বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/ঊনত্রিশ
ঊনত্রিশ
ফরওয়ার্ড ব্লকের আপোষ বিরোধী প্রচারকার্যে কংগ্রেস ও গান্ধীজী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পক্ষে জনমতের চাপ অনুভব করিলেন। কংগ্রেস আসন্ন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের মুখোস খুলিয়া গেল। ভারতসচিব লর্ড জেট্ল্যাণ্ডের ঘোষণার উত্তরে গান্ধীজী কহিলেন— “I cannot conscientiously pray for the success of British arms if it means a further lease of life to India's subjection to foreign domination.” রামগড় কংগ্রেসেই কংগ্রেসী নেতৃবর্গের সুর বদলাইয়া যায়। মূল প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্রের চিন্তা ও কর্মপন্থার প্রভাব বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হয়। কংগ্রেস প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় অংশটি উদ্ধৃত করা গেল—“The Congress consider the declaration by the British Government of India as a belligerent country, without any reference to the people of India, and the exploitation of India's resources in this war as an affront to them, which no self-respecting and freeedom loving people can accept or tolerate. The recent pronouncements made on behalf of the British Government in regard to India demonstrate that Great Britain is carrying on her war fundamentally for imperialist ends and for the preservation and strengthening of her Empire, which is based on exploitation of the people of India, as well as of other Asiatic and African countries. Under these circumstances, it is clear that the Congress cannot, in any way, directly or indirectly, be party to the war, which means continuance and perpetuation of this exploitation. The Congress, therefore, strongly disapproves of Indian troops being made to fight for Great Britain and of the drain from India of men and material for the purpose of the war. Neither the recruiting nor the money raised in India can be considered voluntary contributions from India. Congressmen, and those under the Congress influence, cannot help in the prosecution of the war with men, money or material.”
এই প্রস্তাবে ভবিষ্যতের জন্য কোন সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপন্থার নির্দেশ না থাকিলে ও বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের যুদ্ধ-প্রচেষ্টার প্রতি ভারতবাসীর তীব্র অসন্তোষ ও অনাস্থা বলিষ্ঠ ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে। কংগ্রেস নেতৃত্বের এই পরিবর্ত্তিত মনোভাবের জন্য ফরওয়ার্ড ব্লক অবশ্যই কৃতিত্ব দাবী করিতে পারে।
১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র কলিকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান পদে নির্বাচিত হন। রামগড়ে আপোষ-বিরোধী সম্মেলন হইতে ফিরিয়া আসিবার কিছুকাল পরেই সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ‘হলওয়েল মনুমেণ্ট্’ আন্দোলন আরম্ভ হয়। লালদীঘির কোণে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নৃশংসতার অলীক কাহিনী বুকে লইয়া অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতিস্তম্ভ দণ্ডায়মাণ। ঐতিহাসিকের গবেষণার ফলে এই কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ইংরেজের গভীর দুরভিসন্ধিপ্রসূত ও স্বকপোল-কল্পিত বলিয়া নিংসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের নামে এই মিথ্যা কলঙ্কময় স্তম্ভ রাজধানীর বুক হইতে অপসারণের দাবী লইয়া ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে ধর্মঘট করে। সরকারী প্রতিরোধের মুখে কয়েকদিন হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত আন্দোলন চলিতে থাকে। অবশেষে দমননীতির মাশ্রয় লইয়াও যখন আন্দোলন বন্ধ করা গেল না তখন উক্ত মনুমেণ্ট অপসারিত করা হয়।
হল্ওয়েল মনুমেণ্ট আন্দোলন আরম্ভ হইবার পূর্ব্বদিন ১৯৪০ সালের ২রা জুলাই একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতরক্ষা আইনে সুভাষচন্দ্রকে গ্রেফ্তার করা হয়। কিছুদিন পরে বিলাতের কমন্স সভায় এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতসচিব এমেরী ঘোষণা করেন যে হল্ওয়েল স্তম্ভ অপসারণের আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণের জন্যই সুভাষ কারারুদ্ধ হন। বন্দী অবস্থায় সুভাষচন্দ্র উপনির্ব্বাচনে ভারতীয় পরিষদের সভ্য নির্ব্বাচিত হন। জেলে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে আরও দুইটি রাজদ্রোহের অভিযোগ আনীত হন। এক, ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতায় মহম্মদআলী পার্কে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা প্রদান, অপরটি ১৯৩৯ সালের ১৪ই মে ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রে The Day of Reckoning (হিসাব নিকাশের দিন) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ।
আসল কথা, ইউরোপে যুদ্ধের অবস্থা তখন গ্রেটবৃটেনের প্রতিকূল। স্বাধীন ফ্রান্সের পতন হইয়াছে—গ্রেট বৃটেনও জার্মানীর কামানের মুখে আসিয়া পড়িয়াছে। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট দেখিলেন এই সময় সুভাষচন্দ্রকে বাহিরে রাখা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ও যুদ্ধরত গ্রেট বৃটেনের পক্ষে বিপজ্জনক হইবে। কোন অজুহাতে তাঁহাকে আটক রাখাই এখন সরকারের আসল উদ্দেশ্য। কাজেই, বৎসরাধিক কালের পুরাতন অভিযোগ আনিয়া তাঁহাকে বিনাবিচারে কারাগৃহে বন্দী করিয়া রাখা হইল। অবশেষে ১৯৪০ খৃঃ ২০শে নভেম্বর সুভাষচন্দ্র অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেন। অনশন ব্রত গ্রহণ করিবার পূর্বে তিনি বাংলার গভর্ণর, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগী মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে তাঁহার সিদ্ধান্ত জানাইয়া একখানি পত্র লিখেন। সুভাষচন্দ্র এই পত্রখানিকে “My Political Testament” আখ্যা দিয়াছেন। সুভাষচন্দ্রের জীবনাদর্শের দিক হইতে এই পত্রখানির বিশেষ গুরুত্ব আছে। আমরা নিম্নে উহা হইতে কয়েকটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করিতেছি।—“বর্ত্তমান অবস্থায় আমার জীবন দুর্ব্বিষহ হইয়া উঠিয়াছে। অবিচার ও অন্যায়ের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার সুযােগ গ্রহণ করা আমার পক্ষে আত্মমর্য্যাদাহানিকর। এভাবে জীবনকে ক্রয় করিবার পরিবর্ত্তে আমি জীবন বিসর্জ্জন দিতে প্রস্তুত। গভর্ণমেণ্ট প্রকাশ্যভাবে তাহার সর্বশক্তি প্রয়ােগ করিয়া আমাকে আটক রাখিতে বদ্ধপরিকর। ইহার বিরুদ্ধে আমি বলিতে চাই যে, আমাকে মুক্তি না দিলে আমি বাঁচিতে চাহি না। এভাবে বাঁচিয়া থাকা অথবা জীবন বিসর্জ্জন দেওয়া সম্পূর্ণ আমার নিজের হাতে।”
“যদিও আমার মৃত্যুতে এখনই কোন বাস্তব ফল হইবে না। তবুও কোন ত্যাগস্বীকারই বিফল হয় না। দুঃখ বরণ ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়াই যুগে যুগে, দেশে দেশে সমস্ত সংগ্রাম শক্তি ও প্রেরণা লাভ করে। সর্বদেশে সর্বকালে বীর শহিদের রক্তবিন্দু হইতেই ভবিষ্যৎ সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়।”
“এই মরজগতে সমস্তই ধ্বংস প্রাপ্ত হয় কেবল আদর্শ, প্রেরণা ও বিশ্বাস বাঁচিয়া থাকে। একজনের আত্মত্যাগের আদর্শ সহস্রজনের মধ্যে নূতন প্রেরণা জাগাইয়া দেয়—সেই আদর্শ সহস্র জীবনে মূর্ত্ত হইয়া উঠে। এই নিয়মেই বিবর্ত্তনশীল জগতে যুগ হইতে যুগান্তরে একের আদর্শ ও সাধনা সঞ্জীবিত ও সংক্রামিত হইয়া থাকে। দুঃখবরণ ও আত্মদান ব্যতীত কোন আদর্শ, কোন সংগ্রামই জয়যুক্ত ও সার্থক হয় না।”
“কোন আদর্শের বেদীমূলে জীবন বিসর্জ্জন অপেক্ষা মানবজীবনের আর কি কাম্য আছে? মানুষ যদি ত্যাগ ও কষ্টের দ্বারা পার্থিব জীবনে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সে প্রতিদানে অমরজীবনের উত্তরাধিকারী হইয়া লাভবান হইবে। ইহাই আত্মার নাতি। জাতিকে বাঁচাইতে হইলে ব্যক্তির মৃত্যু চাই। ভারত স্বাধীন হইয়া গৌরবের সহিত যাহাতে বাঁচে সেজন্য আমাকে আজ মরিতে হইবে।”
“দেশবাসীর নিকট আমার অনুরোধ—ভুলিও না মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড় অভিশাপ পরাধীন হইয়া থাকা। ভুলিও না অন্যায় ও অত্যাচারের সংগে আপোষ করা মহাপাপ। প্রকৃতির এই নিয়ম মনে রাখিও—কোন কিছু পাইতে হইলে অগ্রে কিছু দান করা প্রয়োজন। আরও মনে রাখিও জীবনের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ, যে কোন মূল্য দিয়াই অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করা।”
কর্ত্তৃপক্ষ বুঝিয়াছিলেন, ইহা সুভাষচন্দ্রের কেবলমাত্র ভীতি প্রদর্শন নহে—ইহার মধ্যে যশ ও সুখ্যাতি অর্জ্জন করিবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নাই। যে জীবনাদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়া সুভাষচন্দ্র আজীবন দুঃখও নির্যাতন সহ্য করিয়া অবিরাম সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছেন ইহা সেই জীবনাদর্শ-প্রণোদিত স্থির সিদ্ধান্ত। সুভাষচন্দ্র মৃত্যুপণ করিয়া অনশন আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহার সঙ্কল্প হইতে কিছুতেই যে তাঁহাকে নিবৃত্ত করা বাইবে না সরকার ইহা ভাল ভাবেই জানিতেন। অবশেষে যখন অনশনের ফলে সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যের অবস্থা গভীর উদ্বেগের সঞ্চার করিল তখন ৫ই ডিসেম্বর সরকার বাহাদুর সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দিতে বাধ্য হইলেন।
সুভাষচন্দ্রকে কারাগৃহ হইতে মুক্তি দিয়া সরকারের দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে এই সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক ব্যক্তিটিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করিতে দিলে সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ শোষণ-শাসন যে অব্যাহত ভাবে চলিতে পারিবে না—যুদ্ধ প্রচেষ্টা যে ব্যাহত হইতে পারে, এই আশঙ্কার বশবর্ত্তী হইয়া সরকার বাহাদুর সুভাষচন্দ্রকে স্বগৃহে অন্তরীণ অবস্থায় থাকিবার আদেশে জারী করিলেন। অন্তরীণাবস্থায় ধ্যান-ধারণা ও যোগচর্চ্চায় সুভাষচন্দ্রের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হইত। তিনি মৌনব্রত অবলম্বন করিলেন—আত্মীয় স্বজনের সংগে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করিয়া দিলেন। কেশ ও শ্মশ্রুগুম্ফাদি ধারণ করিয়া যোগীর ন্যায় কঠোর তপশ্চর্য্যায় নিমগ্ন রহিলেন। সকলেই ভাবিল, গভর্ণমেণ্টের নির্দ্দয় অত্যাচার ও ক্রমাগত কারাবাস তৎসঙ্গে কংগ্রেসী বড় কর্ত্তাদের অশোভন ব্যবহার কর্মজীবনের প্রতি তাঁহাকে বীতশ্রদ্ধ করিয়া তুলিয়াছে। কাজেই, ১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারী তাঁহার রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধানের খবর প্রকাশিত হইলে সকলেই নিঃসন্দেহে ধরিয়া লইল যে, শ্রীঅরবিন্দের ন্যায় সুভাষচন্দ্রও রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হইয়া সন্ন্যাসব্রত অবলম্বন করিয়াছেন।
নিঃস্ব ও নির্য্যাতিত ভারতবাসীর দুঃখ ও দুর্দশা মোচনের দুর্বার আকাঙ্ক্ষার অপেক্ষা শেষে কি সুভাষচন্দ্রের জীবনে কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত হিমালয়ের নির্জ্জন ও অনাসক্ত জীবনের আকর্ষণই প্রবলতর হইল? এই প্রশ্নের উত্তর মিলিল ১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ্চ। বিশ্বদূত রয়টায় সংবাদ দিলেন—“টোকিও রেডিওতে বলা হইয়াছে যে, সুভাষচন্দ্র স্বাধীন ভারত কংগ্রেসে যোগদানের জন্য টোকিও যাইবার পথে জাপানের উপকূলে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হইয়াছেন।” পরদিনই রয়টার জানাইলেন, এই সংবাদ ভুল—সুভাষচন্দ্র জীবিতই আছেন। কিয়ৎকাল পরে বোম্বাই ক্রনিক্ল্ এর লণ্ডনস্থিত সংবাদ-দাতার সংবাদে প্রকাশ পাইল, সুভাষচন্দ্র বার্লিনে আছেন। জার্মানীর ডিক্টেটর হের হিটলার তাঁহাকে “India's Fuehrer and Excellency” উপাধিতে ভূষিত করিয়াছেন ও পররাষ্ট্রদূতের মর্য্যাদা ও সম্মান দিয়াছেন। জার্মানীতে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের সংগঠিত করিয়া জাতীয় বাহিনী গঠন করেন। অতঃপর সেখান হইতে তিনি পূর্ব্বএশিয়াস্থ ভারতীয় স্বাধীনতালীগের সভ্যবৃন্দের আহ্বানে সিঙ্গাপুরে পোঁছেন। এইখানেই আরম্ভ হইল তাঁহার জীবনের এক বিচিত্র ও গৌরবময় অধ্যায়। কংগ্রেসের নেতা হিসাবে, অহিংস সংগ্রামের সৈনিক হিসাবে, আপোষ-বিরোধী বিপ্লবী হিসাবে যিনি ভারতীয় গণ-নায়কদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করিতে পারিতেন আজ তাঁহারই নেতৃত্বে ও সংগঠনে গড়িয়া উঠিল স্বাধীন ভারতবাসীর গভর্ণমেণ্ট ও সামরিক শক্তি। সমস্ত পৃথিবী বিস্ময়চকিত হইয়া দেখিল—রাইফেল হস্তে ভারতীয় ফৌজ তাহাদের স্বাধীন গভর্ণমেণ্টেকে রক্ষা করিতেছে—মাতৃভূমির মুক্তির জন্য মৃত্যুপণ করিয়া লড়িতেছে।
কঠিন বিপদ তুচ্ছ করিয়া, নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া, দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়া সেই আজীবন বিপ্লবী অকুতোভয়ে তাঁহার কর্ত্তব্য সম্পাদনে চলিলেন। যেদিন কারাগারে সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে কেবলমাত্র আভ্যন্তরীণ সংগ্রামেই দেশ স্বাধীন করা যাইতে পারে না সেইদিনই তাঁহার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির হইয়া গেল।