বিচিন্তা/ইহকাল পরকাল
ইহকাল পরকাল
ইংরেজীতে প্রবাদ আছে―অন্ধকার ঘরে একজন অন্ধ একটি কালো বেরালকে ধরবার চেষ্টা করছে, কিন্তু বেরাল সে ঘরেই নেই; একেই বলে দার্শনিক গবেষণা।
দার্শনিক সিদ্ধান্ত বাঁধাধরা নয়, তাই এই উপহাস। বৈজ্ঞানিক মত প্রায় সর্বসম্মত। কোনও এক মতে যদি মোটামুটি কাজ চলে তবে সকল বিজ্ঞানীই তা মেনে নেন, এবং পরে যদি আরও ব্যাপক ও যুক্তিসম্মত নূতন মত আবিষ্কৃত হয় তবে বিনা দ্বিধায় পূর্বের ধারণা ছেড়ে দিয়ে নূতন মতের অনুবর্তী হন। পূর্বে লোকে মনে করত যে পৃথিবী স্থির হয়ে আছে, সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ধারণা অনুসারেও গ্রহণ প্রভৃতি অনেক জ্যোতিষিক ব্যাপারের গণনা করা যেত সেজন্য সেকালের বিজ্ঞানীরা তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন বুঝেছিলেন যে এই সিদ্ধান্তে অনেক বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। অবশেষে দেখা গেল যে সূর্য স্থির এবং পৃথিবী প্রভৃতি গ্রহই তাকে বেষ্টন করে ঘোরে―এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে জ্যোতিষগণনা সরল হয় এবং সমস্ত অসংগতির অবসান হয়। তখন সকল বিজ্ঞানীই নূতন মত মেনে নিলেন। নিউটনের মহাকর্ষবাদ এতদিন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু আইনস্টাইনের মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত অধিকতর যুক্তিসম্মত মনে হওয়ায় সকল বিজ্ঞানীই এখন তা মেনে নিয়েছেন, যদিও সব রকম স্থূল গণনায় নিউটনের সূত্রেই কাজ চলে।
দার্শনিক তত্ত্বে এ রকম সর্বসম্মতি দেখা যায় না। বিজ্ঞানশিক্ষার্থী তাঁর পাঠ্যপুস্তকে যেসব তথ্যের বর্ণনা পান তা সুপ্রতিষ্ঠিত। তথ্যের যাঁরা আবিষ্কর্তা বা মতের যাঁরা প্রবর্তক তাঁদের নাম পুস্তকে থাকে বটে, কিন্তু তা নিতান্ত গৌণ। পক্ষান্তরে দার্শনিক পাঠ্যপুস্তকে কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না; শংকর বা রামানুজ বা বৌদ্ধাচার্যগণ কি বলেছেন, স্পিনোজা হিউম বার্ক্লি হেগেল প্রভৃতির মত কি―এই সব আলোচনাই থাকে, সত্যজিজ্ঞাসু পাঠককে দিশাহারা হতে হয়। আমাদের টোলের বা কলেজের ছাত্ররা যা পড়েন তা দার্শনিক তথ্য নয়, দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস। বিজ্ঞান আর দর্শনের এই প্রভেদের কারণ―বিজ্ঞান প্রধানত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নিয়ে কারবার করে, তার সহায় প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং তদাশ্রিত অনুমান; কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য কিনা তা বার বার পরীক্ষা বা নিরীক্ষার পর স্থির করা হয়। জূল বললেন, এতটা শক্তি রূপান্তরিত হয়ে এতটা তাপ উৎপন্ন করে; তিনি পরীক্ষা করে তা দেখিয়ে দিলেন। তার পর বহু বিজ্ঞানী অনুরূপ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে জূলের সিদ্ধান্ত ঠিক। গীতায় আছে, মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নব বস্ত্র পরে, সেইরূপ জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নব শরীর গ্রহণ করে; কিন্তু গীতাকার প্রমাণ দিলেন না। বার্ক্লি বললেন, ঈশ্বরের চৈতন্যই সকল পদার্থের আধার, কিন্তু কোন্ উপায়ে ঐশ্বরিক চৈতন্য উপলব্ধি করা যায় তা বললেন না। দার্শনিক মতের প্রমাণ নেই―অন্তত আদালতে গ্রাহ্য হতে পারে এমন প্রমাণ নেই, তাই পরস্পরবিরুদ্ধ নানা মতের উৎপত্তি হয়েছে এবং লোকে রুচি অনুসারে পুনর্জন্ম স্বর্গনরক নির্বাণ দ্বৈতবাদ মায়াবাদ দেহাত্মবাদ প্রভৃতি যা খুশী মেনে নেয়।
বিজ্ঞান আর দর্শনের মাঝে একটি প্রান্তভূমি আছে, পণ্ডিতরা বহু দিন থেকে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। এই গহন প্রদেশে এখনও ইচ্ছামত পরীক্ষা বা নিরীক্ষা চলে না তাই তত্ত্বান্বেষীকে প্রধানত অনুমান আর কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। যাঁরা কঠোর যুক্তিবাদী তাঁরা অতি সতর্ক হয়ে যথাসাধ্য অপক্ষপাতে রহস্য ভেদের চেষ্টা করছেন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধানে এখনও বেশী মতৈক্যের আশা নেই এবং কল্পনার বিলাস অবাধে চলছে। তারই নমুনাস্বরূপ কিঞ্চিৎ আলোচনা করছি।
বিদ্যাসাগর বোধোদয়ে লিখেছেন (ভাষাটি ঠিক মনে নেই)―‘আমরা ইতস্তত যে সমুদায় বস্তু দেখিতে পাই তাহাদিগকে পদার্থ কহে।’ আর একটু বিশদ করে বলা যেতে পারেদ―আমরা যেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথক পৃথক বিষয়ের সংস্রবে আসি তাদের নাম পদার্থ। মানুষ জন্তু গাছ নক্ষত্র পাহাড় নদী বাড়ি ইট শস্যকণা জীবাণু সবই পদার্থ। পদার্থের উৎপত্তি স্থিতি ও বিনাশ হতে পারে, কিন্তু অনেক পদার্থের উৎপত্তি-বিনাশ দেখবার সুযোগ আমাদের নেই, যেমন নক্ষত্র, হিমালয় পর্বত। পদার্থ মাত্রই নিরন্তর বদলাচ্ছে, আজ যেমন আছে কাল তেমন থাকবে না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অত্যন্ত মন্থর, সেজন্য আমাদের অগোচর।
একটি দার্শনিক সংজ্ঞা আছে―একদেশসম্বন্ধ। আমি যখন কোনও গাড়িতে চড়ি বা বিছানায় শুই তখন আমার সর্ব দেহ দিয়ে গাড়ি বা বিছানার সমস্তটা ব্যাপ্ত করে থাকি না, এক অংশেই থাকি, তাই তার সঙ্গে আমার একদেশসম্বন্ধ হয়। মায়ের সঙ্গে কোলের ছেলের, আমার সঙ্গে আমার হাতে ধরা কলমের এই সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধ অল্পকালস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, একবার ঘুচে গিয়ে আবার স্থাপিত হতে পারে, চিরকালের জন্য লুপ্তও হতে পারে। একদেশসম্বন্ধের ন্যায় এককালসম্বন্ধও আমরা কল্পনা করতে পারি। আমার পিতা এখন মৃত। তিনি আর আমি কয়েক বৎসর একই কালে বিদ্যমান ছিলাম, তখন তার সঙ্গে আমার এককালসম্বন্ধ ছিল। দুজন লোক যদি একই মুহূর্তে জন্মায় এবং এক সঙ্গেই মরে তবে বলা যেতে পারে যে তাদের সমকালসম্বন্ধ আছে, কিন্তু এমন সম্বন্ধ দুর্ঘট। কোনও সময়ে জগতে যত লোক জীবিত থাকে তাদের মধ্যে আলাপপরিচয় বা সাক্ষাৎকার না হলেও এককালসম্বন্ধ হয়। এই সম্বন্ধ মৃত্যুতে ছিন্ন হয়, একদেশসম্বন্ধের ন্যায় পুনর্বার স্থাপিত হতে পারে। জীবন-মৃত্যু মিলন-বিরহ আমাদের পক্ষে চিত্তবিক্ষোভকর গুরুতর ব্যাপার, কিন্তু উদাসীন তত্ত্বদর্শী বলেন—
যথা কাষ্ঠঞ্চ কাষ্ঠঞ্চ সমেয়াতাং মহোদধৌ।
সমেত্য চ ব্যপেয়াতাং তদ্বদ্ভূতসমাগমঃ॥
―মহাসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এক খণ্ড কাষ্ঠ অপর এক কাষ্ঠের সঙ্গে মিলিত হয়, আবার দূরে চলে যায়; প্রাণিগণের মিলনবিরহও সেইরূপ।
আমরা কি শুধুই ‘কাষ্ঠং কাষ্ঠং’? মৃত্যুর পরে কি পুনর্বার মিলনের সম্ভাবনা নেই? হিন্দু খ্রীষ্টান মুসলমান এক বাক্যে বলেন, অবশ্যই আছে, আত্মা মরে না, পরজন্মে অথবা স্বর্গে বা নরকে আবার মিলন হতে পারবে। এই ধারণায় মন তৃপ্ত হতে পারে, কিন্তু যুক্তিবাদী তত্ত্বান্বেষী এমন শূন্যগর্ভ আশ্বাসে ভোলেন না। তিনি বলেন, ইহকালে আমাদের অস্তিত্ব কি রকম তাই আগে জানা দরকার, পরকালের কথা পরে ভাবব। শাস্ত্রে আছে—‘আত্মানং বিদ্ধি’, আত্মাকে জান। আত্মা বললে ঠিক কি বোঝায় তা জানি না; তার বদলে আমার প্রত্যক্ষ স্থূল সত্তাকে বোঝবার চেষ্টা করব।
বোধোদয়ের মতে আমি একটি চেতন পদার্থ, ধরাধামে আমার অস্তিত্ব জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। বাল্যকালে আমি যেরকম ছিলাম এখন সেরকম নেই, শরীর আর মতিগতি অনেক বদলেছে। এই পরিবর্তমান আমি কি একই পদার্থ? বহু লোকে বলেন, দেহের আর মনের যতই অদলবদল হ’ক তোমার আত্মা বরাবর একই আছে, পরলোকেও থাকবে। যাঁরা বলেন তাঁরা কেউ পরলোক-ফেরত নন, সুতরাং তাদের কথার মূল্য নেই। গীতায় আছে, জীব আদিতে ও মরণান্তে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত; অর্থাৎ জন্মের আগে এবং মৃত্যুর পরে জীবের অবস্থা অজ্ঞাত, কেবল জীবিতাবস্থাই জ্ঞাত। অতএব এই প্রত্যক্ষ জীবিতাবস্থারই বিচার করে দেখা যাক আমার সত্তা কিরকম। আমার ছেলেবেলার ছবির সঙ্গে বুড়ো বয়সের ছবির অল্প মিল থাকতে পারে, কিন্তু দুটি বিভিন্ন ক্ষণিক বিষয়ের প্রতিরূপ। আমার স্বভাব শক্তি রুচি বিদ্যাবুদ্ধিরও এইরকম পরিবর্তন হয়েছে। বস্তুত আমি একটি পদার্থ নই, অসংখ্য পদার্থের পরম্পরা, যেমন সিনেমার ছবি। মনে করুন হীরাবাই-নাটকের সিনেমা-ফিল্ম দশ হাজার ফুট লম্বা। তার সমস্ত রীলকে বলা যেতে পারে হীরাবাই-ফিল্ম, কিন্তু এক টুকরোকে এ নাম দেওয়া যায় না। ফিল্মের রীল যখন কৌটায় থাকে তখন খানিকটা জায়গা জুড়ে থাকে, অর্থাৎ তার দু-চার ঘন-ফুট দেশব্যাপ্তি আছে। কিন্তু তার ছবি যখন পর্দায় দেখানো হয় তখন তার প্রায় ২০০ বর্গ-ফুট দেশব্যাপ্তি হয় এবং সেই সঙ্গে প্রায় দু ঘণ্টা কালব্যাপ্তি হয়। দেশে কালে ব্যাপ্ত এই চিত্র পরম্পরাই হীরাবাই-নাটকের যথার্থ প্রতিরূপ; ফিল্মের রীল সেই প্রতিরূপের উৎপাদক মাত্র।
অতএব আমার যথার্থ সত্তা আমার সমগ্র জীবন। শুধু দেশে কালে ব্যাপ্ত আমার শরীর নয়, আমার চিত্ত ও কর্মও এই সত্তার অঙ্গীভূত। যদি সত্তর বৎসর বাঁচি তবে এই সময়ের মধ্যে আমার শারীরিক মানসিক যত পরিবর্তন হয়েছে, আমি সুখ দুঃখ অনুরাগ বিরাগ যা ভোগ করেছি, সুকর্ম দুষ্কর্ম যা করেছি, সব সুদ্ধ নিয়ে আমার সত্তা। আমাকে পদার্থ বললে ছোট করা হবে, আমি সত্তর বৎসর ব্যাপী একটি ঘটনাপ্রবাহ। এ ভিন্ন যদি আমার অন্যবিধ সত্তা মানা হয় তবে তা ক্ষণিক, অসম্পূর্ণ, অথবা অপ্রমাণিত।
আপাত দৃষ্টিতে হিমালয় যতই অটল অচল মনে হ’ক, তারও পরিবর্তন ঘটছে, অতএব হিমালয় একটি ঘটনাপ্রবাহ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও এইরকম, তাই ‘জগৎ’ আর ‘সংসার’ নাম। গঙ্গার যে জলরাশি এই মুহূর্তে দেখছি পর মুহূর্তে তা চলে গেছে, তার স্থানে অন্য জলরাশি এসেছে, তটরেখাও ক্রমশ বদলাচ্ছে, গঙ্গার কোনও অংশই স্থায়ী নয়। এই কারণেই গ্রীক পণ্ডিত হেরাক্লাইটস বলেছিলেন, একই নদী দুবার পার হওয়া যায় না। নির্বাত স্থানে প্রদীপের শিখা একটি স্থির পদার্থ বলে মনে হয়। তেলের বাষ্প আর বাতাসের অক্সিজেন একসঙ্গে মিশে জ্বলছে এবং এই দুই উপাদান নিরন্তর বদলাচ্ছে; এই ঘটনাপ্রবাহকেই আমরা দীপশিখা রূপে দেখি।
প্রদীপ নিবে গেলে তার শিখা কোথায় যায়? মৃত্যুর পরেও কি আত্মার অস্তিত্ব থাকে? আমরা কিছুই জানি না। নদী আর প্রদীপ অচেতন তাই তাদের আত্মার কথা আমাদের মনে আসে না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চেতন অবস্থায় যে অহংজ্ঞান থাকে, আমি পূর্বে এই করেছিলাম, এখন এই করছি, এই ছিলাম, এখন এই হয়েছি―এই ধারাবাহিক জ্ঞান বা স্মৃতিই আমার ব্যক্তিত্ব, তাকেই আত্মা মনে করতে পারি। মহাভারতের উপমা অনুসারে বলা যেতে পারে―মহাকালসমুদ্রে ঘটনাপ্রবাহরূপ অসংখ্য কাষ্ঠ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, আমি তাদেরই একটি। অন্যান্য যে সকল সচেতন কাষ্ঠ আমার সংসর্গে আসে―অর্থাৎ তাদের সঙ্গে যখন আমার এককালসম্বন্ধ হয় তখন তাদের আমি জীবিত মনে করি। যে কাষ্ঠ সরে যায় তাকে মৃত মনে করি। আমি স্বয়ং যখন আমার সঙ্গীদের কাছ থেকে দূরে চলে যাই তখন তারা আমাকে মৃত মনে করে। তার পরেও আমার চেতনা বা ব্যক্তিত্ববোধ থাকে কিনা তা বলা আমার সাধ্য নয়।
এই পর্যন্ত মেনে নিতে বিশেষ বাধা হয় না, কিন্তু পরে যা বলছি তা বিভিন্ন পণ্ডিতের অনুমান বা কল্পনা মাত্র। সিনেমার ছবি একবার দেখানো হলেই তার বিনাশ হয় না; চিত্রপ্রবাহরূপ যে ঘটনার একবার অবসান হয়েছে আবার তা দেখানো যেতে পারে, কারণ, তার মূলীভূত ফিল্মের তো বিনাশ হয় নি। আমাদের জীবনরূপ চলচ্চিত্রের মূলস্বরূপ কি কিছু নেই? বিজ্ঞানী বলেন, আমরা যে লাল নীল প্রভৃতি রং দেখি তা দর্শনেন্দ্রিয়ের বিভ্রম মাত্র, আলোকতরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ভেদই আমাদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন রং বলে মনে হয়। সেই রকম বলা যেতে পারে যে মহাকাল একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ, আমাদের মনের গুণে (বা দোষে)ই ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের ভেদজ্ঞান হয়। যা বর্তমান তারই অস্তিত্ব আছে, যা অতীত আর ভবিষ্যৎ তার অস্তিত্ব এখন নেই—এমন মনে করব কেন? সমস্তই সিনেমা-ফিল্মের রীলের ন্যায় যুগপৎ বিদ্যমান, সমস্তই নিত্য; আমার মনের শক্তি সীমাবদ্ধ তাই কালকে খণ্ড খণ্ড করে উপলব্ধি করি। বহু পণ্ডিতের মতে দেশ ও কাল illusion বা অধ্যাস বা মায়া মাত্র।
একদেশসম্বন্ধ ছিন্ন হলে আবার তা স্থাপিত হতে পারে, সেইরকম এককালসম্বন্ধ কি পুনস্থাপিত হতে পারে না? কালসমুদ্রে বিয়োজিত দুই কাষ্ঠের পুনর্মিলন কি অসম্ভব? যদি অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সমস্তই একসঙ্গে বিদ্যমান থাকে তবে আপাতদৃষ্টিতে কালব্যবধান যতই থাকুক, এক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আর এক ঘটনাপ্রবাহের পুনর্বার সংযোগ অসাধ্য নাও হতে পারে।
পনর-বিশ বৎসর পূর্বে J. W. Dunne কয়েকটি গ্রন্থ লেখেন— An Experiment with Time, The New Immortality, The Serial Universe, ইত্যাদি। এইসকল গ্রন্থে তিনি কাল এবং সংবিৎ (consciousness) সম্বন্ধে এক নূতন মত প্রচার করেছেন এবং বলেছেন যে চেষ্টা করলে স্বপ্নযোগে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বিষয় কিছু কিছু জানা যায়, অর্থাৎ অতীত বা ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বর্তমান ব্যক্তিগত ঘটনাপ্রবাহের সংযোগ করা যায়। তিনি অনেক যুক্তি দিয়ে এবং অঙ্ক কষে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে আমাদের সংবিৎ বা চেতনা চিরস্থায়ী, অর্থাৎ আমরা সকলেই অমর। উক্ত পুস্তকগুলি প্রকাশিত হলে বিলাতের সুধীসমাজে একটি প্রবল সাড়া পড়েছিল, খ্যাতনামা বহু সাহিত্যিক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন, এবং অনেক বিজ্ঞানীও বলেছিলেন যে এই মত উপেক্ষার যোগ্য নয়। কিন্তু সাধারণের আগ্রহ বেশী দিন রইল না, এখন আর Dunne-এর নাম বড় একটা শোনা যায় না। সম্ভবত তার নির্দেশিত উপায়ে যাঁরা পরীক্ষা করেছিলেন তাঁরা সন্তোষজনক ফল পান নি।
দিব্যদৃষ্টি আর ত্রিলোক-ত্রিকাল-দর্শিতার কথা পুরাণে আছে। clairvoyance, telepathy, medium-এর মধ্যতায় মৃতজনের সঙ্গে আলাপ, ইত্যাদিতে আস্থাবান লোকেরও অভাব নেই। কিন্তু যুক্তিবাদী তত্ত্বান্বেষী মুখের কথায় বিশ্বাস করেন না, অতিসাধু লোকের সাক্ষ্যও অভ্রান্ত মনে করেন না। বাজিকর আর ভণ্ড লোকে অনেক অলৌকিক খেলা দেখাতে পারে, তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিজ্ঞানী উকিল জজ বা পুলিসের পক্ষেও তার রহস্যভেদ সুসাধ্য নয়। সম্প্রতি আমেরিকায় Rhine এবং ইংলণ্ডে Soal প্রমুখ কয়েকজন বিজ্ঞানী অতীন্দ্রিয় অনুভূতি সম্বন্ধে অভিনব উপায়ে পরীক্ষা করেছেন যাতে প্রতারণা অসম্ভব। এঁদের গবেষণার উপকরণ―কতকগুলি কার্ড যাতে নানা রকমের চিহ্ন আঁকা আছে। এই কার্ডগুলি যন্ত্রের সাহায্যে একে একে একজন লোককে দেখানো হয় এবং দূরবর্তী অন্য ঘরে আর একজন লোক আন্দাজে সেই অদেখা কার্ডের বর্ণনা দেয়। অধিকাংশ স্থলে অনুমানে ভুল হয়, কিন্তু বহুবার বহু লোককে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কিছু কিছু মিলে যায়। সব মিলই আকস্মিক এমন বলা যায় না, কারণ, probability বা সম্ভাবনা-গণিত অনুসারে আকস্মিক মিল যত হতে পারে তার চেয়ে বেশী মিল দেখা গেছে। এই পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে জনকতক লোকের অল্পাধিক মাত্রায় telepathy বা দূরবেদনের ক্ষমতা আছে এবং সম্ভবত সকল লোকেরই ঈষৎ মাত্রায় আছে। মাঝে মাঝে এমনও দেখা গেছে যে দ্বিতীয় লোকটি অন্য ঘরে প্রদর্শিত কার্ডের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কার্ড অনুমান করেছে, অর্থাৎ সে অতীত বা ভবিষ্যৎ দর্শন করেছে।
এইপ্রকার পরীক্ষায় যে ফল পাওয়া গেছে তা বৃহৎ নয়, কিন্তু নিরপেক্ষ পণ্ডিতদের মতে তার গুরুত্ব আছে। পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে ইহকাল-পরকালের স্পষ্ট সম্বন্ধ কিছু দেখা যায় না, কিন্তু কয়েকজন দার্শনিক আর বিজ্ঞানী এই সামান্য প্রমাণ অবলম্বন করে দেশকাল-আত্মা সম্বন্ধে নানারকম সিদ্ধান্ত করেছেন, আবার অন্যে তাঁদের ভুলও দেখিয়েছেন। মানুষ বহুকাল থেকে আকাশে ডানা মেলে ওড়বার স্বপ্ন দেখেছে, চেষ্টা করতে গিয়ে বার বার বিফল হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন অঙ্ক কষে প্রমাণ করেছিলেন যে বাতাসের চেয়ে ভারী যন্ত্রে (অর্থাৎ এয়ারোপ্লেনে মানুষ কখনও উড়তে পারবে না, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়েছে। অতীন্দ্রিয় ব্যাপার নিয়ে সতর্ক গবেষণা সবে আরম্ভ হয়েছে, তা সফল হবে কি বিফল হবে এখনই বলা অসম্ভব। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক আশ্চর্য বিষয় আবিষ্কৃত হবে, অন্ধকার ঘরে কালো বেরাল ধরা না পড়লেও অন্তত তার কিঞ্চিৎ লোম হস্তগত হবে; কিন্তু এখনই উৎফুল্ল হবার কারণ নেই।
১৩৫৫