বিবিধ প্রসঙ্গ/গরীব হইবার সামর্থ্য
গরীব হইবার সামর্থ্য।
অনেকের গরীব-মানুসী করিবার সামর্থ্য নাই। এত তাহাদের টাকা নাই যে, গরীব-মানুষী করিয়া উঠিতে পারে। আমার মনের এক সাধ আছে। যে, এত বড় মানুষ হইতে পারি যে, অসঙ্কোচে গরীব-মানুষী করিয়া লইতে পারি। এখনো এত গরীব মানুষ আছি যে, গিল্টি-করা বোতাম পরিতে হয়, কবে এত টাকা হইবে যে, সত্যকার পিতলের বোতাম পরিতে সাহস হইবে! এখনো আমার রূপার এত অভাব যে অন্যের সমুখে রূপার থালায় ভাত না খাইলে লজ্জায় মরিয়া যাইতে হয়। এখনো, আমার স্ত্রী কোথাও নিমন্ত্রণ খাইতে গেলে তাহার গায়ে আমার জমিদারীর অর্দ্ধেক আয় বাঁধিয়া দিতে হয়! আমার বিশ্বাস ছিল রাজশ্রী ক বাহাদুর খূব বড়মানুষ লোক। সে দিন তাঁহার বাড়িতে গিয়ছিলাম দেখিলাম, তিনি নিজে গদীর উপরে বসেন ও অভ্যগতদিগকে নীচে বসান, তখন জানিতে পারিলাম যে তাহার গরীব-মানুষী করিবার মত সম্পত্তি নাই। এখন আমাকে যেই বলে যে, ক রায়বাহাদুর মস্ত বড় মানুষ লোক, আমি তাহাকেই বলি, “সে কেমন করিয়া হইবে? তাহা হইলে তিনি গদীর উপর বসেন কেন?” উপার্জ্জন করিতে করিতে বুড়া হইয়া গেলাম, অনেক টাকা করিয়াছি, কিন্তু এখনো এত বড় মানুষ হইতে পারিলাম না যে, আমি যে বড় মানুষ এ কথা একেবারে ভুলিয়া যাইতে পারিলাম। সর্ব্বদাই মনে হয়, আমি বড় মানুষ। কাজেই আংটি পরতে হয়, কেহ যদি আমাকে রাজাবাহাদুর না বলিয়া বাবু বলে, তবেই চোক রাঙাইয়া উঠতে হয়। যে ব্যক্তি অতি সহজে খাবার হজম করিয়া ফেলিতে পারে, যাহার জীর্ণ খাদ্য অতি নিঃশব্দে নিরুপদ্রবে শরীরের রক্ত নির্ম্মাণ করে, সে ব্যক্তির চব্বিশ ঘণ্টা, আহার করিয়াছি বলিয়া একটা চেতনা থাকে না। কিন্তু যে হজম করিতে পারে না, যাহার পেট ভার হইয়া থাকে পেট কামড়াইতে থাকে, সে প্রতি মুহূর্ত্তে জানিতে পারে যে, হাঁ আহার করিয়াছি বটে। অনেকের টাকা আছে বটে, কিন্তু নিঃশব্দে টাকা হজম করিতে পারে না; পরিপাক শক্তি নাই, ইহাদের কি আর বড় মানুষ বলে! ইহাদের বড়মানুষী করিবার প্রতিভা নাই। ইহারা ঘরে ছবি টাঙ্গায় পরকে দেখাইবার জন্য, শিল্প-সৌন্দর্য্য উপভোগ করিবার ক্ষমতা নাই, এই জন্য ঘরটাকে একেবারে ছবির দোকান করিয়া তুলে। ইহারা গণ্ডা গণ্ডা গাহিয়ে বাজিয়ে নিযুক্ত রাখে, পাড়া প্রতিবেশীদের কানে তালা লাগাইয়া দেয়, অথচ যথার্থ গান বাজনা উপভোগ করিবার ক্ষমতা নাই। এই সকল চিনির বলদ্দিগকে প্রকৃতি গরীব মনুষ্য করিয়া গড়িয়াছেন। কেবল কতকগুলা জমিদারী ও টাকার থলিতে বেচারাদিগকে বড়-মানুষ করিবে কি করিয়া?