বিদ্যাসাগরচরিত/বিদ্যাসাগরস্মৃতি

যে সযত্নস্মরণীয় বার্তা সর্বজনবিদিত তারও পুনরুচ্চারণের উপলক্ষ বারংবার উপস্থিত হয়; যে মহাত্মা বিশ্বপরিচিত, বিশেষ অনুষ্ঠানের স্মৃষ্টি হয় তাঁরও পরিচয়ের পুনরাবৃত্তির জন্যে। মানুষ আপন দুর্বল স্মৃতিকে বিশ্বাস করে না, মনোবৃত্তির তামসিকতায় স্বজাতির গৌরবের ঐশ্বর্য অনবধানে মলিন হয়ে যাবার আশঙ্কা ঘটে, ইতিহাসের এই অপচয় নিবারণের জন্যে সতর্কতা পুণ্যকর্মের অঙ্গ। কেননা কৃতজ্ঞতার দেয় ঋণ যে জাতি উপেক্ষা করে, বিধাতার বরলাভের সে অযোগ্য।

 যে-সকল অপ্রত্যাশিত দান শুভ দৈবক্রমে দেশ লাভ করে সেগুলি স্থাবর নয়; তারা প্রাণবান, তারা গতিশীল, তাদের মহাৰ্ঘতা তাই নিয়ে। কিন্তু সেই কারণেই তারা নিরন্তর পরিণতির মুখে নিজের আদিপরিচয়কে ক্রমে অনতিগোচর করে তোলে। উন্নতির ব্যবসায়ে মূলধনের প্রথম সম্বল ক্রমশই আপনার পরিমাণ ও প্রকৃতির পরিবর্তন এমন করে ঘটাতে থাকে যাতে করে তার প্রথম রূপটি আবৃত হয়ে যায়, নইলে সেই বন্ধ্যা টাকাকে লাভের অঙ্কে গণ্য করাই যায় না।

 সেইজন্যেই ইতিহাসের প্রথম দূরবর্তী দাক্ষিণ্যকে স্বপ্রত্যক্ষ করে রাখবার প্রয়োজন হয়। পরবর্তী রূপান্তরের সঙ্গে তুলনা করে জানা চাই যে, নিরন্তর অভিব্যক্তির পথেই তার অমরতা, নির্বিকার জড়ত্বের বন্দিশালায় নয়।

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় সাহিত্যভাষার সিংহদ্বার উদ্‌ঘাটন করেছিলেন। তার পূর্ব থেকেই এই তীর্থাভিমুখে পথখননের জন্যে বাঙালির মনে আহ্বান এসেছিল এবং তৎকালীন অনেকেই নানা দিক থেকে সে আহ্বান স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁদের অসম্পূর্ণ চেষ্টা বিদ্যাসাগরের সাধনায় পূর্ণতার রূপ ধরেছে। ভাষার একটা প্রকাশ মননের দিকে এবং জ্ঞানের তথ্যসংগ্রহের দিকে, অর্থাৎ বিজ্ঞানে তত্ত্বজ্ঞানে ইতিহাসে; আর একটা প্রকাশ ভাবের বাহন-রূপে রসসৃষ্টিতে; এই শেষোক্ত ভাষাকেই বিশেষ করে বলা যায় সাহিত্যের ভাষা। বাংলায় এই ভাষাই দ্বিধাবিহীন মূর্তিতে প্রথম পরিস্ফুট হয়েছে বিদ্যাসাগরের লেখনীতে, তার সত্তায় শৈশব-যৌবনের দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়েছিল।

 ভাষার অন্তরে একটা প্রকৃতিগত অভিরুচি আছে; সে সম্বন্ধে যাঁদের আছে সহজ বোধশক্তি, ভাষাসৃষ্টিকার্যে তাঁরা স্বতই এই রুচিকে বাঁচিয়ে চলেন, একে ক্ষুণ্ন করেন না। সংস্কৃত শাস্ত্রে বিদ্যাসাগরের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এইজন্য বাংলাভাষার নির্মাণকার্যে সংস্কৃতভাষার ভাণ্ডার থেকে তিনি যথোচিত উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু উপকরণের ব্যবহারে তাঁর শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ ছিল। তাই তাঁর আহরিত সংস্কৃত শব্দের সবগুলিই বাংলাভাষা সহজে গ্রহণ করেছে, আজ পর্যন্ত তার কোনোটিই অপ্রচলিত হয়ে যায় নি। বস্তুত পাণ্ডিত্য উদ্ধত হয়ে উঠে তাঁর সৃষ্টিকার্যের ব্যাঘাত করতে পারে নি। এতেই তাঁর ক্ষমতার বিশেষ গৌরব। তিনি বাংলাভাষার মূর্তি নির্মাণের সময় মর্যাদারক্ষার প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন ধ্বনিহিল্লোলের প্রতি লক্ষ রেখে বিস্তর নূতন সংস্কৃত শব্দ অভিধান থেকে সংকলন করেছিলেন। অসামান্য কবিত্বশক্তি সত্ত্বেও সেগুলি তার নিজের কাব্যের অলংকৃতিরূপেই রয়ে গেল, বাংলাভাষার জৈব উপাদানরূপে স্বীকৃত হল না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দান বাংলাভাষার প্রাণপদার্থের সঙ্গে চিরকালের মতো মিলে গেছে, কিছুই ব্যর্থ হয় নি।

 শুধু তাই নয়। যে গদ্য ভাষারীতির তিনি প্রবর্তন করেছেন তার ছাঁদটি বাংলাভাষায় সাহিত্যরচনা-কার্যের ভূমিকা নির্মাণ করে দিয়েছে। অথচ যদিও তাঁর সমসাময়িক ঈশ্বর গুপ্তের মতো রচয়িতার গদ্যভঙ্গির অনুকরণে তখনকার অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক আপন রচনার ভিত গাঁথছিলেন, তবু সে আজ ইতিহাসের অনাদৃত নেপথ্যে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। তাই আজ বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার দিন এল যে, সৃষ্টিকর্তারূপে বিদ্যাসাগরের যে স্মরণীয়তা আজও বাংলাভাষার মধ্যে সজীব শক্তিতে সঞ্চারিত, তাকে নানা নব নব পরিণতির অন্তরাল অতিক্রম করে সম্মানের অর্ঘ্য নিবেদন করা বাঙালির নিত্যকৃত্যের মধ্যে যেন গণ্য হয়। সেই কর্তব্যপালনের সুযোগ ঘটাবার জন্যে বিদ্যাসাগরের জন্ম প্রদেশে এই-যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সর্বসাধারণের উদ্দেশে আমি তার দ্বার উদ্‌ঘাটন করি। পুণ্যস্মৃতি বিদ্যাসাগরের সম্মাননার অনুষ্ঠানে আমাকে যে সম্মানের পদে আহ্বান করা হয়েছে, তার একটি বিশেষ সার্থকতা আছে। কারণ, এইসঙ্গে আমার স্মরণ করবার এই উপলক্ষ ঘটল যে, বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বার উদ্‌ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

 এখনো আমার সম্মাননিবেদন সম্পূর্ণ হয় নি। সবশেষের কথা উপসংহারে বলতে চাই। প্রাচীন আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণপণ্ডিতের বংশে বিদ্যাসাগরের জন্ম, তবু আপন বুদ্ধির দীপ্তিতে তাঁর মধ্যে ব্যক্ত হয়েছিল আনুষ্ঠানিকতার বন্ধন -বিমুক্ত মন। সেই স্বাধীনচেতা তেজস্ব ব্রাহ্মণ যে অসামান্য পৌরুষের সঙ্গে সমাজের বিরুদ্ধতাকে একদা তাঁর সকরুণ হৃদয়ের আঘাতে ঠেলে দিয়ে উপেক্ষা করেছিলেন, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে জয়ী করেছিলেন আপন শুভ সংকল্পকে, সেই তাঁর উত্তুঙ্গ মহত্ত্বের ইতিহাসকে সাধারণত তাঁর দেশের বহু লোক সসংকোচে নিঃশব্দে অতিক্রম করে থাকেন। এ কথা ভুলে যান যে, আচারগত অভ্যস্ত মতের পার্থক্য বড়ো কথা নয়, কিন্তু যে দেশে অপরাজেয় নির্ভীক চারিত্রশক্তি সচরাচর দুর্লভ সে দেশে নিষ্ঠুর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের নির্বিচল হিতব্রতপালন সমাজের কাছে মহৎ প্রেরণা। তাঁর জীবনীতে দেখা গেছে ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বারংবার আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন, তেমনি যে শ্রেয়োবুদ্ধির প্রবর্তনায় দণ্ডপাণি সমাজশাসনের কাছে তিনি মাথা নত করেন নি সেও কঠিন সংকটের বিপক্ষে তার আত্মসম্মান রক্ষার মূল্যবান দৃষ্টান্ত। দীনদুঃখীকে তিনি অর্থদানের দ্বারা দয়া করেছেন, সে কথা তার দেশের সকল লোক স্বীকার করে; কিন্তু অনাথ নারীদের প্রতি যে করুণায় তিনি সমাজের রুদ্ধ হৃদয়দ্বারে প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছিলেন তার শ্রেষ্ঠতা আরো অনেক বেশি কেননা তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কেবলমাত্র তাঁর ত্যাগশক্তি নয়— তাঁর বীরত্ব। তাই কামনা করি আজ তাঁর যে কীর্তিকে লক্ষ্য করে এই স্মৃতিসদনের দ্বার উন্মোচন করা হল, তার মধ্যে সর্বসমক্ষে সমুজ্জ্বল হয়ে থাক্ তার মহাপুরুষোচিত কারুণ্যের স্মৃতি। ১২ অগ্রহায়ণ ১৩৪৬

পৌষ ১৩৪৬

গ্রন্থমধ্যে প্রত্যেক প্রবন্ধ-শেষে উহার প্রথম প্রকাশকাল মুদ্রিত। পরে বিশদ বিবরণ দেওয়া যাইতেছে।

 বিদ্যাসাগরচরিত প্রবন্ধটি ১৩০২ সালের '১৩ই শ্রাবণ অপরাহুে বিদ্যাসাগরের স্মরণার্থ সভার সাম্বৎসরিক অধিবেশনে এমারল্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে পঠিত’ ও ১৩০২ সালের সাধনা পত্রের ভাদ্র-কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

 বিদ্যাসাগর প্রবন্ধটি ১৩০৫ সালের ভারতী পত্রের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় মুদ্রিত হইয়াছিল।

 অত:পর উল্লিখিত প্রবন্ধদ্বয় ১৯০৭ খৃস্টাব্দে 'চারিত্রপূজা’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। পরে এই দুইটি প্রবন্ধ লইয়া ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামে স্বতন্ত্র পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। প্রথম মুদ্রণকাল জানা যায় না; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেন যে, সম্ভবত: '১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ইহা সর্ব্বপ্রথম পুস্তিকাকারে | আনা মূল্যে প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মুদ্রণ যথাক্রমে ১৩২৩ ও ১৩২৪ বঙ্গাব্দে। বর্তমান পুস্তক উহারই পরিবর্ধিত সংস্করণ।

 চারিত্রপূজা বা প্রথম-প্রকাশিত বিদ্যাসাগরচরিত এই দুখানি গ্রন্থের সংকলনের অতিরিক্ত, বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে অন্য নূতন দুইটি প্রবন্ধ বর্তমান গ্রন্থের সংযোজন-অংশে সন্নিবেশিত হইল। তন্মধ্যে ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধটি, কলিকাতায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে ‘বিদ্যাসাগর-স্মরণসভায় বক্তৃতার মর্ম', প্রষ্ঠোতকুমার সেনগুপ্ত -কর্তৃক অনুলিখিত ও বক্তা-কর্তৃক সংশোধিত। রচনাটি ১৩২৯ সালের ভাদ্র সংখ্যা প্রবাসীতে ও নব্যভারতে মুদ্রিত হয়, ১৩৬৩ সালের শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যা বিশ্বভারতী পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের কোনো গ্রন্থের অন্তর্গত হয় নাই।

 ‘বিদ্যাসাগরস্মৃতি প্রবন্ধটি মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগরস্মৃতিমন্দির-প্রবেশউৎসবে রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক পঠিত হয় ১৩৪৬ সালের ৩০ অগ্রহায়ণ তারিখে। তদুপলক্ষে ইহা পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। ১৩৪৬ পৌষ সংখ্যা প্রবাসীতে ও অন্য কোনো কোনো সাময়িক পত্রেও পুনরমুদ্রিত হয়, এখন গ্রন্থভুক্ত হইল।

 গ্রন্থসূচনায় যে কবিতাটি মুদ্রিত হইয়াছে তাহা উক্ত বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের ভিত্তিস্থাপন উপলক্ষে রচিত ও প্রেরিত। উহা ১৩৪৫ কার্তিক সংখ্যা প্রবাসীতে ও অন্য কোনো কোনো সাময়িক পত্রে মুদ্রিত হয়, বর্তমানে গ্রন্থভুক্ত হইল। বিদ্যাসাগর-স্মৃতিমন্দিরের প্রবেশ-উৎসব উপলক্ষে যে কার্যসূচী-সংবলিত আমন্ত্রণপত্র প্রচারিত হয়, কবির হস্তলিপি তাহা হইতে গৃহীত।

 ১৩০৫ অগ্রহায়ণের ‘ভারতী’ (পৃ. ৭৪২-৪৩) হইতে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধের বর্জিত সূচনাংশ এখানে সংকলনযোগ্য —


 আশ্বিন-কাতিকের প্রদীপে শ্রীযুক্ত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় 'পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ -নামক যে প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন তাহা পাঠমাত্র করিয়া সংক্ষেপে বিদায় করিবার জিনিস নহে। এই প্রবন্ধে শাস্ত্রী মহাশয় যে সকল চিন্তা

১ বিদ্যাসাগরস্মৃতিমন্দির। প্রবেশ-উৎসব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণী। মেদিনীপুর। ৩০ পৌষ [ অগ্রহায়ণ ], ১৩৪৬ ফলাইয়া তুলিয়াছেন তাহা প্রাণবান বীজের মতো পড়িয়া পাঠকহৃদয়ে আপনাকে নবজীবনে অঙ্কুরিত করিয়া তুলিতেছে।

 বর্তমান প্রবন্ধে আমরা কোনো নূতন কথা বলিবার জন্য উপস্থিত হই নাই। শাস্ত্রীমহাশয়ের কথাকেই আমরা নিজের মতো করিয়া ব্যক্ত করিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরা তাহারই প্রবন্ধটিকে সাদরে লালন করিতেছি। ভাল লেখা বাঙালী পাঠকসমাজে ভূমিষ্ঠ হইয়া কেবল ঔদাসীন্যের বিষবায়ুতে দুই দিনেই মারা যায়; সাহিত্যরাজ্যের এই মহামারী নিবারণের একমাত্র উপায় শ্রদ্ধা।