বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/মহানুভবতা ও পরার্থপরতা

সপ্তম পরিচ্ছেদ॥ মহানুভবতা ও পরার্থপরতা

 মানবমাত্রেই স্বার্থসাধনে সতত ব্যস্ত। এবং যদিও আপনার মঙ্গল চেষ্টা করা কোনক্রমে দূষণীয় নহে, তথাপি আত্মসার ব্যক্তি অপেক্ষা পরার্থপর ব্যক্তি যে প্রকৃত সাধুপদবাচ্য সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। মনুষ্যজাতি জীবনযাত্রা নির্ব্বহার্থ পরস্পর আনুকূল্য অপেক্ষা করে, কিন্তু সকলে পরার্থসাধনার্থ পরস্পর অনুকূলাচরণ করিলে, কখনই লোকস্থিতি উচ্ছিন্ন হইয়া যাইতে পারে না। পরন্তু জনসমাজ সুশৃঙ্খল হয় এবং অনন্ত উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে। পরার্থপর ব্যক্তিদিগের অভ্যুদয় অধিককাল স্থায়ী হয়। কারণ, আত্মপ্রসাদ তাঁহাদের চিরসঞ্চিত ধন। ফলতঃ যিনি আত্মস্বার্থ পরার্থে বলি দিতে শিক্ষা করিয়াছেন, তিনিই ইহজগতে প্রকৃত মহান ও মহানুভব। তিনি যে স্থানে পদসঞ্চালন বা অবস্থিতি করেন, সে স্থান শান্তরসাস্পদ তপোবনেই পরিণত হয়।

 বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের প্রিনসিপাল্, ৩০০ টাকা বেতন পান, পুস্তকাদির আয়ও যথেষ্ট, তখন এক সময়ে কোন কার্য্যোপলক্ষে বীরসিংহে আগমন করেন। একদিন প্রসঙ্গক্রমে মাতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তোমার কি কি গহনা পরিবার ইচ্ছা হয়? তদুত্তরে ভগবতী দেবী বলিলেন, “বাবা, অনেকদিন হইতে আমার তিনখানি গহনা পরিবার বড়ই ইচ্ছা আছে। কিন্তু সুযোগ উপস্থিত হয় নাই বলিয়া আমি এযাবৎ তোমাকে বলি নাই। যাহা হউক তুমি স্বয়ং জিজ্ঞাসা করিলে, না ভালই হইল। দেখ বাবা, দেশের ছেলেগুলো মূর্খ হইয়া যাইতেছে, ইহাদের বিদ্যাদানের জন্য তুমি একটি দাতব্য বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া দাও, এটি আমার মনে বড় সাধ। আর দেখ দেশের গরীব লোকের অর্থাভাবে চিকিৎসা করাইতে পারে না, চিকিৎসাভাবে অকালে অনেকে মরিয়া যাইতেছে। সুতরাং উহাদের প্রাণরক্ষার জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন কর। আর বাবা, গরিবের ছেলেরা কোথায় থাকিবে, কোথায় আহার করিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিবে? ইহাদের আহার ও বাসস্থানের সুবিধার জন্য একটি অন্নসত্রের প্রতিষ্ঠা কর। বাবা! অনেকদিন হইতে, আমার এই তিনখানি গহনা পরিবার বড়ই ইচ্ছা আছে। মায়ের সাধ পূর্ণ করা উপযুক্ত পুত্রের কার্য্য। তুমি আমার উপযুক্ত পুত্র, এখন মাকে গহনা পরাইয়া তোমার মায়ের অনেক দিনের সাধ পূর্ণ কর।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, জন্মভূমি বীরসিংহ ও তৎসন্নিহিত গ্রামবাসী লোকগণের ও বালকবৃন্দের মোহান্ধকার নিবারণ মানসে বিদ্যালয় স্থাপন করিবেন, শৈশবকাল হইতে এ বিষয় মনে মনে আন্দোলন করিতেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবপ্রযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপন করিব এই বাসনা অন্তর্নিহিত করিয়া রাখিয়াছিলেন।

 এক্ষণে তাঁহার অন্তর্নিহিত বাসনারূপ প্রবল অগ্নিতে মাতার আশীর্ব্বাদরূপ পূর্ণাহতি প্রক্ষিপ্ত হওয়ায় তাঁহার বাসনাগ্নি দ্বিগুণতর প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি আর কালক্ষয় না করিয়া পরদিবসই বিদ্যালয়ের স্থান নিরূপিত করিলেন। ভূস্বামী রামধন চক্রবর্ত্তী প্রভৃতিকে মুল্য দিয়া ভূমিবিক্রয়ের কোবালা পত্র লিখাইয়া লইলেন। ইহার পর দিবস মজুর পাওয়া যায় নাই দেখিয়া, বিদ্যাসাগর স্বয়ং কোদাল লইয়া ভ্রাতৃবর্গের সহিত মাটী খনন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পরে বিদ্যালয় গৃহ শীঘ্র নির্ম্মাণ জন্য পিতৃদেবকে সহস্রাধিক মুদ্রা দিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন।

 ১৮৫৩ খৃঃ অব্দে গ্রীষ্মাবকাশের পূর্ব্বে চৈত্রমাসে মধ্যম ও তৃতীয় সহোদর ও তৎকালীন বাসায় যে যে আত্মীয় সংস্কৃত কলেজের উচ্চ শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহাদিগকে দেশস্থ বালকগণের শিক্ষাকার্য্য সম্পাদনার্থে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। বিদ্যালয় প্রস্তুত হইতে আরও ৪ মাস সময় অতিবাহিত হইবে, একারণ দেশস্থ স্বীয় বাসভবনে ও সন্নিহিত প্রতিবেশী লোকের ভবনে ফাল্গুন মাসে বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ইতিপূর্ব্বে এ প্রদেশে কোনও স্কুল স্থাপিত হয় নাই। স্থানীয় অনেকের সংস্কার ছিল, স্কুলে অধ্যয়ন করিলে খৃষ্টান হইয়া যায়। কেহ কেহ বলিতেন, ছেলেরা নাস্তিক হইবে। কোন কোন ভট্টাচার্য্যের সংস্কার ছিল জাতিভ্রংশ হইবে, ইত্যাদি কত লোকে কত কথাই প্রকাশ করিতেন। তৎকালে বীরসিংহবাসী লোকদিগের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ ছিল। সদ্‌গোপেরা কৃষিকর্ম্ম করিয়া দিনপাত করিত। ইহাদের সন্তানগণ গরু চরাইত; কেহ কেহ অন্যের ক্ষেত্রে মজুরি করিয়া দিনপাত করিত। অনেকের দিনান্তে অন্নসংস্থান দুষ্কর হইত। যাহা হউক, বিদ্যালয় স্থাপন করিবামাত্র ৫।৭ দিনের মধ্যেই প্রায় শতাধিক বালক অধ্যয়নার্থ প্রবিষ্ট হইল। ক্রমশঃ সন্নিহিত পাথরা, উদয়গঞ্জ, কুরাণ, গোপীনাথপুর, যদুপুর, দণ্ডীপুর, ঈরপালা, পুড়শুড়ী, মামরুল, আকপপুর, আগর, রাধানগর, ক্ষীরপাই প্রভৃতি গ্রাম হইতে যথেষ্ট বালক বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে লাগিল। পাঠ্যপুস্তক ক্রয় করে, অনেকেরই এমন সঙ্গতি ছিল না। বিদ্যালয় অবৈতনিক হইল। বিদ্যাসাগর, কলিকাতা হইতে প্রায় ৩০০ তিন শতের অধিক বালকের জন্য পাঠ্যপুস্তক এবং কাগজ, শ্লেট প্রভৃতি অকাতরে প্রেরণ করিলেন। গ্রামের যে যে ছাত্রের বস্ত্রাভাব ছিল, তাহাদিগকে বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিবার জন্য, শম্ভুবাবুকে আদেশ দিলেন। ঐ সময়ে বিদেশস্থ অনেক অধ্যাপকের পুত্র, অধ্যয়ন মানসে বীরসিংহে সমাগত হইল।

 যাহারা অন্যের বাটিতে বেতন গ্রহণ করিয়া দিবসে গরু চরাইত, বা যাহারা দিবসে কৃষিকর্ম্ম করিত, তাহাদের লেখাপড়া শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর নাইট স্কুল স্থাপন করিলেন। ঐ স্কুলে সন্ধ্যার পর রাত্রি দুই প্রহর পর্য্যন্ত দুইজন শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন। বিনামূল্যে পুস্তক বিতরিত হইত। এই সকল বিষয়ে যাহা ব্যয় হইত, তাহা বিদাসাগর স্বয়ং বহন করিতেন।

 বিদ্যাসাগর একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করিলেন। সকলেই বিনামূল্যে ঔষধ পাইত। বীরসিংহ, বোয়ালিয়া, পাথরা, মামদপুর প্রভৃতি সন্নিহিত গ্রামে কাহারও বাটীতে চিকিৎসা করিতে হইলে, পদব্রজে যাইয়া, বিনা ভিজিটে চিকিৎসা করিবার ব্যবস্থা ছিল। এতদ্ব্যতীত দুঃস্থ লোককে পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি দেওয়া হইত।

 তৎকালে এ প্রদেশের স্ত্রীলোকেরা লেখাপড়া শিক্ষা করিত না। বীরসিংহে সর্ব্বাগ্রে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সকল বালিকাই বিনামূল্যে পুস্তক পাইত। বীরসিংহে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইলে প্রতিবেশিবর্গ সন্তুষ্টচিত্তে সব সব দুহিতাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। তজ্জন্য, সন্নিহিত অপরাপর গ্রামস্থিত লোকসকলও কোনও প্রকার আপত্তি উত্থাপন করেন নাই। বালক বিদ্যালয়ে প্রথমতঃ বাঙ্গালা এবং সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কারাদির শিক্ষা দেওয়া হইত। কিছুদিন পরে অধিক সংস্কৃত সাহিত্যাদি অধ্যয়ন না করাইয়া, রীতিমত ইংরাজী ও সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হইত। বিদ্যাসাগর উক্ত বিদ্যালয়ের মাষ্টার ও পণ্ডিতের বেতন মাসিক ৩০০ টাকা প্রদান করিতেন। এতদ্ব্যতীত পুস্তকাদির জন্য মাসিক অন্ততঃ ১০০ টাকা ব্যয় হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম আত্মীয় বাবু প্যারীচরণ সরকার তাঁহার ফার্ষ্ট বক, সেকেণ্ড বুক, থার্ড বুক প্রভৃতি পুস্তকগুলি বালকদিগের পাঠার্থ বিনামূল্যে দান করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, বীরসিংহে বালিকা বিদ্যালয়ে মাসে মাসে ৩০ টাকা ব্যয় করিতেন। ডাক্তারখানায়, ডাক্তার ও কম্পাউণ্ডারের বেতন এবং অন্যান্য খরচ ও ঔষধাদির মূল্য প্রভৃতিতে মাসে মাসে ১০০ টাকা ব্যয় করিতেন। নাইট স্কুলে প্রতি মাসে ১৫ টাকা ব্যয় করিতেন। বীরসিংহ বিদ্যালয়ের ও নাইট স্কুলের অনেক দরিদ্র বালক বাটীতে ভোজন করিয়া অধ্যয়ন করিবে, এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত বিদেশস্থ অনেক ব্রাহ্মণ তনয়কে নিজ বাটীতে অন্ন দিয়া, বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করাইতেন। ন্যূনাধিক ৬০ জন বালক বাটীতে ভোজন করিয়া লেখাপড়া শিক্ষা করিত। মধ্যে মধ্যে ঠাকুরদাস বলিতেন যে, আমি বাল্যকালে বিলক্ষণ অন্নকষ্ট পাইয়াছি, অতএব অন্নব্যয় করা আমার সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান কর্ম্ম। তিনি কুমারগঞ্জের হাটে যাইয়া দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিতেন। ছাত্রসকলকে এবং পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্রদিগকে একত্র বসাইয়া আহার করাইতেন। ভগবতী দেবী সতুষ্টচিত্তে স্বয়ং রন্ধন পরিবেশনাদি কার্য্য প্রতিদিন সমভাবে নির্ব্বাহ করিতেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যখন ৫০০ টাকা বেতন হয়, তখন তিনি এক সময়ে কার্য্যোপলক্ষে দেশে আগমন করিয়া মাতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “মা, আর তোমার মনে কি সাধ আছে আমায় বল।” ভগবতী দেবী বলিলেন, “বাবা, এইবার যেখানে যত দুঃস্থ আত্মীয় স্বজন আছেন, তাঁহাদের একটা মাসহারার ব্যবস্থা করিয়া দাও।” বিদ্যাসাগর মহাশয় মাতার অভিলাষানুযায়ী আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যাঁহাদের হীন অবস্থা ছিল, এমন কি সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করা সুকঠিন হইয়া উঠিয়াছিল, তাঁহাদের পরিবার সংখ্যানুযায়ী মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।

 ৭৩ সালের দুর্ভিক্ষ সময়ে যে সকল লোক অন্নসত্রে ভোজন করিয়াছিল, তাহারা অতঃপর কি উপায় অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিয়া থাকে, বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রামস্থ ঐ সকল দরিদ্র লোকের অবস্থা অবগত হইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। এবং অনুসন্ধানে অবগত হইলেন যে, উহাদের মধ্যে অনেকেই অতি কষ্টে এক সন্ধ্যা ভোজন করিয়া থাকে। ইহা শ্রবণ করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ভগবতী দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎসরের মধ্যে এক দিন জগদ্ধাত্রী পুজো করিয়া ৬|৭ শত টাকা ব্যয় করা ভাল, কি গ্রামের নিরুপায় অনাথ লোকদিগকে এই অর্থ দ্বারা অবস্থানুসারে মাসে মাসে কিছু কিছু সাহায্য করা ভাল?” এই কথা শ্রবণ করিয়া ভগবতী দেবী উত্তর করিলেন, “গ্রামের দরিদ্র নিরুপায় লোক প্রত্যহ খাইতে পাইলে, পূজা করিবার আবশ্যক নাই। তুমি গ্রামবাসীদিগকে মাসে মাসে কিছু কিছু দিলে, আমি পরম আহ্লাদিত হইব।” জননীর মুখে এরূপ কথা শুনিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হন এবং গ্রামের প্রধান প্রধান লোকদিগকে একত্র করিয়া বলিলেন যে, “তোমরা সকলে ঐক্য হইয়া, গ্রামের কোন্ কোন্ ব্যক্তির অত্যন্ত অন্নকষ্ট ও কোন্ কোন্ ব্যক্তি নিরাশ্রয়, তাহাদের নাম লিখিয়া দাও, আমি মাসে মাসে উহাদের কিছু কিছু সাহায্য করিব।” গ্রামস্থ ভদ্রলোকেরা যে তালিকা প্রস্তুত করিয়াছিলেন, সেই তালিকা বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বহস্তে লিখিয়া মধ্যম ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্রের নিকট প্রদান করিয়া বলিলেন, “তুমি পূর্ব্বাবধি যেরূপ নিরূপায় আত্মীয়দিগকে ও বিধবাবিবাহ সম্পর্কীয় নিরূপায় ব্যক্তিদিগকে তালিকানুযায়ী টাকা বিতরণ করিয়া আসিতেছ, সেইরূপ এই তালিকানুসারে গ্রামস্থ নিরুপায় ব্যক্তিদিগকে মাসে মাসে টাকা দিবে এবং সময়ে সময়ে গ্রামস্থ ব্যক্তিদিগের অবস্থার বিষয় বিশেষরপে আমায় লিখিবে।” যিনি ধনশালী ব্যক্তি নহেন, তাহার পক্ষে এরূপ দান সহজ ব্যাপার নহে। ধন্য মাতা! ধন্য পুত্র!