বিচিন্তা/জন্মশাসন ও প্রজাপালন

জন্মশাসন ও প্রজাপালন

পুরাণে আছে, মানব বা দানবের পীড়নে বিপন্না বসুন্ধরা যখন ত্রাহি ত্রাহি রব করতে থাকেন তখন নারায়ণ কৃপাবিষ্ট হয়ে ভূভার হরণ করেন। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই পুরাণোক্তির ব্যাখ্যা করা যেতে পারে —কোনও প্রাণিসংঘ যদি পরিবর্তিত প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে না পারে অথবা নিজের সমাজগত বিকারের প্রতিবিধান করতে না পারে তবে তার ধ্বংস হয়। এই প্রাকৃতিক নিয়মে পুরাকালের অনেক জীব এবং সমৃদ্ধ মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে।

 পৃথিবী এখন একসত্ত্বা, তার একটি অঙ্গ রুগ্ন হলে সর্ব দেহের অম্লাধিক বিকারের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেকালে এক দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যোগ অল্পই ছিল। নেপোলিয়নের আমলে প্রায় সমস্ত ইওরোপ যুদ্ধে লিপ্ত হলেও এশিয়া তাতে জড়িয়ে পড়ে নি। চল্লিশ বৎসর পূর্বে মার্কিন রাষ্ট্র ইওরোপীয় রাজনীতি থেকে তফাতে থাকত। চীন দেশে বা ভারতে দুর্ভিক্ষ হলে বিলাতের বণিক সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হত কিন্তু জনসাধারণ তার জন্য উৎকণ্ঠিত হত না। বিগত প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতীয় প্রজার বিশেষ অনিষ্ট হয় নি। কিন্তু বিভিন্ন দেশের এই পৃথগ‍্ভাব এখন লোপ পেতে বসেছে। জার্মনি আর জাপানে স্থানাভাব, জীবনযাত্রা ও শিল্পের উপাদানও যথেষ্ট নেই, তার ফলে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হল। ভারত আর এশিয়ার অন্যান্য স্থানের দারিদ্র্য দেখে আমেরিকা ব্রিটেন ফ্রান্স প্রভৃতি এখন চিন্তিত হয়ে পড়েছে, পাছে সমস্ত প্রাচ্য দেশ কমিউনিস্টদের কবলে যায়।

 বহু দেশের লোকসংখ্যা দ্রুতবেগে বেড়ে যাচ্ছে। কবি হেমচন্দ্রের ভারতভূমি ছিল ‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’, এখন খণ্ডিত ভারতেরই লোকসংখ্যা ৩৬ কোটি এবং প্রতি বৎসরে প্রায় ৫০ লক্ষ বাড়ছে। পৃথিবীর লোকসংখ্যা ২০ বৎসর আগে প্রায় ১৮৫ কোটি ছিল, এখন ২০০ কোটির বেশী হয়েছে। সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের প্রজাবৃদ্ধির হার অনেক বেশী, কিন্তু এক দেশে অন্নাভাব আর স্থানাভাব হলে সকল দেশের পক্ষে তা শঙ্কাজনক। পৃথিবীতে বাসযোগ্য ও কৃষিযোগ্য ভূমি এবং খনিজ উদ্‌ভিজ্জ ও প্রাণিজ সম্পদ যা আছে তার যথোচিত বিভাগ হলে সমস্ত মানবজাতির উপস্থিত প্রয়োজন মিটতে পারে, কিন্তু রাজনীতিক ও অন্যান্য কারণে তা অসম্ভব। ভারতের নানা স্থানে বাঙালী পঞ্জাবী ও সিন্ধী উদ্‌বাস্তুদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। ব্রিটেন জার্মানি ও ইটালির বাড়তি প্রজাও অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও কানাডায় আশ্রয় পাচ্ছে, কিন্তু সেসব দেশে ভারতী বা জাপানী প্রজার বসতি নিষিদ্ধ। যেখানে প্রচুর তেল কয়লা প্রভৃতি খনিজ বস্তু বা খাদ্যসামগ্রী আছে সেখান থেকে মাল পাঠিয়ে অন্য দেশের অভাব অবাধে পূরণ করা যায় না। পৃথিবী একসত্ত্বা হলেও একাত্মা হয় নি।

 প্রায় দেড় শ বৎসর পূর্বে মালথস বলেছিলেন, খাদ্যের উৎপাদন যে হারে বাড়ানো যেতে পারে তার তুলনায় জনসংখ্যা বেশী গুণ বেড়ে যাবে, অতএব জন্মশাসন আবশ্যক, নতুবা খাদ্যাভাব হবে। এদেশের অনেকে মনে করেন, লোকসংখ্যা যতই বাড়ুক তার জন্য আতঙ্কের কারণ নেই, যিনি জীব দিয়েছেন তিনিই আহার যোগাবেন। ভারতে ভূমির অভাব নেই, একটু চেষ্টা করলেই চাষবাসের যোগ্য বিস্তর নূতন জমি পাওয়া যাবে, জলসেক আর সারের ভাল ব্যবস্থা হলে ফসল বহু গুণ বেড়ে যাবে। আর জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি ভাল নয় বটে, কিন্তু তার প্রতিকার সংযমের দ্বারাই করা উচিত, কৃত্রিম উপায়ের প্রচলন হলে ইন্দ্রিয়াসক্তি প্রশ্রয় পাবে। এঁরা মনে করেন উপদেশ দিয়েই জনসাধারণকে সংযমী করা যেতে পারে।

 যাঁরা দূরদর্শী জ্ঞানী তাঁরা এই যদ্‌ভবিষ্য নীতি মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। খুব চেষ্টা করলে কৃষিযোগ্য ও বাসযোগ্য জমি বাড়বে এবং খাদ্য বস্ত্র ও শিল্পসামগ্রীর অভাব মিটবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু খাদ্যবস্ত্রাদি বৃদ্ধির একটা সীমা আছে। যদি বর্তমান হারে লোকসংখ্যা বেড়ে যায় তবে এমন দিন আসবে যখন এই বিপুলা পৃথিবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে না, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত চেষ্টাতেও ফল হবে না। অ্যাটম বা হাইড্রোজেন বোমায় নয়, ভাবী মহাযুদ্ধে নয়, গ্রহনক্ষত্রের সংঘর্ষেও নয়; বর্তমান সভ্যসমাজের রীতিনীতিতেই এমন বিকারের বীজ নিহিত আছে যার ফলে অচির ভবিষ্যতে মানবজাতি সংকটে পড়বে।

 পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র যদি স্বার্থবুদ্ধি ত্যাগ করে সর্ব মানবের হিতার্থে একযোগে যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করে তবে সংকট নিবারিত হতে পারে। কিন্তু তার আশা নেই, সুতরাং প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই যথাসাধ্য স্বয়ম্ভর হতে হবে, প্রজাসংখ্যা আর জীবনোপায় (necessities of life)এর সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। সংকট যে বহুদূরবর্তী নয় সে বিষয়ে দূরদর্শী পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ নেই, কিন্তু তার স্বরূপ আর প্রতিবিধানের উপায় সম্বন্ধে তাঁরা এখনও বিশদ ধারণা করতে পারেন নি। সংকটের যেসব লক্ষণ ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে এবং তার প্রতিকারের সদুপায় বা কদুপায় যা হতে পারে তার একটা স্থুল আভাস দেবার জন্য দুটি কাল্পনিক দেশের বিবরণ দিচ্ছি—মনুজরাজ্য ও দনুজরাজ্য। মনে করা যাক দুই দেশেরই জনসংখ্যা পর্যাপ্ত, কৃষি ও বাসের যোগ্য ভূমি এবং জীবনযাত্রার জন্য আবশ্যক দ্রব্যও যথেষ্ট আছে, যদি আরও কিঞ্চিৎ প্রজাবৃদ্ধি হয় তাতেও অনটন হবে না।

 মনুজরাজ্যে ধনী মধ্যবিত্ত দরিদ্র শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর প্রজাই আছে। রোগপ্রতিষেধ চিকিৎসা শিক্ষাপ্রসার ও শিল্পপ্রসার, জনসাধারণের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ইত্যাদি প্রজাকল্যাণের সকল চেষ্টাই করা হয়। কালক্রমে দেখা গেল প্রজাবৃদ্ধি অত্যধিক হচ্ছে। দেশের শাসকবর্গ কৃষি ও শিল্পবৃদ্ধির ব্যবস্থা করলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের যেসব নিশ্চিত উপায় আছে তাও জনসাধারণকে শেখাতে লাগলেন। শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণীর মধ্যে শীঘ্রই তা বহুপ্রচলিত হল, কিন্তু অশিক্ষিত ও দরিদ্র নিম্নশ্রেণী শিখতে চাইল না। শিক্ষিত জনের তুল্য তাদের চিত্তবিনোদনের নানা উপায় নেই, ইন্দ্রিয়সেবাই সর্বাপেক্ষা সুলভ বিলাস, তাতে কিছুমাত্র বাধা তারা সইতে পারে না। দশ-বিশ বৎসর পরেই দেখা গেল পূর্বের তুলনায় ভদ্রশ্রেণীর মধ্যে জন্মের হার কমে আসছে এবং নিম্নশ্রেণীর মধ্যে পূর্ববৎ বাড়ছে। শাসকবর্গ এর জন্য উৎকণ্ঠিত হলেন না, মনে করলেন নিম্নশ্রেণীও কালক্রমে শিক্ষিত হয়ে ভদ্রজনের আচরণ অনুসরণ করবে। ভদ্রের সংখ্যা কমে গেলেও ক্ষতি নেই, কারণ বুদ্ধি ও প্রতিভা বংশগত নয়, শিক্ষার ফলে ইতর জনও ভদ্রত্ব ও তদুচিত গুণাবলী লাভ করবে। একটা আশঙ্কা এই আছে যে সর্বসাধারণের মধ্যে জন্মনিরোধ প্রচলিত হলে ভবিষ্যতে প্রজাসংখ্যা অত্যন্ত কমে যেতে পারে। কিন্তু তার প্রতিকার সুসাধ্য, উপযুক্ত প্রচারের ফলে এবং বহু সন্তানবতীকে পুরস্কার দিলে জন্মের হার বেড়ে যাবে। ভবিষ্যৎ সৈন্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে হিটলার আর মুসোলিনি সেই চেষ্টা করেছিলেন।

 মনুজরাজ্যে যথোচিত খাদ্য আবাস আর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় অকালমৃত্যু কমে গেল, লোকের আয়ু বাড়তে লাগল। জন্মশাসনের ফলে জনসংখ্যা যত কমবে আশা করা গিয়েছিল তা হল না। তা ছাড়া যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ ম্যালেরিয়া কলেরা যক্ষ্মা প্রভৃতিতে এখন বেশী লোক মরছে না, শিশুমৃত্যু খুব কমে গেছে, লোকে অনেক কাল বাঁচছে। স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ায় বৃদ্ধরা আগের তুলনায় বেশী দিন খাটতে পারছে বটে, তথাপি বিস্তর অকর্মণ্য বৃদ্ধ সমাজের ভারবৃদ্ধি করছে। যারা জন্মাবধি পঙ্গু বা দুর্বল, যারা অসাধ্য রোগে আক্রান্ত, সুচিকিৎসার ফলে তারাও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকছে এবং তাদের অল্প কয়েকজন কাজের যোগ্য হলেও অধিকাংশই সমাজের গলগ্রহ হয়ে আছে। সকল ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে, জন্মশাসনে অভীষ্ট ফল হচ্ছে না, অকর্মণ্য বৃদ্ধ আর পঙ্গুও পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী হয়েছে। অবশেষে অতিপ্রজতার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম স্থানাভাব খাদ্যাভাব বজ্রাভাব প্রভৃতি নানা অভাব প্রকট হয়ে উঠল, মনুজরাজ্যে মৎস্যন্যায়ের লক্ষণ দেখা গেল। বিজ্ঞ জন ভাবতে লাগলেন, এ যে হিত করতে গিয়ে অহিত হল! সেকালের অব্যবস্থাই ভাল ছিল, যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ মহামারী অচিকিৎসা শিশুমৃত্যু ইত্যাদির ফলে প্রজার অতিবৃদ্ধি হতে পারত না।

 কিছুদিন পূর্বে বোম্বাইএ সার্বজাতিক জন্মশাসন-সম্মেলনের অধিবেশনে শ্রীরাধাকৃষ্ণন বলেছেন, মানবের হিতার্থে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণই সভ্যতা। প্রাণিজগতে কারা বেঁচে থাকবে তা প্রাকৃতিক প্রতিবেশ দ্বারাই নির্ধারিত হয়। ব্যাধি বন্যা দুর্ভিক্ষাদি নিবারিত করে আমরা প্রজার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছি, প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ব্যতিক্রম ঘটিয়েছি, তার ফলে সংকট দেখা দিয়েছে। জন্মশাসন ভিন্ন এই সংকটের প্রতিকার হবে না। সম্প্রতি British Association for the Advancement of Science এর সভাপতি প্রোফেসর এ. ভি. হিল তাঁর ভাষণে বলেছেন— All the impulses of decent humanity....religion and traditions of medicine insist that suffering should be relieved. তার পর তিনি বলেছেন —In many parts of the world improved sanitation and fighting of insect borne diseases lowered infantile death rates and prolonged span of life and led to vast increase of population....There is much discussion of human rights. Do they extend to unlimited reproduction, with a consequent obligation falling on those more careful? সমস্যা এই দাঁড়াচ্ছে—যদি যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ শিশুমৃত্যু রোগ প্রভৃতি নিবারিত হয়, প্রজার স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করা হয় এবং যথেষ্ট জন্মনিরোধ না হয় তবে জনসংখ্যা ভয়াবহ রূপে বাড়বে, প্রজার অভাব মেটানো অসম্ভব হবে। প্রোফেসর হিল অবশেষে হতাশ হয়ে বলেছেন—If ethical principles deny our right to do evil in order that good may come, are we justified in doing good when the foreseeable consequence is evil? অর্থাৎ হিতচেষ্টার পরিণাম যদি সমাজের পক্ষে অনর্থকর হয় তবে সে চেষ্টা কি আমাদের করা উচিত? মনুজরাজ্যের কর্ণধারগণ এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি।

 দনুজরাজ্যের শাসকবর্গ সমাজহিতৈষী কিন্তু নির্মম। অল্প স্থানে যদি অনেক চারা গাছ উৎপন্ন হয় তবে ক্ষেত্রপাল বিনা দ্বিধায় অতিরিক্ত গাছ উপড়ে ফেলে দেয় যাতে বাকী গাছগুলির উপযুক্ত পুষ্টি ও বৃদ্ধি হতে পারে। পাশ্চাত্ত্য দেশের লোক ঘোড়া গরু কুকুর ইত্যাদি সযত্নে পালন করে, কিন্তু অসাধ্য রোগ হলে অতি প্রিয় জন্তুকেও প্রায় মেরে ফেলে। ভারতবাসী গৃহপালিত জন্তুর তেমন যত্ন নেয় না, কিন্তু অকর্মণ্য রুগ্ন জন্তুকে মারতে তার সংস্কারে বাধে, যদিও কসাইকে গরু বাছুর বেচতে তার আপত্তি নেই। বহু বৎসর পূর্বে মহাত্মা গান্ধীর আজ্ঞায় তাঁর আশ্রমের একটি রোগার্ত বাছুরকে ইনজেকশন দিয়ে মারা হয়েছিল। বিপিনচন্দ্র পাল তার তীব্র নিন্দা করে লিখেছিলেন —গান্ধীজী বাছুরের কষ্টনাশের জন্য তাকে মারেন নি, নিজের কষ্টের জন্যই মেরেছেন। কৃষিচর্যায় সকল দেশেই যা করা হয়, পীড়িত ও বিকল জন্তু সম্বন্ধে পাশ্চাত্ত্য দেশে যে রীতি আছে, দনুজরাজ্যে মানুষের বেলাতেও তাই করা হয়। চিররুগ্ন পঙ্গু অক্ষম অসাধ্যরোগাতুর জরাগ্রস্ত এবং কুকর্মা লোককে সেখানে মেরে ফেলা হয়। বয়স বেশী হলেই যেমন কমচারীকে অবসর নিতে হয়, দনুজরাজ্যের বৃদ্ধদের তেমনি ইহলোক ত্যাগ করতে হয়। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। অল্পসংখ্যক হতভাগ্যদের সেখানে বাঁচতে দেওয়া হয়, যাতে ভাগ্যবান প্রজারা কিঞ্চিৎ করুণাচর্চার সুযোগ পায়। বহু দেশে যেমন মহাস্থবির হলেও রাজ্যপাল আর মন্ত্রীরা চাকরিতে বাহাল থাকেন, তেমনি দনুজরাজ্যে বাছা বাছা গুণী বৃদ্ধরা বেঁচে থাকবার লাইসেন্স পান। সেখানকার প্রজানিয়মন-পর্ষদ অর্থাৎ Board of Population Control জনসংখ্যার উপর কড়া নজর রাখেন। যদি তাঁরা দেখেন যে জন্মনিরোধের বহু প্রচলন সত্ত্বেও অভীষ্ট ফল হচ্ছে না, অথবা কোনও কারণে খাদ্যবস্ত্রাদির অত্যন্ত অভাব হয়েছে, তবে তাঁরা নির্মমভাবে প্রজাসংক্ষেপের যথোচিত ব্যবস্থা করেন। মোট কথা দনুজরাজ্যের একমাত্র লক্ষ্য—পরিমিতসংখ্যক প্রজার কল্যাণ ও উৎকর্ষ সাধন, মমতা বা অনুকম্পা সেখানে প্রশ্রয় পায় না।

 দনুজরাজ্যের প্রজারা তাদের অবস্থায় সন্তুষ্ট, কারণ তাতেই তারা অভ্যস্ত। তারা মনে করে, মনুজরাজ্যের শাসনপ্রণালী অতি সেকেলে আর অবৈজ্ঞানিক। সেখানে অযোগ্য জনকে বাঁচাতে গিয়ে সমগ্র সমাজকে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে, সুস্থ কর্মঠ প্রজার ন্যায্য প্রাপ্যের একটা বড় অংশ রুগ্ন অক্ষম অবাঞ্ছিত প্রজাকে দেওয়া হচ্ছে। পরিমিতসংখ্যক প্রজার পক্ষে যে জীবনোপায় পর্যাপ্ত হত, অপরিমিত প্রজার অভাব তা দিয়ে পূরণ করা যাচ্ছে না। ভ্রান্ত নীতির ফলে সেখানে সমাজের সর্বাঙ্গীণ ও পরিপূর্ণ উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়েছে। পক্ষান্তরে মনুজরাজ্যের লোকে মনে করে, দনুজরাজ্যের শাসকবর্গ ধর্মভ্রষ্ট ইহসর্বস্ব নরপিশাচ, সেখানকার প্রজারা মানুষাকৃতি পিপীলিকা।

 চণ্ডীদাস বলেছেন, সবার উপরে মানুষ সত্য। মহাভারতে হংসরূপী প্রজাপতির উক্তি আছে—গুহ্যং ব্রহ্ম তদিদং বো ব্রবীমি, ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ—এই মহৎ গুহ্য তত্ত্ব তোমাদের বলছি, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। ভারতের এই প্রাচীন মানুষবাদ এবং আধুনিক পাশ্চাত্ত্য humanism কি একই? মানুষ কারা? কার দাবি আগে, আমার প্রিয়জনের, না আদর্শরূপে কল্পিত প্রবাহক্রমে নিত্য মানবসমাজের? মহাভারতে সনৎকুমারের বাক্য আছে—যদ্ ভূতহিতমত্যন্তমেতং সত্যং মতো মম— যাতে জীবগণের অত্যন্ত হিত হয় তাই আমার মতে সত্য (অবলম্বনীয়)। এই জীবগণ কারা? Greatest good of the greatest number—বেন্থামের এই উক্তি আর সনৎকুমারের এই উক্তি কি সমার্থক? মহাভারতে কৃষ্ণ বলেছেন —ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ —ধারণ (রক্ষণ বা পালন) করে এজন্যই ধর্ম বলা হয়, ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। প্রজা যদি অত্যধিক হয় তবে কোন্ ধর্ম তাদের ধারণ করবে? যারা সামাজিক কর্ত্তব্য সম্বন্ধে অবহিত এবং পরিমিত মাত্রায় বংশরক্ষা করে তারা আগাছার মত উৎপন্ন অপরিমিত প্রজার ভার কত কাল বইবে? ভাগবতে রন্তিদেব বলেছেন—কাময়ে দুঃখতৃপ্তানাং প্রাণিনামার্তিনাশনম্ —এই কামনা করি যেন দুঃখতপ্ত প্রাণিগণের কষ্ট দূর হয়। প্রজার অতিবৃদ্ধি হলে দুঃখতপ্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তাদের কষ্টলাঘবের জন্য সুস্থ প্রজা কতটা স্বার্থত্যাগ করবে?

 প্রাচীন ধর্মজ্ঞগণ যা চাইতেন আধুনিক সমাজহিতৈষীরাও তাই চান—মানুষের অত্যন্ত হিত হ’ক, দুঃখার্তদের কষ্ট দূর হ’ক। কিন্তু সমস্যা এই—অবাধ প্রজাবৃদ্ধি এবং অযোগ্য প্রজার বাহুল্য হলে সমগ্র সমাজ ভারাক্রান্ত ও ব্যাধিত হয়। সকলের হিত করতে গেলে প্রত্যেকের ভাগে অল্পই পড়ে, অগণিত হতভাগ্যের প্রতি দয়া করতে গেলে সুস্থ সবল ও সুযোগ্য প্রজারা তাদের ন্যায্য ভাগ পায় না। অতএব জন্মশাসন অবশ্যই চাই। সংযম অথবা স্বাভাবিক বন্ধ্যকাল (safe period) পালনের উপদেশ দিলে কিছুই হবে না, কারণ অধিকাংশ মানুষ পশুর তুলনায় অত্যধিক অসংযমী। গর্ভাধান রোধের যেসব সুপরীক্ষিত নিশ্চিত ও নিরাপদ উপায় আছে তাই শেখাতে হবে। কিন্তু যদি জন্মশাসনেও অভীষ্ট ফল না হয় তবে সমাজরক্ষার জন্য ভবিষ্যতে কঠোর ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে।

 সমাজের সংকট ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে, মামুলী ব্যবস্থায় তা বেশী দিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অশুভস্য কালহরণম্ নীতি গ্রহণ করে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে অশুভ দ্রুতবেগে এগিয়ে আসবে। যে ধর্ম সমাজকে ধারণ করে, প্রজাবর্গের অত্যন্ত হিত করে, এবং দুঃখতপ্তগণের আর্তিনাশ করে, বর্তমান ও ভবিষ্য কালের উপযোগী সেই সমঞ্জস ধর্মের তত্ত্ব অতিশয় দুরূহ, কিন্তু তার অন্বেষণে উপেক্ষা করা চলবে না।

 ১৩৬০