বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/চিতাভস্ম
একবিংশ পরিচ্ছেদ॥ চিতাভস্ম
শ্মশান।—তুমি মানবের শেষ সদগতি—স্থল।—তুমি মহাপবিত্র পণ্য তীর্থক্ষেত্র! তোমার এখানে পণ্ডিত, মুর্খ, ধনী, নির্ধন, সুন্দর, কুৎসিত, মহৎ, ক্ষুদ্র—সংসারের এই ভেদজ্ঞান নাই! —তোমার এখানে স্বাভাবিক, কৃত্রিম; নৈসর্গিক, অনৈসর্গিক; পার্থিব, অপার্থিব;—এ সকল বৈষম্য নাই!—এমন সাম্যস্থান জগতে ত অন্বেষণ করিয়া পাই না!—সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান! —তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র! তোমার এখানে আসিলে, মনুষ্যজীবনের অসারতা উপলব্ধি হয়, —আত্মাভিমান সঙ্কুচিত হয়—স্বার্থপরতা দূরে পলায়ন করে —অশান্ত মানব ক্ষণেকের জন্য শান্ত মূর্ত্তি ধারণ করে!—সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান!—তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র। তোমার এখানে আসিলে মনে ঘোরতর বৈরাগ্যের উদ্রেক হয়!—কুলের অহঙ্কার, শীলের অহঙ্কার, সৌন্দর্য্যর অহঙ্কার, বিদ্যার অহঙ্কার, ধর্ম্মের অহঙ্কার, প্রভুত্বের অহংকার,—সকল অহঙ্কারই চূর্ণীকৃত হয়!—সকল অহঙ্কারই তোমার বক্ষে পড়িয়া চিতাভস্মে পরিণত হয়। সেইজন্য মনে হয়, শ্মশান!—তুমি মহাপবিত্র পুণ্যতীর্থক্ষেত্র!
পুণ্যতীর্থ কাশীধামে, জাহ্নবীবক্ষে, মনিকর্ণিকায়, ঐ চিতা ধক্ ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে! ঐ চিতাগ্নিতে সতীর পবিত্র দেহ পড়িতেছে!—সৌন্দর্য্য পুড়িতেছে! বিশ্বপ্রেম পুড়িতেছে!—ওজস্বিতা, তেজস্বিতা; মনস্বিতা, দীনতা; মহানুভবতা, পরার্থপরতা; সহিষ্ণুতা পুড়িতেছে। মহত্ত্ব, মিতাচার; দয়া, পরোপকার; সৌজন্য, সদাচার; কর্ত্তব্যবুদ্ধি সমস্তই পুড়িতেছে! বিদ্যাসাগরের জীবনের জ্যোতিঃ পুড়িতেছে —এই সকলের সমষ্টি পুণ্যশীলা, দীনজননী ভগবতী দেবী পুড়িয়া ক্রমে চিতাভস্মে পরিণত হইতেছেন! মানবজীবনের ইহাই পরিণাম! জগতের ইহাই নিয়ম!
জগৎ —অথাৎ যাহা যায়!—মানুষ জন্মে, আবার মরে!—পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ সকলেই জন্মে, আবার দুদিন পরে মরে!—বৃক্ষ, গুন্ম, লতা সকলেই জমে ও মরে।—নির্ম্মলসলিলা, প্রাণরূপিনী স্রোতস্বিনী, নয়নানন্দকর, গাম্ভীর্য্যময় সুনীল পর্ব্বতরাজি, অপূর্ব্ব বৈচিত্র্যময়ী ধরিত্রী, সৌরজগতের কেন্দ্রীভূত এবং উদ্ভিজ্জ ও জীবজগতের প্রসবিতা সবিতৃদেব, অনন্ত ব্যোমব্যাপী সুবিচিত্র জ্যোতিষ্কমণ্ডলী—সকলেরই আদি ও পরিণাম,—ঐ জন্ম ও মৃত্যু; প্রকাশ ও বিনাশ; উৎপত্তি ও লয়! সকলেই আসে ও কিছুদিনের জন্য বিশ্বে নিজ নিজ লীলা প্রদর্শন করিয়া অনন্তে বিলীন হয়!
সমস্তই যায়!—কিছুই কি থাকে না? মানুষ মরে, কিন্তু মত্যুকেও উপহাস করে, এমন কি কিছু তাহার মধ্যে আছে?—মানুষের কীর্ত্তিই একমাত্র অবিনশ্বর!—কীর্ত্তিই তাহাকে চিরদিন অমর করিয়া রাখে!—মানুষের এই কীর্ত্তিই স্মরণ করিয়া অনন্তকাল ব্যাপিয়া জগৎ তাহার জন্য শোক প্রকাশ করে!
শোক কি?—মর্ম্মন্তুদ করুণ বিলাপই কি শোক? না!—শোক অর্থে মনে হয়—ইহা স্মৃতির উপাসনা!—এই স্মৃতির উপাসনাতেই মনুষ্যত্বের গৌরব! অনন্তকাল ব্যাপিয়া মানুষ মানুষের জন্য অনুরাগ প্রকাশ করিবে,— ইহাই প্রকৃত শোক!—সেইজন্য মনে হয়, শোক,—স্মৃতির উপাসনা! শোক,— অনন্ত সাধনা!
বঙ্গসন্তানগণ! পুণ্যশীলা ভগবতী দেবীর চিতাভস্ম গ্রহণ করুন।—অনন্তকাল ব্যাপিয়া এই আদর্শ জননীর স্মৃতির উপাসনা করুন।—তাঁহার সাধনা করুন। বঙ্গজননীগণ।—সতীর চিতাভস্ম গ্রহণ করুন!—যাঁহারা পুণ্যশীলা, তাঁহারা পুণ্যের পূজা করুন! যাঁহারা আদর্শ জীবন গঠন করিতে যত্নশীলা, তাঁহারাও পুণ্যের আরাধনা করুন!—সকলে আদর্শজননী হউন!—ইহাই আপনাদের নিকট বঙ্গসন্তানগণের বিনীত প্রার্থনা!—আপনারাই বঙ্গের প্রতি গৃহের গৃহলক্ষী,—আপনারাই বঙ্গের প্রতি পর্ণকুটীরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী,—আপনাদের পীযূষসুধাপানে বঙ্গসন্তান শশিকলার ন্যায় অনুদিন বর্দ্ধিত,—আপনাদের স্নেহ মমতায় বঙ্গসন্তান চিরদিন পরিপুষ্ট,—আপনাদের শিক্ষায় দীক্ষায় বঙ্গসন্তান শিক্ষিত ও দীক্ষিত,—আপনাদের আশীর্ব্বাদ তাহাদিগের একমাত্র সম্বল!—আপনারা সুমাতা হউন,—বঙ্গসন্তান, আপনাদেরই সন্তান বলিয়া—জগতে ধন্য হউক! আপনারা তপস্যা ও সাধনার বলে ভগবতী দেবীর ন্যায় আদর্শজননী হউন! আপনাদের অক্ষয় পুণ্যপ্রভাবে বঙ্গের গৃহে গৃহে বিদ্যাসাগর বঙ্গসন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করুন!
স মা প্ত