চার

 এদিকে নানা অনিয়ম ও অত্যাচারের ফলে তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়ে। গৃহে ফিরিবার কিছুদিন পরেই তিনি টাইফয়েড্ জ্বরে আক্রান্ত হন ও দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকেন। পূজার সময় বায়ুপরিবর্ত্তনের জন্য কার্শিয়াং গমন করেন। তথায় তাঁহার স্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি হয়। সেই বৎসরই ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র অল্পকয়েকদিন পড়িয়াই তিনি আই, এ, পরীক্ষা দেন ও বিশেষ সম্মানের সহিত উত্তীর্ণ হন—প্রথমবিভাগের উপরদিকেই তাঁহার নাম ছিল। সুভাষচন্দ্রের ছাত্র জীবনেই তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের মহত্ত্বের অঙ্কুর দেখা গিয়াছিল। তাঁহার জীবনের যে বৃহত্তর লক্ষ্য আছে তাহা তিনি তখন হইতেই উপলব্ধি করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এই উপলব্ধি ও সচেতনতাই সুভাষচন্দ্রকে তাঁহার লক্ষ্যপথে জীবনের মহত্তম পরিণতির দিকে পরিচালিত করিয়াছে—সাংসারিক প্রতিপত্তির কোন প্রলোভনই তাঁহাকে পথভ্রষ্ট করিতে পারে নাই। এই সময়ে তিনি একখানি পত্রে লিখিয়াছিলেন—“আমি এটা বেশ বুঝিতেছি যে আমার জীবনের একটা definite mission আছে—তারই জন্য শরীর ধারণ—and I am not to drift in the current of popular opinion—লোকে ভাল মন্দ বলিরে জগতের এটা রীতি but my sublime self-consciousness consists in this that I am not affected by them. যদি জগতের ব্যবহারে আমার attitude পরিবর্ত্তন হয় অর্থাৎ দুঃখ নৈরাশ্য প্রভৃতি আসে, তাহা হইলে বুঝিব যে সে আমার দুর্ব্বলতা। কিন্তু আকাশের দিকে যার লক্ষ্য, সম্মুখে পর্ব্বত আসছে, কি কূপ আসছে তার সে জ্ঞান থাকে না——সেইরকম যার একমাত্র লক্ষ্য mission এর দিকে, আদর্শের দিকে, তার ওসব দিকে মোটেই ভ্রূক্ষেপ নাই।”

 আই, এ পাশ করিবার পর সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজেই দর্শনশাস্ত্রে অনার্স লইয়া বি, এ, পড়িতে থাকেন এবং নিজের চরিত্রবলে স্বল্পকালের মধ্যে ছাত্রগণের নেতৃস্থানীয় হইয়া উঠেন। এই সময় প্রেসিডেন্সী কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন মিঃ ওটেন। উগ্র সাম্রাজ্যবাদ পুষ্ট সংস্কৃতির উদ্ধত প্রতিনিধি বলিতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তাই। ভারতবাসীর প্রতি চরম অবজ্ঞাই ছিল তাঁহার প্রধান আনন্দ —তাঁহার ঔদ্ধত্যও ছিল অপরিসীম। ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক মিঃ ওটেনের দুর্ব্ব্যবহারে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে গোলযোগ উপস্থিত হয় ও ছাত্রের ধর্ম্মঘট করে! সুভাষচন্দ্র ধর্ম্মঘটকারীদের নেতৃত্ব করেন। এই ঘটনার ঠিক একমাস পরে মিঃ ওটেন পুনরায় ছাত্রদের প্রতি দুর্ব্ব্যবহার করিলে ছাত্রেরা মিঃ ওটেনকে প্রহার করিয়া ইহার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অধ্যাপককে প্রহারের অপরাধে কলেজের কর্ত্তৃপক্ষ সুভাষচন্দ্র ও কতিপয় ছাত্রকে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য ‘রাসটিকেট’ করেন। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হইয়াই ছাত্ররা ওটেনের দুর্ব্ব্যবহারের প্রতিশোধ লয়। কিন্তু ওটেনকে মারপিটের সময় প্রকৃতপক্ষে সুভাষচন্দ্র সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি এই ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকায় কলেজের অধ্যক্ষ জেমস সাহেব তাঁহাকে তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করিয়া শাস্তি হইতে অব্যাহতি লাভ করিবার পরামর্শ দেন। এমন কি বিচারে তাঁহাকে সন্দেহের অবকাশে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হইয়াছিল। কিন্তু দায়িত্ব অস্বীকার করিয়া সুভাষচন্দ্র নিজে শাস্তি হইতে অব্যাহতি পাইতে চাহিলেন না। অনুগত সঙ্গীদিগকে বিপদে ফেলিয়া নিজের পরিত্রাণলাভের এই হীন প্রস্তাবে তাঁহার বীর-হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। তিনি স্বেচ্ছায়ই শাস্তি বরণ করিয়া লইলেন। এই ঘটনায় সুভাষ-চরিত্রের দৃঢ়তা, সহপাঠীদের প্রতি নিবিড় প্রীতি ও সহমর্মিতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং নির্ভরযোগ্য নেতাহিসাবেও তাঁহার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত হইয়াও সুভাষচন্দ্র তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের বিপুল সম্ভাবনা ও প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র হতাশ হন নাই; বরং তাঁহার উদ্যম ও চেষ্টা আরও বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনার কিছুকাল পূর্ব্বের একখানা চিঠিতে তিনি লিখেন, “উদ্যমশীল ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা অর্জ্জনের পথ পৃথিবীতে চিরদিন উন্মুক্তই থাকে। যদি আমি ‘রাসটিকেটেড’, হই তবে তাহার জন্য আমার কিছুমাত্র চিন্তা নাই—আমি ইহার জন্য মোটেই দুঃখিত হইব না।” উক্ত পত্রে তিনি ইহাও উল্লেখ করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষ যদি তাঁহাকে বহিষ্কৃত করিয়া দেয় তাহা হইলে তিনি আমেরিকা গিয়া অধ্যাপক Munsterbergএর নিকট Experimental Psychology অধ্যয়ন করিবেন।

 ‘ওটেন’ সংক্রান্ত ব্যাপারে সুভাষচন্দ্রের জীবনে এক আমূল পরিবর্ত্তন হয়। তিনি জাত্যাভিমানী শাসকশ্রেণীর অসঙ্গত ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশ ও বেরার ছাত্র সম্মেলনের সভাপতিরূপে সুভাষচন্দ্র যে অভিভাষণ প্রদান করেন তাহাতে ছাত্রজীবনের উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “ছাত্রজীবনের সচ্চরিত্রতার দিক হইতে বিচার করিলে, আমার নিজের ছাত্রজীবন নিষ্কলঙ্ক ছিল না। এখনও আমার সেদিনের কথা স্পষ্টই মনে হইতেছে, যেদিন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব আমাকে ডাকাইয়া নিয়া আমার উপর দণ্ডাদেশ জারি করিয়াছিলেন—কলেজ হইতে আমাকে সস্‌পেণ্ড করিয়াছিলেন। তাঁহার কথাগুলি এখনও আমার কানে বাজিতেছে। তিনি বলিয়াছিলেন—“কলেজের মধ্যে তুমিই সর্ব্বাপেক্ষা দুরন্ত ছেলে।”

 আমার জীবনে সেই এক স্মরণীয় দিন। বলিতে গেলে, নানা দিক দিয়াই সেদিন হইতে আমার জীবনে সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায়ের সূচনা হইয়াছিল। সেদিনই আমি সর্ব্বপ্রথম অনুভব করিলাম—কোনও মহৎ কাজে নির্য্যাতন সহ্য করার মধ্যে একটা অনির্বচনীয় আনন্দ আছে। এই আনন্দের সহিত জীবনের আর কোন আনন্দেরই তুলনা হয় না। আর সমস্তই ইহার নিকট তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ। আমার জীবনে বাস্তবক্ষেত্রে এই প্রথম নীতি ও স্বাদেশিকতার অগ্নিপরীক্ষা হইয়া গেল। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া যখন বাহির হইলাম, তখন আমার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপন্থা চূড়ান্তরূপে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে।”

 কলেজ হইতে বিতাড়িত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র কটকে প্রায় বছর দুই কাটান। পরে ১৯১৭ সালে তদানীন্তন ভাইসচ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি পুনরায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিবার অনুমতি লাভ করেন এবং স্কটীশ চার্চ্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স লইয়া তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে ভর্ত্তি হন। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামরিক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে University Training Corps গঠিত হয়। সুভাষচন্দ্র এই ট্রেণিং কোরে যোগদান করেন। আজিকার আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্ব্বাধিনায়কের যুদ্ধবিদ্যায় ইহাই প্রথম হাতেখড়ি। ইহার পরে তিনি ভারতীয় রক্ষীবাহিনী বা Indian defence force-এ যোগদান করিয়া Captain Grayর নিকট সামরিক শিক্ষা লাভ করেন। সেদিন সুভাষচন্দ্র ভারতের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সেনাদল গঠন করিবার সঙ্কল্প লইয়াই ক এত যত্নও আগ্রহের সহিত যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিলেন।

 স্কটিশচার্চ্চ কলেজ হইতেই সুভাষচন্দ্র বি, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বি, এ অনার্স পরীক্ষায় তিনি দর্শনশাস্ত্রে দ্বিতীয়স্থান অধিকার করেন।