ছাব্বিশ

 ছাত্রজীবন হইতেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে সুভাষচন্দ্র কোন দিন পশ্চাৎপদ হন নাই। কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও অসঙ্গত প্রভুত্বস্পৃহা তাঁহার অন্তরের বিদ্রোহীকে আবার ক্ষেপাইয়া তুলিল। কংগ্রেসকে একটি সংগ্রামশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সুভাষচন্দ্রের অনেক দিনের লক্ষ্য ছিল। দক্ষিণপন্থীদের বিপ্লববিমুখতা ও আপোষমুখী মনোভাবের দরুণই তাঁহাদের সহিত সহযোগিতা রক্ষা করা সম্ভব হইল না। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি কোনদিন যাঁহাকে স্পর্শ করে নাই এই আঘাতে হাল ছাড়িয়া দিবার পাত্র তিনি নহেন। সুভাষচন্দ্র এইবার কংগ্রেসের বামপন্থীদল ও কংগ্রেসের বাহিরের অন্যান্য সংগ্রামশীল দলগুলিকে সংঘবদ্ধ করিয়া একটি অখণ্ড বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলার কার্য্যে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি তাঁহার এই সংগ্রামাত্মক নীতি গ্রহণ করিবে ও দেশের সমস্ত গণ-আন্দোলনই তাঁহার সংগ্রামশীল নেতৃত্বে বিশ্বাস স্থাপন করিবে। সুতরাং, সমস্ত বামপন্থী উপাদানকে সংহত করিবার উদ্দেশ্যে তিনি দেশবাসীর নিকট আবেদন জানাইলেন। এই হইতেই অগ্রগামী দল “ফরওয়ার্ড ব্লক”-এর উৎপত্তি।

 অনেকের ধারণা, ত্রিপুরীতে যে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছে তাহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সংগঠনে প্রবৃত্ত হন, কিন্তু এই ধারণা সত্য নহে। বস্তুতঃ পক্ষে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের একটি প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সমস্ত প্রগতিপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করিয়া ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জনের জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম আরম্ভ করা। তাঁহার রাজনৈতিক কর্মধারায় এই প্রগতিপ্রবণ চিন্তা বহু পূর্বেই বিকাশপ্রাপ্ত হইয়াছিল। ১৯২৭ সালে মান্দালয় জেল হইতে মুক্তিলাভের পর হইতে তিনি কংগ্রেসের আপোষমূলক ও নরমপন্থী প্রত্যেকটি নীতি ও কার্য্যের বিরোধিতা করেন। মাদ্রাজ কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাবে সুভাষচন্দ্রের সহিত দক্ষিণপন্থীদের সর্বপ্রথম মতবিরোধ ঘটে। ইহার পরে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে রচিত ‘নেহরু কমিটি’ প্রণীত ভারতবর্ষের গঠনতন্ত্র অনুমোদন করিবার উদ্দেশ্যে লক্ষ্ণৌয়ে যে সর্ব্বদলীয় সম্মেলনের অনুষ্ঠান হয় সেখানে তিনি কংগ্রেসের এই আপোষমূলক নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং জওহরলাল ও অন্যান্য বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে Independence League নাম দিয়া একটি বামপন্থী প্রতিষ্ঠান গঠন করিতে সক্ষম হন। ঐ বৎসর ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় কংগ্রেসের যে বাৎসরিক অধিবেশন হয়, সেই অধিবেশনে স্বাধীনতা লীগের সভ্যগণ কংগ্রেসের উদ্দেশ্য যাহাতে পূর্ণ স্বাধীনতা বলিয়া ঘোষিত হয় তজ্জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। এই সময় হইতেই কংগ্রেসের এই বামপন্থী প্রতিষ্ঠানটি পরবর্ত্তী অধিবেশনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করিতে ও প্রস্তুত হইতে থাকে এবং তদুদ্দেশ্যে ছাত্র, শ্রমিক, কিষাণ, সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের সংঘবদ্ধ করিতে বদ্ধপরিকর ফলে, কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে পূর্ণ-স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

 ১৯৩০ হইতে ১৯৩৩ সাল পর্য্যন্ত কংগ্রেসের ইতিহাস গভর্ণমেণ্টের সহিত সর্বপ্রকার অসহযোগ ও ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলনের ইতিহাস। প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ায় কংগ্রেসের রক্ষণশীল ও প্রগতিপন্থীদলের মধ্যে কোন প্রভেদ রহিল না। কিন্তু, ১৯৩৩ সালে গান্ধীজী কর্ত্তৃক আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলে পুনরায় বামপন্থীদলের প্রয়োজন দেখা দিল। সুভাষচন্দ্র এই সময় স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য ভিয়েনায় ছিলেন। গান্ধীজীর কার্য্যের নিন্দা করিয়া পরলোকগত বিঠলভাই প্যাটেলের সহিত যুক্তভাবে তিনি এক বিবৃতি প্রচার করেন। ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদল গঠিত হয়। এই দলের আদর্শে কংগ্রেসের সংগ্রামবিমুখ নীতির পরিবর্ত্তন সূচিত হইতেছে দেখিয়া সুভাষচন্দ্র সমাজতন্ত্রী দল গঠনে আনন্দিত হন। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের সমস্ত প্রগতিপন্থী মুক্তিকামী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপদানগুলিকে ন্যূনতম সাধারণ কর্ম্মপন্থার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করার প্রয়োজন তিনি বিশেষরূপে উপলব্ধি করেন। হরিপুরার পর হইতে তিনি এই বামপন্থীদল গঠনে বিশেষরূপে আত্মনিয়োগ করেন। হরিপুরা ও ত্রিপুরীর মধ্যবর্ত্তী সময়ে তিনি এই কার্য্যে অনেকদূর অগ্রসর হন। সুতরাং ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’কে কেহ যেন ত্রিপুরীর ঘটনার ফলস্বরূপ মনে না করেন। ইহা আদৌ দক্ষিণ পন্থীদের প্রতি প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষভাব প্রসূত নহে। পাঠকদের সন্দেহ নিরসনকল্পে সুভাষচন্দ্রের লিখিত বিবৃতি হইতে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিলাম।

 ‘১৯৩৭ সালের মার্চ্চ মাসে মুক্তিলাভ করিয়া ঐ বৎসরই অক্টোবর মাসে আমি কলিকাতায় ও পর বৎসর ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হরিপুরায় নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির সভায় যোগদান করি। হরিপুরায় আমি লক্ষ্য করিলাম, বামপন্থীরা পূর্ববৎসর অপেক্ষা শক্তিশালী না হইয়া শক্তিহীন হইয়াছে। হরিপুরার পরে বিভিন্ন মনোভাবসম্পন্ন ও বিভিন্ন মতবাদের বামপন্থীদের সহিত আলোচনা প্রসঙ্গে আমি এই কথা উল্লেখ করি যে, বামপন্থীদের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থায় নিশ্চয়ই এমন কোন ত্রুটি বা অভাব রহিয়াছে যাহার জন্য তাহাদের এই পতন ঘটিয়াছে।

 এই সময়কার কংগ্রেস সংগঠনে কয়েকটি প্রধান প্রধান পার্টি বা গ্রুপ্ লক্ষ্য করা যায়। প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পরিচালিত সরকারী কংগ্রেস (official block)। বামপন্থীদের আবার তিনটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও সুনির্দ্দিষ্ট দল রহিয়াছে—এই তিনটি দলের অনুবর্ত্তীদের সংখ্যাও বিভিন্ন। ইহারা কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট, চরম বামপন্থী ও রায়পন্থী। এই দলগুলির মধ্যে আবার অসংগঠিত আমূল-পরিবর্ত্তন-পন্থী ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উপাদান রহিয়াছে। ইহারা সংখ্যায় বহু; কিন্তু, ইহারা যে কারণেই হউক উল্লিখিত বামপন্থী দলগুলির কোনটিতেই যোগদান করে নাই। আমার মনে হইয়াছিল যে, যতদিন এই “আমূল পরিবর্ত্তনবাদী” উপাদানগুলি একটি নির্দ্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সংঘবদ্ধ না হইবে ততদিন বামপন্থী আন্দোলন যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি সঞ্চয় করিতে পারিবে না। সুতরাং, এইরূপ প্রস্তাব করা হইয়াছিল যে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ন্যূনতম কর্মপন্থার ভিত্তিতে একটি নূতন বামপক্ষ দল গঠন করা হইবে এবং ইহা ‘Leftist Bloc’ নামেই অভিহিত হইবে। বর্ত্তমান সময়ে যে সব পার্টির অস্তিত্ব রহিয়াছে তাহারা ইহাতে যোগদান করিতে পারিবে এবং বিক্ষিপ্ত ও অসংবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উপাদানগুলিকেও ইহাতে যোগদান করিতে আহ্বান করা হইবে। আমার এই পরিকল্পনা বর্ত্তমান বামপন্থী দলগুলি প্রথম প্রথম খুবই উৎসাহের সহিত গ্রহণ করে এবং মনে হইয়াছিল যেন অচিরেই তারা নূতন পরিকল্পনাকে কার্য্যে পরিণত করিবে। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির যে বৈঠক হয় সেখানে এই দিকে আরও একটু অগ্রসর হওয়া গিয়াছিল। এই বৈঠকে জনৈক চরম-বামপন্থী নেতা এই উদ্দেশ্যে একটি ইস্তাহারের খসড়া প্রস্তুত করেন। এই বিজ্ঞপ্তিটি কংগ্রেসের মধ্যে যাঁহারা বামপন্থী চিন্তাধারার পোষকতা করেন তাঁহাদের মতামত জানিবার জন্য প্রচার করা হয়।

 তৎপরে সোশ্যালিষ্টদের মধ্যে মতের পরিবর্ত্তন দেখা দেয়; এমনকি কয়েকজন প্রভাবশালী কংগ্রেসী সমাজতন্ত্রী নেতা প্রকাশ্যেই এইরূপ একটি বামপন্থী ব্লক গঠনের বিরুদ্ধে মত প্রচার করেন। তাঁহাদের এই মত পরিবর্ত্তনের ফলে অপর কোন বামপন্থী দল উক্ত পরিকল্পনাকে কার্য্যে রূপ দিতে পারে নাই। অবশ্য বামপন্থী ব্লক গঠনের এই পরিকল্পনা তখনও একেবারে পরিত্যাগ করা হয় নাই এবং কতিপয় প্রসিদ্ধ কংগ্রেসকর্মী এই দিকে তাঁহাদের চেষ্টা চালাইতে থাকেন। ১৯৩৯ সালের ২৯শে জানুয়ারী কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচনের পরে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে কলিকাতায় আমূলপরিবর্ত্তনপন্থী ও বামপন্থী কংগ্রেস কর্মীদের এক ঘরোয়া বৈঠক হয়। বামপন্থী দল গঠনের প্রশ্ন পুনরায় নূতন করিয়া আলোচিত হয়, কিন্তু, এবারেও কয়েকজন প্রসিদ্ধ সমাজতন্ত্রী নেতা এরূপ নিরুৎসাহ করেন যে, বোধ হইয়াছিল যেন ব্লক গঠনের কোন চেষ্টাই ফলবতী হইবে না।

 কিন্তু তাহাতেও উদ্যোক্তারা দমিত হন নাই। ১৯৩৯ সালে এই উদ্দেশ্যেই ত্রিপুরীতে আর একটি ঘরোয়া বৈঠক হয়। যেহেতু কয়েকজন বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ইহার সহিত যুক্ত হইতে চাহেন নাই, কাজেই স্থির হয় যে, ‘Left Bloc’ নাম পরিবর্ত্তন করিয়া অপর একটি নামকরণ হইবে। কি কি কর্মপন্থা অনুসৃত হইবে ঘরোয়াভাবে তাহারও একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয় ও গৃহীত হয়। অতঃপর স্থির হয় যে পরবর্ত্তী নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। যদিও প্রথম হইতেই আমি এই পরিকল্পনার পক্ষে ছিলাম তথাপি এই সময়ে আমার নিকট মনে হইয়াছিল যেন আমি নিজে ইহার সহিত যুক্ত না থাকিলেই উৎকৃষ্টরূপে দেশ সেবার কাজ করিতে পারিব। অবশ্য, সে ক্ষেত্রেও ইহার প্রতি আমার বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল মনোভাবের কোন পরিবর্ত্তন হইবে না। পরিকল্পিত ‘Left Bloc' এর উদ্যোক্তারা সকলেই আমার সহিত একমত হইলেন।

 অবশেষে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া বৈঠকে সর্ব্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমস্ত আমূল পরিবর্ত্তন-পন্থী ও প্রগতি-প্রবণ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উপাদানগুলিকে ন্যূনতম কর্মপন্থার ভিত্তিতে সংহত ও সংঘবদ্ধ করিতে আর বিলম্ব করা উচিত নয়। এই ন্যূনতম কর্মপন্থা বিভিন্ন মতবাদসম্পন্ন বামপন্থী দলগুলির মধ্যে যথাসম্ভব অধিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করিবে।

 ইহাও স্থির হয়, এই দলের ‘Forward Bloc’এই নূতন নামকরণ হইবে। পূর্বতন ‘Left Bloc’ এর স্থলে এই ‘Forward Bloc’ কোন একটি বিশেষ পার্টি বা দল হইবে না; পক্ষান্তরে, যাহারাই এই ব্লকের কর্মপন্থা গ্রহণ করিবেন ইহা তাহাদের সকলেরই সংযোগস্থল হইবে। এতদ্ব্যতীত বর্ত্তমানে কংগ্রেসের বামপক্ষে যে সমস্ত অসংবদ্ধ ও বিশৃঙ্খল আমূল-পরিবর্ত্তন-পন্থী দলের অস্তিত্ব রহিয়াছে তাহাদের এই ব্লকে যোগদানের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে। বস্তুতপক্ষে, তাহারা সাদরে অভ্যর্থিত হইবে। এইরূপ আশা হয়, কালক্রমে এই ব্লক কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত আমূল-পরিবর্ত্তন-পন্থী ও সমাজতন্ত্রী উপদানগুলিকে ইহার অন্তর্ভুক্ত করিতে সক্ষম হইবে।

 জাতীয় আন্দোলনের ক্রমবিকাশ ও অন্তর্প্রেরণায় কংগ্রেসের বিবর্ত্তনের ফলে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর উৎপত্তি হইয়াছে। ব্লকের গঠনতন্ত্র ও কার্য্যক্রম হইতে আমরা জানিতে পারিব যে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ কংগ্রেসের সহিত একই আদর্শনিষ্ঠ কংগ্রেসেরই অন্তর্গত একটি প্রতিষ্ঠান; এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত বামপন্থী উপাদান ও দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া একটি অখণ্ড ঐক্য স্থাপনই ইহার উদ্দেশ্য। ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ কংগ্রেস-বিরোধী দল নহে। কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতাকামী সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দলগুলির মিলন ক্ষেত্র; অতএব, কংগ্রেসের অন্তর্ভূত কি বহির্ভূত অপরাপর সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রতিষ্ঠানের সহিত কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতা থাকা বাঞ্ছনীয়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য থাকিলেও স্বাধীনতা-যুদ্ধে ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাহাদের আদর্শগত কোন পার্থক্য নাই।

 নিম্নোক্ত বিবৃতির দ্বারা সুভাষচন্দ্র নিজেই বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তিগুলি খণ্ডন করিয়া ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনের সার্থকতা প্রতিপন্ন করিয়াছেন—

 ‘কংগ্রেসের official (সরকারী) bloc এর সাংগঠনিক ভিত্তি ‘গান্ধী-সেবা-সংঘ’। এক্ষণে, বামপন্থীদের ভিত্তি কি? এখনও কোন ভিত্তি নাই বটে, তবে আশা করা যাইতেছে, ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পূর্ণ সমৃদ্ধি লাভ করিয়া সমস্ত সরকারী কংগ্রেস বহির্ভূত (non-official) রেডিক্যাল ও সমাজতন্ত্রী উপাদান সমূহের সাংগঠনিক বনিয়াদের কাজ করিবে। কেবল তখনই কংগ্রেসের বামপক্ষ স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা প্রাপ্ত হইবে।

 আমাদের সমালোচকেরা যুক্তি দেখাইতে পারেন—‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর গঠন কংগ্রেসের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করিয়া জাতীয় ঐক্য নষ্ট করিবে। জিজ্ঞাসা করি, ‘গান্ধী-সেবা-সংঘ’ গঠনে যদি বিচ্ছেদ সৃষ্টি না হইয়া থাকে তবে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনেই বা তা হইবে কেন? বামপক্ষের এই সংহতিই আমার মতে প্রকৃত জাতীয় ঐক্যসৃষ্টির সোপান হইবে; এবং, এই ঐক্য কার্য্যক্ষেত্র ও বাস্তবক্ষেত্রের সক্রিয় ঐক্য—নিষ্ক্রিয় ঐক্য নহে। বামপক্ষের সংহতি ভিন্ন প্রকৃত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আমি ত আর কোন পথ দেখি না।

 ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ কংগ্রেসের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাজ করিবে। ইহা কংগ্রেসের বর্ত্তমান গঠনতন্ত্র, মতবাদ, নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণ করিবে। এই প্রতিষ্ঠান মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিত্বের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবে এবং জাতির নিকট মহাত্মার দান তাঁহার রাজনৈতিক মতবাদ অহিংস অসহযোগ নীতিতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করিবে। কিন্তু, ইহার দ্বারা এই বুঝাইতেছে না যে, ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর বর্ত্তমান কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ডের প্রতিও আস্থা থাকিবে। প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, বর্ত্তমান সঙ্কটকালে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সৃষ্টি করিয়া কেন আমরা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গোলযোগ সৃষ্টি করিতেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, যেহেতু বর্ত্তমান কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ড ভিন্নমতাবলম্বী কংগ্রেস কর্মীদের প্রতি আপোষহীন মনোভাবের পরিচয় দিতেছেন এবং তাঁহারা যুগোপযোগী কর্মপন্থা অনুসরণ করিতে পারিতেছেন না তাহাতে আজ হউক কাল হউক এইরূপ আভ্যন্তরিক বিভেদ ও গোলযোগ অনিবার্য্য। উচ্চমণ্ডলের নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিলে আজিকার এই গোলযোগ ও বিচ্ছেদ এড়ানো যায়, কিন্তু আত্মসমর্পণ করিয়া এই অবশ্যম্ভাবী ভেদসৃষ্টি স্থগিত রাখিলে আমাদের কি উপকার হইবে? যে অকল্যাণ একদিন আসিবেই তাহাকে কেবল আজিকার মত সাময়িকভাবে স্থগিত রাখিয়া কি হইবে? আমরা অতি শীঘ্র বহির্জাগতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হইতেছি। বহির্জাগতিক সঙ্কট দেখা দিলে সে সময়ে অন্তর্বিরোধ নিরতিশয় ক্ষতিকর হইত। তাহার চেয়ে ইহাই বরং সমধিক বাঞ্ছনীয় যে, আমরা অন্তর্গোলযোগের সম্মুখীন হইয়া বহির্জাগতিক সঙ্কট আসিবার পূর্বেই এই গোলযোগ কাটাইয়া উঠিব ও পূর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হইব।

 যদি বলি রাজনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে কোন কোন সময় বিচ্ছেদের প্রয়োজন হয় তাহা হইলে কিছু মারাত্মক ভুল করা হইবে না। ১৯১৮ সালে নরমপন্থীদের বিচ্ছেদ, ১৯২০ সালে অসহযোগের বিরুদ্ধবাদীদের বিচ্ছেদ কেবল অবিমিশ্র অকল্যাণই ডাকিয়া আনে নাই। পক্ষান্তরে, ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে উহা অবশ্যম্ভাবী ও প্রয়োজন ছিল। বৈদেশিক ইতিহাসেও এইরূপ দৃষ্টান্তের অভাব হইবে না। ১৯০৩ সালে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিচ্ছেদ না হইলে বলশেভিক পাটির উদ্ভব ও সমৃদ্ধিলাভ কখনই হইত না। অতএব, আমি আমার দেশবাসীকে অনুরোধ করিব, ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ যে বিচ্ছেদ সৃষ্টির জন্য দায়ী হইতে পারে তাহার সম্বন্ধে তাঁহারা যেন অগভীরভাবে চিন্তা না করেন। ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসে স্বরাজ্যদলের বিদ্রোহ কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য ভ্রান্ত-ধারণা, বিরোধ এমনকি তিক্ততার সৃষ্টি করিয়াছিল কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত কংগ্রেস স্বরাজ্যদলের কর্মপন্থা গ্রহণ করিয়া নূতন পরিস্থিতির সহিত সামঞ্জস্য বিধান করিতে বাধ্য হয়। বর্ত্তমানক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইতে পারে। ইহা যেন কেহ বিস্মৃত না হন যে কংগ্রেসের আভ্যন্তরিক ঐক্য বজায় রাখিতে দক্ষিণ পক্ষের চেয়ে বামপক্ষ কম উদ্‌গ্রীব। এই কারণেই বামপক্ষ সর্ব্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠনের পক্ষপাতী। অপরপক্ষে, দক্ষিণপক্ষ একদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন করিতে আগ্রহান্বিত। ফলতঃ, বামপক্ষ কংগ্রেসের মধ্যে স্থায়ী ও খাঁটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করিতে থাকিবে। এই সঙ্কট সময়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের এই উদ্যম ও চেষ্টা অনিবার্য্য কারণে ও দক্ষিণপন্থীদের অনমনীয় মনোভাবের দরুণই অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছে।

 গত ২৫ বৎসরের কংগ্রেসের ইতিহাস আলোচনা করিলে কংগ্রেসের মধ্যে বিভিন্ন দলের অস্তিত্ব সপ্রমাণ হইবে। ‘অহিংস অসহযোগ’ গ্রহণের পর হইতে কংগ্রেস কর্মিগণ বহুদিন পর্য্যন্ত স্বরাজ্যদল ও ‘নো-চেঞ্জার’ দলে বিভক্ত ছিল। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। সেই সময়ে “কংগ্রেস ন্যাশনালিষ্ট” নামে অপর একটি দলেরও অস্তিত্ব ছিল—বাঙলায় এই দলটি একসময়ে বেশ শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল। কিষাণ সভার অনেক সদস্যই কংগ্রেসকর্মী ও কংগ্রেসের সভ্যশ্রেণীভুক্ত—শ্রমিকদলের মধ্যে কংগ্রেস সদস্যের সংখ্যা কম নহে। গান্ধী-সেবা-সংঘের সভ্যরা কংগ্রেসের কার্য্যকলাপের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং দক্ষিণপন্থীদের সহিত যুক্ত হইয়া রাষ্ট্রনীতিক আলোচনার অংশ গ্রহণ করিতেন। কাজেই দেখা যাইতেছে, কংগ্রেসের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসকর্মিগণ একাধিক দলের সহিত যুক্ত ছিলেন ও এখনও আছেন। এই দিক হইতে বিচার করিলে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সৃষ্টির মধ্যে কোনই নূতনত্ব নাই—কংগ্রেসের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র দল গঠন কংগ্রেসের ইতিহাসে এই প্রথম বা অভূতপূর্ব ও নহে। এই কারণেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর কর্মপদ্ধতির সহিত মতবিরোধ থাকিলেও দক্ষিণপন্থীরা ব্লকগঠনে যুক্তিসঙ্গতভাবে কোনরূপ বাধা দিতে পারেন নাই। একই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে ভিন্নধর্মী লোকের একত্র সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার নজিরও কংগ্রেসে মিলিবে। ত্রিপুরী কংগ্রেসে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলকে মতবৈষম্য সত্ত্বেও দক্ষিপন্থীদলের সহিত সহযোগিতা করিতে দেখা গিয়াছে। অতএব, সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের দ্বারা কংগ্রেসের আনুপূর্বিক ইতিহাসের ধারা ও নিয়মশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কোন কাজ করেন নাই।

‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ কেন?

লেখক: শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু

 ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বলিতে এমন একটি আন্দোলন বুঝায় ভারতের মাটিতেই যাহার উদ্ভব। ইহা ভারতের জনগণের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রচেষ্টা ও আদর্শের প্রতীক। এই প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি ও বিস্তারের অফুরন্ত সম্ভাবনা ইহার মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে। অন্যান্য বাহ্যিক কারণ বর্ত্তমান থাকিলেও প্রধানতঃ অনুপ্রেরনার ফলেই ইহার ক্রমবিকাশ ঘটিয়াছে। এই অনুপ্রেরণা হইতেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর জন্ম। কোন ব্যক্তিগত বা আকস্মিক কারণ দ্বারা ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে এই অভিনব ঘটনার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায় না। ক্রমবিকাশের পথে কংগ্রেসের আন্দোলন এক নব পর্য্যায়ে উত্তীর্ণ হইবে বলিয়াই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সৃষ্টি হইয়াছে।

 ২। কংগ্রেসের এই বিবর্ত্তন কিভাবে ঘটে? ইহার মূলে কোন নিয়ম কাজ করিতেছে? ইহার ব্যাখ্যায় অনেক মতবাদের অবতারণা করা যায়, কিন্তু আমার নিকট হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদই সর্ব্বাপেক্ষা সমীচীন ও বস্তুনিষ্ঠ বলিয়া মনে হয়।

 প্রগতির পথ সরল রৈখিক নয়, ইহার প্রকৃতিও সর্ব্বদা শান্তিপূর্ণ থাকে না। অনেক সময় বিরোধের মধ্য দিয়াই প্রগতির সম্ভব হয়।

 ৩। সঙ্গতি (Thesis) ও অসঙ্গতি (Antithesis)র দ্বন্দ্ব হইতেই সমন্বয়ের (Synthesis) জন্ম হয়। বিবর্ত্তনের নবপর্য্যায়ে এই সমম্বয়ই আবার ‘সঙ্গতি’ রূপে দেখা দেয়। এই ‘সঙ্গতি’ পুনরায় ‘অসঙ্গতি’র সৃষ্টি করে—এবং উভয়ের দ্বন্দ্বের ফলে পুনরায় “সমন্বয়” ঘটে। প্রগতির চক্র এইরূপেই আবর্ত্তিত হইয়া চলিতে থাকে।

 ৪। যাহারা সময়ে অসময়ে ঐক্যের কথা বলে, এবং সর্ব অবস্থায়ই ও যে কোন মূল্যে ঐক্য বজায় রাখিবার জন্য আবেদন করে, তাহারা বিবর্ত্তনের এই মূল সূত্রই বিস্মৃত হয়। প্রকৃত ঐক্য ও মিথ্যা ঐক্য সক্রিয়তার ঐক্য ও নিষ্ক্রিয়তার ঐক্য—যে ঐক্যের ফল প্রগতি ও যে ঐক্যের ফল নিশ্চেষ্টতা—ইহাদের প্রভেদ বিচার করিতে হইবে। যাহারা চলার বেগ হারাইয়াছে, বৈপ্লবিক প্রেরণা যাহাদের নাই, সর্বাবস্থায় ও যে কোন মূল্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সহজ বুলি আজিকার দিনে তাহাদেরই মুখে শোভা পায়। এইরূপ ঐক্যের মোহে পড়িয়া আমরা পথভ্রষ্ট হইব না।

 ৫। প্রত্যেক জীবন্ত ও গতিশীল আন্দোলনের মধ্যে বামপন্থী চিন্তাধারা গুপ্ত আছে—ইহাকে গুপ্ত “অসঙ্গতি”ও বলিতে পারি। সময় পূর্ণ হইলে, এই গুপ্ত বামপক্ষ আত্মপ্রকাশ করে ও ইহার মধ্য দিয়াই ক্রমবিকাশের ধারা চলিতে থাকে। কোন বিশেষ অবস্থায় বামপক্ষ কীরূপে সর্বাপেক্ষা ফলপ্রসূ কর্মপন্থা অনুসরণ করিবে, তাহা নির্ণয় করিতে হইলে রাজনৈতিক ও কখন কখনও দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। সময় সময় এমনও হয় যে, দক্ষিণ পক্ষের সহিত আপোষ ও সহযোগিতা সহায়েই বামপক্ষ শক্তিসংগ্রহ ও প্রভাব বিস্তার করে। আবার বিভিন্ন প্রকার অবস্থায় এইরূপ সম্ভব নাও হইতে পারে। তখন, দক্ষিণ-পক্ষের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া ও প্রসার ও প্রতিপত্তিলাভে তৎপর হওয়াই বামপন্থী দলের কর্ত্তব্য। এইরূপ অবস্থায়, বেদনাদায়ক হইলেও সুস্পষ্ট বিরোধ বস্তুতঃপক্ষে প্রগতির সহায়ক ও অপরিহার্য্যও বটে। সাংগঠনিক বিকাশের ফলে একটি বামপক্ষের আবির্ভাব ও বৃদ্ধি স্বাভাবিক নিয়মেই অনিবার্য হইয়া উঠে। সহযোগিতার সহায়েই অথবা সংঘর্ষের ভিতর দিয়াই হউক বামপক্ষ বিকাশলাভ করিতে করিতে অবশেষে সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিকে অধিকার করিয়া লয় অথবা দক্ষিণপন্থীদিগকে নিজের দলে টানিয়া আনে। এই সাফল্য লাভের পরে বামপন্থীদের (অধুনা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল) বিকাশের সম্ভাবনা নিঃশেষ হইয়া গেলে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, এবং নূতন বামপক্ষ জন্মলাভ করিয়া কালক্রমে প্রাক্তন বামপন্থীদের বিতাড়িত করে।

 ১৯২০ সালের গান্ধীপন্থীদল কংগ্রেসে বামপন্থী থাকিলেও বর্ত্তমানে আর তাহারা বামপন্থী নয়। প্রায়ই দেখা যায়, গতকল্যকার বামপন্থীরা আগামীকল্যের দক্ষিণপন্থীতে পরিবর্ত্তিত হয়।

 আজিকার কংগ্রেসের মধ্যে দক্ষিণ ও বামপক্ষের কোন প্রভেদ রাখা উচিত নয়, বর্ত্তমানে সমগ্র কংগ্রেসই একটি বামপন্থী প্রতিষ্ঠান—এই ধরণের কথা বলা চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা। এমন একটি সন্ধিক্ষণে আমরা উপস্থিত যখন অপ্রীতিকর হইলেও আমাদিগকে বাস্তব সত্যের সম্মুখীন হইতে হইবে।

 ৬। ১৯৩৬ ও ১৯৩৮ সালের মধ্যে কংগ্রেসের বামপন্থীদল দক্ষিণপন্থীদের সহিত সহযোগিতা রক্ষা করিয়া বিকাশলাভ করিয়াছে। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণপন্থীদের তরফ হইতে এই চীৎকার উঠিল যে, আর বামপন্থীদের সহিত সহযোগিতা সম্ভব নয়—বামপন্থীরা বড়ই অশান্তি ও বিঘ্ন সৃষ্টি করিতেছে।

 ৭। পরিশেষে ১৯৩৯ সালে এই অভিযোগ চরম পরিণতি লাভ করিল—দক্ষিণপন্থীদল ইচ্ছা করিয়াই বামপন্থীদের সহিত সহযোগিতা লোপ করিতে সিদ্ধান্ত করিলেন।

 একমতাবলম্বী মন্ত্রণা পরিষদ বা ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের জন্য বর্ত্তমানে দক্ষিণপন্থীদের এই জেদের গভীরতর তাৎপর্য ত ইহাই। তিন বৎসর বাবৎ তাহারা বামপন্থীদের সহিত একযোগে কাজ করিতে পারিল, কিন্তু আর তাহারা এইরূপ করিতে পারিবে না কেন? কারণ এই যে, কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি দক্ষিণপন্থীরা নিরুদ্বেগে আর সহ্য করিতে পারিতেছে না।

 যখন নূতন মন্ত্রণ-পরিষদ বা ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৩৯ সালের ২৯ শে এপ্রিল কলিকাতায় নিখিল ভারত রাষ্ট্রীর সমিতির বৈঠক বসিল, তখন দেখা গেল যে, দক্ষিণপন্থীদের সহিত সহযোগিতাকামী বামপন্থীদল বিভিন্ন মতাবলম্বী বা মিশ্র ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিতে আগ্রহশীল। কিন্তু দক্ষিণপন্থীদল বামপন্থীদের সহিত সহযোগিতা রক্ষা করিতে চাহিল না—একমতাবলম্বী ওয়ার্কিং কমিটি গঠনই তাহাদের একমাত্র শ্লোগান হইয়া উঠিল। ফলে, দক্ষিণপন্থীরাই আপোষ, সহযোগিতা ও ঐক্যের মূলোৎপাটন করিল।

 বামপন্থীদের পূর্ণ আত্মসমর্পণ—ইহাই বর্ত্তমানে দক্ষিণীদের কামনা। ঐক্যের খাতিরে কি বামপক্ষ ইহাতে সম্মত হইবে? দক্ষিণীদের নিকট আত্মসমর্পণ করিলে ইহার ফলাফল কি হইবে? ইহাতে কি প্রগতি দ্রুতায়িত হইবে, না প্রতিক্রিয়াশীল দলেরই শক্তিবৃদ্ধি হইবে?

 দক্ষিণপন্থিগণ বামপন্থীদের সহিত সহযোগিতা স্থাপনে অস্বীকৃত; তবুও ঐক্যপ্রতিষ্ঠার খাতিরে আমরা বামপন্থী দল তাহাদের নিকট আত্মসমর্পন করিতে পারিতাম যদি দক্ষিণপন্থীদল এখনও সংগ্রামশীল ও প্রগতিমুখী কর্মপন্থা গ্রহণ করিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধীর সহিত আমার যে পত্রালাপ হইয়াছে, তাহা হইতে ইহা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে, আসন্ন সংগ্রামের দিক হইতে গান্ধীজী এখন আর চিন্তা করিতেছেন না। কংগ্রেসী মন্ত্রিগণ ও তাহাদের চালক কংগ্রেসের বর্ত্তমান কর্ত্তৃপক্ষেরও সংগ্রাম আরম্ভ করিবার কোন অভিপ্রায় নাই। এই অবস্থায় দক্ষিণপন্থীদের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া ঐক্যের ঠাট বজায় রাখার অর্থ কংগ্রেসে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নিষ্ক্রিয়তাকেই চিরস্থায়ী করা। আমরা এইরূপ করিতে পারি না— আমাদের এইরূপ করা উচিত নয়।

 অতএব, বর্ত্তমানে বামপক্ষের প্রথম কর্ত্তব্য দক্ষিণপক্ষের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া সংহত ও সঘবদ্ধ হওয়া। এই কার্য্য সম্পন্ন হইলে, বামপন্থীদল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিয়া কংগ্রেসের নামে স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু করিতে পারিবে। ইহাই আজিকার দিনে বামপন্থীদের একমাত্র কর্ত্তব্য। এই ঐতিহাসিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্যই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর আবির্ভাব।

 বর্ত্তমান বামপন্থী দলগুলির উচিত ছিল—তাহাদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের এই ব্রত গ্রহণ করা। কিন্তু যে কারণেই হউক তাহারা এই কর্ত্তব্যসাধনে অগ্রসর হয় নাই। গত বৎসর বামপন্থী কংগ্রেসকর্মিগণ বামপন্থী ব্লক গঠনের প্রস্তাব আলোচনা করেন—তখন মনে হইয়াছিল, বামপন্থী দলসমূহ এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কার্য্যে পরিণত করিবার চেষ্টা করিবে। কিন্তু পরে, তাহাদের মত পরিবর্ত্তন হয়। তাই বামপন্থী দলসমূহের অভ্যন্তরস্থিত নবীন কর্মীদের সহায়তায় ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অপরিহার্য হইয়া পড়িল। কাজেই, ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর আবির্ভাবের মূলে কেবলমাত্র কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ অন্তর্প্রেরণাই নয়, ঐতিহাসিক প্রয়োজনও বর্ত্তমান রহিয়াছে। অধিকন্তু, বর্ত্তমান সময়ের ঘটনাসমূহ ইহার উৎপত্তির উপযোগিতা প্রতিপন্ন করিতেছে। এই প্রকারে ও এই অবস্থার মধ্যে যাহার জন্ম, সেই ‘ফরওয়ার্ড ব্লক-এর মৃত্যু নাই। আমাদের রাজনৈতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে ইহা একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।

 স্থায়িত্বের অক্ষয় পাথেয় লইয়া এই প্রতিষ্ঠান কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছে—কালের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইহা ক্রমবর্দ্ধমান ব্যাপ্তি ও শক্তিলাভ করিয়াই চলিবে। আমার এই উক্তির যাথার্থ্য সম্বন্ধে যাঁহারা সন্দেহ পোষণ করেন, তাঁহারা ধৈর্য্য সহকারে কংগ্রেস ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর অনাগত কালের ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করিতে থাকুন।

(“ফরওয়ার্ড ব্লক”—৫।৮।৩৯)
ইংরাজী হইতে অনূদিত।

‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর গঠন-তন্ত্র

 নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের বোম্বাই সম্মেলনে নিম্নোক্ত গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়।

 গঠনতন্ত্রের বিধান:—

 (১) এই প্রতিষ্ঠান “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামে অভিহিত হইবে।

 (২) এই ব্লক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরই অন্তর্গত একটি প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেসের অন্তর্গত সমস্ত বামপন্থী দলের সাধারণ মিলন স্থল হিসাবে এই ব্লক কাজ করিবে।

 (৩) ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ও ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির লক্ষ্য অভিন্ন —অর্থাৎ, সর্বপ্রকার বৈধ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ।

 (৪) কংগ্রেসের যে সকল প্রাথমিক সভ্য ব্লকের কর্মপন্থায় বিশ্বাসী, তাহারা সকলেই ইহার সভ্য হইতে পারে।

 (৫) নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির (এ. আই. সি. সি.) যে সকল সদস্য ব্লকের কর্মপন্থায় আস্থাবান তাদের নিয়াই ব্লকের নিখিল ভারত পরিষদ গঠিত হইবে। পরিষদের সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের অনধিক অতিরিক্ত সদস্য নির্বাচনের অধিকার এই সদস্যদের থাকিবে।

 (৬) ব্লকের কর্মপন্থায় বিশ্বাসী কংগ্রেসের প্রাদেশিক, জেলা ও অন্যান্য অধীন কমিটিগুলির সভ্যদের লইয়া ব্লকের প্রাদেশিক, জেলা ও অন্যান্য অধীন পরিষদগুলি যথাক্রমে গঠিত হইবে।

 (৭) একজন সভাপতি, দুইজন সহ-সভাপতি, একজন সাধারণ সম্পাদক, চারজন সম্পাদক ও একজন কোষাধ্যক্ষ (এই কয়জন কর্মকর্তা) নিখিল ভারত পরিষৎ কতৃক নির্বাচিত হইবে।

 (৮) নিখিল ভারত পরিষৎ ব্যতীত অন্যান্য পরিষদগুলি ব্লকের কার্য্যকরী সমিতি হিসাবে কাজ করিতে পারে অথবা পরিষদগুলির সদস্যদের মধ্য হইতে নির্বাচিত ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিতে পারে।

 (৯) কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ যে সকল বামপন্থী দল বর্ত্তমানে ব্লকে যোগদান করে নাই—তাহাদের সহিত ব্লকের সমন্বয় সাধনকল্পে নিখিল ভারত পরিষদ যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন। কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত বামপন্থী উপাদান ও দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া একটি অখণ্ড ঐক্য স্থাপনই এইরূপ সমন্বয় সাধনের লক্ষ্য থাকিবে।

 (১০) ব্লকের প্রাথমিক সদস্যের রেজিষ্টার বহি প্রদেশ কর্ত্তৃক নিযুক্ত সাব-কমিটি দ্বারা পরীক্ষিত হইবে। সভ্য-তালিকার সংশোধন করা ও তালিকা হইতে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার অধিকার এই সাব-কমিটির থাকিবে। সাব-কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিখিল ভারত কমিটির নিকট আপীল চলিবে।

 ১। ব্লকের কার্য্যক্রম—প্রত্যেক ভারতবাসীর নিজ নিজ ধর্মসম্মত উপাসনা করিবার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ কেবলমাত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী হইতেই আলোচিত হইবে।

 ২। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্ত্তনের পর হইতে প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা উৎকটরূপে বিস্তারলাভ করিতেছে। ইহাদের উচ্ছেদ সাধনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতে হইবে।

 ৩। কংগ্রেস শাসনযন্ত্র অধিকার করিবার ফলে অথবা আইনসভায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণের ফলে কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে বর্ত্তমানে কোন প্রকার দুর্নীতি দেখা দিয়া থাকিলে তাহার মূলোৎপাটন করিতে হইবে।

 (৪) সর্বপ্রকার কায়েমী স্বার্থের প্রভাব তথা কংগ্রেসী মন্ত্রিসভার প্রাধান্য বিস্তার হইতে কংগ্রেসকে মুক্ত রাখিতে হইবে। বর্ত্তমান এককর্ত্তৃত্বের প্রভাবের পরিবর্ত্তে কংগ্রেসে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশে কংগ্রেসের আমূল সংস্কার সাধন করিয়া ইহাকে একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করিতে হইবে।

 (৫) আমূল পরিবর্ত্তনকামী বৈপ্লবিক মনোভাব নিয়া কংগ্রেসের পার্লামেণ্টারি কার্য্যক্রম অধিকতর উদ্যমের সহিত বাস্তবে পরিণত করিতে হইবে। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের রক্ষণাধীনে নয়—কংগ্রেসেরই রক্ষণাধীনে কংগ্রেস-মন্ত্রিসভা কাজ করিবে। প্রতিদ্বন্দ্বী গভর্ণমেণ্ট স্থাপনের উদ্দেশ্য লইয়াই সমগ্র দেশের কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা ও কংগ্রেসী প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করিয়া যাইবে।

 (৬) অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের জন্য কৃষক ও শ্রমিকদের সংগ্রাম সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা হইবে।

 (৭) কিষাণ সভা, ট্রেড ইউনিয়ন, ইয়ুথ লীগ, ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি অপরাপর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সঙ্ঘগুলি ও কংগ্রেসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করিতে হইবে।

 (৮) সর্বভারতীয় ভিত্তিতে একটি স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গড়িয়া তুলিতে হইবে।

 (৯) দায়িত্বশীল গভর্ণমেণ্ট ও ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের সঙ্ঘগুলিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণতি দানকল্পে দেশীয় রাজ্যে প্রজাদের সঙ্ঘসমূহ ও কংগ্রেসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ও সহযোগিতা গড়িয়া তুলিতে হইবে। সমগ্র দেশে দেশীয় রাজ্য প্রজা আন্দোলনের পরিচালনা ও সহায়তার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা করিতে হইবে।

 (১০) ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপোষহীন শত্রুতাসাধন করিতে হইবে। গভর্ণমেণ্ট উক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ভারতীয় জনগণের উপর চাপাইবার চেষ্টা করিলে সর্বপ্রকার বৈধ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম পরিচালনা করিতে হইবে।

 (১১) গ্রেট ব্রিটেন কর্ত্তৃক ভারতবর্ষ কোন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জড়িত হইয়া না পড়ে ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ভারতের ধনবল ও জনবলের শোষণ হইতে না পারে তদুদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা করিতে হইবে।

 (১২) পুনরায় ব্রিটিশ দ্রব্য ও বিদেশী বস্ত্র বর্জ্জন আন্দোলন তীব্রতর করিয়া তুলিতে হইবে। কেবলমাত্র ভারতের স্বদেশীশিল্প ও তাহাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য নহে, পরন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর প্রচেষ্টা ব্যাহত করিবার জন্যও ব্রিটিশ পণ্য ও বিদেশী বস্তু বর্জন আন্দোলন প্রয়োজন।

 (১৩) সমস্ত রাজনৈতিক কর্মীদের যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 (১৪) পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য রাষ্ট্রীয় সংগ্রাম শীঘ্র আরম্ভ করিবার উদ্দেশ্যে দেশীয় পণ্য প্রস্তুত করিবার ব্যবস্থা এখন হইতেই করিতে হইবে।

 (১৫) জাতীয় পুনর্গঠনক্ষেত্রে ফরওয়ার্ড ব্লক পরিকল্পনায়, বিশেষভাবে শিল্পোন্নতির পরিকল্পনায়, বিশ্বাসী। সময় ও সুযোগ উপস্থিত হইলে ফরওয়ার্ড ব্লক রাষ্ট্রের কর্ত্তৃত্বে শিল্পপ্রসার সাধনে সচেষ্ট হইবে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রতিষ্ঠান সমূহের সহিত পরামর্শক্রমে ফরওয়ার্ড ব্লক ভূমি-ব্যবস্থা সম্পর্কেও প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করিবে।

 উপরি-উক্ত কর্মপন্থা কার্য্যকরী করিতে ফরওয়ার্ড ব্লক যথাসাধ্য চেষ্টা করিবে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্ত্তৃক যাহাতে এই কর্মপন্থা গৃহীত হয়, তদুদ্দেশ্যে ইহার অনুকূলে প্রচার কার্য্য চালাইবে।

 গত ১৯৪১ সালে আগষ্ট মাসে কংগ্রেসের “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাবের ভিত্তিতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যে ব্যাপক গণ-আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মিগণ তাহাতে উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করে এবং অশেষ নির্য্যাতন ও লাঞ্ছনা ভোগ করে। সংগ্রাম-বিমুখ দক্ষিণপন্থীদের সহিত বামপন্থী ফরওয়ার্ড ব্লকের মধ্যে যে মতভেদ ছিল আগষ্ট আন্দোলনের ফলে তাহা বিদূরিত হয়। ব্লকের অনেক কর্মী দীর্ঘকাল যাবৎ কারাদণ্ড ভোগ করিতেছেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা আজিও প্রত্যাহৃত হয় নাই। আগষ্ট আন্দোলনের দ্বারাই প্রমাণিত হইল যে, মূল কংগ্রেসের সহিত বামপন্থীদলগুলির যে মতানৈক্য তাহা কেবল কর্মপন্থার—একান্তই বাহ্যিক। সংগ্রামাত্মক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অতিশয় সহজসাধ্য। ফরওয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রভৃতি বামপন্থী প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে কংগ্রেসের মনোভাব এখন পর্য্যন্ত পরিষ্কাররূপে জানা যায় নাই। অথচ গত আগষ্ট আন্দোলনে এই সকল প্রতিষ্ঠানই অধিকতর কষ্টস্বীকার ও দুঃখবরণ করিয়াছে। ইহাদেরই প্রচেষ্টায় আগষ্ট আন্দোলন কিয়ৎ পরিমাণে সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে—নেতৃবৃন্দের গ্রেফ্‌তারের পর এই সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই প্রস্তাবিত আন্দোলনের অসম্পূর্ণ পরিকল্পনাকে একটি সম্পূর্ণ রূপ দিতে চেষ্টা করিয়াছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি প্রতিকূলাচরণ করিলে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তার হানি হইবে। ইহাদের সম্পর্কে কংগ্রেস কি নীতি অনুসরণ করিবে তাহা সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করা প্রয়োজন।