বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/সাত
এই প্রথম সাক্ষাৎকার মোটেই ফলপ্রসূ হয় নাই। সুভাষচন্দ্র হতাশ হইয়া সে স্থান পরিত্যাগ করেন। এই সম্পর্কে তিনি লিখিয়াছিলেন, “আমার যুক্তি আমাকে বার বার বলিয়া দিতে লাগিল যে, মহাত্মা যে পরিকল্পনা স্থির করিয়াছেন তাহার মধ্যে সুস্পষ্টতার শোচনীয় অভাব রহিয়াছে। যে আন্দোলন বা সংগ্রাম আমাদিগকে আমাদের অভীপ্সিত উদ্দেশ্য স্বরাজলাভের দিকে লইয়া যাইবে সেই সংগ্রামের ক্রমবিকাশ বা বিভিন্ন স্তর সম্বন্ধে তাঁহার নিজেরই কোন স্পষ্ট ধারণা নাই।” যাহাই হউক, গান্ধীজীর পরামর্শে তিনি বাঙ্লার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহিত সাক্ষাৎ করেন। ভারতের রাজনৈতিক গগনে দেশবন্ধু তখন মধ্যাহ্ন ভাস্করের তেজে জাজ্বল্যমান—সংগ্রামশীল কর্ম্মপন্থার জন্য সারাদেশ তখন দেশবন্ধুর দিকে চাহিয়া আছে। দেশবন্ধুর অপূর্ব্ব ত্যাগ ও দুঃখবরণ তখন জাতির আদর্শ। দেশবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করিয়াই সুভাষচন্দ্র বুঝিলেন, তিনি উপযুক্ত নেতা ও গুরু লাভ করিয়াছেন। সুভাষচন্দ্র সেইদিনই তাঁহার রাজনৈতিক গুরুকে কৃতজ্ঞচিত্তে অভিনন্দিত করিয়া লইলেন ও “দেশবন্ধুর কাজে” আত্মনিয়োগ করিতে সঙ্কল্পবদ্ধ হইলেন। দেশবন্ধুর সহিত সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধ লেনিনের সহিত ষ্ট্যালিনের সম্বন্ধের সহিত তুলনীয়।
১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গভর্ণমেণ্টের উপাধি ও চাকুরী ত্যাগের হিড়িক পড়িয়া যায়। সেই সময় গভর্ণমেণ্ট-পরিচালিত স্কুল কলেজ ত্যাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই অবস্থায় দেশের শিক্ষাবিস্তারে যাহাতে কোনরূপ বিঘ্ন না ঘটিতে পারে তজ্জন্য কংগ্রেসের পরিচালনায় বিভিন্ন প্রদেশে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হইতে থাকে। ১৯২১ সালের মে মাসে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্রের হস্তে বাঙলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় “গৌড়ীয় সর্ব্ববিদ্যায়তনে”র পরিচালনাভার অর্পণ করেন। এই সময় দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রের উপর বাঙ্লার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রচার বিভাগের ভারও ন্যস্ত করেন। এই কার্য্যে সুভাষচন্দ্রকে অনেক বাধাবিঘ্ন ও অপ্রিয় সমালোচনার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল।
প্রচার বিভাগের কর্ত্তা হিসাবে গভর্ণমেণ্টের কংগ্রেসবিরোধী প্রচারকার্য্য ব্যর্থ করিতে তিনি যে দক্ষতা ও কর্ম্মশক্তির পরিচয় দিয়াছিলেন তাহা বিদেশী আমলাতন্ত্রকেও বিস্মিত করিয়াছে। বাঙ্লার কংগ্রেসী কার্য্যকলাপ ও কর্ম্মনীতি সম্বন্ধে তখন যে সমস্ত সমস্যা উঠিয়াছিল, সুভাষচন্দ্র কয়েকটি বিবৃতি প্রকাশ করিয়া তাহাদের যে সমাধান করেন তাহাতে বিরুদ্ধ সমালোচকগণও নীরব হইয়া যান। সুভাষচন্দ্রের বিবৃতিসমূহ পাঠ করিয়া সরকারী মুখপত্র ‘ভারতবন্ধু’ ষ্টেটস্ম্যান্ মন্তব্য করিয়াছিল— “অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু Indian Civil Service ত্যাগ করিয়াছেন। বৃটিশ আমলাতন্ত্র একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎবিশিষ্ট কর্ম্মচারী হারাইলেন এবং কংগ্রেস-আমলাতন্ত্র তাঁহাকে লাভ করিলেন।··· · ···ইস্তাহারপ্রচারবিদ্যায় শ্রীযুক্ত বসু সিমলাকেও হারাইয়াছেন।” এই সময় বাঙ্লাদেশে “স্বেচ্ছাসেবক আন্দোলন” আরম্ভ হয়, সুভাষচন্দ্র এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ভার গ্রহণ করেন, ইউনিভার্সিটি ট্রেণিং কোরে যোগদান করিয়া তিনি যে শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন তাহা এখন বিশেষ কাজে লাগে। সত্য-সংগঠনের কাজে তাঁহার বিশেষ প্রতিভার প্রমাণ, বাল্যকাল হইতেই পাওয়া যায়। ভবানীপুরে “দক্ষিণ কলিকাতা সেবক সমিতি” নামে একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ছিল। বাল্যকালে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্ম্মীরূপে সুভাষচন্দ্রের দেশসেবার কার্য্যে হাতেখড়ি হয়। প্রতি রবিবারে তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানের জন্য থ’লে কাঁধে করিয়া, বাড়ী বাড়ী মুষ্টি-ভিক্ষা আদায় করিতে যাইতেন। সেদিনের সেই সরল উদার সেবাব্রতী ভাবপ্রবণ বালকের সুকুমার চিত্তে সঙ্ঘ গড়িবার শক্তির যে ক্ষুদ্র বীজটি অঙ্কুরিত হইয়াছিল তাহাই কালক্রমে বিরাট মহীরুহে পরিণত হইয়া সমগ্র পৃথিবীতে বিস্ময়ের সঞ্চার করিয়াছে। জাতীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষপদে থাকিয়া সুভাষচন্দ্র শিক্ষার্থীদের মানসক্ষেত্রে স্বদেশপ্রেমের বীজ বপন করেন ও সকলের মনে স্বাধীনতা অর্জ্জনের অত্যুগ্র আকাঙ্ক্ষা জাগাইয়া তোলেন। ফলে, এই জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রগণ উত্তরকালে জাতীয় আন্দোলনে যোগদান করিয়া তাঁহাদের আত্মত্যাগ ও কর্ম্মকুশলতায় স্বাধীনতা সংগ্রামকে যথেষ্ট শক্তিশালী করেন।
জাতীয় কলেজের পরিচালনায় ও কংগ্রেস সংগঠনে নিযুক্ত এই শক্তিশালী যুবক শীঘ্রই গভর্ণমেণ্টের দুশ্চিন্তার কারণ হইয়া উঠিল। গভর্ণমেণ্ট শীঘ্রই বুঝিতে পারিল যে বেশীদিন ইঁহাকে স্বাধীনভাবে থাকিতে দেওয়া বিপজ্জনক। সুভাষচন্দ্রের কার্য্যকলাপ বন্ধ করিবার জন্য সরকার সুযোগের অপেক্ষায় রহিল। ১৯২১ সালে ১৭ই নভেম্বর যুবরাজের ভারতবর্ষে পদার্পণ করিবার কথা ছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস ও বর্ব্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত দেশবাসী যুবরাজের ভারত আগমন উপলক্ষে সর্ব্বপ্রকার সম্মানপ্রদর্শন ও উৎসবের আয়োজন বর্জ্জন করিতে কৃতসংকল্প হইল। সেইদিন ভারতের সর্ব্বত্র হরতাল ঘোষিত হয়। ১৯২১ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখে বাঙ্লাদেশে যে হরতাল প্রতিপালিত হয় সুভাষচন্দ্রের নিপুণ পরিচালনায় তা অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। ঐদিন কোলাহলমুখর জনবহুল কলিকাতা মহানগরী জনমানবহীন শ্মশানপুরীর ন্যায় প্রতীয়মান হয়। জনসাধারণ স্বেচ্ছায় এই হরতালে যোগদান করে। দেশের সর্ব্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থ কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকগণ বিশেষ ব্যবস্থা করে। ১৭ই নভেম্বরের শান্তিপূর্ণ হরতালের ব্যাপকতা ও সাফল্য দর্শনে সরকারের গাত্রদাহ উপস্থিত হয়। শাসকবর্গ ভারতবাসীর রাজভক্তির অভাব দেখিয়া ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠে। ভবিষ্যতে যাহাতে যুবরাজকে এইরূপ অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে না হয়, তজ্জন্য যুবরাজের কলিকাতা সফরের একমাস পূর্ব্বেই কংগ্রেস ও খিলাফৎ আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীগুলিকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। যুবরাজের কলিকাতা আসিবার কথা ছিল ২৫শে ডিসেম্বর। ১৯শে নভেম্বর তারিখে কলিকাতার পুলিশ কমিশনার কলিকাতা ও শহরতলিতে জনসভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিবার এক আদেশ জারী করেন। কংগ্রেস ও খিলাফৎ প্রতিষ্ঠান সমূহকে বে-আইনী ঘোষণা করিয়া যে আদেশ জারী করা হয় তাহার প্রতিবাদকল্পে কলিকাতার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ও কর্মিগণ এক বিবৃতি প্রচার করিয়া প্রাদেশিক ও জেলা কংগ্রেস কমিটির সভ্যগণকে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনীতে যোগদান করিতে নির্দ্দেশ দেন।
সরকারের দমননীতি নিরঙ্কুশভাবে চলিতে লাগিল। বাঙ্লায় কংগ্রেস ভলাণ্টিয়ার কোর বে-আইনী ঘোষিত; সরকারের উদ্দেশ্য ভলাণ্টিয়ার কোরের উচ্ছেদসাধন করিয়া কংগ্রেসকে ক্ষীণবল করা। দেশবন্ধু হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করিয়া জেলখানাগুলি ভর্ত্তি করিয়া ফেলিবার আয়োজন করিলেন। দিনের পর দিন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক কারাবরণ করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে কলিকাতা ও মফঃস্বলের সমস্ত জেলখানা ভর্ত্তি হইয়া গেল। এই ঘটনা বাঙ্লার যুবকদের দেশপ্রীতি ও আত্মত্যাগের এক সার্থক নিদর্শন। দেশবন্ধুর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। গভর্ণমেণ্ট স্থায়ী জেলখানায় স্থান সঙ্কুলান করিতে না পারিয়া খিদিরপুর ডকে সাময়িক জেলখানা স্থাপন করিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবক দল সংগ্রহ ও পরিচালনার কার্য্যে সুভাষচন্দ্র অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন।
১৯২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও সুভাষচন্দ্র প্রমুখ নেতৃবর্গ যুবরাজের কলিকাতা-আগমন-উৎসব বর্জন-আন্দোলন উপলক্ষে গ্রেফতার হন। তথাপি সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল না। কলিকাতা মহানগরী সাফল্যের সহিত হরতাল প্রতিপালন করিল। যেদিন যুবরাজ হাওড়া স্টেশনে আসিয়া পৌঁছেন, সেইদিন কলিকাতার দোকানপাট সমস্ত বন্ধ। বৃটিশসাম্রাজ্যের মহানগরী কলিকাতায় পদার্পণ করিয়া ইংলণ্ডের যবরাজ কৃষ্ণপতাকাদ্বারা অভ্যর্থিত হইলেন। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর তীব্র অসন্তোষ যুবরাজ নিজেই প্রত্যক্ষ করিলেন।
প্রায় তিনমাস হাজত বাসের পর দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করিয়া সুভাষচন্দ্রের এই প্রথম কারাদণ্ড ভোগ। বিচারকের দণ্ডাদেশ শ্রবণে সুভাষচন্দ্র সকৌতুকে বলিয়াছিলেন—“মাত্র ছয় মাস! আমি কি মুরগী চুরি করিয়াছি যে এত লঘু দণ্ড হইল? (Six months only! Have I robbed a fowl?)” জেলে অবস্থান কালে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। জেলখানায় সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর রন্ধনকার্য্যে নিযুক্ত থাকিতেন। তিনি দেশবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারীর কাজও করিতেন এবং সময়ে সমযে দেশবন্ধুর শিক্ষকতা করিবার সৌভাগ্যও তাঁহার ঘটিত। ৺পৃথ্বীশচন্দ্র রায়ের Life and Times of C. k. Dass নামক গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে কারাবাস কালে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্রের নিকট নীতিশাস্ত্র ও তত্ত্ববিদ্যা অধ্যয়ন করিতেন। এই সময় সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর অধিক প্রিয়পাত্র হইয়া উঠেন।