বিচিত্র প্রবন্ধ/নানা কথা
নানা কথা
মানুষের হৃদয় ছড়িয়ে আছে মিলিয়ে আছে, পৃথিবীর আলোয় ছায়ায়, তার গন্ধে তার গানে। অতীতকালের সংখ্যাতীত মানুষের প্রেমে পৃথিবী যেন ওড়না উড়িয়ে আছে; বায়ুমণ্ডলে যেমন তার বাপের উত্তরীয়, এ তেমনি তার চিন্ময় আবরণ, এর মধ্য দিয়ে মানুষ রং পায় সুর পায় আপন চিরন্তন মনের। তাই যখন শুনি আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের সময়েও “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানু” দেখা যেত, তখন আপনাদের মধ্যে সেই পূর্ব্বপুরুষদের চিত্ত অনুভব করি, তাঁদের সেই মেঘদেখার সুখ আমাদের সুখের সঙ্গে যুক্ত হয়, বুঝতে পারি যাঁরা গেছেন তাঁরাও আছেন।
বিজনে অরণ্যের বৃক্ষ নিতান্ত শূন্য, কিন্তু যে বৃক্ষের দিকে একজন মানুষ চেয়েছে, সে বৃক্ষে সে মানুষের চাহনি ছাপ দিয়ে গেছে। বহুদিন থেকে যে গাছের তলায় রৌদ্রের বেলায় মানুষ বসে সে গাছে যেমন হরিৎবর্ণ আছে তেমনি মনুষ্যত্বের অংশ আছে। আমাদের সেই পূর্ব্বপুরুষদের নেত্রের অভি আমাদের স্বদেশ-আকাশের তারকার জ্যোতিতে প্রতিফলিত। স্বদেশের বিজনে আমাদের শতসহস্র সঙ্গীর বাস, স্বদেশে আমাদের শতসহস্র বৎসর পরমায়ু।
সচরাচর লোকে মাকড়সার জালের সঙ্গে আমাদের জীবনের তুলনা দিয়ে থাকে। বন্ধনই আমাদের বাসস্থান। বন্ধন না থাকলে আমরা নিরাশ্রয়। সে বন্ধন আমরা নিজের ভিতর থেকে রচনা করি। বন্ধন রচনা করা আমাদের এমনি স্বাভাবিক যে একবার জাল ছিঁড়লে দেখতে দেখতে আবার শত শত বন্ধন গাঁথতে বসি, ভুলি আবার জাল ছিঁড়বেই। নতুন জায়গায় যাই সেখানে নতুন বন্ধন জড়াতে থাকি। সেখানকার গাছে ভূমিতে আকাশে, সেখানকার চন্দ্র সূর্য্য তারায়, সেখানকার মানুষে, সেখানকার রাস্তায় ঘাটে, সেখানকার আচার ব্যবহারে, সেখানকার ইতিহাসে, আমাদের জালের শত শত সূত্র লগ্ন ক’রে দিই, মাঝখানে রাখি আপনাকে। এমনি আমরা মাকড়সার জাতি।
আমরা বদ্ধ না হলে মুক্ত হোতে পাই না। ইংরেজিতে যাকে freedom বলে তা আমাদের নেই, বাংলায় যাকে স্বাধীনতা বলে তা আমাদের আছে। কঠিনতর অধীনতাই স্বাধীনতা। সর্ব্বং পরবশং দুঃখং সর্ব্বমাত্মবশং সুখং। কিন্তু পরের অধীন হওয়াই সহজ, আপনার অধীন হওয়াই শক্ত।
স্বাধীনতার অর্থ আপনার অর্থাৎ একের অধীনতা, অধীনতার অর্থ পরের অর্থাৎ সহস্রের অধীনতা। যার গৃহ নেই, তাকে কখনো গাছের তলে, কখনো মাঠে, কখনো খড়ের গাদায়, কখনো দয়াবানের কুটীরে আশ্রয় নিতে হয়; যার গৃহ আছে সে সংসারের অসংখ্যের মধ্যে ব্যাকুল নয়। যে নৌকো হালের অধীন নয় সে কিছুতেই স্বাধীন ব’লে গর্ব্ব করতে পারে না, কারণ সে শতসহস্র তরঙ্গের অধীন। যে দ্রব্য পৃথিবীর ভারাকর্ষণের অধীনতাকে উপেক্ষা করে, তাকে প্রত্যেক সামান্য বায়ুহিল্লোলের অধীনতায় দশদিকে ঘুরে মরতে হবে। অসীম জগৎসমুদ্রে অগণ্য তরঙ্গ, এখানে স্বাধীনতা ব্যতীত আমাদের গতি নাই। অতএব স্বাধীনতা অর্থে বন্ধনমুক্তি নয়, স্বাধীনতার অর্থ কখনো হাল কখনো নোঙরের শৃঙ্খলকে সম্মান করা।
সেদিন আমাকে একজন বন্ধু জিজ্ঞাসা করছিলেন, নূতন কবির আর প্রয়োজন কী? পুরাতন কবির কবিতা তো বিস্তর আছে। নুতন কথা এমনই কী বলা হচ্ছে? পুরাতন নিয়েই তো কাজ চলে যায়।
নূতনই পুরাতনকে রক্ষা করে থাকে। পুরাতনের মধ্যেই নুতনের বাস। নূতন পুরাতনে বিচ্ছেদ হোলেই জীবনের অবসান। যেদিন দেখব পৃথিবীতে নূতন কবি আর উঠছে না, সেদিন জানব পুরাতন কবিদের সম্পূর্ণ মৃত্যু হয়েছে।
নুতন কবিতার ধারা শুষ্ক হোলে পুরাতনে পৌঁছবার স্রোত বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যেকার এ দীর্ঘ ব্যবধান অবিশ্রাম লোপ করে রাখছে কে? নূতন কবিতা।
প্রত্যেক বসন্ত পুরাতনকেই পায় নূতন গানে নূতন ফুলে। আমরা বলি নবীন বসন্ত কিন্তু প্রত্যেক বসন্তই পুরাতন বসন্ত।
ব্যাপ্ত হোলে যা অন্ধকার, সংহত হোলে তা আলোক, আরো সংহত হোলে তা অগ্নি। সংহতিই প্রাণ। সংহত হোলেই তেজ, প্রাণ, আকার, ব্যক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। আমরা জড়োপাসক শক্তি-উপাসক ব’লেই বৃহত্বের উপাসনা করে থাকি, বৃহত্বের অভিভূত হয়ে যাই। কিন্তু বৃহৎ অপেক্ষা ক্ষুদ্র অধিক আশ্চর্য্য। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বাষ্পরাশি অপেক্ষা একবিন্দু জল আশ্চর্য্য। সুবিস্তৃত নীহারিকা অপেক্ষা সংক্ষিপ্ত সৌরজগৎ আশ্চর্য্য। আরম্ভ বৃহৎ, পরিণাম ক্ষুদ্র। আবর্ত্তের মুখ অতি বৃহৎ, অবর্ত্তের শেষ বিন্দুমাত্র। সুবিশাল জগৎ ঘুরে ঘুরে এই ক্ষুদ্রত্বের দিকে বিন্দুত্বের দিকে চলে। কেন্দ্রের মহৎ আকর্ষণে পরিধি সংক্ষিপ্ত হয়ে কেন্দ্রত্বে আত্মবিসর্জ্জন করতে যায়।
যত বৃহৎ হই তত দেশকালের অধীন হোতে হয়। আয়তন নিয়ে আমাদের নিরন্তর যুদ্ধ। কার সঙ্গে? দানব কাল ও দানব দেশের সঙ্গে। দেশকাল বলে—আয়তন আমার; আমার জিনিষ আমাকে ফিরিয়ে দাও। অবিশ্রাম লড়াই ক’রে অবশেষে কেড়ে নেয়। শ্মশানক্ষেত্রে তার ডিক্রিজারি।
কিন্তু আমরা জানি আমরা মৃত্যুকে জিতব। অর্থাৎ দেশকালকে অতিক্রম করব। মনুষ্যের অভ্যন্তরে এক সেনাপতি আছে। সে যুদ্ধ করছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মরছে কিন্তু যুদ্ধের বিরাম নেই। আমরা সংহতিকে অধিকার ক’রে ব্যাপ্তিকে জিতব—মনুষ্যত্বের এই সাধনা।
সংহতিকে অধিকার করাই শক্ত। আমাদের হৃদয় মন বাপের মতো। চারদিকে ছড়িয়ে আছে। হু হু ক’রে ব্যাপ্ত হয়ে পড়া যেমন বাপের স্বাভাবিক গুণ, আমরাও তেমনি স্বভাবতই চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ি। অভ্যন্তরে সুদৃঢ় আকর্ষণশক্তি না থাকলে আপন হয়ে আমরা পর হয়ে যাই। আপনাকে বিন্দুতে নিবিষ্ট করাই শক্ত। যোগীরা এই বিন্দুমাত্রে স্থায়ী হবার জন্য বৃহৎ সংসারের আশ্রয় ছেড়ে সূচ্যগ্রস্থানের জন্যই লড়াই করেন। তাঁরা বিন্দুর বলে ব্যাপককে অধিকার করবেন। সঙ্কীর্ণতার বলে পরিকীর্ণতা লাভ করবেন।
সংহত দীপশিখা তার আলোকে সমন্ত গৃহ অধিকার করে। কিন্তু সেই শিখা যখন প্রচ্ছন্ন উত্তাপ আকারে গৃহের কড়িতে বরগায় তার উপকরণে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে তখন গৃহই তাকে বন্ধ ক’রে রাখে, সে জাগতে পায় না। যতটা ব্যাপ্ত হব ততটা অধিকার করব, এর উল্টোটাই ঠিক। অর্থাৎ যতটা ব্যাপ্ত হবে তুমি ততই অধিকৃত হবে। কিন্তু চারদিক থেকে আপনাকে প্রত্যাহার ক’রে যখন বহ্নিশিখার মতো স্বতন্ত্র দীপ্তি পাবে তখন তোমার সেই তেজস্বী স্বাতন্ত্রের জ্যোতিতে চারিদিক উজ্জ্বলরূপে অধিকার করতে পারবে।
ভারতবর্ষীয় সাধনার চরম লক্ষ্য সংহতি অর্থাং অধ্যাত্মযোগ। প্রাণশক্তি, মানসশক্তি, অধ্যাত্মশক্তিকে সংহত করতে পারলে তবেই অন্তরকে বাহিরকে জয় করা যায়।
আমার কোনো বন্ধু লিখেছেন অতীতকাল অমরাবতী। অতীতে অমৃত আছে। অতীত সংক্ষিপ্তি। বর্ত্তমান কেবল অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। মুহূর্ত্ত, অতীতকালে সেই মুহূর্ত্তরাশি সংহত হয়ে যায়। বর্তমান ত্রিশটা পৃথক দিন, অতীত একটা সমগ্র মাস। যাকে প্রত্যেক বর্ত্তমান মুহূর্তে দেখি আমরা প্রতিক্ষণে তার মৃত্যুই দেখতে পাই, যাকে অতীতে দেখি তার অমরতা দেখতে পাই।
যখন গড়তে আরম্ভ করি তখনই প্রতিমা চোখের সম্মুখে জেগে থাকে, যখন শেষ ক’রে ফেলি তখন দেখি তা নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুদূর লক্ষ্যাভিমুখে যখন যাত্রা আরম্ভ করি তখন লক্ষ্যের প্রতি এত টান যে লক্ষ্য যেন প্রত্যক্ষ, আর পথপ্রান্তে যখন যাত্রা শেষ করি তখন পথের প্রতি এত মায়া যে লক্ষ্য আর মনে পড়ে না। যাকে আশা করি তাকে যতখানি পাই আশা পূর্ণ হোলে তাকে আর ততখানি পাইনে। অর্থাৎ চাইলে যতখানি পাই পেলে ততখানি পাইনে।
আসল কথা শেষ মানুষের হাতে নেই।‘শেষ হোলো’ ব’লে যে আমরা দুঃখ করি তার এই—শেষ হয়নি তবুও শেষ হলো! আকাঙ্ক্ষা রয়েছে অথচ চেষ্টার অবসান হোলো। এইজন্য মানুষের কাছে শেষের অর্থ দুঃখ। কারণ মানুষের সমাপ্তির অর্থ অসম্পূর্ণতা।