নয়

 সুভাষচন্দ্রের মান্দালয় জেলে অবস্থান একটি ঘটনার জন্য বিশেষ স্মরণীয়। ১৯২৬ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি সুভাষচন্দ্র ও অপর কয়েকজন রাজবন্দী অনশন ধর্ম্মঘট করেন। দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা ও অন্যান্য ধর্ম্মোৎসবের জন্য রাজবন্দীদিগকে কোনরূপ ভাতা দেওয়া হইত না। সেই বৎসর ২৫শে অক্টোবর দুর্গাপূজা। মান্দালয় জেলের রাজবন্দীরাও বাঙ্গালীর এই উৎসব উপলক্ষে অর্থসাহায্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করেন। জেল সুপারিন্‌টেন্‌ডেণ্ট মেজর ফিল্‌লে রাজবন্দীদের দাবী পূরণ করিতে স্বীকৃত হইলেও সরকার তাঁহাদের প্রস্তাবে অসম্মত হন। সরকারের এই অনমনীয় মনোভাবের প্রতিবাদ কল্পে রাজবন্দীরা অনশন ধর্ম্মঘট করে। রেঙ্গুনের নাগরিকগণ জনসভা করিয়া অনশন ধর্ম্মঘটকারীদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। ২৪শে ফ্রেব্রুয়ারী তারিখের কলিকাতা কর্পোরেশনের এক সভায় গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের নিন্দা করিয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৫শে কেব্রুয়ারী এই সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় একটি মুলতবী প্রস্তাব আনয়ন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রেসিডেণ্ট উক্ত প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন না। অনশনকারী রাজবন্দীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ২৮শে ফ্রেব্রুয়ারী কলিকাতা সহরে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। এইরূপে দিকে দিকে যখন বিক্ষোভের অগ্নিশিখা জ্বলিয়া উঠিল তখন সরকার বাধ্য হইয়া বন্দীদের সমস্ত দাবী পূরণ করিতে স্বীকৃত হইলেন। সুভাষচন্দ্রের জীবনে এই প্রথম অনশন ধর্ম্মঘট। অনশন ধর্ম্মঘটের ফলে উদ্বুদ্ধ অন্তর্নিহিত আত্মশক্তির উপলব্ধিও সুভাষচন্দ্রের জীবনে এই প্রথম। দক্ষিণ কলকাতা সেবক সমিতির সহ-সম্পাদক শ্রীযুক্ত অনিলচন্দ্র বিশ্বাসকে লিখিত একখানি পত্রে তিনি লিখেন “আপনি বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছেন যে আমাদের অনশন ব্রত একেবারে নিরর্থক বা নিষ্ফল হয় নাই। গভর্ণমেণ্ট আমাদের ধর্ম্ম বিষয়ে দাবী স্বীকারকরিতে বাধ্য হইয়াছেন এবং অতঃপর বাঙ লাদেশের রাজবন্দী পূজার খরচ বাবদ বাৎসরিক ত্রিশটাকা allowance পাইবেন। ত্রিশটাকা অতি সামান্য এবং ইহাদ্বারা আমাদের খরচ কুলাইবেনা; তবে যে Principle গভর্ণমেণ্ট এতদিন স্বীকার করিতে চান নাই তাহা যে এখন স্বীকার করিয়াছেন, ইহাই আমাদের সব চেয়ে বড় লাভ। টাকার কথা সর্ব্বক্ষেত্রে সর্ব্বকালে অতি তুচ্ছ কথা। পূজার দাবী ছাড়া আমাদের অন্যান্য অনেকগুলি দাবীও গভর্ণমেণ্ট পূরণ করিয়াছেন। বৈষ্ণবের ভাষায় বলিতে গেলে আমাকে কিন্তু বলিতে হইবে “এহবাহ্য”। অথাৎ অনশনব্রতের সব চাইতে বড় লাভ অন্তরের বিকাশ ও আনন্দ লাভ। দাবীপূরণের কথা বাহিরের কথা, লৌকিক জগতের কথা। suffering ব্যতীত মানুষ কখন ও নিজের অন্তরের আদর্শের সহিত অভিন্নতা বোধ করিতে পারে না এবং পরীক্ষার মধ্যে না পড়িলে মানুষ কখনও স্থির নিশ্চিন্ত ভাবে বলিতে পারে তাহার অন্তরে কত অপার শক্তি আছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি নিজেকে আরও ভালভাবে চিনিতে পারিয়াছি এবং নিজের উপর আমার বিশ্বাস শতগুণে বাড়িয়াছে।”


 দুই বৎসর অতীত হইতে চলিল সুভাষচন্দ্রকে বিনা বিচারে ও বিনা অপরাধে আটক রাখা হইয়াছে। প্রকাশ্য আদালতে বিচারের জন্য বারংবার দাবী জানাইয়াও কোন সুফল হয় নাই। অবশেষে ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে বাঙ্লা কংগ্রেস এক অভিনব উপায় অবলম্বন করেন। এই মাসে ব্যবস্থাপক সভার নির্ব্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর কলিকাতা অমুসলমান কেন্দ্র হইতে কংগ্রেস কমিটি কর্ত্তৃক সুভাষচন্দ্র ব্যবস্থাপক সভার সভ্যপদপ্রার্থী মনোনীত হন। এই প্রসঙ্গে উত্তর কলিকাতার অধিবাসিগণের উদ্দেশ্যে এক আবেদন পত্রে তিনি লিখেন “নিজের জীবন পূর্ণরূপে বিকশিত করিয়া ভারত মাতার পদাম্বুজে অঞ্জলিস্বরূপ নিবেদন করিব এবং এই আন্তরিক উৎসর্গের ভিতর দিয়া পূর্ণতর জীবন লাভ করিব— এই আদর্শের দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হইয়াছিলাম। স্বদেশসেবা বা রাজনীতির পর্য্যালোচনা আমি সাময়িক বৃত্তিহিসাবে গ্রহণ করি নাই। এই জন্য পরাধীন দেশে স্বদেশসেবকের জীবনে যে বিপদ ও পরীক্ষা, দুঃখ ও বেদনা অবশ্যম্ভাবী, তার জন্য কায়মনে প্রস্তুত হইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আমি কৃতকার্য্য হইতে পারিয়াছি কিনা অথবা কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি তার বিচার করিবেন আমার দেশবাসিগণ। আমার এই ক্ষুদ্র অথচ ঘটনাবহুল জীবনে যে সব ঝড় আমার উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে বিঘ্নবিপদের সেই কষ্টিপাথর দ্বারা আমি নিজেকে সূক্ষ্মভাবে চিনিবার ও বুঝিবার সুযোগ পাইয়াছি। এই নিবিড় পরিচয়ের ফলে আমার প্রত্যয় জন্মিয়াছে যে, যৌবনের প্রভাতে যে কণ্টকময় পথে আমি জীবনের যাত্রা শুরু করিয়াছি, সেই পথের শেষ পর্য্যন্ত চলিতে পারিব; অজানা ভবিষ্যৎকে সম্মুখে রাখিয়া যে ব্রত একদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম তাহা উদ্‌যাপন না করিয়া বিরত হইব না। আমার সমস্ত প্রাণ ও সারা জীবনের শিক্ষা নিঙাড়িয়া আমি এই সত্য পাইয়াছি, পরাধীন জাতির সব ব্যর্থ—শিক্ষা, দীক্ষা, কর্ম্ম সকলই ব্যর্থ যদি তাহা স্বাধীনতা লাভের সহায় বা অনুকূল না হয়। তাই আজ আমার হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ হইতে এই বাণী নিরন্তর আমার কানে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে। “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়?” আমি কৃতাঞ্জলিপুটে আপনাদের নিকট এই প্রর্থনা করিতেছি, আপনারা আমাকে আশীর্ব্বাদ করুন, স্বরাজ লাভের পূর্ণ প্রচেষ্টাই যেন আমার জীবনের জপ, তপ ও স্বাধ্যায়, আমার সাধনা ও মুক্তির সোপান হয় এবং জীবনের শেষ দিবস পর্য্যন্ত আমি ভারতের মুক্তিসংগ্রামে নিরত থাকিতে পারি।” তাঁহার এই আবেদন পত্রখানি কর্ত্তৃপক্ষ আটক রাখিলেও উহার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় নাই। দেশবাসী তাঁহাকে বিপুল ভোটাধিক্যে প্রতিনিধি নির্ব্বাচিত করিয়া সুযোগ্য নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।

 এদিকে সুভাষচন্দ্রের শরীরের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া পড়ে। মান্দালয়ের নির্জ্জন কারাবাসে তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙিয়া গেল। ঐ স্থানের অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া ও নিরানন্দ নির্জ্জনতা তাঁহার শরীরে মারাত্মক ক্ষয়রোগ আনিয়া দেয়। তদুপরি তিনি অজীর্ণ রোগে বিশেষরূপে আক্রান্ত হইলেন। দেহের ওজন ৪০ পাউণ্ড কমিয়া যায়। এই অবস্থায় তাঁহাকে ইন্‌সিন্ জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়েন। সুভাষচন্দ্রের ভ্রাতা ডাঃ সুনীলচন্দ্র বসু ও সরকারী মেডিক্যাল অফিসার লেঃ কর্ণেল কেলসাল তাঁহার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং অবস্থা উদ্বেগজনক বলিয়া মত প্রকাশ করেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সরকার পক্ষ হইতে স্বরাষ্ট্রসচিব মিঃ মোবার্লী সুভাষচন্দ্রের নিকট স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য সুইজারল্যাণ্ডে যাইবার প্রস্তাব করেন। সুভাষচন্দ্রকে এইরূপ সর্ত্ত দেওয়া হয় যে, তিনি কলিকাতা বা ভারতের অপর কোন বন্দরে পদার্পণ না করিয়া সরাসরি ইউরোপ যাত্রা করিবেন। সুভাষচন্দ্র এই প্রস্তাবে অসন্মতি জ্ঞাপন করেন। কারণ তাঁহার মতে “জন্মভূমি হইতে চিরকালের মত নির্ব্বাসন অপেক্ষা জেলে থাকিয়া মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়।” এই প্রসঙ্গে ইনসিন জেল হইতে তিনি তাঁহার ভ্রাতা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসুকে মিঃ মৌবার্লীর প্রস্তাব সম্বন্ধে যে পত্র লিখেন তাহার প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করিতেছি। “দেখা যাইতেছে, সরকার ছোটদাদার (ডা: সুনীলচন্দ্র বসুর) প্রদত্ত রোগবিবরণ গ্রহণ করেন নাই, যদিও তাঁহার প্রদত্ত স্বাস্থ্য অর্জ্জন উপায় গ্রহণ করিয়াছেন, কারণ মিঃ মৌবার্লী স্পষ্টই বলিয়াছেন, “সুভাষচন্দ্র যে অত্যধিক পীড়িত হন নাই এবং একেবারে কর্ম্মশক্তিহীন হন নাই, তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন।” আমার জানিতে কৌতূহল হয়, সরকার কবে আমাকে “অত্যধিক পীড়িত” বা “একেবারে কর্মশক্তিহীন” মনে করিবেন। যেদিন সকল চিকিৎসক ঘোষণা করিবেন আমার রোগমুক্তি অসম্ভব এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে মৃত্যু হইতে পারে, সেইদিন কি? তাছাড়া ছোট দাদার রোগবিবরণ যদি তাঁহারা স্বীকার করিতে রাজী না হন, তাহা হইলে যাহা মাত্র বাহ্যতঃ তাঁহার অনুমোদন তাহা গ্রহণ করিতেই বা সরকার এত ব্যস্ত কেন? ছোট দাদা এ অনুমোদন করেন নাই যে, আমাকে বাড়ীতে যাইতে দেওয়া হইবে না, বা বিদেশে যাইবার পূর্ব্বে আমি আমার আত্মীয়স্বজনকে দেখিতে পাইব না। তিনি একথাও বলেন নাই যে, আমি যে জাহাজে যাইব তাহা কোন ভারতীয় বন্দরে নোঙর করিতে পারিবে না। তিনি একথাও বলেন নাই যে, যদি আমার নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধার হয় তাহা হইলে যতদিন আর্ডিনান্স আইন থাকিবে ততদিন দেশে থাকিতে পারিব না। এই সকল দেখিয়া আমার সন্দেহ হয়, সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য আমার নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধারের ব্যবস্থা নয়।

 মিঃ মৌবার্লী প্রকৃত পক্ষে বলিয়াছেন যে, দুইটি পথ অবশিষ্ট আছে, তাহা (১) জেলে বন্দী হইয়া অবস্থান কিংবা, (২) কোন বিদেশে যাইয়া স্বাস্থ্য অর্জ্জনের চেষ্টা ও অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান। কিন্তু সত্যই কি এই দুয়ের মধ্যে অন্যকোন মধ্যপন্থা নাই? আমার তা মনে হয় না। সরকারের ইচ্ছা যে আমি অর্ডিনান্স আইন উঠিয়া না যাওয়া পর্য্যন্ত, অর্থাৎ জানুয়ারী ১৯৩০ সাল পর্য্যন্ত, বন্দী থাকি। কিন্তু এ আইন যে ১৯৩০ সালের পরও পুনরায় নূতন করিয়া প্রবর্ত্তিত হইবে না, তাহা কে বলিতে পারে? গত অক্টোবর মাসে সি. আই. ডি পুলিসের কর্ত্তা মিঃ লোম্যানের সহিত এ প্রসঙ্গে আমার যে কথা হইয়াছিল তাহা একেবারেই আশাপ্রদ নয়। ১৯২৯ সালে যদি এই অর্ডিনান্স আইনকে চিরকালের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়া রাখিবার আন্দোলন হয় তাহাতে কিছুমাত্র আশ্চর্য্যান্বিত হইব না। তাহা হইলে আমাকে চিরস্থায়ীভাবে বিদেশে বাস করিতে হইবে এবং এইরূপ নির্ব্বাসনের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করিতে হইবে। যদি এ সম্বন্ধে সরকারের সত্যই কোন স্পষ্ট ইচ্ছা থাকিত তাহা হইলে আমি কবে বিদেশ হইতে ফিরিয়া আসিতে পারিব, সে কথাও ঐ প্রস্তাবে উল্লিখিত থাকিত।

 তারপর, প্রবাসে আমি কিরূপ স্বাধীনতা ভোগ করিতে পাইব তাহার কোনও স্পষ্ট আশ্বাস পাওয়া যায় নাই। সুইট্‌জারল্যাণ্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে যে সকল সি. আই. ডি বিচরণ করে, ভারতসরকার কি আমাকে তাহাদের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারিবেন? একথা অস্বীকার করা যায় না যে আমি “রাজনৈতিক অপরাধের সন্দেহে” ধৃত এবং যতদিন না মত পরিবর্ত্তন করিয়া পুলিস গোয়েন্দা হইতেছি ততদিন সরকার আমাকে সন্দেহের চক্ষেই দেখিবেন এবং ইহা খুব সম্ভব যে এই সকল গোয়েন্দা আমাকে প্রতিপদক্ষেপে অনুসরণ করিয়া আমার জীবন দুর্ব্বিসহ করিয়া তুলিবে।

 সুইট্‌জারল্যাণ্ডে শুধু বৃটিশ গোয়েন্দা নাই, তথায় বৃটিশ সরকার কর্ত্তৃক নিযুক্ত সুইস, ইটালীয়, ফরাসী, জার্ম্মান ও ভারতীয় গোয়েন্দা আছে এবং কোনও কোনও উগ্র উৎসাহী গোয়েন্দা আমাকে যে সরকারের কাছে গভীর কালিমাময় করিবার জন্য মিথ্যা ঘটনার সুবিস্তৃত বর্ণনা দিবে না, তাহারই বা প্রমাণ কি? আমি গতবৎসর মিষ্টার লোম্যানকে বলিয়াছিলাম, গোয়েন্দা বিভাগ ইচ্ছা করিলে যে কোন লোকের বিরুদ্ধে কতকগুলি মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিয়া তাহাকে কোনরূপ অর্ডিনান্সে বন্দী করিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করিতে পারে। ইউরোপ হইতে এরূপ করা আরও সহজ। বিদেশে যাহাদিগকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হইত, তাহাদিগকে ভারতে ফিরিতে কিরূপ অসুবিধা ভোগ করিতে হইয়াছে, তাহা সকলেই অবগত আছেন। বিলাতের পার্লামেণ্টের ও মন্ত্রিসভার কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য বিশেষ ভাবে চেষ্টা না করিলে লালা লাজপৎ রায়ের ন্যায় নেতাও দেশে ফিরিতে পারিতেন না। সরকার যখন আমাকে একবার সন্দেহের চক্ষে দেখিয়াছেন, তখন আমার ভবিষ্যৎ অবস্থা কিরূপ হইবে সহজেই অনুমান করা যায়।

 আমি জানি পুলিসের গােয়েন্দারা এ বিষয়ে একটু অধিক কার্য্যতৎপরতা দেখাইয়া থাকেন। আমি ইউরােপে যত শান্তভাবে এবং সাবধানতার সহিত বাস করি না কেন, তাঁহারা ভারত সরকারের নিকট আমার বিরুদ্ধে অন্যায় রিপাের্ট পাঠাইবেন। আমি কিছু না করিলেও এবং খুব শান্তভাব থাকিলেও তাঁহারা আমাকে ভীষণ ষড়যন্ত্রের কর্ত্তা বলিয়া রিপাের্ট দিবেন। তাঁহারা কি রিপাের্ট দিতেছেন, তাহার কিছুই আমি জানিতে পারিব না। কাজেই কোন কালে সে সম্বন্ধে সত্য প্রকাশের বা আমার বিবরণ প্রদানের সম্ভবনা থাকিবে না। এইরূপ ভাবে ইহা খুব সম্ভব যে ১৯২৯ খৃষ্টাব্দ আসিবার পূর্ব্বেই তাঁহারা আমাকে একজন বড় বলশেভিক নেতা বলিয়া প্রচার করিয়া দিবেন এবং তাহার ফলে হয়ত আমার ভারতে প্রত্যাগমনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হইয়া যাইবে; কারণ, ইউরােপের লােক বর্ত্তমানে এক বলশেভিকেই ভয় করে। এইজন্যই স্বেচ্ছায় আমি আমার জন্মভূমি হইতে নির্ব্বাসিত হইতে ইচ্ছা করি না। সরকার পক্ষও যদি আমার দিক হইতে একবার এ বিষয়ের আলােচনা করেন তাহা হইলে আমার যুক্তি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন।

 যদি আমার বলশেভিক এজেণ্ট হইবার ইচ্ছা থাকিত, তবে আমি সরকার বলিবামাত্র প্রথম জাহাজেই ইউরােপ যাত্রা করিতাম। তথায়, স্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্তির পর বলশেভিক দলে মিশিয়া সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘােষণা করিবার উদ্দেশ্যে প্যারিস হইতে লেনিনগ্রাড পর্য্যন্ত ছুটাছুটি করিতাম; কিন্তু আমার সেরূপ কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নাই। যখন শুনিলাম যে আমাকে ভারত, ব্রহ্মদেশ ও সিংহলে ফিরিয়া আসিতে দেওয়া হইবে না, তখন বার বার মনে মনে ভাবিলাম সত্যই কি আমি ভারতে বৃটিশ শাসনরক্ষার পক্ষে এতই বিপজ্জনক যে, বাঙ্‌লাদেশ হইতে নির্ব্বাসিত করিয়াও সরকার সন্তুষ্ট হইতে পারেন না, অথবা সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বিরাট ধাপ্পাবাজি? যদি প্রথম কথা সত্য হয়, তাহা হইলে ব্যুরােক্রেশীর নিকট সেরূপ ভয়ের কারণ হওয়া আমার পক্ষে শ্লাঘার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আমি আমার নিজের জীবন ও কার্য্যাবলীর কথা মনে মনে চিন্তা করি, তখন বুঝিতে পারি যে একদল স্বার্থান্ধ হিংসাপরায়ণ লােক আমাকে যে ভাবে দেখিতেছেন আমি প্রকৃত সেরূপ নহি। আমি বাঙ্‌লার বাহিরে কোন রাজনৈতিক কার্য্য করি নাই এবং ভবিষ্যতে করিব বলিয়াও মনে করি না; কারণ, বাঙ্‌লাকেই আমি আমার কার্য্যক্ষেত্র ও আদর্শের পক্ষে বিরাট বলিয়া মনে করি। বাঙ্‌লা সরকার ছাড়া অন্যকোন সরকারের আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। ছয় বৎসরের মধ্যে আমি কংগ্রেসে যােগদান ও পারিবারিক কারণব্যতীত অন্য কোনও কার্য্যে বাঙ্‌লার বাহিরে যাই নাই। তবে কেন আমাকে সমস্ত ভারত, ব্রহ্মদেশ ও সিংহলে প্রবেশ করিতে নিষেধ করা হইতেছে? সিংহল খাস বৃটিশ উপনিবেশ। ভারত সরকারের নিষেধ আজ্ঞা আইন অনুসারে তথায় খাটিবে কি না সন্দেহ।

 বাঙ্‌লা সরকার এখন আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করিতে চাহেন। আমি যখন স্বাধীন ছিলাম, তখনই বা আমার কি গতিবিধি ছিল? ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর হইতে ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর পর্য্যন্ত একবৎসরের মধ্যে আমি মাত্র দুইবার কলিকাতার বাহিরে গিয়াছিলাম। প্রথম খুলনা জেলা কনফারেন্সে যােগদান করিবার জন্য এবং দ্বিতীয় নদীয়া জিলার কাউন্সিল নির্ব্বাচনে একজন সভ্যপদ প্রার্থীর পক্ষে বক্তৃতা করিবার জন্য। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী হইতে অক্টোবরের মধ্যে আমি একবারও কলিকাতার বাহিরে যাই নাই। আমাকে সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সের সহিত জড়াইবার নানারূপ চেষ্টা হইয়াছে বটে, কিন্তু সে কনফারেন্সের সময় আমি কলিকাতা কর্পোরেশনের চীফ একজিকিউটিভ অফিসাররূপে মিউনিসিপ্যাল কার্য্যে বিশেষ ব্যস্ত ছিলাম; ঠিক কনফারেন্সের সময় কলিকাতায় ঝাড়ুদারদিগের ধর্ম্মঘটের সম্ভাবনা হওয়ায় আমার পক্ষে একমিনিটের জন্যও কলিকাতা ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের মে হইতে অক্টোবর পর্য্যন্ত আমি যাহা করিয়াছি তাহা সকলেই অবগত আছেন। সে সময় আমার সর্ব্বপ্রকার গতিবিধির কথা সরকার জানিতেন। আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করাই যদি আমাকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে আমি বলব, আমাকে গ্রেফতার করার কোন প্রয়োজন ছিল না।

 মিঃ মোবার্লী একটি বিষয়ে বিশেষ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়াছেন। সরকার জানেন যে প্রায় আড়াই বৎসরকাল আমি নির্ব্বাসিত আছি। এই সময়ের মধ্যে আমি আমার কোন আত্মীয়, এমন কি পিতা-মাতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি নাই। সরকার প্রস্তাব করিয়াছেন, আমাকে আরও আড়াই বা তিন বৎসরকাল বিদেশে থাকিতে হইবে, সে সময়েও তাঁহাদের সহিত সাক্ষাতের কোন সুবিধা হইবে না। ইহা আমার পক্ষে কষ্টদায়ক সন্দেহ নাই, কিন্তু যাঁহারা আমাকে ভালবাসেন, তাহাদের পক্ষে আরও অধিক কষ্টদায়ক। প্রাচ্যের লোকেরা তাঁহাদের আত্মীয়-স্বজনের সহিত কিরূপ গভীর স্নেহের বন্ধনে জড়িত থাকেন, তাহা পাশ্চাত্ত্য দেশীয় কাহারও পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নহে। আমার মনে হয়, এই অজ্ঞতার জন্যই সরকার এইরূপ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়াছেন। পাশ্চাত্ত্য দেশীয়েরা মনে করেন, যেহেতু আমার বিবাহ হয় নাই, অতএব আমার পরিবার থাকিতে পারে না এবং কাহারও প্রতি আমার ভালবাসাও থাকিতে পারে না।

 গত আড়াই বৎসর আমাকে কিরূপ কষ্টভোগ করিতে হইয়াছে, সরকার বোধ হয় তাহা ভুলিয়া গিয়াছেন। আমিই কষ্ট পাইয়াছি, তাঁহারা নহেন। বিনা কারণে তাঁহারা এতদিন ধরিয়া আমাকে আটক রাখিয়াছেন। আমাকে তবু বলা হইয়াছিল, যে অস্ত্র-শস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রভৃতি আমদানী সরকারী কর্ম্মচারী হত্যা প্রভৃতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আমি অপরাধী। ঐ সম্বন্ধে অনেকে আমার বক্তব্য জানাইতে বলিয়াছিলেন। আমি উত্তরে জানাইতেছি যে, আমি নির্দ্দোষ। আমার বিশ্বাস, পরলোকগত স্যার এডওয়ার্ড মার্শাল হল বা স্যার জন সাইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ইহা অপেক্ষা অধিক কিছু বলিতে পারিতেন না। দ্বিতীয়বার অভিযোগগুলি আমার নিকট উপস্থিত করা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, এত লোক থাকিতে পুলিস আমাকে ধরিল কেন? আমার মনে হয়, উহাই সন্তোষজনক উত্তর। আমার গ্রেফ্‌তারের পর হইতে বাঙ্‌লা সরকার আমার অধীন ব্যক্তিদিগকে প্রতিপালনের জন্য বা আমার গৃহাদি রক্ষার জন্য কোনরূপ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন নাই। ঐ বিষয়ে আমি বড়লাটের নিকট আবেদন করিলে বাঙ্‌লা সরকার সে আবেদন চাপিয়া রাখিয়াছিলেন। তারপর আবার আমাকে তিন বৎসর বিদেশে থাকিতে বলা হইতেছে। ইউরোপে নির্ব্বাসনের সময় আমার নিজের খরচ নিজেকে যোগাইতে হইবে। এ কিরূপ যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব, তাহা বুঝিতে পারি না। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে আমার যেরূপ স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমাকে অন্ততঃ সেইরূপ স্বাস্থ্যবান করিয়া সরকারের মুক্তি দান করা উচিত। কারাবাসের জন্য আমার স্বাস্থ্যহানি হইলে সরকার কি তাহার ক্ষতিপূরণ দিবেন না? ইউরোপে যতদিন হৃতস্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্ত না হই ততদিন আমার সকল খরচ সরকারের বহন করা উচিত। কতদিন সরকার এই সকল বিষয়ে অনবহিত থাকিবেন? সরকার যদি ইউরোপ যাইবার পূর্ব্বে আমাকে একবার বাড়ী যাইতে দিতেন, যদি ইউরোপে আমার সকল ব্যয়ভার বহন করিতেন ও রোগমুক্তির পর আমাকে বিনা বাধায় দেশে ফিরিতে দিতেন, তাহা হইলে এই দান সহৃদয়তার পরিচায়ক বলিয়া মনে করিতাম।”