বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/শিশুচর্য্যা ও সন্তানশিক্ষা

চতুর্থ পরিচ্ছেদ॥ শিশুচর্য্যা ও সন্তানশিক্ষা

 সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়াই স্নেহময়ী জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় প্রাপ্ত হয়, এবং যতকাল পর্য্যন্ত স্বাধীন ভাবে গতিবিধি করিতে না পারে, ততকাল জননীর শিক্ষাধীন থাকিয়া, শশিকলার ন্যায় অনুদিন বর্দ্ধিত হইতে থাকে। এই সময়ে প্রতিনিয়ত জননীর নিকটে অবস্থিতি করায় শিশু যে সকল শিক্ষা লাভ করে, বয়োবৃদ্ধিসহকারে তৎসমুদয়ের বিকাশ ভিন্ন বিনাশ হইতে প্রায়ই দেখা যায় না। সন্তানবৎসলা জননীর অকৃত্রিম স্নেহের প্রভাব এতই প্রবল যে, শিশু তাঁহারই প্রতি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক অনুরক্ত হয় এবং তাঁহার আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতির অনুকরণ করিয়া থাকে। সুতরাং মাতার দোষ গুণ সন্তানেই সংক্রামিত হইয়া পড়ে।

 যে শিক্ষা দ্বারা প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ হয়, শৈশবেই তাহার সূত্রপাত হইয়া থাকে। এ সময়ে সাধারণতঃ শিশুর অনুসন্ধিৎসা ও অনুকরণ প্রকৃতি অতিশয় প্রবলা থাকে। শিশু ইতস্ততঃ যাহা কিছু নিরীক্ষণ করে, সে সকল তাহার নিকটে নূতন ও অপরিচিত, সুতরাং সে যাহাকে সম্মুখে পায়, তাহাকেই তৎসময়ের বিষয় জিজ্ঞাসা করে এবং সেই সমুদয় বিষয়ের বিশ্লেষণ তাহাকে যাহা বলিয়া দেওয়া হয়, তাহাই সে অভ্রান্ত সত্য বলিয়া গ্রহণ করে। ফলতঃ বাল্যকালে যাহা একবার শিক্ষা করা যায়, তাহা চিরকাল স্মৃতিপটে দেদীপ্যমান থাকে। অতএব এ সময়ে শিশুর পুরোভাগে এরপ সকল আদর্শ রাখা উচিত, যাহাতে তাহার সুকুমার মনোবৃত্তিনিচয় সজীব হয় এবং উন্নত ও পবিত্র চরিত্র লাভ করিতে তাহাকে শক্তিশালী করে; এই সময়ে হৃদয়ে জ্ঞানের যে রেখাপাত হয়, উত্তরকালে তাহাই অধিকতর রঞ্জিত ও বর্দ্ধিত হয় মাত্র। অতএব শিশু যেরূপ পরিবার মধ্যে থাকিয়া লালিত পালিত হয়, তাহার শিক্ষা ও চিত্তবৃত্তির বিকাশও যে তদনুরূপ হইবে, তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সংশয় নাই।

 লর্ড ব্রোহাম বলেন, শিশু আঠার হইতে ত্রিশ মাসের মধ্যে বহির্জগতের বিষয়, তাহার স্বকীয় ক্ষমতা, অন্যান্য বস্তুর প্রকৃতি, এমন কি আপনার ও অপরের মন সম্বন্ধে এত অধিক শিক্ষা প্রাপ্ত হয় যে, তাহার অবশিষ্ট সমগ্র জীবনে সে আর তত শিক্ষা লাভ করে না। এই সময়ে শিশু চিরজীবনের শিক্ষার বীজ সংগ্রহ করে। সুতরাং অতি শৈশব কাল হইতেই শিশুর সুশিক্ষার বিধান করা অতীব প্রয়োজন। জনৈক মহিলা কোন্ সময়ে তাঁহার চারি বৎসর বয়ঃক্রম সন্তানের শিক্ষার সূত্রপাত করিবেন, এই কথা যেমন ধর্ম্মযাজককে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন, “ভদ্রে! এখনও যদি শিশুর শিক্ষা আরম্ভ করিয়া না থাক, তবে এই চারি বৎসর বৃথা অতিবাহিত হইয়াছে।” জনক জননী ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সংসারে শিশু সন্তানগণের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন। জননীর উদার বা অনুদার প্রকৃতি, তাঁহার কুসংস্কার তমসাচ্ছন্ন অথবা দিব্য জ্ঞানালোক পরিস্ফুট প্রকৃতিনিচয়ই শিশুর জীবনপথের পরিচালক। সুতরাং মাতার এক একটি সদনুষ্ঠান বা অসদনুষ্ঠান, তাঁহার আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি, স্বভাব, চরিত্রের উপর শিশুর বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করিতেছে।

 পরিবার মধ্যে ধর্ম্ম ও সাধুতা রক্ষা করিবার ভার রমণীর হতে। জননী যদি ধর্ম্মপরায়ণা ও বিবেকশালিনী হন, তাঁহার অন্তরে যদি সাধুতা লাভের ইচ্ছা বলবতী থাকে, তাহা হইলে সন্তানগণও সেই সকল সদ্‌গুণ লাভ করে। স্নেহময়ী মাতার অধরনিঃসৃত সুমিষ্ট অনুশাসন বাক্য সন্তানের স্মৃতিপটে নিবদ্ধ হইয়া থাকে। বিদ্যালয়ের শত শিক্ষকের উপদেশে যে শিক্ষায় লাভ না হয়, একটি সুশিক্ষিত, সচ্চরিত্রা, সংযতচিত্তা, বিবেকপরায়ণা মাতার ক্রোড়ে বর্দ্ধিত হইলে, সন্তানদিগের সে শিক্ষা লাভ হইয়া থাকে। মহৎ লোকের জীবনচরিত পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, জগতে যত মহাজন যে যে সদ্‌গুণের জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া গিয়াছেন, অধিকাংশ স্থলে, এরপ পরিলক্ষিত হয় যে, তাঁহাদের জননীগণ এই সকল চরিত্র গুণে গুণবতী ছিলেন।

 ত্রিভুবনবিজয়ী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু নিরতিশয় হরিবিদ্বেষী ছিলেন। হরির নাম শুনিলেই তিনি ক্রোধে অধীর হইতেন। তাঁহার রাজ্যের চতুঃসীমাতেও কেহ হরিনাম উচ্চারণ করিতে পারিত না। এমন হরিদ্বেষী গৃহেও, হরিভক্তিপরায়ণ, রাজমহিষী কয়াধূর ভক্তির ফলে, প্রহ্লাদের আবির্ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। পঞ্চমবর্ষীয় শিশু এতদূর ধর্ম্মপরায়ণতা ও ভগবানের প্রতি আত্মনির্ভরের ভাব কোথায় শিক্ষা করিল? সকলেই জানেন, যে প্রেম কয়াধূর হৃদয়ে, অন্তঃসলিলা ফল্গু নদীর ন্যায় প্রবাহিত হইতেছিল, তাহাই পঞ্চমবর্ষীয় শিশু প্রহ্লাদের হৃদয়ে ভক্তিমন্দাকিনীতে পরিণত হইয়াছিল।

 উত্তানপাদ রাজার পত্র ধ্রুব, বিমাতা সুরুচির দুর্ব্বাক্য বাণে বিদ্ধ হইলে পর জননীর নিকটে উপস্থিত হইয়া অতি কাতর ভাবে ক্রন্দন করিতে করিতে সমস্ত বিষয় নিবেদন করিলে, ধর্মশীলা, সহিষ্ণু ও বিবেকপরায়ণা জননী সুনীতি, যে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহা অতি মহৎ, অতি উচ্চ। তিনি তাঁহাকে ক্রোড়ে লইয়া সান্ত্বনা করিয়া বলিয়াছিলেন “বৎস! কাঁদিও না; এই পৃথিবীতে মানুষ নিজ কার্য্যের গুণেই বড় হয়। যদি বিমাতার কথায় মনে অত্যন্ত ক্লেশ হইয়া থাকে, পুণ্যলাভ করিবার জন্য যত্ন কর; পুণ্যলাভ করিলে, সকল ফল লাভ হইবে। বিনয়ী, সত্যবাদী, ধর্ম্মপরায়ণ ও পরহিতব্রতী হও; জল যেমন নিম্নাভিমুখেই ধাবমান হয়, এই সকল গুণবিশিষ্ট হইলে, পথিবীর সর্ব্বসম্পদ অনায়াসেই তোমাকে আশ্রয় করিবে। সর্ব্বদুঃখহারী ভগবান, আমাদের মঙ্গল করিবেন, তুমি তাঁহার শরণ লও। এরূপ ক্ষমাশীলা পুণ্যবতী জননীর সন্তান বলিয়াই পঞ্চমবর্ষীয় শিশু ধ্রুবের হৃদয় পুণ্যের পবিত্র ও বিমল জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়াছিল; ধ্রুব কঠোর তপঃপ্রভাবে, পদ্মপলাশলোচন হরির কৃপা লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 থিওডোর পার্কার স্বীয় জীবনচরিতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, তিনি যখন পঞ্চমবর্ষীয় বালক, তখন একদিন তাঁহার পিতার সঙ্গে বাড়ীর বহির্ভাগে কিয়দ্দূরে গমন করিয়া গৃহে জননীর নিকটে একাকী প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন। পথে দেখিলেন, একটি কূর্ম্মশিশুকে অপর কতিপয় শিশু প্রহার করিবার চেষ্টা করিতেছে, তিনিও বালস্বভাববশতঃ প্রহার করিবার জন্য যষ্টি উত্তোলন করিলেন, কিন্তু কে যেন তাঁহাকে হঠাৎ নিষেধ করিল! তিনি মাতার নিকটে তৎক্ষণাৎ দৌড়িয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! কূর্ম্মশিশুকে প্রহার করিতে উদ্যত হইলে, আমাকে কে নিষেধ করিল?” জননী তাঁহাকে ক্রোড়ে করিয়া মখচুম্বন করিলেন এবং বলিলেন, “বৎস, লোকে উহাকে বিবেক বলে, কিন্তু আমি বলি, উহা ঈশ্বরের বাণী। তিনি তোমাকে অসৎ কার্য্য হইতে নিরস্ত করিলেন। তুমি যদি এইরূপ সর্ব্বদা তাঁহার নিষেধাজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া চল, তাহা হইলে সর্ব্বদা সৎপথে বিচরণ করিতে পারিবে।” পার্কার বলিয়াছেন, ঐ দিনের ঘটনাটি ও মাতার ঐ উপদেশবাক্যটি চিরকাল তাঁহার হৃদয়ে জাগরূক থাকিয়া, তাঁহাকে ধর্ম্মপথে বিচরণ করিতে উৎসাহিত করিয়াছিল।

 শতবর্ষাধিক অতীত হইল, কলিকাতার সুপ্রিম কোর্টে স্যার উইলিয়ম জোন্স নামক একজন বিচক্ষণ বিচারপতি ছিলেন। জোন্স যখন তিন বৎসরের শিশু তখন তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যু হইলে, তাঁহার সুশিক্ষিতা মাতার উপরই তাঁহার শিক্ষার ভার ন্যস্ত হয়, তাঁহার জননী অসাধারণ বিদ্যাবতী রমণী ছিলেন। অতি শৈশবকাল হইতেই মাতার যত্নে পাঠের প্রতি জোন্সের রুচি জন্মিয়াছিল। তিনি যখন দুই তিন বৎসরের বালক, তখন কোন নূতন বিষয় দেখিয়া, তাহার বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলেই, মাতা বলিতেন, “পড়, পড়িলেই জানিতে পারিবে।” জননীর মুখে এই কথা বারম্বার শ্রবণ করায়, শিশু জোন্সের বিদ্যাশিক্ষার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মিয়াছিল। তাঁহার এই অনুরাগ পঠদ্দশাতেই বর্দ্ধিত হইয়াছিল। এই সময়েই তিনি বিদ্যালয়ের নির্দ্দিষ্ট পাঠ ব্যতীত অনেক বিষয় শিক্ষা করিতেন। পঠদ্দশাতেই তিনি গ্রীক ও লাটিন এবং স্বকীয় যত্নে ভিনদেশীয় চারি পাঁচটি ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত হইলে, কতিপয় বৎসর পর, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিবার বাসনা তাঁহার এত প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল যে, অবশেষে তিনি ভারতবর্ষের পূর্ব্বতন রাজধানী কলিকাতা নগরীতে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির পদ গ্রহণ করিয়া, সে বাসনাও চরিতার্থ করিয়াছিলেন।

 জননীর সাধুতা ও ধর্ম্মনিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়া সন্তান অধর্ম্ম পথ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়াছে, অনুতাপের অশ্রু বিসর্জ্জন করিয়া, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছে, এরপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। ভাগ্যবলে মণিকার ন্যায় ধর্ম্মপরায়ণা সুধীরা জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়াই, দুষ্ক্রিয়াসক্ত সেণ্ট অগাষ্টিনের স্বকীয় দুর্দ্দশার জন্য ঘোরতর আত্মগ্লানির উদয় হইয়াছিল। এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে কাতরকণ্ঠে আপনার পাপ স্বীকারপূর্ব্বক জগদীশ্বরের করুণা ভিক্ষা করিতে করিতে উন্মত্তের ন্যায় বলিয়াছিলেন,—“হে পরমেশ্বর! আমি তোমার দাসীর পুত্র, তোমার বাঁদীর সন্তান, তোমার চিরানুগত পরিচারিকার ধন।”

 সন্তানের উপর মাতার প্রভাব যে অতি গুরুতর এবং মাতার ধর্ম্মশীলতা, আত্মসংযম ও সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদ্‌গুণের উপর যে সন্তানের ও সমাজের ভাবী শুভাশুভ সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে, তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই।

 ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট স্বীয় জননীর আদেশ ভিন্ন অপর কাহারও আদেশ মান্য করিয়া চলিতেন না। তাঁহার যে মাতা সদপায় অবলম্বনপূর্ব্বক স্নেহ ও ভালবাসাপূর্ণ শাসন ও ন্যায়ানুষ্ঠান দ্বারা সন্তানকে তাঁহার প্রতি অনুরক্ত ও ভক্তিপ্রবণ হইতে এবং তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন, সেই আদর্শ-রমণী জননীর নিকটই শৈশবকালে তিনি বাধ্যতাগুণ শিক্ষা করিয়াছিলেন। শৈশবের আশ্রয়স্থল জননীক্রোড়েই তিনি ধর্ম্মে বীর, নীতিতে অটল, অধ্যবসায়ে সুদৃঢ় ও উৎসাহে জ্বলন্ত বহ্নিশিখাবৎ গঠিত হইয়াছিলেন।

 আমেরিকার ভূতপূর্ব্ব অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট এডাম বলেন, “শৈশবে আমি মানবজীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সুখের নিদান সুশিক্ষিতা ও সম্পূর্ণরূপে সন্তানপালনে সমর্থা জননী লাভ করিয়াছিলাম। এবং তাঁহার নিকট যে ধর্ম্ম ও নীতিশিক্ষা করিয়াছিলাম, তাহা আমার চিরজীবন সঙ্গী হইয়া রহিয়াছে।”

 শিশু বিদ্যাসাগর সকলের চক্ষের অগোচরে, জননীর স্নেহময় বক্ষে, শুক্লপক্ষের শশিকলার ন্যায় অনুদিন বর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার ভাগ্যে এডামের ন্যায় বিদ্যাবতী জননীলাভ ঘটে নাই। কারণ, বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতে স্ত্রীজাতি অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলেন। দেশে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল না। কুমারসম্ভব ও বিক্রমোর্ব্বশী নাটক প্রভৃতি গ্রন্থে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পুরাকালে স্ত্রীলোকেরা ভূর্জ্জপত্রে লিখতেন। তাঁহারা নানা বিষয় শিক্ষা পাইতেন। সংস্কৃত দশকুমারচরিত নামক গ্রন্থেও দেখিতে পাওয়া যায় যে, স্ত্রীলোকেরা বিদেশী ভাষা, চিত্রবিদ্যা, পুষ্পবিদ্যা, নৃত্যবিদ্যা, সঙ্গীত, তর্কবিদ্যা, গণনা, বাক্যবিন্যাস, সৌগন্ধ ও মিষ্টান্ন প্রস্তুতকরণ বিদ্যা, জীবিকানির্ব্বাহক অর্থকরী প্রমুখ বিদ্যা শিক্ষা করিতেন। কিন্তু হায়! যে ভারতবর্ষে স্ত্রীশিক্ষার আলোচনা এক সময়ে প্রকৃষ্টরূপে প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল; যে ভারতে দেবযানী, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, রোমশা, ও বাক্ প্রভৃতি বিদুষী বনিতারা বেদমন্ত্র রচনা করিয়াছিলেন; যে ভারতে, ভাস্করাচার্য্যের কন্যা লীলাবতী জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শিনী হইয়া স্বনামে জ্যোতিষ গ্রন্থ প্রচার করিয়া জগতের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করিয়াছেন; যে ভারতে অনসূয়া, অরুন্ধতী, সাবিত্রী, মৈত্রেয়ী, শৈব্যা, গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয় রমণীগণ সাংসারিক সুখসম্ভোগ পরিহারপূর্ব্বক ধর্ম্মালোচনায় প্রবৃত্ত থাকিতেন; যে ভারতে, এমন দিন ছিল, যখন বারাণসী নগরীতে চতুম্পাঠী স্থাপন করিয়া হট্টি বিদ্যালঙ্কার নামে এক বিখ্যাত রমণী, ছাত্রদিগকে ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্র পর্য্যন্ত শিক্ষা দিতেন; যে ভারতে, মিহিরের স্ত্রী খনা, জ্যোতির্বিদ্যা ও তাহার রচনার জন্য বিখ্যাত আছেন; যে ভারতে, চিতোরের রাণী মীরাবাই, আপন কবিত্বশক্তিগুণে জয়দেবের ন্যায় সুমিষ্ট কবিতা লিখিয়া গিয়াছেন; যে ভারতে, পৃথ্বীরাজ-লক্ষ্মী পদ্মাবতী, চৌষট্টি শিল্প ও চতুর্দ্দশ বিদ্যা জানিতেন; যে ভারতে, মালাবারে আভীর নামে একটি অবিবাহিত বিদ্যাবতী স্ত্রীলোক নীতি, কাব্য ও দর্শনবিষয়ক পুস্তকসকল রচনা করিয়া পাঠশালার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে প্রচলিত করিয়াছিলেন; যে ভারতে, নানা শ্রেণীস্থ স্ত্রীলোকেরাও নানাপ্রকার বিদ্যাশিক্ষা করিতেন, দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ভারতে শিক্ষা একবারে বিলুপ্ত হইয়া যায়। ক্রমে এদেশের লোকের এতাদৃশ কুসংস্কার জন্মে যে, নারীজাতি বিদ্যাশিক্ষা করিলে, তাহাদের বৈধব্য দশা ঘটিবে। ফলতঃ এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকেরা তৎকালে এবম্বিধ অকিঞ্চিৎকর ও অমূলক ভয়ে বিদ্যাভ্যাসে অনুরক্ত হইতেন না। দেশে যখন স্ত্রীশিক্ষার পথ এইরূপ ভাবে নিরুদ্ধ, তখন স্ত্রীলোকগণ গহপালিত পশুবৎ জীবন যাপন করিতেন, এরূপ যেন কেহ মনে না করেন। চরিত্রগত এবং অনুষ্ঠানগত শিক্ষাই দেশকে সজীব রাখিয়াছিল। তখন দেশে শাস্ত্রকথা, কথকতা, রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক উপাখ্যানসমূহ আদর্শ হিন্দুগৃহে প্রতিদিন ধ্বনিত হইত এবং এই সকল ধর্ম্মানুষ্ঠানই দেশের ধর্ম্মভাব ও নৈতিকভাব জাগরিত রাখিয়াছিল।

 তখনকার জননীগণ রত্নাকরের মুক্তি, হরিশ্চন্দ্রের স্বার্থত্যাগ, যুধিষ্ঠিরের ন্যায়নিষ্ঠা, ভীষ্মের শরশয্যাতে শয়ন, অর্জ্জুনের রণকৌশল ও বাহুবল, রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃবৎসলতা. লোকরঞ্জনের জন্য স্বার্থত্যাগ, লক্ষণের অগ্রজানুরাগ, সতী সাবিত্রীর পতিভক্তি প্রভৃতি উপাখ্যানগুলি সন্তানশিক্ষার প্রকৃষ্ট উপাদান বলিয়া মনে করিতেন। তখনকার সন্তানগণ মাতা, মাতামহী পিতামহী প্রভৃতির মুখের অন্নে অভ্যাগতের পরিচর্য্যা, অপরিচিত রুগ্নব্যক্তির সেবা শুশ্রূষা, বিপন্নকে আশ্রয়দান, ক্ষুধাতুরকে অনুদান করতে দেখিয়া পরোপকার ও সেবাধর্ম্ম শিক্ষা করিত। গ্রামের সামান্য লোকদিগের সহিতও ধনশালী সভ্রান্ত পরিবারের অল্পবয়স্ক বালকদিগেরও এক একটি সম্বন্ধ থাকিত, কেহ কাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিত না। এইরূপে তাহারা দয়াশীল, হৃদয়বান ও মিষ্টভাষী হইতে শিক্ষা পাইত। পূর্ব্বে আদর্শপরিবারে বার মাসে তের পার্ব্বণ ছিল, ধর্ম্মানুষ্ঠান ছিল, গৃহের সর্ব্ববিধ কর্ম্মের মধ্য দিয়া সন্তানগণ শিক্ষা লাভ করিত। দেশে এই সকল স্বভাব ও সদুদ্দেশ্যে বিদ্যমান ছিল বলিয়াই দেশ প্রাণহীন বা হৃদয়বিহীন হয় নাই। তখনকার জননীগণ সতানশিক্ষা সম্মন্ধে বর্তমান শিক্ষিত জননীগণের ন্যায় বেন, গাল্‌টন, হারবার্ট স্পেন্সার, স্মাইল, কারপেণ্টার, ফাউলর[] প্রভৃতি পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মন্তব্য পাঠ করিবার সুযোগ পান নাই সত্য বটে, কিন্তু ঋতধ্বজ রাজপত্নী মদালসা কিরূপ সদুপদেশ দানে সাধু অলকের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য রাজর্ষি জনককে যে মহামূল্য উপদেশরত্ন দান করেন, তন্মধ্যে সন্তানের উপর মাতার প্রভাবের বিষয় যাহা উক্ত হইয়াছে, তন্ত্রশাস্ত্রে গাহস্থ্যধর্ম্ম কথনের মধ্যে সন্তানশিক্ষা সম্বন্ধে যে উপদেশের উল্লেখ আছে[] এবং বিবিধ উপাখ্যানের অন্তর্গত উপদেশাবলী সেই সময়ে প্রত্যেক আদর্শ হিন্দুগৃহে মুখে মুখে গীত হইত এবং সন্তানশিক্ষার উপাদান বলিয়া বিবেচিত হইত।

 এ পর্য্যন্ত সন্তানের উপর মাতার প্রভাব এবং তৎকালীন আদর্শ হিন্দু, পরিবারের অনুষ্ঠানগত ধর্ম্ম ও নৈতিক শিক্ষার বিষয় কথিত হইল। পথেই বলিয়াছি, তখন দ্বিবিধ শিক্ষা ছিল—অনুষ্ঠানগত এবং চরিত্রগত শিক্ষা। ভগবতী দেবীর চরিত্রগত শিক্ষা কি কি ছিল, সে সম্বন্ধে অনুসন্ধান দ্বারা আমরা যত দূর অবগত হইতে পারিয়াছি, সেই সময়ের উল্লেখ করিয়া আমরা এই অধ্যায়ের উপসংহার করিব।

 তাঁহার চরিত্রের এই এক বিশেষত্ব দেখিতে পাওয়া যায় যে, তিনি অসত্যকে সত্যরূপে প্রতীয়মান করিতে অতিশয় ঘৃণা বোধ করিতেন। অনেক জননীকে এূরপ দেখা যায় যে, রোরুদ্যমান শিশু সন্তানগণকে শান্ত করিবার মানসে, কিম্বা অবাধ্য সন্তানদিগকে বাধ্য করিবার অভিপ্রায়ে তাঁহারা তাহাদিগকে ‘জুজুর ভয়’ দেখাইয়া থাকেন। এরপ ভয় প্রদর্শন যে সন্তানের পক্ষে মহা অনিষ্টের কারণ, সে বিষয়ে অণুমাত্র সংশয় নাই। ইহার দ্বারা শিশুর বল, বিক্রম ও আত্মরক্ষার ভাব সকলই একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায়।

 কোন কোন জননীকে এরপ দেখা যায় যে, শিশু; যদি তাহার প্রিয় বস্তু পাইবার জন্য ক্রন্দন করে, তবে তাহাকে “আকাশের চাঁদ’ প্রভৃতির প্রলোভন দেখাইয়া শান্ত করেন। এইরূপ ব্যবহারে শিশুরা অতি সহজেই অন্য সকলকে অবিশ্বাস করিতে শিক্ষা করে। এবং ধীরে ধীরে মিথ্যা, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি তাহাদের সুকোমল বাল্যহৃদয়ে প্রবেশ লাভ করিয়া কালক্রমে বদ্ধমূল হইতে থাকে।

 অনেক মাতর এরূপ স্বভাব আছে যে, তাঁহারা সন্তানগণের নিকট সংসারের অবস্থা গোপন করিতে প্রয়াস পান, এরপ আত্মগোপন নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। কারণ শিশুদিগের অন্যায় প্রার্থনায় তাঁহাদিগকেই জ্বালাতন হইতে হয়।

 ভগবতী দেবী সন্তানদিগকে কখন ‘জুজুর ভয় দেখান, কিম্বা তাহাদিগকে শান্ত করিবার মানসে ‘আকাশের চাঁদ’ ধরিয়া দিবার কথা বলিতেন না। তিনি এরূপ ক্ষেত্রে সন্তানের যতদূর সম্ভব প্রার্থনা রক্ষা করিতেন এবং স্নেহ ও মমতার দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাহাদিগকে শান্ত করিতেন। কঠোর শাসন দ্বারা তাহাদিগের কোমল বৃত্তিগুলির মূলে আঘাত করিতে তিনি কখনই প্রয়াস পাইতেন না। ইহা তাঁঁহার একেবারেই প্রকৃতিবিরুদ্ধে ছিল। অবস্থায় যাহা সঙ্কুলান হয়, তাহার অতিরিক্ত প্রার্থনা করিলে, সংসারের দরিদ্র অবস্থা স্মরণ করাইয়া এবং বুঝাইয়া দিয়া তাহাদিগকে নিরত করিতেন।

 সৎকার্য্যে উৎসাহ দান, তাঁহার চরিত্রের আর এক বিশেষত্ব। শিশু সন্তানদিগের দ্বারা অনুষ্ঠিত সৎকার্য্য ও সদ্ব্যবহার দেখিলে, তিনি আনন্দ প্রকাশ করিতেন এবং উৎসাহ দিতেন। একদা বালক বিদ্যাসাগর সমবয়স্ক বালকদিগের সহিত ক্রীড়া করিতেছিলেন। ক্রীড়াশেষে দেখিতে পাইলেন, একজন সঙ্গী ছিন্নবস্ত্র পরিধান করিয়া রহিয়াছে। তিনি তাহাকে আপনার বস্ত্রখানি গ্রহণ করিতে বলিয়া স্বয়ং তাহার ছিন্নবস্ত্রখানি পরিধান করিলেন। গৃহে সমাগত হইলে, মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার বস্ত্র কোথায়? বালক উত্তরে সত্য ব্যাপার প্রকাশ করিলেন। মাতা সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, এই ত ভাল ছেলের কাজ; আমি চরকায় সুতা কাটিয়া তোমায় আর একখানি নতুন কাপড় প্রস্তুত করাইয়া দিব। সন্তানগণের এইরূপ সদনুষ্ঠান বা পরোপকারপ্রবৃৃত্তি দেখিলে, তাহাদিগের প্রতি আদর ও সস্নেহ ভাব প্রদর্শন করা তিনি অবশ্য-কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করিতেন। কেবল তাহাই নহে, সেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি লক্ষ্য রাখিতেন যে, বালক বালিকার জীবনে তিনি যে সকল সৎপ্রবৃত্তি পরিকস্ফুুট দেখিতে ইচ্ছা করেন, তাহা ধীরে ধীরে তাহাদের হদয়ে বিকাশপ্রাপ্ত হইতেছে কি না।

 স্নেহ ভালবাসা বজ্জিত কঠোর শাসন যে কোমলমতি শিশুর পক্ষে অতীব অনিষ্টকর, তাহা তিনি বিলক্ষণ বুঝিতেন। কঠোর শাসনে শিশু; দিনদিন উৎসাহ ও স্ফুর্ত্তিহীন হইয়া পড়ে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আলস্য, ভীরুতা ও শঠতা আসিয়া শিশুকে আশ্রয় করে। ভীরুতায় মনুষ্যত্বের লোপ পায়, এ সত্য বৃদ্ধ, যুবক, শিশু; সকলের পক্ষেই সমান। প্রয়োজন হইলে, শিশুকে প্রাণের স্নেহ মমতা দ্বারা পরিচালিত হইয়া শাসন করা উচিত। কোন কোন মাতা এরূপ আছেন যে, সন্তানের সামান্য অপরাধে উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, ইহা অতীব অন্যায়। প্রদীপে একবার হাত দিয়া যন্ত্রণা অনুভব করিলে, শিশু; আর কখনও প্রদীপে হাত দিতে যাইবে না। এরূপ স্থলে, মাতার গুরতর শাসনের প্রয়োজন হয় না। কোন সন্তানের অসাবধানতা বশতঃ তাহার হস্তপদ ভগ্ন হইয়াছে, এরূপ স্থলে মাতার অগ্রে সন্তানের জীবন রক্ষার উপায় বিধান করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কিন্তু এরূপ অনেক নির্ম্মম মাতা আছেন যে, তাঁহার সেই সময়ে ক্রোধপরবশ হইয়া সন্তানকে ভয়ানক তিরস্কার করিতে আরম্ভ করেন। উপস্থিত কর্ত্তব্যের বিষয় একেবারে বিস্মৃত হইয়া যান। ভগবতী দেবীর প্রকৃতি এরূপ ছিল না। বালক বিদ্যাসাগর এক সময়ে ধানক্ষেত্রের নিকট দিয়া গমনকালে, ধানের শীষ তুলিয়া চিবাইতে চিবাইতে গমন করেন। শেষে ধান্যের শীষের শুঁয়া গলায় আটকাইয়া প্রাণসংশয় হইয়া উঠে। তদবস্থায় বাটীতে নীত হইলে, তাঁহার পিতামহী অতি কষ্টে সেই শুঁয়া বাহির করিয়া দেন, এবং সে যাত্রায় বিদ্যাসাগরের প্রাণরক্ষা হয়। মাতা সেই সংকটাপন্ন অবস্থায়, যাহাতে সন্তান বিপন্মুক্ত হয়, প্রথমতঃ তাহারই সহায়তা সর্ব্বতোভাবে করিয়া শেষে শিক্ষা দিলেন,—"বাবা, অমুক অমুক শস্যের শীষে শুঁঁয়া আছে, আর কখন এই সকল শস্যের শিষ চিবাইও না।”

 তিনি লোকের আত্মবিশ্বাসের উপর কখন কোন প্রকার আঘাত করতেন না। তিনি যেন এই আত্মবিশ্বাসের মধ্যে অমিত শক্তি, অমিত বল, কত প্রাণ, কত বীর্য্য, কত ওজ, কত অমৃত নিহিত রহিয়াছে বলিয়া মনে করিতেন। অবশ্য সময়ে সময়ে এই আত্মবিশ্বাসের সহায়তা করায় শিশুদিগের দুই একটি ভুল ভ্রান্তি ঘটিত। কিন্তু তিনি বলিতেন যে−“এই ভুলটাই যে একটা মহা শিক্ষা।”

 লোকের দোষ অপেক্ষা গুণের উপরই তাঁহার অধিক লক্ষ্য ছিল এবং গুণের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া তাহার দোষকে গুণে পরিণত করিতে সতত চেষ্টা করিতেন। যেমন পাপীকে ‘পাপী’ ‘পাপী’ বলিলে, তাহার উদ্ধার অসম্ভব। তাহার ভিতর যে মহাশক্তি আছে, সেই দিকে তাহার দষ্টি আকর্ষণ করিয়া দিতে পারিলেই তাহার পক্ষে মঙ্গল হয়, সন্তানশিক্ষা সম্বন্ধেও ঠিক সেই ভাবেই তিনি কার্য্য করিতেন। কারণ তিনি যেন মনে করিতেন, জগতে পাপ তাপ নাই, রোগ শোক নেই, যদি কিছু পাপ জগতে থাকে তাহ। এই ভয়। যে কোন কার্য্য তোমার ভিতরে শক্তির উদ্রেক করিয়া দেয়, তাহাই পুণ্য; আর যাহাতে তোমার শরীর মনকে দুর্ব্বল করে, তাহাই দুর্ব্বলতা, মৃত্যু বা মহাপাপ। সুতরাং মত্যুর সহায়তা না করিয়া জীবনদান করাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার অর্থ-ধ্বংসসাধন নহে; প্রকৃত শিক্ষার অর্থ—গঠন। সুশিক্ষায় অন্তর্নিহিত শক্তির উপচয়ই হইয়া থাকে; শক্তির অপচয়ের কোন আশঙ্কাই থাকে না।

 বিদ্যাসাগর বাল্যকালে অতিশয় দুষ্ট ছিলেন। অনেক প্রতিভাবান প্রতিষ্ঠাশালী ব্যক্তির বাল্যজীবনে বালম্বভাবসুলভ চপলতার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য বাল্যকালে গঙ্গাতীরে ব্রাহ্মণগণের নৈবেদ্য কাড়িয়া খাইতেন; অমর কবি সেক্সপিয়র বাল্যকালে দুষ্ট বালকদিগের সঙ্গদোষে হরিণ চুরি করিয়াছিলেন। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের অত্যাচারে তাঁহার জননী জ্বালাতন হইতেন। বালক বিদ্যাসাগর বাল্যকালে পাড়ার লোকের বাগানের ফল পাড়িয়া চুপে চুপে খাইতেন; কেহ কাপড় শুখাইতে দিয়াছে দেখিলে, তাহার উপর মলমূত্র ত্যাগ করিতেন। প্রত্যহ পাঠশালায় যাইবার সময় মথুুর মণ্ডল নামক একজন প্রতিবেশীর দ্বারদেশে মলত্যাগ করিতেন। সকল সংবাদ মাতার কর্ণে প্রবেশ করিলে, তিনি বিদ্যাসাগরকে বলিলেন,—'বাপু, তুমি লোকের ছেঁড়া কাপড় দেখিলে, আপনার ভাল কাপড় তাহাকে পরাইয়া, নিজে সেই ছেঁড়া কাপড় পরিয়া বাটিতে আইস, লোকের দুঃখ দেখিলে তুমি মনে এত দুঃখ পাও, আর এরূপ করিয়া লোকের মনে ব্যথা দাও কেন? কোন খাদ্যদ্রব্য হস্তে তাহারা তোমার বিষ্ঠা স্পর্শ করিলে, সেই দ্রব্যগুলি তাহাদিগকে ফেলিয়া দিতে হয়, পুনরায় স্নান করিতে হয়। আহা, তাহাদের কত কষ্ট দেখ দেখি।” শুনা যায়, মাতার এরূপ শিক্ষায় সন্তানের সুফল ফলিয়াছিল। বালক বিদ্যাসাগর বলস্বভাবসুলভ চপলতাবশতঃ ঐরূপ অন্যায় কার্য্য করিতেন। কিন্তু যে দিন মাতার সুশিক্ষায় বুঝিতে পারিলেন, ঐ সকল অন্যায় কার্য্য হেতু লোকে নিগ্রহ ভোগ করে, তাহাদের মনে কষ্ট দেওয়া হয়, সেই দিন হইতেই তিনি ঐরূপ অন্যায় কার্য্য করিতে বিরত হইয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগর বাল্যকালে অতিশয় অনাশ্রব (একগুঁয়ে) ছিলেন। এজন্য পিতা ঠাকুরদাস তাঁহাকে প্রহার পর্যন্ত করিতেন, এবং তাহার নাম রাখিয়াছিলেন-‘ঘাড় কেঁদো'। কিন্তু ভগবতী দেবী হৃদয়ের স্নেহ মমতার দ্বারাই তাঁহাকে সংযত করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি যেন জানিতেন, প্রগাঢ় সন্তানবাৎসল্যই শিশুকে আপনার হইতে আপনার করিয়া দেয়। তখন এমন কোন কার্য্যই নাই, যাহা তাহার দ্বারা করাইয়া লওয়া যায় না। শিশু যেমন ভালবাসার অধীন, এমন আর কেহই নহে। স্নেহ, মমতা ও বাৎসল্যের শাসনই প্রকৃত শাসন। ভগবতী দেবী বলিতেন, “সন্তান বালকবুদ্ধিবশতঃ কোন অন্যায় কার্য্য করিলে পর, মাতা যদি মুখ আঁধার করিয়া তাহার সহিত কিছুক্ষণ আলাপ বন্ধ রাখেন, আর সন্তান মাতাকে প্রসন্ন করিবার জন্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া না বেড়ায়, তাহা হইলে, সে মাতাই বা কিরপ, তাঁহার ভালবাসাই বা কিরূপ, আর তাঁহার মায়ামমতাই বা কিরূপ, কিছুই ত বুঝিতে পারিলাম না।” ভগবতী দেবীর এই উক্তি হইতেই পাঠকগণ তাহার সন্তানবাৎসল্যের প্রগাঢ়তা অনুভব করিবেন।

 সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ তাঁহার চরিত্রের আর এক বিশেষ লক্ষণ ছিল। সহানুভূতিই সর্ব্ববিধ উন্নতির নিত্য সহচর এবং দায়িত্বজ্ঞানই মানুষকে সর্বোচ্চ উন্নতিসোপানে উন্নীত করিতে পারে, ইহাই যেন তাঁহার ধারণা ছিল। তিনি সন্তানগণকে বলিতেন, “আপনি ভাল কাপড় পরার চেয়ে, পরকে পরাইতে পারিলে, অধিক সুখ হয়। নিজে ভাল খাওয়া অপেক্ষা পরকে ভাল খাওয়াইতে পারিলে, অধিক আনন্দ হয়।” এইরূপে তিনি সন্তানগণের হৃদয়ে মনুষ্য জীবনের উচ্চতর ও গভীরতর দায়িত্বসকল অনুভব করাইয়া দিতেন।

 স্বীকার করি মানবের সদগুণাবলী স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সদগুণাবলীর বিকাশ শিক্ষাসাপেক্ষ। শিক্ষারূপ ইন্ধন না পাইলে, জ্ঞান ও বিদ্যাগ্নি প্রজ্বলিত হয় না। ক্রিয়ার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ভিন্ন, অন্য উপায়ে মানুষ মানুষকে শিক্ষা দিতে অসমর্থ। যদি কেহ সম্পূর্ণরূপে আপনাকে বিকাশ করতে সমর্থ হন, তবেই তাঁহার শিক্ষা দিবারও ক্ষমতা জন্মে। কিন্তু বিশুদ্ধ বাক্যপ্রয়োগ দ্বারা শিক্ষাদানে কেহ কখনই কৃতকার্য্য হন না। যিনি গ্রহণ করিতে সমর্থ, তিনিই কেবল শিক্ষা দিতে পারদর্শী, এবং গ্রহণ করিবার শক্তি না থাকিলে, কেহই শিক্ষিত হইতেও পারে না। ছাত্র-শিক্ষকের মনোভাব এবং বুদ্ধিবিশ্বাসের সমতলবর্ত্তী না হইলে, শিক্ষার আদান প্রদান কোন মতে সম্ভাবিত নহে। কারণ, শিক্ষাকালে পরস্পরের চিত্তসংযোগ বা বিমিশ্রণ ঘটিয়া থাকে। এইরপ চিত্তসন্নিপাতের সংঘটন হইলেই, কেবল প্রকৃত শিক্ষা কার্য্যোপযোগিনী হয় এবং প্রতিকূল দৈবপাত বা অসৎসংসর্গ হেতু তাহার উপকারিতা কোন কালেই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় না। ভগবতী দেবীর এই সকল শিক্ষাদীক্ষা সকল সন্তানগণই সমান পরিমাণে লাভ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার উপদেশের সফল আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনেই যে অধিক পরিমাণে পরিস্ফুট দেখিতে পাই, তাহারও কারণ এই। এ সম্বন্ধে অপর দিকে মহাকবি ভবভূতির গভীরভাবপূর্ণ নিম্নলিখিত লোকটি আমাদের মনে পড়ে:

“বিতরতি গুুরঃ প্রাজ্ঞে বিদ্যাং ষথৈব তথা জড়ে
ন চ খলু তয়োর্জ্ঞানে শক্তিং করোত্যপহন্তি বা।
ভবতি চ তয়োর্ভূয়ান্ ভেদঃ ফলং প্রতি তদ্ যথা
প্রভবতি শুচির্বিদ্বেদগ্রাহে মণির্ন মৃদাং চয়ঃ।”

গুরু, সুবোধ এবং নির্ব্বোধ দ্বিবিধ ছাত্রকেই সমভাবে বিদ্যা বিতরণ করেন; কিন্তু তদুভয়ের ধারণাশক্তির বৃদ্ধি বা হ্রাস করিতে পারেন না। বিদ্যা-বিষয়ে যে পূর্ব্বোক্ত ছাত্রই প্রভূত পার্থক্য প্রাপ্ত হন, ইহা বলা বাহুল্য। নির্ম্মল মণিই প্রতিবিম্ব গ্রহণে সমর্থ হয়, মৃৎপিণ্ড কখনই সমর্থ হয় না।

  1. Bain's Education as a science; Gulton's Heriditary Genius; Education by Herbert Spencer; Smile's Character; Human Physiology by Dr. Carpenter; Love and Parantage applied to the improvement of offspring by O. S. Fowler.
  2. গার্হস্থ্য ধর্ম্ম:—শ্রীদেবী কহিলেন:—বিভো! গৃহস্থগণের ধর্ম্ম কি? ভিক্ষুকগণের ধর্মই বা কিরূপ? ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণভিন্ন অন্যান্য বর্ণসমূহের সংস্কার প্রভৃতিই বা কিরপ? তৎসমুদায় আমার নিকট সবিশেষ কীর্ত্তন করুন।
     শ্রীসদাশিব কহিলেন। কৌলিনি! গার্হস্থ্যধর্ম্মই মনুষ্যবর্গের প্রথম ধর্ম্ম (ও সকলের মুল বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকে)। অতএব সর্ব্বাগ্রে গাহস্থ্যধর্ম্মের বিষয় বলিতেছি, শ্রবণ কর।
     গৃহস্থগণ ব্রহ্মনিষ্ঠ ও ব্রহ্মজ্ঞান-পরায়ণ হইবে। তাহারা যে যে কর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবে, তৎসমুদায়ই ব্রহ্মে সমর্পণ করিবে। গৃহস্থগণ কাহারও নিকট মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিবে না; সর্ব্বতোভাবে কপটতাচরণ পরিত্যাগ করিবে; এবং তাহারা দেবতা ও অতিথি পূজায় নিরত থাকিবে। গৃহস্থগণ মাতাপিতাকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ দেবতা জ্ঞান করিয়া নিরন্তর সর্ব্বতোভাবে সর্ব্বপ্রযত্নে তাঁহাদের সেবা করিবে। শিবে! দেবিপার্ব্বতি! যে ব্যক্তি মাতাপিতার সন্তোষসাধন করে, তুমি তাহার প্রতি প্রীত হইয়া থাক এবং পরমব্রহ্মও তাহার প্রতি প্রসন্ন হয়েন। আদ্যে! তুমিই জগতের মাতা এবং পরাৎপর পরমব্রহ্মই জগতের পিতা। অতএব যে সকল গৃহস্থ ব্যক্তি পিতা-মাতার সেবা দ্বারা তোমাদের উভয়ের সন্তোষসাধন করে, তাহাদিগের সেই তপস্যা হইতে আর অন্য উৎকৃষ্টতর তপস্যা কি আছে? গৃহস্থ ব্যক্তি যথোপযুক্ত সময় বুঝিয়া মাতাপিতাকে আসন, শয্যা, বস্ত্র, পানীয় ও ভোজ্যবস্তু প্রভৃতি প্রদান করিতে থাকিবে। কুলপাবন সৎপুত্র পিতামাতাকে মৃদুল বাক্য শ্রবণ করাইবে; সর্ব্বদাই তাঁহাদিগের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবে এবং নিয়ত পিতামাতার আজ্ঞাবহ হইয়া থাকিবে। যদি গৃহস্থ আপনার হিতকামনা করে, তাহা হইলে, সে কদাপি মাতাপিতার নিকট ঔদ্ধত্য প্রকাশ বা পরিহাস করবে না। তাঁহাদিগের সমীপে তর্জন গর্জন বা কুবচন প্রয়োগও করিবে না; মাতাপিতাকে দেখিলেই সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থানপক প্রণাম করিবে। পরে তাঁহাদের আজ্ঞা ব্যতিরেকে আসনে উপবিষ্ট হইবে না; এবং তাহাদিগের আদেশ পালনে সতত উন্মুখ হইয়া থাকিবে। যে ব্যক্তি বিদ্যামদে বা ধনমদে মত্ত হইয়া মাতাপিতাকে অবহেলা করে, সে সর্ব্বধর্ম্ম বহিষ্কৃত হইয়া ঘোর নরকে গমন করে। যদি প্রাণ কণ্ঠাগত হয়, তথাপি গৃহস্থগণ মাতা, পিতা, পুত্র, ভার্ষ্যা, অতিথি ও সহোদর ইহাদিগকে না দিয়া কদাপি স্বয়ং ভোজন করিবে না। যে ব্যক্তি মাতা পিতা ভ্রাতা বন্ধুবান্ধব প্রভৃতি জনগণকে দিয়া স্বকীয় উদর পূরণার্থে ভোজন করে, সে ইহলোকে অতীব নিন্দিত হয়, এবং পরলোকেও ঘোর নরকে পতিত হইয়া থাকে। গৃহস্থগণের কর্ত্তব্য্য এই যে, ভার্ষ্যার রক্ষণাবেক্ষণ করিবে; পুত্রগণকে বিদ্যাশিক্ষা করাইবে; স্বজন ও বন্ধুবান্ধবগণের ভরণপোষণ করিবে। ইহাই তাহাদিগের সনাতন ধর্ম্ম। জননী দ্বারা দেহের পুষ্টিসাধন হয়, জন্মদাতা জনক হইতে দেহের উৎপত্তি হয়, এবং জনগণ প্রীতিবশত শিক্ষা প্রদান করিয়া থাকে; সুতরাং যে ব্যক্তি ইহাদিগকে পরিত্যাগ করে, সে নরাধম (তাহাতে সন্দেহ নাই)। মহেশানি! গুরুজন ও আত্মীয়-স্বজনগণের নিমিত্ত শত শত কষ্ট স্বীকার করিয়াও নিরন্তর শক্তি অনুসারে ইহাদের সকলের সন্তোষসাধন করিবে। ইহাই সনাতন ধর্ম্ম। যে ব্যক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠ ও সত্যপ্রতিজ্ঞ হইয়া কর্ম্ম করে পৃথ্বীতলে সেই মহাপুরুষই ধন্য, সেই মহাপুরুষই কৃতী এবং সেই মহাপুরুষই পরমার্থ জ্ঞান লাভে সমর্থ হইয়া থাকে। ভার্য্যা যদি পতিব্রতা ও সাধ্বী হয়, তাহা হইলে গৃহস্থ কদাপি তাহাকে প্রহার করিবে না, অধিকন্তু নিরন্তর মাতার ন্যায় পরিপালন করিবে এবং ঘোর কষ্টে পতিত হইলেও তাহাকে কখনই পরিত্যাগ করিতে পারিবে না।
     * * * * *
     প্রাজ্ঞ ব্যক্তি *** কোন স্ত্রীকে অযুক্ত কথা বলিবে না; এবং স্ত্রীলোকের উপরি শৌর্য্য প্রদর্শনও করিবে না। ধন-প্রদান, বসন-প্রদান, প্রেম-প্রদর্শন, শ্রদ্ধা-প্রকাশ, অমৃততুল্য মধুর বচন প্রয়োগ প্রভৃতি দ্বারা নিরন্তর ভার্য্রযা সন্তোষসাধন করিবে; কদাপি কোন বিষয়ে তাহার অপ্রিয়াচরণ করিবে না। সুবুদ্ধি ব্যক্তি উৎসবে, লোকযাত্রায়, তীর্থে এবং পরগৃহে পত্র অথবা আত্মীয় কাহাকেও সমভিব্যাহারে না দিয়া কদাপি একাকিনী পত্নীকে প্রেরণ করিবে না। মহেশানি! যে পুরুষের প্রতি পতিব্রতা ভার্য্যা পরিতুষ্টা থাকে, সে নিখিল ধর্ম্মকর্ম্মকরণজনিত ফল লাভ করিয়া থাকে, এবং তোমার প্রীতিভাজন হয়। পিতা চারি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত পুত্রের লালনপালন করবে, পরে যোড়শ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত বিদ্যা ও (দয়া দাক্ষিণ্য, শিষ্টাচার, ধর্ম্মনিষ্ঠতা, পরোপকারপরায়ণতা, জিতেন্দ্রিয়তা, সত্যনিষ্ঠা, ধৈর্য্য, গাম্ভীর্য্য প্রভৃতি) গণসমূহ শিক্ষা প্রদান করিতে থাকিবে। অন্তর বিংশতি বৎসর বয়স পর্য্যন্ত গৃহকার্য্যে নিয়োজিত রাখিবে; তৎপরে আত্মতুল্য জ্ঞান করিয়া স্নেহ প্রদর্শন করিবে।
     এইরূপে কন্যাকেও পালন করিবে এবং যত্নপূর্ব্বক শিক্ষা প্রদান করিবে। পরে ধনরত্নে বিভূষিতা করিয়া জ্ঞানবান বরকে সম্প্রদান করিবে; অর্থাৎ চার বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত লালনপালন করিয়া তৎপরে যোড়শ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত বিদ্যা ও সদ্‌গুণ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করিবে; অনন্তর বিংশতি বৎসর পর্য্যন্ত গৃহকর্ম্মে নিযুক্ত রাখিয়া গৃহকর্ম্ম বিষয়ে শিক্ষা পরন্তু পুত্র হইতে কন্যার বিশেষ এই যে, উপযুক্ত পাত্র উপস্থিত হইলে, যথাসময়ে ঐ কন্যাকে ধনরত্নে বিভূষিত করিয়া সম্প্রদান করিতে হইবে। গৃহস্থগণ এইরপে ভ্রাতৃবর্গ, ভগিনীবর্গ, ভ্রাতুষ্পুত্রবর্গ, জ্ঞাতিবর্গ, মিত্রবর্গ ও ভৃত্যবর্গের যথাক্রমে ভরণপোষণ, প্রতিপালন এবং তাহাদিগের তুষ্টিবর্দ্ধন করিবে। অনন্তব গৃহস্থ (সমর্থ হইলে) স্বধর্ম্ম-নিরত মানবগণ, একগ্রামবাসী জনগণ, অভ্যাগত অতিথিগণ ও উদাসীনগণকেও যথাশক্তি প্রতিপালন করিবে। দেবি! বিভবসত্ত্বেও যদি গৃহস্থ এইরপ আচরণ না করে, তাহা হইলে সে ঘোর পাপে লিপ্ত, লোকনিন্দিত ও পশতুল্য বলিয়া পরিগণিত হয়।
     গৃহস্থগণ নিদ্রা, আলস্য, দেহযত্ন, কেশবিন্যাস, অশন ও বসনে আসক্তি, এতৎসমুদায় অপরিমিতরপে করিবে না। তাহারা পরিমিত ভোজন ও পরিমিত নিদ্রা সেবন করিবে; পরিমিতভাষী * * * হইয়া থাকিবে; কপটতা পরিহার করিবে; এবং সতত বিশুদ্ধাচার, সর্ব্বকর্ম্মে নিরালস্য ও উদ্‌যোগশীল এবং নম্র হইয়া কালাতিপাত করিবে। তাহারা শত্রুর নিকট শূরত্ব এবং বন্ধু, বান্ধব ও গুরুজনসমীপে বিনয় প্রদর্শন করিবে; নিন্দিত-জনগণকে আদর করিবে না; মানী জনগণের সম্মান রক্ষা করিবে; সহবাস ও সবিশেষ পর্য্যলোচনা দ্বারা লোকের স্বভাব, সৌহার্দ্দ, ব্যবহার, প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি পরিজ্ঞাত হইয়া পশ্চাৎ তাহাদের প্রতি বিশ্বাস করিবে। শত্রু লঘু হইলেও বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহাকে ভয় করিবে, এবং সময় বুঝিয়া স্বীয় প্রভাব প্রদর্শন করিবে; পরন্তু কোনক্রমে ধর্ম্মপথ অতিক্রম করবে না। ব্যক্তি পরের উপকার কবিবার নিমিত্ত যাহা করিয়াছে, তাহা প্রকাশ করিবে না; স্বীয় যশ ও পৌরুষের পরিচয় প্রদান করবে না; এবং পরের কথিত গুপ্ত কথাও কাহারও নিকট ব্যক্ত করিবে না। নিশ্চয় জয়ের সম্ভাবনা থাকিলেও যশস্বী ব্যক্তি কদাপি লোকগর্হিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া গুর বা লঘু ব্যক্তির সহিত বিবাদ করিবে না; বিদ্যা, ধন, যশ ও ধর্ম্ম যত্নপূর্ধ্বক উপার্জ্জন করিবে, এবং ব্যসন, কুসংসর্গ, মিথ্যাবচন, পরদ্রোহ প্রভৃতি সর্ব্বতোভাবে পরিত্যাগ করিবে। চেষ্টা অবস্থার অনুগত এবং ক্রিয়া সময়ের অনুগত; অতএব অবস্থা ও সময় অনুসারেই কর্ম্মানুষ্ঠান করিবে।
     গৃহীরা যোগক্ষেমে নিরত থাকিবে; দক্ষ ও ধার্ম্মিক হইবে; বন্ধধুুগণের প্রতি সৌহার্দ্দ প্রদর্শন করিবে; (সর্ব্বজন সমক্ষে) বিশেষতঃ মাননীয় জনসমূূহের নিকট পরিমিতভাষী হইবে; তাঁহাদের নিকট অপরিমিত হাস্যও করিবে না। গৃৃহস্থগণ জিতেন্দ্রিয়, প্রসন্নচিত্ত, দৃৃঢ়ব্রত, অপ্রমত্ত ও দীর্ঘদর্শী হইবে; অসৎ বিষয় চিন্তা না করিয়া কেবল সবিষয়েরই আলোচনা করিবে; ইন্দ্রিয়বৃত্তি বিষয় অথাৎ ভোগ বস্তু সমুদায় বিচার না করিয়া ভোগ করিবে না। ধীর ব্যক্তি সতত সত্য, মদ, প্রিয় ও হিতকর বাকা প্রয়োগ করিবে এবং কদাপি আত্মশ্লাঘা ও পরনিন্দা করিবে না।
     যে ব্যক্তি জলাশয় খনন, বক্ষরোপণ, পথিমধ্যে বিশ্রামগহ নির্ম্মাণ ও সেতু নির্ম্মাণ করিয়া সাধারণের ব্যবহারের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠা ও উৎসর্গ করে, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করিতে পারে। মাতাপিতা যাহার প্রতি সন্তুষ্ট, সুহৃদগণ যাহাতে অনুরক্ত, মানবগণ যাহার যশোগান করিয়া থাকে, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করে। সত্যই যাহার সনাতন ব্রত, যে ব্যক্তি সর্ব্বতোভাবে দীন দরিদ্রের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে, কাম ও ক্রোধ যাহার বশীভূত, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি * * * ও পরদ্রব্যে নিস্পৃৃহ, যে ব্যক্তি দম্ভ ও মাৎসর্য্যবিহীন, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি রণে ভীত হয় না, সমরেও পরাঙ্খুুখ হয় না, অথবা যে ব্যক্তি ধর্ম্মযুদ্ধে দেহ পরিত্যাগ করে, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করিতে পারে। যাহার আত্মা সন্দিগ্ধ নহে, অথচ যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত ও শৈবাচারে নিরত থাকিয়া মদীয় শাসনের বশবত্তী হয়, সেই ব্যক্তিই (পণ্যফলে ত্রিভুবন জয় করে। যে ব্যক্তি তত্তজ্ঞানসম্পন্ন হইয়া কি শহু, কি মিত্র সকলের প্রতি সমদৃষ্টি রাখিয়া কেবল লোকযাত্রা নির্ব্বাহের নিমিত্ত কর্ম্মানুষ্ঠান করে, সেই ব্যক্তিই (পুণ্যফলে) ত্রিভুবন জয় করিতে পারে।
    মহানিব্বণিতনন্ত্রম্-অষ্টম উল্লাসঃ।