বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত/স্বাধীনাবস্থা
স্বাধীনাবস্থা।
যে সকল বালিকাবিদ্যালয়, ছোট লাট হেলিডে সাহেবের বাচনিক আদেশে স্থাপন করিয়াছিলেন, সেই সকল বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ন্য়ূনাধিক চারি সহস্র টাকা স্বয়ং ঋণ করিয়া প্রদান করেন। অতঃপর অধিকাংশ বালিকাবিদ্যালয় উঠাইয়া দিয়া, নদীয়া, বর্দ্ধমান, মেদিনীপুর ও হুগলি জেলার অন্তঃপাতী বীরসিংহ, রামজীবনপুর, উদয়রাজপুর, গোবিন্দপুর, ঈড়পালা, কুরাণ, যৌগ্রাম প্রভৃতি গ্রামে প্রায় ২০টী বালিকাবিদ্যালয় স্থায়ী করেন, এবং ঐ সকল বিদ্যালয়ের ব্যয় স্বয়ং ও নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সাহায্যে নির্ব্বাহ করিতেন। মহানুভবেরা উক্ত বালিকাবিদ্যালয়ে সাহায্য দান করিতেন, তাঁহাদের নাম এই—তৎকালীন গবর্ণর জেনেরালের পত্নী লেডি ক্যানিং, হোমডিপার্টমেণ্টের সেক্রেটারি সিসিল বীড়ন ও তৎকালীন কৌন্সেলের মেম্বর গ্রাণ্ট ও গ্রে সাহেব প্রভৃতি এবং রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও চক্দিঘীনিবাসী বাবু সারদাপ্রসাদ সিংহ প্রভৃতি। এই সকল মহোদয়েরা ভারতবর্ষের কামিনীগণের ভাবীহিতকামনায় বালিকাবিদ্যালয়ের সাহায্যার্থ প্রতি মাসেই অগ্রজ মহাশয়ের নিকট নিয়মিত টাকা প্রেরণ করিতেন। কতিপয় বৎসর উক্তরূপ সাহায্যেই বালিকাবিদ্যালয় সকল চলিয়া আসিতেছিল। পরে অগ্রজ মহাশয়, তৎকালীন ছোট লাট গ্রাণ্ড্, সাহেবের অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া, গবর্ণমেণ্টের প্রদত্ত অর্দ্ধেক চাঁদা গ্রহণ করিয়া ব্যয়নির্ব্বাহ করিতেন। অনন্তর ক্রমশঃ কলিকাতার সন্নিহিত উপনগরে বালিকাবিদ্যালয় সকল স্থাপিত হইতে লাগিল। প্রথমতঃ ভারতবর্ষে বালিকাবিদ্যালয় প্রচলনজন্য হিন্দুদিগের মধ্যে অগ্রজই প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। অতঃপর স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ে দেশীয় অন্যান্য সন্ত্রান্ত লোকের পূর্ব্বের ন্যায় ঘৃণা বা দ্বেষ রহিল না; সকলেই স্বীয় স্বীয় দুহিতা প্রভৃতিকে বিদ্যালয়ে পাঠাইতে লাগিলেন। অবশেষে কলিকাতার দলপতিগণও বেথুনবালিকাবিদ্যালয়ে স্ব স্ব দুহিতা প্রভৃতিকে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। গবর্ণমেণ্ট, স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ে প্রজাবর্গের উৎসাহ-বর্দ্ধনার্থ পল্লীগ্রামের বালিকাবিদ্যালয়ে সাহায্য-প্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন। অগ্রজ মহাশয়ও ঐ সকল বালিকাবিদ্যালয়ে যেরূপ সাহায্য করিতেন, সেইরূপ অপরাপর স্থানের সম্ভ্রান্ত লোকদিগের স্থাপিত বালিকাবিদ্যালয়েও মাসে মাসে সাহায্য করিতেন; এবং ঐ সকল বালিকাবিদ্যালয়ের পারিতোষিক-দানের সংবাদ-প্রাপ্তি-মাত্র উৎসাহ-বর্দ্ধনার্থ অন্ততঃ বিংশতি মুদ্রার পারিতোষিক পুস্তক পাঠাইয়া দিতেন। কিছু দিন পরে, হিন্দুস্থানেও বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হইতে লাগিল। ঐ সময়ে কাশীবাসী রাজা দেবনারায়ণ সিংহ প্রভৃতি মহোদয়গণ, প্রায় প্রতি বৎসর কলিকাতায় ইণ্ডিয়া লেজিস্লেটিভ কৌন্সিলে আগমন করিতেন। অগ্রজ মহাশয়, ঐ সকল বড় লোকদিগকে কলিকাতার বেথুন-ফিমেল-স্কুল দেখাইবার জন্য সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতেন। উক্ত বিদ্যালয়ের যে কয়েকটি বালিকা ভালরূপ শিক্ষা করিয়াছিল, রাজা দেবনারায়ণ সিংহ, তাহাদিগকে বেনারসের সাটি পুরস্কার করেন। একবার রাজা দেবনারায়ণ সিংহ মহোদয়, কথাপ্রসঙ্গে অগ্রজ মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, “এই স্কুলবাটী কোন্ মহাত্মার অর্থব্যয়ে নির্ম্মিত হইয়াছে?” তাহার প্রশ্ন শুনিয়া অগ্রজ বলেন, “মহামতি অবলাবন্ধু বেথুন সাহেব এই বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করিয়া, ইহার ইমারত প্রভৃতির জন্য প্রায় লক্ষ টাকা প্রদান করিয়াছেন।” অনন্তর ঐ সকল মহাত্মারা দেশে গমনপূর্ব্বক প্রোৎসাহিত হইয়া, স্থানে স্থানে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন-বিষয়ে আন্তরিক যত্ন করিতেন।
তৎকালে সিসিল বীডন সাহেব, হিন্দুবালিকাগণের লেখাপড়া শিক্ষার উৎসাহ -বর্দ্ধনার্থ আন্তরিক যত্ন প্রকাশ করিতেন, এবং বেথুন-ফিমেল-স্কুলের পারিতোষিক -দান-সময়ে গবর্ণর জেনেরল প্রভৃতিকে সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করিয়া বলিতেন, ভারতবর্ষের বালিকাবিদ্যালয়-প্রচলন-বিষয়ে বিদ্যাসাগরই একমাত্র প্রধান উদ্বোগী। মফঃস্বলে যে কোন স্থানে বালিকাবিদ্যালয় হইয়াছে, তাহাও বিদ্যাসাগরের যত্নে ও উৎসাহেই হইয়াছে এবং পরেও যে ভারতবর্ষের নানা স্থানে ফিমেল-স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইবে, বিদ্যাসাগরই তাহার পথপ্রদর্শক। এতদ্ব্যতীত তৎকালে যে যে বালিকাবিদ্যালয়ে পারিতোষিক-দান-কার্য্য সমাধা হইত, সেই সেই স্থানীয় কৃতবিদ্যগণ, বিদ্যাসাগরের গুণ-কীর্ত্তন না করিয়া ক্ষান্ত হইতেন না।
মগরার সন্নিহিত দিগসুগ্রামনিবাসী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, শৈশবকাল হইতে সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিয়া, সংস্কৃত ও ইংরাজী ভাষা উত্তমরূপ শিক্ষা করিয়া এস্কলার্শিপ প্রাপ্ত হন। কিন্তু তিনি পরীক্ষোত্তীর্ণ হইবার কিছু দিন পরেই বধির হইলেন; সুতরাং কর্ম্ম পাইলেন না। বহু পরিবার অনাহারে মারা পড়িবে, এই বলিয়া এক দিবস অগ্রজের নিকট রোদন করিতে লাগিলেন। ইঁহার রোদনে পরদুঃখকাতর অগ্রজ মহাশয়ের হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল; কিন্তু কি করিবেন, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, অবশেষে সোমপ্রকাশনামে সংবাদপত্র প্রচার করেন। ইহাতে যাহা লাভ হইবে, তাহা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবারগণের ভরণপোষণার্থ ব্যয়িত হইবে। সোমপ্রকাশে প্রথম যাহা প্রকাশ হইয়াছিল, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজের রচনা। ঐ সময়ে বর্দ্ধমানাধিপতি ধীরাজ বাহাদুর, সংস্কৃত মহাভারত দেশীয়-ভাষায় অনুবাদ করিয়া প্রচার করিবার মানস করিলে, অগ্রজ তাঁহাকে বলিলেন, “সংস্কৃত-কলেজের ছাত্র সারদাপ্রসাদ উত্তম বাঙ্গালা অনুবাদ করিতে পারে। সারদা কালা হইয়াছে, অন্য কোন কর্ম্ম করিতে অক্ষম, কিন্তু আপনার মহাভারত রচনা ভালরূপ করিতে পারিবে এবং আপনার পুস্তকালয়ের লাইব্রেরিয়ানের কার্য্যও সুন্দররূপে সম্পন্ন করিতে পারিবে।” তাঁহার অনুরোধে সারদাপ্রসাদ রাজবাটীতে কর্ম্ম পাইয়া, পরিবার-প্রতিপালনে সক্ষম হইয়াছিলেন। অনন্তর দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে যোগ্যপাত্র বিবেচনায়, তাঁহাকে সোমপ্রকাশ সংবাদপত্র প্রচারের ভার অর্পণ করিলেন। তদবধি বিদ্যাভূষণ মহাশয়ই উহার উপস্বত্বভোগী হইলেন।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ জি, টি, লেজার মার্শেল সাহেব, শিক্ষাসমাজের কর্ম্মাধ্যক্ষ ডাক্তার ময়েট্ সাহেব, শিক্ষাসমাজের প্রেসিডেণ্ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেব, ইহাঁরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং ইহাঁরা তিন জনেই তাঁহার উন্নতি, প্রতিপত্তি ও মানসম্রমের আদিকারণ; এই জন্য অগ্রজ, ইহাঁদের প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত করাইয়া, কলিকাতার বাদুড়বাগানের বাটীতে রাখিয়াছিলেন। তিনি প্রত্যহ উক্ত প্রতিমূর্ত্তিগুলি একবার দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না।
মেট্রোপলিটান।
১৮৫৯ খৃঃ অব্দে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুল স্থাপিত হয়। ঠাকুরদাস চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র ধাড়া, পতিতপাবন সেন, যাদবচন্দ্র পালিত, বৈষ্ণবচরণ আঢ্য, ইহাঁরাই স্কুলের স্থাপয়িতা এবং শ্যামাচরণ মল্লিক পেট্রন ছিলেন।
ঐ স্কুল-স্থাপয়িতাগণ এবং আরও কয়েকজন দেশীয় ভদ্রলোক, একত্র একটি কমিটি স্থাপন করিয়া, খৃঃ ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত উক্ত বিদ্যালয়ের কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। কিন্তু পরস্পরের মনোমালিন্যবশতঃ এবং বিদ্যালয়ের অবস্থার অবনতি দেখিয়া, ১৮৬৪ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হস্তে সমস্ত ভার অর্পণ করেন। কিয়দ্দিবস পরে মেম্বরগণের পরস্পর মনান্তর ঘটিলে, পৃথক্ পৃথক্ স্থানে দুইটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। মেম্বরগণ তাঁহাদের স্থাপিত বিদ্যালয়ের নাম ট্রেনিং একাডেমি রাখিয়াছিলেন। কিন্তু অগ্রজ, স্বীয় ব্যয়ে বেঞ্চ প্রভৃতি বিদ্যালয়ের আবশ্যক দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া, মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউসন স্থাপন করেন। উভয় বিদ্যালয় অতি সন্নিহিত স্থানে স্থাপিত হয়, এবং উভয় বিদ্যালয়ই পরম্পর প্রতিদ্বন্দ্বীভাবে চলিতে লাগিল। অগ্রজ মহাশয়, উপযুক্ত শিক্ষক সকল-নিযুক্ত করিতে লাগিলেন, এবং নিজব্যয়ে বহুমূল্য পুস্তকারি ক্রয় করিয়া, বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী স্থাপন ও উত্তম বন্দোবস্ত করেন। ক্রমশঃ এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় গবর্ণমেণ্ট বিদ্যালয় অপেক্ষা এখানে বহুসংখ্যক ছাত্র উত্তীর্ণ হওয়ায়, চতুর্দ্দিক হইতে বিদ্যার্থী বালকবৃন্দ মেট্রোপলিটান স্কুলে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। অগ্রজ মহাশয়, নিরন্তর বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য যত্নবান্ ছিলেন; একারণ, সকল বিদ্যালয় অপেক্ষা ইহা ক্রমশঃ উন্নত-পদবীতে অধিরূঢ় হইয়াছে। কিয়দ্দিবস পরে ছাত্রদত্ত বেতন দ্বারা বিদ্যালয়ের সকল প্রকার ব্যয় নির্ব্বাহ হইতে লাগিল। অতঃপর তাঁহাকে নিজ হইতে আর সাহায্য করিতে হইত না। নিম্ন-শ্রেণী হইতে উচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত সকল ছাত্রেরই মাসিক ৩৲ টাকা বেতন ধার্য্য় করেন; কেবল বাঙ্গালা-বিভাগে মাসিক ১৲ টাকা বেতন। নিতান্ত দরিদ্রবালকগণ বিনা বেতনে পড়িতে পাইত। অনেক দরিদ্র-বালককে পুস্তক ও বাসা-খরচ পর্য্য়ন্ত নিজব্যয়ে সাহায্য করিতেন। অন্যান্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ ছাত্রদিগকে প্রহার করিতেন; কিন্তু তিনি স্বীয় বিদ্যালয়ে প্রহার বা দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ রহিত করেন। যদি কোন শিক্ষক, বালকগণকে প্রহার বা দুর্ব্বাক্য বলিতেন, তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ পদচ্যুত করিতেন। যে বালক শিক্ষকের সদুপদেশ শ্রবণ না করে ও অধ্যয়নে মনোনিবেশ না করে এবং অন্য বালকের পড়াশুনার ব্যাঘাত জন্মায়, তাহাকে প্রথমতঃ নানাপ্রকার উপদেশ দেওয়া হইত। যদি উপদেশে ফল না হইত, তবে তাহার নাম কর্ত্তন করিয়া, বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবার নিয়ম করিয়াছিলেন।
এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এল,এ ও বি,এ কোর্স অধ্যয়ন জন্য প্রেসিডেন্সী-কলেজে প্রবিষ্ট হইলে, মাসিক ১২৲ টাকা বেতন লাগিত; এজন্য মধ্যবিত্ত বিদ্যার্থিগণ উক্ত কলেজে অধ্যয়ন করিতে অক্ষম হইত। অগ্রজ মহাশয়, সাধারণের হিতকামনায় এল,এ ক্লাস স্থাপনের মানস করিয়া, অবিলম্বে প্রথমতঃ অবৈতনিক এল, এ ক্লাস খুলিলেন, এবং অনেক দরিদ্র বালকও প্রবিষ্ট হইবার জন্য নাম লেখাইল। কিন্তু দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত তৎকালে গবর্ণমেণ্ট আবেদনপত্রে সম্মতি প্রদান না করায়, আপাততঃ এল,এ ক্লাস বন্ধ রাখিলেন। কিন্তু ঐ চিন্তা অগ্রজ মহাশয়ের মনোমধ্যে অহর্নিশ জাগরূক রহিল। তিনি যাহা ধরিতেন, তাহার চূড়ান্ত না দেখিয়া কখনও নিবৃত্ত হইতেন না। তাঁহার উদ্যম একবার ভঙ্গ হইলে, ক্ষণমাত্রও বিচলিত হইতেন না; বরং দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন। কিছুদিন পরে পুনর্ব্বার চেষ্টা করিলেন। সেই সময়ে বিদ্যালয়সমূহের কর্তৃপক্ষ সাহেবেরা অহঙ্কারপূর্ব্বক বলেন যে, “বাঙ্গালীদের ইংরাজী কলেজ চালাইবার এখনও ক্ষমতা হয় নাই। ইংরাজ ভিন্ন ইংরাজী-কলেজ পরিচালনা অসম্ভব।” অগ্রজ, তাঁহাদের এই সাহঙ্কার-বাক্য অগ্রাহ্য করিয়া, তর্ক-বিতর্ক দ্বারা নানা প্রকার বাধা অতিক্রমপূর্ব্বক, নিজ কলেজে সমস্ত দেশীয় শিক্ষক নিযুক্ত করতঃ ভারতবাসীদের মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে কলেজ-ক্লাস খুলিলেন। এই কলেজ লইয়া, ই, সি বেলির সহিত তাঁহার অনেক কথাবার্ত্তা হয়। ই, সি, বেলি বলেন, “বিদ্যাসাগর! কিরূপে তুমি নিজ কলেজ চালাইবে? ইংরাজ-সাহায্য ব্যতীত ইংরাজী-কলেজ কিছুতেই চলিতে পারে না।” অগ্রজ, তাঁহাকে উত্তর করেন, “আমি আপন বিদ্যালয়ের ছাত্রবর্গকে ইংরাজী-বিদ্যা শিখাইতে না পারিলেও পাশ করাইতে পারিব, ইহা নিশ্চয় জানিবেন।” ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে এল,এ ক্লাসের এফিলিয়েসন্ মঞ্জুর হয়, এবং সেই বৎসর হইতে এল,এ পরীক্ষার্থীদিগের রীতিমত পড়াশুনা আরম্ভ হয়। এই সময়ে অগ্রজ মহাশয় কায়িক অত্যন্ত অসুস্থ হইয়াছিলেন। ১৮৭৬ খৃঃ অব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে, অগ্রজ মহাশয়ের তৃতীয় জামাতা বাবু সূর্য্যকুমার অধিকারী, কলেজ এবং স্কুলের সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হইয়া, আয় ও ব্যয়ের উত্তম বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন।
১৮৭৯ খৃঃ অব্দে বি,এ ক্লাস খোলা হয়। বৎসর বৎসর বি,এ পরীক্ষার্থীদিগের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল; এমন কি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বৎসর ২৫০টি ছাত্র বি,এ পাশ হয়, সেই বৎসর ঐ ২৫০ জনের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই এক মেট্রোপলিটান হইতে এবং বাকী দুই-তৃতীয়াংশ কলিকাতার বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য যাবতীয় বিদ্যালয় হইতে পাশ হইয়াছিল। তদ্দর্শনে অগ্রজ মহাশয়, প্রোৎসাহিত হইয়া ল-ক্লাস খুলিবার জন্য যত্নবান হন, এবং ১৮৮৪ খৃঃ অব্দে ল-ক্লাস খোলা হয়। ১৮৮৫ খৃঃ অব্দে বি,এ পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান-কলেজ সর্ব্বপ্রথম স্থান অধিকার করে। সেই বৎসর বেঙ্গলগবর্ণমেণ্ট সুফল দেখিয়া, কলিকাতা গেজেটে মেট্রোপলিটান-কলেজের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া, এক রেজোলিউসন্ প্রকাশ করেন।
ইতিপূর্ব্বে কলিকাতা সুকিয়াষ্ট্রীটের যে বাটীতে বিদ্যালয় ছিল, লাহাবাবুরা ঐ বাটী ক্রয় করিয়া, ঐ স্থান হইতে অপর স্থানে বিদ্যালয় উঠাইয়া লইয়া যাইবার নোটীস দেন। এই সংবাদে অগ্রজ মহাশয়ের অত্যন্ত দুর্ভাবনা হয়। তিনি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে স্থির করেন, বাদুড়-বাগানে যে স্থানে নিজের বসতবাটী আছে, ঐ স্থানে আপন নূতন বাটী ভগ্ন কুরিয়া, ও উহার সংলগ্ন আরও কিঞ্চিৎ ভূমি ক্রয় করিয়া, কলেজ-বাটী প্রস্তুত করিব। তাহার প্ল্যান পর্য্যন্ত প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার প্রকৃত মহত্ত্বের পরিচায়ক; কারণ, ঐ বাটী ভিন্ন তাঁহার কলিকাতায় অবস্থিতি করিবার ও তাঁহার লাইব্রেরী স্থাপন করিবার অপর আর কোন স্বকীয় স্থান ছিল না এবং ঐ বাটীও মূল্যবান্ ছিল। ঐ সময়ে পঞ্চাশ সহস্র টাকা মজুত ছিল। প্রিন্সিপাল সূর্য্যবাবুর যত্নে, শঙ্কর ঘোষের লেনে মহেন্দ্রনারায়ণ দাসের নিকট, বিদ্যালয়ের নিমিত্ত ন্যূনাধিক ত্রিশ হাজার টাকায় ভূমি ক্রয় করা হয়। বাটী নির্ম্মাণের জন্য তৎকালে যে টাকার অসদ্ভাব হয়, তাহা কর্জ করিয়া বাটীনির্ম্মাণ-কার্য্য সম্পন্ন করেন। ভূমি-খরিদ ও ইমারত-নির্ম্মাণ প্রভৃতি কার্য্যে, প্রায় একলক্ষ ত্রিশহাজার টাকা ব্যয়িত হয়। অল্পদিনের মধ্যেই বিদ্যালয়-গৃহ নির্মাণের জন্য যাহা ঋণ হইয়াছিল, তৎসমস্ত পরিশোধ হইয়া যায়। খৃঃ ১৮৮৭ সালের জানুয়ারী মাসে, কলেজ-ক্লাস নূতন বাটীতে প্রবেশ করে, এবং ইহার দুই চারি মাস পরে স্কুলও নুতন বাটীতে যায়।
শাখা-স্কুলের মধ্যে ১৮৭৪ সালে শ্যামপুকুর ব্রাঞ্চস্কুল স্থাপিত হয়। ১৮৮৫ খৃঃ অব্দে বহুবাজার এবং ১৮৮৭ খৃঃ অব্দে বড়বাজার ও বালাখানা ব্রাঞ্চ এই তিনটি স্কুল স্থাপন করেন। এস্থলে ইহাও স্বীকার করা উচিত যে, এই কয়েকটী স্কুল স্থাপনসময়ে, প্রিন্সিপাল সূর্য্যবাবু নিরন্তর যথেষ্ট পরিশ্রম করিয়াছিলেন।
১৮৮৮ খৃঃ অব্দে ১লা ভাদ্র বৃহস্পতিবার পূজ্যপাদ জ্যেষ্ঠা বধূদেবী পরলোক গমন করায়, অগ্রজ মহাশয় নানাপ্রকার দুর্ভাবনায় অভিভূত হইলেন এবং ক্রমশঃ তাঁহার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি হইতে লাগিল। ঐ বৎসর ভাদ্র মাসের ২৫ শে রবিবার সূর্য্য়বাবুকে পদচ্যুত করেন, এবং অঙ্কশাস্ত্রাধ্যাপক বাবু বৈদ্যনাথ বসুকে প্রিন্সিপালের কার্য্য় চালাইবার ভারার্পণ করেন। ইতিপূর্ব্বে অগ্রজ, কায়িক অসুস্থতানিবন্ধন মধ্যে মধ্যে বায়ুপরিবর্ত্তনজন্য কর্ম্মাটাড় নামক স্থানে গমন করিতেন, কিন্তু জামাতা সূর্য্যকুমারকে পদচ্যুত করিয়া অবধি প্রায় কর্ম্মাটাড়ে গমন করেন নাই। কলিকাতায় সর্ব্বদা অবস্থিতি করিয়া, ক্রমশঃ অবসন্ন হইতে লাগিলেন; তথাপি প্রায় প্রত্যহ বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না।
যৎকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় কিছু দিনের জন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার কার্য্য়কলাপ পরিদর্শন করিতেন, ঐ সময়ে তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কয়েকটী প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন; তন্মধ্যে মহাভারতের উপক্রমণিকা অধ্যায় বাঙ্গালায় অনুবাদ করিয়া, ক্রমশঃ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ১৮৬০ খৃঃ অব্দে পুনরায় উহা পুস্তকাকারে মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন।
১৮৬০ খৃঃ অব্দে হিন্দু-পেট্রিয়টের বিখ্যাত এডিটার, ভবানীপুরনিবাসী বাবু হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় মানবলীলা সম্বরণ করেন। ইহাঁর উত্তরাধিকারীর মধ্যে অপর কেহ উক্ত সংবাদপত্র চালাইবার যোগ্য লোক না থাকা প্রযুক্ত, উহার উত্তরাধিকারিণী ৫০০০৲ পঞ্চ সহস্র মুদ্রা মূল্য লইয়া, কলিকাতা যোড়াসাঁকোনিবাসী বিদ্যোৎসাহী বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়কে হিন্দুপেট্রিয়টের সত্ত্বাধিকার বিক্রয় করেন। বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ, মাসিক ৬০০৲ শত টাকা বেতনে একজন সুযোগ্য ইউরোপীয়ান লেখক নিযুক্ত করিয়া, কিছু দিন হিন্দুপেট্রিয়ট সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। পরে উহা প্রচার করিতে অক্ষম হইয়া, অগ্রজ মহাশয়ের হস্তে উহার সমস্ত ভার সমর্পণ করেন। অগ্রজ মহাশয়ও কয়েকবার ঐ কাগজ প্রচার করিয়া বিরক্ত হইলেন, এবং প্রকাশ করিলেন যে, উপযুক্ত পাত্রে বিনামূল্যে এই সংবাদপত্রের পরিচালন-ভার অর্পণ করিব। একারণ, হিন্দু-পেট্রিয়টের স্বত্ব-প্রাপ্ত্যভিলাষে অনেক কৃতবিদ্য লোক তাঁহার নিকট গতিবিধি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময়ে কৃষ্ণদাস পাল, ব্রিটিশ এসোসিয়েসনে কেরাণীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। যদিও বাবু কৃষ্ণদাস পাল তৎকালীন কোন বিখ্যাত বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া জুনিয়র বা সিনিয়র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছিলেন না, তথাপি বাটীতে স্বয়ং সর্ব্বদা অধ্যয়ন করায়, তাঁহার ভালরূপ ইংরাজী লিখিবার অসাধারণ ক্ষমতা জন্মিয়াছিল। কৃষ্ণদাস পাল অতিশয় বুদ্ধিমান্ ও কার্য্য়দক্ষ ছিলেন; বিশেষতঃ অগ্রজের সহিত তাঁহার বিশেষ সদ্ভাব ছিল। তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয়, বাবু কৃষ্ণদাস পালকে হিন্দুপেট্রিয়টের স্বত্ব এককালে সমর্পণ করেন। তদ্দর্শনে অনেক কৃতবিদ্য লোক স্পষ্টবাক্যে বলিয়াছিলেন যে, বিদ্যাসাগর, কৃষ্ণদাসকে বিনামূল্যে হিন্দুপেট্রিয়ট একেবারে দিয়া ভাল কাজ করেন নাই। যেহেতু, কৃষ্ণদাস পাল কোনও ভাল বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া বৃত্তি পান নাই। হিন্দু-কলেজ, হুগলী-কলেজ ও কৃষ্ণনগর-কলেজের পরীক্ষোত্তীর্ণ যশস্বী লেখকদিগের মধ্যে কাহাকেও না দিয়া অন্যায় কার্য্য করিলেন। তৎকালে অনেকেই অগ্রজকে নির্ব্বোধ জ্ঞান করিয়াছিলেন। কিন্তু বাবু কৃষ্ণদাস পাল, হিন্দুপেট্রিয়টের এডিটার হইয়া, ক্রমশঃ বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন। হিন্দুপেট্রিয়ট উপলক্ষেই বাবু কৃষ্ণ দাস পাল বিখ্যাত হইয়াছিলেন এবং ক্রমশঃ তিনি ভারত-ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হইয়াছিলেন। পরন্তু, কৃষ্ণদাস বাবুর ওরূপ নাম ও প্রতিপত্তি লাভ হইবার কোন আশাই ছিল না; অগ্রজই কৃষ্ণদাস বাবুর এই উন্নতির মূল।
ইতিপূর্ব্বে যৎকালে অগ্রজ মহাশয়, বৈঁছিগ্রামে বালিকাবিদ্যালয় ও ইংরাজী-বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপনোপলক্ষে গিয়াছিলেন, তৎকালে গোবিন্দচাঁদ বসুর বাটীতে অবস্থিতি করিতেন। স্থানীয় লোকের প্রমুখাৎ অবগত হইয়াছিলেন যে, বৈঁছিগ্রামের মধ্যে উক্ত বাবুরা সাবেক বনিয়াদি তালুকদার এবং পরম দয়ালু। কালসহকারে ইহাঁদের সম্পত্তিসমুহ লোপ হইয়া যাওয়ায়, গোবিন্দচাঁদ বাবু ঢাকা জেলায় মুন্সেফী কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত গোবিন্দচাঁদ বাবু কর্ম্মচ্যুত হইয়া, উপায়ান্তর-বিহীন হইয়াছেন শুনিয়া, অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং কলিকাতায় প্রত্যাগত হইয়া, কয়েক দিবস পরে পাইকপাড়ানিবাসী রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ মহোদয়কে অনুরোধ করিয়া, বৃন্দাবনের লালাবাবুর ঠাকুরবাটীর ও তৎসন্নিহিত জমিদারির নায়েবের পদে মাসিক ১৫০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। বৎসর পরে গোবিন্দচাঁদ বাবু ঐ পদ পরিত্যাগ করায়, উহাঁর ভ্রাতুস্পুত্রগণের কলেজের অধ্যয়ন বন্ধ হয়। অগ্রজ ইহা শ্রবণ করিয়া, উহাঁর ভ্রাতা বাবু গগাকুলচাঁদ বসুকে স্বীয় সংস্কৃত-প্রেস এবং উহার ডিপজিটারিতে মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। ঐ টাকায় তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র দেবেন্দ্র ও উপেন্দ্র বসু প্রভৃতির কলিকাতায় বাসাখরচ নির্ব্বাহ হইত। এতদ্ভিন্ন গোকুলবাবু সাংসারিকব্যয়-নির্ব্বহের জন্য কয়েক মাসের মধ্যে অতিরিক্ত প্রায় দুই সহস্র টাকা না বলিয়া খরচ করেন; ইহাতে অগ্রজ মহাশয় কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ বা অসন্তুষ্ট হন নাই।
এই ঘটনার কয়েক মাস পরে, কলিকাতা বহুবাজারনিবাসী বাবু নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, উক্ত গোকুলবাবু প্রভৃতির নামে অভিযোগ করিয়া, বৈঁছির বসতবাটী ক্রোক করিয়া নীলাম করিবেন স্থির করিলেন। গোকুলচাদ বাবু প্রভৃতি উক্ত সংবাদ অগ্রজ মহাশয়ের কর্ণগোচর করিলে, তিনি অকাতরে প্রায় সহস্র মুদ্রা ডিক্রীদার নীলকমল বাবুকে প্রদান করিয়া, উহাদের বাস্তবাটী প্রভৃতি মুক্ত করিয়া দিলেন।
ঐ সময়ে একদিন সন্ধিপুরনিবাসী শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় আসিয়া ক্রন্দন করিয়া বলেন, জনাই গ্রামের মুখোপাধ্যায় মহাশয়েরা ডিক্রী করিয়া আমাদের বাটী নীলাম করিবেন। আপনি ৫০০৲ টাকা দিলে বাটী রক্ষা হয়; নচেৎ পরিবার লইয়া কাহার বাটীতে যাইয়া বাস করিব। ইহা শুনিবা মাত্র অগ্রজ মহাশয়, তাঁহাকে অকাতরে ৫০০৲ টাকা দান করিলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় খৃঃ ১৮৪৭ সালে বা বাঙ্গালা ১২৫৪ সালে সংস্কৃতডিপজিটারি সংস্থাপন করেন। সংস্কৃত-যন্ত্রে মুদ্রিত স্বকীয় পুস্তক সকল ও অন্যান্য আত্মীয় ব্যক্তির রচিত পুস্তক এবং এতদ্ব্যতীত বিদেশীয় লোকের মুদ্রিত পুস্তক এই পুস্তকালয়ে বিক্রয় হইত। ইহা স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, কতকগুলি নিরাশ্রয় অনুগত ব্যক্তি প্রতিপালিত হইবে; কিন্তু অনেকেই কার্য্যভার গ্রহণ করিয়া, আত্মসাৎ করিতে কুষ্ঠিত হন নাই। তাঁহাদের সংস্কার ছিল যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় অপরাধ দেখিলেও আদালতে অভিযোগ করিতে পরিবেন না। অবশেষে নানা কারণে ঐ সকল আত্মীয় লোককে কর্ম্মচ্যুত করিয়া, ডিপজিটারীর কার্য্যের সৌকর্য্যার্থে ১৮৫৯ খৃঃ অব্দের ১১ই জুন তারিখে বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে মাসিক ১৫০৲ টাকা বেতনে কর্ম্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে রাজকৃষ্ণ বাবু ফোর্ট উইলিয়মকলেজে মাসিক ৮০৲ টাকা বেতনে কর্ম্ম করিতেন। রাজকৃষ্ণ বাবু সংস্কৃত ও ইংরাজী ভাষায় পারদর্শী; এরূপ কার্য্যদক্ষ লোক অতি বিরল। ইনি কর্ম্মাধ্যক্ষ থাকিয়া, অগ্রজ মহাশয়ের নানা বিষয়ের বিশিষ্টরূপ সুবিধা করিয়াছিলেন। কিছুদিন পরে, অগ্রজ মহাশয় উহাঁর প্রতি পরিতুষ্ট হইয়া, অনুরোধপূর্ব্বক উহাকে প্রেসিডেন্সী কলেজের সংস্কৃতের প্রফেসারিপদে নিযুক্ত করিয়া দেন। তৎপরে ঐ পদে বৈঁছির বাবু গোকুলচাঁদ বসুকে মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন। কিন্তু তিনি সুচারুরূপে কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে অক্ষম হওয়ায়, তাঁহাকে পদচ্যুত করেন। এক দিবস বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ভবনে, কৃষ্ণনগরের ব্রজনাথ বাবুর সহিত কথোপকথন সময়ে তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, আপনি এক্ষণে ডিপজিটারির কার্য্য রীতিমত চালাইয়া, ইহার উপস্বত্ব ভোগ করুন, পরে যেরূপ বিবেচনা হয় করা যাইবে।
সন ১২৭১ সালের ভাদ্র মাস হইতে ব্রজবাবু ডিপজিটারির উপস্বত্ব নির্ব্বিরোধে ভোগ করিয়া আসিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উক্তরূপ নিঃস্বার্থদান-প্রভাবে কৃষ্ণনগরের মধ্যে ব্রজবাবু একজন ধনশালী ও মান্যগণ্য ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছিলেন।
অতঃপর সন ১২৯২ সালের অগ্রহায়ণ মাসে অগ্রজ মহাশয়, ব্রজবাবুর ও তাঁহার পরমাত্মীয় কোন ব্যক্তির কার্য্যকলাপ অবলোকনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া, ডিপজিটারি হইতে স্ব-রচিত ও প্রকাশিত সমস্ত পুস্তক উঠাইয়া লইয়া, সন ১২৯২ সালের ১৮ই আগ্রহায়ণ তারিখে, কলিকাতা সুকিয়াষ্ট্রীটের ২৫ নং বাটীতে কলিকাতা পুস্তকালয় নামে একটী নূতন পুস্তকালয় সংস্থাপিত করেন। তাঁহার স্ব-রচিত ও প্রকাশিত এবং ক্রীত সমস্ত পুস্তক এই স্থানেই বিক্রয় হইয়া থাকে। যে সময় সংস্কৃত-যন্ত্রের পুস্তকালয় হইতে পুস্তক সকল উঠাইয়া লন, ঐ সময়ে ব্রজবাবু অগ্রজকে ডিপজিটারি প্রত্যাৰ্পণ করিবার প্রস্তাব করেন; কিন্তু অগ্রজ মহাশয় তাহা না লইয়া, কেবলমাত্র নিজের পুস্তকগুলি উঠাইয়া লন। ডিপজিটারি ব্রজবাবুকেই রাখিতে বলিলেন। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় যে কতদূর ঔদার্য্য প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা পাঠকবর্গই অনুভব করিবেন।
পূর্ব্বে বলা হইয়াছে যে, কলিকাতাতেই পাঁচটী বিধবাবিবাহ-কার্য্য সমাধা হইয়াছে, পল্লীগ্রামে একটিও হয় নাই; একারণ, অগ্রজ মহাশয়, স্বদেশে বিবাহ দেওয়াইবার জন্য সবিশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। দেশীয় অনেক লোক তাঁহার নিন্দ করিত; কিন্তু মহাপুরুষকে সকলই সহ্য করিতে হইয়াছিল। দেশের বিধবা রমণীগণের ত্বরায় যাহাতে বিবাহ হয়, তদ্বিষয়ে জননীদেবী বিশিষ্টরূপ যত্নবতী হইয়াছিলেন। সন ১২৬৫ সালের আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জেলা। হুগলি মহকুমা জাহানাবাদের অন্তঃপাতী রামজীবনপুর, চন্দ্রকোণা, সোলা, শ্রীনগর, কালিকাপুর, ক্ষীরপাই প্রভৃতি গ্রামে প্রায় পনরটি বিধবা রমণীর পাণিগ্রহণকার্য্য সমাধা হয়। অগ্রজ মহাশয়, ঐ সকল বিবাহের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করেন। যাহারা বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়াছিল, তাহাদের বিপক্ষ প্রতিবাসিবর্গ উহাদের প্রতি নানারূপ অত্যাচার করিয়াছিল। অতঃপর অত্যাচার না হইতে পারে, তদ্বিষয়ে রাজপুরুষগণ সতর্ক হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও উহাদিগকে বিপক্ষের অত্যাচার হইতে রক্ষার জন্য, অকাতরে যথেষ্ট অর্থব্যয় করিয়াছিলেন। তৎকালীন জাহানাবাদের ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট মৌলবি আবদুল লতিব খাঁন বাহাদুর সম্পূর্ণরূপ আনুকূল্য করেন; তিনি পুলিশ দ্বারা সাহায্য না করিলে, প্রতিবাসীরা বিবাহসময়ে বিস্তর অনিষ্টসাধন করিতে পারিত; একারণ, আমরা কস্মিকালেও উক্ত মহাত্মা মৌলবী আবদুল লতিব খাঁন বাহাদুরের নাম বিস্মৃত হইতে পারিব না। ১২৬৬ সাল হইতে ১২৭২ সাল পর্যন্ত ক্রমিক বিস্তর বিধবা কামিনীর বিবাহকার্য্য সমাধা হয়। ঐ সকল বিবাহিত লোককে বিপদ্ হইতে রক্ষার জন্য, অগ্রজ মহাশয়, বিশেষরূপ যত্নবান্ ছিলেন; উহাদিগকে মধ্যে মধ্যে আপনার দেশস্থ ভবনে আনাইতেন। বিবাহিতা ঐ সকল স্ত্রীলোককে যদি কেহ ঘৃণা করে, একারণ জননীদেবী ঐ সকল বিবাহিতা ব্রাহ্মণজাতীয় স্ত্রীলোকের সহিত একত্র একপাত্রে ভোজন করিতেন। মধ্যে মধ্যে ঐ সকল স্ত্রীলোেক আমাদের বাটীতে আসিলে, জননীদেবী এবং বাটীর অপরাপর স্ত্রীলোকেরা উহাদের সহিত একত্র সমভাবে পরিবেশনাদি করিয়া, ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করাইত।
সন ১২৭০।৭১।৭২।৭৩ সালে জেলা মেদিনীপুর মহকুমায় গড়বেতার অন্তঃপাতী রায়খা, বাছুয়া, লেদাগমা, কেশেডাল, রসকুণ্ডু, শ্রীরামপুর প্রভৃতি গ্রামে বহুসংখ্যক কায়স্থজাতীয় বিধবা-কন্যার বিবাহ-কার্য্য সমাধা হয়। ঐ সময়েই বর্দ্ধমান জেলার অন্তঃপাতী যৌগ্রামের নিমাইচরণ সিংহের সহিত জাহানাবাদ মহকুমার অন্তঃপাতী যদুপুর গ্রামের রামকৃষ্ণ বসুর বিধবা-তনয়ার কলিকাতায় বিবাহ হয়। অগ্রজ মহাশয়, উহাদের সাংসারিক-ক্লেশ নিবারণের জন্য যথাসাধ্য আনুকূল্য করিয়া আসিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য, স্ত্রীজাতির কষ্ট-নিবারণ। তদ্বিষয়ে তাহাকে যথাসর্বস্ব ব্যয় করিতেও কখন কাতর বা কুষ্ঠিত হইতে দেখা যায় নাই।
সন ১২৬৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসের শেষে পিতামহীর আসন্নকাল উপস্থিত দেখিয়া, বীরসিংহা হইতে তাঁহাকে গঙ্গাযাত্রা করান হয়। তিনি শালিখায় গঙ্গাতীরে, বিনা আহারে, কেবল গঙ্গাজল পান করিয়া, কুড়ি দিন পরে গঙ্গালাভ করেন। তাঁহার শ্রাদ্ধাদি-কার্য্যে বিধবাবিবাহের প্রতিবাদিগণ অনেকে শক্রতা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। শ্রাদ্ধোপলক্ষে এ প্রদেশের বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতগণের সমাগম হইয়াছিল; অনেকে মনে করিয়াছিল, বিদ্যাসাগরের পিতামহীর শ্রাদ্ধে কোনও ব্রাহ্মণ ভোজন করিতে আসিবেন না; তাহা হইলেই পিতৃদেব মনোদুঃখে দেশত্যাগী হইবেন। যাহারা এরূপ মনে করিয়াছিল, তাহারা অতি নির্ব্বোধ; কারণ, অগ্রজ মহাশয় দেশে অবৈতনিক ইংরাজী-সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন, প্রায় চারি পাঁচ শত বালককে বিনা বেতনে শিক্ষা এবং ঐ সমস্ত বালককে পুস্তক কাগজ শ্লেট প্রভৃতি প্রদান করিতেন। ইহা ভিন্ন বাটীতে প্রত্যহ ৬০টী বিদেশস্থ সম্ভ্রান্ত ও অধ্যাপকদের বিদ্যার্থী সন্তানগণকে অন্নবস্ত্র প্রদান করিয়া অধ্যয়ন করাইতেন। মধ্যে মধ্যে অনেক ভিন্ন গ্রামের ছাত্রগণেরও চাকরি করিয়া দিতেন। দেশে দাতব্যঔষধালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। ডাক্তার বিনা ভিজিটে গ্রামের ও সন্নিহিত গ্রামবাসীদিগের ভবনে চিকিৎসা করিতে যাইত। নাইট্র-স্কুলের মধ্যে অনেকেই কলিকাতার বাসায় অন্নবস্ত্র পাইয়া, মেডিকেল-কলেজে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া চিকিৎসক হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত কি ধনশালী, কি মধ্যবিত্ত, কি দরিদ্র, সকল সম্প্রদায়ের লোক বিপদাপন্ন হইয়া আশ্রয় লইলে, বিপদ্ হইতে পরিত্রাণ পাইত; চাঁদা প্রদান করিয়া, বিস্তর বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া সাধারণের বিশিষ্টরূপ প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন। এবংবিধ লোকের পিতামহীর শ্রাদ্ধে শত্রুপক্ষ কেমন করিয়া বিঘ্ন জন্মাইতে পারে?
অগ্রজ মহাশয়, পিতৃদেবকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য, শ্রাদ্ধের ব্যয়ার্থ রীতিমত টাকা দিয়াছিলেন। শ্রাদ্ধের দিবস অনেক অধ্যাপক ভট্টাচার্য্যের সমাগম হইয়াছিল। বরদাপরগণার প্রায় সমস্ত ব্রাহ্মণ, কুটুম্ব ও বন্ধুবান্ধব অন্যুন ৩০০০ তিন সহস্ৰ ব্রাহ্মণ ফলাহার করেন, এবং পরদিবস অন্নেও প্রায় দুই সহস্ৰ ব্রাহ্মণ ভোজন করেন। ইহাতে পিতৃদেব পরম আহলাদিত হইয়াছিলেন।
পরবৎসর সপিণ্ডনসময়েও দাদা, পিতৃদেবকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য যথেষ্ট টাকা দিয়াছিলেন। অধ্যাপকগণের নিমন্ত্রণার্থ প্রথমে যে কবিতাটা প্রস্তুত হয়, উহা দুর্ব্বোধ দেখিয়া, স্বয়ং এই সরল কবিতাটি লিখিয়া দেন।
পৌষস্য পঞ্চবিংশাহে রবৌ মাতুঃ সপিণ্ডনং।
কৃপয়া সাধ্যতাং ধীরৈর্বীরসিংহসমাগতৈঃ॥
আমাদের বাটীর সন্নিহিত রাধানগরীনিবাসী জমিদার ৺বৈদ্যনাথ চৌধুরীর পৌত্র বাবু শিবনারায়ণ চৌধুরী, এ প্রদেশের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ও মান্য-গণ্য জমিদার ছিলেন। বাবু রমাপ্রসাদ রায়ের নিকট ইনি জমিদারী বন্ধক রাখিয়া, পঞ্চাশ সহস্ৰ মুদ্র ঋণ গ্রহণ করেন। ইহার সুদও ২৫০০০৲ পঁচিশ হাজার টাকা হইয়াছিল। এই পঁচাত্তর হাজার টাকার কিস্তীবন্দী করিতে যাইয়া, বাবু শিবনারায়ণ চৌধুরী কলিকাতাস্থ উক্ত রায় মহাশয়ের দপ্তরখানায় পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। উহাঁর পুত্রদ্বয়, রমাপ্রসাদ বাবুর নিকট কাঁদিয়া পদানত হইলেও, উক্ত রায় মহাশয়ের অন্তঃকরণে দয়ার উদ্রেক হইল না। অনন্তর রাধানগরীনিবাসী মৃত শিবনারায়ণ চৌধুরীর পুত্রদ্বয় এবং মৃত সদানন্দ ও লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর বিধবা পত্নীদ্বয়, ইঁহারাও কলিকাতায় অগ্রজ মহাশয়ের নিকট যাইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। উহাঁদের রোদনে অগ্রজ মহাশয়েরও চক্ষে জল আসিল। উহাঁরা রমাপ্রসাদ বাবুর ভয়ে তাঁহার বাটী পরিত্যাগ করিয়া, খিদিরপুর পদ্মপুকুরের ধর্ম্মদাস কেরাণীর ভবনে গুপ্তভাবে প্রায় চারি মাস কাল অবস্থিতি করেন। অগ্রজ, উহাঁদিগকে ঋণজাল হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করেন।যাঁহার নিকট টাকার স্থির করিতেন, রমাপ্রসাদ বাবু তাঁহাকেই টাকা দিতে নিবারণ করিয়া দিতেন। তজ্জন্য কলিকাতার মধ্যে কোন মহাজন টাকা ধার দিতে অগ্রসর হয় নাই। অবশেষে রাজা প্রতাপসিংহের আত্মীয় বাবু কালিদাস ঘোষ মহাশয়ের নিকট পঞ্চাশ সহস্ৰ টাকা ও অন্য এক ব্যক্তির নিকট পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করিয়া টাকা দিতে যাইলে, উক্ত রায় মহাশয় টাকা গ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। কারণ, তিনি উহাঁদের জমিদারী লাইব, এরূপ দৃঢ়সংকল্প করিয়াছিলেন। সুতরাং অগ্রজ মহাশয়, সুইনহো লা-কোম্পানির বাটীতে গতিবিধি করিয়া, অবিলম্বে টাকা জমা দিয়া, উহাদিগকে রমাপ্রসাদ বাবুর নিকট ঋণদায় হইতে মুক্ত করিয়া দেন। অগ্রজ মহাশয়, রাধানগরের চৌধুৱী-বাবুদের জমিদারী রক্ষার জন্য, ক্রমিক ছয় মাস কাল অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া, নানা স্থানে নিজের প্রায় দুই সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিয়া কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। তিনি রমাপ্রসাদ বাবুর হস্ত হইতে উহাদিগকে পরিত্রাণ করিয়া, দেশস্থ সাধারণের নিকট বিলক্ষণ প্রশংসাভাজন হইয়াছিলেন; কিন্তু এইজন্য তদবধি বাবু রমাপ্রসাদ রায়ের সহিত অগ্রজের মনান্তর ঘটিয়াছিল। অতঃপর কয়েক বৎসর চৌধুরী-বাবুরা পরম-সুখে কালাতিপাত করেন। দুঃখের বিষয় এই, ভ্রাতৃবিরোধ ও সুবন্দোবস্ত না হওয়াতে, রীতিমত ঋণ পরিশোধ না হইয়া, দুই এক মহাজন পরিবর্ত্তনের পর, ঐ সম্পত্তি ক্রোক নীলামে বিক্রয় হয়। তন্নিবন্ধন উহাদের কষ্ট উপস্থিত হইলে, মৃত লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর পত্নী ও সদানন্দ চৌধুরীর পত্নীকে মাসিক ব্যয়-নির্ব্বাহার্থ অগ্রজ মহাশয় প্রতি মাসে প্রত্যেককে গোপনভাবে ৩০৲ টাকা করিয়া মাসহরা প্রেরণ করিতেন। কিছুদিন পরে মোনপুরের কাশীনাথ ঘোষ ৮০০৲ শত টাকার জন্য উক্ত চৌধুরীর নামে অভিযোগ করিয়া বসতবাটী ক্রোক করিলে, আমি, অগ্রজ মহাশয় ও উহাঁদের অনুরোধে, কাশীনাথ ঘোষের সহিত ১৫০৲ টাকায় রফা করিয়া, দাদার নিকট হইতে ঐ টাকা লইয়া, উক্ত বিষয় খোলসা করিয়া দিয়াছিলাম।
ঐ বৎসর পিতৃদেব মহাশয়, দীনবন্ধু কুম্ভকারকে সমভিব্যাহারে লইয়া, পদব্রজে তীর্থপর্য্যটনে প্রস্থান করেন। তৎকালে পশ্চিমাঞ্চলে রেলওয়ে হয় নাই। এক বৎসর কাল সকল তীর্থ পরিভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে পুষ্কর তীর্থ হইতে অগ্রজকে এক পত্র লিখেন যে, তুমি আমার বংশে রামাবতার, তোমার পিতা বলিয়া এ প্রদেশের সকল স্থানের লোকই আমাকে পরম সমাদর করিয়া থাকেন; অথচ তুমি কাশী, এলাহাবাদ, কানপুর, মথুৱা, বৃন্দাবন, জ্বালামুখী, পুষ্কর প্রভৃতি তীর্থে কখন আগমন করা নাই। তোমার শব্দপরিচয়ে আমি সকলের নিকট পরিচিত হইতেছি। অনন্তর, অগ্রজ মহাশয়ের অনুরোধে পিতৃদেব ত্বরায় দেশে পুনরাগমন করেন।
সংস্কৃত-কলেজের ছাত্রদিগের উৎসাহ-বৰ্দ্ধনার্থ অগ্রজ মহাশয়, তৎকালের লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর গ্রাণ্ড্ সাহেবকে বলেন যে, রামকমল ভট্টাচার্য্য, গিরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রামাক্ষয় চট্টোপাধ্যায়কে ডেপুটি মাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত করা আবশ্যক হইয়াছে। সাহেব, উহাঁদের নাম লিখিয়া রাখিলেন এবং বলিলেন, “ইহাঁরা এক্ষণে কি করিতেছেন শুনিতে ইচ্ছা করি।” অগ্রজ বলিলেন, “রামকমল, কলিকাতার নর্ম্ম্যাল-স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত আছেন।” সাহেব শুনিয়া উত্তর করিলেন, “যিনি ছেলে পড়াইয়া থাকেন, তিনি অকর্ম্মা হইয়াছেন, তাঁহার দ্বারা এ সকল কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়া কঠিন।” ইহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “রামকমল সংস্কৃত ও ইংরাজী ভালরূপ জানেন। বিশেষতঃ অঙ্কে ইহাঁর তুল্য লোক এক্ষণে দেখিতে পাওয়া যায় না। অতএব ইঁহাকে ডেপুটী মাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত না করিলে, আমি বড়ই দুঃখিত হইব।” তাহা শুনিয়া সাহেব বলিলেন, “আচ্ছা, পণ্ডিত, তোমার কথা স্বীকার করিলাম।” গিরিশ কি করেন জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, ইনি এক্ষণে চব্বিশ-পরগণার জজ-আদালতে ওকালতি করিতেছেন। তাহা শুনিয়া, সাহেব উত্তর করেন, “ইনি উহাঁর অপেক্ষা উপযুক্ত লোক, ইনি ভালরূপ কার্য্য করিতে পরিবেন।” রামাক্ষয়ের এই পরিচয় দেন যে, ইনি আমার অধীনে ডেপুটী ইনস্পেক্টরের পদে থাকিয়া, মফঃস্বলের বিদ্যালয় সকল পরিদর্শন করিতেছেন। ইহা শুনিয়া সাহেব উত্তর করেন যে, ইনিও কার্য্যক্ষম হইবেন।
কয়েক মাস অতীত হইল, তথাপি ইহাঁরা কার্য্যভার প্রাপ্ত হইলেন না। তজ্জন্য এক দিন রামকমল, অগ্রজকে বলিলেন, “আপনার কথায় বিশ্বাস নাই, যেহেতু অদ্যাপি আমরা ডেপুটী মাজিষ্ট্রেটের কর্ম্মে নিযুক্ত হইতে পারিলাম না।” পর দিবস দাদা, গ্রাণ্ডসাহেবের নিকট গমন করিয়া, সাহেবকে বিশেষরূপ অনুরোধ করাতে তিনি বলিলেন, “আচ্ছা, রামকমল শীঘ্রই কর্ম্ম পাইবেন।” দুঃখের বিষয় এই, বাসায় প্রত্যাগত হইয়া কিয়ৎক্ষণ পরে জানিলেন যে, রামকমল উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। রামক্ষয়, ত্বরায় ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইলেন। গিরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ওকালতীতে বিশিষ্টরূপ পশার করিয়াছেন, এজন্য ডেপুটী-মাজিষ্ট্রেটের পদগ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন না।
সন ১২৬৯ সালের কার্ত্তিক মাসে অগ্রজ মহাশয়, বাটী আগমন করেন। এই সংবাদে স্থানীয় অনেক দুঃখিনী ভদ্র-কুলাঙ্গন স্বীয় স্বীয় সাংসারিক কষ্টনিবারণ-মানসে তাঁহার নিকট আসিয়াছিলেন। তিনি দরিদ্র স্ত্রীলোকদের প্রতি বিশেষ দয়া প্রকাশ করিতেন। পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীজাতির প্রতি সচরাচর ইহাঁর অধিক অনুগ্রহ দৃষ্টিগোচর হইত। ঐ সময়ে বৎসরের মধ্যে প্রায় দুই তিন বার দেশে আগমন করিতেন। প্রত্যেক বারে অন্ততঃ নগদ ৫০০৲ টাকা অন্যুন ৫০০৲ টাকার বস্ত্র লইয়া আসিয়া, নিরুপায় স্ত্রীলোকদিগকে অকাতরে বিতরণ করিতেন।
এক দিবস অগ্রজ, মধ্যাহ্ন-সময়ে বাটীর মধ্যে ভোজন করিতে যাইয়া দেখিলেন যে, দুইটি অপরিচিত স্ত্রীলোক বসিয়া আছেন। একটির বয়স প্রায় ৬০ বৎসর, অপরটির বয়স ১৮।১৯ বৎসর। তাহাদের পরিধেয় বস্ত্র আতি জীর্ণ, মুখের ভাব দেখিলেই বোধ হয়, উহারা অতি দুঃখিনী। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! ইহারা কে? এখানে বসিয়া কেন?” জননীদেবী বলিলেন, “বয়োজ্যেষ্ঠাটি তোমার বাল্যকালের গুরুমহাশয়ের প্রথমকার স্ত্রী, আর অল্পবয়স্কটি ইহার কন্যা। ইহারা তোমাকে আপনাদের দুঃখের কথা বলিবার জন্য এখানে বসিয়া আছেন। তোমার গুরুমহাশয় দুই পুরুষিয়া ভঙ্গ-কুলীন, ছয় সাতটি মাত্র বিবাহ করিয়াছেন।” উক্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট দাদা বাল্যকালে পাঠশালায় অধ্যয়ন করিয়াছিলেন; একারণ, উহাঁকে মাসে মাসে ৮৲ টাকা দিতেন; আর বীরসিংহ বিদ্যালয়ের বাঙ্গাল ডিপার্টমেণ্টের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন, তজ্জন্যও উপযুক্ত বেতন দিতেন। ইহাঁর অন্য আর এক স্ত্রীর গর্ভসম্ভৃত এক পুত্রকেও মাসিক ১০৲ টাকা বেতনে বিদ্যালয়ের তৃতীয় পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। উক্ত মহাশয়েরা দাদার বিলক্ষণ খাতির রাখিতেন। গুরুমহাশয়ের ভগিনীদ্বয় ও ভাগিনেয় তাঁহারই বাটীতে থাকিতেন। তিনি যাহা উপাৰ্জ্জন করিতেন ও ভূম্যাদির উপস্বত্ব যাহা প্রাপ্ত হইতেন, তৎসমস্তই ভগিনীদ্বয়ের হস্তে সমর্পণ করিতেন। চট্টোপাধ্যায় মহাশয় নিজে অতি ভদ্রলোক ছিলেন। দেশস্থ সকলেরই সহিত তিনি সৌজন্য প্রকাশ করিতেন। এই কারণে এবং তিনি অনেকেরই গুরুমহাশয় ও কুলীন বলিয়া, সকলেই তাঁহাকে মান্য করিতেন। কিন্তু তাঁহার ভগিনীদ্বয় অত্যন্ত দুর্বৃত্তা ও প্রখরা ছিলেন। যদি তিনি কোন স্ত্রীকে আপন বাটীতে আনিয়া রাখিতেন, তাহা হইলে তাঁহার ভগিনীদ্বয় তাহার দ্রব্যাদি লইয়া বাটী হইতে বহিষ্কৃতা করিয়া দিতেন। তিনি ভয়ে ভগিনীদ্বয়কে কখন কিছু বলিতে সাহস করিতেন না। একবার আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, মেদিনীপুরের সন্নিহিত পাথরার অল্পবয়স্ক পরমাসুন্দরী কনিষ্ঠ পত্নীকে আনিয়া বাটীতে রাখিয়াছিলেন। তাঁহার ঐ স্ত্রী, পিত্রালয় হইতে আসিবার সময়, যথেষ্ট দ্রব্যাদি সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। কিছুদিন পরে তাঁহার ভগিনীদ্বয়, দ্রব্যাদি আত্মসাৎ করিয়া, ঐ অল্পবয়স্কা ভ্রাতৃজায়াকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেয়। তাহা দেখিয়া, তিনি ভগিনীদ্বয়ের ভয়ে কোন কথা বলিতে সাহস করেন নাই। তাঁহার অন্যান্য স্ত্রী বীরসিংহায় আসিলে, তাহাদের প্রতিও এইরূপ নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেন।
অগ্রজ, ঐ দুইটি স্ত্রীলোককে দেখিয়া ভোজনে বিরত হইলেন, এবং উহাদিগকে বলিলেন, “তোমরা উভয়ে কিজান্য আসিয়াছ, তাহা বল।” বুদ্ধ বলিলেন, “আমি তোমার বাল্যকালের শিক্ষক মহাশয়ের প্রথম-বিবাহিতা স্ত্রী, আর এইটা আমার গর্ভসম্ভৃত কন্যা। এই কন্যার পতি কুলীন। তিনি প্রায় চল্লিশটী কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন; এবং যে স্ত্রীর জনকজননীর নিকট খোরাকীর টাকা প্রাপ্ত হন, সেই স্ত্রীকেই গৃহে রাখেন। আমাদের নিকট কিছুই পাইবার আশা নাই; একারণ, আমার কন্যাকে লইয়া যান না। বৎসরের মধ্যে একবার জামাতাকে আনিতে হইলেও দশ টাকা ব্যয় হয়, তাহাও আমাদের ক্ষমতা নাই। কুলীন জামাতার, কন্যাকে প্রতিপালন করিবার কথা নাই। অগত্যা কন্যাটী আমার নিকটেই অবস্থিতি করে। আমি এখান হইতে তিন ক্রোশ দূরে পিত্রালয়ে যাবজ্জীবন অবস্থিতি করিয়া থাকি। আমার পুত্ত্র, কষ্টে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। এক্ষণে পুত্ত্রটী বলিতেছেন, অতঃপর আমি তোমাদের দুইজনকে অন্নবস্ত্র দিতে পারিব না। ইহা শুনিয়া আমি পুত্ত্রকে বলিলাম, বল কি বাবা! তুমি এরূপ বলিলে, আমরা কোথায় যাই? তাহাতে পুত্র বলিল, তুমি জননী, না হয় তোমাকে অন্ন দিতে পারি, কিন্তু ভগিনীকে খেতে দিতে পারিব না। ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, কুলীন কর্ত্তৃক বিবাহিত কন্যা চিরকাল ভ্রাতার বাটীতেই থাকে। আমার কথা শুনিয়া পুত্র বলিল, সে যাহা হউক, তোমাকেই খেতে দিব, তুমি উহার বন্দোবস্ত কর। ইহা শুনিয়া আমি রাগ করিয়া বলিলাম, তুমি খেতে দিবে না, তবে কি প্রসন্ন বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিবে? তাহাতে পুত্র বলিল, উহার যাহা ইচ্ছা তাহাই করুক। তদুপলক্ষে উপযুক্ত পুত্রের সহিত আমার বিলক্ষণ মনান্তর ঘটিল। পুত্রের এইরূপ কথা শুনিয়া চতুর্দ্দিক এককালে অন্ধকারময় দেখিলাম।
কি করি, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। অবশেষে শুনিলাম, আমার মাসতুত ভ্রাতার বাটীতে একটী পাচিকার আবশ্যক হইয়াছে। কন্যাটী লইয়া তথায় যাইলাম; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁহারা বলিলেন যে, চারি দিবস। অতীত হইল আমাদের বাটীতে পাচিকা নিযুক্ত হইয়াছে। কি করি, কোথা যাই, এই ভাবিতে লাগিলাম। মনে হইল, শুনিয়াছি গঙ্গাতীরে একটি গ্রামে স্বামীর এক সংসার আছে, তথায় এক সপত্নীপুত্র ব্যবসা-উপলক্ষে বিলক্ষণ সঙ্গতি করিয়াছেন। তিনি পরম ধার্ম্মিক ও পরম দয়ালু লোক। যদিও আমি বিমাতা আর প্রসন্নময়ী বৈমাত্রেয় ভগিনী, কিন্তু তাঁহার নিকট যাইয়া আমাদের অন্ন-বস্ত্রের দুঃখ জানাইলে, অবশ্য তাঁহার দয়ার উদ্রেক হইতে পারে। এই ভাবিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলাম এবং সমস্ত ব্যক্ত করিয়া রোদন করিতে লাগিলাম। আমাদের কাতরতা-দর্শনে সপত্নীপুত্র হইয়াও যথেষ্ট স্নেহ ও যত্ন করিলেন এবং বলিলেন, মা, যতদিন আপনারা উভয়ে জীবিত থাকিবেন, ততদিন আমি আপনাদিগের ভরণ-পোষণ করিব। ইহা শুনিয়া, আমরা পরম আহলাদিত হইলাম। তিনি যথোচিত যত্ন করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহার বাটীর স্ত্রীলোকেরা সেরূপ নহেন। তাঁহারা প্রায় বলিতেন যে, এ আপদ্ আবার কোথা হইতে আসিল। স্ত্রীলোকদের সহিত প্রায় মনান্তর ঘটিত; একারণ, আমি একদিন সপত্নীপুত্রকে বলিলাম, বাবা, আমাদের উভয়ের প্রতি বাটীর স্ত্রীলোকেরা যেরূপ ব্যবহার করিতেছেন, তাহাতে আমরা ক্ষণকাল এখানে অবস্থান করিতে পারি না। তাহাতে তিনি বলিলেন, আমি সকলই ইতিপূর্ব্বে অবগত হইয়াছি। বাটীর স্ত্রীলোকদিগকে শাসন করিলে, উহারা আপনাদের প্রতি আরও অসহ্য ব্যবহার করিবেন। এমন স্থলে আপনারা এখান হইতে প্রস্থান করুন। আমি আপনাদের ভরণপোষণ জন্য, মাসে মাসে কিছু কিছু সাহায্য করিতে পারি। এইরূপে নিরাশ্বাস হইয়া, কন্যার সহিত তথা হইতে বহির্গত হইলাম। পরিশেষে ভাবিলাম, স্বামী জীবিত আছেন এবং বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয়ে পণ্ডিতি-কর্ম্ম করিয়া থাকেন। তাঁহার নিকট যাইয়া রোদন করিলে, অবশ্য কন্যাটির জন্য দয়া হইতে পারে। এই স্থির করিয়া দশ বার দিবস অতীত হইল, এখানে আসিয়াছি। পতি নিজে ভদ্রলোক বটে, কিন্তু তিনি তাঁহার দুইটী ভগিনীর নিতান্ত বশীভুত, তাহাদের পরামর্শে আমাদিগকে জবাব দিলেন যে, তোমাদের এখানে থাকা হইবে না। তোমাদিগকে অন্ন-বস্ত্র দিতে পারিব না। স্বামীর কথা শুনিয়া আশ্চর্য্যান্বিতা হইলাম। কোথা যাই কি করি ভাবিতেছিলাম, এমন সময়ে এই গ্রামের নবীন চক্রবর্ত্তী ও হারাধন চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি ও অন্যান্য অনেক লোক বলিল, বিদ্যাসাগর পরম দয়ালু, অনাথা স্ত্রীলোকের একমাত্র বন্ধু। তিনি গতকল্য বাটী আসিয়াছেন, আসিয়া অবধি অনেক দরিদ্র স্ত্রীলোককে যথেষ্ট টাকা ও বস্ত্র বিতরণ করিতেছেন। তাহা শুনিয়া আমরা তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। তুমি আমাদের যাহা হয়, একটা উপায় করিয়া দাও।” বৃদ্ধার ঐ সকল কথা শুনিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় দুঃখে অভিভূত হইলেন, এবং তাঁহার নয়নদ্বয় অশ্রুজলে প্লাবিত হইল।
কি আশ্চর্য্য! পুত্র ও স্বামী অম্নান-বদনে বলিলেন, তোমাদিগকে অন্ন-বস্ত্র দিতে পারিব না, তোমরা যথায় ইচ্ছা যাও! কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত উহাদের কোন সংস্রব নাই, তিনি বৃদ্ধার কথা শুনিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বৃদ্ধাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া, চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাটীতে গমন করিয়া বলিলেন, “আপনার ব্যবহার দেখিয়া আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছি। আপনি কেমন করিয়া বৃদ্ধ স্ত্রী ও যুবতী কন্যাকে বাটী হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিতেছেন? আপনি তাঁহাদিগকে বাটীতে রাখিবেন কি, না জানিতে ইচ্ছা করি।” দাদার এই ভাবভঙ্গি দেখিয়া, গুরুমহাশয় ভয় পাইলেন, এবং বলিলেন, “তুমি এক্ষণে বাটী যাও, আমি ঘরে গিয়া দুই ভগিনীর সহিত বুঝিয়া, পরে তোমার নিকট যাইতেছি।” তদনন্তর তিনি অগ্রজের নিকট আসিয়া বলিলেন, “যদি তুমি তাহাদের হিসাবে মাসে মাসে স্বতন্ত্র কিছু দিতে সম্মত হও, তাহা হইলে আমি উহাদিগকে রাখিতে পারি; নচেৎ আমার ভগিনীদ্বয় উহাদিগকে রাখিতে সম্মত হইবে না।” অগ্রজ, তৎক্ষণাৎ স্বীকার পাইলেন, এবং তিন মাসের অগ্রিম বার টাকা তাঁহার হস্তে দিয়া বলিলেন, “এইরূপে তিন মাসের টাকা অগ্রিম পাইবেন। এতদ্ভিন্ন ইহাঁদের পরিধেয় বস্ত্রের ভার আমার প্রতি রহিল।” ছয় মাসের বস্ত্র তাঁহার হস্তেই প্রদান করেন। ছয় মাস পরে আবার বস্ত্র প্রদানের ভার আমার প্রতি অৰ্পণ করেন। গুরুমহাশয় আর কোন ওজর করিতে না পারিয়া নিরুপায় হইয়া, স্ত্রী ও কন্যা লইয়া গৃহাভিমুখে গমন করিলেন। চারি টাকা করিয়া দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন শুনিয়া, তাঁহার ভগিনীদ্বয় সম্মত হইলেন। গুরুমহাশয়, কখনও কোন স্ত্রীকে আনিয়া নিকটে রাখিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে, ভগিনীরা খড়গহস্ত হইয়া উঠিতেন; সুতরাং তিনি কস্মিনকালেও আপন অভিপ্রায় সম্পন্ন করিতে পারেন নাই। ভঙ্গ-কুলীনদের ভগিনী, ভাগিনেয় ও ভাগিনেয়ীরাই পরিবার-স্থানে পরিগণিত। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রভৃতির সহিত তাঁহাদের কোন সংস্রব থাকে না। দয়াময় বিদ্যাসাগর মহাশয়, হতভাগিনীদের প্রতি অনুগ্রহ-প্রদৰ্শন-পূর্বক বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করেন এবং যথাকালে অঙ্গীকৃত মাসিক দেয় প্রেরণ করিতে বিস্মৃত হন নাই। কতিপয় মাস অতীত হইলে পর, অগ্রজ মহাশয় বাটী আসিয়া, সেই দুই হতভাগিনীর বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন, চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ও তাঁহার ভগিনীদ্বয় স্থির করিয়াছিলেন যে, বিদ্যাসাগরের অঙ্গীকৃত নূতন মাসহরা পুরাতন মাসিক মাসহরার অন্তর্ভূত হইয়াছে। আর তাহা কোন কারণে রহিত হইবার নহে। তদনুসারে তিনি ভগিনীদের উপদেশের অনুবর্ত্তী হইয়া, বৃদ্ধ স্ত্রী ও যুবতী দুহিতাকে বাটী হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিয়াছেন; তাঁহারাও উপায়ান্তর-বিহীন হইয়া কলিকাতা প্রস্থান করিয়াছেন। ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন। দাদার দুঃখ দেখিয়া, নবীন চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি বলিলেন, “মহাশয়! গুরুমহাশয়ের কন্যার কথা শুনিয়া আপনি রোদন করিতে লাগিলেন, তবে আপনি দেশের কুলীনদের কোনও সন্ধান রাখেন নাই। কুলীনদের চরিত্র শুনিলে ঘৃণা ও রাগ হয়। মহাশয়! শুনিতে পাই, সাহেবেরা আপনার কথা শুনিয়া থাকেন। লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সার সিসিল বীডনের সহিত আপনার বিলক্ষণ সম্ভাব আছে, তিনি আপনাকে সম্মান করিয়া থাকেন। অতএব আপনার নিকট আমাদের এই প্রার্থনা যে, আপনি যোগাড় করিয়া এই কুব্যবহারের মূলোৎপাটনে যত্ন করুন। কুলীনদিগের বহুবিবাহ কুপ্রথা উঠাইয়া দিবার জন্য যত্ন পাইলে, অনায়াসে দেশবিদেশের রাজা, সন্ত্রান্ত লোক ও ভূম্যধিকারী প্রভৃতি সকলেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করবেন। আপনি মনোযোগী হইলে, আক্লেশে বহুবিবাহ কুপ্রথা একেবারে দেশ হইতে তিরোহিত হইবে।” এই কথা শুনিয়া, তিনি দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগপূর্বক চিন্তা করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে নবীন চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি, কতিপয় কুলীন-মহিলার কাহিনী বর্ণন করিয়া বলিলেন, “মহাশয়! আপনি কলিকাতায় থাকেন, পল্লীগ্রামের কুলীনদের কোনও সংবাদ রাখেন না। এ সকল বিষয় আপনার কর্ণগোচর হইলে, দেশের অনেক মঙ্গল হইবে, একারণ আপনাকে জানাইলাম। ইহাতে আমাদের যদি কোন অপরাধ হয়, তাহা অনুগ্রহপূর্বক ক্ষমা করিবেন?”
কিছুদিন পরে অগ্রজ মহাশয়, তাঁহাদিগকে বলিলেন, “কোন্ গ্রামের কোন কুলীন কত বিবাহ করিয়াছেন, কয়েক মাসের মধ্যে তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আমার নিকট পাঠাইবে।” অনন্তর, বহুবিবাহ নিবারণের আবেদনপত্রে বঙ্গদেশের সন্ত্রান্ত লোকদিগের দস্তখত থাকা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, তিনি বৰ্দ্ধমানাধিপতি শ্রীযুক্ত মহারাজাধিরাজ মহাতাপচন্দ্র রায় বাহাদুর, নবদ্বীপাধিপতি শ্রীযুক্ত মহারাজা সতীশ্চন্দ্র রায় বাহাদুর, শ্রীযুক্ত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ রায় বাহাদুর, শ্রীযুক্ত রাজা সত্যনারায়ণ ঘোষাল বাহাদুর প্রভৃতি এবং প্রায় পঁচিশজন কৃতবিদ্য লোক ও অন্যান্য লোকের স্বাক্ষর করাইয়া, আবেদন-পত্র দাখিল করেন। তৎকালীন লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সর সিসিল বীডন সাহেব, বহুবিবাহ কুপ্রথা রহিতের ঐ দরখাস্ত সমাদরপূর্ব্বক গ্রহণ করেন। কুলীন অবলাগণের দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত সেই সময়ে রাজ্যে মিউটিনির আশঙ্কা হওয়ায় ও তৎকালে অগ্রজ মহাশয়েয় অসুস্থতা নিবন্ধন চলৎশক্তি-রহিত হওয়ায় এবং অন্যান্য কারণে, বহুবিবাহ কুপ্রথা ভারতবর্ষ হইতে তিরোহিত হইল না।
সন ১২৬৮ সালের ১লা বৈশাখ অগ্রজ মহাশয়, সীতার বনবাস মুদ্রিত করেন। আমরা বাল্মীকির রামায়ণ পাঠ করিয়াছি এবং অগ্রজ মহাশয়ের রচিত সীতার বনবাসও দেখিয়াছি। লেখার পাণ্ডিত্য-দর্শনে মোহিত হইতে হয়। কারুণ্য-রাসের বর্ণনপক্ষে ইহাঁকে বাল্মীকির তুল্য বলিলেও বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। অগ্রজ মহাশয়, বাঙ্গালা-ভাষায় যেরূপ পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়াছেন, বোধ করি, এরূপ বাঙ্গালা-ভাষা লেখার প্রতিদ্বন্দ্বী কেহ ভারতবর্ষে অদ্যাপি জন্মগ্রহণ করেন নাই। অতি নিষ্ঠুর নির্দ্দয় ব্যক্তিও সীতার বনবাসের অষ্টম পরিচ্ছেদ পাঠ বা শ্রবণ করিলে, অশ্রাজল বিসৰ্জন না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে সক্ষম হন না।
এই সময়ে নদীয়া জেলার মহারাজা সতীশচন্দ্র রায় বাহাদুর মানবলীলা সংবরণ করিলে পর, তাঁহার পত্নী, রাণী ভুবনেশ্বরী দেবী, গুরুদেব লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্য্য ও মোক্তারের পরামর্শানুসারে পোষ্যপুত্র গ্রহণ না করিয়া, স্বয়ং বিষয়কার্য্য চালাইতে অভিলাষ করেন। যাহাতে বিষয় কোট অব ওয়ার্ডের অধীনে যায়, তদ্বিষয়ে তাঁহাদের গুরুদেব ও মোক্তার, বিধিমতে চেষ্টা পাইতে ছিলেন। কৃষ্ণনগরের দুই একটি ভদ্রলোক ও তৎকালীন দেওয়ান বাবু কার্ত্তিকচন্দ্র রায় মহাশয়, অগ্রজ মহাশয়কে বিশেষরূপে অনুরোধ করেন যে, তিনি কৃষ্ণনগর যাইয়া রাণীকে উপদেশ দিয়া, যাহাতে বিষয়টি কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে যায়, তাহা করুন। তাহা না করিলে, নদীয়ার বিখ্যাত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম ও বংশমর্য্যাদা এককালে বিলুপ্ত হইবার সম্ভাবনা। ইহা শ্রবণ করিয়া অগ্রজ মহাশয়, ত্বরায় কৃষ্ণনগর গমন করিয়া, রাণীকে নিজে ও কমিসনর ক্যাম্বেল সাহেব সহোদয়ের দ্বারা নানাপ্রকার উপদেশ দিয়া, বিষয় কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে আনাইয়াছিলেন। তাহাতেই এই ফলোদয় হইয়াছিল যে, ঋণ পরিশোধ হইয়া এক্ষণকার মহারাজা ক্ষিতীশচন্দ্র রায় বাহাদুর সাবালক হইয়া, দুই লক্ষ দশ হাজার টাকা প্রাপ্ত হন। তজ্জন্য মহারাজা ক্ষিতীশচন্দ্র, কলিকাতায় আগমন করিয়া, কৃতজ্ঞতাপ্রদর্শনার্থ অগ্রজ মহাশয়ের বাটতে তাঁহার সহিত মধ্যে মধ্যে সাক্ষাৎ করিতেন। অপিচ, বর্তমান মহারাজার পিতামহ শ্রীশচন্দ্র রায়-বাহাদুর, অগ্রজ মহাশয়কে এত আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন যে, বিধবাবিবাহের আবেদনপত্রে স্বয়ং স্বাক্ষর করিয়াছিলেন এবং যৎকালে গ্রাণ্ড্ সাহেব মহোদয়কে কলিকাতা ও অন্যান্য প্রদেশের সন্ত্রান্ত ধনশালী ও সুশিক্ষিত লোক প্রশংসাপত্র প্রদান করেন, তৎকালে শ্রীশচন্দ্র রায়বাহাদুর স্বয়ং উক্ত সাহেবের বাটীতে যাইয়া, স্বহস্তে ঐ পত্র সাহেবকে প্রদান করেন। রাজা শ্রীশচন্দ্র রায়-বাহাদুর বিধবাবিবাহের পক্ষসমর্থনকারী ছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, কলিকাতায় প্রথম বিবাহসময়ে, তাঁহার অধীনস্থ কৃষ্ণনগর সমাজের প্রধান প্রধান ব্যক্তিদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় আগমনপূর্বক সভাস্থ হইয়া, প্রথম বিধবাবিবাহ কার্য্য সম্পাদন করিবেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, হতভাগিনী হিন্দু বিধবাদিগের দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ বিবাহের পূর্বদিবস তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু হয়। এই বিপদে পতিত হওয়ায়, তিনি সভায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই। ইহাও প্রকাশ আছে যে, নবদ্বীপাধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশীয়েরা বঙ্গদেশের সকল সমাজের ও জাতীয় আচার-ব্যবহারাদির কর্ত্তা; তিনি ঐ বিবাহে উপস্থিত হইতে পারিলে, বিধবাবিবাহ বঙ্গদেশে সর্ব্ববাদি-সম্মত হইয়া প্রচলিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। তাঁহার এই অনুপস্থিতিজন্য বিপক্ষদল প্রবল হইয়াছিল।
বৰ্দ্ধমান-জেলার অন্তঃপাতী চকদিঘী-গ্রামনিবাসী ধনশালী সন্ত্রান্ত জমিদার বাবু সারদাপ্রসাদ রায়সিংহ মহোদয়ের সহিত অগ্রজ মহাশয়ের বিশেষ আত্মীয়তা ছিল; তজ্জন্য তিনি সারদাবাবুর অনুরোধে মধ্যে মধ্যে চকৃদিঘী যাইতেন এবং সারদাবাবুও মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আসিয়া, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। সারদাবাবুর পুত্রকন্যা হয় নাই। এক সময়ে তিনি কথাপ্রসঙ্গে কলিকাতায় অগ্রজকে বলেন, “আমার বংশ-রক্ষা হইল না। বংশরক্ষার জন্য পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিব; এবিষয়ে আপনার মত কি?” ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় “প্রত্যুত্তর করেন যে, “পরের ছেলেকে টাকা দিয়া ক্রয় করিয়া গ্রহণ করা আমার মতে ভাল নয়; কারণ, সেই বালক বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া সৎ কি অসৎ হইবে, তাহা বলা দুষ্কর। যদি দুশ্চরিত্র হয়, তাহা হইলে অল্পদিনের মধ্যেই তোমার চিরসঞ্চিত ধনসম্পত্তি নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে। যদি এরূপ হয়, তাহা হইলে কিরূপে তোমার কীর্ত্তি থাকিবে? এমন স্থলে, যদি আমার পরামর্শ শুন, তাহা হইলে চকদিঘীতে একটি অবৈতনিক উচ্চশ্রেণীর ইংরাজীসংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপন কর যে, চকদিঘীর চতুঃপার্শ্বের সন্নিহিত গ্রামস্থ বালকগণ লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া জ্ঞান-লাভ করিবে ও উপাৰ্জ্জনক্ষম হইবে। তাহা হইলেই তোমার নাম ও কীর্ত্তি চিরস্থায়ী হইবে। ঐ বিদ্যালয়ের নাম সারদাপ্রসাদ ইনষ্টিটিউসন রাখা। আর দাতব্য-চিকিৎসালয় স্থাপন কর; তাহা হইলে দেশস্থ নিরুপায় পীড়িত ব্যক্তিরা বিনা মূল্যে ঔষধ ও পথ্য পাইয়া, আরোগ্য লাভ করিতে পরিবে। উক্ত দেশহিতকর মহৎ কার্য্যদ্বয় স্থাপন করিয়া যাইতে পারিলে, তোমার অনন্তকাল পর্য্যন্ত যশঃসুধাকর দেদীপ্যমান থাকিবে।” এতদ্ব্যতীত অপরাপর নানাপ্রকার হিতকর কার্য্য করিবারও উপদেশ দিয়াছিলেন। পূর্ব্বে চক্দিঘীতে গবর্ণমেণ্টের একটী এডেড্ স্কুল ছিল। তাহাতে বিশেষ ফলোদয় হইত না। তৎপরিবর্ত্তে সারদাবাবু, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শে ও অনুরোধে খৃঃ ১৮৬৮ সালে ১লা আগষ্ট চকদিঘীতে অবৈতনিক এণ্ট্রেন্স বিদ্যালয় স্থাপন করেন, এবং তৎকালের লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরকে অনুরোধ করিয়া, মেডিকেল বোর্ড হইতে উৎকৃষ্ট ডাক্তার নির্ব্বাচন করিয়া, ১২৬৬ সালে চকদিঘীতে ডাক্তারখানা স্থাপন করিয়াছিলেন। চকদিঘীতে এণ্ট্রেন্স স্কুল স্থাপন-সময় হইতে দাদা ঐ বিদ্যালয়ের কমিটির মেম্বর ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি উহার তত্ত্বাবধান করিতেন। তিনি যেরূপ শিক্ষাপ্রণালীর বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন, ঐ প্রণালী আদ্যাপি সেইরূপ প্রচলিত আছে। স্থানীয় লোক, দাদার ও সারদাবাবুর নাম যে কখন বিস্মৃত হইবেন, এমত বোধ হয় না।
বিদ্যাসাগর মহাশয়, উক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শনজন্য মধ্যে মধ্যে চকদিঘী যাইতেন। ঐ সময়ে চকদিঘীর সন্নিহিত এক গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারকে কয়েক বৎসর মাসিক দশ টাকা, মাসহারা দিয়াছিলেন। একদিন তাহাদের অবস্থা অবলোকন করিবার জন্য তাহাদের বাটী গিয়াছিলেন। তাহাদের একটি শিশুকে অতি শীর্ণকায় দেখিয়া বলিলেন, “ছেলেটি এত রোগা কেন?” তাহাতে গৃহস্বামী বলেন, “মহাশয়, যে দশ টাকা প্রদান করিয়া থাকেন, তাহাতে আতি কষ্টে আমাদের দিনপাত হয়; ছেলের জন্য দুগ্ধ ক্রয় করা ঐ টাকায় কুলায় না। দুগ্ধ খাইতে না থাইয়া, ছেলেটি দিন দিন শীর্ণ হইতেছে।” ইহা শুনিয়া আরও মাসিক পাঁচ টাকা ঐ ছেলের দুধের জন্য স্বতন্ত্র দিতেন। এক্ষণে ঐ পরিবারের অবস্থা ভাল হইয়াছে। এ বিষয়টী দাদার আত্মীয়, বাবু ছক্কনলাল সিংহ মহাশয়ের পুত্র, বাবু মণিলাল রায় ও বাবু বিনোদবিহারী সিংহ মহাশয়ের নিকট অবগত হইয়াছি। দাদা, দান করিয়া কাহাকেও তাহা ব্যক্তি করিতেন না।
মাইকেল মধুসুদন দত্ত বাঙ্গালাভাষায় মেঘনাদবধ প্রভৃতি কয়েকখানি পুস্তক রচনা করিয়া, সাধারণের নিকট কবি বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। তিনি কলিকাতা পুলিসের ইণ্টারপিটারের পদ পরিত্যাগ করিয়া, বারিষ্টার হইবার মানসে বিলাত যাত্রা করেন। যাইবার প্রাক্কালে তাঁহার কোন সম্ভ্রান্ত আত্মীয়ের হস্তে যাবতীয় সম্পত্তি গচ্ছিত রাখিয়া প্রস্থান করেন। কিয়দ্দিবস পরে বিলাতে তাঁহার টাকার আবশ্যক হইলে, তাঁহার সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ককে পত্র লিখেন। দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত তাঁহারা প্রত্যুত্তরে কোন পত্র লিখেন নাই। টাকার জন্য তথায় তাঁহার কারাবাস হইবার সম্ভাবনা দেখিয়া, অগত্যা দয়াময় অগ্রজকে বিনীতভাবে পত্র লিখেন। তিনি তাঁহার ঐরূপ পত্র পাইয়া, ৬০০০৲ ছয় সহস্র টাকা ঋণ করিয়া বিলাত পাঠান। মাইকেল মধুসুদন দত্ত, দাদার প্রেরিত আশাতীত প্রচুর টাকা পাইয়া, অপরিসীম হর্ষপ্রাপ্ত হইলেন এবং ঋণপরিশোধপূর্ব্বক বারিষ্টার হইয়া, সপরিবারে স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কলিকাতায় উপস্থিত হইয়া, বারিষ্টারের কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে ব্যয়নির্ব্বাহার্থ ক্রমশঃ কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় আরও দুই সহস্র টাকা অগ্রজের নিকট গ্রহণ করেন। দুঃখের বিষয় এই যে, স্বল্পদিনের মধ্যেই মাইকেল মৃত্যুমুখে নিপতিত হন। অগ্রজ মহাশয়, কোন আত্মীয়ের নিকট উপরি উক্ত আট হাজার টাকা যাহা ঋণ করিয়া দিয়াছিলেন, সুদসহ উক্ত আত্মীয়াকে সমস্ত টাকা তাঁহাকেই পরিশোধ করিতে হইল। তজ্জন্যই বাবু কালীচরণ ঘোষ ও বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংস্কৃত-যন্ত্র বিক্রয় করেন। পরের হিতকামনায় অগ্রজ ব্যতীত কেহ কি এরূপ ঋণ করিয়া, নিজের জীবিকানির্ব্বাহের সম্পত্তি বিক্রয় করিতে পারেন?
ঐ সময় গঙ্গাদাসপুরনিবাসী তারাচাঁদ সরকার, রাধানগরীনিবাসী বাবু রামকমল মিশ্র ও গঙ্গাদাসপুরনিবাসী বাবু গোরাচাঁদ দত্তের নামে কলিকাতাস্থ আদালতে অভিযোগ করিয়া, ৫০০৲ টাকা আদায় করেন। যে সময়ে উহাদিগকে ওয়ারেণ্ট দ্বারা গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যায়, সেই সময়ে উহারা নিরুপায় হইয়া, পিয়াদাসহ পটলডাঙ্গাস্থ বাবু শ্যামাচরণ বিশ্বাসের ভবনে অগ্রজের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহাকে ঐ দায় হইতে মুক্ত করিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করেন। নিজের টাকা না থাকা প্রযুক্ত অগ্রজ মহাশয়, তৎক্ষণাৎ তথায় উপবিষ্ট বাবু রাখালমিত্রের নিকট খত লেখাইয়া ও স্বয়ং সাক্ষী হইয়া ৫০০৲ টাকা উক্ত ব্যক্তিদ্বয়কে দেওয়াইয়া, তাহাদিগকে ঋণদায় হইতে মুক্ত করেন। পরে ইহারা ঐ টাকা পরিশোধ না করাতে, রাখালবাবুর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে অগ্রজ, সুদসহ ৮০০৲ টাকা তাঁহার পত্নীকে পরিশোধ দিয়া, ঐ খাত খালাস করেন। দাদা, খতে কেবল সাক্ষীমাত্র ছিলেন; উত্তমর্ণ দাদার খাতিরে টাকা দিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহার নিকট চাহিয়াছিলেন। উক্ত অধমর্ণদ্ধয় আর কখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই। শুনিয়াছি, তাঁহাদের উভয়েরই মৃত্যু হইয়াছে এবং উভয়েরই বিলক্ষণ ভূমিসম্পত্তি আছে।
এক সময়ে পণ্ডিত জগন্মোহন তর্কালঙ্কার বিপদে পড়িয়া, বিষণ্ণ-বদনে দাদার নিকট আসিয়া বলেন, “মহাশয়, অত্যন্ত বিপদে পড়িয়াছি, পরিত্রাণের উপায়ান্তর নাই, যদি অনুগ্রহ করিয়া ৫০০৲ টাকা ধার দেন, তাহা হইলে এ যাত্রা পরিত্রাণ পাই, নচেৎ আমায় আত্মহত্যা করিতে হয়।” তাহা শুনিয়া, অগ্রজ অতিশয় দুঃখিত হইলেন। নিজের টাকা না থাকা প্রযুক্ত অপরের নিকট ঋণ করিয়া ৫০০৲ টাকা দিলেন। তাহার পর এই দীর্ঘকালের মধ্যে জগন্মোহন তাঁহার সহিত আর কখন সাক্ষাৎ করিলেন না।
জাহানাবাদের সন্নিহিত কোন গ্রামে এক ভট্টাচার্য্য মহাশয়, অগ্রজের নিকট উপস্থিত হইয়া বিষণ্ণ-বদনে রোদন করিতে করিতে বলেন, “বাবা ঈশ্বর! বড়বাজারের রামতারক হালদারের নিকট ২০০৲ টাকা ঋণ করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়াছি; তাহারা টাকা না পাইয়া, আমার নামে অভিযোগ করিয়া জয়লাভ করিয়াছেন এবং ত্বরায় আমাকে নাতক করিয়া, অপমানিত করিবার উদেযাগে আছেন; কিসে পরিত্রাণ পাই? তাঁহার কাতরতাদর্শনে আমার হস্তে দাবীকৃত সমস্ত টাকা দিয়া, তাঁহাকে আমার সঙ্গে বড়বাজারের মহাজনের দোকানে প্রেরণ করেন। উত্তমর্ণ, আমার নিকট দাবীকৃত উক্ত টাকা লইয়া, তাঁহাকে অব্যাহতি দেন।
অগ্রজ মহাশয় কেবল দরিদ্রগণকে সাহায্য করিতেন, এমন নহে; বন্ধুবান্ধবেরা বিপদে পড়িলেও তিনি অকাতরে অর্থসাহায্য করিতেন। ঐ সকল টাকা পরে ফেরৎ পাইব, কখন এরূপ আশা করিতেন না ও চাহিতেন না। তিনি এই মনে করিতেন যে, আমি বন্ধুদিগের বিপদে সাহায্য করিতেছি, পরে তাঁহাদের সময় ভাল হইলে, ইচ্ছা হয় তাঁহারা স্বয়ং প্রত্যাৰ্পণ করিবেন। দুঃখের বিষয় এই যে, দুই একজন ভিন্ন কেহই তাহা ফেরৎ দেন নাই। কিন্তু দাদাও তাঁহাদিগকে কখনও টাকার কথা বলেন নাই।
সন ১২৭০ সালের ১০ই ফান্তন কলিকাতায় একটি বিধবা ব্রাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ-বিধি সমাধা হয়। ইহাঁদের নিবাস ঢাকা জেলা।
সন ১২৭১ সালের ১২ই মাঘ কলিকাতায় একটি বৈদ্যজাতীয় বিধবার বিবাহ-কার্য্য সমাধা হয়। বর জগচ্চন্দ্র দাসগুপ্ত, নিবাস পরগণা বিক্রমপুর মধ্যপাড়া, জেলা ঢাকা। এইরূপ সন ১২৭১ ও ৭২ সালে আরও ২০।২৫টী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, তন্তুবায়, বৈদ্য ও তৈলিক প্রভৃতি জাতীয় বিধবার পাণিগ্রহণবিধি সমাধা হয়।
ভাটপাড়ানিবাসী, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন, নৈয়ায়িক শ্রীযুক্ত রাখালদাস ন্যায়রত্ন মহাশয়, পাঠসমাপনান্তে মনে মনে স্থির করেন, ভাটপাড়ায় টোল করিয়া দুই তিনটী ছাত্র বাটীতে রাখিয়া, ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনার কার্য্য করিবেন; কিন্তু তাঁহার পিতা বলেন, “ছাত্রকে অন্ন দিতে পারিব না; থাইতে দিতে হইলে, মাসে ৬।৭ টাকার কমে চলিবে না।” তাহা শুনিয়া, ন্যায়রত্নের অত্যন্ত দুর্ভাবনা হইল। কারণ, বহুকাল অনবরত পরিশ্রম করিয়া যে দৰ্শন-শাস্ত্র শিক্ষা করিলেন, তাহা ছাত্র রাখিয়া শিক্ষা না দিলে, সকলই বিফল হয়। তিনি মাসিক ছয় টাকা আয়ের জন্য অনেক স্থানে অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই পূর্ণ-মনোরথ হন নাই। তৎকালের বেথুন বালিকাবিদ্যালয়ের পণ্ডিত মাখনলাল ভট্টাচার্য্য তাঁহার শিষ্য ছিলেন। এক দিবস। তাঁহার বাসায় উপস্থিত হইয়া, মনঃকষ্টের কথা ঘ্যক্ত করিলে পর তিনি বলিলেন, “পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এরূপ বিষয়ে অনেককে গোপনে মাসহরা দিয়া থাকেন। যদি ইচ্ছা হয় ত চলুন, আমি সঙ্গে করি আপনাকে লইয়া যাই।” ইহা শুনিয়া ন্যায়রত্ন মহাশয় বলিলেন, “তিনি পণ্ডিত ও মহাশয় ব্যক্তি, তাঁহার নিকট দান লইবার বাধা নাই।” মাখনলাল ভট্টাচার্য্য, ন্যায়রত্ন মহাশয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, সুকিয়া-স্ত্রীটে রাজকৃষ্ণ বাবুর বাটীতে দাদার সহিত সাক্ষাৎ করেন। ইতিপূর্বে দাদা ঐ পণ্ডিতের দর্শনশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের বিষয় অবগত ছিলেন; তজ্জন্য তাঁহাকে বিলক্ষণ সমাদর করিলেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় বলিলেন যে, “আমি সমগ্র ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি। এক্ষণে বাটীতে টোল করিয়া বিদ্যাদান করিতে মানস করিয়াছি; কিন্তু টোল করিতে হইলে মাসিক ১০৲ টাকা ব্যয় হইবে, মাসিক এই টাকার সংস্থান না করিতে পারিলে, বাটীতে বসিয়া আপনার কার্য্য করিতে পারি না। আপনার অবিদিত নাই যে, ন্যায়শাস্ত্র যাহারা অধ্যয়ন করিবে, তাহাদিগকে অল্প দিতে না পারিলে, তাহারা নিশ্চিন্ত হইয়া দীর্ঘকাল কেমন করিয়া শিক্ষা করিবে।” ন্যায়রত্নের কথা শুনিয়া, অগ্রজ বলিলেন, “যে পর্য্যন্ত আপনার পশার না হইবে, সেই পর্য্যন্ত আমি মাসিক দশ টাকা দিতে পারিব, আপনি নিশ্চিন্ত হইয়া ছাত্র রাখিয়া দৰ্শন-শাস্ত্রের ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হউন।” দাদা, ক্রমিক আট বৎসরকাল মাসে মাসে দশ টাকা করিয়া ন্যায়রত্বের বাটীতে পাঠাইয়া দিতেন। এতদ্ব্যতীত মধ্যে মধ্যে উহাঁর পরিবারগণকে বস্ত্রাদিও প্রদান করিতেন। ঐ টাকা ব্যতীত মধ্যে মধ্যে আরও বিশ পঞ্চাশ টাকা সাহায্য করিতেন। পরে পাশার হইলে পর, এক দিবস ন্যায়রত্ন মহাশয়, স্বয়ং দাদাকে বলিলেন, “আর আপনি সাহায্য না করিলেও আমার দিনপাত হইতে পারে।” ন্যায়রত্ন মহাশয়, প্রথমেই আপনার অবস্থা অনেককে জানাইয়াছিলেন, কিন্তু কেহই এরূপ সাহায্য করিতে সাহস করেন নাই। তিনি এ বিষয় অনেকের নিকট স্বীকার করিয়া, আপন কৃতজ্ঞতা দেখাইতেন এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতেন; অগ্রজও ন্যায়রত্নকে আন্তরিক স্নেহ করিতেন। ন্যায়রত্ন মহাশয়, কৃতজ্ঞতা-সহকারে সভাস্থলে নিজে যেরূপ প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহাই এস্থলে লিখিত হইল।
সন। ১২৭২ সালের অগ্রহায়ণ মাসে পিতৃদেব স্বপ্ন দেখেন যে, ত্বরায় তোমার বাসভূমি শ্মশান হইবে। স্বপ্ন দেখিয়া পিতৃদেব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন। তদনন্তর বিখ্যাত গঙ্গানারায়ণ ভট্টাচার্য্যকে ডাকাইয়া, তাঁহার কোষ্ঠীর ফল গণনা করাইলেন। তিনিও ঐ কথা ব্যক্ত করিলেন; অধিকন্তু বলিলেন যে “ত্বরায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শনির দশা উপস্থিত হইবে। গণনানুসারে দেখিতেছি, তাঁহার আত্মবিচ্ছেদ, বন্ধুবিচ্ছেদ ও ভ্রাতৃবিচ্ছেদ ঘটিবে ও তাঁহাকে দেশত্যাগী হইতে হইবে। এক দিনের জন্যও সুখী হইবেন না ও একস্থানে স্থায়ী হইবেন না। নূতন নূতন স্থানে যাইয়া বাস করিবার ইচ্ছা হইবে। ইহা আপনি অন্যের নিকট ব্যক্ত করিবেন না। বিশেষতঃ, বিদ্যাসাগর বাবাজীর নিকট ব্যক্ত করিলে, তিনি আমায় তিরস্কার করিতে পারেন।” স্বপ্নদর্শন ও কোষ্ঠীর গণনা ঐক্য হইল দেখিয়া, পিতৃদেবের অত্যন্ত দুর্ভাবনা হইল। তদবধি তাঁহারা আর দেশে থাকিতে ইচ্ছা রহিল না। কয়েক দিন পরে কাশীবাস করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন; সুতরাং আমি অগ্রজ মহাশয়কে ঐ সংবাদ লিখিলাম। তিনি তৎকালে রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের পীড়া উপলক্ষে মুরশিদাবাদের সন্নিহিত কান্দীগ্রামে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পত্রপ্রাপ্তিমাত্রেই অগ্রজ মহাশয়, তদুত্তরে আমায় যাহা লিখেন, তাহা নিয়ে প্রকাশিত হইল।
“তিনি বিদেশে একাকী অবস্থিতি করিবেন, তাহা কোন ক্রমেই পরামর্শসিদ্ধ নহে; সমুদায় আহরণ করিয়া আপনার আহারাদি নির্ব্বাহ করিবেন, তাহাতে কষ্টের একশেষ হইবে। যে ব্যক্তির পুত্র-পৌত্রাদি এত পরিবার, তিনি শেষ-বয়সে একাকী বিদেশে কালাহরণ করিবেন, ইহা অপেক্ষা দুঃখ ও আক্ষেপের বিষয় কি হইতে পারে? সুতরাং এ অবস্থায় তিনি একাকী কাশীতে বাস করিবেন, ইহা আমি কোনও মতে সহ্য করিতে পারিব না। সেরূপ করিলে তাঁহার কষ্টের সীমা থাকিবে না। যদি তাঁহার সেবা ও পরিচর্য্যার নিমিত্ত কেহ কেহ সঙ্গে যাইতে পারেন, তাহা হইলেও আমি কথঞ্চিৎ সম্মত হইতে পারি; নতুবা তাঁহাকে একাকী পাঠাইয়া দিয়া, আমরা এখানে নিশ্চিন্ত হইয়া, সুখে কালযাপন করিব, ইহা কোনও ক্রমেই ধর্ম্ম-সঙ্গত নহে। অন্যের কথা বলিতে পারি না, আমি কোনও মতেই আমার মনকে দায়বোধ দিতে পারিব না; যদি নিতান্তই তাঁহার যাইবার মানস হইয়া থাকে, তবে এইরূপ তাড়াতাড়ি করিলে চলিবে না। তুমি তাঁহার চরণারবিন্দে আমার প্রণিপাত জানাইয়া কহিবে যে, পাছে আমার মনে দুঃখ হয়, এই খাতিরে তিনি অনেকবার অনেক কষ্ট সহ্য করিয়াছেন, এক্ষণেও সেই খাতিরে আর কিছু কষ্ট সহ্য করুন; আমি সত্বর বাটী যাইবার চেষ্টায় রহিলাম। সেখানে পঁহুছিলে পরামর্শ করিয়া কর্ত্তব্য স্থির করিব; নতুবা অকস্মাৎ এরূপে সংসার ত্যাগ করিয়া যাইলে এবং উপযুক্ত বন্দোবস্ত না করিলে, আমি মর্ম্মান্তিক বেদন পাইব। যাহা হউক, যেরূপে পার আপাততঃ তাঁহার এ অভিপ্রায় রহিত করিবে এবং তিনি আপাততঃ ক্ষান্ত হইলে, এই সংবাদ সত্বর কান্দীতে আমার নিকট পাঠাইবে। যাবৎ এ সংবাদ না পাইব, তাবৎ আমার দুর্ভাবনা দূর হইবে না। দুই চারি দিন কোন মতে এখান হইতে যাইতে পারিব না; নতুবা অদ্যই আমি প্রস্থান করিতাম। যাহা হউক, যেরূপে পার তাঁহাকে আপাততঃ কোনমতে ক্ষান্ত করিবে; নিতান্ত ক্ষান্ত না হন, এই রবিবারে বাটী হইতে আসিতে না দিয়া, আমাকে সংবাদ লিখিলে, আমি যেরূপে পারি বাটী যাইব। আমি কায়িক ভাল আছি, ইতি তারিখ ৩০ শে অগ্রহায়ণ।
পিতৃদেব মহাশয়কে উক্ত পত্র দেখান ও শ্রবণ করান হইল, তথাপি তিনি কাশী যাইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন; সুতরাং পুনর্ব্বার কান্দীতে পত্র লেখা হইল। পত্র-প্রাপ্তি-মাত্রেই আহার-নিদ্রা-পরিত্যাগপূর্ব্বক বৰ্দ্ধমান আগমন করিলেন, এবং তথা হইতে রাত্রিতেই পাল্কী করিয়া জাহানাবাদে আসিলেন। তথা হইতে বেহারারা আরও আট ক্রোশ আসিতে অসমর্থ হইলে, পদব্রজেই বীরসিংহার বাটীতে আগমন করিলেন। তিনি অনেক অনুনয় বিনয় এবং রোদন করাতেও পিতৃদেব বাটীতে অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করিলেন না। কয়েক দিবস পরে পিতৃদেব, তাঁহার সমভিব্যাহারে কলিকাতায় গমন করিলেন। তথায় কতিপয় দিবস থাকিলেন এবং শেষে অগ্রজের অনেক অনুনয় বিনয়ে দেশে আগমন করিবেন স্থির করিলেন। ইতিমধ্যে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঈশানের সহিত কথাপ্রসঙ্গে পিতৃদেব তাহাকে বলেন যে, “ঈশ্বর আমায় দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছে, তোমার মত কি?” ঈশান বসিল, “আমার মতে দেশে গিয়া সংসারী-ভাবে থাকা আর আপনার উচিত নয়, এই সময় আপনার কাশীধামে গিয়া বাস করাই উচিত।” কনিষ্ঠ সহোদর ঈশান, পিতৃদেবকে এরূপ অসদৃশ নানাবিধ উপদেশ দেওয়াতে, তিনি একেবারে দেশে যাইবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করিলেন। ঈশান এই কথা বলিয়াছে শুনিয়া, অগ্রজ মহাশয়, ঈশানের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন এবং পিতৃদেবকে বলিলেন, “আপনি গৃহস্থের মধ্যে থাকিয়া সময়াতিপাত করিতেন। এক্ষণে আপনাকে কদাচ একাকী কাশী যাইতে দিব না। বাটীর কেহ আপনার সমভিব্যাহারে না থাকিলে, নিজে বৃদ্ধ-বয়সে পাকাদি-কার্য্য সম্পন্ন করিয়া দিনপাত করা, আপনার পক্ষে অতি কষ্টকর হইবে।” পিতৃদেব কোনও উপদেশ না শুনিয়া, কাশীতে অবস্থিতি করাই স্থির করিলেন; সুতরাং কাশীধামে সুখস্বচ্ছন্দে অবস্থিতি করিবার বন্দোবস্ত হইল।
যাইবার পূর্বে দাদা বলিলেন, “আপনি গেলে আমাদের মন অত্যন্ত ব্যাকুল হইবে। আমাদের অন্য কোনও চিত্ত-বিনোদনের উপায় নাই; অতএব আপনি সন্মতি প্রদান করিলে, চিত্রকর হাড়সন প্রাটের বাটী গিয়া, তাঁহার দ্বারা পটে আপনার প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত করাইয়া লইব। অতএব আপনাকে আর পনর দিবস কলিকাতায় অবস্থিতি করিতে হইবে।” পিতৃদেব সম্মত হইলে, তাঁহার প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত করাইলেন। ইহাতে তিন শত টাকা ব্যয় হয়। কিছুদিন পরে ঐ রূপ জননীদেবীরও প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত করাইলেন; ইহাতেও তিন শত টাকা ব্যয় হয়। দাদা প্রত্যহ অন্ততঃ দুইবার ঐ মূর্ত্তি দর্শন করিতেন। কর্ম্মাটার ও ফরাশডাঙ্গার বাসাতেও স্বতন্ত্র প্রতিমূর্ত্তি প্রস্তুত করাইয়া রাখিয়াছিলেন।
খৃঃ ১৮৫৯ সালের ১লা এপ্রেল, দেশহিতৈষী পরম-দয়ালু রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুর, অগ্রজ মহাশয়ের পরামর্শে ও উদ্যোগে তাঁহাদের জন্মভূমি কান্দীগ্রামে ইংরাজী-সংস্কৃত স্কুল স্থাপন করেন। উক্ত রাজাদের জীবিতকাল পর্য্যন্ত অর্থাৎ ১৮৬৬ সাল পর্য্যন্ত ঐ স্কুল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ই শিক্ষকাদি নিযুক্ত করিতেন। রাজাদের টাকায় স্কুলের চেয়ার, ডেক্স, বেঞ্চ, আলমারি প্রভৃতি ক্রয় করিয়া পাঠাইয়াছিলেন ও বহুমূল্যবান্ পুস্তকাদি ক্রয় করিয়া, লাইব্রেরী করিয়া দিয়াছিলেন। ঐ রূপ বিদ্যালয়-গৃহ ও ঐরূপ লাইব্রেরী মফঃস্বলে দৃষ্ট হয় না। পারিতোষিক-প্রদান-কালে অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উপস্থিত থাকিতেন। দাদাকে কোথাও বক্তৃতা করিতে শুনা যায় নাই; কিন্তু ঐ স্থানে অনেকের অনুরোধে মনের ভাব লিখিয়া দিয়াছিলেন, ঐ লেখা অপরে পাঠ করিয়াছিলেন। ঐ বক্তৃতা তৎকালে সংবাদ-পত্রে প্রচারিত হইয়াছিল।
খৃঃ ১৮৬৬ সালে যখন রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ উৎকট রোগে আক্রান্ত হইয়া, কান্দী রাজভবনে কার্ত্তিক মাস হইতে মাঘ মাস পর্য্যন্ত অবস্থিতি করেন, তৎকালে অগ্রজ মহাশয়, রাজার রীতিমত চিকিৎসার জন্য কলিকাতার বিখ্যাত ডাক্তার সি, আই, ই, বাবু মহেন্দ্রনাথ সরকারকে মাসিক সহস্ৰ মুদ্রা বেতনে নিযুক্ত করিয়া ও সমভিব্যাহারে লইয়া কান্দী গমন করেন। অগ্রজ মহাশয়, উক্ত চারি মাসের মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনবশতঃ দুই তিন বার তথা হইতে বাটী আগমন করেন এবং আট দশ দিন বাটীতে অবস্থিতি করিয়া, পুনর্ব্বার তথায় গমন করেন। উক্ত রাজাদিগকে তিনি সহোদর-সদৃশ স্নেহ করিতেন বলিয়া, এতদূর নিঃস্বার্থভাবে তাঁহার জীবন-রক্ষার জন্য আন্তরিক যত্ন করিয়াছিলেন। ধনশালী সম্ভ্রান্ত লোকের মধ্যে রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর যেরূপ বিনয়ী ও ভদ্রলোক ছিলেন, সেরূপ প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না। ইনি সৌজন্যাদি গুণসমূহে সাধারণ মানবগণকে বশীভুত করিয়াছিলেন।
রাজা, কাশীপুরের গঙ্গাতীরে মৃত্যুর পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে স্বীয় সমস্ত সম্পত্তির তত্ত্বাবধানজন্য একমাত্র ট্রষ্টী নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন; কিন্তু অগ্রজ মহাশয় নানা কারণে রাজার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না; তজ্জন্য তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন।
রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের মৃত্যুর পর, বিষয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁহার পিতামহী রাণী কাত্যায়নী অতিশয় ভাবিত হইয়াছিলেন। ইতস্ততঃ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া, কলিকাতাস্থ অনেক ধনশালী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগকে আনাইলেন, কিন্তু ঐ সকল ব্যক্তিদিগের পরস্পর নানা তর্ক-বিতর্কের পর কোন বিষয়ের স্থিরীকরণ না হওয়ায়, রাণী কাত্যায়নী, অগ্রজকে আনাইয়া বলিলেন, “বিদ্যাসাগর বাবা, আমাকে এরূপ গোলযোগে ও বিপদে পতিত হইতে দেখা তোমার উচিত নহে। অতএব আমার এই বিপদের সময় আমাদিগকে কি করিতে হইবে, সেই সমস্ত নিৰ্দ্ধারণ করিয়া, যাবতীয় বিষয়ের কর্ত্তব্য নিৰ্দ্ধারণ করা তোমার অবশ্য-কর্ত্তব্য কর্ম্ম। অতএব তুমি বিলম্ব না করিয়া, অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্ম হইয়া সত্বর কার্য্যে প্রবৃত্ত হও। আমার এই উক্তির অপেক্ষা না করিয়া, এ কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়াই তোমার উচিত ছিল। তোমাকে এরূপ কথা আর না বলিতে হয়, ইহা যেন তোমার মনে থাকে।” ইহা শ্রবণ করিয়া তিনি বলিলেন, “প্রতাপচন্দ্রের মৃত্যুতে আমার মন স্থির না থাকায় এরূপ হইয়াছে, তজ্জন্য কিছু মনে করিবেন না; সত্বর যাহাতে সুবন্দোবস্ত হয়, আদ্যাবধি তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইলাম। যদিও আপনি বরাবর আমার প্রতি স্নেহ, মমতা ও বিশ্বাস করিয়া আসিতেছেন, তথাপি কি জানি সময়দোষে আমার প্রতি দ্বিধা করিয়া, পাছে অপরের কথায় কর্ণপাত করিয়া গোলমাল করেন, এই আশঙ্কায়, আপনাকে অনুরোধ করিতেছি, অন্য কোনও ব্যক্তির কথায় কর্ণপাত করিবেন না ও বিচলিত হইবেন না। কারণ, তাহা হইলে কার্য্যক্ষতি হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা।” তাঁহার এই কথা শ্রবণ করিয়া রাণী বলিলেন, “বিদ্যাসাগর বাবা! আমি অন্যের কথায় তোমার প্রতি অবিশ্বাস করিয়া, আমার নাবালক প্রপৌত্রদিগের কি সর্ব্বনাশ করিব? ইহা তুমি কদাচ মনে করিও না। তোমার যেরূপ ইচ্ছা ও বিবেচনা হয়, আমি তদনুসারে কার্য্য করিব; তদ্বিষয়ে আমি স্থির রহিলাম।”
এই সকল কথাবার্ত্তার পর, অগ্রজ মহাশয়, আইন-পারদর্শী পরমবন্ধু দ্বারকানাথ মিত্র মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া, পাইকপাড়া ষ্টেট্, কোর্ট অব ওয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করা যুক্তিযুক্ত স্থির করিয়া, তৎকালীন লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সার সিসিল বীডন মহোদয়ের সদনে গমন করিলেন। দুই এক বিষয়ের কথোপকথনের পর, পাইকপাড়ার রাজষ্টেটের কথা উত্থাপন করিয়া, ঐ ষ্টেটের বর্তমান শোচনীয় অবস্থা বর্ণনা করিলেন। ইহা শ্রবণ করিয়া লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুর বলিলেন, “তোমার মত বন্ধু থাকিতে তাহাদিগের এরূপ শোচনীয় অবস্থা হওয়া, তোমার পক্ষে দূষণীয়। তুমি কিরূপে এতদিন ঐ সকল বিষয়ে উপেক্ষা করিয়া, তাহাদিগকে ঋণগ্রস্ত হইতে দেখিলে?” তদুত্তরে তিনি বলিলেন, “তাঁহাদের সময়দোষে ও কর্ম্মদোষে বিষয়-কর্ম্ম-সম্বন্ধে সকল সময়ে আমার কথা না শুনিয়া, তাঁহারা ভোগবাসনারই অনুবর্ত্তী হইয়াছিলেন এবং এক্ষণেও যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে আমার মতে এই বিষয় কোর্ট অব ওয়ার্ডে যাওয়া উচিত। তদ্ভিন্ন রক্ষার আর কোনও উপায় দেখি না। এ বিষয় আমার নিজের দ্বারা রক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা অতি অল্প; আপনি নাবালকদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া, আপনারই একমাত্র কর্ত্তব্যকর্ম্ম বিবেচনায়, সমস্ত ক্লেশ স্বীকার করিয়া, এই বিষয়ের ভার গ্রহণ করুন। এ বিষয়ে নাবালকদের প্রপিতামহী রাণী কাত্যায়নীয় সম্মতি করিয়া দিব, তদ্বিষয়ে কোন দ্বিধা করিবেন না; কারণ, রাণী কাত্যায়নী, আমাকে এ বিষয়ের কর্ত্তব্যাবধারণের ভার দিয়াছেন। রাজপুত্রদিগকে সমভিব্যাহারে করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইলে, আপনি তাহাদের সমক্ষে আমাকে এইরূপ তিরস্কার করিবেন। এইরূপে নানাপ্রকার উপায় উদ্ভাবন করিয়া, পাইকপাড়া রাজ-ষ্টেট্, কোর্ট অব ওয়ার্ডে দিবার ব্যবস্থা করুন।” এই কথার পর দাদা, রাণী কাত্যায়নীর সমক্ষে গমন করিয়া বলিলেন, “এক্ষণে আমি রাজপুত্রদিগকে সমভিব্যাহারে করিয়া লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের নিকট যাইব।” এই কথাগুলি বলিবামাত্র অন্য কথার অপেক্ষা না করিয়া রাণী বলিলেন, “তদ্বিষয়ে আমার সন্মতির আবশ্যক নাই। তুমি যাহা ভাল বুঝিবে, তাহাই করিবে।” অগ্রজ মহাশয়, রাজপুত্রদিগকে সমভিব্যাহারে লাইয়া, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুরের সমীপে উপস্থিত হইলেন। লেপ্টনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুর, সমাদরে সকলকে বসাইয়া, কুমার গিরিশচন্দ্র সিংহ বাহাদুরকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “পণ্ডিত বিদ্যাসাগর তোমাদের পিতৃবন্ধু; ইনি থাকিতে তোমাদের বিষয়কর্ম্মের বিশৃঙ্খলা ঘটবার কারণ কি?” এই কথা বলিয়া অগ্রজকে বলিলেন, “পণ্ডিত! আমার বোধ হয়, তুমি নিজ কর্ম্মে ব্যস্ততাপ্রযুক্ত তোমার বন্ধুদিগের প্রতি উপেক্ষা করিয়া, তাহদের বিষয়কর্ম্মের অনুসন্ধান না লওয়ায় এবং তোমার পরমবন্ধু প্রতাপচন্দ্র সিংহকে সদুপদেশ প্রদান ও শাসন না করায়, তাঁহাদিগকে ঋণগ্রস্ত হইতে হইয়াছে এবং তাঁহাদিগের বিষয়কর্ম্মের বিশৃঙ্খলা ঘটিয়াছে। এতদ্ভিন্ন তাঁহাদিগের কর্ম্মচারিগণের কার্য্য ও ব্যবহারে তুমি রীতিমত দৃষ্টি রাখ নাই বলিয়া, ঐ কর্ম্মচারীরা ইহাঁদিগের যথেষ্ট ক্ষতি করিয়াছে। অতঃপর ইহাঁদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি না রাখিলে, তোমাকে ইহাঁদিগের পিতৃবন্ধু বলিতে পারি না।” এইরূপ নানাপ্রকার তিরস্কার করিবার পর, সাহেব স্বীকার করিলেন যে, তিনি পাইকপাড়ার রাজ-ষ্টেট্ তাঁহার সাধ্যানুসারে কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে সমর্পণ করিবার চেষ্টা পাইবেন। এই বলিয়া তাঁহাকে ও রাজপুত্রদিগকে বিদায় দিলেন।
তিনি বিদায় লইয়া রাজকুমারগণের সহিত বাসায় আসিয়া, তাঁহাদিগকে পাইকপাড়ায় পাঠাইয়া দিলেন। রাজকুমারগণ, রাণী কাত্যায়নীকে ছোট লাট ও বিদ্যাসাগরের কথোপকথনগুলি আনুপুর্ব্বিক বর্ণন করিলেন। তচ্ছ্রবণে রাণী সমধিক যত্ন ও আগ্রহাতিশয়-সহকারে দাদাকে পাইকপাড়ার বাটীতে লইয়া গেলেন। রাণী কাত্যায়নী তাঁহাকে বলিলেন, “বিদ্যাসাগর বাবা! তোমা ভিন্ন আর কে আমাদিগের প্রতি এরূপ যত্ন ও স্নেহ করিয়া আমাদিগের বিষয় রক্ষা করিবে? তুমি বই আর আমাদের হিতৈষী কেহই নাই।” পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়, বাবু দ্বারকানাথ মিত্র ও ছোট লাটের পরামর্শে চব্বিশপরগণার কালেক্টার সাহেবের নিকট আবেদন করায়, তিনি তাহাতে নিজের মন্তব্য লিখিয়া, কমিসিনর সাহেবের নিকট প্রেরণ করেন। কমিসনর সাহেব, তাঁহার রিরুদ্ধে অভিপ্রায়সহ বোর্ডে প্রেরণ করায়, তৎকালীন অন্যতর মেম্বার ড্যাম্পিয়ার সাহেব, ঐ আবেদন-পত্র অগ্রাহ করিয়া, কমিসনর সাহেবের হাত দিয়া কালেক্টর সাহেবের নিকট প্রেরণ করেন। ইহা অবগত হইয়া, উহাঁরা তিন জনে যুক্তি করিয়া পুনর্ব্বার দরখাস্ত করায়, ঐরূপ অগ্রাহ হয়। ইহাতে দ্বারকনাথ মিত্র আইনপুস্তক ভালরূপ দেখিয়া ও অগ্রজের সহিত পরামর্শ করিয়া, ১৮৫৮ সালের ৪০ আইনের ১২ ধারা মতে দরখাস্ত লেখাইয়া, নাবালক গিরিশচন্দ্র বাহাদুর দ্বারা চব্বিশ পরগণার জজসাহেবের নিকট দরখাস্ত দাখিল করেন। জজ সাহেব, সাবালক ও নাবালকগণের প্রতি সানুকুল হইয়া, উক্ত আইন অনুসারে দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়া, কালেক্টর সাহেবের নিকট পাঠান। পূর্ব্বের ন্যায় জজ সাহেবের হুকুম অগ্রাহ হয়। ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয়, পুনর্ব্বার দ্বারকানাথ মিত্র মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া, দরখাস্ত দ্বারা জজ সাহেবকে অবগত করিলে, তিনি আদালত অবজ্ঞার কথা উল্লেখ করিয়া, কালেক্টার সাহেবকে লিখেন যে, আমি ডিষ্ট্রক্ট জজ; উক্ত পাইকপাড়া রাজষ্টেট্ কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে যাইবার হুকুম দিয়াছি। এ হুকুম অনুসারে কার্য্য না করিলে, আইন অনুসারে আদালত অবজ্ঞার দণ্ড পাইবে। এই সময় রাজ-ষ্টেটের কার্য্যের সুবন্দোবস্ত না থাকায় ও ষ্টেট ঋণজালে জড়িত থাকায়, কালেক্টারি খাজনা দাখিল হয় নাই এবং ত্বরায় দাখিল হইবার সম্ভাবনা ছিল না; সুতরাং ১৭৯৩ সালের লাটবন্দীর আইন অনুসারে সমস্ত জমিদারী বিক্রয় হইবার সম্ভাবনা দেখিয়া, অগ্রজ মহাশয় ভয় পাইয়া, দারাজিলিংস্থ বীডন সাহেবকে পত্র লেখেন। বীডন সাহেব, অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া জমীদারী রক্ষা করেন। তিনি দারাজিলিং হইতে লিখেন যে, তোমার অনুরোধে এ যাত্রা পাইকপাড়া রাজ-ষ্টেট রক্ষা করিলাম। এরূপ কাহারও হয় না; অতঃপর এরূপ যেন না হয়।
কালেক্টর সাহেব, আদালত-অবজ্ঞার দণ্ডের ভয়ে, ত্বরায় কমিসনর ও বোর্ডকে অবগত করাইয়া ও সন্মতি লইয়া, পাইকপাড়ার রাজ-ষ্টেট্ কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে লইলেন ও সুবন্দোবস্ত করিলেন। কোর্ট অব্ ওয়ার্ডের সুবন্দোবস্ত অনুসারে, পাইকপাড়ার রাজ-ষ্টেট্ স্বল্পদিন-মধ্যে দুশ্ছেদ্য ঋণজাল ছিন্ন করিয়া মুক্তিলাভ করিল।
নাবালক রাজপুত্রদিগকে নিয়মানুসারে ডাক্তার সি, আই, ই, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্রের অধীনে থাকিবার আদেশ হওয়ায়, রাণী কাত্যায়নী রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহার ক্রন্দন দেখিয়া, অগ্রজ মহাশয় পুনরায় বীডন সাহেবকে অনুরোধ করায়, তাঁহার আদেশমতে নাবালকগণ বাটীতে অবস্থিতি করিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। উপরি-উক্ত বৃত্তান্তটী পূর্ব্বে দাদার নিকট শুনিয়াছিলাম, এবং এক্ষণে প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুরের কুটুম্ব বাবু তারিণীচরণ ঘোষ মহাশয় ও মেট্রোপলিটন বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক বাবু গোপীকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতির প্রমুখাৎ অবগত হইয়াছি। এই বিষয়ে পাথেয়াদি নানা কার্য্যে অগ্রজ মহাশয়ের দুই সহস্ৰ মুদ্রার অধিক ব্যয় হয়। তিনি যখন যাহার উপকারার্থে পরিশ্রম করিতেন, তদ্বিষয়ে নানাস্থানে গমনজন্য যাহা ব্যয় হইত, তাহা কাহারও নিকট কখন গ্রহণ করেন নাই। এরূপ কার্য্য না করিলে, পাইকপাড়ার রাজ-ষ্টেটের ও রাজকুমারদিগের যে কি অবস্থা ঘটিত, তাহা পাঠকবর্গ অনুমান করিয়া লইবেন।
খৃঃ ১৮৫৯ সালে তিনি যখন কান্দীতে বিদ্যালয় স্থাপন-মানসে গমন করেন তৎকালে তথায় বাবু লালমোহন ঘোষের পত্নী শ্রীমতী ক্ষেত্রমণি দাসী, অগ্রজের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে সংবাদ পাঠান। তাহাতে তিনি রাজাদিগকে বলেন, “যিনি সাক্ষাৎ করিবেন, ইনি আপনাদের কে হন?” রাজারা বলিলেন, “এ বাটীর ভাগিনেয়-বধু লালমোহন ঘোষের পত্নী শ্রীমতী ক্ষেত্রমণি দাসী; ইনি কলিকাতানিবাসী মৃত জগদ্দুর্লভ সিংহের কন্যা। আপনি উহাকে বালাকালে কলিকাতায় দেখিয়াছিলেন। ইনি মধ্যে মধ্যে আপনার নাম করিয়া থাকেন।” তাহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “আমি উহার সহিত দেখা করিব কি না? তোমাদের মত কি?” রাজারা বলিলেন, “আপনি উহাঁর সহিত অবশ্য দেখা করিতে পারেন।” অনন্তর সাক্ষাৎ হইলে পর, ক্ষেত্রমণি বলিলেন, “খুড়া মহাশয়! বাল্যকালে আমার পিত্রালয়ে আপনাদের বাসা ছিল। আপনি আমাকে কোলে করিয়া, মানুষ করিয়াছেন, এবং কতই স্নেহ ও যত্ন করিতেন। বোধ করি, তাহা আপনি বিস্মৃত হইয়া থাকিবেন। এক্ষণে আমি কষ্টে পড়িয়াছি, আমার স্বামীর যাহা আয় আছে, তৎসমস্তই তিনি ব্রাহ্মণভোজনাদি সৎকার্য্যে ব্যয় করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমাদের অনেক ঋণ হইয়াছে, তজ্জন্য বিশেষ ভাবিত হইয়াছি; এ কথা অন্যের নিকট প্রকাশ করি নাই। আপনি পিতৃব্য-তুল্য, আপনি আমার ভ্রাতা, ভুবনমোহন সিংহকে মাসে মাসে ৩০৲ টাকা মাসহরা দিতেছেন, তাহাতে তাঁহার সাংসারিক কষ্ট নিবারণ করিয়াছেন।” এই সকল কথা শুনিয়া অগ্রজের চক্ষের জলে বক্ষঃস্থল ভাসিয়া গেল, এবং তিনি বলিলেন, “আমরা তোমার পিতামহ ও তোমার পিতার কতই খাইয়াছি। বাল্যকালে তোমার জননী ও পিতৃঘসা রাইদিদি, আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিয়াছেন। তাঁহাদের যত্নেই বাল্যকালে কলিকাতায় অবস্থিতি করিতে পারিয়াছিলাম। তদবধি তিনি ক্ষেত্রমণিকে মাসিক ১০৲ টাকা দিতেন, এবং ঋণ পরিশোধের জন্যও তৎকালে কিছু কিছু পাঠাইয়াছিলেন।
পূর্ব্বে পাইকপাড়ার রাজাদের সহিত যখন তাঁহার প্রথম আলাপ হয়, তৎকালে তিনি মধ্যে মধ্যে পাইকপাড়া যাইতেন। একদিন বৈকালে গাড়ীতে যাইতেছিলেন, রাজবাটীর নিকট একজন মুদি ডাকিতে লাগিল, “ঈশ্বর-খুড়া, এদিকে কোথায় যাইতেছ?” তাহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় গাড়ী থামাইলেন। সেই দরিদ্র মুদি বলিল, “ঈশ্বর-খুড়া ভাল আছ?” তাহাতে অগ্রজ বলিলেন, “হাঁ রামধন-খুড়া।” রামধন, দাদাকে বসিবার জন্য দূর্ব্বাঘাসের উপর একটা চট বিছাইয়া দিলে, তিনি তাহাতে বসিয়া, একটা খেলো হুঁকায় তামাক খাইতেছেন, এমন সময়ে, রাজাদের বাটীর কয়েকটি বাবু গাড়ীতে চড়িয়া হাওয়া খাইতে যাইতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া উহারা আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় সামান্য একজন ইতর মুদির দোকানের সম্মুখভাগে রাস্তার ধারে বসিয়া, উহার সহিত গল্প ও হাস্য করিতেছেন। বাবুরা বেড়াইয়া যখন প্রত্যাগমন করেন, তিনি তখনও ঐ স্থানে বসিয়া আছেন দেখিয়া, বাবুরা মুখ ফিরাইয়া বাটী আইসেন। পরে তিনি ঐ মুদির নিকট বিদায় লইয়া রাজাদের বাটী গমন করেন। রাজবাটীর কয়েকটী বাবু তাঁহাকে বলিলেন, “মহাশয়! সামান্য লোকের দোকানে চটের উপর বসিয়াছিলেন কেন? আপনার অপমান বোধ হয় না?” ইহা শুনিয়া অগ্রজ বলিলেন, “তোমাদের খানকয়েক চেয়ার আছে বলিয়া কি তোমরা বড় লোক? আমি দরিদ্র-লোকের বাটীতে বসিয়া যত সুখী হই, বড়-লোকের বাটীতে বসিয়া তত তৃপ্তিলাভ করিতে পারি না। আমার সহিত তোমাদের বসিতে যদি লজ্জা হয়, তাহা হইলে আমি আর আসিব না।” তাহা শুনিয়া তাঁহারা বলিলেন, “মহাশয়! ক্ষমা করুন।” দাদা বলিলেন, “আমার পক্ষে ধনশালী ও দরিদ্র উভয়ই সমান।”
খৃঃ ১৮৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে পূজ্যপাদ প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ মহাশয় পেনসন লইয়া কাশীযাত্রা করিবার উদ্যোগ পাইলে, অলঙ্কারশাস্ত্রের পদ শূন্য হয়। তর্কবাগীশ মহাশয়ের সহোদর রামময় চট্টোপাধ্যায় মহাশয়, সংস্কৃতকলেজে কাব্য, অলঙ্কার, জ্যোতিষ, স্মৃতি ও দর্শনের কিয়দংশ অধ্যয়ন করিয়া, সংস্কৃত-কলেজের উচ্চশ্রেণীর বৃত্তি প্রাপ্ত হন। রামময় চট্টোপাধ্যায় মহাশয়, তৎকালে কাব্যে ও অলঙ্কারে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন; আর সংস্কৃত গদ্যপদ্য-রচনায় তাঁহার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তর্কবাগীশ মহাশয় ও অন্যান্য লোকে মনে করিয়াছিলেন যে, রামময়ই তাঁহার ভ্রাতার পদ পাইবার উপযুক্ত। কিন্তু এ পক্ষে মহেশ্চন্দ্র ন্যায়রত্ন মহাশয়ও ঐ পদ প্রাপ্ত্যভিলাষে আবেদন করেন। তৎকালে ন্যায়রত্ন, ষড়দর্শনে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। যদিও ইনি সংস্কৃত-কলেজের ছাত্র নহেন, তথাপি কাব্য ও অলঙ্কারে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। একটী পদ শূন্য, কিন্তু উক্ত পণ্ডিত দুইজনেই পদপ্রার্থী। কাউএল সাহেব, কাহাকে ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করেন যে, একটি পদ শূন্য আছে, উক্ত দুই পণ্ডিতের মধ্যে কে ঐ পদের উপযুক্ত লোক, তাহা নির্ব্বচন করিয়া দেন। আমি কাহাকে ঐ পদ দিব, স্থির করিতে পারি নাই। তৎকালে ভাগ্যদেবী মহেশ ন্যায়রত্নের পক্ষে অনুকুল থাকায়, দাদা বলিলেন, “অলঙ্কার-শ্রেণীতে কাব্যপ্রকাশ পড়াইতে হইলে, ন্যায় ভাল জানা আবশ্যক। মহেশ ন্যায়রত্ন সমগ্র ন্যায়শাস্ত্র রীতিমত অধ্যয়ন করিয়া, বিশেষরূপ বুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন। অতএব আমার মতে ন্যায়রত্ন ঐ কার্য্য পাইবার উপযুক্ত পাত্র।” কাউএল সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায়, ন্যায়রত্ন মহাশয়ের নামে রিপোর্ট করিয়া, ঐ পদে ন্যায়রত্ন মহাশয়কে নিযুক্ত করেন। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের উন্নতির মূল বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বৃত্তান্তটি কাশীতে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয় ও প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ মহাশয়ের প্রমুখাৎ শুনিয়াছিলাম।
হোমিওপ্যাথি।
বহুবাজার মলঙ্গানিবাসী দেশহিতৈষী সম্ভ্রান্তবংশোদ্ভব বাবু রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয়ের সহিত, অগ্রজ মহাশয়ের অত্যন্ত প্রণয় ছিল। এক দিবস উভয়ে কথোপকথন করিয়া স্থির করিলেন যে, ডাক্তার বেরিণি সাহেব কলিকাতায় আসিয়া, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা-ব্যবসায়ের চেষ্টা করিয়া, কৃতকার্য হইতে পারিতেছেন না। অতএব এ বিষয়ে উপেক্ষা না করিয়া, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কিরূপ, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। কিয়ৎক্ষণ পরে দাদা বলিলেন, “রাজেন্দ্র! তুমি এক্ষণে বিষয়কর্ম্ম হইতে অবসর পাইয়াছ, অতএব তোমারই এবিষয়ে পরীক্ষা করা উচিত|” এইরূপ কথাবার্ত্তার পর, রাজেন্দ্রবাবু, বেরিণি সাহেবের সহিত কথাবার্ত্তা কহিয়া, তাঁহার উপদেশানুসারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষা করিলেন। প্রথমতঃ রাজেন্দ্রবাবু মালঙ্গার নিজ বাটীতেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন এবং কলিকাতা সহরে ও উপনগরসমূহে চিকিৎসার উদ্যোগ করিয়া, কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। অনেকে বলিতে লাগিল, “যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভাল এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় আপনার পরমবন্ধু, তবে তাঁহাকে অগ্রে কেন না চিকিৎসা করেন?” এইরূপ নানা প্রকার যুক্তিযুক্ত বাদানুবাদের পর, রাজেন্দ্রবাবু, দাদার চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন। কয়েক দিবসের পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিরঃপীড়া প্রভৃতি রোগের উপশম হইল। রাজেন্দ্রবাবু, অগ্রজ মহাশয়ের পরমবন্ধু রাজকৃষ্ণ বাবুকে মলকণ্টক-পীড়ায় কয়েক দিন ঔষধ সেবন করাইয়া ভাল করেন। ইহা দেখিয়া, অনেকেই রাজেন্দ্রবাবুর ঔষধ সেবন করিতে লাগিল। সৌভাগ্যক্রমে রাজেন্দ্রবাবু অনেক উৎকট ও অসাধ্য রোগ আরোগ্য করিতে লাগিলেন। অগ্রজও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা করিয়া, চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন এবং অনেক অনুগত ব্যক্তিদিগকে ঙ্গোমিওপ্যাথি চিকিৎসাব্যবসায়ী করিবার জন্য, রাজেন্দ্রবাবুর নিকট পাঠাইতে লাগিলেন। ঐ সকল ব্যক্তিরা রাজেন্দ্রবাবুর দাতব্য-চিকিৎসালয়ে ভালরূপ শিক্ষা করিয়া, চতুর্দ্দিকে গমন করিয়া, চিকিৎসা-ব্যবসা করিয়া উন্নতি লাভ করিয়াছেন। অগ্রজ মহাশয়, মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে পুস্তক ও ঔষধের বাক্স দিয়া, বীরসিংহায় যাইয়া দেশের লোককে চিকিৎসা করিতে বলেন। তিনি দেশে যাইয়া, অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া, চিকিৎসা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং কতকগুলি লোককে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা দিতে লাগিলেন। অদ্যাপি ইহাঁর অনেক ছাত্র নানা স্থানে অবস্থিতি করিয়া চিকিৎসা করিতেছেন।
বাবু লোকনাথ মৈত্র, পূর্ব্বে সামান্য বেতনে রাইটারি কর্ম্ম করিতেন। তিনিও দুর্ঘটনাপ্রযুক্ত দাদার সাহায্যে রাজেন্দ্রবাবুর নিকট হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা করিলে পর, অগ্রজ মহাশয় পত্র লিখিয়া কাশীতে রাজা দেবনারায়ণ সিংহের নিকট পাঠাইয়া দেন। তথায় লোকনাথবাবু বিলক্ষণ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। একসময়ে কাশীর ম্যাজিষ্ট্রেট আয়রণ-সাইড্ মহোদয়ের পত্নীর অসাধ্য পীড়া হইয়াছিল। নানারূপ চিকিৎসার পর, পরিশেষে লোকনাথবাবুর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন। তজ্জন্য লোকনাথবাবু, ঐ সাহেবের প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন এবং সাহেব চাঁদা সংগ্রহ করিয়া, একটি দাতব্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়া, উক্ত লোকনাথবাবুকে চিকিৎসক নিযুক্ত করেন। পরে কাশীতে লোকনাথবাবুর নিকট অনেকেই চিকিৎসা শিক্ষা করিয়া, নানাস্থানে যাইয়া চিকিৎসা-ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হন।
সুপ্রসিদ্ধ সি, আই, ই, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহাশয়ের প্রথমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আস্থা ছিল না। কিন্তু উক্ত মহেন্দ্রবাবু মধ্যে মধ্যে ভাবিতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ভারতে অদ্বিতীয় ব্যক্তি হইয়াও হোমিওপ্যাথির এত গোঁড়া কেন? এক দিবস অগ্রজের সহিত অনেক বাদানুবাদের পর, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কিরূপ, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য তাঁহার নিকট স্বীকার করেন। এক দিবস মহেন্দ্রবাবু ও দাদা ভবানীপুরে অনারেবল বাবু দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয়কে দেখিতে গিয়াছিলেন। তথা হইতে উভয়ে বাটী আসিবার সময় এক শকটে আইসেন। আমিও উহাঁদের সমভিব্যাহারে ছিলাম। গাড়ীতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা-উপলক্ষে ভয়ানক বাদানুবাদ হইতে লাগিল; দেখিয়া শুনিয়া আমি বলিলাম, “মহাশয়! আমাকে নামাইয়া দেন। আপনাদের বিবাদে আমার কর্ণে তালা লাগিল।” পরিশেষে উহাঁদের স্থির হইল যে, মহেন্দ্রবাবু পরীক্ষা না করিয়া, কথায় বিশ্বাস করিবেন না। অনন্তর মহেন্দ্রবাবু, দিন কয়েক পরীক্ষা করিয়া বুঝিতে পারিলেন যে, বর্ত্তমান যাবতীয় চিকিৎসা-প্রণালীর মধ্যে হোমিওপ্যাথি-চিকিৎসা উৎকৃষ্ট; এই বিবেচনায় মহেন্দ্রবাবু এলোপ্যাথি চিকিৎসা পরিত্যাগ করিয়া, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করিতে আরম্ভ করেন। কলিকাতার মধ্যে মহেন্দ্রবাবুই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সর্বাপেক্ষা প্রতিপত্তি ও সুখ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রতি বৎসর থ্যাকার কোম্পানির দ্বারা অর্ডার দিয়া, বিলাত হইতে অনেক টাকার হোমিওপ্যাথিক পুস্তক আনাইয়া প্রচারজন্য অনেককে বিনামূল্যে বিতরণ করিয়াছেন। খৃঃ ১৮৭৭ সাল হইতে প্রতি বৎসর প্রায় দুই শত টাকার ঔষধ ও পুস্তক লইয়া বিতরণ করিতেন। অনেক আত্মীয় ব্যক্তি, যাহারা য়্যালোপ্যাথির গোঁড়া ছিল এবং যাহাদের হোমিওপ্যাথিতে আস্থা ছিল না, হোমিওপ্যাথির উৎকর্ষ জানাইবার জন্য, তিনি বেঙ্গল হোমিওপ্যাথি ডিস্পেনসারির স্বামী, তাঁহার আত্মীয়, বাবু লালবিহারী মিত্র মহাশয়ের নিকট হইতে উক্ত চিকিৎসা শিক্ষা ও পরীক্ষা করিতে দিতেন। তাঁহার এত সহগুণ ছিল যে, এক দিবস উক্ত লালবিহারীবাবুর ডিস্পেনসারিতে আলমারি খুলিয়া পুস্তক দেখিবার সময়ে, তিনি অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছিলেন এবং উক্ত আলমারি হইতে একটি লৌহের কর্ক প্রেসার তাঁহার পায়ের বুদ্ধ অঙ্গুলির উপর পতিত হয়; তাহাতে এত গুরুতর আঘাত লাগিয়াছিল যে, তাঁহাকে প্রায় মাসাবধি শয্যাগত থাকিতে হয়, কিন্তু আঘাত লাগিবার সময় পাছে লালবিহারীবাবুর মনে দুঃখ হয়, একারণ তিনি মুখের বিকৃত ভাব প্রকাশ করেন নাই। সহজভাবে পুস্তকাদি দেখিয়া, বাটীতে প্রত্যাগমন করেন। মৃত্যুর পূর্ব্বে এই লালবিহারী বাবুকে শেষ পত্র লিখিয়াছিলেন। হোমিওপ্যাথি পুস্তক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লাইব্রেরীতে যেরূপ দৃষ্ট হয়, এরূপ অপরের পুস্তকালয়ে দৃষ্ট হয় না; পূর্ব্বে বেরিণি কোম্পানি ও অন্যান্য স্থান হইতে হোমিওপ্যাথি পুস্তক লইতেন। যে অবধি লালবিহারী বাবুর সহিত পরিচয় হয়, সেই অবধি অপর স্থানে লাইতেন না।
দুর্ভিক্ষ।
সন ১২৭২ সালে এ প্রদেশে অনাবৃষ্টিপ্রযুক্ত কিছুমাত্র ধান্যাদি শস্য উৎপন্ন হয় নাই; সুতরাং সাধারণ লোকের দিনপাত হওয়া দুষ্কর হয়। ঐ সালের পৌষ মাসে কোন কোন কৃষক যৎসামান্য ধান্য পাইয়াছিল, তাহাও প্রায় মহাজনগণ আদায় করেন। কৃষকদের বাটীতে কিছুমাত্র ধান্য ছিল না। দুঃসময় দেখিয়া ভদ্রলোকেরা, ইতর লোককে কোনও কাজকর্ম্ম করান নাই; সুতরাং যাহারা নিত্য মজুরি করিয়া দিনপাত করিত, তাহাদের দিনপাত হওয়া কঠিন হইল। জাহানাবাদ-মহকুমার অন্তঃপাতী ক্ষীরপাই, রাধানগর, চন্দ্রকোণা প্রভৃতি গ্রামে অধিকাংশ তাঁতির বাস। তাঁতিরা বস্ত্র-বয়ন ব্যতীত অন্য কোন কার্য্য করিতে অক্ষম। সুতরাং যে অবধি বিলাতি কলের কাপড় হইয়াছে, তদবধি তন্তুবায়গণের অবস্থা ক্রমশঃ হ্রাস হইয়া আসিতেছিল। যেরূপ কাপড় ইহারা ২॥০ টাকা যোড়া বিক্রয় করিত, সেইরূপ কলের কাপড় ১॥০ বা ১৸০ যোড়া বিক্রয় হইতেছিল; সুতরাং তৎকালে ইহাদের বস্ত্র বিক্রয় হইত না। ঐ সময়ে টাকায় পাঁচ সেরা চাউল বিক্রয় হইত, তাহাও সকল সময়ে দুষ্প্রাপ্য। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই তিন মাস অনেকেই ঘটী, বাটী ও অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া, কথঞ্চিৎ প্রাণধারণ করে; পরে চাউল-ক্রয়ে অপারক হইয়া, কেহ কেহ বুনো-ওল ও কচু খাইয়া দিনপাত করে এবং নানাপ্রকার কষ্টভোগ করিয়া, অনাহারে অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। শত শত ব্যক্তি সমস্ত দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া, পেটের জ্বালায় কলিকাতায় প্রস্থান করে, ও তথায় পথে পথে ভিক্ষা করিয়া উদরপূর্ত্তি করিত। ৭৩ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে এ প্রদেশের অর্থাৎ জাহানাবাদ মহকুমার প্রায় অশীতিসহস্ৰ লোক অন্নাভাবপ্রযুক্ত কলিকাতায় যাইয়া, তথাকার অন্নসত্রে ভোজন করিত। তৎকালে কেহ জাতির বিচার করে নাই। জননী, সন্তানকে পথে ফেলিয়া দিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করেন। অনেক কুলকামিনী, জাত্যভিমানে জলাঞ্জলি দিয়া জাত্যন্তরিত হয়। চতুর্দ্দিকেই হাহাকার শব্দ, কেহ কাহারও প্রতি দয়া করে নাই, সকলেই অন্নচিন্তায় ব্যাকুল হইয়াছিল।
আমাদের বীরসিংহবাসী অধিকাংশ লোক প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত আমাদের দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিত। তাহাদিগকে ভোজন না করাইয়া, আমরা ভোজন করিতে পারিতাম না। কোনও কোনও দিন রাত্রিতেও সন্নিহিত গ্রামের ভদ্রলোকগণ উদরের জ্বালায়, দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইয়া চীৎকার করিত, তাহাদিগকে খাইতে না দিলে, সমস্ত রাত্রি চীৎকার করিত। এইরূপ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় মাসে, কোনদিন সত্তর, কোনদিন আশী জন লোক ক্ষুধায় প্রপীড়িত হইয়া চীৎকার করিত। এই সকল সংবাদ কলিকাতায় অগ্রজ মহাশয়কে লেখা হয়; তিনি উত্তর লিখেন যে, “স্বগ্রাম বীরসিংহ ও উহার সন্নিহিত পাঁচ ছয়টি গ্রামের দরিদ্রগণকে প্রত্যহ ভোজন করাইতে পারিব। অন্যান্য গ্রামের লোককে কেমন করিয়া খাওয়াইতে পারি। যেহেতু আমি ধনশালী লোক নাহি। অপরাপর গ্রামের দরিদ্রদিগকে প্রত্যহ ভোজন করাইতে হইলে, অনেক ব্যয় হইবে। এমনস্থলে জাহানাবাদের ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রকে আমার নাম করিয়া বলিবে যে, তিনি জাহানাবাদ মহকুমার দুর্ভিক্ষের কথা গবর্ণমেণ্টে রিপোর্ট করিলে, আমি এখানে লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সিসিল বীডনকে বলিয়া, সাহায্য করাইতে পারিব।” অগ্রজ মহাশয়ের আদেশ-পত্রানুসারে জাহানাবাদের ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রকে বিশেষ বলায়, তিনি মধ্যমাগ্রজ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন সহ ঘাঁটাল, ক্ষীরপাই, রাধানগর, চন্দ্রকোণা, রামজীবনপুর প্রভৃতি গ্রাম সকল ভ্রমণ ও পর্যবেক্ষণ করিয়া, প্রজাগণের দুরবস্থার বৃত্তান্ত রিপোর্ট করেন। তথায় অগ্রজ, বীডন সাহেব ও অন্যান্য সাহেবকে অনুরোধ করায়, লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বীডন সাহেব, স্থানে স্থানে অন্নসত্র স্থাপনজন্য ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট বাবুকে আদেশ করেন। বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, রামজীবনপুর, শ্যামবাজার, জাহানাবাদ, খানাকুল প্রভৃতি কয়েকটি বিখ্যাত ও বহুজনাকীর্ণ গ্রামে গবর্ণমেণ্টের অন্নসত্র স্থাপন করেন। কার্য্যদক্ষ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র মহাশয়, অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া, এ প্রদেশের সম্ভ্রান্ত লোকের দ্বারে দ্বারে ভ্রমণপূর্ব্বক যথেষ্ট টাকা সংগ্রহ করিয়া, উক্ত অন্নসত্রের সাহায্যার্থ প্রদান করেন, এবং স্থানীয় সম্ভ্রান্ত লোকদিগকে ঐ অন্নসত্রের তত্ত্বাবধায়ক করেন। প্রত্যহ উক্ত অন্নসত্র সকলে, স্থানীয় অভুক্ত দরিদ্রসমূহ ভোজন করিয়া প্রাণধারণ করিতে লাগিল। শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক ও অগ্রহায়ণ পর্য্যন্ত গবর্ণমেণ্টের অন্নসত্রের কার্য্য চলিল। ইহাতে দরিদ্রলোকেরা ভোজন করিয়া প্রাণরক্ষা করিল। যাহারা পেটের জ্বালায় দেশ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় প্রস্থান করিয়াছিল, তাহাদিগকে গবর্ণমেণ্ট পথখরচাদি প্রদানপূর্ব্বক দেশে পাঠাইয়া দেন।
অগ্রজ মহাশয়, নিজ জন্মভূমি বীরসিংহ ও তৎসংলগ্ন পাথরা, কেঁচে, অৰ্জ্জুনআড়ী, বুয়ালিয়া, কৌমারসা, রাধানগর, উদয়গঞ্জ, কুরাণ, মামুদপুর প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রামবাসী নিরুপায় লোকের প্রতি দয়া করিয়া, বীরসিংহায় অন্নসত্র স্থাপন করেন। প্রথমে কাষ্ঠ-সংগ্রহের এই বন্দোবস্ত হয় যে, তিনজন করাতি প্রত্যহ তেঁতুল গাছ ক্রয় করিয়া ছেদন করিবে ও বার জন মজুর কাষ্ঠ চেলাইবে। বার জন ব্রাহ্মণ প্রাতঃকাল হইতে ক্রমিক খেচরান্ন পাক করিবে; কুড়ি জন স্কুলের ছাত্র ও স্থানীয় ভদ্রলোক পরিবেশন করিবে। দুইজন ভদ্রলোক ও দুইজন দ্বারবান্ প্রত্যহ ঘাঁটাল হইতে চাউল, ডাউল, লবণ ক্রয় করিয়া আনয়নজন্য নিযুক্ত হইল। আৰ্দ্ধমণ চাউল-ডাউলের খেচরান্ন পাক হইতে পারে, এরূপ চারিটি বড় পিতলের হাঁড়া রাধানগরের চৌধুরী বাবুদের বাটী হইতে আনীত হয়, এবং কলিকাতা হইতেও বড় বড় কটাহ ও পিতলের হাড়ী আনীত হইয়াছিল। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস পর্য্যন্ত যাহারা নিজবাটীতে ভোজন করিত, অতঃপর তাহাদিগকে বাটীতে ভোজ্যদ্রব্য না দিয়া, অন্নসত্রে ভোজনের আদেশ দেওয়া হইল। প্রথমতঃ গ্রামস্থ লোকদিগের ভোজন করিবার এই ব্যবস্থা হয় যে, যে ভদ্রলোক অন্নসত্রে ভোজন করিতে কুষ্ঠিত হইবেন, তাঁহারা লোকসংখ্যা হিসাবে সিদা পাইবেন। অগ্রজ মহাশয়, স্বয়ং এরূপ সিন্দার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করেন। শ্রাবণমাসে যৎকালে স্বতন্ত্র বাটীতে অন্নসত্র স্থাপিত হয়, ঐ সময়ে গ্রামস্থ লোকই ভোজন করিতে পায়। ভাদ্রমাস হইতে রাধানগর, কেঁচে, অৰ্জ্জুন-আড়ী, কৌমারসা প্রভতি চতুর্দ্দিকের লোক আসিয়া ভোজন করায়, ক্রমশঃ লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। এই সমাচার কলিকাতায় অগ্রজ মহাশয়কে বিস্তারিতরূপে লেখা হয়, তদুত্তরে তিনি লিখেন, “অভুক্ত যুত লোক আসিবে, সকলকেই সমাদরপূর্ব্বক ভোজন করাইবে; কেহ যেন অভুক্ত ফিরিয়া না যায়। ত্বরায় টাকা পাঠাইতেছি এবং আমিও সত্বর বাটী যাইতেছি।” যে কয়েক মাস দেশে অন্নসত্র ছিল, সেই সময়ে তিনি মাসে প্রায় একবার করিয়া বাটী আগমন করিতেন।
অনেক নিরুপায় দরিদ্র লোক, ছোট ছোট বালকবালিকাগণকে ঐ অন্নসত্রে ফেলিয়া, স্থানান্তরে প্রস্থান করে। ঐ বালকবালিকাগণের রক্ষণবেক্ষণজন্য কয়েকজন লোক নিযুক্ত করা হয়। দশ মাসের গর্ভবতী কয়েকটি স্ট্রীলোক প্রত্যহ ভোজন করিত। অনেকের অনুরোধে পড়িয়া, উহাদের সাধ দেওয়া হয়। ঐ সাধ-ভক্ষণ-দিবস অন্নসত্রের সকলকেই দধি, মৎস্য, পায়স, মিষ্টান্ন প্রভৃতি ভোজন করান হয়। প্রসবের পর ঐ নবপ্রসূত সন্তানের দুগ্ধ ও প্রসুতিদের পথ্যের ব্যবস্থা হয়। কিছু দিনের পর, ঐ প্রসুতিদের মধ্যে একটি মৃত্যুমুখে নিপতিত হইলে, উহার ছেলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক নিযুক্ত হয়। ঐ সন্তানের ক্রমিক সতর বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত সমস্ত ব্যয় নির্ব্বহ করা হইয়াছিল। বিদেশীয় কয়েকজন লোক ভোজন করিতে করিতে অন্নসত্রে প্রাণত্যাগ করে, কিন্তু এক পক্তিতে উভয় পার্শ্বের লোক মৃতদেহ প্রত্যক্ষ অবলোকন করিয়াও, কেহ ঘূণা বা অশ্রদ্ধা করিয়া ভোজন করিতে ক্ষান্ত হয় নাই। ত্বরায় ঐ মৃতদেহ অপসারিত করা হইল। অন্নসত্র খুলিবার প্রথমাবস্থায় দেখা গিয়াছে যে, কেহ কেহ স্বীয় প্রাণসম সন্তানগণের হস্ত-ধারণপূর্ব্বক, স্বয়ং সমস্ত খাইয়া ফেলিত; তৎকালে কেহ কাহারও প্রতি স্নেহ-মমতা করিত না, সকলেই সতত স্বীয় স্বীয় উদরের জ্বালায় বিব্রত ছিল। কিছুদিন পরে ঐ ভাব তিরোহিত হইয়াছিল। অন্নসত্রে ভোজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। অগ্রজ মহাশয় তাহা অবলোকন করিয়া, দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, প্রত্যেককে দুই পালা করিয়া তৈল দেওয়া হইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা, পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোককে স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় তফাৎ হইতে তৈল দিত। ইহা দেখিয়া, অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্য জাতীয় স্ত্রীলোকের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। নীচবংশোদ্ভবা স্ত্রীজাতির প্রতি অগ্রজের এরূপ দয়া দেখিয়া, তাহারা পরম আহিলাদিত হইয়াছিল এবং কর্ম্মচারিগণ তাঁহার এরূপ দয়া অবলোকনে, তদবধি উহাদিগকে স্পর্শ করিতে ঘৃণা পরিত্যাগ করিল। পরিবেশনের সময়, দাদা স্বয়ং পরিবেশনকার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন দেখিয়া, উপস্থিত ভদ্র-লোকেরাও পরিবেশন করিতেন।
অন্নসত্রে যাহারা ভোজন করিত, তাহারা অগ্রজের নিকট প্রকাশ করিয়া বলে, “মহাশয়! প্রত্যহ খেচরান্ন খাইতে অরুচি হয়, সপ্তাহের মধ্যে একদিন অন্ন ও মৎস্য হইলে আমাদের পক্ষে ভাল হয়।” একারণ, প্রতি সপ্তাহে এক দিন অন্ন, পোনা মৎস্যের ঝোল ও দধি হইত। ইহাতে ব্যয়বাহুল্য হওয়ায়, দাদা, অকাতরে যথেষ্ট টাকা বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। পূর্ব্বে দেশস্থ লোক মনে করিত যে, বিদ্যাসাগর বিদ্যোৎসাহী; একারণ, দরিদ্র বালকদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়, বালিকাবিদ্যালয় ও রাখাল-স্কুল স্থাপন করিয়াছেন, এবং দরিদ্রবর্গের রোগোপশমের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু তিনি দরিদ্রগণের প্রতি এতদূর দয়ালু ছিলেন, তাহা কেহই জানিত না। এই অবধি সকলে তাঁহাকে বলিত যে, ইনি দয়াময় অথবা দয়ার সাগর। নীচজাতীয় স্ত্রীলোকদের মাথায় স্বয়ং তৈল মাখাইয়া দেন, ইনি তো মানুষ নন,—সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৎকালে এদেশে সকলেই এই কথার আন্দোলন করিতে লাগিল।
গবর্ণমেণ্টের অন্নসত্রে দরিদ্রদিগকে কর্ম্ম করাইয়া খাইতে দিত; এজন্য কতকগুলি লোক কর্ম্ম করিবার ভয়ে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্নসত্রে ভোজন করিতে আসিত; তজ্জন্য ক্রমশঃ লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। এখানে পীড়িতদিগের চিকিৎসা হইত, এবং রোগিগণের পথ্যের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল। গ্রামস্থ সভ্য-লোকের মধ্যে যাহাদের অবস্থা অতি মন্দ, তাহাদিগকে প্রত্যহ প্রাতে বেলা নয় ঘটিকা পর্যন্ত সিদা দেওয়া হইত। এতদ্ব্যতীত প্রায় কুড়িটি পরিবার প্রত্যহ সিদা লইতে লজ্জিত হইতেন; তন্নিমিত্ত তাহাদিগকে গোপনে নগদ টাকা দেওয়া হইত। খাতায় নাম লেখা ব্যতীত আরও পঁচিশ ছাব্বিশটী গৃহস্থ, রাত্রিতে গোপনে চাউল, ডাউল ও লবণ লইয়া যাইত। অগ্রজ মহাশয়, খাতায় ইহাদের নাম লিখিতে নিবারণ করিয়া দেন। যে যে ভদ্র-পরিবারের বস্ত্র ছিল না, তাহারা প্রকাশ্যে বস্ত্র লাইতে লজ্জিত হইবে, একারণ প্রায় দুই সহস্র টাকার বস্ত্র গোপনে বিতরণ করেন। সন্ধ্যার পর অগ্রজ মহাশয়, স্বয়ং বগলে বস্ত্রগ্রহণ-পূর্ব্বক মোটাচাদর গাত্রে দিয়া, বস্ত্র বিতরণ করিবার জন্য অনেক পরিবারের বাটীতে গমন করিতেন এবং বলিতেন, “ইহা কাহারও নিকট ব্যক্ত করিবার আবশ্যক নাই।” তিনি ভদ্রলোককে অতি গোপনে দান করিতেন।
ইতিমধ্যে গড়বেতার অন্নসত্রের কর্ম্মাধ্যক্ষ বাবু হেমচন্দ্র কর ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ সাহায্য-প্রার্থনায় অগ্রজ মহাশয়কে পত্র লেখায়, অগ্রজ মহাশয় আমার দ্বারা দরিদ্রভোজনের জন্য ৫০৲ টাকা আর উহাদের বস্ত্রের জন্য ৫০৲ টাকা একুনে ১০০৲ টাকা প্রেরণ করেন। এতদ্ব্যতীত ঐ সময় কোন কোন ভদ্রলোক, পিতৃহীন অবস্থায় যাচ্ঞা করিতে আইসেন, তাহাদের মধ্যে কাহাকেও ৫০৲ টাকা, কাহাকেও ১০০৲ টাকা, কাহাকেও ২০০৲ টাকা দান করেন। ২৮শে শ্রাবণ পৃথক্ বাটীতে অন্নসত্র স্থাপিত হয়, ১লা পৌষ ভোজনের পর অন্নসত্র বন্ধ করা হইয়াছিল। কিন্তু বিদেশীয় নিরুপায়গণ ৮ই পৌষ পর্যন্ত অন্নসত্রগৃহে উপস্থিত ছিল; একারণ, দুর্ব্বল নিরুপায় প্রায় ৬০ জনকে কয়েক দিন ভোজন করাইতে হইয়াছিল। অন্নসত্র শেষ হইলে, কর্ম্মচারী, পরিচারক, পরিচারিকা ও দ্বারবান প্রভৃতি সকলকে রীতিমত বেতন দেওয়া হইয়াছিল। ভালরূপ পরিশ্রম করায়, তাহাদিগকে পুরস্কারও দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ে যে সকল ব্রাহ্মণের বালক পরিবেষ্ট ছিল, তন্মধ্যে যাহারা নিতান্ত দরিদ্র, তাহাদিগকেও সন্তুষ্ট করিতে ক্ষান্ত হন নাই। যৎকালে অগ্রজ মহাশয় সংস্কৃত-কলেজের প্রিন্সিপাল-পদে নিযুক্ত ছিলেন, তৎকালে নানাকারণে ষোল দিন রাত্রিতে নিদ্রা হয় নাই, সমস্ত রাত্রি ছাদে বেড়াইতেন। তাঁহার পরমবন্ধু বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, অনেক য়্যালোপাথি ঔষধ সেবন করান, তথাপি নিদ্রা হইল না। অবশেষে অগ্রজের পরমবন্ধু, তৎকালের কবিরাজশ্রেষ্ঠ ৺হারাধন বিদ্যারত্ন কবিরাজ মহাশয়, মধ্যম-নারায়ণ তৈল ও ঔষধের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় দুই ঘণ্টা কাল তৈল মর্দ্দন করাইবে, এইরূপ বলিয়া দেন। দুই তিন দিন তৈল মাখাইলে পর, এক দিন তৈল মাখাইয়া গাত্র দলন করিতেছে, অমনি নিদ্রাকর্ষণ হইল; তজ্জন্য তিনি হারাধন কবিরাজ মহাশয়কে আন্তরিক ভক্তি করিতেন। অন্যান্য আত্মীয়লোকের পীড়া হইলে, উক্ত কবিরাজ মহাশয়ের নিকট প্রেরণ করিাতেন। যে সকল লোককে কবিরাজ মহাশয়ের নিকট পাঠাইতেন, তিনিও সেই সকল লোককে বিনা ভিজীটে দেখিতেন এবং বহুমূল্য ঔষধও প্রদান করিতেন। সন ১২৭২ সালে একবার উদরাময়ে ও উদরের বেদনায় কষ্ট পান; একারণ কবিরাজ মহাশয় আদেশ করেন যে, যবের গাছ পোড়াইয়া এক বস্তা ছাই প্রেরণ করিলে, তাহা হইতে লবণ বাহির করিব; সেই লবণে যে ঔষধ প্রস্তুত হইবে, তাহাতে উপকার দর্শিব। একারণ, দেশ হইতে যবের ভস্ম আনাইয়া দেওয়া হয়; তদ্বারা যে ঔষধ প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা সেবনে তৎকালে উদরের পীড়ার অনেক লাঘব হয়।
রাজা দিনকর রাও কলিকাতায় আসিলে, অগ্রজ মহাশয় তাহাকে বেথুন সাহেবের স্থাপিত বালিকাবিদ্যালয় দেখাইতে লইয়া যান। তিনি দেখিয়া তুষ্ট হইয়া, বালিকাগণকে মিষ্টান্ন খাইতে তিনশত টাকা দেন। তৎকালে সার সিসিল বীডন সাহেব মহোদয় বলেন, অত টাকার মিষ্টান্ন খাইলে ইহাদের উদরাময় হইবে। তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয়, ঐ টাকায় সকল বালিকাকে ঢাকাই সাটী ক্রয় করিয়া দেন। দুইখান বস্ত্র অধিক হইল দেখিয়া, তিনি দুই পণ্ডিতকে প্রদান করেন। ঐ সময়ে দিনকার রাও, অগ্রজকে জিজ্ঞাসা করেন, “এই বাটী প্রস্তুতের জন্য কে টাকা দেন ও এই ভূমিই বা কাহার দত্ত?” তাহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “দেশহিতৈষী বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মহাশয় এই ভূমি দান করিয়াছেন। তৎকালে এই ভূমির মূল্য চৌদ্দ হাজার টাকা স্থির করিয়াছিল; একারণ আমরা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের নাম বিস্মৃত হইতে পারিব না। আর মহামতি বেথুন সাহেব, এই বাটী নির্ম্মাণের জন্য টাকা দিয়াছেন। তিনি এই টাকা দিবার সময় ও অন্যান্য স্থলে বলিতেন যে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল। ইহার অর্থ জিজ্ঞাসা করায় বলেন, “ষাৎকালে গবর্ণমেণ্ট ভারতবর্ষ হইতে সহমরণ-কুপ্রথা নিবারণের চেষ্টা করেন, তৎকালে বেথুনসাহেব, হিন্দুদের পক্ষাবলম্বন করিয়া অনেক প্রতিবাদ করেন। ঐ পাপের প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ এই বাটী নির্ম্মাণ ও বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন।” উত্তরপশ্চিম প্রদেশের সম্ভ্রান্ত লোক ও রাজারা কলিকাতায় আগমন করিলে, অগ্রজ মহাশয়, ঐ সকল ব্যক্তিকে ৰালিকাবিদ্যালয় দেখাইবার জন্য যত্ন পাইতেন। তাঁহার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহারা স্বদেশে যাইয়া বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করিবেন। এই বৃত্তান্তটী বেথুন বালিকাবিদ্যালয়ের পণ্ডিত শ্রীযুক্ত মাখনলাল ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের প্রমুখাৎ অবগত হইয়াছি।
সন ১২৭৩ সালের পৌষ মাস হইতে কয়েক মাস অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত অসুস্থ হইয়াছিলেন। তজ্জন্য পিতৃদেবকে দেখিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক হইয়াও যাইতে অক্ষম হয়েন। অতএব আমাকে পিতৃদেবের নিকট যাইবার আদেশ করেন, এবং বলিয়া দেন যে, যদি তথায় তোমার অবস্থিতি করা আবশ্যক হয়, তাহা হইলে তাঁহার নিকট থাকিবে। ফলতঃ, পিতৃদেব যেরূপ আদেশ করিবেন, তাহাই করিবে। অগ্রজের আদেশানুসারে আমায় কাশী যাইতে হইল। কয়েক দিন তথায় অবস্থিতি করিলে, তিনি আদেশ করেন যে, আমি যখন দুর্ব্বল ও অসমর্থ হইব, তৎকালে তোমাদের মধ্যে, কেহ নিকটে থাকিবে; সম্প্রতি এখানে তোমাদের কাহারও অবস্থিতি করিবার আবশ্যক নাই; সুতরাং আমাকে দেশে ফিরিয়া, আসিতে হইল। বৃদ্ধ পিতৃদেবকে কাশী পাঠাইবার পর অবধি, অগ্রজের অত্যন্ত দুর্ভাবনা উপস্থিত হয়। তৎকালে তিনি সর্ব্বদাই অন্যমনস্ক থাকিতেন এবং মধ্যে মধ্যে পিতৃদেবের জন্য অশ্রু বিসর্জ্জন করিতেন। দুর্ভাবনায় রাত্রিতে তাঁহার নিদ্রা হইত না। এই সকল কারণে তাঁহার পীড়া আরও প্রবল হইয়াছিল।
সন। ১২৭৪ সালের বৈশাখ মাসে অগ্রজ মহাশয়, কায়িক অত্যন্ত অসুস্থতাপ্রযুক্ত, চিকিৎসকদের উপদেশানুসারে জলবায়ু পরিবর্ত্তনমানসে বীরসিংহায় আগমন করেন। তৎকালে একটী বিধবা নারী সাংসারিক ক্লেশ-নিবারণমানসে, স্বীয় পতির কয়েক বিঘা সকর ভূমি কোন এক ব্যক্তিকে বিলি বন্দোবস্ত করেন, ইহাতে তাঁহার দুই জন আত্মীয় ঐ নিরুপায়ার বিরুদ্ধে ন্যায়বিরুদ্ধ কার্য্যে প্রবৃত্ত হন। নিরুপায়া অবীরা, অগ্রজ মহাশয়ের শরণা লইলেন। ঐ বিধবার রোদনে অগ্রজ অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন এবং অবিলম্বে উক্ত আত্মীয়দ্বয়কে আনয়নার্থে এক আত্মীয়কে প্রেরণ করিলেন। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি উপস্থিত হইলে, অগ্রজ অনুরোধ করেন যে, এই পতিপুত্রবিহীনা তোমাদের আত্মীয়া, অতএব কয়েক বিঘা জমার জমি ত্যাগ কর। তাহাতে তিনি বলিলেন, “আমরা ইঁহার উত্তরাধিকারী; ইনি লোকান্তর গমন করিলে পর, আমরাই ঐ ভূমি পাইব। কিন্তু যাহাতে উহা আমরা আর না পাই, এই অভিপ্রায়ে ইনি জীবদ্দশাতেই সমস্ত বিষয় অন্যকে বন্ধক দিতেছেন; সুতরাং আমরা উপায়ান্তরাবলম্বনে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” অগ্রজ বলিলেন, “ইঁহার অবর্ত্তমানে ঐ ভূমি তোমরা পাইবে সত্য, কিন্তু এক্ষণে ইনি কি খাইয়া প্রাণধারণ করেন, অগত্য বন্ধক দিতেছেন; ইহাতে তোমাদের স্বত্বের কোনও হানি হইবে না। তোমরা সামান্য ভূমির জন্য অসৎপথ অবলম্বন করিতেছ কেন?” তাহাতে তিনি উহার ভূমি ত্যাগ করিতে সম্মত না হইয়া প্রস্থান করেন। তৎক্ষণাৎ দাদা ঐ ভূমি বাহাল রাখাইয়া দেওয়াইলেন। এই সংবাদে বাটীর পরিবারবর্গের মধ্যে কেহ কেহ অগ্রজকে বিনীতভাবে অত্যন্ত দুঃখিতান্তঃকরণে এই অনুরোধ করেন, যেন ঐ অবীরা ভূমি না পায়। তাহাতে তিনি উত্তর করেন যে, এ বিষয়ে আমি কাহারও অনুরোধ রক্ষা করিব না। যাহাতে নিরুপায় পতিপুত্রবিহীনা স্ত্রীলোক স্বীয় ভূমিসম্পত্তি পুনর্গ্রহণে সমর্থ হন, আমি তদ্বিষয়ে আন্তরিক যত্নবান্ হইব। ঐ স্ত্রীলোকের জন্য আমাকে যদি সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিতে হয়, আমি তাহাতেও সম্মত আছি; তথাপি ঐ অসহায়া স্ত্রীলোকটির পক্ষ কদাচ পরিত্যাগ করিতে পারিব না। ইহা শুনিয়া উপস্থিত সকলে আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় অদ্য একটি দরিদ্রা স্ত্রীলোকের রোদনে এমন মুগ্ধ হইয়াছেন যে, গুরুতর লোকের উপরোধ রক্ষা করিলেন না। ঐ দরিদ্রার প্রতি ইঁহার অদ্ভুত দয়ার সঞ্চার হয়। আমরা মনে করিয়াছিলাম, এবার ঐ আত্মীয়েরা ভয়ে ঐ স্ত্রীলোকের জমি পরিত্যাগ করিবেন, কিন্তু উহারা তাহা না করিয়া পূর্ব্বপেক্ষা উহার প্রতি আরও শত্রুতা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয়, নায়েবকে অনুরোধ করেন। অগ্রজের আদেশ পাইয়া, নায়েব পরম আহ্লাদিত হইয়া তাহাদিকে ডাকাইয়া বলেন যে, তাঁহারা উত্তরকালে ঐ স্ত্রীলোকটির কোন সম্পত্তি বলপূর্ব্বক অধিকার করিতে না পারেন। অবশেষে তাহারা অগত্যা তাহাদের কুটুম্ব মহাশয়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাহারা ঐ ভূমির তালুকদার বাবুদের কুটুম্ব; সুতরাং ঐ কুটুম্বেরা অবীরাকে ঐ ভূমি হইতে বেদখল করিবার জন্য যত্ন পাইতে লাগিলেন। আবীরার প্রমুখাৎ উক্ত সংবাদ শ্রবণ করিয়া, অগ্রজ মহাশয় তালুকদার বাবুকে পত্র লিখেন। উক্ত পত্র পাইয়াও তিনি পক্ষাবলম্বন করিয়া অবীরাকে বেদখল করিয়া, ধান্য রোপণ করিতে আন্তরিক যত্নবান্ হন। তাহাতে অসহায়া বিধবা ৭৪ সালের আষাঢ় মাসে কলিকাতায় যাত্রা করেন এবং তথায় অগ্রজ মহাশয়কে আদ্যন্ত নিবেদন করিলে পর, তিনি আমায় পত্র লিখেন। ঐ পত্র লইয়া অবীরা জাহানাবাদে প্রস্থান করেন। কিন্তু মোক্তারগণ বলেন, বেদখল হইতে দেওয়া হইবে না, সাবেক দখল বজায় রাখিতে হইবে, সুতরাং বাটী প্রত্যাগমন করেন। আসিয়া দেখিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় বাটী আগমন করিয়াছেন। উক্ত আত্মীয়েরা, অন্য দ্বারা গড়বেতায় ঐ অবীরার নামে যে অভিযোগ করিয়াছিলেন, তাহার ধার্য্য দিনে বাদী, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভয়ে উপস্থিত না হওয়ায়, মোকদ্দমা খারিজ হয়। আবীরার দখল কায়েম রহিল। অসহায়ার প্রতি এরূপ দিয়া প্রকাশ করাতে, এ প্রদেশে অগ্রজ মহাশয়ের প্রতি দেশের লোকের গাঢ়তর ভক্তি জন্মিল। ৭৪ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে বীরসিংহার বাটীর নূতন বন্দোবস্ত করেন। মধ্যম ও তৃতীয় সহোদরের এবং স্বীয় পুত্রের পৃথক্ পৃথক্ ভোজনের ব্যবস্থা করিয়া দেন। সকলেরই মাসিক ব্যয়ের নিমিত্ত যাহার যেরূপ টাকার আবশ্যক, সেইরূপ ব্যবস্থা হইল। এইরূপ করিবার কারণ এই, একত্র অনেক পরিবার থাকিলে কলহ হইবার সম্ভাবনা; বিশেষতঃ বহুপরিবার একত্র অবস্থিতি করিলে সকলেরই সকল বিষয়ে কষ্ট হয়। ইতিপূর্বে ভগিনীদ্বয়ের পৃথক্ বাটী নির্ম্মাণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বিদেশীয় যে সকল বালকগণ বাটীতে ভোজন করিয়া বীরসিংহা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিবে, তাহাদের মাসিক ব্যয় নির্ব্বহের সমস্ত টাকা দিয়া, পাচক ও চাকর দ্বারা স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করেন। ৭৫ সালে আমায় স্বতন্ত্র বাটী প্রস্তুত করিয়া দেন। ইহার কিছু দিন পরে তাঁহার পুত্র নারায়ণের পৃথক্ বাটী প্রস্তুত হয় এবং নিজের নিকট জননীদেবীর অবস্থিতি করিবার ব্যবস্থা হয়।
বৰ্দ্ধমান।
অগ্রজ মহাশয় কায়িক অসুস্থতাপ্রযুক্ত ফরেশডাঙ্গায় বাটী ভাড়া করিয়া অবস্থিতি করেন। কয়েক মাস তথায় থাকিয়া কিছু সুস্থ হন; কিন্তু তথায় অবস্থিতি করিয়া বিশেষ উপকার না হওয়ায়, বৰ্দ্ধমান যাইবার মানস করেন।
প্রায় ৪৫ বৎসর অতীত হইল, বৰ্দ্ধমানের রাজা মহাতাপচন্দ্র বাহাদুরের সালগিরার সময় নিমন্ত্রিত তৎকালের বিখ্যাত বাবু রামগোপাল ঘোষ ও ভূকৈলাসের রাজা সত্যচরণ ঘোষাল মহোদয়েরা যৎকালে বৰ্দ্ধমান যাত্রা করেন, ঐ সময় তাঁহাদের সহিত অগ্রজ মহাশয়ও বৰ্দ্ধমান-দর্শনমানসে গমন করিয়াছিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া তিনি প্রথমতঃ তাঁহাদের বাসায় অবস্থিতি করেন। কিয়ৎক্ষণ পরে রাজবাটী হইতে তাঁহাদের সিদ আসিল, এবং উহাঁদের সঙ্গে কত লোক আসিয়াছেন গণনা করিয়া ভোজনের দ্রব্যাদি দেওয়া দেখিয়া, অগ্রজ প্রকাশ্যভাবে বলেন যে, আমি তোমাদের বাসায় অবস্থিতি বা ভোজন করিব না; এই বলিয়া বাবু প্যারীচরণ মিত্রের ভবনে প্রস্থান করেন। তথায় তাঁহার বাটীতে মধ্যাহ্ন-কার্য্য সমাপন করিয়া উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে রাজবাটীর লোক আসিয়া বলিল, “মহাশয়! বৰ্দ্ধমানাধিপতি বাহাদুর আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন। অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক রাজবাটী গমন করুন।” তাহদের কথা শুনিয়া, অগ্রজ উত্তর দেন যে, এসময় তাঁহার বাটীতে কার্য্যোপলক্ষে নানা স্থানের লোক উপস্থিত হইয়াছেন। একারণ এসময় রাজবাটী যাইতে ইচ্ছা করি না। রাজকর্ম্মচারীরা এই সংবাদ রাজার কর্ণগোচর করিলে, রাজা পুনর্ব্বার কয়েক জন সম্ভ্রান্ত লোককে অগ্রজের নিকট প্রেরণ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, ঐ কয়েক জন সম্ভ্রান্ত লোকের অনুরোধে অগত্য রাজবাটীতে গমন করেন। রাজা, অগ্রজ মহাশয়কে অবলোকন করিয়া বলেন, “আপনি অতি বিখ্যাত লোক ও সুপণ্ডিত। লাট সাহেব প্রভৃতি আপনাকে অত্যন্ত সম্মান করিয়া থাকেন।” রাজা, প্রায় দুই ঘণ্টাকাল নানা বিষয়ের গল্প করিলেন; অবশেষে অগ্রজ মহাশয় বিদায় লইলেন। রাজা ৫০০৲ টাকা ও এক জোড়া শাল বিদায় দেন। তাহা দেখিয়া দাদা বলিলেন, “আমি কখন কাহারও নিকট দান গ্রহণ করি না। কলেজে গবর্ণমেণ্ট প্রদত্ত যাহা বেতন পাইয়া থাকি, তাহাতে আমার সাংসারিক ব্যয় নির্ব্বাহ হইয়া থাকে। যাহারা টোল করিয়া শিক্ষা দেন, তাঁহাদের পক্ষে এরূপ বিদায় গ্রহণ করা উচিত।” ইহা শুনিয়া রাজা আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “এরূপ নিঃস্বার্থ নির্লোেভ পণ্ডিত আমি কখনও দেখি নাই।” তদবধি রাজা তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন।
কিছু দিন পরে তিনি যৎকালে হুগলি, বৰ্দ্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর এই জেলাচতুষ্টয়ের স্কুলসমূহের এসপিসিয়াল ইনস্পেক্টরের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তৎকালে কয়েকবার বর্দ্ধমানের বিদ্যালয় পরিদর্শনার্থে আগমন করেন। ইহার কয়েক বৎসর পরে, যখন মিস্ কারপেণ্টার কলিকাতায় আগমন করেন, তৎকালেও লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের অনুরোধে অগ্রজ মহাশয়, মিস্ কারপেণ্টারকে কলিকাতার কয়েকটি বিদ্যালয় ও কয়েকজন কৃতবিদ্য লোকের অন্তঃপুরস্থ স্ত্রীলোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়াছিলেন, এবং পরিশেষে ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে এক দিবস মিস কারপেণ্টারকে সমভিব্যাহারে লইয়া, উত্তরপাড়ানিবাসী জমিদার বাবু বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রভৃতির স্থাপিত বালিকাবিদ্যালয় দেখাইতে গমন করেন। তথা হইতে প্রত্যাগমনসময়ে বগী গাড়ীতে আরোহণ করিয়া আসিতেছিলেন; মোড় ফিরিবার সময়, গাড়ী উলটিয়া পড়ে। বিদ্যাসাগর মহাশয় গাড়ী হইতে পড়িয়া অচেতন অবস্থায়, ঘোড়ার পায়ের নিকটে ভূমিতে নিপতিত ছিলেন। তথায় উপস্থিত দর্শকগণের মধ্যে কেহ সাহস করিয়া, সেই স্থান হইতে ঘোড়াকে সরান নাই। স্কুল-ইনস্পেক্টার উড়রো সাহেব ও বিদ্যালয়সমূহের ডিরেক্টার রাটকিনসন্ সাহেব তাহা দেখিয়া, ত্বরায় ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া সেই স্থান হইতে অপসারিত করেন। ঘোড়া না সরাইলে, ঘোড়ার পদাঘাতেই অপমৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল। তাঁহাকে ভূমিতে পতিত ও হতজ্ঞান দেখিয়া, মিস কারপেণ্টারের চক্ষে জল আসিল। তিনি নিজের উৎকৃষ্ট বসনের দ্বারা দাদার গায়ের কাদা ও ধূলি সমস্ত পরিমাৰ্জি্তজ করিয়া দেন। ঐ গাড়ী হইতে পতনাবধি অগ্রজ মহাশয়ের স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়। নানা প্রতীকারেও সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করিতে পারেন নাই। পরে তিনি কিছুদিন ফরেসডাঙ্গায় অবস্থিতি করেন। তথায় অবস্থিতি করিয়া বিশেষ ফলপ্রাপ্ত না হওয়ায়, পুনর্ব্বার কলিকাতায় ফিরিয়া যান। অনন্তর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য চিকিৎসকগণ কিছু দিনের নিমিত্ত কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া, তৎকালের স্বাস্থ্যকর স্থান বৰ্দ্ধমানে অবস্থিতি করিতে উপদেশ প্রদান করেন। তৎকালে বৰ্দ্ধমান অতি স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল। প্রথমতঃ বৰ্দ্ধমানবাসী বাবু প্যারীচরণ মিত্রের বাটীতে প্রায় এক মাস অবস্থিতি করেন।
ঐ সময় মাইকেল মধুসুদন দত্ত ইংলণ্ড হইতে কলিকাতায় আসিয়া হাইকোটে প্রবিষ্ট হইবার উদ্যোগ করেন; কোন কারণে তাঁহার হাইকোর্টে প্রবিষ্ট হইবার বাধা জন্মিল। মাইকেল নিরুপায় হইয়া, বৰ্দ্ধমানে প্যারীচরণ মিত্রের ভবনস্থিত অগ্রজ মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করেন। তথায় যাইয়া তাহার নিকট বিস্তর অনুনয় বিনয় করিলে পর, তিনি দয়ার্দ্র হইয়া চরিত্রসম্বন্ধে সার্টিফিকেট লিখিয়া, মাইকেলের হস্তে প্রদান করেন। অনন্তর অবিলম্বে অগ্রজ মহাশয় কলিকাতা আসিয়া যোগাড় করিয়া দেওয়াতে, মাইকেল, বারিষ্টারের কর্ম্মে প্রবিষ্ট হইলেন। প্রথমতঃ বিলাতে মাইকেলের ঋণ পরিশোধের জন্য ছয় হাজার টাকা প্রেরণ করেন। দ্বিতীয়তঃ বারিষ্টারের কার্য্যে বাধা জন্মিলে, দাদা স্বতঃপরতঃ অনুরোধ দ্বারা বাধা খণ্ডাইয়া দেন। এতদ্ব্যতীত যখন যত টাকার আবশ্যক হইত, তাহা প্রদান করিতেন। একারণ, মাইকেল, অগ্রজের নিতান্ত অনুগত ছিলেন। দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত মাইকেল স্বল্পদিনের মধ্যেই লোকান্তরিত হন। মাইকেলের মৃত্যুসংবাদে অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন।
ঐ সময় তিনি মধ্যে মধ্যে জননী-দেবী, বিদ্যালয় ও বিধবাবিবাহদি কার্য্যকলাপ পরিদর্শনার্থে, পান্ধী করিয়া উচালনের রাজপথ দিয়া বৰ্দ্ধমান হইতে বীরসিংহায় গমন করিতেন। কখন কখন উচালনে রাত্রিতে অবস্থিতি করিতেন। অনেক অনাথ দরিদ্রবালক সম্মুখে উপস্থিত হইত। অগ্রজ, তাহাদের দুঃখদর্শনে দুঃখিত হইয়া তাহাদিগকে কিছু কিছু প্রদান না করিয়া জলগ্রহণ করিতেন না। প্রায় দুই তিন জন দরিদ্র বালক সমভিব্যাহারে করিয়া বাটী আগমন করিতেন। বাটীতে লোকের কোনও অসদ্ভাব ছিল না; তথাপি তাহাদিগকে অকারণ একটা কার্য্যের ভার প্রদান করিতেন এবং ঐ সকল লোকের মাসিক বেতন ধার্য্য করিতেন।
কয়েক দিবস বাটীতে অবস্থিতি করিয়া, পুনর্ব্বর বর্দ্ধমানে যাত্রা করিতেন। বৰ্দ্ধমানে প্যারীবাবুর বাটীতে প্রায় এক মাস অবস্থিতি করিয়া, কিছু সুস্থ হইলেন দেখিয়া, বৰ্দ্ধমানধিরাজ-বাহাদুরের কমলসায়েরের পার্শ্বস্থ বাগানবাটীতে অবস্থিতি করেন। কমলসায়েরের চতুর্দ্দিকেই দরিদ্র নিরুপায় মুসলমানগণের বাস। এই পল্লীর বালক-বালিকাগণকে প্রতিদিন প্রাতে জলখাবার দিতেন। যাহাদের অন্নকষ্ট এবং পরিধেয় বস্ত্র জীর্ণ ও ছিন্ন দেখিতেন, তাহাদিগকে অর্থ ও বস্ত্র দিয়া কষ্ট নিবারণ করিতেন। এতদ্ভিন্ন কয়েক ব্যক্তিকে দোকান করিবার জন্য মূলধন দিয়াছিলেন। কি স্ত্রীলোক, কি পুরুষ, কি বালকবালিকা, সকলেই তাঁহাকে আপনার ঘরের লোকের মত মনে করিত ও আন্তরিক ভাল বাসিত, এবং পিতা ও বন্ধুর ন্যায় ভক্তি ও মান্য করিত। ঐ সময়ে অগ্রজ মহাশয়, কমলসায়েরের সন্নিহিত একটা মুসলমানকন্যার বিবাহের সমস্ত খরচ প্রদান করিয়াছিলেন।
বৰ্দ্ধমান হইতে আসিবার কালে কোনও কোনও বারে হাজিপুরের দোকানে অবস্থিতি করিতেন। পাল্কী নামাইলেই, ঐ স্থানের বহুসংখ্যক দরিদ্র বালক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকিত। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাল্যকাল হইতে ছোট ছোট বালকবালিকাগণকে আন্তরিক ভাল বাসিতেন। উপস্থিত প্রায় শতাধিক বালককে মিঠাই খাইতে কিছু কিছু প্রদান না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না। বালকেরা পয়সা পাইয়া পরম আহলাদিত হইয়া প্রস্থান কিরিত। তন্মধ্যে তামলিজাতীয় দ্বাদশবর্ষীয় একটী বালক চারিট পয়সা পাইয়া, সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এই চারিটী পয়সায় কি করিবে? তাহাতে সে উত্তর করিল, “এই পয়সায় বন্দীপুরের হাট হইতে আমি কিনিয়া এই হাজীপুরে বিক্রয় করিব; তাহা হইলে আট পয়সা হইবে। অদ্য এক পয়সার চাউল কিনিয়া ভাত রাঁধিয়া খাইব। কল্য পুনরায় বন্দীপুরের হাটে যাইয়া সাত পয়সার আম কিনিব; সেই আম এখানে বিক্রয় করিলে চৌদ্দ পয়সা হইবে, তাহা হইলে সেই পয়সায় এক পয়সার পোনা-মাছ কিনিয়া খাইব। বালকের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, উহাকে সঙ্গে করিয়া বীরসিংহায় আনয়ন করেন। কয়েক দিন বাটীতে রাখিয়া, একটী ডালি দোকান করিবার উপযুক্ত টাকা দিয়া বিদায় করেন। এইরূপ উচালনের নফরকেও দোকান করিবার মূলধন প্রদান করেন। বিধবা হতভাগিনী স্ত্রীলোক, নাবালক সন্ততি সহিত আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলেই, তাহাদের প্রতি তাঁহার কারুণ্যরসের উদ্রেক হইত। অনাথা স্ত্রীলোকের প্রতি কখন তাঁহাকে বিরক্ত হইতে দেখি নাই। তিনি যতবার বাটী আসিতেন, প্রত্যেক বারেই উদয়গঞ্জের গঙ্গাধর দত্তের দোকান হইতে অন্ততঃ ৫০০৲ শত টাকার বস্ত্র আনাইয়া, অনাথ স্ত্রীলোক দেখিলেই তাহাদিগকে প্রদান করিতেন। উদয়গঞ্জের গঙ্গাধর দত্ত, অগ্রজ মহাশয়কে বস্ত্র বিক্রয় করিয়া সঙ্গতি করিয়াছিলেন।
এক সময় অগ্রজ মহাশয়, বাটী হইতে বৰ্দ্ধমান-গমনকালে সোজা পথে নামিয়া, কামারপুখুর হইতে এক আত্মীয়ের ভবনে গমন করেন। তথায় রাত্রি যাপন করিয়া প্রাতঃকালে দেখিলেন, তাঁহাদিগের বাটীর অবস্থা ভাল নয়; একারণ, তাঁহাদিগকে বলিলেন, “তোমরা বাটীর অবস্থার উন্নতি কর, আমি ইহার জন্য টাকা দিব।” এই বলিয়া বৰ্দ্ধমান গমন করিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, আমায় ঐ টাকা পাঠাইবার আদেশ করেন এবং এ বিষয় কাহারও নিকট ব্যক্ত করিতে নিষেধ করিয়া পত্র লিখেন।
পোলপাতুলের হরকালী চৌধুরী, প্রায় ২৫ বৎসর কাল কলিকাতায় আমাদের বাসায় পাকাদিকার্য্য সমাধা করিয়া, স্বীয় সংসার-প্রতিপালন করিয়া আসিতেছিলেন। উক্ত হরকালী, বৰ্দ্ধমানের বাসাতেও পাক করিতেন। বৰ্দ্ধমানে অনাথ স্ত্রীলোকগণ সর্বদা যাচ্ঞা করিতে আসিত। দাদা তাহাদের প্রতি দয়া করিয়া কাহাকেও বস্ত্র, কাহাকেও টাকা প্রদান করিতেন। কোনও কোনও স্ত্রীলোক বারম্বার আসিয়া, প্রতারণা করিয়া লইয়া যাইত। একদিবস উক্ত পাচক হরকালী, একটী স্ত্রীলোককে বলেন যে, “মাগী, বিদ্যাসাগরকে কি তোরা লেদা আমগাছ পাইয়াছিস্?” হরকালীর প্রমুখাৎ উক্ত কথা শুনিয়া, অগ্রজ মহাশয়, হরকালীকে বলেন, “তুমি বহুকাল আমার বাটীতে আছ; তোমার বেতন কি বাকী আছে বল, ফেলিয়া দিই, এবং তুমি এই মুহুর্ত্তেই আমার বাটী হইতে বিদায় হও। দরিদ্র লোককে আমি দান করিব, তোমার বাবার কি?” ইহা শুনিয়া হরকালী বলেন, “ঐ বৃদ্ধা এক সপ্তাহ অতীত হয় নাই বস্ত্র ও টাকা লইয়াছে; তাহা আপনার স্মরণ নাই, এই কারণেই এরূপ বলিয়াছি। যাহা হউক, আমার অপরাধ হইয়াছে, এ যাত্রা আমায় ক্ষমা করুন।” তথাপি অগ্রজ, হরকালীকে না রাখিয়া, মাসিক দুই টাকা মাসহরার বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া বিদায় দেন।
১৮৬৯ খৃঃ অব্দে অগ্রজ মহাশয়, প্যারীচরণ মিত্রের বাটীর সন্নিহিত ৺রসিককৃষ্ণ মল্লিকের বাটী ভাড়া করিয়া অবস্থিতি করেন। সেই সময়ে বৰ্দ্ধমানে দেশব্যাপক ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাব হয়। অগ্রজের বাসার অতি সন্নিকটে একটি মুসলমান-পল্লী ছিল। সেই পাড়ার লোকেরা অতি দরিদ্র। সকলেই জ্বারাক্রান্ত হইয়া কষ্ট পাইতেছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাদের শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া, স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না। নিজ বাসাবাটীতে তিনি একটি ডিস্পেনসারি খুলিলেন এবং ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ মিত্র মহাশয়ের হস্তে তাহার ভার ন্যস্ত করিলেন। দেশ ব্যাপিয়া জর হইতেছে, লোক ঔষধ ও অন্নাভাবে মরিতেছে দেখিয়া ও শুনিয়া, অগ্রজ মহাশয়, ত্বরায় কলিকাতায় যাইয়া, শ্রীযুক্ত লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর গ্রে সাহেব বাহাদুরকে সমস্ত বিবরণ জানাইলেন। দাদার প্রমুখাৎ অবগত হইয়া, গ্রে সাহেব বৰ্দ্ধমানে ডাক্তার প্রেরণ করেন এবং রিলিফ অপারেশনের কর্তৃপক্ষদিগকে পত্র লিখেন।
বৰ্দ্ধমানের সিবিলসার্জ্জন ডাক্তার মেণ্টন, এ বিষয়ে কোন রিপোর্ট করেন নাই শুনিয়া, গ্রে সাহেব বিরক্তিভাব প্রকাশ করেন এবং আট দশ দিনের মধ্যে কয়েক জন আসিষ্টাণ্ট সার্জ্জন প্রেরণ করেন। মেণ্টন সাহেব, এই কথা শুনিয়া, অবিলম্বে ছুটি লইয়া ঐ স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ডাক্তার ইলিয়াট্ বিলক্ষণ সহৃদয় ও কার্য্যদক্ষ ছিলেন। তিনি আসিয়া সহরের প্রকৃত অবস্থা জ্ঞাত হইয়া, চারি পাঁচটী ডিস্পেনসারি খুলিলেন এবং যে সকল রোগী বাটী হইতে ডিস্পেনসারিতে ঔষধ লইতে আসিতে অক্ষম, তাহাদিগকে ডাক্তারবাবুরা বাটীতে গিয়া দেখিয়া আসিবেন, এরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। ডিস্পেনসারির সঙ্গে অন্নসত্রের ব্যবস্থা হইল এবং এই অন্নসত্রে দুগ্ধ, সাগু প্রভৃতিও দিবার ব্যবস্থা হইল। বৰ্দ্ধমান জেলার মধ্যে ম্যালেরিয়াজরের ক্রমশঃ প্রাদুর্ভাব হইতেছে শুনিয়া, গ্রে সাহেব, বৰ্দ্ধমান জেলার মফঃস্বলস্থ প্রত্যেক গ্রামে অনুসন্ধান লইতে আদেশ করেন। গ্রে সাহেব, ডাক্তার সাহেব ও জেলার মাজিষ্ট্রেট সাহেবের রিপোর্ট পাইয়া, দুই তিন ক্রোশ অন্তর গ্রামের লোকসংখ্যা বিবেচনা করিয়া, ঔষধালয় খুলিতে আজ্ঞা করেন। ডাক্তার ইলিয়ট্, জেলার মধ্যে ঔষধ বিতরণের উত্তমরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন, এবং অনেক নেটিভ ডাক্তার আনাইয়াছিলেন। এই সময়ে বিলাত-ফেরত ডাক্তার, বাবু গোপালচন্দ্র রায়, বাবু ফকিরচন্দ্র ঘোষ, বাবু রসিকলাল দত্ত, বাবু কালীপদ গুপ্ত, বাবু বন্ধুবিহারী গুপ্ত, এবং আসিষ্টাণ্ট সার্জন বাবু দীনবন্ধু দত্ত ও বাবু প্রিয়নাথ বসু প্রভৃতি কয়েক জনকে মেডিকেল ইনস্পেক্টর নিযুক্ত করিয়া, ইহাঁদের উপর পরিদর্শনের ভার দিলেন। ইহাঁরা প্রতিসপ্তাহে স্ব স্ব পরিদর্শনের রিপোর্ট সিবিল সার্জ্জনকে প্রেরণ করিতেন এবং সিবিল সার্জন, স্বীয় মন্তব্যসহ উক্ত রিপোর্টগুলি একত্র করিয়া গবর্ণমেণ্টে পাঠাইতেন। এই সময়মধ্যে ইলিয়ট্, এই তিন জন সিবিল সার্জ্জনের পদের রীতিমত বন্দোবস্ত করেন নাই, এবং এই সুবৃহৎ ব্যাপার অতি সহজে বিনা বন্দোবস্তে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছিল। অদ্যাবধি বৰ্দ্ধমানবাসীদিগের মধ্যে কেহই জানে না যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাদের এই মহোপকার করিয়া, তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। গবর্ণমেণ্টকে এইরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত করিয়াও, তিনি নিজে ক্ষান্ত হন নাই। তাঁহার ডিস্পেনসারির ব্যয় দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ঔষধ বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে সাগু, এরোরুট বিতরিত হইতে লাগিল। দুর্বল রোগীর জন্য দুগ্ধ ও সুরুয়ার পয়সা দিবার ভার গঙ্গানারায়ণ বাবুর উপর অর্পিত হয়। তিনি রোগীদের বাটীতে যাইয়া দুগ্ধাদি বিতরণ করিতেন। এই কার্য্যের জন্য গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে ধন্যবাদ দেন। দেখুন, সংবাদপত্রে না লিখিয়া, গোপনভাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় বৰ্দ্ধমান জেলার কি পর্য্যন্ত উপকার করিয়াছিলেন! দীনদরিদ্রগণ অবারিতভাবে ঔষধ ও পথ্য পাইয়াছিল। ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ বাবু ঔষধ বিতরণের সঙ্গে সাগু, দুগ্ধ এবং সুরুয়ার জন্য পয়সা দিয়াছিলেন। শীতকাল উপস্থিত হইল; দরিদ্র লোকের বস্ত্রাভাব দেখিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় দুই সহস্র টাকার বস্ত্র আনাইলেন। রোগী ব্যতীত অনেক দরিদ্র ব্যক্তি শীতবস্ত্র ও পরিধেয় বস্ত্র পাইয়াছিল। প্রবঞ্চনা করিয়া কেহ কেহ বস্ত্র লইয়া যায়, তাহা ভালরূপ ভেদাভেদজন্য নির্ব্বাচন করিতে গিয়া, যেন কোন প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তি বঞ্চিত না হয়, এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন।
ডিস্পেনসারির সম্পূর্ণভার বাবু গঙ্গানারায়ণ মিত্রের উপর ছিল। তথাপি তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে না জানাইয়া, কোনও কাজ করিতেন না। তাঁহার ঔদার্য্য ও বদান্যতা দেখিয়া, ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ, রোগীদের জন্য ভাল ভাল ঔষধ আনাইতে লাগিলেন। কুইনাইনের অধিক আবশ্যকতা এবং উহা দুর্মূল্য দেখিয়া, ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ, ইহার পরিবর্ত্তে সিঙ্কোনা ব্যবহার করিবার জন্য একবার প্রস্তাব করেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ ডাক্তারের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন, “যখন পীড়া একই প্রকারের, তখন বড় লোক ও দরিদ্র ব্যক্তিনির্ব্বিশেষে এক প্রকারই ঔষধ হওয়া উচিত।” তিনি শয্যাশায়ী ব্যক্তিগণের বাটীতে যাইয়া, তাহাদের শুশ্রষার বন্দোবস্ত করিয়া দিতেন এবং অর্থ ও ঔষধ দিয়া তাহদের দুঃখ মোচন করিতেন। পূর্ব্বোক্ত ভগবানবাবুও ভ্রমণশীল ডাক্তার ছিলেন। তিনি রোগীদের বাটীতে বাটীতে ঔষধ দিয়া বেড়াইতেন। ঐ ডাক্তারের ১৫৲ টাকা বেতন বিদ্যাসাগর মহাশয় দিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় দুই বৎসরকাল বৰ্দ্ধমানে ছিলেন। তিনিও জরাক্রান্ত হইতে পারেন, তাঁহার এ আশঙ্কা কখনও হয় নাই। বৰ্দ্ধমানের লোকে বলিয়া থাকেন, “বিদ্যাসাগর, নির্ম্মল চরিত্রের লোক, তাঁহার রাগদ্বেষ দেখি নাই, তাঁহার শরীর দয়া ও স্নেহে পরিপূর্ণ। তাঁহার মাতৃভক্তি, পরদুঃখকাতরতা ও দানশীলতা অনুপমেয়। তাঁহাকে অপরের মনে কষ্ট দিতে দেখি নাই। তাঁহার সকল বিষয়েই উদারতা দেখিয়াছি।”
মধ্যে মধ্যে যখন তাঁহার পাচক-ব্রাহ্মণ থাকিত না, তখন রাত্রিকালে বাবু প্যারীচরণ মিত্রের বাটী হইতে তাঁহার আহারের সামগ্রী যাইত। এই সময়ে তিনি ভ্রান্তিবিলাস নামক একখানি পুস্তক লিখেন। বাবু প্যারীচরণ মিত্র মহাশয়ের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অত্যন্ত বন্ধুত্ব ছিল। সেই কারণে তিনি তাঁহার ভ্রাতুষ্পপুত্র গঙ্গানারায়ণ বাবু প্রভৃতিকে বাৎসল্যভাবে দেখিতেন।
বিগত ৭৩ সালের দুর্ভিক্ষসময়ে যে সকল লোক অন্নসত্রে ভোজন করিয়াছিল, তাহারা এক্ষণে কি উপায় অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিয়া থাকে, অগ্রজ মহাশয় ঐ সকল গ্রামস্থ দরিদ্র লোকের অবস্থা অবগত হইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন; তজ্জন্য তাঁহাকে ঐ সকলের সবিশেষ পরিচয় দেওয়া হয় যে, উহাদের মধ্যে অনেকেই অতিকষ্টে একসন্ধ্যা ভোজন করিয়া থাকে। ইহা শ্রবণ করিয়া অগ্রজ মহাশয়, জননী-দেবীকে বলেন, “বৎসরের মধ্যে এক দিন পূজা করিয়া ছয় সাত শত টাকা বৃথা ব্যয় করা ভাল, কি গ্রামের নিরুপায় অনাথ লোকদিগকে ঐ টাকা অবস্থানুসারে মাসে মাসে কিছু কিছু সাহায্য করা ভাল?” ইহা শুনিয়া জননীদেবী উত্তর করেন, “গ্রামের দরিদ্র নিরুপায় লোক প্রত্যহ খাইতে পাইলে, পূজা করিবার আবশ্যক নাই। তুমি গ্রামবাসীদিগকে মাসে মাসে কিছু কিছু দিলে, আমি পরম আহলাদিত হইব।” জননীদেবীর মুখে এরূপ কথা শুনিয়া, অগ্রজ মহাশয়, অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হন এবং গ্রামের প্রধান প্রধান লোকদিগকে আনাইয়া বলেন যে, “তোমরা সকলে ঐক্য হইয়া, গ্রামের কোন্ কোন্ ব্যক্তির অত্যন্ত অন্নকষ্ট ও কোন্ কোন্ ব্যক্তি নিরাশ্রয়, তাহাদের নাম লিখিয়া দাও, আমি মাসে মাসে উহাদের কিছু কিছু সাহায্য করিব।” গ্রামস্থ ভদ্রলোকেরা যে ফর্দ্দ করিয়া দিলেন, সেই ফর্দ্দ অগ্রজ মহাশয় স্বহস্তে লিখিয়া আমার নিকট প্রদান করিয়া বলিলেন, “তুমি পূর্ব্বাবধি যেরূপ নিরুপায় আত্মীয়াদিগকে ও বিধবাবিবাহসম্পৰ্কীয় নিরুপায় ব্যক্তিদিগকে ফর্দ্দানুসারে টাকা বিতরণ করিয়া আসিতেছ, সেইরূপ এই ফর্দ্দানুসারে গ্রামস্থ নিরুপায় ব্যক্তিদিগকে মাসে মাসে টাকা দিবে এবং সময়ে সময়ে গ্রামস্থ ব্যক্তিদিগের অবস্থার বিষয় বিশেষরূপে আমায় লিখিবে।” দূরস্থ স্বসম্পৰ্কীয় বা বিধবাবিবাহকারী লোকদিগের বাটীতে লোক পাঠাইয়া, মাসিক টাকা প্রদান করা হইত। ঐ লোকের রীতিমত বেতন তাহাদিগকে দিতে হয় নাই; এরূপ দান সহজ নহে।
৭৪ সালের শ্রাবণ মাসে নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী আইসমালী গ্রামে গোপালচন্দ্র সমাজপতির সহিত বিদ্যাসাগরের জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতাদেবীর বিবাহ হয়। বর অতি সৎপাত্র; অগ্রজ মহাশয় ইঁহাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন।
এই সময় মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন মহাশয়ের সহিত জ্যেষ্ঠাগ্রজ মহাশয়ের সংস্কৃত-প্রেস ও উহার ডিপজিটারী লইয়া বিবাদ হয়। কিন্তু মধ্যমাগ্রজ মহাশয়কে ক্ষান্ত করিয়া দেওয়ায়, তিনি সংস্কৃত-প্রেসের ও উহার ডিপজিটারীর দাবী পরিত্যাগ করিলেন।
সন ১২৭৫ সালের অগ্রহায়ণ মাসে গবর্ণমেণ্টের আদেশে বাবু রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ইনকম্ ট্যাক্স ধার্য্যের জন্য জাহানাবাদ মহকুমায় উপস্থিত হন। যে সকল সামান্য ব্যবসায়ীর আইনানুসারে ট্যাক্স ধার্য্য হইতে পারে না, তাহাদের প্রতি অন্যায়পূর্বক দুই নামে একত্র এক বিলে ট্যাক্স ধার্য্য করিতেছিলেন। কেহ কেহ এই গৰ্হিত আইনবিরুদ্ধ কার্যো সন্মত না হইলে, ভয় প্রদর্শন দ্বারা ঐ সকল লোককে সম্মত করাইতেন। সামান্য ব্যক্তিরা নিরুপায় হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানাইয়া, সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিল। ন্যায়বিরুদ্ধ কার্য্য হইতেছে অবগত হইয়া, তিনি খড়ার গ্রামে সমাগত আসেসর রমেশবাবুর নিকট যাইয়া বলেন, “ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী ব্যক্তিদিগকে একব্যবসায়ী লিখিয়া ট্যাক্স ধার্য্য করিলে অতি অন্যায় কার্য্য হয়।” রমেশবাবু বলিলেন, “দুই নামে এক কাগজে এক বিলে না দিলে, অনেক সামান্য আয়ের ব্যবসায়ী লোক বাদ পড়ে, এরূপ হইলে গবর্ণমেণ্টের আয়ের অনেক খর্ব্বত হয়।” অগ্রজ মহাশয়, আসেসর বাবুকে বলেন যে, “গবর্ণমেণ্টের আয়ের লাঘব হয় বলিয়া, এরূপ অন্যায় কার্য্যে প্রবৃত্ত হওয়া কি আপনাদের উচিত হইতেছে?” রমেশবাবু, অগ্রজ মহাশয়ের উপদেশ অগ্রাহ করিয়া, তৎকালে তাঁহার নিকট উপস্থিত কতকগুলি সামান্য আয়ের ব্যবসায়ীকে ধমকাইয়া স্বীকার করাইলেন। মফঃস্বলে এরূপ আইনবিরুদ্ধ কার্য্য দেখিয়া, অবিলম্বে অগ্রজ মহাশয় কলিকাতায় আসিয়া লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের কর্ণগোচর করিলেন, এবং স্বয়ং দেশস্থ লোকের হিতকামনায় বাদী হইলেন। লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুর, অগ্রজ মহাশয়ের প্রমুখাৎ উহা শ্রবণ করিয়া, কৃষ্ণনগরের মাজিষ্ট্রেট্ মনরো সাহেবের কথা বলেন; কিন্তু অগ্রজ মহাশয়, হেরিসন সাহেবকে মনোনীত করেন। তদনুসারে ছোট লাট বাহাদুর, বৰ্দ্ধমানের কালেক্টার হেরিসন সাহেব বাহাদুরকে কমিসনার নিযুক্ত করিয়া, মফঃস্বল তদন্ত জন্য প্রেরণ করেন। হেরিসন সাহেব, বাদী অগ্রজ মহাশয়ের সমভিব্যাহারে খড়ার, রাধানগর, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, রামজীবনপুর, বদনগঞ্জ, জাহানাবাদ প্রভৃতি গ্রামে যাইয়া, সকল ব্যবসায়ীর খাতা ও কাগজপত্র অবলোকন করেন ও আসেসর রমেশবাবুর কৃত অন্যায় প্রমাণ হয়। অগ্রজ মহাশয়, বিপদগ্রস্ত দেশস্থ সাধারণের উপকারের জন্য, প্রায় দুই মাস কাল অনন্যকর্ম্ম ও অনন্যমনা হইয়া, কেবল এই কার্য্যেই লিপ্তছিলেন। একারণ দেশস্থ লোক উপকার প্রাপ্ত হইয়া, অগ্রজ মহাশয়ের বিশিষ্টরূপ গুণানুবাদ করেন। উহারা পুর্ব্বে মনে করিত যে, বিদ্যাসাগর কেবল বিদ্যোৎসাহী ও বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক। এখন দেশস্থ লোক ভালরূপ অবগত হইলেন যে, সকল বিষয়েই তিনি সমাদৃষ্টি-নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। উক্ত কার্য্যে দুই মাস নিরন্তর লিপ্ত থাকায়, অগ্রজ মহাশয়ের দুই সহস্ৰাধিক টাকা ব্যয় হয়।
ঘাঁটাল ইনকমট্যাক্সের তদন্ত-সময়ে, তথাকার মুনসেফ বাবু তারিণীচরণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি, অগ্রজ মহাশয়কে সানুনয়ে এই নিবেদন করেন যে, আমাদের ঘাঁটালে একটি মাইনার ইংরাজী বিদ্যালয় আছে, আদ্যাপি স্কুল-গৃহ না থাকা প্রযুক্ত, আমরা চাঁদা করিয়া ইষ্টক-নির্ম্মিত বাটী প্রস্তুত করিতেছি। কিন্তু ৫০০৲ টাকার অসদ্ভাবপ্রযুক্ত বাটী-নির্ম্মাণ-কার্য্য সম্পন্ন হয় নাই। একারণ, অগ্রজ মহাশয় তৎকালে ঘাঁটাল স্কুল-গৃহ-নির্ম্মাণার্থে ৫০০৲ টাকা প্রদান করিয়াছিলেন। এরূপ দান দেখিয়া ও শুনিয়া, ঘাঁটাল-চৌকীর সম্ভ্রান্ত লোকেরা আহিলাদিত হইয়া বলিয়াছিলেন যে, “আমরা জমিদার, তথাপি দশ বার টাকার উৰ্দ্ধ সাহায্য করিতে সাহস করি নাই; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় অকাতরে ৫০০৲ টাকা প্রদান করিলেন।”
হেরিসন সাহেবের তদন্তকার্য্য সমাধা হইলে পর, অগ্রজ মহাশয়, হেরিসন সাহেবকে বীরসিংহস্থিত বাটীতে নিমন্ত্রণ করিয়া ভোজন করাইয়াছিলেন। জননীদেবী, সাহেবের ভোজনসময়ে উপস্থিত থাকিয়া, তাঁহাকে ভোজন করাইয়াছিলেন। তাহাতে সাহেব আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন যে, অতি বৃদ্ধ হিন্দু গ্রীলোক, সাহেবের ভোজনের সময় চেয়ারে উপবিষ্টা হইয়া কথাবার্ত্তা কহিতে প্রবৃত্ত হইলেন। উপস্থিত সকলে ও সাহেব পরম সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। সাহেব হিন্দুর মত জননীদেবীকে ভূমিষ্ঠ হইয়া মাতৃভাবে অভিবাদন করেন। তদনন্তর নানা বিষয়ে কথাবার্ত্তা হইল। জননীদেবী প্রবীণা হিন্দু স্ত্রীলোক; তথাপি তাঁহার স্বভাব অতি উদার, মন অতিশয় উন্নত এবং মনে কিছুমাত্র কুসংস্কার নাই। কি ধনশালী, কি দরিদ্র, কি বিদ্বান্, কি মুর্থ, কি উচ্চজাতীয়, কি নীচজাতীয়, কি পুরুষ, কি স্ত্রী, কি.হিন্দুধর্ম্মাবলম্বী, কি অন্যধর্ম্মাবলম্বী সকলেরই প্রতি সমদৃষ্টি; ইহা জানিতে পারিয়া সকলেই চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সন্তোষলাভ করিলেন। হেরিসন সাহেব, দাদাকে বলিলেন, “মাতার গুণেই আপনি এরূপ স্বভাবতঃ উন্নতমনা হইয়াছেন।” কথাবার্ত্তার শেষে সাহেব, জননীকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনার; কত টাকা আছে?” জননী উত্তর করেন, আমার টাকা নাই এবং টাকার আবশ্যকও নাই; যেরূপ ভাবে চলিয়া আসিতেছি, এইরূপ ভাবে চলিয়া পুত্রকন্যা রাথিয়া যাইতে পারিলে, আমার সকল অভিলাষ পূর্ণ হইবে।
সন ১২৭৫ সালের চৈত্রমাসে এক দুর্ঘটনা হয়। বীরসিংহস্থ পৈত্রিক বসতবাটীর সমস্ত গৃহ নিশীথ-সময়ে অগ্নি লাগিয়া ভস্মীভূত হয়। শালগ্রাম ঠাকুরটি পর্যন্ত অগ্নির উত্তাপে দগ্ধ ও বিদীর্ণ হয়; মধ্যমাগ্রজ ও জননীদেবী প্রভৃতি নিদ্রিত ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহারা সকলেই রক্ষা পাইয়াছিলেন। কিন্তু দ্রব্যাদি কিছুমাত্র বাহির করিতে পারা যায় নাই। অগ্রজ, এই সংবাদ পাইবামাত্র দেশে আগমন করেন। জননীদেৰীকে সমভিব্যাহারে করিয়া কলিকাতা লইয়া যাইবার জন্য যত্ন পাইলেন; কিন্তু তিনি বলিলেন, “আমি কলিকাতা যাইব না। কারণ, যে সকল দরিদ্র লোকের সন্তানগণ এখানে ভোজন করিয়া বীরসিংহা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে, আমি এস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তর প্রস্থান করিলে, তাহারা কি খাইয়া স্কুলে অধ্যয়ন করিবে? কে দরিদ্র বালকগণকে স্নেহ করিবে? বেলা দুই প্রহরের সময় যে সকল, বিদেশস্থ লোক ভোজন করিবার মানসে এখানে, সমাগত হন, কে তাঁহাদিগকে আদর-অভ্যর্থনাপূর্ব্বক ভোজন করাইবে? যে সকল কুটুম্ব আগমন, করিবেন, কে তাঁহাদিগকে যত্ন করিয়া ভোজন করাইবে?” জননী-দেবী, কলিকাতা যাইতে সম্মত হইলেন না; তজ্জন্য তাঁহার স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করেন। এস্থলে জননীদেবীর দয়াশীলুতার দুই এক কথা না লিখিয়া ক্ষান্ত থাকা যায় না। জননীদেবী, সর্ব্বদা গ্রামস্থ অভুক্ত লোককে ভোজন করাইতেন। স্থানীয় প্রতিবাষিগণ পীড়িত হইলে সর্বদা তাহাদের তত্ত্বাবধারণ করিতেন এবং ঐ বাস্তু ভিটা দেখিয়া রোদন করিতেন। সম্মুখে বর্ষাকাল, একারণ অগ্রজ মহাশয়, তাহার বাসার্থ সামান্য গৃহ প্রস্তুত করাইয়া দেন। বিদেশীয় যে সকল রোগিগণ চিকিৎসার জন্য আসিয়া বাটীতে অবস্থিতি করিত, স্বয়ং তাহাদের আবশ্যকীয় দ্রব্য পাক করিয়া দিতেন। যে সকল দরিদ্র প্রতিবেশীর বস্ত্র না থাকিত, সময়ে সময়ে তাহাদিগকে যথেষ্ট বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিতেন, এবং সময়ে সময়ে অনেকের আপদবিপদে যথেষ্ট অর্থ প্রদান করিতেন। জননী-দেবীর দান-খয়রাতের জন্য যখন যাহা আবশ্যক হইত, অগ্রজ মহাশয় অবিলম্বে তাহা পাঠাইতেন। তিনি যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন, অগ্রজ মহাশয় সেই কার্য্য অবিলম্বে সম্পন্ন করিতেন। প্রতিবৎসরেই অগ্রজকে অনুরোধ করিয়া, বীরসিংহা বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের ও অন্যান্য অনেক দীনদরিদ্রের কর্ম্ম করিয়া দিতেন। বৎসরের মধ্যে নুতন নূতন অনেক কুটুম্ব ও গ্রামস্থ অনাথগণের মাসহরা করাইয়া দিতেন। জননীদেবীর ও পিতৃদেবের স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি বিলক্ষণ দ্বেষ ছিল; তাঁহারা প্রায়ই বলিতেন, “বাটীর স্ত্রীলোকদিগকে অলঙ্কার দিলে, বাটীতে ডাকাইতি এবং দস্যুর ভয় হইবে। স্ত্রীলোকদিগের মনে অহঙ্কারের উদয় হইবে, এবং তাহাদের গৃহস্থালীকার্য্যে সেরূপ যত্ন থাকিবে না, দীন-দরিদ্রদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিবে। অলঙ্কার না করিয়া, ঐ টাকায় যথেষ্ট অল্পব্যয় করিতে পারিব। তাহাতে দরিদ্র বালকেরা আমাদের বাটীতে ভোজন করিয়া লেখাপড়া শিখিতে পরিবে।” জননীদেবী, বাটীর স্ত্রীলোকদিগকে পাতলা কাপড় পরিধান করিতে দিতেন না। কখন কখন কলিকাতা হইতে পাতলা কাপড় গেলে, অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করিতেন। বাটীর স্ত্রীলোকদের জন্য মোটা বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিতেন, এবং পাকাদি সাংসারিক কার্য্য করিবার জন্য সর্ব্বদা উপদেশ দিতেন। তিনি বিদেশীয় অনুপায় রোগীদের শুশ্রূষাদি কার্য্যে বিশেষরূপ যত্নবতী ছিলেন। কাহারও নিরামিষ ব্যঞ্জন, কাহারও মৎস্যের ঝোল প্রভৃতি স্বয়ং প্রস্তুত করিয়া দিতেন। তাঁহাকে এই কার্য্যে কখনও বিরক্ত হইতে দেখা যায় নাই। বাটীর অন্যান্য স্ত্রীলোকেরাও এই সকল বিষয়ে মাতৃদেবীর অনুকরণ করিতেন। বিবাহিতা বিধবাদের মধ্যে কেহ পীড়িত হইয়া চিকিৎসার জন্য বাটীতে আসিলে, অথবা অপর কেহ রোগগ্রস্ত হইয়া উপস্থিত হইলে, জননী-দেবী তাহাদের মল-মূত্রাদি পরিষ্কার করিতেন; তাহাতে কিছুমাত্র ঘুণাবোধ করিতেন না। এ প্রদেশের অনেকেই প্রায় বলিয়া থাকেন যে, অগ্রজ মহাশয় বাল্যকাল হইতে জননী-দেবীর দয়া-দক্ষিণ্যাদি গুণ সকল অধিকার করিয়াছেন। জননীদেবী, পরের দুঃখাবলোকনে রোদন করিতেন, অগ্রজও সাধারণ লোকের শোকতাপ দেখিয়া রোদন করিতেন। অধিক কি, সামান্য শৃগাল কুকুর মরিলেও দাদার নেত্রজল বহির্গত হইত। গ্রামে বিদ্যালয় সংস্থাপনের পূর্ব্বে, গ্রামস্থ প্রায় সকল লোকই দরিদ্র ছিল, কেহ লেখাপড়া জানিত না, কেহ চাকরি করিত না; সকলেই সামান্য কৃষিবৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিত। সম্বৎসরের পরিশ্রমলব্ধ সমস্ত ধান্য পৌষমাসেই মহাজনগণ বলপূর্ব্বক এককালেই লইয়া যাইতেন। গ্রামের প্রায় অনেক লোক এক-সন্ধ্যা আহার করিয়া অতি কষ্টে দিনপাত করিত। দয়াময়ী জননী-দেবী, গ্রামস্থ অনেককেই টাকা ধার দিতেন; কিন্তু কাহারও নিকট পাইবার আশা রাখিতেন না।
তৎকালীন এডুকেশন গেজেটের সম্পাদক বাবু প্যারীচরণ সরকার ও বারাসতনিবাসী বাবু কালীকৃষ্ণ মিত্র মহাশয়দ্বয়, অগ্রজের পরমবন্ধু ছিলেন। বিধবাবিবাহ ও বালিকা-বিদ্যালয় প্রভৃতি দেশহিতকর কার্য্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রায় পঞ্চাশ সহস্র মুদ্রা ঋণ হইয়াছিল; একারণ, উক্ত সরকার ও মিত্র মহাশয় অত্যন্ত চিন্তিত হইয়াছিলেন এবং এডুকেশন গেজেটে প্রকাশ করেন যে, বিদ্যাসাগর, দেশহিতকর কার্য্যে যথেষ্ট ঋণগ্রস্ত হইয়াছেন। অতএব তাঁহার বন্ধুবান্ধবের, কর্ত্তব্য যে, সকলে কিছু কিছু সাহায্য করিলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্লেশে ঋণ-দায় হইতে পরিত্রাণ পান। যাঁহার সাহায্য করিবার ইচ্ছা হইবে, তিনি এডুকেশন গেজেটের সম্পাদক প্যারীবাবুর নিকট প্রেরণ করিবেন। ইহা প্রকাশ করায়, অল্প দিনের মধ্যেই যথেষ্ট টাকা প্যারীবাবুর নিকট জমা হইল। ঐ সময় দাদা বাটী হইতে কলিকাতা আইসেন। তিনি এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া, পত্রের দ্বারা সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন যে, হে বন্ধুগণ! তোমরা আমায় রক্ষা কর, আমি কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিব না। যিনি যাহা আমার উদ্দেশে প্যারীবাবুর নিকট প্রেরণ করিয়াছেন, তিনি তাহা অবিলম্বে ফেরৎ লইবেন। আমার ঋণ আমিই পরিশোধ করিব। আমার ঋণের জন্য তোমাদিগকে কোন চিন্তা করিতে হইবে না। পূর্ব্বাপেক্ষা আমার ঋণ অনেক কমিয়াছে; যাহা অবশিষ্ট আছে, আমিই শোধ করিতে পারিব। দেখ, বিদ্যাসাগরের তুল্য নিঃস্বার্থ নির্লোভ লোক প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় নাই।
সন ১২৭৬ সালের আষাঢ় মাসে বীরসিংহায় একটী বিধবা ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণ-কার্য্য সমাধা হয়। বর শ্রীমুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, নিবাস ক্ষীরপাই; তৎকালে বর কেঁচকাপুর স্কুলের হেড্ পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন। কন্যা শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী, নিবাস কাশীগঞ্জ। অগ্রজ মহাশয় বাটী আগমন করিলে পর, ক্ষীরপাই গ্রামের সম্ভ্রান্ত লোক হালদার মহাশয়েরা অগ্রজের নিকট আসিয়া বলেন যে, মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের ভিক্ষাপুত্র, ইনি বিধবাবিবাহ করিলে আমরা অতিশয় দুঃখিত হইব। হালদার বাবুরা অতি কাতরতা পূর্ব্বক বলিলে, দাদা তাঁহাদিগকে উত্তর করেন, “আপনাদের অনুরোধে আমি এই বিবাহের কোন সংস্রবে থাকিব না। আপনারা উভয়কে উপদেশপ্রদানপূর্বক সমভিব্যাহারে লইয়া যান। উহারা উভয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কলিকাতা গিয়াছিলেন; তথা হইতে আসিয়া এখানে যে রহিয়াছেন, তাহা আমি জানিতাম না; শম্ভুর নিকট শুনিলাম, ইহারা কলিকাতায় গিয়া নারায়ণের পত্র লইয়া এখানে আসিয়া, শম্ভু কে ঐ পত্র দিয়াছেন। তাহাতেই সে ইহাদিগকে বাটীতে রাখিয়া, ইহাদের বিবাহের উদ্যোগ পাইতেছে। অদ্য আপনাদের সম্মুখেই বিদায় করা হইবে।” কিয়ৎক্ষণ পরে উহারা বাটী হইতে বহিষ্কৃত হইল বটে, কিন্তু উহারা হালদারদের অবাধ্য হইল। বীরসিংহাস্থ কয়েকজন প্রাচীন লোক, মধ্যমাগ্রজ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, রাধানগরীনিবাসী কৈলাসচন্দ্র মিশ্র প্রভৃতি উহাদিগকে আশ্রয় দিয়া, বাটীর অতি সন্নিহিত অপর এক ব্যক্তির বাটীতে রাখিয়া, উহাদের বিবাহ-কার্য্য সমাধা করেন। এই বিবাহে অগ্রজ, আন্তরিক কষ্টানুভব করেন এবং প্রকাশ করেন, “গতকল্য ক্ষীরপাই গ্রামের হালদারদিগকে বলিয়াছিলাম যে, আমি এই বিবাহের কোনও সংস্রবে থাকিব না। কিন্তু তোমরা তাহাদের নিকট আমাকে মিথ্যাবাদী করিয়া দিবার জন্য, এই গ্রামে এবং আমার সম্মুখস্থ ভবনে বিবাহ দিলে। ইহাতে আমার যতদূর মনঃকষ্ট দিতে হয়, তাহা তোমরা দিয়োছ। যদিও তোমাদের একান্ত বিবাহ দিবার অভিপ্রায় ছিল, তাহা হইলে ভিন্ন গ্রামে লইয়া গিয়া বিবাহ দিলে, এরূপ মনঃকষ্ট হইত না। যাহা হউক, আমি তাহাদের নিকট মিথ্যাবাদী হইলাম।” কনিষ্ঠ সহোদর ঈশানচন্দ্র উত্তর করিলেন, “উক্ত হালদার বাবুদের সমক্ষে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, শাস্ত্রানুসারে এই বিবাহ দেওয়া বিধেয় কি না? তাহাতে আপনি উত্তর করিলেন, ইহা শাস্ত্রসম্মত ও ন্যায়ানুগত বলিয়া আমি স্বীকার করি; কিন্তু হালদার বাবুদের মনে দুঃখ হইবে।” ইহাতে ঈশান-ভায়া উত্তর করিলেন, “লোকের খাতিরে এই সকল বিষয়ে পরাঙ্মুখ হওয়া ভবাদৃশ ব্যক্তির পক্ষে দূষণীয়।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় ক্রোধাভরে বলিলেন, “অদ্য হইতে আমি দেশ পরিত্যাগ করিলাম।” তিনি কয়েক দিবস দেশে অবস্থিতি করিয়া বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, রাখাল-স্কুল, বালিকাবিদ্যালয়, দেশস্থ ও বিদেশস্থ লোকের ও বিধবাবিবাহকারীদের মাসহরা প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিয়া, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন। মৃত্যুর পাঁচ ছয় বৎসর পূর্ব্বে বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, বালিকাবিদ্যালয়, প্রভৃতির পুনঃস্থাপনজন্য দেশে যাইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিতেন; কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্যবশতঃ নানাকার্য্যে ব্যস্ততাপ্রযুক্ত ও অসুস্থতাজন্য দেশে শুভাগমন করিতে পারেন, নাই।
বাঙ্গালা ১২৭৬ সালের পূর্ব্বে, রাধানগর গ্রামবাসী জমিদার বাবু উমাচরণ চৌধুরী প্রভৃতির সহিত বৈঁচি-নিবাসী জমিদার বিহারীলাল মুখোপাধ্যায়ের ঋণগ্রহণ ও বিষয়-কর্ম্ম উপলক্ষে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত বিহারী বাবুর পরিচয়, প্রণয় ও বিশেষ হৃদ্যতা জন্মে। এক সময়ে বিহারীবাবু কলিকাতায় আসিয়া কথাপ্রসঙ্গে অগ্রজকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়! আমি অপুত্রক, স্ত্রীর মনে যদি কষ্ট হয়, একারণে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিতে আমার ইচ্ছা নাই। অতএব আমি পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিব, অভিপ্রায় করিয়াছি, নতুবা আমার বিষয়-সম্পত্তি অকারণ নষ্ট হইয়া যাইবে এবং আমাদের নাম লোপ হইবে।” ইহা শ্রবণ করিয়া তিনি বলিলেন, “যদি আমার মত গ্রহণ করেন, তবে আমার মতে দত্তকপুত্র না লইয়া, আপনার যাবতীয় সম্পত্তি দেশের হিতকর কার্য্যে সমর্পণ করুন। তাহাই কর্ত্তব্য ও তাহাই পরমধর্ম্ম, এবং তাহাই বহুকালস্থায়ী; কোন সভ্য রাজার সময়ে ইহার লোপ হইবে না। দাতব্য-বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় এবং অসহায় রোগীদিগের আহার ও থাকিবার স্থান দান করা এবং নিজ গ্রামের ও তাহার পার্শ্বস্থ গ্রাম সমূহের অন্ধ, পঙ্গু ও অনাথ প্রভৃতি নিরুপায় লোকদিগের দুঃখমোচনে যাবতীয় সম্পত্তি নিয়োজিত করা প্রধান ধর্ম্ম।” স্বৰ্গীয় বিহারীলাল বাবু আহলাদের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই প্রস্তাবে অনুমোদন করিয়া, তাঁহাকে দ্বিতীয় উইলের আদর্শ প্রস্তুত করিতে অনুরোধ করেন। তদনুসারে তিনি একখানি নূতন উইল প্রস্তুত করাইয়া, বহুদশী উকিল-বাবুদিগকে দেখান, পরে ঐ আদর্শ উইলখানি বিহারীবাবুকে দেন। তিনি উহা পাঠ করিয়া, পরম আহ্বলাদিত হইলেন। সন ১২৭৭ সালের ২৫ শে শ্রাবণ ঐ উইল প্রস্তুত করিয়া যথারীতি রেজেষ্টারি করাইলেন। ইহার কিছুদিন পরে বিহারীলাল বাবুর মৃত্যু হইলে, ঐ উইলের সর্ভানুসারে তাঁহার বনিতা শ্রীমতী কমলেকামিনী দেবী দাতব্য-স্কুল, ডিস্পেনসারি ও হাঁসপাতাল জন্য সন ১২৮৪ সালের ৫ই শ্রাবণ, ইং ১৮৭৭ সালের ২৯ শে জুলাই, এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা ঐ বৎসরের শেষ পর্য্যন্ত হুগলি জেলার কালেক্টারিতে আমানত করিলেন এবং ঐ বৎসর হইতে দাতব্য এণ্টান্স স্কুল, ডিসপেনসারি ও হাসপাতালের কার্য্য আরম্ভ হয়। ঐ কার্য্য আজও পর্য্যন্ত অবাধে চলিয়া আসিতেছে। অপিচ, দাতার উইল অনুসারে ভোগাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত অভাবে, যাবতীয় সম্পত্তি গবর্ণমেণ্ট নিজ হন্তে তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া, দাতার ইচ্ছানুরূপ কার্য্য সকল নিষ্পন্ন করিবেন; এবং ঐ বিষয় প্রিভি কৌন্সেল পর্যন্ত যাইয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে। উইলের কোন অংশ রহিত কি পরিবর্ত্তিত হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়, পরোপকারার্থে নিজ ধন ব্যয় করিতে যেরূপ কাতর ছিলেন না, অন্য ব্যক্তিকেও সেইরূপ কার্য্যে ব্রতী করিতেও তাঁহার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। স্বতঃপরতঃ পরোপকারে যেরূপ ধর্ম্ম, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয় অনুভব করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। এই বিবরণটী বৈঁচিগ্রামনিবাসী বাবু গোকুলচাঁদ বসু মহাশয়ের প্রমুখাৎ অবগত হইয়াছি।
সন ১২৭৬ সালের শ্রাবণের শেষে অগ্রজ মহাশয়, জননীদেবীকে কাশীবাস করিবার অন্য প্রেরণ করেন। জননী-দেবী কাশীতে পিতৃদেবের নিকটে কতিপয়দিবস অবস্থিতি করেন; তদনন্তর অন্যান্য তীর্থস্থান পর্য্যটন করিয়া, পুনর্ব্বর কাশীতে সমুপস্থিত হন। মাতৃদেবী, পিতৃদেবকে বলেন, “এখন হইতে এস্থলে অবস্থিতি করা অপেক্ষা আমরা দেশে অবস্থিতি করিলে, অনেক অক্ষম দরিদ্র লোককে ভোজন করাইতে পারিব। দেশে বাস করিয়া প্রতিবাসিবর্গের অনাথ শিশুগণের আনুকূল্য করিতে পারিলে, আমার মনের সুখ হইবে। আমার মৃত্যুর এখনও বিলম্ব আছে, আমি আমার সময় বুঝিয়া আসিব।” আরও তৎকালে পিতৃদেবকে স্পষ্ট করিয়া বলেন যে, “আপনাকে এখনও অনেক দিন বাঁচিতে হইবে, কায়িক অনেক কষ্ট পাইতে হইবে, এত তাড়াতাড়ি তীর্থস্থলে আগমন করা যুক্তিসিদ্ধ হয় নাই। ফলতঃ আপনার মত আমাকে কায়িক কোনও কষ্টানুভব করিতে হইবে না। আমাকে আপনার পরলোকযাত্রা করিবার অনেক পূর্ব্বেই পরলোকে গমন করিতে হইবে, ইহা নিশ্চয় জানিবেন।” জননী-দেবী কাশীতে কয়েক দিবস বাস করিয়া, পুনর্বার দেশে প্রত্যাগমন করেন। বাটীতে সমুপস্থিত হইয়া শ্রাদ্ধাদি-কার্য্য সমাপনান্তে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, ব্রাহ্মণগণ ও গ্রামস্থ লোকদিগকে ভোজন করাইলেন। বাটীতে যতদিন ছিলেন, ততদিন প্রাতঃকাল হইতে সমস্ত পাক করিয়া দরিদ্রদিগকে ভোজন করাইয়া, স্বয়ং যৎসামান্য আহার করিতেন। মোটা মলিন বস্ত্র পরিধান করিতেন। যে সকল অনাথ পীড়িত, অগ্রজের দাতব্য-চিকিৎসালয়ে আসিত, তাহাদের শুশ্রূষ্যাদিতে বিশিষ্টরূপ যত্নবতী ছিলেন। বাটীতে যে সকল বিদেশীয় বালকবৃন্দ ভোজন করিয়া স্কুলে অধ্যয়ন করিত, সেই সকল বালককে স্বয়ং পরিবেশন করিতেন। যে দিবস জননী স্থানান্তরে যাইতেন, সেই দিবস বালকগণের ভোজনের সুবিধা হইত না। জননী, বাটীর ও বিদেশের বালক সকলকে সমভাবে পরিবেশন করিতেন; কখনও ইতারবিশেষ করিতেন না। একারণ, এ প্রদেশে সকলেই অদ্যাপি জননী-দেবীর প্রশংসা করিয়া থাকেন। দেশস্থ সকলে বলিয়া থাকেন যে, কর্ত্রী ঠাকুরাণীর ঐ পুণ্যপ্রভাবেই বিদ্যাসাগর মহাশয় উহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। দেশের যে কোন জাতির গৃহে কোনরূপ বিপদ্ উপস্থিত হইলে বা কেহ মরিলে, জননী মান আহার পরিত্যাগ করিয়া, তাহাদের সঙ্গে রোদনে প্রবৃত্ত হইতেন। তিনি দরিদ্রদিগকে ভোজন করানই প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া মনে করিতেন। যাহাতে অল্পবয়স্ক বিধবা বালিকার বিবাহ হয়, তিনি তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ ইচ্ছা প্রকাশ করিতেন। অল্পবয়স্ক বিধবাকে দেখিলে, নেত্রজলে তাঁহার বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যাইত। অনেকে বলিয়া থাকেন, অগ্রজ মহাশয় সমস্ত মাতৃগুণ অধিকার করিয়াছেন। দাদাও ঐরূপ বালিকাকে বিধবা দেখিলে, চক্ষের জলে প্লাবিত হইতেন।
১৮৬৯ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় বেথুন বালিকাবিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ পরিত্যাগ করেন।নারায়ণের বিধবাবিবাহ।
সন ১২৭৭ সালের ২৭শে শ্রাবণ বৃহস্পতিবার অগ্রজ মহাশয়ের একমাত্র পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, খানাকুলকৃষ্ণনগরনিবাসী শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা-তনয়া শ্রীমতী ভবসুন্দরী দেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। অগ্রজ মহাশয়, বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক; এতাবৎকাল উদেযাগ করিয়া, সর্ব্বস্বান্ত হইয়া, অন্যান্য লোকের বিধবাবিবাহ দিয়া আসিতেছিলেন; আমাদের বংশে অদ্যাপি বিবাহের কারণ ঘটে নাই। এই জন্য সকল স্থানের লোকেই বলিত, বিদ্যাসাগর মহাশয় পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গেন, নিজের বেলায়, ঠিক আছেন। এক্ষণে তাঁহার পুত্র নারায়ণের বিবাহ হওয়ায়, অগ্রজ মহাশয়কে আর কাহারও নিকট নিন্দার ভাজন হইতে হইল না। ঐ পাত্রীর জননী সারদাদেবী অতিশয় বুদ্ধিমতী। স্বীয় কন্যার পুনর্ব্বার বিবাহ দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া কাশীবাস করিবার মানসে, প্রথমতঃ আমার নিকট আগমন করেন। ইনি নিকষ কুলীনের বংশোদ্ভবা কন্যার মাতুল, চন্দ্রকোণানিবাসী নীলরতন চট্টোপাধ্যায়। কন্যার প্রথম বিবাহ কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়দের বাটীতে হইয়াছিল। উক্ত সারদাদেবী, তনয়াসহ বীরসিংহায় আমার বাটীতে আগমন করিয়া, আমাকে উহার বিবাহের কথা ব্যক্ত করেন। তাঁহাদিগকে আমার বাটীতে রাখিয়া, অগ্রজকে ঐ সংবাদ দিই। অগ্রজ মহাশয়, অন্য এক পাত্র স্থির করিয়া, কিছুদিন পরে আমায় পত্র লিখেন, “তুমি ঐ পাত্রীসহ পাত্রীর মাতাকে প্রেরণ করিবে।” ইতিমধ্যে নারায়ণ বাবাজী, কোন কার্য্যোপলক্ষে বীরসিংহায় আসিয়া, কথাবার্ত্তাতে পরম প্রীতিলাভ করিয়া, আমার নিকট নিজের বিবাহের অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠাবধু দেবী প্রভৃতি এ বিষয়ে অসন্মতি প্রকাশ করায়, উভয় পক্ষের মন্তব্য-পত্র-সঙ্গ ঐ পাত্রী ও উহার মাতাকে কলিকাতায় অগ্রজের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। কয়েক দিন পরে নারায়ণও কলিকাতায় গমন করে। পরে এই পরিণয় কার্য্য সম্পন্ন হইলে পর, জ্যেষ্ঠা-বধূদেবী পরম আহলাদিত হইয়াছিলেন। সকলে কলিকাতায় উপস্থিত হইলে পর, উভয় পক্ষের সম্মতি ও আগ্রহাতিশয়ে পরম প্রীতি লাভ করিয়া পরিণয়-কার্য্য সমাধা করাইয়া, অগ্রজ মহাশয় আমাকে যে পত্র লিখেন, তাহা নিয়ে উদ্ধৃত হইল।
শ্রীশ্রীহরিঃ
শরণং।
“শুভাশিষঃ সন্ত-
২৭শে শ্রাবণ বৃহস্পতিবার, নারায়ণ, ভবসুন্দরীর পাণিগ্রহণ করিয়াছে। এই সংবাদ মাতৃদেবী প্রভৃতিকে জানাইবে।
ইতিপূর্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবাবিবাহ করিলে আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়াছে; আমার ইচ্ছা বা অনুরোধে করে নাই। যখন শুনিলাম, সে বিধবাবিবাহ করা স্থির করিয়াছে এবং কন্যাও উপস্থিত হইয়াছে, তখন সে বিষয়ে সম্মতি না দিয়া প্রতিবন্ধকতাচরণ করা, আমার পক্ষে কোনও মতেই উচিত কর্ম্ম হইত না। আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্তক; আমরা উদেযাগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি, এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী-বিবাহ করিলে, আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। ভদ্রসমাজে নিতান্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতাম। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া, আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে। বিধবাবিবাহ-প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম্ম। এজন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নাহি। সে বিবেচনায় কুটুম্ববিচ্ছেদ অতিসামান্য কথা। কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, এই ভয়ে যদি আমি পুত্রকে তাহার অভিপ্রেত বিধবাবিবাহ হইতে বিরত করিতাম, তাহা হইলে আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেহ হইত না। অধিক আর কি বলিব, সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করাতে, আমি আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিয়াছি। আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নাহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সন্ধুচিত হইব না। অবশেষে আমার বক্তব্য এই যে, সমাজের ভয়ে বা অন্য কোন কারণে নারায়ণের সহিত আহার-ব্যবহার করিতে যাঁহাদের সাহস বা প্রবৃত্তি না হইবে, তাঁহারা স্বচ্ছন্দে তাহা রহিত করিবেন, সে জন্য নারায়ণ কিছুমাত্র দুঃখিত হইবে, এরূপ বোধ হয় না, এবং আমিও তজ্জন্য বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হইব না। আমার বিবেচনায় এরূপ বিষয়ে সকলেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ, অন্যদীয় ইচ্ছার অনুবর্ত্তী বা অনুরোধের বশবর্ত্তী হইয়া চলা, কাহারও উচিত নহে। ইতি ৩১শে শ্রাবণ।
সন ১২৭৭ সালের ২রা ফাল্গুন, কাশীবাসী পিতৃদেবের পীড়ার সংবাদে অগ্রজ মহাশয় অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইলেন এবং অবিলম্বে বীরসিংহাস্থ মধ্যম সহোদর ও আমাকে পত্র লিখিলেন যে, ত্বরায় আমি কাশীযাত্রা করিলাম। তোমরা জননীদেবীকে সমভিব্যাহারে করিয়া, পত্রপাঠমাত্র কাশী যাত্রা করিবে। আমি ও মধ্যম সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন মহাশয়, অগ্রজ মহাশয়ের আদেশ-পত্র পাইবামাত্র, জননী-দেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া, বীরসিংহ বাটী হইতে কাশীধামে, যাত্রা করিলাম। পিতৃভক্তিপরায়ণ অগ্রজ মহাশয়, দুই সপ্তাহ কাশীতে অবস্থিতি করিয়া, শুশ্রুষাদিকার্য্যে নিরন্তর ব্যাপৃত থাকায়, পিতৃদেব ক্রমশঃ আরোগ্যলাভ করিতে লাগিলেন। কাশীর মদনপুরা বাঙ্গালী-টোলার মাতঙ্গীপদ ভট্টাচার্য্যের বাটী অতি সঙ্কীর্ণ ও জঘন্য স্থান; তজ্জন্য অগ্রজ মহাশয় সোণারপুরস্থিত সোমদত্তের একটি প্রশস্ত বাটী ভাড়া করিলেন। মাতঙ্গীপদ ভট্টাচার্য্য দেখিলেন, ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আমার বাটী পরিত্যাগ করিবেন; ইহাঁর পুত্র বিদ্যাসাগর অন্য বাটী ভাড়া করিলেন। আমার বাটী পরিত্যাগ করিলে, আর বিদ্যাসাগরের পিতার নিকট পূর্ব্বের ন্যায় প্রাপ্তির আশা রহিল না। ইহা দেখিয়া মাতঙ্গীপাদ, পিতৃদেবকে অনেক উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন। পিতৃদেব, কাশীতে প্রাতঃকাল হইতে সমস্ত দিবস কেদারঘাটে জপতপ সমাপনান্তে, দেবালয় পর্য্যবেক্ষণপূর্ব্বক সন্ধ্যার সময়ে বাসায় আগমন করিয়া, পাকাদিকার্য্য সম্পন্ন করিতেন। গৃহস্বামী মাতঙ্গীপদ ও তাঁহার পত্নী, সমস্তই আত্মসাৎ করিত। পৌরহিত্য-কার্য্য-কলাপের সময়, পুরোহিত মাতঙ্গীপদ, হস্তে কুশ দিয়া, কৌশল-ক্রমে স্বর্ণ-মোহর দক্ষিণ লইয়া ক্রমশঃ যথেষ্ট স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুত করিয়াছিলেন। সর্ব্বদা নানাপ্রকার ক্রিয়া করাইয়া, তিনি বিস্তর উপায় করিতেন; কিন্তু স্বতন্ত্র বাটীতে বাসা করিলে, এরূপ বশীভুত করিয়া গ্রহণ করিতে পারিবেন না; এজন্য উক্ত পুরোহিত, পিতৃদেবকে নির্জ্জনে বিস্তর উপদেশ দিয়া বলেন, “তোমার পত্নী ও পুত্রগণ বাটী প্রস্থান করুন। তীর্থ-স্থানে স্ত্রী-পুত্র লইয়া গৃহী হইয়া অবস্থিতি করা অতি অকর্ত্তব্য। তুমি আমার বাটীতে নিশ্চিন্ত হইয়া যেমন অবস্থিতি করিতেছ, সেইরূপই থাক। তোমার পুত্রগণ নাস্তিক, উহাদের সংস্রবে থাকা উচিত নয়।” পিতৃদেব, পুরোহিতকে উত্তর করিলেন, “আমার পুত্র ঈশ্বর আমায় যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিয়া থাকে। সেই সৎপুত্র আমার কষ্ট দেখিয়া, পৃথক্ প্রশস্ত বাটীতে আমায় লইয়া গেলে যদি সন্তুষ্ট হয়, আমার তাহাই করা কর্ত্তব্য। এক্ষণে আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, উপযুক্ত পুত্রের কথা রক্ষা করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য।” ইহা বলিয়া, পুরোহিত ও তৎপত্নীর উপদেশে কর্ণপাত না করিয়া, অগ্রজ মহাশয়ের সহিত নূতন ভাড়াটিয়া ভবনে গমন করিলেন। তৎকালে কাশীস্থ দলপতি ব্রাহ্মণগণ বাসায় উপস্থিত হইয়া অগ্রজকে বলেন যে, “আপনার পিতা কাশীতে অনেক প্রকার কার্য্য করিয়াছেন। আমরা ইহাঁর নিকট অনেক খাইয়াছি, অনেক টাকা ও তৈজসপত্রাদি সময়ে সময়ে গ্রহণ করিয়াছি। আপনার পিতা পরমধার্ম্মিক ও ক্রিয়াবান্। পিতৃপুণ্য-প্রভাবে আপনি জগদ্বিখ্যাত হইয়াছেন। আপনি আমাদিগকে পাঁচ সাত হাজার টাকা দান করিয়া নাম ক্রয় করুন।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় তাঁহাদিগকে উত্তর করেন, “আপনারা পিতৃদেবের নিকট পাইয়া থাকেন, তাঁহাকে বলুন, তিনি আপনাদিগকে যেরূপ দিয়া থাকেন, সেইরূপই দিবেন, তাহার ব্যতিক্রম হইবে না।” ইহা শুনিয়া কাশীবাসী বাঙ্গালী দলপতিগণেরা বলেন, “বড় লোক কাশী-দর্শনার্থে আগমন করিলে, আমরা তাঁহাদের নিকট যাইয়া বলিলেই, তাঁহারা আমাদিগকে প্রচুর অর্থ দান করিয়া থাকেন, তাহাতেই আমাদের কাশীবাস হইতেছে। তুমি নামজাদা লোক, তোমাকে অবশ্য দান করিতে হইবে।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় উত্তর করেন যে, “আমি কাশী দর্শন করিতে আসি নাই, পিতৃদর্শনের জন্য আসিয়াছি। আমি যদি আপনাদের মত ব্রাহ্মণকে কাশীতে দান করিয়া যাই, তাহা হইলে আমি কলিকাতায় ভদ্রলোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিব না। আপনার যতপ্রকার দুষ্কর্ম্ম করিতে হয়, তাহা করিয়া, দেশ পরিত্যাগ-পূর্ব্বক কাশীবাস করিতেছেন। এখানে আছেন বলিয়া, আপনাদিগকে যদি আমি ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিয়া বিশ্বেশ্বর বলিয়া মান্য করি, তাহা হইলে আমার মত নরাধম আর নাই।” ইহা শুনিয়া ব্রাহ্মণের বলেন, “আপনি কি তবে কাশীর বিশ্বেশ্বর মানেন না?” ইহা শুনিয়া দাদা উত্তর করিলেন, “আমি তোমাদের কাশী বা তোমাদের বিশ্বেশ্বর মানি না।” ইহা শুনিয়া কেশেল ব্রাহ্মণের ক্রোধান্ধ হইয়া বলেন, “তবে আপনি কি মানেন?” তাহাতে অগ্রজ উত্তর করেন, “আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা, উপস্থিত এই পিতৃদেব ও জননী-দেবীবিরাজমান। দেখ, জননীদেবী আমাকে দশ মাস গর্ভে ধারণা করিয়া কতই কষ্ট ভোগ করিয়াছেন। বাল্যকালে আমাকে স্তনদুগ্ধ পান করাইয়া পরিবদ্ধিত করিয়াছেন। আমার জন্য কতই কষ্ট ভোগ করিয়াছেন, কতই যত্ন পাইয়াছেন। আমি পীড়িত হইলে জননী, আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া, কিসে আমি আরোগ্য লাভ করি, নিরন্তর এই চিন্তায় নিমগ্ন হইতেন। পিতৃদেব কত কষ্ট স্বীকার করিয়া আমাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছেন, বাল্যকালে অন্ন-বস্ত্র। দিয়াছেন। পিতামাতার আন্তরিক যত্নেই। আমি পরিবর্দ্ধিত হইয়াছি। পিতা, বাল্যকালে আমাকে স্কন্ধে আরোহণ করাইয়া, লেখাপড়া শিক্ষার জন্য কলিকাতায় লইয়া গিয়াছিলেন। তথায় আমার পীড়া হইলে, মলমূত্রাদি পরিষ্কার করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং এতাদৃশ জনক-জননীকেই আমি পরমেশ্বর জ্ঞান করি, এবং সেইরূপই আমি শ্রদ্ধা-ভক্তি করিয়া থাকি। ইহাঁদের উভয়কে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই, আমি আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিব। ইহাঁদিগকে অসন্তুষ্ট করিলে, বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইবেন। পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট করিলে, সকল দেবতাই আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইবেন। দেখুন, আপনারা শ্রাদ্ধের সময় কি বলিয়া থাকেন। অর্থাৎ পিতা স্বৰ্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমং তপঃ, পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রায়ন্তে সর্বদেবতা।
ব্রাহ্মণেরা কিছু না পাইয়া, ক্রোধান্ধ হইয়া প্রস্থান করেন। ১৫ই ফাল্গুন অগ্রজ মহাশয়, জননী-দেবী, মধ্যম ও তৃতীয় সহোদরকে পিতৃদেবের শুশ্রূষাদিকার্য্য নির্ব্বাহের জন্য রাখিয়া, স্বয়ং কলিকাতা গমন করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই পিতৃদেব সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করেন। জননীদেবী, ফাল্গুন ও চৈত্র দুই মাস কাল কাশীবাস করিয়া, অগ্রজকে অনুরোধ করিয়া, কয়েকটা নিরুপায়া হতভাগিনী স্ত্রীলোকের অন্নকষ্ট নিবারণ করেন। তাহাতে ঐ অশীতিবর্ষবয়স্ক স্ত্রীলোকেরা পরমসুখে কাশীবাস করেন। জননীদেবী, ফান্তন ও চৈত্র দুইমাস কাল কাশীবাস করিয়া, বিষম বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হইয়া, ১২৭৭ সালের চৈত্র-সংক্রান্তির দিবস স্বামী, পুত্র, পৌত্র ও দৌহিত্রাদি রাখিয়া কাশীলাভ করেন। জননীর মৃত্যুসংবাদে অগ্রজ মহাশয় যৎপরোনাস্তি শোকাভিভূত হয়েন। দিবারাত্রি রোদন করিয়া সময়াতিপাত করিতেন। দশাহে যথাশাস্ত্র কলিকাতার অতি সন্নিহিত কাশীপুরস্থ গঙ্গাতীরে চন্দনধেনু করিয়া ঔৰ্দ্ধদৈহিক শ্রাদ্ধকার্য্য সমাধা করেন। শাস্ত্রানুসারে এক বৎসর কাল শোকচিহ্নস্বরূপ স্বহস্তে নিরামিষ পাক করতঃ এক-সন্ধ্যা ভোজন করিয়া, শরীরধারণ করিতেন। চর্ম্মপাদুকা, আতপত্র, পালঙ্গ প্রভৃতি সুখসেব্য (দ্রব্য ও বিষয়) গুলি এক বৎসরের জন্য পরিত্যাগ করিলেন। কয়েকমাস বিষয়-কার্য্য পরিত্যাগপূর্বক নির্জনে উপবিষ্ট হইয়া রোদন করিতেন। পিতৃদেবের শুশ্রূষাদি-কার্য্য-নির্ব্বাহার্থে আমাকে কাশী পাঠান। জননী কাশীলাভ করিয়াছেন, একারণ দাদা আপাততঃ কাশী যাইতে ইচ্ছা করিলেন না। কাশীর বাঙ্গালীদলস্থ ব্রাহ্মণদিগকে কিছু দান করেন নাই, তজ্জন্য তাঁহারা শক্রতা করিয়া পুরোহিত মাতঙ্গাপদ ন্যায়রত্নকে পৌরহিত্য-কার্য্য নিম্পন্ন করিতে নিবারণ করেন; সুতরাং পিতৃদেব, রামমাণিক্য তর্কালঙ্কার মহাশয়কে নূতন পুরোহিত স্থির করিয়া, স্বীয় বাসায় স্থায়ী করেন। নচেৎ দলপতিরা নূতন পুরোহিতকে ভয় দেখাইয়া, ভাঙ্গাইয়া দিবেন। পিতৃদেব, মধ্যে মধ্যে কার্য্যোপলক্ষে বেদপাঠী মহারাষ্ট্ৰীয় ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতেন। জননীর মৃত্যুর পর, অগ্রজ মহাশয় প্রায় দুই বৎসর কাল কাশী গমন করেন নাই।
বহুবিবাহ।
অসুস্থতানিবন্ধন অগ্রজ মহাশয়, সন ১২৭৬।৭৭ দুই বৎসরকাল স্বাস্থ্যরক্ষার মানসে প্রায় বৰ্দ্ধমানে অবস্থিতি করিতেছিলেন। তথায় দেশব্যাপক ম্যালেরিয়া জরের বিশেষ প্রাদুর্ভাবপ্রযুক্ত বৰ্দ্ধমান পরিত্যাগপূর্বক, ৭৮ সালের বৈশাখ মাস হইতে কলিকাতার সন্নিহিত কাশীপুরের গঙ্গাতীরস্থ বাবু হীরালাল শীলের এক ভবনে মাসিক ১৫০৲ টাকা ভাড়া দিয়া, কয়েক বৎসর অবস্থিতি করেন। এই সময়ে কলিকাতাস্থ সনাতন-ধর্ম্মরক্ষিণী সভার সভ্য মহাশয়েরা, বহুবিবাহের নিবারণ-বিষয়ে বিলক্ষণ উদ্যোগী হইয়াছিলেন। তাঁহাদের নিতান্ত ইচ্ছা, এই অতি জঘন্য, অতি নৃশংস প্রথা রহিত হইয়া যায়। এই প্রথা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধর্ম্মের ব্যতিক্রম ঘটবে কি না, এই আশঙ্কার অপনয়ন জন্য, সভার সভ্য মহোদয়েরা ধর্ম্মশাস্ত্র-ব্যবসায়ী প্রধান প্রধান পণ্ডিতের মত গ্রহণ করিতেছিলেন এবং রাজদ্বারে আবেদন করিবার অপরাপর উদ্যোগ দেখিতেছিলেন। তাঁহারা সাদভিপ্রায়-প্রণোদিত হইয়া, যে অতি মহৎ দেশহিতকর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, হয় ত সে বিষয়ে তাঁহাদের কিছু সাহায্য হইতে পরিবে, এই ভাবিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়, বহুবিবাহ নামক পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। ইহা প্রকাশিত হইবার, অব্যবহিত পরে, সন ১২৭৮ সালের ১লা শ্রাবণ প্রতিবাদী মুরশিদাবাদ-নিবাসী শ্রীযুত গঙ্গাধর কবিরত্ন, বরিশাল-নিবাসী শ্রীযুত রাজকুমার ন্যায়রত্ন, শ্রীযুত ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, শ্রীযুত সত্যব্রত সামশ্রমী ও শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয় প্রভৃতি কয়েক জন বিখ্যাত পণ্ডিত পুস্তক লিখিয়া প্রতিবাদ করেন যে, বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত; -শাস্ত্রবিরুদ্ধ নহে। সুতরাং দাদা, তর্কবাচস্পতি মহাশয় প্রভৃতি প্রতিবাদীদের প্রকাশিত মত খণ্ডন করিয়া, বহুবিবাহ যে অতি জঘন্য, অতি নৃশংস ব্যবহার ও শাস্ত্র-বিরুদ্ধ, ইহা হইতে অশেষবিধ অনর্থ সংঘটন হইতেছে, এই সমুদয় দেখাইয়া, যত্ন ও পরিশ্রম-সহকারে শাস্ত্রোদ্ধৃত বচনসমূহ সঙ্কলন করিয়া মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন।
শ্রীযুত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয় দেশবিখ্যাত অধ্যাপক। ইনি পূজ্যপাদ অগ্রজ মহাশয়ের পরমবন্ধু ও পরম আত্মীয়। ইহাঁদের পরস্পর বাল্যকাল হইতে সম্ভাব ছিল, ইহা সকলেই অবগত আছেন। এক্ষণে এতদুপলক্ষে এরূপ যে মনান্তর ঘটবে, তাহা স্বপ্নের অগোচর। পাঁচ ছয় বৎসর পূর্বে জঘন্য বহুবিবাহ-নিবারণ-মানসে ব্যবস্থাপক-সমাজে যে আবেদন হয়, তাহা বাচস্পতি মহাশয় স্বয়ং আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া স্বাক্ষর করিয়াছিলেন। এক্ষণে, ইহাতে সাধারণে বাচস্পতি মহাশয়ের প্রতি দোষারোপ করিতে পারেন; কিন্তু এ বিষয় তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “বহুবিবাহ অতি কুপ্রথা, শাস্ত্রবিরুদ্ধ না হইলেও এই প্রথা হইতে জগতের নানাপ্রকার অনিষ্ট হইতেছে এবং আমাদের সমাজের ততদূর বল নাই যে, সমাজ হইতে এই কুপ্রথা নিবারণ হইতে পারে; এই কারণে রাজদ্বারে আবেদনসময়ে ঐ আবেদন-পত্রে স্বাক্ষর করি। কিন্তু তা বলিয়া ইহা যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহা আমি বলিতে পারি না।” এই কারণে দাদার সহিত তাঁহার বিচার হয়। এই বিচারে অগ্রজ মহাশয় বহুবিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন করেন।
১৮৬৯ খৃঃ অব্দে মল্লিনাথের টীকাসহিত মেঘদূতের পাঠাদিবিবেক মুদ্রিত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের পাঠের জন্য ১৮৭১ খৃঃ অব্দে উত্তরচরিত ও অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের স্বয়ং টীকা করিয়া মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন।
অগ্রজ মহাশয়, জননীদেবীর মৃত্যুর পর অবধি দেশে আগমন করেন নাই সত্য বটে; কিন্তু জন্মভূমির লোকের হিতকামনায় দাতব্য-চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়া দিয়াছেন, ডাক্তারখানায় সকলেই বিনা মূল্যে ঔষধ পাইয়া-থাকেন। এতদ্ব্যতীত যে সকল ভদ্র-কুলাঙ্গনা ডাক্তারখানায় না যান, প্রত্যহ একবার তাহাদিগকে এবং গ্রামের কি ভদ্র কি অভদ্র সকলের বাটীতে রোগীগণকে দেখিতে যাইবার জন্য, বিনাভিজীটে ডাক্তারের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ৭৭।৭৮।৭৯।৮০ এই কয়েক বৎসর দেশব্যাপক ম্যালেরিয়া-জ্বরের প্রাদুর্ভাব হইলে, ডাক্তারখানার যেরূপ ব্যয় নির্দিষ্ট ছিল, তদপেক্ষা চতুর্গুণ ব্যয়বাহুল্যের ব্যবস্থা করিলেন। দরিদ্র রোগীগণ পথ্যের দরুণ সাগু, মিছারী প্রভৃতি পাইত, অনাথ ব্যক্তিদিগের অন্নের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। দেশস্থ যে সকল নিরুপায়দিগকে মাসহরা দিতেন, তাহা যথাসময়ে পাঠাইতে বিস্মৃত হন। নাই। কেবল ম্যালেরিয়া-নিবন্ধন বিদ্যালয়ের ছাত্রগণ উপস্থিত হইতে না পারায়, অগত্যা বন্ধ করিতে বাধ্য হইলেন।
কর্ম্মটার।
কলিকাতায় সর্বদা অবস্থিতি করিলে, দাদার শরীর সুস্থ হওয়া দুষ্কর। কারণ, প্রাতঃকাল হইতে নিরুপায় লোক আসিয়া, কেহ চাকরীর জন্য, কেত সুপারিসপত্রের জন্য, কেহ মাসহরার জন্য, কেহ কন্যার বিবাহের সাহায্যদান জন্য, কেহ বস্ত্রের জন্য, কেহ পুস্তকের জন্য, কেহ বিনা বেতনে পুত্ত্র বা আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতিকে বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করিয়া দিবার জন্য সর্ব্বদা বিরক্ত করিয়া থাকেন। দ্বার অবারিত ছিল, লোকের প্রবেশ-নিবারণ জন্য দ্বারে প্রহরী ছিল না। যাহার যখন ইচ্ছা, বিনা অনুমতিতে বাটী প্রবেশ করিয়া দেখা করিতে পারিত। সচরাচর বড় লোকের দ্বারে যেমন প্রহরী উপস্থিত দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার সে আড়ম্বর ছিল না। সুতরাং প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি নয়টা পর্য্যন্ত, সর্ব্বদা নানাপ্রকারের লোক আসিয়া বিরক্ত করিত। প্রাতঃকাল হইতে সমাগত অধিক লোকের সহ কথাবার্তা ও গল্প করিয়া, রাত্রিতে নিদ্রা হইত না; সুতরাং উদরাময় হইয়া কষ্ট পাইতেন। ইত্যাদি কারণে আত্মীয় বন্ধু ও চিকিৎসকগণের পরামর্শানুসারে, সাঁওতাল পরগণার অন্তঃপাতী কর্ম্মটারে রেলওয়ে ষ্টেশনের অতি সন্নিহিত এক বাঙ্গালা-ঘর ক্রয় করেন। মধ্যে মধ্যে তথায় যাইয়া কিছু সুস্থ থাকিতেন; এজন্য তথায় অবস্থিতি করিতেন। ক্রমশঃ তথায় প্রতিবাসী সাঁওতালগণের সহিত তাঁহার উত্তমরূপ সদ্ভাব ও পরিচয় হইয়াছিল। সাঁওতালদের মধ্যে অনেকে তাঁহার বাগানে মজুরি কার্য্য করিতে আসিত; তাহাদের দৈনিক বেতন কিছু বেশী করিয়া দিতে লাগিলেন। সঁওতালদের সংস্কার ছিল যে, বাঙ্গালীরা লোক ভাল নয়; কিন্তু দাদার উদারতা ও দয়া দেখিয়া, তাহারা সকলেই পরিতোষ লাভ করিয়াছিল। ঐ স্থানীয় লোকের লেখাপড়া শিক্ষার জন্য, তথায় স্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন; এই বিদ্যালয়ে আজও পর্যন্ত মাসিক কুড়ি টাকা ব্যয় করিয়া আসিতেছিলেন। প্রতি বৎসর পূজার সময় কর্ম্মটারের সাঁওতালদের জন্য সহস্র টাকার অধিক বস্ত্র ক্রয় করিয়া বিতরণ করিতেন। শীতকালে জঙ্গলপ্রদেশে অত্যন্ত শীত হয়। সঁওতালদের গাত্রে শীতবস্ত্র নাই দেখিয়া, প্রতি বৎসর যথেষ্ট মোট চাদর ও কম্বল ক্রয় করিয়া তাহাদিগকে বিতরণ করিতেন। শীতকালে যথেষ্ট কমলালেবু ও কলসীখেজুর প্রভৃতি নানাপ্রকার উপাদেয় দ্রব্য কলিকাতা হইতে ক্রয় করিয়া লইয়া যাইতেন, এবং সাঁওতালদিগকে নিকটে বসাইয়া ঐ সকল দ্রব্য খাওয়াইতেন।
সন ১২৭৯ সালের আষাঢ় মাসে অগ্রজ মহাশয়ের মধ্যম দুহিতা শ্রীমতী কুমুদিনীদেবীর বিবাহ হয়। বর শ্রীঅঘোরনাথ চট্টোপাপ্যায়, নিবাস রুদ্রপুর, জেলা চব্বিশ পরগণা।
সন ১২৭৯ সালের মাঘ মাসে কাশী হইতে আমার বাটী যাইবার বিশেষ আবশ্যক হইলে, অগ্রজ মহাশয়কে পত্র লিখি যে, পনর দিবসের জন্য পিতৃদেবের শুশ্রূষ্যাদি কার্য্য নিম্পন্ন করেন, এরূপ কাহাকেও প্রেরণ করিবেন। পত্র পাইয়া তিনি ভাগিনেয় বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়কে পাঠাইবার জন্য স্থির করেন। ঐ সময় তাঁহার জ্যেষ্ঠ জামাতা গোপালচন্দ্র সমাজপতি বহুদিন হইতে কায়িক অসুস্থ ছিলেন; তজ্জন্য দাদা তাহাকে জলবায়ু-পরিবর্ত্তন-মানসে কৃষ্ণনগর পাঠাইয়াছিলেন। তথায় সম্পূর্ণরূপ সুস্থ না হইয়া, কলিকাতায় প্রত্যাগমন করেন। বেণী, কাশী যাইবেন শুনিয়া, গোপালচন্দ্র, অগ্রজ মহাশয়কে বলেন, আমিও বেণীর সঙ্গে কাশী যাইব। এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলে, তিনিও সম্মত হইলেন। জামাতা, বেণীর সহিত কাশী গমন করেন। আমি উহাদিগকে রাখিয়া ২০শে মাঘ কলিকাতায় যাত্রা করি; তথায় দুই চারি দিবস অবস্থিতি করিয়া দেশে গমন করি।
সন ১২৭৯ সালে ২৩শে মাঘ অগ্রজের জ্যেষ্ঠ জামাতা গোপালচন্দ্র সমাজপতি, বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া কাশীপ্রাপ্ত হন। ইহাতে বেণীমাধব, কাশীতে ক্ষণমাত্র অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা না করিয়া, কলিকাতায় সংবাদ লিখিলে, দাদা শোকে অভিভূত হইলেন। পরে আমাকে সংবাদ লিখিলেন যে, পত্রপাঠমাত্রেই কাশী যাইয়া বেণীকে পাঠাইয়া দিবে। আমি আদেশপত্র পাইবামাত্র কাশী যাইয়া, ঘেণীকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। দাদা, জ্যেষ্ঠ জামাতার মৃত্যুর পর, তাহার মাতা, ভগিনী ও ভ্রাতাকে কলিকাতায় আনিয়া, স্বতন্ত্র বাটীভাড়া করিয়া রাখিলেন। নিজ হইতে সমস্ত ব্যয় দিয়া, তাহাদের রীতিমত তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। বিধবা তনয়া, মৎস্য ও রাত্রিকালের অন্ন পরিত্যাগ করিলে, তিনিও কিছু দিনের জন্য ঐ রূপ করিলেন, এবং কন্যার ন্যায় একাদশী করিতে আরম্ভ করিলেন। কিছুদিন পরে ঐ বিধবা-কন্যা হেমলতার অনুরোধে মৎস্য খাইতে আরম্ভ করিলেন এবং একাদশী করা বন্ধ করিলেন। ঐ কন্যার পুত্রদ্ধয়কে এরূপ ভাবে লালনপালন ও শিক্ষিত করিলেন যে, উহারা পিতৃহীন হইয়াও উহাদিগকে একদিনের জন্যও কোন ক্লেশ অনুভব করিতে হইল না। ঐ কন্যার দেবরের পালন ও শিক্ষার বন্দোবস্ত করিলেন, এবং ঐ কন্যাকে শোকে অভিভূত দেখিয়া, উহার হস্তে সাংসারিক ব্যয়-নির্ব্বহের ও তত্ত্বাবধানের ভার দিলেন। তদবধি আজ পর্যন্ত ঐ কন্যা সাংসারিক সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিয়া আসিতেছেন। দাদার অভিপ্রায়ানুসারে দয়াদাক্ষিণ্যাদিসহ সংসারকার্য্যের তত্ত্বাবধান করায়, ঐ কন্যা তাঁহার সমধিক স্নেহের ভাজন হইয়াছিল।
কাশী।
সন ১২৮০ সালের অগ্রহায়ণ মাসের প্রারস্তে, পিতৃদেব অত্যন্ত পীড়িত হন। এই সংবাদ প্রাপ্তি-মাত্রেই অগ্রজ মহাশয়, কর্ম্মটার হইতে কাশী গমন করেন। কাশীতে তিনি প্রায় দুই সপ্তাহ কাল অবস্থিতি করেন; অনেক শুশ্রূষাদি দ্বারা পিতৃদেব সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করেন। দাদার উপস্থিতসময়ে, পিতামহীর একোদ্দিষ্টশ্রাদ্ধে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণগণকে ভোজন করান হয়। শ্রাদ্ধকালে তাঁহারা বেদপাঠ করিয়া থাকেন; তাহা শুনিবার জন্য অনেকেই আমাদের বাসায় উপস্থিত হইতেন। দাদা দেখিলেন যে, তাঁহারা বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের মত ভোজন করিতে করিতে উচ্ছিষ্ট-দ্রব্য বস্ত্রে বন্ধন করেন নাই। ইঁহারা ভোজনের সময় গ্রাসকালে একবার সকলে চীৎকার করিয়া, সঙ্গীতের ন্যায় শ্রুতি-সুখকর বেদপাঠ করিয়া ভোজনে প্রবৃত্ত হইলেন; তৎপরে আর কাহাকেও কথা কহিতে দেখা যায় নাই। আমাদের দেশীয় ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় যেরূপ গোলযোগ হয়, এখানে সে গোলের সম্পর্ক নাই, পাতে কেহ কোন দ্রব্য ফেলেন নাই, সকলেরই পাত পরিষ্কার; ইহা দেখিয়া দাদা পরম আহলাদিত হইলেন। তাঁহারা ভোজনান্তে আচমন করিয়া, পান ও দক্ষিণাগ্রহণ-সময়ে কৃতিকে বেদপাঠ করিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকেন। আমরা যেরূপ দক্ষিণা দিতাম, দাদা তদপেক্ষা অধিক দক্ষিণার ব্যবস্থা করিয়া বলিলেন, “আগামী বৈশাখমাসে মাতৃশ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণভোজনের সময়ে কাশী আসিব।”
মৃত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দাদার বাল্যবন্ধু ও সহাধ্যায়ী ছিলেন। এজন্য তাঁহার জননী বিশ্বেশ্বরী-দেবীকে তিনি মাতৃ-সম্বোধন করিতেন। তর্কলঙ্কারের পত্নীর সহিত তাঁহার মনের মিল হইত না; সুতরাং সর্ব্বদা বিবাদ হইত। একারণ, তর্কালঙ্কারের জননী, কলিকাতায় বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের ভবনে আসিয়া, দাদার নিকট রোদন করেন। তিনি তাঁহাকে অতি শীর্ণকায়া দেখিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “মা! তোমার উপযুক্ত সন্তান লোকান্তরিত হইয়াছেন; এক্ষণে আপনার বধুর সহিত যেরূপ অসদ্ভাব দেখিতেছি, তাহাতে আপনার উহার সংস্রবে থাকা বিধেয় নহে; আমি আপনার জীবদ্দশায় মাসিক দশ টাকা দিতে পারি, আপনি কাশীতে অবস্থিতি করুন।” ইহা শুনিয়া তর্কালঙ্কারের জননী বিশ্বেশ্বরী-দেবী আহলাদিত হইয়া, স্বতন্ত্র পাথেয় গ্রহণ-পূর্ব্বক কাশীবাস করিলেন। তথায় থাকিয়া সবলকায় হইলেন এবং দশ বৎসর পরে পুনরায় দাদার নিকট অতিরিক্ত টাকা লইয়া কথকতা দিয়াছিলেন। তথায় ১৮ বৎসর থাকিয়া, তর্কালঙ্কারের জননী কাশীলাভ করেন।
ভূতপূর্ব্ব সংস্কৃত-কলেজের স্মৃতি-শাস্ত্রাধ্যাপক ভারতচন্দ্র শিরোমণি মহাশয়ের গুরু-কন্যা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী, স্বীয় কষ্টের কথা ব্যক্ত করিলে, অগ্রজ মহাশয় তাঁহার ক্লেশ-নিবারণের জন্য মাসিক ৪৲ টাকা মাসহরা বন্দোবস্ত করিয়া দেন। ইনি প্রায় দশ বৎসর মাসহরা পাইয়া কাশীলাভ করেন। ভারতচন্দ্র শিরোমণি মহাশয় ঐ সংবাদ পাইয়া, তিনিও ঐ অনাথ বৃদ্ধ গুরুকন্যাকে সাহায্য করিতেন। আমাদের দেশস্থ দীর্ঘগ্রামবাসী চট্টোপাধ্যায়দের বাটীর দুহিতা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী, সম্ভ্রান্ত কুলীনস্বামী বর্ত্তমানেও অন্নবস্ত্র না পাইয়া, কাশীবাস করিয়া শ্রমসাধ্য কার্য্য করিয়া দিনপাত করিতেন। ক্রমশঃ বাৰ্দ্ধক্যনিবন্ধন কার্য্য করিতে অক্ষম হইয়া দাদাকে বলেন, “বাবা বিদ্যাসাগর! তোমার জননী আমাকে মাসে ২৲ টাকা করিয়া দিতেন, তাঁহার মৃত্যুর পর তোমার পিতা আমাকে আর দেন না; আমার বড়ই কষ্ট হইয়াছে।” অগ্রজ মহাশয় এই কথা শুনিয়া, মাসিক ৩৲ টাকা মাসহরা ব্যবস্থা করেন। ইনি দ্বাদশ বৎসর মাসহরা পাইয়া কাশী লাভ করেন।
দাদার পরমবন্ধু পরমধার্ম্মিক বাবু অমৃতলাল মিত্র মহাশয়, পীড়া নিবন্ধন শেষাবস্থায় কাশীবাস করেন। ইনি দেশহিতৈষী ও বিদ্যোৎসাহী লোক ছিলেন। ইনি কাশীবাস করিয়াও সর্ব্বদা লোকের হিতাকাঙ্ক্ষায় ব্যাপৃত ছিলেন। ইনি প্রাচীন দুস্তপ্রাপ্য পুস্তক সকল সংগ্রহ করিয়া, কলিকাতায় প্রেরণ করিতেন। পূর্ব্বে যৎকালে দাদা কলিকাতায় রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন, তৎকালে কলিকাতা সভাবাজারস্থ রাজবাটীতে যাইয়া, বাবু অমৃতলাল, বাৰু আনন্দকৃষ্ণ ও শ্রীনাথ বাবুর সহিত পরামর্শ করিতেন; কাশীতেও অমৃতবাবুর সহিত পরামর্শ করিতেন। উক্ত মহাশয়ের অনুরোধে, তাঁহার অনুগত শ্রীযুক্ত তারাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাসিক ৪৲ টাকা, আর বাপুদেব শাস্ত্রীকে মাসিক ২৲ টাকা মাসহরা প্রদান করিতেন।
পিতৃদেবের কেদারঘাটের আত্মীয় অশীতিবর্ষীয় রাধানাথ চক্রবর্ত্তীকে অগ্রজ মহাশয়, মাসিক ৩৲ টাকা মাসহরার বন্দোবস্ত করেন। কয়েক বৎসর যথাসময়ে টাকা পাইয়া, কিছু দিন হইল ইনি কাশীলাভ করিয়াছেন। জননী-দেবীর অনুরোধে, পিতৃদেবের পিতৃঘসার দুহিতা নিস্তারিণী-দেবীকে মাসিক ৪৲ টাকার ব্যবস্থা করেন। ইনি প্রায় ত্রয়োদশবর্ষ টাকা পাইয়া কাশীপ্রাপ্ত হন।
পিতৃদেবের পুরোহিত রামমাণিক্য তর্কালঙ্কার মহাশয়কে মাসিক ১০৲ টাকার ব্যবস্থা করিয়া, পরে অথর্ব হইলে আর ৫৲ টাকা বৃদ্ধি করিয়া দেন। ইনি প্রায় পনর বৎসর টাকা পাইয়া, ইহলোক হইতে পরলোকে গমন করেন।
পিতৃদেবের বেদপাঠী পুরোহিত চিন্তামণি ভট্টকে মাসিক ৩৲ টাকা মাসহরা দিতেন। এইরূপ অনেকের মাসহরার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।
দাদা, স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য পদব্রজে প্রত্যহ প্রাতে ও সায়ংকালে প্রায় দুই ক্রোশ ভ্রমণ করিতেন। ভ্রমণ করিতে যাইবার সময় সঙ্গে ২০।২২ টাকার সিকি, দুয়ানি ও আধুলি লইতেন। পথে অনাথ, কুষ্ঠরোগী, কাণা, খঞ্জ, কালা, রুগ্ন দেখিলেই অবস্থানুসারে দান করিতেন। বাসায় যে সকল বৃদ্ধ ও দীন ব্যক্তি এবং যে সকল বৃদ্ধ ও ভদ্রকুলাঙ্গনা সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া কষ্টের কথা আবেদন করিতেন, তাহাদের প্রত্যেককে ২৲ টাকা এবং এক এক জোড়া বস্ত্র প্রদান করিতেন। যে কয়েক দিবস কাশীতে অবস্থিতি করিতেন, প্রাতে পিতৃদেবের পাকাদিকার্য্য স্বহস্তে নির্ব্বাহ করিতেন। বাল্যকালে দাদা স্বয়ং পাকাদি-কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া লেখাপড়া শিক্ষা করিতেন; বাল্যকালের অভ্যাস অদ্যাপি বিস্মৃত হইতে পারেন নাই। কাশীতেও পাকাদি-কার্য্য সমাধা করিয়া, পিতৃদেবের ভোজনান্তে পিতার উচ্ছিষ্ট পাত্রে প্রসাদ পাইতেন। ভোজনান্তে আমি পিতৃদেবকে মহাভারত শ্রবণ করাইতাম। কিন্তু দাদা যে কয়েক দিবস থাকিতেন, সেই কয়েক দিবস তিনি স্বয়ং মহাভারত শুনাইতেন। সন্ধ্যার পর দাদা, পিতৃদেবের প্রমুখাৎ পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ প্রভৃতির রীতিনীতি ও গল্প শ্রবণ করিতেন। ইহা সাধারণের নিকট প্রকাশ করিবার মানসে আমায় আদেশ করেন যে, পিতৃদেব সম্পূর্ণ সুস্থ হইলে তুমি পূৰ্বপুরুষগণের নাম, ধাম, আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি প্রভৃতি অবগত হইয়া, আমায় লিখিয়া পাঠাইবে। নানা কার্য্যে ব্যাপৃত থাকায়, অগত্যা উহাঁকে কলিকাতায় যাইতে হইত; তথায় যাইয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিতেন না। পিতৃদেব আনারস, চালতা, ছোট উচ্ছে, প্রভৃতি যে সমস্ত দ্রব্য ভাল বাসিতেন, কাশীতে ঐ সকল দ্রব্য দুষ্প্রাপ্য বলিয়া, দাদা সময়ে সময়ে কলিকাতা হইতে ঐ সমস্ত দ্রব্য পাঠাইতেন।
সন ১২৮১ সালের অগ্রহায়ণ মাসে অগ্রজ মহাশয়, উদরাময় ও শিরঃপীড়ায় অত্যন্ত ক্লেশানুভব করেন। সেই সময়ে স্বাস্থ্য-রক্ষার জন্য কাণপুরে গঙ্গাতীরে বাটী ভাড়া লইয়া অবস্থিতি করেন। তথায় কয়েক মাস অবস্থিতি করিয়া, সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করেন এবং তথা হইতে লক্ষ্মৌ সহরে গমন করেন। তথায় বাবু রাজকুমার সর্ব্বধিকারী মহাশয়ের বাসায় কয়েক দিন যাপন করিয়া, প্রয়াগে গমন করেন; তথায় কতিপয় দিবস অতিবাহিত করিয়া, চৈত্র মাসের শেষে, বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুইটি পুত্রসহ কাশীধামে প্রত্যাগমন করেন। দাদা, কাশীতে যখন থাকিতেন, প্রায়ই স্বয়ং দশাশ্বমেধের ঘাটে বাজার করিতে যাইতেন। তজ্জন্য অনেকে বলিতেন, “চাকর দ্বারা যে কাজ সমাধা হইবে, তাহা স্বয়ং সমাধা করিতে লজ্জা বোধ হয় না? এরূপ দেখিয়া আমাদিগের লজ্জা বোধ হয়।” দাদা বলিতেন, “তবে আপনার পথে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন না। পিতার জন্য বাজার করিতে আসিয়াছি, ইহাতে আমি পরম সন্তোষলাভ করিয়া থাকি। যাঁহারা না পারেন, তাঁহারা চাকরের দ্বারাই এ সকল কাজ করিয়া থাকেন। আমি বিষয়কর্ম্মে লিপ্ত না থাকিলে, এখানে নিরন্তর থাকিয়া পিতার চরণ-সেবা করিয়া, আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিতাম।”
সন ১২৮১ সালের বৈশাখ মাসে জননীদেবীর একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধোপলক্ষে মহারাষ্ট্রীয় বেদপাঠী ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ করা হয়। নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণেরা সমাগত হইলে, কৃতীকে স্বয়ং ব্রাহ্মণদিগের পাদপ্রক্ষালন করিয়া দিবার প্রথা থাকায়, আমি ঐ কার্য্য সমাধা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। দাদা, ইহা দেখিয়া বলিলেন, “তুমি একাই কি এ কার্য্য নিম্পন্ন করিবে? আমি কি কেহ নই?” এই বলিয়া দাদা, ঐ সকল ব্রাহ্মণদের পা ধোয়াইয়া দিতে লাগিলেন। ঐ সকল ব্রাহ্মণদের মধ্যে দুই চারি জনের পায়ে ঘা থাকাপ্রযুক্ত তাহাতে পূয নিৰ্গত হইতেছিল; তাহা দেখিয়াও তিনি কিছুমাত্র ঘৃণাবোধ করেন নাই। অপরাপর দর্শকগণ দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিয়াছিলেন, এরূপ মাতৃভক্তি অপর কোন সম্ভ্রান্ত লোকের দৃষ্ট হয় না।
কলিকাতানিবাসী বাবু শিবকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জালিয়াতী অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া দোষী সাব্যস্ত হন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সারা মর্ভাণ্ট ওরেন্স, তাঁহার প্রতি দ্বীপান্তর-প্রেরণ দণ্ডাজ্ঞাপ্রদানসময়ে যাবতীয় বঙ্গবাসীদিগকে জালিয়াৎ, মিথ্যাসাক্ষীদাতা প্রভৃতি বলিয়া দোষারোপ করেন ও নানা কটুবাক্য প্রয়োগ করেন। তাহাতে অগ্রজ মহাশয়, কলিকাতাবাসী ন্যূনাধিক পঞ্চসহস্ৰ সম্ভ্রান্ত কৃতবিদ্য ভদ্রলোকদিগকে একযোগ করিয়া, সার্ রাজা রাধাকান্তদেবের বাটীতে বসিয়া, স্থিরভাবে কথাবার্ত্তার পর কার্য্যশেষ করিয়া, সকলের সহ একযোগে দরখাস্ত লিখিয়া স্বাক্ষর করিলেন ও করাইলেন, এবং ঐ দরখাস্ত গবর্ণর জেনেরলের মারফতে বিলাতে ষ্টেট-সেক্রেটারির নিকট পাঠান। ঐ দরখাস্ত অনুসারে ষ্টেট-সেক্রেটারি, গবর্ণর জেনেরলকে লিখেন যে, আপনি সার্ মর্ভাণ্ট ওরেন্সকে সাবধান করিয়া দিবেন, অতঃপর যেন এরূপ অন্যায় কার্য্য আর না করেন। বঙ্গদেশে দাদাই একযোগের পথপ্রদর্শক হন।
ঐ সময় কলিকাতা সংস্কৃত-কলেজের প্রফেসার পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়, বায়ু পরিবর্ত্তন-মানসে কাশীধামে আগমন করিয়াছিলেন। দাদার সহিত তাঁহার বিশেষ আত্মীয়তা দেখিয়া, বাঙ্গালী-দল-সংক্রান্ত ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে অনুরোধ করেন যে, বিদ্যাসাগরের সহিত আমাদের মনান্তর হইয়াছিল, তাহা আপনি মধ্যস্থ হইয়া মীমাংসা করিয়া দেন। দলস্থ বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের অনুরোধে তিনি দাদাকে বলেন, “কাশীবাসী দলস্থ ব্রাহ্মণদের সহিত আপনার বিরোধ মীমাংসা হইলে আমি পরম সুখী হইব।” ইহা শুনিয়া দাদা উত্তর করিলেন, “কাশীর ভিক্ষুক, প্রতারক ব্রাহ্মণদের সহিত আমাকে কি নিম্পত্তি করিতে হইবে? পিতৃদেব এখানে বাস করিবার মানসে আগমন করেন নাই, এখানে মৃত্যু-কামনায় আসিয়াছেন। কাশীস্থ দল-সংক্রান্ত ব্রাহ্মণেরা আমায় ভয় দেখাইয়া প্রচুর অর্থ চাহেন; তাহা না দেওয়াতে ভয় দেখাইয়া আমায় জব্দ করিবেন বলিয়া থাকেন। পুরোহিত মাতঙ্গীপদ ন্যায়রত্নকে ভয় দেখাইয়া ত্যাগ করাইয়াছেন। একারণ, রামমাণিক্য তর্কালঙ্কার মহাশয়কে পুরোহিত নিযুক্ত করা হইয়াছে। কাশীর দুর্বৃত্তগণকে আমি ভালরূপ চিনি, ইহাঁরা কাশীতে সমাগত ব্যক্তিদিগকে যথেচ্ছরূপে উৎপীড়ন করিয়া থাকেন। কিন্তু উহাঁরা যাহাই করুন না কেন, আমি কাহারও অনিষ্ট করিব না। এক্ষণে তাঁহারা যদি স্বীকার করেন যে, আমরা অন্যায় কার্য্যগুলি করিব না, তাহা হইলে তাঁহাদের সহিত আমার নিম্পত্তি হইবে। আর তাঁহাদের সহিত আমার কি সম্পর্ক; আমি দান করিব, তাঁহারা গ্রহণ করিবেন, এই সম্পর্ক। এখানে পিতৃদেব, কার্য্যোপলক্ষে মহারাষ্ট্ৰীয় বেদপাঠী ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ করিযা থাকেন, ইহাঁদের আচার-ব্যবহার দেখিয়া আমার শ্রদ্ধা ও ভক্তি জন্মিয়াছে; কিন্তু আমাদের বাঙ্গালা হইতে যে সকল বাঙ্গালী-ব্রাহ্মণ কাশীবাস করিতেছেন, তন্মধ্যে অনেকেই দুষ্ক্রিয়াসক্ত, ধর্ম্মাধর্ম্মজ্ঞানশূন্য ও মুর্থ। শাস্ত্রজ্ঞ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণগণ থাকিতে, ইহাদিগের প্রতি কেন আমার শ্রদ্ধা ও ভক্তি জন্মিবে?”
অগ্রজ মহাশয় এক দিবস কথাপ্রসঙ্গে পিতৃদেব মহাশয়কে বলেন, “এতাবৎ কাল ভাড়াটিয়া বাটীতে কলিকাতায় অবস্থিতি করিতেছি; কলিকাতায় বাটী না করিবার তাৎপর্য্য এই যে, যদি বীরসিংহ জন্মভূমি বিস্মৃত হই। এক্ষণে কলিকাতায় নিজের বাটী না করিলে, সময়ে সময়ে এই এক মহৎ কষ্ট হয় যে, কতকগুলি পুস্তকের সেলফ আছে, মধ্যে মধ্যে এক বাটী হইতে অপর বাটীতে লইয়া যাইতে অনেক ক্ষতি হইয়া থাকে; ইত্যাদি কারণে স্থান ক্রয় করিয়া বাটী প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করি, আপনার মত কি?” তাহাতে পিতৃদেব বলিলেন, “তুমি পুস্তক রাখিবার উপলক্ষে বাটী প্রস্তুত করিবে, এ সংবাদে পরম সন্তোষ লাভ করিলাম, ত্বরায় বাটী প্রস্তুতের উদ্যোগ কর।” দাদা, পিতৃদেবের বিনা অনুমতিতে কখন কোন কার্য্য করেন নাই।
দাদা এক দিবস কথাপ্রসঙ্গে পিতৃদেবকে বলেন, “আয়ের হ্রাস হইয়াছে, যাহাদিগকে যাহা দিয়া থাকি তাহা বন্ধ করিতে পারিব না; ইত্যাদি নানা কারণে বড় দুর্ভাবনা হইয়াছে।” ইহা শুনিয়া পিতৃদেব, আমি ও বাবু অমৃতলাল মিত্র, আমরা তিন জনেই বলিলাম, “যাহাকে যাহা দিয়া থাকেন, তাহার কিছু কিছু কম করিয়া দেন।” ইহা শুনিয়া দাদা বলেন, “কেমন করিয়া তাহাদিগকে কমের কথা বলিব?” আমরা বলিলাম, “পিতৃদেবকে মাসে ৬০৲ টাকা পাঠান, অতঃপর ৪০৲ চল্লিশ টাকা পাঠাইবেন। ভ্রাতৃবর্গের প্রত্যেককে মাসিক যাবজ্জীবন ৭০৲ টাকা দিবার স্বীকার আছেন, যতদিন আপনার আয়ের লাঘব থাকিবে, ততদিন আমাদের প্রত্যেককে মাসে ৪০৲ টাকা দিলে চলিবে। এই হিসাবে যত লোককে মাসিক যাহা দিয়া থাকেন, সকলেরই কমাইয়া দিবেন। ফর্দের শিরোভাগে আমাদের নাম দেখিলে, কেহ আপনাকে বিরক্ত, করিতে পরিবেন না। যখন পিতা ও ভ্রাতার কম হইল, তখন তাঁহারা কোন আপত্তি করিতে পরিবেন না।” সেই সময় হইতে আমাদের সকলেরই মাসিক বৃত্তি কমিয়াছিল; কিন্তু আয় বৃদ্ধি হইলে, আমায় মাসিক ৪০৲ টাকার পরিবর্তে ৬০৲ টাকা দিয়া আসিতেছিলেন। আয় কম হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, “বর্ত্তমান ছোটলাট ক্যাম্বেল সাহেবের সহিত আমার মনান্তর হয়। মনান্তরের কারণ এই যে, কলিকাতা সংস্কৃতকলেজের স্মৃতিশাস্ত্রাধ্যাপকের পদ পাইবার সময় আমার সহিত পরামর্শ করিয়া, আমার উপদেশের বিরুদ্ধে ঐ পদ উঠাইবার আজ্ঞা দেন এবং প্রকাশ করেনু যে, এ বিষয় তিনি আমাদের সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য্য করিয়াছেন। কিন্তু আমি ইহা দ্বারা সাধারণের ক্ষতি ও নিজের অপবাদ দেখিয়া ঐ বিষয় প্রকাশ করায়, তাঁহার সহিত মনান্তর হয়। এই কারণে শিক্ষা-বিভাগে আমার পুস্তকের বিক্রয় কমিয়া যাওয়ায়, আয়ের অনেক হ্রাস হইয়াছে।”
এক দিন কথাপ্রসঙ্গে পিতৃদেব মহাশয় ব্যক্ত করেন, “তোমার প্রতি বালাকালে আমি সামান্য ব্যয় করিয়াছি; কিন্তু তুমি আমার জন্য বহুব্যয় করিতেছ, তজ্জন্য আমি মানসিক সুখানুভব করিয়া থাকি। কোন বিষয়ে আমার কোন কষ্ট নাই। তুমি আমার বংশে রাম-অবতার হইয়াছ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না; তুমি ধর্ম্মশীল, সত্যপরায়ণ, পিতৃভক্তি-পরায়ণ; কেবল আমার মনে কখন কখন সামান্য একটু কষ্টানুভব হইয়া থাকে।” ইহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “কি, তাহা ব্যক্ত করুন। সাধ্য হয়, অবশ্য তাহা সম্পাদনা করিতে ক্রটা করিব না।” পরে পিতৃদেব বলেন, “তোমার কনিষ্ঠ সহোদর ঈশান, পড়াশুনা ত্যাগ করিয়া বনে বনে পরিভ্রমণ করিয়া থাকে, এই আমার আন্তরিক দুঃখের কারণ; তাহাকে ও তাহার পত্নীকে এখানে পাঠাইতে পারিলে, আমি পরম সুখী হইব।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ বলিলেন, “আমি যাইয়া তাহাকে পত্র লিখিয়া কলিকাতায় আনাইয়া পাঠাইবার চেষ্টা করিব, আপনিও তাহাকে এখান হইতে পত্র লিখুন।” পরে পিতৃদেব বলিলেন, “শুনিতে পাই, তাহার অনেক ঋণ আছে, তাহা পরিশোধ করিয়া পাঠাইবে।” এই কথা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “ইতিপূর্বে একবার তাহার যথেষ্ট ঋণ পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তৎকালে তাহাকে কোন কর্ম্মের ভার দিব বলিয়াছিলাম; সে কোন কর্ম্মে লিপ্ত থাকিতে ইচ্ছা করে নাই।” অতঃপর অগ্রজ মহাশয়, কয়েক দিবস কাশীতে অবস্থিতি করিয়া কর্ম্মাটারে প্রত্যাগমন করেন, তথায় ৮।১০ দিন থাকিয়া কলিকাতায় গমন করেন।
সন ১২৮২ সালের ৩০ শে আষাঢ় মঙ্গলবার অগ্রজ মহাশয়ের তৃতীয়া কন্যা বিনোদিনী-দেবীর বিবাহ হয়। বর, বাবু সূর্য্যকুমার অধিকারী। ইনি একুশ বৎসর বয়সের সময় হেয়ার-স্কুলের শিক্ষকতাকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। বিবাহের পর অগ্রজ-মহাশয়, সুর্য্যবাবুকে ঐ পদ পুরিত্যাগ করাইয়া, মেট্রোপলিটানে সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত করাইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। এবিষয়ে সূর্য্যবাবু প্রথমতঃ অসম্মতি প্রকাশ করেন; অনেক বাদানুবাদের পর, দাদার আগ্রহাতিশয় দেখিয়া ও অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হন। সুর্য্যবাবু, হেয়ার-স্কুলের কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া, মেট্রোপলিটানে সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত হন।
১৮৬৫ সালে অগ্রজ মহাশয়, উত্তরপাড়ায় গাড়ী হইতে পড়িয়া যকৃতে আঘাত লাগায় যে বেদনা হইয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপ ভাল হয় নাই; মধ্যে মধ্যে ঐ স্থানে বেদনা হইত। এক্ষণে তাহা প্রবল হইয়া উঠিলে, অত্যন্ত যাতনায় অভিভূত হইলেন। অগ্রজের আত্মীয় ডাক্তার সূর্য্যকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় যত্নপূর্বক চিকিৎসা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই রোগের উপশম হইল না, ক্রমশঃ যাতনার বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ভয়প্রযুক্ত বাসাবাটী পরিত্যাগ করিয়া, সুকিয়া-স্ট্রীটে তাহার পরমবন্ধু বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবনে যাইয়া অবস্থিতি করিলেন। রাজকৃষ্ণ বাবু ও তঁহার পুত্র সুরেন্দ্র বাবু এবং ভাগিনেয় বেণীমাধব ও ভ্রাতৃ-জামাতা নীলমাধব মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলে শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে, ডাক্তার বাবু সূর্য্যকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয়, তৎকালের বিখ্যাত ডাক্তার পামর সাহেব মহোদয়কে রোগ-নির্ণয় করিতে আনয়ন করেন। তাহাতেও সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভ করিতে পারেন নাই সত্য, কিন্তু যাতনার অনেক হ্রাস হইয়াছিল। অবশেষে দাদার পরমবন্ধু ডাক্তার বাবু মহেন্দ্রনাথ সরকার মহাশয়, প্রায় একমাস কাল চিকিৎসা করিলে, তিনি সম্পূর্ণরূপ আরোগ্য লাভ করেন। অগ্রজ মহাশয়, সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ হইয়া, পিতৃদেবের আদেশ-প্রতিপালনজন্য কনিষ্ঠ সহোদর ঈশান ও তৎ-পত্নীকে আনাইয়া, কাশীতে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিলেন এবং তাহার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিয়া দিলেন। ঈশান, পরিবার-সহ সন ১২৮২ সালের ১৩ই শ্রাবণ কাশীতে উপস্থিত হইল। ইহাকে পিতার শুশ্রুষাদিকার্য্যে নিযুক্ত করিয়া, আমি কর্ম্মটারে দাদার সহিত সাক্ষাৎ করি। কয়েক দিবস তথায় থাকিয়া দেখিলাম, তিনি তখনও সম্পূর্ণরূপ সবলকায় হইতে পারেন নাই। তিনি প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্য্যন্ত, সাঁওতালরোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি-মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছারী প্রভৃতি নিজ হইতে প্রদান করিতেন। আহারাদির পর বাগানের গাছ পর্য্যবেক্ষণ করিতেন; আবশ্যকমতে এক স্থানের চারাগাছ তুলাইয়া অন্য স্থানে বসাইতেন। পরে পুস্তক-রচনায় মনোনিবেশ করিতেন। অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণ-কুটীরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন। তাহাদের কুটীরে যাইলে, তাহারা সমাদরপূর্ব্বক বলিত, “তুই আসেছিস।” তাহাদের কথা অগ্রজকে বড় ভাল লাগিত। আমায় তৎকালে বলেন, “বড়লোকের বাটীতে যাওয়া অপেক্ষা, এ সকল লোকের কুটীরে যাইতে আমায় ভাল লাগে; ইহাদের স্বভাব ভাল, ইহারা কখনও মিথ্যাকথা বলে না, ইত্যাদি কারণে এখানে থাকিতে ভাল বাসি।” পরে আমায় বলেন যে, “বীরসিংহ-বিদ্যালয় দেশব্যাপক ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রাদুর্ভাবপ্রযুক্ত কিছুদিনের জন্য বন্ধ হইয়াছে।” আমি তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর করিলেন, “ম্যালেরিয়া-জ্বরনিবন্ধন বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের মৃত্যু হইয়াছে দেখিয়া, ভয়প্রযুক্ত হেডমাষ্টার বাবু উমাচরণ ঘোষ রিপোর্ট দেন যে, তিন শত ছাত্রের মধ্যে কোন দিন দুই জন, কোন দিন তিন জন উপস্থিত হয়; উহারা ক্ষণেককাল বেঞ্চে বসিয়া জ্বরে কাঁপিতে কাঁপিতে শয়ন করে। এরূপ অবস্থায় এত অধিক ব্যয় করিয়া বিদ্যালয় রাখা যুক্তি-সঙ্গত নহে। এ অবস্থায় কোন শিক্ষকই তথায় যাইতে সম্মত নন; সকলেই ভয়ে ব্যাকুল। হেড্ মাষ্টার ও দ্বিতীয় মাষ্টার রোগে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসার মানসে কলিকাতায় আসিয়াছেন। তাহাদিগকে পুনর্ব্বার যাইতে অনুরোধ করিলেও তাহারা ভয়ে যাইতে সাহস করেন নাই, সুতরাং যতদিন ম্যালেরিয়া থাকিবে, অগত্যা ততদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকিবে।”
কর্ম্মটারে অগ্রজ মহাশয়কে কিছু সুস্থ দেখিয়া, আমি দেশে গমন করিলাম। তিনি পুনর্ব্বার পিতৃদর্শনার্থে কাশী গমন করেন; তথায় প্রায় কুড়ি দিবস অবস্থিতি করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করেন। ঐ বৎসর মাঘ মাসে পিতৃদেব অতিশয় পীড়িত হন। তারে বীরসিংহায় সংবাদ পঠাইয়া, আমাকে কাশী যাইবার সংবাদ লিখিয়া, স্বয়ং ত্বরায় কাশী যাত্রা করেন। অগ্রজের আদেশ পাইবামাত্র, আমি কাশী যাত্রা করি। পিতৃদেব কিছু সুস্থ হইলে, দাদা, আমাকে ও জ্যেষ্ঠ ভগিনী মনোমোহিনীকে তথায় রাখিয়া, স্বয়ং কর্ম্মটার হইয়া কলিকাতা প্রত্যাগমন করেন।
১৮৭২ সালের জুন মাসে হিন্দু ফিমেলয়্যানিউটিফণ্ড স্থাপিত হয়। অনরেবল জষ্টিস্ বাবু দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয় ও অগ্রজ মহাশয় উহার ট্রাষ্ট্রী মনোনীত হন। অল্পদিনের মধ্যেই এই ফণ্ডের বিশেষ উন্নতি করেন। অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্রের মৃত্যুর পর, এক ট্ৰষ্ট্ৰী-পদে থাকা উচিত নয় বিবেচনা করিয়া, অন্য ব্যক্তিকে ট্ৰষ্ট্ৰী-পদে মনোনীত করেন। হিন্দু ফিমেলয়্যানিউটি ফণ্ডের ডাইরেক্টারদের বিসদৃশ কার্য্যকলাপ দেখিয়া, সবসক্রাইবার সমূহকে জানাইয়া, ১২৮২ সালের ফাল্গুন মাসে সকলেই ট্ৰষ্ট্ৰীপদ পরিত্যাগ করেন।
কিছুদিন পূর্ব্বে এক গণককার বলিয়াছিলেন, সন ১২৮২ সালের ১৪ই চৈত্র হইতে জননীদেবীর মৃততিথিমধ্যে পিতৃদেবের মৃত্যু হইবে। ১৪ই চৈত্র একবার ভেদ হইয়া নাড়ী দমিয়া যায়; সুতরাং তারে সংবাদ দিয়া অগ্রজ মহাশয়কে আনান হয়।
সন ১২৮৩ সালের ১লা বৈশাখ সূর্য্যাস্তসময়ে পিতৃদেব কাশীলাভ করেন। পিতার মৃত্যু দেখিয়া, দাদা রোদন করিতে লাগিলেন। তৎকালে বিস্তর আত্মীয় বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিলেন। দাদা, জাঁকজমক ভাল বাসেন না। উপস্থিত ভদ্রলোক সমূহকে বিদায় দিলেন এবং প্রকাশ্যভাবে বলিলেন, “আমাদের পিতাকে আমরাই বহন করিয়া লইয়া যাইব; অন্য ভদ্রলোকদিগকে ক্লেশ দিব না।” এই বলিয়া, তিন সহোদর ও কনিষ্ঠের শুশ্বর প্রতাপচন্দ্র কাঞ্জিলাল মহাশয়, এই চারিজনে বহন করিয়া লইয়া যাই। পুরোহিত ও ভূত্য ফুরসতকে সমভিব্যাহারে লওয়া হইয়াছিল। মণিকর্ণিকার ঘাটে দাহাদিকার্য্য সমাধা করিয়া, স্নান-তৰ্পণ সমাপনান্তে বাসায় প্রত্যাগমন করা হয়। দাদা, বাসায় উপস্থিত হইয়া ছেলেমানুষের মত রোদন করিতে লাগিলেন দেখিয়া, অনেকে আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় নীতিজ্ঞ ও পণ্ডিত লোক হইয়া, বৃদ্ধ পিতার জন্য এত শোকাভিভুত কেন?
২রা বৈশাখ প্রাতঃকাল হইতে দাদার ভেদ বমি হইতে লাগিল। অত্যন্ত দুর্ব্বল হইতে লাগিলেন দেখিয়া, আমরা ভীত হইয়া বলিলাম, “অদ্য কাশী পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতা যাইব।” প্রথমতঃ অগ্রজ মহাশয় শ্রাদ্ধাদিকার্য্য সমাধা করিয়া কলিকাতা যাইবেন, ইহা প্রকাশ করিলেন। কলিকাতা না যাইবার কারণ এই যে, ইতিপূর্বে পিতৃদেব এক উইল প্রস্তুত করিয়া, তাহা অগ্রজের হস্তে সমর্পণ করেন। উইলের মর্ম্ম এই যে, আমার অন্তিমসময়ে জ্যেষ্ঠপুত্র নিকটে থাকিবে ও দাহাদিকার্য্য সম্পন্ন করিয়া, কাশীতেই আদ্যশ্রাদ্ধ করিবে। আমি যে সকল মহারাষ্ট্ৰীয় বেদজ্ঞ ও অন্যান্য হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণগণকে ভোজন করাইতাম, তাহাদিগকে ভোজন করাইবে। তৎপরে স্বয়ং গয়ায় যাইয়া গয়াকৃত্য সমাধা করিবে। এই সকল কারণেই কলিকাতা যাইতে প্রথমতঃ সম্মত ছিলেন না। পরে আমি ঐ সকল ব্রাহ্মণদিগকে আনাইয়া বলিলাম, “দাদার পীড়া হইতেছে, অতএব দাদাকে অদ্যই কলিকাতা লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি, মহাশয়দের এ বিষয়ে মত কি, প্রকাশ করিয়া বলুন।” অগ্রজের অবস্থা অবলোকন করিয়া, তাঁহারা সকলেই দাদাকে কলিকাতা যাইবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন এবং বলিলেন, অতঃপর সুস্থ হইয়া একবার আসিয়া, ব্রাহ্মণ-ভোজনাদি কার্য্য সম্পন্ন করিবেন। এ অবস্থায় কোন ঔষধ, সেবন করিবেন না। কলিকাতায় যাইয়াও তাঁহার অশ্রুবিন্দু নিবারণ হয় নাই।
দশাহে যথাশাস্ত্র ঔৰ্দ্ধদৈহিক কৃত্য সমাধা করেন। পরে এক সময়ে কাশী আগমন করিয়া, পিতার আদেশ প্রতিপালন করিতে বিস্মৃত হন নাই। উইল অনুসারে কাশীতে কার্য্য সমাধা করিয়া, পিতৃভক্তি প্রদৰ্শন করিয়াছিলেন। সন ১২৮৩ সালের শীতকালে অগ্রজ, বাদুড়-বাগানের নুতন বাটীতে প্রবেশ করেন। ঐ বাটীতেই স্বকীয় লাইব্রেরী স্থাপন করিয়া, একাকী নিভৃতভাবে থাকিবেন, এই অভিপ্রায়েই বাটী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, পরিবারগণকে অন্য বাটীতে রাখিব; কিন্তু অন্য বাটী প্রস্তুত না হওয়াতে, সকল পরিবারগণকে ঐ বাটীতে আনয়ন করিলেন; আমরাও শ্রীচরণ-দর্শনে আগমন করিয়া যত দিন ইচ্ছা ঐ বাটীতেই থাকিতাম। এ বাটীতে প্রবেশ করিয়া অবধি, পরিবারবর্গের ও অন্যান্য সমাগত সম্ভ্রান্ত ও দীন-দরিদ্র ব্যক্তিদিগের আহারাদি বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে ব্যয় করিতেন। সকলের প্রতি এরূপ সমভাবে প্রত্যহ ভোজন করান, অপর কোন স্থানে দৃষ্ট হয় না। নিজের আহার বা পরিধেয় বস্ত্রাদির কোন পারিপাট্য ছিল না। দিবসে অন্ন আহার করিতেন এবং রাত্রিতে মুড়ি ও সামান্যরূপ মিষ্টান্ন জলযোগ করিয়া রাত্রি-যাপন করিতেন। এই বাটীতে সাংসারিক-কার্য্যে ও আচার-ব্যবহারাদিতে অগ্রজের কনিষ্ঠা-কন্যা, তাহার জ্যেষ্ঠ ভগ্নী হেমলতাদেবীর সহযোগিনী ছিল এবং দয়াদাক্ষিণ্যাদিগুণেও উক্ত হেমলতাদেবীর সহযোগিনী ছিল।
সন। ১২৮৪ সালের বৈশাখ মাসে দাদার কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। বর, শ্রীযুক্ত কার্ত্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কনিষ্ঠ জামাতাকে ও কন্যাকে দাদা অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। কনিষ্ঠ জামাতা কার্ত্তিক বাবুকে বাটীতে রাখিয়া, লেখাপড়া শিখাইতে লাগিলেন। কার্ত্তিক বাবু সর্ব্বদা বাদুড়বাগানস্থ ভবনে উপস্থিত থাকিয়া, সমাগত সকল সম্প্রদায়ের লোকের সহিত ভদ্রতা করিতেন; এজন্য অনেকেই কার্ত্তিক বাবুকে ভাল বাসিয়া থাকেন।
সন ১২৮৪ সালে অগ্রজ মহাশয়ের ছোট একটা ঘড়ী অদৃশ্য হয়; তাহার কোন অনুসন্ধান হইল না। এক দিবস ৺রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের পুত্র অগ্রজের নিকট আসিয়া বলেন, “মহাশয়, আপনার ছোট, ঘড়ীটী কোথায়? একবার দেখিব।” দাদা বুলিলেন, “সেই ঘড়ীটী প্রায় পনর দিবস অতীত হইল চুরি গিয়াছে, আর পাওয়া যায় নাই।” ইহা শুনিয়া রাজকুমার বলিলেন, “আপনার ঘড়ীর সদৃশ একটি ঘড়ী লালমোহন বাবুর পুত্র, পাইকপাড়ার একটি মুদীর নিকট ২০৲ টাকায় বন্ধক দিয়াছেন। ঐ মুদী, ঘড়ীটি আমাকে দেখাইতে আসিয়াছিল; আমি তাহাকে বলিয়াছি যে, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই ঘড়ী, ইহা কেমন করিয়া তোমার হস্তগত হইল?” সে বলিল, “ইহা লালমোহন বাবুর পুত্র আমাকে দিয়াছেন।” ইহা শুনিয়া অগ্রজ মহাশয় নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। উপস্থিত অন্যান্য লোক বলিলেন, “অমন ছোকরাকে পুলিশে ধরাইয়া দেওয়া উচিত।” তাহাতে দাদা বলিলেন, “উহার মাতামহ আমাদের অনেক উপকার করিয়াছেন; এক্ষণে তাঁহার দৌহিত্রের এই সামান্য অপরাধ আমার ব্যক্ত করা উচিত নয়।” তৎক্ষণাৎ রাজপুত্রের সহিত পাইকপাড়া যাইয়া, সেই মুদীকে ২০৲ টাকা ও কিছু সুদ দিয়া ঘড়ীটি মুক্ত করেন। অনন্তর সেই বালককে সমভিব্যাহারে আনিয়া বলিলেন, “তোমার মাতামহের অনেক খাইয়াছি এবং বাল্যকালে তাঁহারা আমার অনেক দৌরাত্ম্য সহ করিয়াছেন। তোমার যখন যাহা আবশ্যক হইবে, তাহা তুমি আমাকে জানাইলে পাইবে। ক্ষণকালের জন্য আমি কখন কোন কারণে তোমাদের প্রতি বিরক্ত হইব না।” ইহা শুনিয়া উপস্থিত ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন।
সন ১২৮৫ সালে দাদার আত্মীয় জনকয়েক ব্যক্তি, দাদার পত্র লইয়া পথে ষড়যন্ত্র করিয়া বীরসিংহায় পঁহুছিয়া, বীরসিংহার দাতব্য ডাক্তারখানার চিকিৎসক বাবু শ্রীরামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দাদার পত্রাদি দেখাইলেন। ডাক্তারবাবু, ষড়যন্ত্রে পতিত হইবার ভয়ে বলিলেন, “আমি ওরূপ কার্য্য করিতে অক্ষম।” এই বলিয়া তিনি কলিকাতায় আগমনপূর্ব্বক, দাদার নিকট সমুদয় ষড়যন্ত্রের বিষয় জ্ঞাত করিয়া, পদ পরিত্যাগ করিলেন। দাদা, এই সমস্ত বিষয় পর্য্যালোচনা করিয়া ডাক্তারখানা বন্ধ করিলেন, এবং তৎকালে উপস্থিত ডাক্তার-খানার সমস্ত দ্রব্য উক্ত ডাক্তার মহাশয়কে প্রদান করিলেন।
১৮৪৬ খৃঃ অব্দের শেষে পাঠ্যাবস্থা শেষ করিয়া সংস্কৃত-কলেজ পরিত্যাগ সময়ে, উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকগণ, অগ্রজ মহাশয়কে বিদ্যাসাগর উপাধি প্রদান করেন।
১২৭৩ সালের দুর্ভিক্ষসময়ে, কাঙ্গালীরা দাদাকে “দয়ার সাগর” উপাধি প্রদান করেন।
১৮৮০ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়া, কম্পানিয়ন অব্ ইণ্ডিয়ান এম্পায়ার উপাধি প্রদান করেন।
সন ১২৯৪ সালের চৈত্রমাসে অগ্রজ মহাশয় বলিলেন, “পিতৃদেব আমার প্রতি যে সমস্ত কার্য্যের ভার দিয়াছিলেন, তন্মধ্যে তিনটি কার্য্য করা হয় নাই। প্রথমতঃ গয়াকৃত্য; আমি শারীরিক যেরূপ দুর্ব্বল আছি, তাহাতে গয়াধামে গিয়া যে, নিজে ঐ সমস্ত কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারিব, এরূপ বোধ হয় না। একারণ, তোমাকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইব। তুমি সমস্ত কার্য্য নির্ব্বহ করিবে, আমি সঙ্গে থাকিব মাত্র। দ্বিতীয়তঃ বীরসিংহ গ্রামে বাটীর উত্তরাংশে অনতিদূরে পিতামহের শ্মশানে একটি মঠ নির্ম্মাণ করিয়া, তাহার চতুর্দ্দিকে রেল দিয়া বেষ্টিত করা। তৃতীয়তঃ বীরসিংহ গ্রামে পিতামহীদেবীর প্রতিষ্ঠিত অশ্বখ-বৃক্ষের মূলে আলবাল-বন্ধন ও তলে স্থানে স্থানে সাধারণের বসিবার উপযোগী প্রস্তার-নির্ম্মিত বেঞ্চ স্থাপন।
অশ্বখ-বৃক্ষ।
অগ্রজ মহাশয় আমায় বলিলেন, “পিতামহীর প্রতিষ্ঠিত অশ্বখ-বৃক্ষ মধ্যে মধ্যে দেখিয়া থাক?” আমি উত্তর করিলাম, “না মহাশয়।” দাদা বলিলেন, “বৃক্ষ কিরূপ অবস্থায় আছে, এ বিষয়ের তত্ত্বাবধান না করা তোমার অন্যায়; অতএব তুমি বাটী যাইয়া ঐ বৃক্ষের তত্ত্বাবধান করিবে এবং বংশের মধ্যে কেহ যদি দেশাচারানুসারে বৈশাখ মাসে মূলে জল না দেয়, তুমি বৈশাখ মাসে প্রত্যহ জল সেচন করিবে।” পরে কথাপ্রসঙ্গে আমি বলিলাম, “নবকুমার ডাক্তার, নারাজোলের রাজবাটীর হস্তীতে আসিয়া, ঐ হাতী দ্বারা শাখাগুলি ভগ্ন করে; এবং বৃক্ষটি ছেদন করিবার জন্য করাতি সংগ্রহ করিয়া বৃক্ষতলে উপস্থিত হয়; ঐ সংবাদ পাইয়া তথায় আমরা উপস্থিত হইলাম। বৃক্ষে করাত সংলগ্ন করিয়াছে দেখিয়া, উহাদিগকে তাড়াইয়া দিলাম। নবকুমার ডাক্তারকে বাটীতে আনয়ন করিয়া তিরস্কার করিলে, সে ক্ষমা প্রার্থনা করিল। নবকুমার ডাক্তারের মৃত্যুর পর, আমার পুত্রদ্বয়ের পীড়ার জন্য কলিকাতায় এবং কাশীতে আমায় কিছু দিনের জন্য অবস্থিতি করিতে হইয়াছিল। যদিও মধ্যে মধ্যে বীরসিংহায় গিয়াছিলাম, কিন্তু ঐ বৃক্ষের আর তত্ত্বাবধান করা হয় নাই।” চৈত্র মাসে বাটী গিয়া, দাদার আদেশানুসারে ৯৪ সালের চৈত্রসংক্রান্তিতে বৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখি, বৃক্ষটিকে বেড়া দিয়া পুষ্করিণীর পাড়ের অন্তর্গত করিয়া লইয়াছে। বেড়ার দ্বার দিয়া বৃক্ষের নিকট গিয়া অন্তর হইতে জল দিয়া দেখিলাম যে, বৃক্ষের চতুর্দ্দিক ফণিমনসা অর্থাৎ এক প্রকার কণ্টকবৃক্ষে আচ্ছন্ন। ঐ বৃক্ষটিকে নষ্ট করিবার মানসে উহার নিকটবর্ত্তী স্থানে বাঁশ, তেঁতুলগাছ, বাবলাগাছ প্রভৃতি রোপণ করিয়াছে। বাটী আসিবার সময় ৺কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের বাটীতে গিয়া ৺নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্নীকে বৃক্ষের চতুর্দ্দিকের বেড়া খুলিয়া বৃক্ষতল পরিষ্কার করিয়া দিতে বলায়, অনেক বাদানুবাদের পর বেড়া খুলিয়া দিতেছি বলিয়া, আমাদিগকে নিজ ব্যয়ে বৃক্ষের ........ করিয়া লইতে বলেন। তাহার বেড়া ভাঙ্গিয়া দিবার পর, আমরা নিজ-ব্যয়ে বৃক্ষের তলীয় স্থান পরিষ্কার করিয়া লইলাম। ১২৯৫ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে কয়েক জন অসচ্চরিত্র ব্যক্তির উত্তেজনায়, আমাদের পিতৃব্য-পৌত্র আশুতোষ ও কেনারাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং আমাকে প্রতিবাদী শ্রেণীভুক্ত করিয়া, ঘাটাল ফৌজদারী আদালতে অভিযোগ করেন। বিচারপতি, প্রথমতঃ মীমাংসার জন্য আদেশ করেন। তাহাতে বাদী কেশবচন্দ্র বলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং যদি এখানে আমার নিকট আসিয়া চাহিয়া লন, তবে দিতে পারি; নচেৎ পারি না।” দাদার পরমাত্মীয় ব্যক্তি বাদীর পক্ষ হইয়া, আমাদিগকে দণ্ড দেওয়াইবার জন্য অশেষ প্রয়াস পাইয়াও কৃতকার্য্য হন নাই। পিতামহীদেবী সাধারণ গোমনুষ্যদিগকে ছায়াদানমানসে অশ্বখ-বৃক্ষ ও তত্তলীয় ভূমি ক্রয় করিয়া, শাস্ত্রানুসারে যে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন তাহা প্রকাশ পাইল; সুতরাং আমরা মিথ্যাভিযোগ হইতে অব্যাহতি পাইলাম।
কয়েক মাস পরে ঐ নবকুমারের পত্নী কলিকাতায় দাদার নিকট আগমন করিয়া বলিলেন, “আপনি অনেক ব্যক্তিকে মাসহরা দিতেছেন, আমাকে ত কিছুই দিতে হয় না। অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক আমাদের চাপড়ার পাড়ে আপনার পিতামহীর প্রতিষ্ঠিত অশ্বখ-বৃক্ষটি আমাকে প্রদান করুন। উহা বহুকালের গাছ; ঐ অশ্বখ-বৃক্ষের নিকট আমরা প্রায় নয় দশ বৎসর বাগান করিয়াছি। ঐ গাছের আওতায় আমার বাগানের অনিষ্ট ঘটিতেছে।” তাহাতে দাদা বলেন, “আমার পিতামহী পঞ্চাশ বৎসরেরও অধিক পূর্ব্বে ঐ বৃক্ষ ও তত্তলস্থ ভূমি রীতিমত টাকা দিয়া ক্রয় করিয়া, পথিকগণের আতপতাপনিবারণ-মানসে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। আর যিনি ঐ স্থান পিতামহীদেবীকে বিক্রয় করিয়াছেন, পিতৃদেব তাহার পরিবারকে প্রতিপালন করিয়াছেন। বাবার কাশী যাইবার পর, তাহার অনুরোধে আমিও তাহার বৃদ্ধ পরিবার প্রসন্নময়ীদেবীকে মাসে মাসে ২৲ টাকা দিয়া থাকি। তোমার স্বামী জানিয়া শুনিয়া, পিতামহীর ঐ স্থান কেন ক্রয় করিয়াছে?” তাহা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটি বলিলেন, “আমার স্বামীকে আপনি লেখাপড়া শিখাইয়া কর্ম্ম করিয়া দিয়াছিলেন, তাহাতেই তিনি আট দশ বৎসর অতীত হইল, ঐ স্থান ক্রয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।”
ইহা শুনিয়া দাদা বলিলেন, “তোমার স্বামী নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি নিজ-ব্যয়ে লেখা পড়া শিখাইয়া, পরে কলিকাতাস্থ মেডিকেল কলেজে পড়াইয়াছিলাম; পরে সে নারাজোলের রাজার ডাক্তার হইয়া, হস্তিপৃষ্ঠে বীরসিংহায় আসিয়া, আমার পিতামহীর প্রতিষ্ঠিত অশ্বখ-বৃক্ষের কতকগুলি ডাল হাতীর দ্বারা ভাঙ্গাইলেন, এই ঘটনার পূর্বে আমার মৃত্যু হইলে সৌভাগ্য জ্ঞান করিতাম। পিতামহীর গাছের শাখা না কাটিয়া, আমার হাত-পা কাটিলে এত দুঃখ হইত না; পরে আবার উহার মূলে করাত লাগাইলেন এবং তুমি তাহার উপযুক্ত পত্নী, ঐ বৃক্ষে বেড়া দিয়া, বৃক্ষ নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে উহার শিকড় কাটিয়া বাঁশবৃক্ষাদি রোপণ করিয়াছ, এবং আমার ভাইকে কয়েদ দিবার জন্য বিধিমতে প্রয়াস পাইয়াছিলে; এক্ষণে আবার আমার নিকট আসিয়া উদারতা ও সরলভাব দেখাইতেছ। তুমি মোকদ্দমায় জয়লাভ করিলে কখনই আসিতে না; পরাজয় হইয়াছে, তজ্জন্যই আসিয়াছ। আমার ভাই যদি অন্যায় করিয়াছিল, তাহা হইলে নালিস না করিয়া পূর্ব্ব কেন আমায় জানাইলে না?” ইহা শুনিয়া ঐ ডাক্তারের পত্নী বলিলেন, “ঐ গাছের তলায় আপনাকে কতখানি ভূমি চাই, তাহা আপনি আমার নিকট চাহিয়া লউন।” এই কথায় দাদা বলিলেন, “তুমি আমার নবাবের বেটি, আমি তোমার নিকট ভিক্ষা চাহি না। আমার হয় আমার থাকিবে, নতুবা যাইবে; তজ্জন্য তোমার নিকট আমি ভিক্ষা চাহিব না।” ঐ স্ত্রীলোকটী কয়েক দিন অগ্রজের বাটীতে অবস্থিতি করিয়া, পরে তাঁহার নিকট পাথেয় বস্ত্রাদি লইয়া প্রস্থান করেন।
১২৯৬ সালের প্রারম্ভে বীরসিংহা ও তৎসন্নিহিত, গ্রামবাসী, অগ্রজ মহাশয়ের প্রতিপালিত কয়েক ব্যক্তির উত্তেজনায়, নবকুমার ডাক্তারের জামাতা কেশবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আমাদের নামে দেওয়ানীতে নালিস করে; পরে ক্রমশঃ দাদা ভিন্ন আমাদের পিতামহীর পৌত্র-প্রপৌত্রাদির নামে অভিযোগ হইলে, আমি দেশ হইতে কলিকাতায় আসিয়া দাদাকে সমস্ত অবগত করিয়া বলিলাম, “মহাশয়, আমি ঐ মোকদ্দমায় লিপ্ত থাকিতে ইচ্ছা করি না; অনেকে বলেন, পিতামহী প্রায় ৩৫ বৎসর অতীত হইল গঙ্গা-লাভ করিয়াছেন, তাহার অশ্বখ-বৃক্ষের জন্য মনান্তর করা উচিত নয়। কেহ কেহ বলেন, গাছটি ত্যাগ কর; এক সামান্য অশ্বখ-বৃক্ষের জন্য এত ব্যয় করার আবশ্যক কি? দূর হউক, গাছটা ত্যাগ করি; আমি ওসব হাঙ্গামে থাকিতে ইচ্ছা করি না।” ইহা শুনিয়া তিনি ক্রোধভরে বলিলেন, “তুই মর্, তাহা হইলে আমি স্বয়ং লাঠী হাতে করিয়া গাছের তলায় দাঁড়াইয়া ঐ গাছ রক্ষা করিব।” ইহা শুনিয়া তাঁহার প্রতিপালিত প্রিয়পাত্র বাবু নিজের উত্তেজনা স্বীকার করিয়া, আমাকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, ঐ পত্র দেখাইলাম। দাদা, পত্র লইয়া তাঁহার আত্মীয় উকীলদিগকে দেখাইয়া ও পরামর্শ লইয়া দুই তিন দিন পরে আমাকে বলিলেন, “এ সকল তোমার কর্ম্ম নয়, তুমি ঈশানের সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য্য করিবে। এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত হইতে হয়, তাহাতেও পশ্চাৎপদ হইব না।” আমার মোকদ্দমার সময়, নবকুমারের জামাতা কেশবচন্দ্র ও বাদিনীর কয়েক জন সাক্ষীর জবানবন্দীতে বিচারপতি বাবু অক্ষয়কুমার বসু, তাঁহাদের মিথ্যাসাক্ষী প্রভৃতি দোষ উল্লেখ করিয়া, বাদিনীর জামাতাকে মীমাংসা করিতে উপদেশ দেন। অনেক বাদানুবাদের পর, আমি মীমাংসা করিতে সম্মত ছিলাম না, ঈশানের অনুরোধে সন্মত হইলাম; সোলেসুরত নিস্পত্তি হইল। তিনি যে কেবল মাতৃভক্তি ও পিতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন এমত নহে; পিতামহী-দেবীর প্রতিও আন্তরিক ভক্তি ছিল। তিনি নিজের স্বার্থসাধনোদ্দেশে কখনও আদালতে মোকদ্দমা উত্থাপিত করেন নাই।
মলয়পুর।
গবর্ণমেণ্ট, বন্যা হইতে দামোদর-নদের পূর্বাংশের রেলপথ রক্ষার জন্য, নদীর পশ্চিমাংশের সেতু খুলিয়া দেন, এবং প্রায় দ্বাদশবর্ষ হইল, দামোদরের বেগের হানা বন্ধ হইয়া, জানকুলীর হানা দিয়া নদীর স্রোত পশ্চিমাংশে সরিয়া আসায়, দামোদর নদ, কেশবপুর . প্রভৃতি স্থানের সীমার মধ্য দিয়া স্রোত বহিয়া চলিতেছে। সুতরাং বর্ষাকালে মলয়পুর প্রভৃতি বহুসংখ্যক গ্রাম বন্যার জলে প্লাবিত হওয়ায়, ধান্য জন্মে নাই। কয়েক বৎসর বন্যায় ধান্য না হওয়ায়, প্রজাবৰ্গ নিতান্ত নিঃস্ব হইয়াছে; বিশেষতঃ ধান্যের ভূমি সকল বন্যায় বালুকাময় স্থান হইয়াছে। সুতরাং ক্রমশঃ গ্রামবাসীর মধ্যে অনেকেই পৈতৃক বাসস্থান পরিত্যাগপূর্বক, স্থানান্তরে বাস করিতে লাগিলেন। সন ১২৮৯ সাল হইতে ৯৭ সালের আশ্বিনমাস পর্য্যন্ত এই আট বৎসর কাল, উক্ত গ্রামবাসী জ্ঞাতি শ্রীঅধরচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, শ্রীষজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য্য, শ্রীনবরাম ভট্টাচার্য্য, মৃত হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারসমূহ নিরুপায় হইয়া, প্রতিবৎসর বন্যার সময় প্রায় চারি মাস কাল কলিকাতায় দাদার বাটীতে অবস্থিতি করেন। দাদা, বিপদাপন্ন ও স্বয়ং-সমাগত ঐ সকল ব্যক্তিদিগকে সমাদরপূর্ব্বক গ্রহণ করিয়া, উহাদের মধ্যে প্রায় পচিশ জনকে নিজ বাটীতে রাখিয়া, ভরণপোষণ করিতে লাগিলেন; অবশিষ্ট লোকদিগকে কিছু কিছু নগদ টাকা দিতেন, তদ্ব্বরা তাঁহারা অপর স্থানে ভোজন করিতেন। বন্যায় ভগ্ন-ভবন পুনঃ-সংস্করণ জন্য অনেককেই টাকা দিতেন। ক্রমিক চারি মাসকাল প্রত্যত দুই বেলা প্রায় পঞ্চাশ জন লোককে বাটীতে ভোজন করাইতেন।
নিকট-জ্ঞাতি হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, কয়েকটি নাবালক পুত্র ও কুমারী কন্যা, বিধবা ভগিনী ও ভাগিনেয় রাখিয়া লোকান্তরিত হন। তাঁহার পরিবারবর্গের প্রতিপালনের কিছুমাত্র সংস্থান ছিল না; এজন্য অগ্রজ মহাশয়, মাসে মাসে ১৫৲ টাকা মাসহরা দিতেন। ৭০০৲ টাকা দিয়া ইহাঁর কন্যার বিবাহকার্য্য সমাধা করেন, এবং নুতন বাটী প্রস্তুত জন্য ১০০৲ টাকা প্রদান করিয়াছিলেন।
দাদা দুগ্ধ পান করিতেন না; কিন্তু প্রতি মাসে উপরি লোক ও বাটার অপরাপর লোকের জন্য প্রায় ৮০৲ টাকার দুগ্ধ ক্রয় করিতেন। ভোজনের সময় প্রায় দেখি, যাহারা অপর স্থানে চাকরি করিতেছেন, তাহারা ভোজনের সময় দুই বেলা আসিয়া ভোজন করেন; কতকগুলি ছেলেকেও দেখিতে পাই, তাহারা দাদার বাটীতে আহার করিয়া; বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া থাকে। প্রতিবৎসর ৺দুর্গাপূজার সময় পাঁচ ছয় হাজার টাকার বস্ত্র বিতরণ করিতেন। অপর সময়েও বাটীতে কাপড়ের দোকান সাজাইয়া রাখিতেন। অনাথ, দীন, দরিদ্র প্রভৃতি উপস্থিত হইলে, বিবেচনামতে প্রদান করিতেন। ইহাতেও প্রায় প্রতি বৎসর তিন চারি হাজার টাকা ব্যয় হইত।
দাদা, নিজে প্রায় আঁব খাইতেন না; কিন্তু প্রতি বৎসর জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এই তিন মাসে প্রায় ১৫০০ পনর শত টাকার আঁব ক্রয় করিয়া, আত্মীয় লোকের বাটীতে পাঠাইতেন এবং বাটীস্থ লোক ও চাকর, চাকরাণী, মেথর প্রভৃতিকে আপনি দাঁড়াইয়া আঁব খাওয়াইতেন। ঐ সময়ে তাঁহার বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও অন্য যে সকল ব্যক্তি আসিতেন, তাঁহাদিগকে নিজের সমক্ষে বসাইয়া আঁব খাওয়াইতেন। আম্রপোস্তার হরিশ্চন্দ্র গুঁই ও শীতল চন্দ্র রায়ের দোকানে স্বয়ং যাইয়া আম্র ক্রয় করিতেন এবং উহাদের দোকানে প্রায় আধা ঘণ্টা বা তিন কোয়াটার বসিয়া, তাহাদের সহিত গল্প করিতেন। উহাদের দোকানের সম্মুখ দিয়া কোন বড়লোক গমন করিলে, তাঁহারা আশ্চর্য্যান্বিত হইতেন। এক সময়ে একটি বাবু বলেন, “মহাশয়, ও স্থানে বসিবেন না, আপনি বড়লোক, উহারা সামান্য দোকানদার।” ইহা শুনিয়া দাদা হাস্য করিয়া বলিলেন, “আমি বড় লোক অপেক্ষা ইহাদের নিকট বসিতে ও গল্প করিতে ভালবাসি।”
কালীঘাটনিবাসী বাবু ক্ষেত্রমোহন হালদার, বসতবাটী প্রভৃতি সমস্ত সম্পত্তি মহাজন ডিক্রীজারী করিয়া দেন-ডিক্রীতে বিক্রয় করিয়া লইবে জানিয়া, নিরুপায় হইয়া অগ্রজ মহাশয়ের নিকট আসিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। ইহাঁর রোদনে তিনি দুঃখিত হন এবং স্বহস্তে টাকা না থাকায়, অপরের নিকট ৪০০৲ টাকা ঋণ করিয়া, তাঁহার মহাজনের ঋণ পরিশোধ করিয়া দেন। দাদার ঐ টাকা প্রাপ্তির আশা ছিল না। কিন্তু তিনি কিছুকাল পরে ঐ টাকা যখন পরিশোধের মানস করিয়াছিলেন, তখন মহাজনের প্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, উক্ত হালদার, ক্রমশঃ ঐ টাকা পরিশোধ করিয়াছেন। বৈষ্ণবচরণ সরকার প্রভৃতি কয়েক সরীকের বসতবাটী দেন-ডক্রীতে বিক্রয় হইবার উপক্রমকালে, তাহাদিগকেও ঐরূপে উদ্ধার করিয়াছিলেন। সে সময় উহাদের এরূপ দুরবস্থা হইয়াছিল যে, কেহই তাহাদিগকে বিশ্বাস করিয়া কিছু মাত্র ধার দেয় নাই; তজ্জন্য উহারা দাদার শরণাগত হওয়াতে, তিনি দয়ার বশবর্ত্তী হইয়া, নিজহস্তে টাকা না থাকা প্রযুক্ত, তাঁহার এক পরম বন্ধুর নিকট হইতে ৮০০৲ শত টাকা ধার করিয়া, মহাজনকে দিয়া উহাদিগের বসতবাটী রক্ষা করেন।
উত্তরপাড়ায় গাড়ী হইতে পতনের দোষে দাদা, যকৃতে আঘাতপ্রাপ্ত হন; এই সূত্রে উদরাময় পীড়ার সূত্রপাত হয়। ১২৯১ সালের বৈশাখ মাস হইতে কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত পীড়া এত দূর প্রবল হয় যে, তাহাতে দাদার জীবন-সংশয় হয়। চিকিৎসক মহাশয়দের অভিপ্রায়ে আফিং খাইতে আরম্ভ করেন। প্রত্যহ প্রাতে ও সন্ধ্যায় ৩০ ফোঁট লডেনম ব্যবহার করিতে লাগিলেন, ইহাতে ত্বরায় ঐ পীড়ার উপশম হইল; কিন্তু দুই তিন মাস পরে পুনর্বার পীড়ার উদয় হইল। আফিংয়ের মাত্রায় উপকার না হওয়ায়, আফিং পরিত্যাগ করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন; কিন্তু কোন মতেই ত্যাগ করিতে পারিলেন না।
সন ১২৯৫ সালের শ্রাবণ মাসে তাঁহার পত্নী দিনময়ীদেবীর রক্তাতিসার পীড়ার উদয় হয়। দিন দিন পীড়ার বৃদ্ধি হইতে লাগিল; চিকিৎসার দ্বারা কোন ফললাভ না হওয়ায়, ভাদ্র মাসের ১লা বৃহস্পতিবার রাত্রি নয়টার সময় পতিপুত্র প্রভৃতি সমুদায় পরিবারবর্গের সমক্ষে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। দাদা, শোকে অধীর হইয়াও স্বীয় ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্যগুণে শোকদুঃখাদি প্রকাশ না করিয়া, একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা তাঁহার ঔর্দ্ধদৈহিকাদি কার্য্য সমাধার পর, কলিকাতায় শ্রাদ্ধ-ক্রিয়া সমাধা করিলেন। ঐ বৎসর পৌষমাসে পুত্রের হাতে খরচপত্র দিয়া, দেশে আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদিগের ভোজন ও সম্বৰ্দ্ধনাদি-কার্য্য করিবার জন্য বীরসিংহায় পাঠাইয়াছিলেন। নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বীরসিংহায় গিয়া, গ্রামস্থ সমুদায় স্ত্রীপুরুষদিগকে ও নিকটবর্ত্তী জমিদার ও সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া, রীতিমত সম্বৰ্দ্ধনা করিয়াছিলেন। ইহাতে যথেষ্ট ব্যয় হইয়াছিল।
দাদার পরমবন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিবিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাতে পাঠান। তথায় অবস্থিতি করিয়া সুরেন্দ্র বাবু, সিবিল সাভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অধিক বয়স বলিয়া আপত্তি উত্থাপিত হইলে ও বিলাত হইতে সংবাদ আসিলে, বাবু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আসিয়া, দাদাকে গোলযোগের কথা বলিলেন। ইহা শুনিয়া তিনি অনারেবল বাবু দ্বারকানাথ মিত্র ও শ্রীযুক্ত বাবু রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয় প্রভৃতির সহিত পরামর্শ করিয়া, বিলাতে কোষ্ঠী প্রভৃতি কাগজপত্র প্রেরণ করিয়া আপত্তি খণ্ডন করিলেন; সুরেন্দ্র বাবু সিবিলিয়ান হইলেন। বঙ্গে আগমনপূর্বক কার্য্যে প্রবিষ্ট হইলে, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদিগের সহিত তাঁহার মিল না হওয়াতে, সুরেন্দ্রবাবু পদচ্যুত হন। পদচ্যুত হইবার পরে সুরেন্দ্রবাবু মেট্রোপলিটানে প্রফেসর নিযুক্ত হন।
এক দিবস দাদা সুখাসীন হইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন, এমন সময়ে দুই জন ধর্ম্ম-প্রচারক ও কয়েকজন কৃতবিদ্য ভদ্রলোক আসিয়া উপবেশনপূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়! ধর্ম্ম লইয়া বঙ্গদেশে বড় হুলস্থূল পড়িয়াছে, যাহার যা ইচ্ছা সে তাহাই বলিতেছে, এ বিষয়ের কিছুই ঠিকানা নাই; আপনি ভিন্ন এ বিষয়ের মীমাংসা হইবার সম্ভাবনা নাই।” এই কথায় দাদা বলিলেন, “ধর্ম্ম যে কি, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই।” ইহা শুনিয়া তাঁহারা আরও পীড়াপীড়ি করিলে, তিনি বলিলেন, “আমি পরের জন্য বেত খাইতে পারিব না”; এই বলিয়া গল্প আরম্ভ করিলেন।
“এক দিবস মৃত্যুরাজ, কর্ম্মচারিগণসহ কাছারি খুলিয়া কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে; প্রহরী এক ব্যক্তিকে ধৃত করিয়া আনিলে, মৃত্যুরাজ তাহাকে বলিলেন, তুমি অমুকের উপাসনা না করিয়া, কি জন্য অমুকের উপাসনা করিলে? উপাসক বলিলেন, আমার অপরাধ নাই, অমুক ধর্ম্ম-প্রচারক আমাকে যেরূপ উপদেশ দিয়াছেন, আমি তদনুসারে কার্য্য করিয়াছি। এই কথায় মৃত্যুরাজ, উপাসকের প্রতি পাঁচ বেতের আদেশ দিয়া, তাহাকে এক সন্নিহিত বৃক্ষতলে রাখিতে বলিলেন। এইরূপ তিন চারি জন উপাসককে দণ্ড দিবার পর, আপনার মত একজন ধর্ম্ম-প্রচারক আনীত হইলেন। ঐ ধর্ম্মপ্রচারককে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, বিদ্যাসাগরের উপদেশানুসারে আমি অমুক উপাসনা করিয়াছি এবং অনুগামী ব্যক্তিদিগকেও ঐ উপাসনার উপদেশ দিয়াছি। মৃত্যুরাজ, প্রথমতঃ তাঁহার নিজের হিসাবে পাঁচ বেত দিয়া, অনুগামী উপাসকদিগকে আনাইয়া, প্রত্যেকের হিসাবে পাঁচ পাঁচ বেতের আদেশ দেন। এরূপ দুই তিন জন প্রচারকের পর, আমিও মৃত্যুরাজের সম্মুখে নীত হইলাম। প্রথমতঃ আমাকে নিজের হিসাবে পাঁচ বেত দিয়া, প্রত্যেক উপাসক ও প্রত্যেক প্রচারকের হিসাবে পাঁচ পাঁচ বেত হুকুম দিলেন। ইহাতে আমার শরীরে তিলাৰ্দ্ধ স্থান রহিল না; তথাপি বহুসংখ্যক বেত বাকী রহিল এবং অবশিষ্ট বেত শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত প্রত্যহ বেত খাইতে হইল।” এই কথার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন, “আমার বোধ হয় যে, পৃথিবীর প্রারম্ভ হইতে এরূপ তর্ক চলিতেছে ও যাবৎ পৃথিবী থাকিবে, তাবৎ এই তর্ক থাকিবে; কস্মিনকালেও ইহার মীমাংসা হইবে না। তাহার দৃষ্টান্ত দেখুন, মহাভারতে বেদব্যাস লিখিয়াছেন, বকরূপী ধর্ম্মরাজ, এই মর্ম্মে ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলে, যুধিষ্ঠির উত্তর করিলেন।
বেদা বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্নাঃ নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নং।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ॥” বীরসিংহ ভগবতী-বিদ্যালয়।
সন ১২৯৬ সালের চৈত্র মাসে অগ্রজ মহাশয়, পত্র লিখিয়া আমায় কলিকাতায় আনাইয়া বলেন, “দেশে ম্যালেরিয়াপ্রযুক্ত এতাবৎকাল বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এক্ষণে আর দেশে ম্যালেরিয়া নাই; অতএব জন্মভূমির বালকগণের মোহান্ধকার নিবারণ জন্য পুনর্ব্বার বিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা করিতেছি।” কিন্তু তিনি কায়িক অসুস্থতা-নিবন্ধন স্বয়ং দেশে যাইয়া বিদ্যালয় স্থাপন করিতে অক্ষম হইয়া, আমায় বলেন, “তোমাকে পূর্ব্বের মত সকল কার্য্যেরই ভার গ্রহণ করিতে হইবে।” তাহাতে আমি বলিলাম, “কাশী হইতে আসিবার পর আমার দুই পুত্র কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে, অবশিষ্ট পুত্রটীও জ্বরকাশ-রোগে আক্রান্ত হইয়াছে। বিশেষতঃ ৯৪ সালে পিতামহীর প্রতিষ্ঠিত যে অশ্বখ-বৃক্ষের তত্ত্বাবধানের ভার দিয়াছিলেন, তাহাতে যে সকল লোক মহাশয়ের দ্বারা প্রতিপালিত হইয়াছে, তাহারা সকলে ঐক্য হইয়া, ঐ বৃক্ষ-উপলক্ষে অকারণ আমাকে ফৌজদারীতে আসামী-শ্রেণী-ভূক্ত করিয়া, আমার নামে অভিযোগ করিয়াছিল। ঐ মোকদ্দমায় অব্যাহতি পাইলে, দেওয়ানীতে আসামী হই। এইরূপে সকলের সহিত মনান্তর হইলে, আমি অন্য কার্য্যের ভার গ্রহণ করিতে অক্ষম। বিশেষতঃ বিদ্যালয়ের বাটী নাই, নূতন বাটী প্রস্তুত করিতে চইবে। আগ্রে বাটী প্রস্তুত করিয়া, পরে বিদ্যালয় স্থাপন করা উচিত; নচেৎ অপরের বাটীতে বিদ্যালয় বসাইলে, কার্য্যের সুবিধা হইবে না।” এই কথা বলিয়া আমি দেশে যাই। সন ১২৯৭ সালের ২রা বৈশাখ, অগ্রজ মহাশয়, ভাগিনেয় চিন্তামণি মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি পাঁচ জনকে শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া, বীরসিংহায় বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রথমতঃ নিজ গ্রাম ও সন্নিহিত দুই তিন খানি গ্রামের বালকের অধ্যয়নার্থে প্রবিষ্ট হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঁচ জন শিক্ষক নিযুক্ত করতঃ, পুনর্বার বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন দেখিয়া, দেশস্থ লোকপরম আহলাদিত হইলেন। শিক্ষুক চিন্তামণি বাবু, দাদার বিনা অনুমতিতে কার্য্য করিয়াছিলেন। তাহা শুনিয়া চিন্তামণি বাবুকে পত্র দ্বারা ডাকাইয়া বলেন, “তোমাদের দ্বারা বিদ্যালয়ের কার্য্য সম্পন্ন হইবে না, অতএব তোমাদের বেতনাদি গ্রহণ কর। বিদ্যালয় বন্ধ থাকিবে, আমি স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করিব।” সুতরাং চিন্তামণি হতাশ হইয়া বাটী প্রতিগমন করেন। এই সংবাদ শুনিয়া, আমি আষাঢ় মাসে দাদার সহিত সাক্ষাৎ করিতে কলিকাতা গিয়াছিলাম; তাহাতে তিনি আমাকে বলেন, “তুমি যদি ভার গ্রহণ কর, তাহা হইলে স্কুল রাখিব, নিচেৎ তুলিয়া দিব।” ইহা শুনিয়া অগত্যা ভার গ্রহণ করিয়া, বাটী আগমন করিলাম। পুনরায় শ্রাবণমাসে কলিকাতায় গমন করিলে, আর পাঁচজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। বালকগণের বেতন ও য়্যাডমিসন ফি না থাকায় এবং সুশৃঙ্খলা স্থাপন হওয়ায়, দিন দিন ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। শিক্ষকগণসহ আসিবার সময় কতকগুলি বেঞ্চ ও চেয়ার আমার সমভিব্যাহারে পাঠাইয়া দেন এবং বিদ্যালয়-সম্বন্ধে তাঁহার কৃত নিয়মাবলীও স্বাক্ষর করিয়া, আমার হস্তে প্রদান করেন। ইহা দেখিয়া ঘাঁটাল, জাড়া, ক্ষীরপাই, ঈড়পালা প্রভৃতি স্থানের বিদ্যালয় সকলের কর্তৃপক্ষগণ এবং ঘাঁটাল মুনসেফী আদালতের অনেকগুলি উকীল, ঈর্য্যাপরবশ হইয়া কল-কৌশলে ঐ বিদ্যালয় উঠাইবার মানসে অগ্রজকে অনেক পত্র লিখেন। কিন্তু তিনি ঐ সকল অসম্বন্ধ-পত্র দেখিয়া, কিঞ্চিম্মাত্র ক্ষুব্ধ বা অসন্তুষ্ট না হইয়া, আমাকে দেশে পত্র লিখেন ও কলিকাতায় তাঁহার নিকটে আসিলে ঐ সকল পত্রগুলি আমাকে দেখাইয়া বলেন, “শঙ্কু, এই সকল কারণে তুমি ক্ষুব্ধ বা নিরুৎসাহ হইও না। আমি এই সকল অজ্ঞ ও ঈর্যাপরবশ ব্যক্তিদিগের কথায় কর্ণপাত করি না। আমি পুর্ব্বে বীরসিংহ-বিদ্যালয় স্থাপন করিলে, যেরূপ দেশের উন্নতি-সাধন জন্য যত্ন করিয়াছিলে, এক্ষণেও সেইরূপ যত্ন করিতে ত্রুটি করিও ना। আমার অভিপ্রায়, আমি ব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হইব না। আমি টাকা মাত্র দিব, কিন্তু তুমি অন্য সকল বিষয়ে সর্ব্বেসর্ব্বা অর্থাৎ শিক্ষক-নিয়োগ ও পদচ্যুতি বিষয়ে তুমি যাহা করিবে, আমি তাহাতেই সম্মত হইব।” কয়েক মাস পরে আর চারিজন শিক্ষক প্রেরণ করেন ও আমাকে পত্র লিখেন। শারীরিক অস্বাস্থ্য-নিবন্ধন অগ্রজ, পৌষমাসে ফরাসডাঙ্গার গঙ্গাতীরে বাবু গুরুপ্রসন্ন ঘোষ ও উমাচরণ খাঁয়ের বাটী ভাড়া লইয়া, তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আগমনপূর্ব্বক মেট্রোপলিটান কলেজ ও স্কুল কয়েকটীর ও অন্যান্য বিষয় সকলের তত্ত্বাবধান করিয়া ফরাসডাঙ্গায় গমন করিতেন। বীরসিংহ-বিদ্যালয়ের এপিলেসন ও অন্যান্য কার্য্য জন্য আমাকে আসিতে আদেশ করায়, আমি উপস্থিত হইলে পর, দাদা বলিলেন, “ত্বরায় চিকিৎসালয় স্থাপন না করায়, আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি।” আমি বলিলাম, “নিজ বাটী ভিন্ন অপরের বাটীতে চিকিৎসালয়ের কার্য্য চলিতে পারে না। অতএব আপনি ত্বরায় বালক-বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় ও বলিকা-বিদ্যালয় এবং রাখাল-স্কুলের বাটী নির্ম্মাণের ব্যবস্থা করুন। বাটী নির্ম্মাণ হইবার পর পনর দিবস মধ্যে চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপন করিতে পারিব।” তিনি বলিলেন, “শরীরে কিছু স্বাস্থ্য লাভ করিয়া ও ভারতব্যবস্থাপক-সভার সহবাস-সম্মতি আইনের সম্বন্ধে আমার অভিপ্রায়ানুরূপ ব্যবস্থা লিখিয়া পাঠাইয়া, দেশে যাইয়া ঐ সকল কার্য্য সমাধা করিব।”
এক দিবস দাদাকে বলিলাম, “মহাশয়! আমি আপনার জীবনচরিত লিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।” এই কথায় দাদা বলিলেন, “পড় দেখি, শুনি।” তাঁহার আজ্ঞানুসারে জীবনচরিতের উপক্রমণিকা, শিশুচরিত সমগ্র ও স্থানে স্থানে দুই চারি পৃষ্ঠা শুনাইবার পর তিনি বলিলেন, “লেখা ভাল হইয়াছে, কিন্তু দান ও সাহায্য বিযয়গুলি উঠাইয়া দিও, নতুবা অনেকে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হইবেন।” কিন্তু আমি এই পুস্তক মুদ্রিত করিবার পুর্বে অনেককে জিজ্ঞাসা করায়, যাঁহারা ঐ বিষয় মুদ্রিত-করণে আপত্তি করিলেন, তাঁহাদের বিষয় উল্লেখ করিলাম না এবং য়াঁহারা কৃতজ্ঞ-হৃদয়ে ও সরল ভাবে অনুমতি দিলেন, তাঁহাদের বিষয় মুদ্রিত করিলাম।
ইতিমধ্যে অৰ্দ্ধোদয়-যোগে ফরাসডাঙ্গার বাসা-বাটীতে বহু লোকের সমাগম হওয়ায়, তাহাদের রীতিমত তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে কলিকাতায় বাদুড়বাগানের বাটীতে আত্মীয় কুটুম্ব ও কুটুম্বদিগের গ্রামবাসীরা এবং বীরসিংহা ও তৎসন্নিহিত কয়েকটী গ্রামবাসী কতকগুলি লোক অৰ্দ্ধোদয়যোগ উপলক্ষে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছিল। দাদার প্রতীক্ষা করিয়া, তাহারা বাদুড়বাগানের বাটী হইতে না যাওয়ায়, দাদার কনিষ্ঠ জামাতা কার্ত্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ফরাসডাঙ্গায় ঐ মর্ম্মে পত্র লিখেন। এই সংবাদ পাইয়া অগ্রজ, ফরাসডাঙ্গার বাটীস্থিত আগত আত্মীয়াদিগকে বিদায় দিয়া কলিকাতায় আসিলেন। বহু লোকের সমাগম দেখিয়া আমি বলিলাম, “অৰ্দ্ধোদয় না হইয়া আপনার পূর্ণোদয় হইয়াছে।” এই কথায় তিনি ঈষৎ হাস্য করিলেন। পাথেয় ও বস্ত্র দিয়া অধিকাংশ লোককে বিদায় করিলেন। দেশস্থ বিদ্যালয়ের আপিলেসন-সম্বন্ধে আমাকে আপন নামে দরখাস্তাদি দাখিল করিতে আদেশ করেন; কিন্তু আমি তাহাতে সন্মত না হইয়া, দাদাকে অনুরোধ করায়, দাদা স্বীয় নামে দরখাস্তাদি লিখাইয়া, তাহার প্রিয়পাত্র মেট্ৰপলিটান বিদ্যালয়ের কর্ম্মচারী বাবু ব্রজনাথ দের দ্বারা স্কুল-ইনস্পেক্টরের নিকট প্রেরণ করেন। বিদ্যালয়ের মোহর ও নাম-কারণের উল্লেখ হওয়ায়, আমাকে নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে বলেন। আমি উহা বিদ্যাসাগর ইনসটিটিউসন বলিয়া লিখিলাম। দাদা তাহা দেখিয়া বলিলেন, “আমি তোমা অপেক্ষা ভাল লিখিতে পারি।” এই বলিয়া “ভগবতী-বিদ্যালয়” এই নামটি লিখিয়া, আমাকে ও উপস্থিত ব্রজবাবু প্রভৃতিকে বলিলেন, “শাস্তুর অপেক্ষা আমার লেখাটি ভাল হইল কি না?” আমি বলিলাম, “মহাশয়! লেখা ভাল হইলে কি হইবে, উহাতে অনেক দোষ আছে; বিদ্যালয়টি আপনার নামে থাকিয়া কোন কারণে উঠিয়া গেলে, আপনার পুত্রের উপর দোষ বর্ত্তিবে; কিন্তু জননী-দেবীর নামে হইয়া উঠিয়া গেলে, লোকে বলিবে, বিদ্যাসাগর এমনি কুলাঙ্গার যে, মাতৃদেবীর কীর্ত্তি লোপ করিল।” দাদা বলিলেন, “আমি কি ইহার বন্দোবস্ত না করিব। তুমি ঐ সকল বিষয়ের জন্য দেশে একত্র, আট বিঘা জমী স্থির করিয়া দাও, স্কুলের স্থায়িত্বের বিষয় তোমায় ভাবিতে হইবে না। স্কুলের স্থায়িত্ব-সম্বন্ধে যাহা করিতে হইবে, তাহা আমার স্থির করা আছে।” এই বলিয়া উহাঁর প্রিয়পাত্র ব্রজবাবুর প্রতি স্কুলের মোহর করাইবার ভার অর্পণ করিলেন। ব্রজবাবু, মোহর প্রস্তুত করাইয়া আমার হস্তে দেন। তদবধি বিদ্যালয়টি জননী-দেবীর নামে “ভগবতী-বিদ্যালয়” হইল। এই সময়ে ভগবতী-বিদ্যালয়ে চৌদ্দ জন শিক্ষক নিযুক্ত হয় এবং মাসিক দুইশত বাষট্টি টাকা ব্যয়ের বন্দোবস্ত হয়। তৎপরে আমাকে বলিলেন, “স্কুলবাটীর জন্য দশহাজার টাকা রাখ, এবং আবশ্যক হয়, আরও দুই তিন হাজার দিব।” আমি বলিলাম, “দেশে গিয়া বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিলে ঐ টাকা লইব, এখন লইতে পারি না।”
শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ সরকার সি, আই, ই র সায়েন্স-আসোসিয়েসনের জন্য অগ্রজ মহাশয়, এক সহস্র টাকা দিয়াছিলেন।
ঘাঁটাল-প্রদেশ বন্যার জলে প্লাবিত হওয়ায়, ঐ প্রদেশবাসী বিপন্ন লোকদিগের সাহায্যজন্য দাদা, মেদিনীপুরের মাজিষ্ট্রেট্ কর্ণিস্ সাহেবের নিকট পাঁচ শত টাকা প্রেরণ করিয়াছিলেন।
শ্রীযুক্ত প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় বিপদে পড়িয়া দাদার শরণাগত হইলে, দাদা তাঁহার আত্মীয় ব্যক্তিদের নিকট ঋণ করিয়া, প্রসন্নবাবুকে ন্যূনাধিক পঞ্চ সহস্র টাকা দেন। উহাঁর মৃত্যুর পর, দাদা নিজে ঐ ঋণ পরিশোধ করেন। অনেকের জন্য দাদাকে এরূপ করিতে হইয়াছে।
এক দিবস জনৈক সন্ত্রান্ত ব্যক্তি শীতকালে ৫০০৲ শত টাকা মূল্যের শালের জোড়া গায়ে দিয়া, বাদুড়াগানের বাটীতে আসিয়া, লাইব্রেরী দেখিয়া দাদাকে বলিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়! এত অধিক ব্যয় করিয়া পুস্তকগুলি বাঁধাইবার প্রয়োজন কি?” দাদা স্মিত-বদনে বলিলেন, “মহাশয়! ১।০ পাঁচ সিকার কম্বলে শীত নিবারণ হয়, আপনি কি জন্য ৫০০৲ শত টাকার শাল গায়ে দিয়াছেন?”
পৌষমাস হইতে দাদার পীড়া দিন দিন বৃদ্ধি হইতে লাগিল ও বলের হ্রাস হইতে লাগিল এবং মানসিক অবস্থার অবনতি হইতে লাগিল। এই সকল দেখিয়া, চিকিৎসক ও বন্ধুগণ কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া, জলবায়ু পরিবর্ত্তনজন্য সমধিক স্বাস্থ্যকর স্থানে বাস করিতে অনুরোধ করেন।་ এদিকে মেট্ৰপলিটানের অবস্থা এরূপ ঘটিয়াছে যে, মধ্যে মধ্যে স্বয়ং মেট্ৰপলিটানে উপস্থিত হইয়া সমস্ত বিষয় স্বয়ং তত্ত্বাবধান না করিলে কোনও মতেই চলে না; এই কারণে সমধিক দূরবর্তী স্বাস্থ্যকর প্রদেশে যাইতে পারিলেন না। কিন্তু কলিকাতায় অবস্থিতি করাও চলিতেছে না; এমত অবস্থায় গঙ্গাতীরে ফরাসডাঙ্গায় দুইটী বাটী ভাড়া লইয়া ও নিত্য-ব্যবহারোপযোগী দ্রব্যসামগ্রী লইয়া, তথায় গমন করেন। মধ্যে মধ্যে মেট্ৰপলিটানের ও অন্যান্য বিষয়-কর্ম্মের জন্য কলিকাতায় আসিতে হইত। প্রথম মাসে কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্য লাভ করিলেন; কিন্তু কন্যা ও দৌহিত্রাদি নিকটে না থাকায় ও মনের স্বচ্ছন্দতা না থাকায়, তাহাদিগকে ফরাসডাঙ্গায় লইয়া যান।
এই সময়ে পৌষের প্রারম্ভে, জাহানাবাদের অনাররি মাজিষ্ট্রেট্ কয়াপাঠ বদনগঞ্জ-নিবাসী রামরাঘব মুখোপাধ্যায়, স্বকীয় কোনও বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া, ঈশানচন্দ্রের সহিত কথোপকথন-সময়ে আমার সহিত আলাপ হওয়ায়, তাঁহাকে দাদার নিকট পরিচিত করিয়া দিই। তিনি দাদার কোষ্ঠী লইয়া দেশে গমন করেন। তথায় গণনা করিয়া মৃত্যু-আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়া, অযুত হোমের ও পঞ্চাঙ্গ-স্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করিয়া পত্র লিখেন। ফাল্গুন মাস হইতে ফরাসডাঙ্গা আর স্বাস্থ্যকর বোধ হইল না। উল্লিখিত গণনায় জলমগ্ন হইবার আশঙ্কা প্রভৃতি অবলোকন করিয়া, নিজের তাদৃশ বিশ্বাস না থাকায়, কেবল কন্যা প্রভৃতির অনুরোধে, পঞ্চাঙ্গ-স্বস্ত্যয়ন ও হোমের ব্যবস্থা করিয়া, কলিকাতায় বাদুড়বাগানের বাটীতে পুরোহিত ও ব্রাহ্মণদিগকে নিযুক্ত করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু ফলোদয় হইল না। উত্তরোত্তর পীড়া বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে, আর ফরাসডাঙ্গায় অবস্থিতি করা উচিত নয় এই বিবেচনায়, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে কলিকাতায় আসিয়া চিকিৎসার উদেযাগ পাইতে লাগিলেন। এই সময় এলোপ্যাথি ডাক্তার ও আয়ুর্ব্বেদীয় চিকিৎসক মহাশয়েরা বলিলেন, “অহিফেনের মাত্রা এত অধিক পরিমাণে থাকিলে, আমাদের চিকিৎসায় উপকার দর্শিবে না।” কলুটোলা হইতে সেখ আবদুল লতীব হকিমকে আফিং পরিত্যাগ করাইবার জন্য আনাইলেন। ১৮ই আষাঢ় হইতে উক্ত হকিমের চিকিৎসা আরম্ভ হইল।
তাঁহার ব্যবস্থায় পীড়ার উপশম হইতে লাগিল; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, দুই দিন পরে হিক্কা প্রভৃতি উদয় হইয়া, ২০ শে আষাঢ় কম্পের সহিত জ্বরের উদয় হইল। ২১ শে আষাঢ় জ্বরের হ্রাস হইল বটে, কিন্তু হিক্কা প্রবল হইয়া হস্তপদ শীতল হইল; কিন্তু তথাপি উক্ত হিক্কা নিবারণ জন্য অপর ঔিষধ ব্যবহার করিলেন না। ঐ দিবসেই হকিমের ঔষধে অহিফেন ভিন্ন অপর মাদকদ্রব্য-নিবন্ধন দুই তিন দিন প্রলাপ হয়। এই সময়ে সমাগত ব্যক্তিদিগকে সাবেক অভ্যাস অনুসারে সমধিক সমাদর করিতে লাগিলেন এবং ঐ প্রলাপ-সময়ে নিজের কালেজ ও স্কুলগুলির সম্বন্ধে নানাবিধ কথা কহিতে লাগিলেন। ২৩ শে আষাঢ় পুনরায় হিক্কা, বেদনা প্রভৃতি পীড়ার লক্ষণগুলি প্রবল হইতে লাগিল এবং ঐ সময় নেবা রোগের আরম্ভ হইয়াছে দেখিয়া, হকিমের চিকিৎসা বন্ধ হইল। ক্লোরোডাইন সেবন করায় বেদন ও হিক্কার হ্রাস হইল। উক্ত হকিম সাহেব উদারচরিত ভদ্রলোক; আন্তরিক যত্ন ও শ্রদ্ধাসহকারে চিকিৎসা করিয়াছিলেন। ২৪শে আষাঢ়, ডাক্তার হীরালাল বাবু ও বাবু অমূল্যচরণ বসু পরীক্ষা করিয়া, ২৫শে আষাঢ় পরামর্শজন্য ডাক্তার ম্যাকোনেল সাহেবকে আনাইলেন। উক্ত সাহেব পরীক্ষা করিয়া অসাধ্য বিবেচনায়, বাৰ্চ্চ সাহেবের সহিত পরামর্শ করিতে হইবে বলিয়া, তাঁহাকে আনাইবার উপদেশ দেন; কিন্তু ম্যাকোনেল সাহেব, এই পীড়া এলোপ্যাথি চিকিৎসার অসাধ্য বলায়, পরদিন ২৬ শে আষাঢ় বেল ৯টার সময় ডাক্তার শালজার সাহেব আসিয়া ভালরূপ পরীক্ষা করিয়া বললেন, “ষ্টমাকে ক্যানসার হয় নাই, কেবল পাকস্থলীতে টিউমার হইয়াছে; কিন্তু উহা মারাত্মক নহে, তবে এই যে নেবা উৎপন্ন হইয়াছে, ইহাই ইহাঁর পক্ষ মারাত্মক হইবার সম্ভাবনা। ইহা চরি পাঁচ দিনের মধ্যে উপশম হইলে হইতে পারে; কিন্তু ইহা অপেক্ষা পণ্ডিতের বয়োবাৰ্দ্ধক্য, শারীরিক দৌর্ব্বল এবং জীর্ণশীর্ণতা এই তিন কারণেই পীড়া উপশমের সম্ভাবনা অতি অল্প।” এই কথা বলায় তাঁহাকে বিদায় দিয়া, বৈকালে ম্যাকোনেল ও ভাক্তার বার্চ উভয়ে আসিয়া ও পরীক্ষা করিয়া অসাধ্য বলায়, ডাক্তার হীরালাল বাবু ও অমূল্য বাবুর এলোপ্যাথিক চিকিৎসা-নির্ব্বন্ধ খণ্ডন করিয়া, শালজার সাহেব দ্বারা চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। শালজার সাহেবের চিকিৎসায় বেদনা, হিকা, নেবা, প্রভৃতি লক্ষণগুলির হ্রাস হইতে লাগিল, কিন্তু কোষ্ঠবদ্ধ পীড়ার উদয় হইল। হিক্কার লক্ষণ পুনরায় বৃদ্ধি হইতে লাগিল। মধ্যে মধ্যে অম্লপিত্ত কমিতে লাগিল। ডাক্তার শালজার সাহেব প্রত্যহ তিন চারি বার আসিতে লাগিলেন। কোন দিবস কিছু কমে, কোন দিবস বৃদ্ধি হয়। হিক্কা বন্ধ না হওয়ায়, রজনীগন্ধ ফুল বাটিয়া সেবন করান হয়; তাহাতে যদিও হিক্কার অনেক হ্রাস হক্সাছিল, কিন্তু ঐ দিবসেই স্বল্প জ্বরের উদয় হয়। দিনে দিনে অল্পে অল্পে জ্বর বৃদ্ধ হইতে লাগিল। হিক্কাসম্বন্ধে রজনীগন্ধ ফুলের আর কোনও ক্ষমতা রহিল না। মুখমণ্ডল প্রভৃতির ও জীবনের শ্রী কমিয়া আসিতে লাগিল।
ডাক্তার শালজার নিরাশ হইলেন এবং বলিলেন, “তোমরা অপরের দ্বারা চিকিৎসা করাইতে পার এবং অবশ্যক হইলে, আমি বন্ধুভাবে ও চিকিৎসকভাবে প্রত্যহ আসিতে ও দেখিতে পারি, তদ্বিষয়ে আমার মনে কিছুমাত্র আপত্তি বা অসন্তোষ নাই।” পর দিবস ৭ই শ্রাবণ বৈকালে, দাদা পূর্ব্বে মধ্যে মধ্যে যে ঔষধ ব্যবহার করিতেন, সেই ঔষধ ব্যবহৃত হইতে লাগিল। ৯ই শ্রাবণ রাত্রিতে সামান্য পুরাতন মল নিৰ্গত হয় ও ১০।১১ই শ্রাবণ তাঁহাকে সকলে কিঞ্চিৎ সুস্থ বলিয়া বোধ করিলেন। ঐ দিবস কনিষ্ঠ সহোদর ঈশান, ভালরূপ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “যাতনা প্রভৃতি পীড়ার লক্ষণগুলির হ্রাস হইয়াছে বটে, কিন্তু নাড়ীর ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে এবং আরও দুই একটি লক্ষণ উদয় হইয়াছে, তাহাতে অদ্য আমার বিবেচনায় আর কিছুমাত্র আশা নাই। তরুণবয়স্ক হইলে অদ্যই মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু পরিণতবয়স্ক বলিয়া ও শরীরের দৃঢ় গঠন বলিয়া, মৃত্যুর আরও ২।৩ দিন বিলম্ব আছে।” শেষ কয়েক দিবস যদিও প্রত্যহ জ্বর বৃদ্ধি হইতে লাগিল, তথাপি অল্প অল্প অল্প দাস্ত হওয়ায়, মৃত্যুর সময় পর্য্যন্ত তাঁহার জ্ঞানের ব্যতিক্রম ঘটে নাই।
সচরাচর মৃত্যুর পূর্ব্ব জ্বরবিচ্ছেদ হইয়া নাড়ী ত্যাগ হয়, কিন্তু ১৩ই শ্রাবণ অপরাহ্ন হইতে জ্বর বৃদ্ধি হইতে লাগিল। রাত্রি ৯টার পর হইতে প্রতি মিনিটে নাড়ীর গতি এক শত ত্রিশ ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সংখ্যা ৫০শের নূ্ন্য নহে। কিন্তু এই পীড়ায় অন্য সময়ে নাড়ীর স্বাভাবিক গতি ৬০এর উৰ্দ্ধ নহে।
এই দিবস রাত্রি একটা পনর মিনিটের পর জ্ঞানরাশির জ্ঞানলোপ হইল। দুইটা আঠার মিনিটের সময় তিনি এই অসার সংসার পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার আত্মীয়বর্গ তাঁহাক নিজ-ব্যবহৃত পল্যঙ্কে শয়ন করাইয়া, তাঁহার এক মাত্র পুত্র নারায়ণকে সমভিব্যাহারে লইয়া, তাঁহার আদরের জিনিস মেট্টোপলিটান কলেজে কিয়ৎক্ষণ রাখিয়া, বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে পুনরায় স্কন্ধে বহন পূর্ব্বক নিমতলার ঘাটে নামাইলেন, ও কিয়ৎক্ষণ পরে শ্মশানে গিয়া অন্তোষ্টিক্রিয়া সমাপন করিলেন। অনন্তর সকলে গঙ্গায় স্নানতৰ্পণাদি সমাপন করিয়া, বাদুড়বাগানের বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন।
সম্পূর্ণ।