজের চেয়ে চুপকারের কাজ অনেক ভালো। আমি প্রগল্ভ, কিন্তু যারা চুপ করতে জানে তাদের শ্রদ্ধা করি। যে-মনটা কথায় কথায় চেঁচিয়ে কথা কয় তাকে আমি এখানকার নির্ম্মল আকাশের নিচে গাছতলায় ব’সে চুপ করাতে চেষ্টা করছি। এই চুপের মধ্যে শান্তি পাওয়া যায়, সত্যও পাওয়া যায়। প্রত্যেক নূতন অবস্থার সঙ্গে জীবনকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানা জায়গায় ঘা লাগে—তখনকার মতো সেগুলো প্রচণ্ড—নতুন চলতে গিয়ে শিশুদের প’ড়ে যাওয়ার মতো—তা নিয়ে আহা উহু করতে গেলেই ছেলেদের কাঁদিয়ে ভোলা হয়—বুদ্ধি যার আছে সে এমন জায়গায় চুপ ক’রে যায়—কেননা সব-কিছুকেই মনে-রাখা মনের শ্রেষ্ঠ শক্তি নয়, ভোলবার, জিনিষকে ভুলতে দেওয়াতেও তার শক্তির পরিচয়।
আমার চিঠি লেখার বয়স চলে গেছে—এখন দু’লাইন চিঠি লেখার চেয়ে গাড়ি ভাড়া ক’রে বাড়িতে গিয়ে বলে আসা অনেক সহজ বোধ হয়। কলমের ভিতর দিয়ে কথা কইতে গেলে কথার প্রাণগত অনেকটা অংশ এদিক ওদিক দিয়ে ফ’সকে যায়—যখন মনের শক্তি প্রচুর থাকে তখন বাদ সাদ দিয়েও যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকে—তাই তখন লেখার বকুনিতে অভাবের লক্ষণ দেখা যায় না। এখন বাণী সহজে বকুনিতে উছ্লে উঠতে বাধা পায়—তাই কলমের ডগায় কথার ধারা ক্ষীণ হয়ে আসে, বোধ হয় এইজন্যেই লেখবার দুঃখ স্বীকার করতে মন রাজি হয় না।
তা হোক্ গে, তবু তোমাকে কিছু বলা যাক। কোনো ঘটনার বিবরণ নয়, নিছক ভিতরের কথা। অন্তর অন্তরীক্ষের মেঘ ও রৌদ্রের লীলা। সময় অনুকূল নয়, নানা চিন্তা, নানা অভাব, নানা আঘাত সংঘাত। ক্ষণে ক্ষণে, ভিতরে ভিতরে অবসাদের ছায়া ঘনিয়ে আসে, একটা পীড়ার হাওয়া মনের একদিক থেকে আর-একদিকে হুহু ক’রে বইতে থাকে। এমন সময় চ’মকে উঠে’ মনে পড়ে যায় যে এ ছায়াটা “আমি” ব’লে একটা রাহুর। সে রাহুটা সত্য পদার্থ নয়। তখন মনটা ধড়ফড় ক’রে চেঁচিয়ে উঠে’ ব’লে ওঠে-ও নেই ও নেই। দেখতে দেখতে মন পরিস্কার হয়ে যায়। বাড়ির সামনের কাঁকর-বিছানো লাল রাস্তায় বেড়াই আর মনের মধ্যে এই ছায়া-আলোর দ্বন্দ্ব চলে। বাইরে থেকে যারা দেখে তার। কে জানবে ভিতরে একটা সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। এ সৃষ্টির কি আমারই মনের মধ্যে আরম্ভ আমারই মনের মধ্যে অবসান? বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে এর কি কোনো চিরন্তন যোগসূত্র নেই? নিশ্চয়ই আছে। জগৎ জুড়ে’ অসীম কাল ধ’রে একটা কী হয়ে উঠছে, আমাদের চিত্তের মধ্যে বেদনায় বেদনায় তারি একটা ধাক্কা চল্ছে। ব্যক্তিগত জীবনে সুখ দুঃখ লাভ ক্ষতি বিচ্ছেদ মিলন নিয়ে যে সব বিশেষ ঘটনার ধারা বয়ে চলে গেল কয়েক বছর পরে কোথাও তার কোনো চিহ্নই থাকবে না-ঝঞ্চামথিত সমুদ্রের ‘পরে ফেনাগুলোর যেমন কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না। তরুণ পৃথিবীতে আগুন জল হাওয়ার যে প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা চলেছিল সে নৃত্যলীলার নাট্যমঞ্চ আজ একেবারেই নেই—কিন্তু সেই নৃত্যলীলারই চরণ পাতে আজকেকার পৃথিবীর প্রাণনিকেতন তৈরি হয়ে উঠেছে—সৃষ্টির উপকরণ ও প্রকরণ বদল হোলো কিন্তু সৃষ্টি রইল। মনের উপর দিয়ে নানা ঘটনার ধাক্কা নানা অবস্থার আলোড়ন তুফান তুলে যায় আজ বাদে কাল তা’রা থাকে না কিন্তু সেই ধাক্কায় যেখানেই এই “আমির” ঘন আবরণ ছিন্ন হয়ে যায় সেইখানেই সত্যের কোনো একটা চিরন্তন রূপসৃষ্টির প্রকাশ হোতে থাকে—আমি তার উপলক্ষ্য মাত্র। সভ্যতার ইতিহাসধারায় মানুষ আজ যে অবস্থার মধ্যে এসে উত্তীর্ণ হয়েছে—এই অবস্থাসৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যে কত কোটি কোটি নামহীন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের চিরবিস্মৃত চিত্তসংঘাত আছে। সৃষ্টির যা-কিছু রয়ে-যাওয়া তা সংখ্যাহীন চলে-যাওয়ার প্রতিমুহূর্ত্তের হাতের গড়া। আজ আমার এই জীবনের মধ্যে সৃষ্টির সেই দূতগুলি, সেই চলে-যাওয়ার দল তার কাজ করছে—“আমি” ব’লে পদার্থটা উপলক্ষ্য মাত্র-বাড়ি তৈরির সময় যে-ভারা বাঁধা হয় তা ভারা মাত্র—আজকের দিনে এর প্রয়োজনীয়তার প্রাধান্য যতই থাক্ কালকের দিনে যখন এর চিহ্ন মাত্র থাকবে না তখন কারো গায়ে একটুও বাজবে না। ইমারত আপন ভারার জন্যে কোথাও শোক করে না, তার জন্যে সমাধি-মন্দির স্থাপন করে না। মোদ্দা কথাটা এই যে, আজ আমার এই “আমি”-টাকে নিয়ে যে-গড়া-পেটা চলছে, এই লাল কাঁকর বিছানো রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে ভিতবে ভিতরে যা-কিছু উপলব্ধি করছি তার অনেকখানিই আমার নামের স্বাক্ষর মুছে ফেলে দিয়ে মানুষের সৃষ্টিভাণ্ডারে জমা হচ্ছে। এই কথা মনে রেখে ক্ষণিকের আঘাত বেদনাকে যেন তুচ্ছ করতে পারি। মনে যেন রাখি চিরমানব আমার মধ্যে তপস্যা করছেন-তপস্যার দ্বারাই সৃষ্টি হয়। সেই তপস্যার আগুনে আমার এই “আমি”-ইন্ধন ছাই হয়ে যাক্ না, তাতে ক্ষতি কী? কিন্তু তার অন্তরের দান সবটাই ব্যর্থ হবে না।
* * * বৃষ্টি ধরে গেছে, মেঘও গেছে স’রে—চারিদিকে সরস সবুজের চিকণ আভা—একেবারে ঝলমল করছে—বাঙ্গালোরের সেই সবুজ সিল্কের সাড়িতে যেন সোনালি সূতোর কাজ করা। একটু একটু হাওয়া দিচ্চে। এখন বেলা দুটো। কেয়াফুলের গন্ধ আসছে টেবিলের একপাশে কে রেখে দিয়েছে। এই বর্ষাদিনের দুপুর-বেলাকার রোদ্দুর ঈষৎ আর্দ্র, তারপরে যেন তার আবেশ আছে; সামনের আকন্দগাছে ফুল ধরেছে, তারই উপরে গোটাকতক প্রজাপতি কেবল ঘুরঘুর ক’রে বেড়াচ্চে—কোথাও কোনো শব্দটিমাত্র নেই—চাকরবাকর আহারে বিশ্রামে রত-ছুতোর মিস্ত্রির দল এখনো কাজ করতে আসেনি, মাঝে মাঝে কেবল পাশের ঘর থেকে এক-একবার কার কাশি শুনতে পাচ্চি। বসে বসে কোনো একটা খেয়ালের কাজ করতে ইচ্ছে করছে—এই “রৌদ্র মাখানো অলস বেলায়” গুন্ গুন্ করতে কিম্বা সৃষ্টিছাড়া ধরণের ছবি আঁকতে—অথচ কোনোটাই করা হবে না—সহজ ইচ্ছেগুলোরই সহজে পূরণ হয় না। আমার ক্লান্তিভরা কুঁড়েমির ডিগ্রিটা অতটুকু কাজ করারও নিচে। সেই আমার গদিওয়ালা মোটা কেদারাটাকে নামিয়ে এনেছি—দক্ষিণের জানালার কাছে ঐটের মধ্যেই এখনি আমার কৈবল্যপ্রাপ্তি হবে ব’লে মনে হচ্চে।
আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন, কিছুদিন থেকে বৃষ্টির অভাব ঘটাতে তরুণ ধানের ক্ষেত পাণ্ডুবর্ণ,তারা বিদায়কালীন বর্ষার দানের জন্যে উৎসুক হয়ে আকাশে চেয়ে আছে। মেঘের কৃপণতা নেই কিন্তু বাতাস হয়েছে অন্তরায়। যেই বৃষ্টির আয়োজন প্রায় পূর্ণ হয়ে ওঠে অমনি কুমন্ত্রীর মতো প্রতিকূল হাওয়া কী যে কানে মন্ত্র দেয় উপরিওয়ালার সমস্ত পলিসি যায় ব’দ্লে। আকাশের পার্লামেণ্টে কয়েকদিন ধ’রে আশা নৈরাশ্যের debate চল্ছে—আজ বোধ হচ্চে যেন বাজেট পাস হয়ে গেছে—বর্ষণ হোতে বাধা ঘটবে না। খুব ঝমাঝম যদি বৃষ্টি নামে—তাহোলে চমৎকার লাগবে—এ বৎসরটা আমার কপালে বাদলের সম্ভোগটা মারা গেছে—জোড়াসাঁকোর গলি জলে ভেসে গেছে কিন্তু মনের মধ্যে বর্ষার মৃদঙ্গ নাচের তাল লাগায়নি। এবারকার বর্ষায় গান হলো না—এমন কার্পণ্য আমার বীণায় অনেকদিন ঘটেনি।
বর্ষা, শেষ পর্য্যন্ত তার আকাশের সিংহাসন আঁকড়ে রইল, মাঝে মাঝে দু’চারদিন ফাঁক পড়েছে—হোলির রাত্রে হিন্দুস্থানীর দল ক্ষণকালের জন্য যেমন তাদের মাদোল পিটুনিতে ক্ষান্ত দেয়, সেই রকম, তারপরেই আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কোলাহল সুরু করে। এমনি করতে করতে শরতের মেয়াদ ফুরিয়ে গেল-হেমন্ত এসে হাজির। ধরাতলে শিউলি মালতী বর্ষার অভ্যর্থনার আয়োজন যথেষ্ট করেছে, কিন্তু আকাশতলে দেবতা পথ আট্কে ছিলেন। শীতের বাতাস সুরু হয়েছে, গায়ে গরম কাপড় চড়িয়েছি। ভালোই লাগ্ছে—বিশেষত বেলা দশটার পর থেকে প্রান্তরের উপর যখন পৃথিবীর রোদ পোহাবার সময় আসে-নির্ম্মল আকাশে একটা ছুটির ঘোষণা হোতে থাকে—পথ দিয়ে পথিকেরা চলে, মনে হয় যেন ছবি রচনায় সাহায্য করবার জন্যেই, তাদের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি প্রায় প্রত্যেক চিঠিতেই আমার এই চেয়ে দেখার বিবরণটা লিখি। পৃথিবী কিছুতেই আমার কাছে পুরানো হোলো না—ওর সঙ্গে আমার মোকাবিলা চল্ছে এইটেই আমার সব খবরের চেয়ে বড়ো খবর।
আমার এখানকার সব প্রধান দৈনিক খবর হচ্ছে ছবি আঁকা। রেখার মায়াজালে আমার সমস্ত মন জড়িয়ে পড়েছে। অকালে অপরিচিতার প্রতি পক্ষপাতে কবিতা একেবারে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। কোনোকালে যে কবিতা লিখ্তুম সে কথা ভুলে গেছি। এই ব্যাপারটা মনকে এত ক’রে যে আকর্ষণ করছে তার প্রধান কারণ এর অভাবনীয়তা। কবিতার বিষয়টা অস্পষ্টভাবেও গোড়াতেই মাথায় আসে, তার পরে শিবের জটা থেকে গোমুখী বেয়ে যেমন গঙ্গা নামে তেমনি ক’রে কাব্যের ঝরনা কলমের মুখে তট রচনা করে, ছন্দ প্রবাহিত হতে থাকে। আমি যে সব ছবি আঁকার চেষ্টা করি তাতে ঠিক তার উল্টো প্রণালীরেখার আমেজ প্রথমে দেখা দেয় কলমের মুখে তারপরে যতই আকার ধারণ করে ততই সেটা পৌঁছতে থাকে মাথায়। এইরূপ সৃষ্টির বিস্ময়ে মন মেতে ওঠে। আমি যদি পাকা আর্টিস্ট্ হতুম তাহোলে গোড়াতেই সঙ্কল্প ক’রে ছবি আঁকতুম, মনের জিনিষ বাইরে খাড়া হোত—তাতেও আনন্দ আছে। কিন্তু বাইরের রচনায় মনকে যখন আবিষ্ট করে তখন তাতে আরো যেন বেশি নেশা। ফল হয়েছে এই যে, বাইরের আর সমস্ত কাজ দরজার বাইরে এসে উঁকি মেরে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চে। যদি সেকালের মতো কর্ম্মদায় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাক্তুম-তাহোলে পদ্মার তীরে ব’সে কালের সোনার তরীর জন্যে কেবলি ছবির ফসল ফলাতুম—এখন নানা দায়ের ভিড় ঠেলে ওর জন্যে অল্পই একটু জায়গা করতে পারি—তাতে মন সন্তুষ্ট হয় না-ও চাচ্চে আকাশের প্রায় সমস্তটাই, আমারো দিতে আগ্রহ—কিন্তু গ্রহদের চক্রান্তে নানা বাধা এসে জোটে জগতের হিতসাধন তার মধ্যে সর্ব্বপ্রধান।
এতদিনে আমাদের মাঠের হাওয়ার মধ্যে শীত এসে পৌঁছল। এখন তার সব গাঁঠরি খোলা হয়নি। কিন্তু আকাশে তাঁবু পড়েছে। বাতাসে ঘাসগুলো গাছের পাতাগুলো একটু একটু সির্ সির্ করতে আরম্ভ করল। তরুণ শীতের এই আমেজটায় কঠোরে কোমলে মিশোল আছে। সন্ধ্যাবেলায় বাইরে বসি কিন্তু ঘরের ভিতরকার নিভৃত আলোটি পিছন থেকে মৃদুস্বরে ডাক দিতে থাকে—প্রথমে গায়ের কাপড়টা একটু ভাল ক’রে জড়িয়ে নিই, তার খানিকটা পরে মনটা উঠিউঠি করে—অবশেষে ঘরে ঢুকে কেদারাটায় আরাম ক’রে ব’সে মনে হয় এটুকুর দরকার ছিল। এখন দুপুর বেলায় মেঘমুক্ত আকাশের রোদ্দুর সমস্ত মাঠে কেমন যেন তন্দ্রালসভাবে এলিয়ে রয়েছে; সামনে ঐ দুটো বেঁটে পরিপুষ্ট জামগাছ পূর্ব্ব উত্তরদিকে ঘাসের উপর এক-এক পোঁচ ছায়া টেনে দিয়েছে। আজ ওখানে একটিও গরু নেই, সমস্ত মাঠ শূন্য, সবুজ রঙের একটা প্রলেপ আছে কিন্তু তার প্রাচুর্য্য অনেক কম। ঐ আমাদের টগর বীথিকার গাছগুলি রোদ্দুরে ঝিলিমিলি এবং হাওয়ায় দোলাদুলি করছে। বাতাস এখনও তেতে উঠল না। নিঃশব্দতার ভিতরে ঐ রাঙা রাস্তায় গরুর গাড়ীর একটা আর্ত্তস্বর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্চে—আর, কী জানি কী সব পাখীর অনির্দ্দিষ্ট ক্ষীণ আওয়াজ যেন নীরবতার সাদা খাতায় সরু সরু রেখায় ছেলেমানুষি হিজিবিজি কাট্ছে। আনি না, কেন আমার মনে পড়ছে বহুকাল আগে সেই যে হাজারিবাগে গিয়েছিলুম—ডাকবাংলার সাম্নের মাঠে হাতাওয়ালা কেদারায় আমি অর্দ্ধশয়ান, রোদ্দুর পরিণত হয়ে উঠেছে, কাজকর্ম্মের বেলা হোলো— মাঝে মাঝে অনতিদুরে ঘণ্টা বাজে। সেই ঘণ্টার ধ্বনি ভারি উদাস। আজ হাটের দিনে হাট ক’রে পথিকরা রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরে চলেছে, কারো বা মাথায় পুঁটুলি, কারো বা কাঁধে বাঁক। আর সেই ঘণ্টার ধ্বনি যেন আকাশে নীরবে বাজছে, মূলতানে বলছে—বেলা যায়।
যারা স্বভাবতই কুঁড়ে তাদের যখন কাজে কিম্বা অকাজে পায় তখন তাদের টিকি দেখবার জো থাকে না। পদ্মার এক পাড়িতে যেমন নিচু বালির চর, অন্য পাড়িতে উঁচু ডাঙা এবং লোকালয়—ইদানীং আমার জীবনস্রোতে সেই দশ—একই সঙ্গে তার এক পারে অত্যন্ত বাজে কাজ—মাইল মাইল ধ’রে—যেটা হচ্ছে ছবি আঁকা; অন্যপারে রীতিমতো কেজো কাজ। অর্থাৎ এর একদিকটা দায়িত্ববিহীন আকাশ এবং আলো এবং বর্ণ বিভঙ্গীআর একটা দিক, লোকযাত্রা ও তার সংখ্যাহীন দায়িত্ব। ছবি আঁকাটাও কাজ তারই পক্ষে, যে সত্যি আর্টিস্ট, আমার পক্ষে ওটা মাৎলামি। মাৎলামিতে ভদ্রতা থাকে না, জীবনযাত্রার নিত্যকৃত্যগুলো একেবারেই ঝাপসা হয়ে যায়,—সময়ের উপর একটা প্লাবনের মতো বইতে থাকে—তার পরে যেই সেটা উত্তীর্ণ হয়ে যায় অমনি দেখা যায় তার পথে পথে সব নুড়ি সাজানো—তাতে কারো কোনো কাজ হয় না। এটা খামখেয়ালী সৃষ্টিকর্ত্তার নিছক ছেলেমানুষী, সময়ের যিনি অধীশ্বর তিনি মাঝে মাঝে এই রকম কোমর বেঁধে সময় নষ্ট করেন—এ সম্বন্ধে তাঁর লজ্জা নেই, কারো কাছে কোনো জবাবদিহী স্বীকার করেন না। অথচ এর বন্যাবেগ তাঁর প্রাত্যহিক কেজো কাজের ধারার চেয়ে অনেক বেশি প্রবল। বিধাতার সেই ছেলেমানুষী যখন মানুষের চিত্তে আবির্ভূত হয় তখন তার কাছ থেকে চিঠির উত্তর প্রত্যাশা করা মিথ্যে।
যখন দূরে যাত্রা করবার সময় আসে তখন খোঁটা ওপড়ানো ও রসি টেনে ছেঁড়া এত কঠিন হয়ে ওঠে। মানুষ যখন বাড়ি তৈরি করে তখন নিজেকে মনে মনে আপন সুদুর ভাবীকালে বিস্তার করে দেয়—যে কালের মধ্যে তার নিজের স্থান নেই। তাই পয়লা নম্বরের ইঁট ও সেরামার্কার দামী সিমেণ্ট ফরমাস করে—তার নিজের ইচ্ছের কঠিন স্তূপটাকে উত্তরকালের হাতে দিয়ে যায়, সেই কাল সেটার গ্রন্থি শিথিল করতে লেগে যায় নয়তো নিজের চলতি ইচ্ছের সঙ্গে সেই স্থাবর ইচ্ছেটার মিল করবার জন্যে নানাপ্রকার কসরৎ করতে থাকে। বস্তুত মানুষের বাস করা উচিত সেই তাঁবুতে যে তাঁবুর ভিৎ মাটিকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে না এবং পাথরের দেয়াল উঁচিয়ে মুক্ত আকাশকে মুষ্টিঘাত করতে থাকে না। আমাদের দেহটাই যে আল্গা বাসা, আমাদের যাযাবর আত্মার উপযোগী, ত্যাগ করবার সময় এলে সেটাকে কাঁধে ক’রে নিয়ে যেতে হয় না। এইজন্যেই আমি তোমাকে অনেকবার পরামর্শ দিয়েছি ইঁটকাঠের বাঁধন দিয়ে অচল ডাঙার উপরে বাড়ি তৈরি কোরো না—স্রোতের উপর সচল বাসার ব্যবস্থা কোরো—যখন স্থির থাক্তে চাও একটা নোঙর নামিয়ে দিলেই চলবে—আবার যখন চলতে চাও তখন নোঙরটা টেনে তোলা খুব বেশি কঠিন হবে না। আমাদের কালস্রোতে-ভাসা জীবনের সঙ্গে বাসাগুলোর সামঞ্জস্য থাকে না ব’লেই টানাহেঁচড়ায় পদে পদে দুঃখ পেতে হয়। আমাদের বাসাগুলোর মধ্যে দুটো তত্ত্বই থাকা চাই স্থাবর এবং জঙ্গম। থাক্বার বেলা থাক্তে হবে ফেল্বার বেলা ফেলতে হবে আত্মার সঙ্গে দেহের সম্বন্ধের মতো। এ সম্বন্ধ সুন্দর কারণ এটা ধ্রুব নয়। সেইজন্য নিয়তই দেহের সঙ্গে দেহীর বোঝাপড়া করতে হয়। সাধনার অন্ত নেই। এর বেদনা এর আনন্দ সমস্তই অধ্রুবতার স্রোত থেকেই আবর্ত্তিত হয়ে উঠছে—এর সৌন্দর্য্যও সকরুণ, তার উপরে মৃত্যুর ছায়া। কালের এবং ভাবের, পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এর পরিবর্ত্তন চলেইছে।—
সংসারে আমাদের সব বাসাই এমনি হওয়াই ভালো।
আমার ধ্যান যে রূপকে আশ্রয় করেছে পরের হাতে নিজেকে বেচবার জন্যে সে যেন সেজেগুজে লোভনীয় হয়ে বসে না থাকে, নিজেকে সম্পূর্ণ ক’রে তারপরে অন্যকালের অন্য লোকের তপস্যাকে ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিয়ে যেন একেবারেই সরে দাঁড়ায়। নইলে কালের পথ রোধ করতে চেষ্টা করলে তার দুর্গতি ঘটতে বাধ্য। টাকার জোরে আমরা আমাদের ধ্যানের রূপটাকে বেঁধে দিয়ে যেতে ইচ্ছা করি। তার মধ্যে অন্য পাঁচজনের ধ্যান যখন প্রবেশ করতে চেষ্টা করে তখন সেটা বেখাপ হোতেই হবে। আমার উচিত ছিল বিশ্বভারতীর সম্পূর্ণতা সাধনের জন্যে বিশ্বভারতীর শেষ টাকা ফুঁকে দিয়ে চলে যাওয়া। তারপরে নতুন কাল নিজের সম্বল ও সাধনা নিয়ে নিজের ধ্যানমন্দির পাকা করুক। আমার সঙ্গে যদি মেলে তো ভালো যদি না মেলে তো সেও ভালো। কিন্তু এটা যেন ধার-করা জিনিষ না হয়। প্রাণের জিনিষে ধার চলে না—অর্থাৎ তাতে প্রাণবান কাজ হয় না—আমগাছ নিয়ে তক্তপোষ করা চলে কিন্তু কাঁঠালব্যবসায়ী তা নিয়ে কাঁঠাল ফলাতে চেষ্টা যেন না করে, এর ভিতরকার কথাটা হচ্চে ‘মা গৃধঃ’।
আমি যে কথাটা বলতে বসেছিলুম সেটা এ নয়। তোমরা তাঁবুতে থাক্বে কিম্বা নৌকোতে থাক্বে সে পরামর্শ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার হাল খবরটা হচ্ছে এই যে, কাল যখন জাহাজে চড়েছিলুম তখন মনটা তার নতুন দেহ না পেয়ে থেকে-থেকে ডাঙা আঁকড়ে ধরছিল কিন্তু তাহার দেহান্তর প্রাপ্তি ঘটেছে। তবুও নতুন দেহ সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে কিছু দিন লাগে, কিন্তু খুব সম্ভব কাল থেকেই লেক্চার লিখতে বসতে পারব। সেটাকে বলা যেতে পারে সম্পূর্ণ নতুন ঘরকন্না পাতানো। যে পার ছেড়ে এলুম সে পাড়ের সঙ্গে এর দাবী দাওয়ার সম্পর্ক নেই। এর ভাষাও স্বতন্ত্র। বাজে কথা গেল। এবার সংবাদ শুন্তে চাও। আজ সকাল সাতটা পর্য্যন্ত অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলুম। ক্লান্তি যেন অজগর সাপের মতো আমার বুক পিঠ জড়িয়ে ধ’রে চাপ দিচ্ছিল। তারপর থেকে নিজেকে বেশ ভদ্রলোকেরই মতো বোধ হচ্চে। যুগল ক্যাবিনের অধীশ্বর হয়ে খুসি আছি। পূব ক্যাবিনে দিন কাটে পশ্চিম ক্যাবিনে রাত্রি অর্থাৎ আমার আকাশের মিতার পন্থা অবলম্বন করেছি—পূর্ব্বদিগন্তে ওঠা পশ্চিমদিগন্তে পড়া। আমার সহচরত্রয় ভালোই আছে—ত্রিবেণীসঙ্গমের মতো উত্তর প্রত্যুত্তর হাস্য প্রতিহাস্যের কলধ্বনি তুলে তাদের দিন বয়ে চলেছে। আমি আছি ঘরে, তারা আছে বাইরে। আমার অভিভাবক স্থানীয় সঙ্গীটি মনে করছে এখানে আমার যা-কিছু সুযোগ সুবিধা সমস্তই তার নিজের ব্যবস্থার গুণে। আমি তার প্রতিবাদ করিনে—প্রতিবাদের অভ্যাসটা খারাপ—স্থানবিশেষে সংসারে ছোটো ছোটো অসত্যকে যারা মেনে নিতে পারে না, তারা অশান্তি ঘটায়। এই জন্যেই ভগবান মনু বলেছেন—সে কথা থাক্।
জাহাজ জিনিষটাই আগাগোড়া চলে, কিন্তু আর সব চলাকেই সে সীমাবদ্ধ ক’রে রেখেছে। এই বাসাটুকুর বেড়ার মধ্যে সময়ের গতি অত্যন্ত মন্দবেগে। সময়ের এই মন্দাক্রান্তা ছন্দে যে সব ঘটনা অত্যন্ত প্রধান হয়ে প্রকাশ পায় অন্যত্র ছন্দের বেগে সেগুলো চোখেই পড়তে চায় না। এই মুহূর্ত্তেই ডাঙার মানুষ যে সব খেলা খেল্ছে তা প্রচণ্ড খেলা-জীবনমরণ নিয়ে ছোড়াছুড়ি। এখানে দুই পক্ষের খেলোয়াড় বিড়ে নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। তাতেই উৎসাহ উত্তেজনার অন্ত নেই। এই সব দেখ্লে একথা স্পষ্ট ক’রেই বোঝা যায় যে স্থানান্তরকে লোকান্তর বলে না। বিশেষ বিশেষ বেড়া বেঁধে সময়ের গতির মধ্যে পরিবর্ত্তন ঘটিয়ে আমাদের জগতের বিশেষত্ব ঘটাই। তার মানেই হচ্চে ছন্দ বদল হোলেই রূপের বদল হয়। আমি এবং আমার প্রতিবেশী ইংরেজ এক জায়গায় বাস করি কিন্তু এক জগতে নয়। তার মানে তার জীবনে কালের ছন্দ আমার থেকে স্বতন্ত্র। সেই জন্যেই তার খেলার সঙ্গে আমার খেলার তাল মেলে না। আমি ঠেলা গাড়িতে চল্ছি, সে মোটরে চল্ছে—আমাদের উভয়ের সময়ের পরিমাণ এক, ছন্দ আলাদা। বস্তুত এক হোলেও ঝাঁপতালে এবং টিমেতেতালায় তার মূল্য সম্পূর্ণ বদ্লে দেয়। মানুষে মানুষে সুরের ঐক্য থাক্তেও পারে; সব চেয়ে বড়ো অনৈক্য তালের। তালের দ্বারা জীবনের ঘটনাগুলোকে ভাগ করে, সাজায়, বিশেষ বিশেষ জায়গায় ঝোঁক দেয়। একেই বলে সৃষ্টি। জগৎ জুড়ে এই ব্যাপার চল্ছে। মহাকালের মৃদঙ্গ এক-এক তাণ্ডব-ক্ষেত্রে এক-এক তালে বাজছে, সেই নৃত্যের রূপেই রূপের অসংখ্য বৈচিত্র্য। আমার জীবনের নটরাজ আমার মধ্যে যে নাচ তুলেছেন, সে আর কোথাও নেই, কোনো জীবনচরিতের পটে এর সম্পূর্ণ ছবি উঠ্বে কী ক’রে? কোনো কালেই উঠ্বে না। আমাদের আটিষ্ট যা গড়েন—তার নব নব সংস্করণ ঘট্তে দেন না, সাজানো টাইপ ভেঙে ফেলেন—অতএব রবীন্দ্রনাথ নিরবধিকালের চয়নিকায় একবার ধরা দেয়, তারপর তাকে ফেলে দেয়—অনন্তকালে আর রবীন্দ্রনাথ নেই। হয়তো পরকালে আর একটা ধারা চল্তে পারে, কিন্তু তার এ নাম নয়, এ রূপ নয়, এ পরিবেশ নয়, এ সমাবেশ নয়; সুতরাং রবীন্দ্রনাথের পালা এইখানেই চিরকালের মতো চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। আর যাই হোক্ বিশ্বসভায় কারো মেমোরিয়াল মিটিং হয় না। হয় কেবল আগমনী এবং বিসর্জ্জন। আজ রাত্রে পিনাঙ।
চলেছি, নতুন নতুন মেয়েপুরুষের সঙ্গে আলাপ চলেছে। আলাপ জম্তে না জম্তে আবার ঘাটে ঘাটে মানুষ বদল হচ্চে। অর্থাৎ দিনের পর দিন যাদের নিয়ে সময় কাট্ছে তারা যেন এমন জীব যাদের ভিতরটা নেই কেবল উটা আছে—যা ধাঁ করে চোখে পড়ে; মনের উপর ছায়া ফেলে সেইটুকু মাত্র। কেদারার পিঠে তাদের নামের ফলক ঝুল্ছে, আর তারা কেদারার উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে, তারা আর কোথাও নেই কেবল ঐটুকুর উপরে। আমার সঙ্গে কেবল তিন জন মাত্র মানুষ আছে যারা জায়গা ওদের চেয়ে বেশি জোড়ে না, কিন্তু যারা অনেকখানি,—যাদের সত্যতা, দৃশ্য অদৃশ্য বহু সাক্ষ্যের দ্বারা আমার মনের মধ্যে চারদিক থেকে প্রমাণীকৃত—এই জন্যে যাদের কাছ থেকে অনেক খানি পাই এবং যারা সরে গেলে অনেকখানি হারাই—যারা তাসের উপরকার ছবির মত একতলবর্ত্তী নয়—যাদের মধ্যে পূর্ণায়তন জগতের পরিচয়। পূর্ণায়তন জগতেই বাস্তবতার স্বাদ পাওয়া আমাদের অভ্যাস তার চেয়ে কম পড়লে দুধের বদলে এক বাটি ফেনা খাবার চেষ্টা করার মতো হয়। যতটা চুমুক দিলে আমার জানার পূরো স্বাদ পাই এই জাহাজভরা যাত্রীদের মধ্যে তা পাবার জো নেই। এই কারণে আমাদের পেট ভরে জানার অভ্যাস পীড়িত হচ্ছে। কিছুদিনের উপবাসে ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশিদিন এমন অত্যল্প জানার খোরাকে চলে না। আত্মীয়ের মধ্যে আমাদের জানার ভরপুর খোরাক মেলে ব’লেই তাতে আমরা এত আরাম পাই। কেন এই কথাটা এমন জোরে মনে এল সেই কথাটা খুলে বলি। আজ বিকেলে সিঙ্গাপুরের ঘাটে জাহাজ থাম্তেই সরযূ জাহাজে এসে উপস্থিত। আমি তাঁকে গতবারে অল্প কয়দিনমাত্র দেখেছিলুম, সুতরাং তাঁকে সুপরিচিত বল্লে বেশি বলা হবে। কিন্তু তাঁকে দেখে মন খুসি হোলো এই জন্যে যে তিনি বাঙালি মেয়ে অর্থাৎ এক মুহূর্ত্তে অনেকখানি জানা গেল—তাঁর সরযু নাম বিয়াট্রীস্ বা এলিয়োনোবার মতো পরিচয়সূচক নয়, আমার পক্ষে তাতে তার চেয়ে অনেকবেশি পদার্থ আছে। তার পরে তাঁর শাড়ী, তাঁর বালা, তাঁর কপালের মাঝখানের কুংকুমের বিন্দু, কেবলমাত্র দৃশ্যগত নয়; তার পিছনে অনেকখানি অদৃশ্য সামগ্রী আছে এক নিমেষেই সেই সমস্ত এসে চোখ এবং মনকে ভ’রে ফেলে। ভালো ক’রে ভেবে দেখো এই সমস্ত চিহ্ন, বচনীয় এবং অনির্বচনীয় কত বিচিত্র পদার্থকে সংক্ষেপে একই কালে বহন করে; তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে গেলে আঠারো পর্ব্ব বই ভরতি হয়ে যায়। এ জাহাজে অনেক মেয়ে আছে তাদের মধ্যে এই বাঙালি মেয়েকে দেখে মন এত খুসি হেলো—আর কিছু নয় জান্তেই মনের আনন—মন যখন বলে জান্লুম তখন সে খুসি হয়—আমরা যাকে বলি মন-কেমন-করা তার মানে হচ্চে চারদিকের জানা পদার্থটা যথেষ্ট পূর্ণায়তন নয়।
কাল জাপানী বন্দরে এসেছি-নাম মোজি। আগামী কাল পৌঁছব কোবে। পাখী বাসা বাঁধে খড়কুটো দিয়ে, সে বাসা ফেলে যেতে তাদের দেরি হয় না—আমরা বাসা বাঁধি প্রধানত মনের জিনিষ দিয়ে—কাজেকর্ম্মে, লেখাপড়ায়, ভাবনাচিন্তায় চারিদিকে একটা অদৃশ্য আশ্রয় তৈরী হতে থাকে। হাওয়া-গাড়ির গদি যেমন শরীরের মাপে টোল খেয়ে খোঁদলগুলি গড়ে তোলে, মন তেমনি নড়তে চড়তে তার হাওয়াআসনে নানা আকারের খোঁদল তৈরী করে, তার মধ্যে যখন সে বসে তখন সে ব’সে যায়—তারপরে যখন সেটাকে ছাড়তে হয় তখন আর ভালো লাগে না। এ জাহাজে আমার তেমনি ঘটেছে। এই ক্যাবিনে এক পাশে একটি লেখবার ডেস্ক, আর একপাশে বিছানা, তা ছাড়া আয়নাওয়ালা দেরাজ আর কাপড় ঝোলাবার আলমারী—এর সংলগ্ন একটি নাবার ঘর এবং সেটা পেরিয়ে গিয়ে আর একটা ক্যাবিন—সেখানে আমার বাক্স তোরঙ্গ প্রভৃতি। এরই মধ্যে মন নিজের আসবাব গুছিয়ে নিয়েছে। অল্প জায়গা ব’লেই আশ্রয়টি বেশ নিবিড়—প্রয়োজনের জিনিষ সমস্ত হাতের কাছে। এখান থেকে নেমে দুদিনের জন্য সাংহাইয়ে ‘সু’র বাড়িতে ছিলাম, ভালো লাগেনি, অত্যন্ত ক্লান্ত করেছিল-তার প্রধান কারণ নূতন জায়গায় মন তার গায়ের মাপ পায়নি—চারিদিকে এখানে ঠেকে ওখানে ঠেকে—আর তার উপরে দিনরাত আদর অভ্যর্থনা গোলমাল। প্রতিদিনের ভাবনা কল্পনার মধ্যেই নতুনত্ব আছে—বাইরের নতুনত্ব তাকে বাধা দিতে থাকে। জীবনে আমরা যে-কোনো পদার্থকে গভীর ক’রে পেয়েছি অর্থাৎ অনেকদিন ধ’রে অনেক ক’রে জেনেছি সত্যিকার নতুন তারি মধ্যে, তাকে ছেড়ে নতুনকে খুঁজতে হয় না। অন্য সব মূল্যবান জিনিষেরই মতো নতুনকে সাধনা ক’রে লাভ করতে হয়। অর্থাৎ পুরানো ক’রে তবে তাকে পাওয়া যায়। হঠাৎ যাকে পেয়েছি ব’লে মনে হয়, সে ফাঁকি—দুদিন বাদেই তার যথার্থ জীর্ণতা ধরা পড়ে। আজকের দিনে এই সস্তা নতুনত্বের মৃগয়ায় মানুষ মেতেছে—সেইজন্যেই মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে তার বদল চাই—তার এই বদলের নেশায় বিজ্ঞান তার সহায়তা করছে—সে সময় পাচ্চে না গভীরের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে চিরনূতনের পরিচয় পেতে। এই জন্যেই চারিদিকে একটা পুঁথি-পড়া ইতরতা ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। ধ্রুবসত্যকে সত্যরূপে পাবার সময় নেই, সময় নেই। সাহিত্যে যে অশ্লীলতা দেখা, দিয়েছে তার কারণ এই; অশ্লীলতা অতি সহজেই প্রবলবেগে মনকে আঘাত করে—যাদের সময় নেই ও শক্তি কম তাদের পক্ষে অতি দ্রুতবেগে আমোদ পাবার এই অতি সস্তা উপায়। তীব্র উত্তেজনা চাই। সেই মনেরই পক্ষে যেমন নির্জীব—মনের জীবনীশক্তি ক’মে গেছে অগভীর মাটিতে—তার শিকড়গুলি উপবাসী।
আমার চিঠিগুলো চিঠি নয় এই তর্ক উঠেছে। আমি নিজে অনেকবার স্বীকার করেছি যে আমি চিঠি লিখতে পারিনে। এটা গর্ব্ব করবার কথা নয়। আমরা যে-জগতে বাস করি সেখানে কেবল যে চিন্তা করবার কিম্বা কল্পনা করবার বিষয় আছে তা নয়। সেখানকার অনেকটা অংশই ঘটনার ধারা; অন্তত যেটা আমাদের চোখে পড়ে, সেটা একটা ব্যাপার; সে কেবল হচ্চে, চলছে, আসছে যাচ্চে; অস্তিত্বের সদর রাস্তা দিয়ে চলাচল, তার ভিতরকার সব আসল খবর আমাদের নজরে পড়ে না। মাঝে মাঝে যদি বা পড়ে, তাদের ধরে রাখিনে, পথ ছেড়ে দিই; সমস্ত ধরতে গেলে মনের বোঝ অসহ্য ভারী হয়ে উঠত। আমাদের ঘরের ভিতর দিকটাতে সংসারের সঙ্কীর্ণ দেয়াল-ঘেরা সীমানার মধ্যে আমাদের অনেক ভাবনার বিষয়, অনেক চেষ্টার বিষয় আছে তার ভার আমাদের বহন করতে হয়। কিন্তু যখন জানলায় এসে বসি তখন রাস্তায় দেখি চলাচলের চেহারা। ভালো ক’রে যদি খোঁজ নিতে পারতুম তাহোলে দেখতুম তার কোনো অংশই বস্তুত হাল্কা নয়,— ট্র্যাম হু হু ক’রে চলে গেল কিন্তু তার পিছনে মস্ত একটা ট্রাম কোম্পানি,—সমুদ্রের এপারে ওপারে তার হিসেব চালাচালি। মানুষটা ছাতা বগলে নিয়ে চলেছে, মোটর গাড়ি তার সর্ব্বাঙ্গে কাদা ছিটিয়ে চলে গেল—তার সব কথাটা যদি চোখে পড়ত তাহোলে দেখতুম বৃহৎ কাণ্ড—সুখে দুঃখে বিজড়িত একটা বিপুল ইতিহাস। কিন্তু সমস্তই আমাদের চোখে হাল্কা হয়ে ঘটনা প্রবাহ আকারে দেখা দিচ্চে। অনেক মানুষ আছে যারা এই জান্লার ধারে বসে যা দেখে তাতে এক রকমের আনন্দ পায়। যারা ভালো চিঠি লেখে তারা মনের জানলার ধারে ব’সে লেখে—আলাপ ক’রে যায় তার কোনো ভার নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। এই সব চল্তি ঘটনার পরে লেখকের বিশেষ অনুরাগ থাকা চাই, তাহোলেই তার কথাগুলি পতঙ্গের মতো হাল্কা পাখা মেলে হাওয়ার উপর দিয়ে নেচে যায়। অত্যন্ত সহজ বলেই জিনিষটি সহজ নয়-ছাগলের পক্ষে একটুও সহজ নয় ফুলের থেকে মধু সংগ্রহকরা। ভারহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস। সেই রস পাওয়া এবং দেওয়া অল্প লোকের শক্তিতেই আছে। কথা বলবার বিষয় নেই অথচ কথা বলবার রস আছে এমন ক্ষমতা ক’জন লোকের দেখা যায়? জলের স্রোত কেবল আপন গতির সংঘাতেই ধ্বনি জাগিয়ে তোলে, তার সেই সংঘাতের উপকরণ অতি সামান্য, তার নুড়ি, বালি, তার তটের বাঁকচোর, কিন্তু আসল জিনিষটা হচ্ছে তার ধারার চাঞ্চল্য। তেমনি যে-মানুষের মধ্যে প্রাণস্রোতের বেগ আছে সে মানুষ হাসে আলাপ করে, সে তার প্রাণের সহজ কল্লোল, চারিদিকের যে-কোনো-কিছুতেই তার মনটা একটু মাত্র ঠেকে তাতেই তার ধ্বনি ওঠে। এই অতিমাত্র অর্থভারহীন ধ্বনিতে মন খুসি হয়—গাছের মর্ম্মর ধ্বনির মতো প্রাণ-আন্দোলনের এই সহজ কলরব।
অল্প বয়সে আমি চিঠি লিখতুম যা-তা নিয়ে। মনের সেই হাল্কা চাল অনেকদিন থেকে চলে গেছে—এখন মনের ভিতর দিকে তাকিয়ে বক্তব্য সংগ্রহ করে চলি। চিন্তা করতে করতে কথা কয়ে যাই—দাঁড় বেয়ে চলিনে, জাল ফেলে ধরি। উপরকার ঢেউয়ের সঙ্গে আমার কলমের গতির সামঞ্জস্য থাকে না। যাই হোক্ এ-কে চিঠি বলে না। পৃথিবীতে চিঠি লেখায় যারা যশস্বী হয়েছে তাদের সংখ্যা অতি অল্প। যে দু-চারজনের কথা মনে পড়ে তারা মেয়ে। আমি চিঠি রচনায় নিজের কীর্ত্তি প্রচার করব এ আশা করিনে।
নীলমণি দ্বিতীয়বার এসে বললে চা তৈরি। চা বিলম্ব সয় না—পোষ্টআপিসের পেয়াদাও তথৈবচ। অতএব ইতি।
তোমার ভরপুর বিশ্রামের খবর শুনে আমার লোভ হচ্চে। লিখেছ তোমার বিছানা ঘিরে দেশীবিদেশী নানা জাতের নানা বই। সংসারে কর্ত্তব্য-না-করা ছাড়া তোমার কোনো কর্ত্তব্য নেই। যে বদমেজাজি লোকটা অন্তরে বাহিরে সর্ব্বদাই কাজের জবাবদিহী তলব করে, শুনছি তোমার ঘরে তার নাকি দরওয়াজা বন্ধ। কর্ত্তব্যবুদ্ধির এমনতরো নির্ব্বাসন কেবলমাত্র দেবলোকেই সম্ভব। এই পরিপূর্ণ চুপচাপ রসের নিবিড় স্বাদ আমিও একদা ভোগ করেছি। চারসপ্তাহ শয্যালীন অবস্থায় ছিলেম শুশ্রূষালয়ে। তখন একটি সত্য আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়েছিল সেটি হচ্ছে এই যে, নদীটাকে পান করা যায় না। তার চেয়ে একগ্লাস জলে অনেক সুবিধে। কিছুদিনের জন্যে যখন জীবনটাকে চারটে দেয়ালের মধ্যে সঙ্কীর্ণ করে এনেছিলুম, তার পদার্থভার যতদূর সম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন সেই হাল্কা জিনিষটাকে হাতে তুলে নিয়ে বেশ চেখে চেখে ভোগ করবার সুযোগ হয়েছিল। ভোগের সামগ্রীটি আর কিছুই না, কেবলমাত্র একখানি মন, আর একখানি প্রাণ। সে মন সে প্রাণ আপনার শেষপ্রান্তে-আপনার অতীত দেশের গায়ে-ঠেকা। লণ্ডনের ডাক্তার পাড়ায় সে বাড়িটা। ছোটোঘর, বিছানা ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। দেয়ালের উপরিভাগে একটি বাতায়ন, তার থেকে কিছুই দেখা যেত। কেবল কোনো একসময়ে আস্ত একটুখানি রোদ্দুর, আর বাকী সময়ে আস্ত কেবল পরিমিত আলো। আকাশভরা রোদ্দরকে এমন করে কখনো দেখিনি—এটিকে পেতুম যেন একটুক্রো পরশমণির মতো, আমার মনের সমস্ত ভিতরটাকে সোনার আভায় পরিপূর্ণ ক’রে দিত। এমনি টুক্রো করে পাওয়াতেই আমি যেন আকাশের সমস্ত আলোককে সত্য ক’রে পেয়েছি—উদাসীন অঞ্জলি উপছিয়ে আঙুলের ফাঁকের ভিতর দিয়ে একটুও গ’লে প’ড়ে যায়নি। দীর্ঘকাল নিস্তব্ধ হয়ে থাকার দরুণ মনের ধারণাশক্তি বোধ হয় বাড়ে। তাকে ঠিক ধারণাশক্তি নাম দেওয়া যায় না—আত্মানুভূতি বলা যেতে পারে। অহরহ নানা বিষয়ে চিত্ত যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে বেড়ায় তখন সে আপনার কাছে আসবার অবকাশ পায় না—কিছুকাল দায়ে প’ড়ে যখন চলাচল বন্ধ ক’রে স্থির হয়ে থাকা যায় তখন ক্রমে সমস্ত আবিলতা থিতিয়ে গিয়ে চিত্ত আপনাকে আপনি স্বচ্ছ করে জানতে পায়—সেই জানাতে নিবিড় একটি আনন্দ আছে। সেই আনন্দটি কেন ও কী, স্পষ্ট ক’রে বলা শক্ত। ইংরেজি ভাষায় যাকে Mystic বলে যদি সেই জাতীয় একটা ব্যাখ্যা চিঠির মধ্যে দিলে নিতান্ত অসঙ্গত না হয় তাহোলে বল। যেতে পারে যে, বিশ্বজগতের গভীরতার মধ্যে একটি নিস্তব্ধ বিশুদ্ধ আনন্দময় আত্মানুভূতি আছে, কোনো উপায়ে যদি বাহিরের অবিশ্রাম নানা গোলমাল থেকে ছুটি পাওয়া যায়, তাহোলে আপন সত্তার নির্ম্মল উপলব্ধিকে পরম সত্তার সেই ধ্রুব আনন্দে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাই। আমরা যখন নানাখানাকে কেবলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়াই, তখনি সমগ্র বোধটা হারিয়ে যায়, সেই অখণ্ডই হচ্চেন উপনিষৎ যাকে বলেন ভূমা। এই ভূমার মধ্যে অভিনিবিষ্ট হবার যে আনন্দ তার তুলনা হয় না। অমনি চারিদিকের ছোটো ছোটো জিনিষকে আমরা অসীমের ভূমিকার মধ্যে দেখতে পাই। ঐ যে বল্লেম আমার শুশ্রূষালয়ে অল্পখানিকটা সূর্য্যের আলো দেখতে পেতেন, কিন্তু সেইটুকুতেই আমাকে অখণ্ড জ্যোতিঃস্বরূপ বেশ স্পর্শ দিত—যে জ্যোতিঃ আনন্দময়। মাঝে মাঝে কোনো ইংরেজবন্ধু আমাকে দেখতে আসতেন। সাধারণতঃ বহুলোকের মাঝখানে তাঁদের ঠিক মূল্যটি পাইনি। কিন্তু এই ঘরটির মধ্যে যখন তারা আসতেন তখন একেবারে পূর্ণভাবে তাঁদের পাওয়া যেত, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ স্বভাবতই অসামান্য। সে একান্তই বিশেষ। কিন্তু তাদের আমরা অনেকের সঙ্গে তাল পাকিয়ে দেখি এই জন্যেই ঠিকমতো দেখি না। কিন্তু জনহীনতার বৃহৎ অবকাশের মধ্যে যখন কাউকে দেখি, তখন তাকে বিশেষভাবে সত্য ক’রে দেখার আনন্দ পাই। তাকে ধাঁ ক’রে এড়িয়ে যাবার জো থাকে না। তখন সে আপন ঐকান্তিকতার মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠে। বড়ো হয়ে ওঠে বললে ভুল হয়। সে যথার্থ হয়। অন্য সময় আমাদের দৃষ্টির জড়তায় সে ছোটো হয়ে থাকে। কথাটা একটু অদ্ভুত শোনায়, কিন্তু আরোগ্যশালার নিঃশঙ্কতা ও নিঃস্তব্ধতার মধ্যে আমি যে নিরবচ্ছিন্ন গভীর আনন্দ পেয়েছি জীবনে তেমন আনন্দ বেশিবার পাইনি। প্রথমবার যখন আমেরিকায়যাত্রা উপলক্ষ্যে অতলান্তিক পাড়ি দিয়েছিলাম, জাহাজটা ছিল জীর্ণ, সমুদ্র ছিল অশান্ত, অসুস্থ শরীর নিয়ে ক্যাবিনের মধ্যে অবরুদ্ধ ছিলাম। তখন সেই স্বাস্থ্যের অভাব ও স্থানাভাবের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে একটি নিবিড় আনন্দের উৎস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, নিতান্তই অকারণ আনন্দ, অস্বচ্ছন্দতাকে প্লাবিত করে দিয়ে। শরীরের কষ্টটাই তখন বাহিরের বহু বৈচিত্র্যকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। বেদনার সেই খিড়্কীর দরজার ভিতর দিয়ে একটা মুক্তির ক্ষেত্রে এসে পড়েছিলুম। সেইক্ষেত্রে আলোতে আনন্দে এবং আমার সত্ত্বার কোনো ভেদ নাই। বিজ্ঞান যখন বস্তুর অন্তরতম লোকে প্রবেশ করে, অনির্ব্বচনীয় আলোকের নৃত্যশালায় গিয়ে উপস্থিত হয়, দেখে যে সেখানে রূপের বৈচিত্র্য প্রায় বিলীন হয়েছে। রূপলোক—সেটা প্রত্যন্তভূমি। তার পরেই অরূপ। সেই অরূপের কথা বিজ্ঞান কিছু বলতে পারে না। উপনিষৎ তাঁকেই বলেছেন আনন্দ। “প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্”—সেই অরূপ আনন্দ হতে নিঃসৃত হয়ে প্রাণ নিরন্তর কম্পিত হচ্চে। নিজের গভীরতার মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে, সেইরকমই একটি নির্ব্বিশেষ পূর্ণতার মধ্যে এসে যেন পৌঁছই। সেখানে শরীর মনের দুঃখও দুঃখ নয়, কেননা শরীর মনের গণ্ডীটাই নেই।
ফুল ফোটে গাছের ডালে, সেই তার আশ্রয়। কিন্তু মানুষ তাকে আপনার মনে স্থান দেয় নাম দিয়ে। আমাদের দেশে অনেক ফুল আছে যারা গাছে ফোটে, মানুষ তাদের মনের মধ্যে স্বীকার করেনি। ফুলের প্রতি এমন উপেক্ষা আর কোনো দেশেই দেখা যায় না। হয়তো বা নাম আছে সে নাম অখ্যাত। গুটিকয়েক ফুল নামজাদা হয়েছে কেবল গন্ধের জোরে—অর্থাৎ উদাসীন তাদের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ না করলেও তারা এগিয়ে এসে গন্ধের দ্বারা স্বয়ং নিজেকে জানান দেয়। আমাদের সাহিত্যে তাদেরই বাঁধা নিমন্ত্রণ। তাদেরও অনেকগুলির নামই জানি, পরিচয় নেই, পরিচয়ের চেষ্টাও নেই। কাব্যের নাম-মালায় রোজই বারবার প’ড়ে আসছি যুথী জাতি সেঁউতি। কিন্তু ছন্দ মিললেই খুসি থাকি,—কোন্ ফুল জাতি, কোন্ ফুল সেঁউতি সে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবারও উৎসাহ নেই। জাতি বলে চামেলিকে, অনেক চেষ্টায় এই খবর পেয়েছি—কিন্তু সেঁউতি কা’কে বলে আজ পর্য্যন্ত অনেক প্রশ্ন ক’রে উত্তর পাইনি। শান্তিনিকেতনে একটি গাছ আছে তাকে কেউ কেউ পিয়াল বলে—কিন্তু সংস্কৃত কাব্যে বিখ্যাত পিয়ালের পরিচয় কয়জনেরই বা আছে? অপর পক্ষে দেখো, নদীর সম্বন্ধে আমাদের মনে ঔদাস্য নেই, নিতান্ত ছোটো নদীও আমাদের মনে প্রিয় নামের আসন পেয়েছে, কপোতাক্ষী, ময়ূরাক্ষী, ইচ্ছামতী-তাদের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারের সম্বন্ধ। পূজার ফুল ছাড়া আর কোনো ফুলের সঙ্গে আমাদের অবশ্য প্রয়োজনের সম্বন্ধ নেই। ফ্যাসানের সম্বন্ধ আছে অচিরায়ু সীজ্ন্ ফ্লাউয়ারের সঙ্গে—মালীর হাতে তাদের শুশ্রূষার ভার—ফুলদানিতে যথারীতি তাদের গতায়াত। একেই বলে তামসিকতা,অর্থাৎ মেটিরিয়ালিজ্ম্ স্থূল প্রয়োজনের বাইরে চিত্তের অসাড়তা। এই নামহীন ফুলের দেশে কবির কী দুর্দ্দশা ভেবে দেখো, ফুলের রাজ্যে নিতান্ত সঙ্কীর্ণ তার লেখনীর সঞ্চরণ। পাখী সম্বন্ধেও ঐ কথা, কাক কোকিল পাপিয়া বৌ-কথা-কও-কে অস্বীকার করবার উপায় নেই—কিন্তু কত সুন্দর পাখী আছে যার নাম অন্তত সাধারণে জানে না। ঐ প্রকৃতিগত ঔদাসীন্য আমাদের সকল পরাভবের মূলে—দেশের লোকের সম্বন্ধে আমাদের ঔদাসীন্যও এই স্বভাববশতই প্রবল। পরীক্ষাপাসের জন্যে ইতিহাস পাঠে উপেক্ষা করবার জো নেই—আমাদের স্বদেশীকতা সেই পুঁথির বুলি দিয়ে তৈরী— দেশের লোকের ’পরে অনুরাগের উৎসুক্য দিয়ে নয়। আমাদের জগৎটা কত ছোটো ভেবে দেখে—তার থেকে ও জিনিষটাই বাদ পড়েছে।
মেয়েরা ঋতুরঙ্গ অভিনয় করবে আজ সন্ধ্যেবেলায়। ওরা অঙ্গভঙ্গির লতানে রেখা দিয়ে গানের স্বরের উপর নক্সা কাটতে থাকে। এর অর্থটা কী। আমাদের প্রতিদিনটা দাগ-ধরা ছেঁড়া-খোঁড়া, কাটাকুটিতে ভরা, তার মধ্যে এর সঙ্গতি কোথায়? যারা লোকহিত-ব্রতপরায়ণ সন্ন্যাসী তারা বলে বাস্তব সংসারে দুঃখ দৈন্য শ্রীহীনতার অস্ত নেই, তার মধ্যে এই বিলাসের অবতারণা কেন? তারা জানে “দরিদ্র নারায়ণ” তো নাচ শেখেননি, তিনি নানা দায় নিয়ে কেবলি ছট্ফট্ ক’রে বেড়ান, তাতে ছন্দ নেই। এরা এই কথাটা ভুলে যায় যে, দরিদ্র শিবের আনন্দ নাচে। প্রতিদিনের দৈন্যটাই যদি একান্ত সত্য হোত, তাহোলে এই নাচটা আমাদের একেবারেই ভালো লাগত না, এটাকে পাগ্লামি বলতুম। কিন্তু ছন্দের এই সুসম্পূর্ণ রূপলীলাটি যখন দেখি, মন বলতে থাকে এই জিনিষটি অত্যন্ত সত্য—ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অপরিচ্ছন্নভাবে চারিদিকে যা চোখে পড়তে থাকে তার চেয়ে অনেক গভীরভাবে নিবিড়ভাবে। পর্দ্দাটার উপরেই প্রতিদিনের চলতি হাতের ছাপ পড়ছে, দাগ ধরছে, ধূলো লাগছে, পরিপূর্ণতার চেহারাটা কেবলি অপ্রমাণ হচ্চে—একেই বলি বাস্তব। কিন্তু পর্দ্দার আড়ালে আছে সত্য, তার ছন্দ ভাঙে না, সে অম্লান, সে অপরূপ, তাই যদি না হবে তবে গোলাপফুল ফুটে ওঠে কিসের থেকে কোন্ গভীরে কোথায় বাজে সেই বাশি যার ধ্বনি শুনে মানুষের কষ্টে কণ্ঠে যুগে যুগে গান চলে এসেছে আর মনে হয়েছে মানুষের কলকোলাহলের চেয়ে মানুষের এই গানেই চিরন্তনের লীলা? অঙ্গে অঙ্গে যখন নাচ দেখা দিল তখন ঐ ময়লা ছেঁড়া পর্দাটার এক কোণা উঠে গেল—“দরিদ্র নারায়ণ”কে হঠাৎ দেখা গেল বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর ডান পাশে। তাকেই অসত্য ব’লে উঠে’ চলে যাব মন তত তাতে সায় দেয় না। দরিদ্রনারায়ণকে বৈকুণ্ঠের সিংহাসনেই বসাতে হবে, তাঁকে লক্ষ্মীছাড়া ক’রে রাখব না। আমাদের পুরাণে শিবের মধ্যে ঈশ্বরের দরিদ্র বেশ আর অন্নপূর্ণায় তাঁর ঐশ্বর্য্য—বিশ্বের এই দুইয়ের মিলনেই সত্য। সাধুরা এই মিলনকে যখন স্বীকার করতে চান না তখন কবিদের সঙ্গে তাঁদের বিবাদ বাধে। তখন শিবের ভক্ত কবি কালিদাসের দোহাই পেড়ে সেই যুগলকেই আমাদের সকল অনুষ্ঠানের নান্দীতে আবাহন করব যারা “বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ”। যাঁদের মধ্যে অভাব ও অভাবের পূর্ণতার নিত্যলীলা।
আমাকে তুমি মনে মনে অনেকখানি বাড়িয়ে নিয়ে নিজের পছন্দসই করবার চেষ্টা করছ। কিন্তু আমি তো রচনার উপাদানমাত্র নই, আমি যে রচিত। তুমি যে লিখছ এখন থেকে আমার বই খুব ক’রে পড়বে —এমন কাজ কোরো না—অত্যন্ত বেশি ক’রে পড়তে গেলে কম ক’রে পাবে। হঠাৎ মাঝে মাঝে একখানা বই তুলে নিয়ে সাতের পাতা, কি সতেরোর পাতা কি সাতাশের পাতা থেকে যদি পড়তে সুরু ক’রে দাও হয়তো তোমার মন ব’লে উঠবে—বাঃ, বেশ লিখেছে তো। রীতিমত পড়া অভ্যাস কর যদি তাহলে স্বাদ নষ্ট হোতে থাকবে—কিছুদিন বাদে মনে হবে, এমনই কী। আমাদের সৃষ্টির একটা সীমানা আছে সেইখানে বারে বারে যদি তোমার মনোরথ এসে ঠেকে যায় তবে মন বিগড়ে যাবে। মানুষের একটা রোগ আছে যা পায় তার চেয়ে বেশি পেতে চায়, তোমার প্রকৃতিকে সর্ব্বতোভাবে পরিতৃপ্তি দিতে পারে আমার রচনা থেকে এমন প্রত্যাশা কোরো না। কিছু তোমার ভালো লাগবে কিছু অন্যের ভালো লাগবে—কিছু তোমার মনের সঙ্গে মিলবে না অথচ আর একজন ভাববে সেটা তারই মনের কথা। নানা ভাবে নানা সুরে নানা কথাই বলেছি—যেটুকু তোমার পছন্দ হয় বাছাই ক’রে নিয়ো। পাঠকেরও রসগ্রহণ করবার একটা সীমা আছে; তোমার মন অনুভূতির একটা বিশেষ অভ্যাসে প্রবলভাবে অভ্যস্ত, সেই অভ্যাস সব-কিছু থেকে নিজের জোগান খোঁজে। কিন্তু কবিতায় কোনো একটা বিশেষ ভাব বড় জিনিষ নয়, এমন কি খুব বড়ো অঙ্গের ভার। কবিতার মুখ্য জিনিষ হচ্ছে সৃষ্টি—অর্থাৎ রূপভাবন। বিশ্বকাব্যেও যেমন, কবির কাব্যেও তেমনি,—রূপ বিচিত্র—কোনোটা তোমার চোখে পড়ে, কোনোটা আর কারও। তুমি খুঁজছ তোমার মনের একটি বিশেষ ভাবকে তৃপ্তি দিতে পারে এমন কোনো একটি রূপ,—অন্যগুলোও রূপের মুল্যে মূল্যবান হোলেও হয়তো তুমি গ্রহণ করতে চাইবে না। কিন্তু কাব্যের যারা যথার্থ রসজ্ঞ, তারা নিজের ভাবকে কাব্যে খোঁজে না—তারা যে-কোনো ভাব রূপবান হয়ে উঠেছে তাতেই আনন্দ পায়। তোমার চিঠি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে একটা বিশেষ খাদে তোমার চিন্তাধারা প্রবাহিত—সেইটেই তোমার সাধনা। আমরা কবিরা কেবল সাধকদের জন্য লিখিনে, বিশেষ রসের রসিকদের জন্যও না। আমরা লিখি রূপদ্রষ্টার জন্য—তিনি বিচার করেন সৃষ্টির দিক থেকে—যাচাই ক’রে দেখেন রূপের আবির্ভাব হোলো কি না। আমার রূপকার বিধাতা সেইজন্যে আমাকে নানা রসের নানা ভাবের নানা উপলব্ধির মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ান—নিজের মনকে নানান্খানা ক’রে নানা চেহারায়ই গড়তে হয়। যেই একটা কিছু চেহারা জাগে ওস্তাদজী তখন আমাকে চেলা ব’লে জানেন। আমি যে-সব কর্ম্ম হাতে নিয়েছি তার মধ্যেও সেই চেহারা গড়ে তোলবার ব্যবসায়। উপদেশ দেওয়া উপকার করা গৌণ, রচনা করাই মুখ্য। আমি কী ও বটে কিন্তু যার অন্তর্দৃষ্টি আছে সে বুঝতে পারে আমি কারুকর্ম্মের কর্ম্মী। আমি কবিতা লিখি, গান লিখি, গল্প লিখি, নাট্যমঞ্চেও অভিনয় করি, নাচি নাচাই, ছবি আঁকি, হাসি, হাসাই, একান্তে কোনো একটা মাত্র আসনেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসবার উপায় রাখিনে। যারা আমাকে ভক্তি করতে চায় তাদের পদে পদে খটকা লাগে। তুমি আমার লেখা পড়তে চেয়েছ, পোড়ো, কিন্তু কবির লেখা বলেই পোড়ো। অর্থাৎ আমি সকলেরই বন্ধু, সকলেরই সমবয়সী, সকলেরই সহযাত্রী। আমি কিন্তু পণ্ডিত নই। পথ চলতে চলতে আমার যা-কিছু সংগ্রহ। যা-কিছু জানি তার অনেকখানি আন্দাজ। যতখানি পড়ি, তার চেয়ে গড়ি অনেক বেশি।
আমার জীবনটা তিন ভাগে বিভক্ত—কাজে, বাজে কাজে, অকাজে। কাজের দিকে আছে ইস্কুলমাষ্টারী, লেখা, ইত্যাদি, এইটে হোলো কর্ত্তব্য বিভাগ। তার পর আছে অনাবশ্যক বিভাগ। এইখানে যত কিছু নেশার সরঞ্জাম। কাব্য, গান এবং ছবি। নেশার মাত্রা পরে পরে, তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
একদা প্রথম বয়সে কবিতা ছিলেন একেশ্বরী-ধরণীর আদিযুগে যেমন সমস্তই ছিল জল। মনের এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্ত তারই কলকল্লোলে ছিল মুখরিত। নিছক ভাবরসের লীলা, স্বপ্নলোকের উৎসব। তার পর দ্বিতীয় বয়সে এল কাজের তাগিদ। এই উপলক্ষে মানুষের সঙ্গে কাছাকাছি মিল্তে হোলো। তখনি এল কর্ত্তব্যের আহ্বান। জলের ভিতর থেকে স্থল মাথা তুল্ল। সেখানে জলের ঢেউয়ে আর উনপঞ্চাশ পবনের ধাক্কায় ট’লে ট’লে কেবল ভেসে বেড়ানো নয়, বাসা বাঁধার পালা, বিচিত্র তার উদ্যোগ। মানুষকে জাতে হোলো, রঙীন্ প্রদোষের আবছায়ায় নয়, সে তার সুখ দুঃখ নিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠ্ল বাস্তবলোকে। সেই মানব অতিথি যখন মনের দ্বারে ধাক্কা দিয়ে বল্লে, অয়মহং ভোঃ, সেই সময়ে ঐ কবিতাটা লিখেছিলুম, এবার ফিরাও মোরে। শুধু আমার কল্পনাকে নয়, কলাকৌশলকে নয়, দাবি করলে আমার বুদ্ধিকে চিন্তাকে সেবাকে আমার সমগ্র শক্তিকে, সম্পূর্ণ মনুষ্যত্বকে।
তখন থেকে জীবনে আর এক পর্ব্ব শুরু হলো। একটা আর একটাকে প্রতিহত করলে না—মহাসাগরে পরিবেষ্টিত মহাদেশের পালা এল। মাতামাতি ঐ রসসাগরের দিকে, আর ত্যাগ ও তপস্যা ঐ মহাদেশের ক্ষেত্রে। কাজেও টানে, নেশাতেও ছাড়ে না। বহুদিন আমার নেশার দুই মহল ছিল বাণী এবং গান, শেষ বয়সে তার সঙ্গে আর একটি এসে যোগ দিয়েছে—ছবি। মাতনের মাত্রা অনুসারে বাণীর চেয়ে গানের বেগ বেশি, গানের চেয়ে ছবির। যাই হোক্ এই লীলাসমুদ্রেই আরম্ভ হয়েছে আমার জীবনের আদি মহাযুগ—এইখানেই ধ্বনি এবং নৃত্য এবং বর্ণিকাভঙ্গ, এইখানেই নটরাজের আত্মবিস্মৃত তাণ্ডব। তার পরে নটরাজ এলেন তপস্বী-বেশে ভিক্ষুরূপে! দাবির আর শেষ নেই। ভিক্ষার ঝুলি ভরতে হবে। ত্যাগের সাধনা, কঠিন সাধনা।
এই লীলা এবং কর্ম্মের মাঝখানে নৈষ্কর্ম্ম্যের অবকাশ পাওয়া যায়। ওটাকে আকাশ বলা যেতে পারে, মনটাকে শূন্যে উড়িয়ে দেবার সুযোগ ঐখানে—না আছে বাঁধা রাস্তা, না আছে গম্য স্থান, না আছে, কর্ম্মক্ষেত্র। শরীর মন যখন হাল ছেড়ে দেয় তখনি আছে এই শূন্য।
এই পৃথিবীকে আমরা ভালো বেসেছি, এ’কে আমাদের ভালো লাগে, কেবলমাত্র এ জন্যে নয় যে, এর থেকে আমাদের প্রয়োজন সাধ্য হয়। এর রঙে রূপে রসে আমাদের মন ভুলিয়েছে। এর সকাল বেলাকার সূর্য্যোদয় কেবল যে আমাদের আলো দেয় তা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু দেয় যাকে বলি আনন্দ। সেই আনন্দের উপাদানগুলি খুব সূক্ষ্ম খুব ব্যাপক, সেগুলির স্পর্শে খুসি হয়ে আমাদের মন দেয় সাড়া। আমার বাগানের রাস্তায় সকালে যখন বেড়াচ্চি দেখি আমার পলাশ ডালে ডালে গুটি ধরেছে, পাতা-ঝরা শিমুল গাছ ভরে গেছে কুঁড়িতে, অপেক্ষা করে আছি কবে মাঘের শেষে হাওয়া দেবে দখিন থেকে, নীল, আকাশের আঙিনায় ফুলের গুচ্ছে গুচ্ছে লাল রঙের পাগলামি লেগে যাবে। এই যে আমাদের অন্তরের সঙ্গে বাহিরের একটা ভালোলাগবার সম্বন্ধ নানা প্রকার রূপকে নিয়ে ভাবকে নিয়ে গভীর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, একে অবজ্ঞা করা চলে না। এ যে কেবল সুখের, আরামের তা নয়, এর মধ্যে কঠোরতা আছে, বেসুর আছে, দ্বন্দ্ব আছে। সব সুদ্ধ জড়িয়ে এ আমাদের চৈতন্যকে জাগিয়ে রেখেছে, নানা রঙে রঙিয়ে রেখেছে। এই যেমন প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের রসবোধের সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গেও তেমনি। সে আরো বিপুল, আরো গভীর, তার সুখদুঃখের তীব্রতা আরো প্রবল, তার মধ্যে পদে পদে অভাবনীয়তা, তার ঘাতপ্রতিঘাত আমাদের সমস্ত দেহমন প্রাণকে নাড়া দিয়ে তোলে। এই নিয়ে আমাদের চৈতন্যের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার মূল্য অনুসারে আমাদের ব্যক্তিস্বরূপ সম্পদবান হয়ে উঠেছে। মানুষের এই বহুবিচিত্র প্রাণবান অভিজ্ঞতার শ্রেষ্ঠ মূল্য প্রকাশ পাচ্চে তার সাহিত্যে তার কলাবিদ্যায়। এই অভিজ্ঞতা রসের অভিজ্ঞতা, যাকে ইংরেজিতে বলে Emotion। এ বুদ্ধির অভিজ্ঞতা নয়, প্রয়োজনের অভিজ্ঞতা নয়।
শক্তির প্রকাশ দেখলেও মানুষের বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দ হয়, সার্কাসে ঘোড়ার উপর ডিগবাজি খেলা দেখলে হাততালি দিয়ে ওঠে। এর একটা হেতু আছে, সেই হেতুটা হচ্চে দুঃসাধ্যসাধন; তাসের খেলার ভোজবাজির মধ্যেও সেই হেতু আছে, কী ক’রে কী হোলো বোঝা গেল না ব’লে মজা লাগ্ল। কিন্তু আমার পলাশ গাছে যখন ফুল ফোটে তখন সে কোনো শক্তির ডিগ্বাজির ধাক্কায় আমাদের চৈতন্যকে তরঙ্গিত করে না। “Love is enough” ভালোবাসা ভালোলাগা আপনাতেই আপনি পর্য্যাপ্ত।
মানুষের সব-কিছুর মতে এই ভালোলাগারও একটা চর্চ্চা আছে, একটা বিদ্যা আছে। বিশ্বপ্রকৃতি থেকে মানবপ্রকৃতি থেকে বাছাই ক’রে সাজাই ক’রে মানুষ আপনার একটি বিশেষ আনন্দ-লোক আপনি সৃষ্টি করে তুলছে। দেশে দেশে কত কাব্য কত ছবি কত মূর্ত্তি কত মন্দির তার এই সৃষ্টির অন্তর্গত। আজ মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন হঠাৎ অত্যন্ত বিপুল হয়ে উঠেছে। তার ফল অত্যন্ত প্রভূত, জিনিষ উৎপন্ন হচ্চে অসংখ্য আকারে অসম্ভব বেগে, সংখ্যায় এবং পরিমাণে, শক্তির দুঃসাধ্যতায় ও কৌশলে মানুষের মনকে অভিভূত করে দিয়েছে। লোভে এবং দুরাকাঙ্ক্ষায় মানুষ আপন প্রাণকে পীড়িত ক’রে মানবসম্বন্ধকে ভেঙে চুরে যন্ত্রকে ও বস্তুকে মনুষ্যত্বের চেয়ে বড়ো ক’রে তুল্ছে। তার এই শক্তিমদমত্ততার অবস্থায় যন্ত্রশক্তির প্রকাশকেই সে যদি বলিষ্ঠ ব’লে আস্ফালন করে এবং প্রাণের প্রকাশকে হৃদয়ের প্রকাশকে বলে সেণ্টিমেণ্টাল দুর্ব্বলতা তাহোলে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে, সুন্দর দুর্ব্বলও নয় সবলও নয়, তা সুন্দর, তার শ্রেষ্ঠতা যদি এই ব’লে বিচার করতে চাই যে সে এক সেকেণ্ডে কয়বার চাকা ঘোরাতে পারে কিম্বা তার উৎপাদনের সংখ্যা কত তাহোলে বলব সেটা বর্ব্বরতা। এবং সেই সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, যন্ত্রের অপরিমিত জটিলতা, তার বিকট আওয়াজ, তার দুরন্তবেগ ও দুম্মুল্য উপকরণ, যাতে ক’রে সে বর্ত্তমান যুগের মনকে ছেলে-ভোলানোর মতো ক’রে ভোলায় সেটাতে তার শক্তির চেয়ে অশক্তিরই পরিচয় বেশি। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির যতই উন্নতি হবে তার হাঁসফাঁসানি ততই কম্বে, তার মানুষমার। দৌরাত্ম্য ততই হালকা হয়ে আস্বে, তার উপকরণ ততই হবে সহজ। কারখানাঘর কুশ্রী কেননা মানুষের অশক্তিই এখানে উৎকট হয়ে উঠেছে, নিজের শক্তি দিয়ে প্রকৃতির শক্তিকে বাঁধতে গিয়ে বন্ধনটাকেই ক’রে তুলেছে অত্যন্ত জবড়জঙ্গ, সেইটেই তার দুর্ব্বলতা—দুর্ব্বলতা কুশ্রী। যে মানুষ সাঁতার জানে না, সে বিকট রকম হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে, তার আস্ফালনে শিশুর মন ভুলতে পারে কিন্তু যে মানুষ সাঁতার জানে, সমজদার তার সাঁতারের ভঙ্গী দেখে বাহবা দেয়—কেবল যে সেই ভঙ্গী ফলদায়ক তা নয় সেই ভঙ্গী সুশ্রী, তার গতির সুপরিমিত সুঠামতা তার শক্তির উদ্দামতাকে অনায়াসে সংযত করে রাখে। শক্তি বর্ত্তমান যুগের কলকারখানায় দৈত্যের মতো বিকটাকার, কেন না আপন দুর্দ্দামতাকে সে দেবতার মতো সহজে সংযত করতে পারেনি, তাই সে আমাদের ইন্দ্রিয়বোধকে সৌন্দর্যবোধকে মানবসম্বন্ধবোধকে এমন ক’রে পীড়িত করছে। মানুষের কলাবুদ্ধি আনন্দিত হয় দেবতাকে নিয়ে, কলবুদ্ধি দৈত্যকে নিয়ে; এই দৈত্যের সঙ্গে তার লোভ মিতালি করতে পারে কিন্তু তার আনন্দ এর বেদীতে পূজা আনবে না। কলকারখানার প্রয়োজন নেই এমন কথা আমি কখনই বলিনে—কিন্তু সে দাস, পণ্য বিনিময়ের কাজে তাকে পূরো দমে খাটিয়ে নেও কিন্তু তার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের ভান করতে যাওয়া ছেলেমানুষী।
(২)
চিঠির একটা অংশের উত্তর দেওয়া হয়নি, সেটুকুও যোগ ক’রে দিই। লিখেছ একটা যুগ আসছে যখন আমরা বিজ্ঞান, economic production নিয়ে কবিতা লিখব। কত ধানে কত চাল হয় এই প্রয়োজনীয় বিষয়টা এতকাল ধ’রে এত গৃহস্থকে আলোচনা করতে হয়েছে তবু কেন আজ পর্য্যন্ত এই প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ কবিতা লেখেনি। কিম্বা “ধন্য রাজা পুণ্যদেশ, যদি বর্ষে মাঘের শেষ,” এই ছড়াটাকে কেউ কেউ সাহিত্যে বড়ো জায়গা দেয় নি? মাঘের শেষে বৃষ্টি হোলে চাষীদের উপকার হয় এ তথ্যটা তো “production” তত্ত্বের অন্তর্গত। একস্চেঞ্জের বাজার ওঠা নামা নিয়ে দেশজুড়ে সুখদুঃখ তত কম নয়, এ নিয়ে খবরের কাগজে লেখালেখি চলে, কিন্তু ভৈরবীরাগিণীতে আলাপ তো কেউ করে না। মানুষের জীবনের একটা ভাগ আছে যেটা খবর দেওয়া-নেওয়া নিয়ে-তা নিয়ে লাভ লোকসান ঘটে কিন্তু তা নিয়ে কেউ গান গায় না, নাচে না, মূর্ত্তি বানাতে বসে না। তা নিয়ে যা লেখালেখি হয় তা হিসেবের খাতায়, সেই খাতায় কবিত্ব ফলাতে গেলেই মনিবের কাছে কানমলা খেতে হয়। আইন্ষ্টাইন বেহালা বাজাতে পারেন এবং ভালোবাসেন কিন্তু রেলেটিভিটি নিয়ে সঙ্গীত রচনার কথা তার মনে হয়নি, সেটা তাঁর পক্ষে ও তাঁর বিজ্ঞানের পক্ষে ভালোই হয়েছে। রেলেটিভিটি তত্ত্বে দেশ ও কালের যুগলমিলন ঘটেছে ব’লে কোনো কবি যদি তাই নিয়ে সনেট্ লিখ্তে বসেন, তাহলে আপত্তি করব না যদি রচনাটা ভালো হয়। কিন্তু সেই উপলক্ষ্যে সাহানা রাগিণীর নাড়া খেয়ে রেলেটিভিটি তত্ত্বটা ঘুলিয়ে যাবে সে কথাটা ধ’রে নিতেই হবে। তোমার মতে, স্বয়ং বিজ্ঞান যখন কবিত্বের আসরে নামবে সেই যুগে অকাম প্রেমের জায়গায় লালসার আকর্ষণ, মানুষের স্বভাবের অতীত ভাবুকতার জায়গায় স্বভাবসঙ্গত প্রবৃত্তি সাহিত্যে সম্মান পাবে।—কথাটা ভেবে দেখা যাক। কলকারখানা জিনিষটা স্বভাবসঙ্গত নয়। মানুষের হাতদুখানা স্বভাবদত্ত, সেই হাত দিয়ে মাটি খোঁড়াটা ছিল তার পক্ষে স্বাভাবিক, খুঁড়তে গায়ের জোরও লাগত বেশি। অথচ তোমার মতে কত্রিম কলকারখানায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সেইজন্যে সেইটেই কবিতার বিষয় হওয়া উচিত, তাই ট্র্যাক্টার তোমাকে মুগ্ধ করছে। অথচ যাকে তুমি ন্যাচারাল ইনষ্টিঙ্ক্ট অর্থাৎ সহজ প্রবৃত্তি বলেছ সেটাকে তুমি বড়ো বলেছ মানুষের বানানো সেণ্টিমেণ্টের চেয়ে। এটা যে উল্টো কথা হোলো। সায়ান্সের বেলায় মানুষ পশুর স্বাভাবিক বুদ্ধি ছাড়িয়ে নিজ চেষ্টায় বড়ো হয়ে উঠবে অথচ তার চরিত্রের বেলায় মানুষ পশুর সহজ প্রবৃত্তির দিকে গেলেই তার বাহাদুরী এ কেমনতরো কথা হোলো। ক্ষিদে পেলেই কুকুর যেমন-তেমন জায়গা থেকে যেমন-তেমন ক’রে খায়, ক্ষিদের এইটেই স্বভাব। কিন্তু মানুষ রেঁধে খায়, সাজিয়ে খায়, যেমন-তেমন ক’রে খাওয়াটাকে ঘৃণা করে। মানুষ ক্ষিদের ইন্ষ্টিঙ্ক্টের সঙ্গে আর্টের আনন্দ মিলিয়ে তবেই খেয়ে সুখ পায়। সে কুকুরের মতো খায় না ব’লে কেউ তাকে সেণ্টিমেণ্টাল ব’লে উপহাস করে না। অসভ্য মানুষেরা যেমন-তেমন ক’রেই খায় তাই ব’লে তারাই যে উঁচুদরের মানুষ এমন কথা কেউ বলে না। কামুকতা নিয়েই মানুষ পূরো তৃপ্তি পায়নি ব’লেই প্রেমিককে বড়ো করে তুলেছে। তাতে আনন্দের গভীরতা প্রবলতা ও স্থায়িকতা বেশি তাই তার মূল্য বেশি। স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ নিতান্তই যেমন-তেমনভাবে যদি ঘটে তাহোলে সেটা কুকুরদের সমান হয় ব’লেই যদি তাকে প্রবল ও পুরুষোচিত বলা হয় তাহোলে পালা ফেলে দিয়ে ধূলো থেকে খাবার খাওয়া চাই এবং ট্র্যাকটার পুড়িয়ে হাত দিয়ে আঁচড়ে মাটি চাষ করা কর্ত্তব্য। তুমি বলবে হাত দিয়ে মাটিখোঁড়ার চেয়ে ট্র্যাক্টার দিয়ে চাষ ক’রে ফল বেশি পাওয়া যায়, আমি বলব অমিশ্র কামুকতার চেয়ে প্রেমিতায় আনন্দের পূর্ণতা বেশি। ভালো ক’রে খাওয়াও মানুষের সৃষ্টি তেমনি স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধকে সংযমে ত্যাগে শোভনতায় ভরিয়ে তোলাও মানুষের। কেবল শক্তির নয়, আনন্দেরও একটা সায়ান্স আছে, সেই সায়ান্সে মানুষের উপভোগকে তার সহজ পশুত্ব থেকে বড়ো ক’রে তুলেছে, তার বিচিত্র সৌন্দর্য্যসৃষ্টিকে উদ্বোধিত করছে। এতদিন তো মানুষের পশুপ্রবৃত্তিকে দাবিয়ে রাখাকেই বলিষ্ঠতা ব’লে জানত, আজ কি তার উল্টো কথা বলবার দিন এল। যে ভাবীযুগে কেবল সায়ন্সই মানুষের আদিমশক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে আর তার চরিত্রই নামবে আদিমতার দিকে, সে যুগে কবিতাই থাকবে না।
শরৎকালের আলোয় ছুটির আমন্ত্রণ আকাশে আকাশে। কোনো কাজ না করবার মতো মেজাজে আছি, অথচ কাজ এসেছে ভিড় ক’রে। মন ক্লান্ত হয়ে আছে অথচ কলমের বিশ্রাম নেই।
আমি মাটির মানুষ, তার মানে এ নয় যে ভালোমানুষ আমি। তার মানে এই যে, ধরণীর মাটির পাত্র থেকেই আমি অমৃত পান করি-জলস্থল আকাশে আমার মনের খেলাঘর। মেয়েরা শ্বশুর ঘরের উপর বিরক্ত হোলেই বাপের ঘরে চলে যায়। তেমনিতরো মনের ভাব নিয়েই মানুষ দৌড় মারতে চায় বৈকুণ্ঠের দিকে—এই মর্ত্ত্য পৃথিবীর উপর আমার যদি তেমন বিতৃষ্ণা হোত আমিও তাহোলে বৈকুণ্ঠের প্রতি বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতুম। দরকার হয়নি ব’লে কল্পনাও করিনে। আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি—আমার কাছে এই মর্ত্যের রূপই আনন্দরূপ অমৃতরূপ—একে অবজ্ঞা করি এত বড়ো ধৃষ্টতা আমার নেই। এর চেয়ে আরো কিছু উঁচু আছে বলে যে মনে করে, তার নিজের চোখে দোষ আছে। আমার এই উত্তরের দিকের জানলা দিয়ে নীল আকাশ ঢেলে দিচ্চে তার আলোকসুধা, পূর্ব্বদিকের খোলা দরজার সামনে উদার পৃথিবী তার শ্যামল আমন্ত্রণ প্রসারিত করে ধরেছে—আমি এই সোনার ধারা সবুজধারার মোহনায় ব’সে দুই চক্ষুকে ছাড়া দিয়েছি, বেলা যাচ্ছে কেটে—আর কী চাই আমার বুঝতেই পারিনে যতসব হতবল মন্ত্র। এতবড়ো সুস্পষ্টতার মধ্যেও উপলব্ধি যদি না হয় তবে কিছুতেই হবে না।
মনে পড়ছে সেই শিলাইদহের কুঠি, তেতালার নিভৃত ঘরটি—আমের -বোলের গন্ধ আসছে বাতাসে—পশ্চিমের মাঠ পেরিয়ে বহুদুরে দেখা যাচ্চে বালুচরের রেখা, আর গুণটানা মাস্তুল। দিনগুলো অবকাশেভরা—সেই অবকাশের উপর প্রজাপতির ঝাঁকের মতো উড়ে বেড়াচ্চে রঙীন পাখাওয়ালা কত ভাবনা এবং কত বাণী। কর্ম্মের দায়ও ছিল তারি সঙ্গে—আর হয়তো মনের গভীরে ছিল অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, পরিচয়হীন বেদনা। সব নিয়ে ছিল যে আমার নিভৃত বিশ্ব সে আজ চলে গিয়েছে বহুদূরে। এই বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে ছিল আমার পরিণত যৌবন—কোনো ভারই তার কাছে ভার ছিল না—নদী যেমন আপন স্রোতের বেগেই আপনাকে সহজে নিয়ে চলে, সেও তেমনি আপনার ব্যক্ত অব্যক্ত সমস্ত কিছুকে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে চলেছিল—যে ভবিষ্যৎ ছিল অশেষের দিকে অভাবনীয়। এখন আমার ভবিষ্যৎ এসেছে সঙ্কীর্ণ হয়ে। তার প্রধান কারণ, যে-লক্ষ্যগুলো এখন আমার দিনরাত্রির প্রয়াসগুলিকে অধিকার করেছে তারা অত্যন্ত সুনির্দ্দিষ্ট। তার মধ্যে অচরিতার্থ অসম্পূর্ণ আছে অনেক কিন্তু অপ্রত্যাশিত নেই। এইটেতেই বোঝ যায় যৌবন দেউলে হয়েছে কেননা যৌবনের প্রধান সম্পদ হচ্চে অকৃপণ ভাগ্যের অভাবনীয়। তখন সামনেকার যে অজানা ক্ষেত্রের ম্যাপ আঁকা বাকি ছিল, মাইলপোষ্ট বসানো হয়নি সেখানে, সম্ভবপরতার ফর্দ্দ তলায় এসে ঠেকেনি। আমার শিলাইদহের কুঠি পদ্মার চর সেখানকার দিগন্তবিস্তৃত ফসলক্ষেত ও ছায়ানিভৃত গ্রাম ছিল সেই অভাবনীয়কে নিয়ে যার মধ্যে আমার কল্পনার ডানা বাধা পায়নি। যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম কাজ আরম্ভ করেছিলেন তখন সেই কাজের মধ্যে অনেক খানিই ছিল অভাবনীয়, কর্ত্তব্যের সীমা তখন সুনির্দ্দিষ্ট হয়ে কঠিন হয়ে ওঠেনি, আমার ইচ্ছা আমার আশা আমার সাধনা তার মধ্যে আমার সৃষ্টির ভূমিকাকে অপ্রত্যাশিতের দিকে প্রসারিত ক’রে রেখেছিল—সেই ছিল আমার নবীনের লীলাভূমি—কাজে খেলায় প্রভেদ ছিল না। প্রবীণ এল বাইরে থেকে, এখানে কেজো লোকের কারখানা ঘরের ছক কেটে দিলে, কর্ত্তব্যের রূপ সুনির্দ্দিষ্ট ক’রে দিলে, এখন সেইটের আদর্শকে নিয়ে ঢালাই পেটাই করা হলো প্রোগ্রাম—হাপরের হাঁপানি শব্দ উঠছে, আর দমাদম চলছে হাতুড়ি পেটা। যথানির্দ্দিষ্টের শাসন আইনে কানুনে পাক। হলো, এখানে অভাবনীয়কেই অবিশ্বাস ক’রে ঠেকিয়ে রাখা হয়। যে পথিকটা একদিন শিলাইদহ থেকে এখানকার প্রান্তরে শালবীথিছায়ায় আসিন বিছিয়ে বসেছিল তাকে সরতে সরতে কতদুরে চলে যেতে হয়েছে তার আর উদ্দেশ মেলে না—সেই মানুষটার সমস্ত জায়গা জুড়ে বসেছে অত্যন্ত পাকা গাথুনির কাজ। মাঝখানে প’ড়ে শুকিয়ে এল কবির যৌবন, বৈশাখে অজয় নদীর মতো। নইলে আমি শেষদিন পর্য্যন্তই বলতে পারতুম আমার পাবে না চুল, মরব না বুড়ো হয়ে। জিৎ হোলো কেজো লোকের। এখন যে কর্ম্মের পত্তন তার পরিমাপ চলে, তার সীমানা সুস্পষ্ট, অন্য বাজারের সঙ্গে তার বাজারদর খতিয়ে দেবার হিসাব মিলবে পাকা খাতায়। মন বলছে, “নিজ বাসভূমে পরবাসী হোলে।” এর মধ্যে যেটুকু ফাঁকা আছে সে ঐ সামনে যেখানে রক্তকরবী ফোটে, সেদিকে তাকাই আর ভুলে যাই যে, পাঁচজনে মিলে আমাকে কারখানাঘরের মালিকগিরিতে চেপে বসিয়ে দিয়ে গেছে।
বয়স যখন অল্প ছিল জন্মদিনের প্রভাতে ঘুম থেকে উঠতেই নানা লোকের কাছ থেকে নানা উপহার এসে পৌঁছত। তুমি যেমন ক’রে বাজার ঘুরেছ তেমনি ক’রেই তারা, যারা আমার জন্মোৎসবে খুচি হোত এবং আমাকে খুসি করতে চাইত, দোকানে দোকানে এমন কিছুর সন্ধান করত যা দেখে আমার চমক লাগ্তে পারে। অপ্রত্যাশিত বই ছবি কাপড় শিল্পদ্রব্য, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ফলফুলের ঝুড়ি। তখন জীবনে প্রভাতের আকাশ ছিল উজ্জ্বল স্নিগ্ধ স্বচ্ছ, মন ছিল সুকুমার সরস, সব কিছুতেই ছিল তার ঔৎসুক্য, স্নেহের ছোঁওয়া লাগলেই বেজে উঠত মননযন্ত্রের তার—তখন জন্মদিনগুলি সমস্ত দিনই গুঞ্জরিত হয়ে থাকত, তার রেশ যেন থামতে চাইত না। তার একটা কারণ, তখনকার পৃথিবী প্রায় ছিল আমার সমবয়সী, পরস্পর এক সমতলে বইত হৃদয়ের আদানপ্রদানের প্রবাহ, জন্মের অধিকাংশই ছিল সামনের দিকে অনুদঘাটিত, মন তখন মৌমাছির মতো হাওয়ায় ঘুরে বেড়াত সম্ভাব্যতার প্রত্যাশায়, অনাঘ্রাত পুষ্পের সৌরভে। এখনকার জন্মদিন তো কাঁচা নয়, কচি নয়, মন তার সকল প্রত্যাশার শেষে এসে পৌঁচেছে। অজানা পথে চলতে চলতে ভাগ্যের হাতে হঠাৎ অভাবনীয় দান পেয়ে অধীর হয়ে উঠব এই ছিল তখনকার আকাশবাণীতে, তখনকার জন্মদিনের অভাবিতপূর্ব্ব উপহারগুলিও এই বাণী বহন করত। তখনকার সেই জন্মদিনের ধারা এখন আর নেই। কিন্তু উৎসর্গ যে আসে না তা নয়—কিন্তু সে আসে দূরের দান পায়ের কাছে, কণ্ঠে আসে না হাতে আসে না—উপহার আসে না। অঞ্জলি থেকে অঞ্জলিতে। দেবতারা কি খুসি হন তাঁদের পূজায, মর্ত্ত্য যখন স্বর্গের দ্বাবের উদ্দেশে রেখে আসে তার নৈবেদ্য। সেই আমার অল্প বয়সে পঁচিশে বৈশাখের স্নিগ্ধ ভোরবেলাটা মনে পড়ছে—শশাবাব ঘবে নিঃশব্দচবণে ফুল বেখে গিযেছিল কা’রা, প্রত্যুষেব শেষঘুম ভ’বে গিয়েছিল তাবি গন্ধে—তারপবে হেসেছি ভালোবাসাব এই সমস্ত মধুব কৌশলে, তারাও হেসেছে আমার মুখের দিকে চেযে। সার্থক হযেছে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ।
অপরাহ্ন এখন বৌদ্রতাপে ক্লান্ত, মাঝে মাঝে একটা কোকিল ডাকছে বোধ হয় য়ুকল্পিটস্ গাছের ডালে ব’সে—এতে ক’বে কোকিলের আধুনিকতার প্রমাণ হয়, উচিত ছিল ওর বকুলের ডালে আশ্রয়। কিন্তু ওর দোষ নেই। পূর্ব্ব আকাশে মেঘের প্রলেপ লেগেছে—কিন্তু বর্ষণে আশা বারবার প্রতিহত হয়ে চলে যাচ্চে।