বিদায়-আরতি/জাফ্রানিস্থান
জাফ্রানিস্থান
যে দেশেতে চড়ুই-পাখীর চাইতে প্রচুর বুল্বুলি,
যেথায় করে কাকলি কাক নীবস নিজের বোল্ ভুলি’,
বারোমাসেই সরল ঘাসে সবুজ যেথা ঘরের চাল,
চালে চালে ফুলেব ফসল চুম্কী-চমক নিত্যকাল,
ভূর্জ্জপাতার ঠোঙায় যেথা আঙুর বেচে সুন্দরী,
হাজার হাজার হৈমবতী বেড়ায় যেথা রূপ ধরি’,
পথে ঘাটে রূপ-শতদল পাপ্ড়ি যেথা ছড়িয়েছে,
গিরিরাজের বুকের পাঁজর আলোক-লতায় জড়িয়েছে,
কোমল-কঠিন মিল্ছে যেথায় আঙুরে আর আখ্রোটে,
ভূঁই-চাঁপারি সই-স্যাঙাতি জাফ্রানে নীল ফুল ফোটে,
শৈল-শ্লেটে অলখ্ আঙুল যেথায় দাগা বুলিয়ে যায়,
বলাকা-বকফুলের মালা বিনি-সূতায় দুলিয়ে যায়,
পাহাড়-কোলের ফাঁকগুলি সব যেথায় তরল-সুর ভরা—
দিকে দিকে নূপুর-পায়ে নাম্ছে ঝোরা স্রগ্ধরা,
হাওয়া যেথা মেওয়ার সামিল, মেওয়া সে অফুরন্ত,
এক্লা ঝিলম্ একশো যেথা, শান্ত এবং দুরন্ত!
যেথায় লুকায়—মন্ত্রে যেন—ক্লান্তি যত কায়-মনের,
চিড়্-খাওয়া হাড় হয় সে তাজা বাতাস লেগে চীড়-বনের,
বনে ফোটে বনপ্য ফুল, পদ্ম ফোটে পল্বলে,
ধূপের গন্ধে আমোদ করে ধূপী-বনের জঙ্গলে,
ফল্সা চেয়ে আঙুর সুলভ, ফুলের জল্সা রোজ দিনই,
ঝাঁকে ঝাঁকে গুলাব ফোটে, ফোটে গুলেল্ য়োস্মিনী,
লাখে লাখে মাজারমণ্ডিগিলাস্-ফুলের খাস্-গেলাস্,
শোষম্-ফুলের নীল সুষমায় আকুল যেথা হয় আকাশ,
মর্ত্তো যাহার নাই তুলনা, তাই যারে কয় ভূস্বর্গ,
মুগ্ধ ওরে! দু-হাত ভ’রে দে তুই তারে দে অর্ঘ্য।
* * *
গোগর-ঝাউয়ের গোকর্ণ-ছাঁদ শাখার তুষার সর্তেছে,
শালের পশম ঝল্মলিয়ে ছাগলগুলি চরতেছে,
শিস্ দিয়ে যায় রাখাল-ছেলে গুজর এবং গক্করে,
লাফিয়ে হঠাৎ হাস্তে থাকে উছট্ খেয়ে টক্করে,
ধান চলেছে চাল চলেছে পশমী মোট বস্তাতে,
মোদো হ’য়ে উঠছে মেতে আপেল-পেয়ার বাস্তাতে,
কল্কা-ছাদে নক্স এঁকে চলছে বেঁকে ঝিলম্ গো,
ফুস্ছে ফেনায় সাপবাজী তার দিন-দেওয়ালির কি রঙ্গ!
ঘূর্ণি ঘুরে চকী কেটে চল্ছে কোথাও ঝড়-গতি,
ঝঙ্কারে তার ঝঞ্ঝা বধির মঞ্জীরে ছড়ায় মোতি,
ঝম্ঝমিয়ে যায় রূপসী চাঁদি-রূপার পায় তোড়া,
ফুলিয়ে হোথা দুলিয়ে কেশর বার হ’ল ওর সাতঘোড়া,
চল্ছে নেচে কাঁচিয়ে কেঁচে পাহাড়গুলোর অচল ঠাট,
ওঠা-নামার নাগর-দোলায় দুলিয়ে আঁচল পাগল নাট,
তুঁত-পাহাড় আর খয়ের-পাহাড় পাহাড় সাদা ফট্কিরি,
নস্যি রঙের পাহাড়গুলো ভস্ম হেন যায় চিরি’,
গৈরিকে সে সাজ্ছে কোথাও, মাজ্ছে কোথাও নীল পাথর,
জম্কে এসে থম্কে হঠাৎ ঘোম্টা টেনে হয় নিথর।
* * *
কঠোর ধূসর নয়কো উষর পাথর হেথা উর্ব্বরা,
এই পাথরের স্তরে স্তরে ফসল ফলে বুক-ভরা,
এই পাথরের পাটায় পাটায় স্বৰ্গ হ’তে বারম্বার
লক্ষ্মী নামেন, ঐ দেখ গো পৈঁঠা-পীড়ি আসন তাঁর!
উথলে দিতে সোনার সরিৎ হরিৎ-বেশে উদয় হন
এই কঠোরের ঘাটে ঘাটে রানায় রানায় তাঁর চরণ!
এই কঠোরে কোমল ক’রে ফসল ফলায় কাশ্মীরী,
অন্ন আয়ু আদায় করে এই পাথরের বুক চিরি’!
* * *
পৌছেছি গো পৌছেছি তাজ গিরিরাজেব তারে,
শিবের বিয়ের ওই যে টোপব ওই যে গো বিরাজ করে,
ঐ যে ‘হরমুকুট’ উজল ঐ যে চির-চমৎকার,
বেড় দিয়ে ভুজঙ্গ-সাথে গঙ্গা আছেন অঙ্গে যাব,
ঐ যে ‘নাঙ্গা’ ঐ যে ধিঙ্গি ঐ যে নন্দী ভৃঙ্গী সব
নিচ্চে মনে আজ বা মোরা শুন্ব শিবের শিঙাব বব,
মূর্ত্তিমতী হৈমবতী কবিরা কন কাশ্মীরে,
ফুটেছে এই সোনার কমল গিরিরাজের বুক চিরে,
তপের তাপের শেষ নাহি এব, শিবের আাশা-পথ চেয়ে,
দুঃসহ ক্লেশ সইল কত উষা-প্রভা এই মেয়ে।
* * *
সার দিয়েছে সফেদ্ তরু দীর্ঘ পথের দুই ধারে,
লক্ষ ময়ূরপুচ্ছ-চামর হেল্ছে হাওয়ার সঞ্চারে,
সবুজ ঘাসেব গাল্চে, ’পরে গাব্বা পাতে সুন্দরী
গাছের ছায়ায় গাব্বা-তাতে টুক্রো রোদের ফুলকরী,
চীনার গাছের ধবল বাহু মেল্ছে পাতার পাঁচ আঙুল,
দেবের ভোগ্য ফল্ছে গো সেব, ফুটছে হোথা আনার-ফুল,
বাদাম-গাছের পাৎলা পাতায় লাগ্ছে হাওয়া দিক্-ভোলা,
হাস্ছে আলো আকাশভরা, হাস্ছে হাসি দিল্-খোলা।
* * *
সপ্তসেতুর শহরে আজ নূতন হিমের পড়্ছে ঘের,
শৈল-পটে বরফ-হরফ নূতন কে গো লিখ্ছে ফের,
হ্রদের জলে কমল লুকায়—মন্ত্রে যেন যায় উড়ে,
পদ্মফুলের পাপ্ড়ি শুকায় পদ্মপাতার কোল জুড়ে’,
শিঠিয়ে ওঠে কাঁটার মালা বেগ্নি পাতায় পানফলের,
ট্যাঁপের ট্যাঁপা ফলগুলো সব শীতের শাসন পাচ্ছে টের,
সর্ষেফুলের ঝাঁঝালো মউ, পদ্মফুলের মউ মিঠে,—
মৌমাছিরা ভিয়েন্ করে, নেই অপচয় এক-ছিটে,
ভাসা ক্ষেতে খাট্ছে চাষা শেষ-ফসলের তদ্বিরে,
কাংড়িতে ফের ভরছে আগুন বুড়োবুড়ী গম্ভীরে,
হাঁজীর মেয়ে আজকে সাঁঝে প্রাচীন কাঁথা জড়িয়েছে,
শীতের বাতাস প্রাচীন গাথা পাণ্ডু পাতা ছড়িয়েছে,
বরফি-কাটা ক্ষেতের পরে জাফরানে ফুল ফুট্ল রে,
শিশির-জলে ঘুম-জড়ানো চোখের ঘুম কি টুটল রে!
নীল-লোহিতের বিভূতি ওই লেগেছে আজ আস্মানে,
লেগেছে য়োস্মিনীর ফুলে, আর লেগেছে মোর প্রাণে,
নীলের কোলে সোনার কেশর, নীলসুখেতে’ স্পন্দমান,
নীলপাহাড়ের ফুলদানীতে প্রফুল্ল জাফ্রানিস্থান।