বিবিধ প্রসঙ্গ/ইচ্ছার দাম্ভিকতা
ইচ্ছার দাম্ভিকতা।
এক জন কবি স্মৃতি সম্বন্ধে বলিতেছেন, যে, জীবনের প্রতি বিধাতার এ কি অভিশাপ যে, কাহারো প্রতি অনুরাগ, বা কোন একটা প্রবৃত্তি, ভুলিয়া যাওয়া যখন আমাদের আবশ্যক হয়,— মহত্তর, উন্নততর, প্রশান্ততর কর্তব্য আসিয়া যখন আদেশ করে ভুলিয়া যাও, তখন আমরা ভুলি না; কিন্তু প্রতি মুহূর্ত্ত প্রতিদিন সামান্য ঘটনার তুচছ ধূলিকণা সমূহ আনিয়া আমাদের স্মৃতি ঢাকিয়া দেয় ও অবশেষে আমরা ভূলি; ভূলিতেই হইবে বলিয়া ভুলি, ভূলিতে চাহিয়াছিলাম বলিয়া ভুলি না। —বাস্তবিক, এ কি দুঃখ! আমরা নিজের মনের উপর নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করিলাম, সে কোন কাজে লাগিল না, আর আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বহিস্থিত সামান্য কতকগুলা জড় ঘটনা সেই কাজ সিদ্ধ করিল! একটা কেন, এমন সহস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। একজন সর্ব্বতোভাবে ভাল বাসিবার যোগ্যপাত্র; জানি, তাহাকে ভাল বাসিলে সুখী হইব ও আমার সকল বিষয়ে মঙ্গল হইবে, প্রতি নিয়ত ইচ্ছা করিও তাহাকে ভাল বাসিতে পারিলাম না। আর এক জনকে ভাল বাসিলাম কেন? না, তাহার সঙ্গে কি লগ্নে, কি মহেন্দ্র ক্ষণে দেখা হইয়াছিল, তাহার কি একটি সামান্য কথার ভাব, কি একটি তুচছ ভাবের আধখানা মাএ দেখিয়াছিলাম, বলা নাই, কহা নাই, ব্যস্ত সমস্ত হইয়া একেবারে সমস্ত হৃদয়টা তাহার পায়ের তলায় ফেলিয়া দিলাম। কোন লেখক যখন কেবল মাত্র ইচ্ছাকে ভাব শিকার করিতে পাঠান, তখন ইচ্ছার পায়ের শব্দ পাইলেই ভাবেরা কে কোথায় পালাইয়া যায় তাহার ঠিকানা পা ওয়া যায় না, ও সমস্ত দিনের পর শ্রান্ত ইচ্ছা তাহার বড় বড় কামান বন্দুক ফেলিয়া কপালের ঘর্ম্মজল মুছিতে থাকে, অথচ কোথা-হইতে-কি একটা সামান্য বিষয় সহসা আসিয়া বিনা আয়াসে এক মুহূর্ত্তের মধ্যে শত সহস্র জীবন্ত ভাব আনিয়া উপস্থিত করে ও ইচ্ছার পশ্চাতে করতালি দিতে থাকে। কবিদের জিজ্ঞাসা কর, তাহাদের কত বড় বড় ভাব দৈবাৎ কথার মিল করিতে গিয়া মনে পড়িয়াছে, ইচ্ছা করলে মনে পড়িত না। মানুষের আনেক বড় বড় আবিক্রিয়ার মূল অনুসন্ধান করিতে যাও দেখিবে,—একট। সামান্য একরত্তি ব্যাপার।
দেখা যাইতেছে, আমাদের ইচ্ছা বলিয়া একটা বিষম দাম্ভিক ব্যক্তিকে আমাদের মন গাঁয়ে প্রতি অল্প লোকেই মানিয়া থাকে, অথচ সে একজন আপনি-মোড়ল। ছোট ছোট কতকগুলি সামান্য বিষয়ের উপর তাঁহার আধিপত্য, অথচ সকলকেই তিনি আদেশ করিয়া বেড়ান। একটা কাজ সমাধা হইলে তিনি জাঁক করিয়া বেড়ান এ কাজে কল আমি টিপিয়া দিয়াছিলাম। অথচ কত ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম বিষয় তাঁহার নিজের কল টিপিয়া দিয়াছে তাহার খবর রাখেন না। তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখে, তিনি দেখিতেছেন, দুশ্চেদ্য লোহের লাগাম দিয়া সমস্ত কাজকে তিনি চালাইয়া বেড়াইতেছেন, পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখেন না, তাঁহাকে কে মাকড়্সার জালের চেয়ে সুক্ষ্মতর তুচ্ছতর হস্র সূত্রে বাঁধিয়া নিয়মিত করিতেছে! মনে করিতে কষ্ট হয় কত অল্প বিষয়ই আমাদের ইচ্ছার অধীন ও কত সহস্র ক্ষুদ্র বিষয়ের অধীন আমাদের ইচ্ছা।