বিবিধ কাব্য (১৯৪০)/দুর্য্যোধনের মৃত্যু

দুর্য্যোধনের মৃত্যু

“দেখ, দেব, দেখ চেয়ে”, কাতরে কহিলা
কুরুরাজ কৃপাচার্য্যে,—“আসিছেন ধীরে
নিশীথিনী; নাহি তারা কবরী-বন্ধনে—
না শোভে ললাটদেশে চারু নিশামণি!
শিবির-বাহিরে মোরে লহ কৃপা করি,
মহারথ! রাখ লয়ে, যথায় ঝরিবে
এ ভূনত-শিরে এবে শিশিরের ধারা
ঝরে যথা শিশুশিরে অবিরল বহি
জননীর অশ্রুজল, কালগ্রাসে যাবে
সে শিশু।” লাইলা সবে ধরাধরি করি
শিবির-বাহিরে শূরে—ভগ্ন-ঊরু রণে!
মহাযত্নে কৃপাচার্য্য পাতিল ভূতলে
উত্তরী। বিষাদে হাসি কহিলা নৃমণি;—
“কার হেতু এ সুশয্যা, কৃপাচার্য্য রথি?
পড়িনু ভূতলে, প্রভু, মাতৃগর্ভ ত্যজি;—
সেই বাল্যাসন ভিন্ন কি আসন সাজে
অন্তিমে? উঠাও বস্ত্র, বসি হে ভূতলে।
কি শয্যায় সুপ্ত আজি কুরুবীর্য্যরূপী
গাঙ্গেয়? কোথায় গুরু দ্রোণাচার্য্য রথী,
কোথা অঙ্গপতি কর্ণ? আর রাজা যত
ক্ষত্র-ক্ষেত্র-পুষ্প, দেব! কি সাধে বসিবে
এ হেন শয্যায় হেথা দুর্য্যোধন আজি?
যথা বনমাঝে বহ্নি জ্বলি নিশাযোগে
আকর্ষি পতঙ্গচয়ে, ভস্মেন তা সবে
সর্ব্বভূক্—রাজদলে আহ্বানি এ রণে—

বিনাশি আমি, দেব! নিঃক্ষত্র করিনু
ক্ষত্রপূর্ণ কর্ম্মক্ষেত্র নিজ কর্ম্মদোষে।
কি কাজ আমার আর বৃথা সুখভোগে?
নির্ব্বাণ পাবক আমি, তেজশূন্য, বলি।
ভস্মমাত্র! এ যতন বৃথা কেন তব?”
সরায়ে উত্তরী শূর বসিলা ভূতলে।
নিকটে বসিলা কৃপ কৃতবর্ম্মা রথী
বিষাদে নীরব দোঁহে;—আসি নিশীথিনী,
মেঘরোপ ঘোমটায় বদন আবরি,
উচ্চ বায়ু-রূপ শ্বাসে সঘনে নিশ্বাসি;—
বৃষ্টি-ছলে অশ্রুবারি ফেলিলা ভূতলে।
কাতরে কহিলা চাহি কৃতবর্ম্মা পানে
রাজেন্দ্র; “এ হেন ক্ষেত্রে, ক্ষত্রচুড়ামণি,
ক্ষত্র-কুলোদ্ভব, কহ, কে আছে ভারতে,
যে না ইচ্ছে মরিবারে? যেখানে, যে কালে
আক্রমেন যমরাজ; সমপাড়া-দায়ী
দণ্ড তাঁর,— রাজপুরে, কি ক্ষুদ্র কুটীরে,
সম ভয়ঙ্কর প্রভু, সে ভীম মূরতি।
কিন্তু হেন স্থলে তাঁরে আতঙ্ক না করি
আমি!—এই সাধ ছিল চিরকাল মনে।
যে স্তম্ভের বলে, শির উঠায় আকাশে
উচ্চ রাজ-অট্টালিকা; সে স্তম্ভের রূপে
ক্ষত্রকুল-অট্টালিকা ধরিনু স্ববলে
ভূভারতে। ভূপতিত এবে কালে আমি;
দেখ চেয়ে চারি দিকে ভগ্ন শত ভাগে
সে সুঅট্টালিকা চুর্ণ এ মোর পতন!
গড়ায় এক্ষেত্রে পড়ি গৃহচুড়া কত!

আর যত অলঙ্কার—কার সাধ্য গণে?
কিন্তু চেয়ে দেখ সবে, কি আশ্চর্য্য! দেখ—
রকত বরণে দেখ, সহসা আকাশে
উদিছেন এ পৌরব বংশ-আদি যিনি,
নিশানাথ! দুর্য্যোধনে ভূশয্যায় হেরি
কুবরণ হইলা কি শোকে সুধানিধি?”
পাণ্ডব-শিবির পানে ক্ষণেক নিরাখি
উত্তরিলা কৃপাচার্য্য;—“হে কৌরবপতি,
নহে চন্দ্র যাহা, রাজা, দেখিছ আকাশে,
কিন্তু বৈজয়ন্তী তব সর্ব্বভূক্‌রূপে।
রিপুকুল-চিতা, দেব, জ্বলিয়া উঠিল।
কি বিষাদ আর তবে? মরিছে শিবিরে
অগ্নি-তাপে ছটফটি ভীম দুষ্টমতি;
পুড়িছে অর্জ্জুন, রায়, তার শরানলে,
পুড়িল যেমতি হেথা সৈন্যদল তব!
অন্তিমে পিতায় স্মরে যুধিষ্ঠির এবে;
নকুল ব্যাকুলচিত সহদেব সহ!
আর আর বীর যত এ কাল সমরে
পাইয়াছে রক্ষা যারা, দাবদগ্ধ বনে
আশে পাশে তরু যথা;—দেখ মহামতি।