বিদায়-আরতি/বজ্র-বোধন

বজ্র-বোধন

অযুত ঢেউয়ের তপ্ত নিশাস সুপ্তিহারা
ফির্‌তেছিল হাওয়ায় ছায়া-মূর্ত্তি-পারা
নিদাঘ-দিবস হান্‌তেছিল আগুন-চাবুক,
লুপ্ত সারা জগৎ হতে সোয়াস্তি সুখ।
শুক্‌নো পাতার সকল-এড়া শিথিল সুরে
তেপান্তরের তপ্ত তামার চাতাল ঘুরে
উঠ্‌তেছিল গুমোট ঠেলে মৌন মুখে
বিদ্যুতেরি বিত্ত নিয়ে গোপন বুকে—
সাগর-তড়াগ-হ্রদের নদের তৃপ্তিহারা
উষ্ণ নিশাস, নীরব ছায়া-মূর্ত্তি পারা।

 *   *   *

হঠাৎ কখন্‌ কোন্‌ গগনের পাণ্ডু হাওয়ার কোন্‌ ইসারায়
শরীর পেল এক নিমিষে ওই অতনু সে কোন্‌ তারায়?
লক্ষ ব্যথার তপ্ত নিশাস পড়ল হঠাৎ ঐক্যে বাঁধা,
জীবন-মরণ-মন্ত্র যেন মন্দ্র-মধুর শব্দে গাঁথা!
আকাশ হ’ল ভাঙড় ভোলার নেশায় ঘোলা চোখের মত,
ঘোর গুমটের গুম্‌-ঘরে আজ ঘুল্‌ঘুলি সে খুল্ল শত;
অস্তাচলের সোনার বরণ অঙ্গ হঠাৎ উঠ্‌ল ঘেমে,
শিউরে সাগর-ঢেউ ঢিমিয়ে থম্‌থমিয়ে রইল থেমে;
তালের সারি পাণ্ডু-ছবি কাজল মেঘের মূর্ত্তি দেখে
চম্‌কে উঠে ময়ুর চেঁচায় “কে গা? এ কে? কে গা? এ কে?”

ধায় আকাশের উল্কামুখী হঠাৎ যেন প্রমাদ গণি’,
আগুন-ডোরে শূন্যে দোলে ইন্দ্রাণীরই স্নানের দ্রোণী।
বজ্র-বোধন বাদ্য বাজে, হিয়ায় হিয়ায় তড়িৎ চুয়ায়,
গুমোট-ভরা আষাঢ-সাঁঝের জলদ-গহন গগন-গুহায়।

 *   *   *

হ্রদের নদের কুড়িয়ে নিশাস নিশান ওড়ে! নিশান ওড়ে!
লক্ষ হিয়ার মন্যু জাগে প্রলয়-মেঘের মূর্ত্তি ধ’রে।
আস্‌ছে কে গো বাষ্পঘন! বারুদ-মাখা-অঙ্গে একা,
ঈশান-কোণে দিগ্নাবণের হাওদা তোমার যাচ্ছে দ্যাখা;
তোমার সাড়ায় বৃংহণেরি বৃহৎ ধ্বনি স্তব্ধ বনে,
সিংহ বারেক গর্জ্জে’ উঠে গুহায় পশে ত্রস্ত মনে,
ঝঞ্জা তোমার চারণ-কবি, জগৎ লোটায় পায়ের নীচে,
পায়ের ধূলার তলায় যাবা তারাষ্ট শুধু অঙ্কুরিছে।
ব্যথার তাপে জন্ম তোমার, আস্‌ছ বাথার আসন দিতে,
নবীন মেঘের গর্ভাধীনে মন্ত্র পড় রুদ্রগীতে।
জীর্ণ যা’ তা পড়্‌ছে ভেঙে—জরার ভারে পড়ছে ভেরে,
তোমার সাড়া চমক দিয়ে জাগায় অফুট অঙ্কুরেরে।
গর্ব্ব যাদের পর্ব্বে পর্ব্বে সে পর্ব্বতের উড়াও চূড়ায়,
বজ্র! কুশাঙ্কুচ্ছবি! তোমার পরশ পাহাড় গুঁড়ায়।
গ্রীষ্মে-জরা দগ্ধ ধরা ভাবছে যাবে চিরস্থায়ী!
তোমার সাড়ায় মূর্চ্ছা সে পায়, বজ! হে নীলপদ্মশায়ী।

 *   *   *

তোমার সাড়ায় তৃষায় অধীর কোন্‌ চাতকের পুড়ল ডানা,
কোন্‌ সে শাপীর ভাঙল শাখা তার কথা নেই তুলতে মানা,

তোমার সাড়ায় তরুণ প্রাণের যে বন্যা আজ জলে-স্থলে,
ক্ষতির কথা ভুলিয়ে দিতে হাস্‌ছে তারা নানান্‌ ছলে।
তোমার সাড়ায় উল্টে গেল শূন্য-শয়ান্‌ জলের দ্রোণী,
সোহাগ-দ্রোণীর ঝর্ণা-ধারায় আর্দ্র ভুবন দিন রজনী।
লক্ষ ব্যথার প্রসব তুমি, সূর্য্যে নিবায় তোমার গাথা,
বজ্র! তুমি দর্পহারী, খড়গ তুমি অভয় দাতা!
তোমার বোধন গাইছে কবি, গাইবে কবি সকল কালে,
জীবন-লোকে বরণ তোমার দীপক রাগে রুদ্রতালে!