বিবিধ প্রসঙ্গ/জগৎ-পীড়া
জগৎ-পীড়া।
জগৎ একটি প্রকাণ্ড পীড়া। অস্বাস্থ্যকে পরাভূত করিবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রাণপণ চেষ্টাকে বলে পীড়া। জগতও তাহাই। জগতও অস্বাস্থ্যকে অতিক্রম করিয়া উঠিবার জন্য স্বাস্থ্যের উদ্যম। অভাবকে দূর করিবার জন্য পূর্ণতাকাঙক্ষার উদ্যোগ। সুখ পাইবার জন্য অসুখের যোঝাযুঝি। জীবন পাইবার জন্য মৃত্যুর প্রযত্ন। অভিব্যক্তি-বাদ (Evolution Theory) আর কি বলে? জগতের নিকৃষ্টতম প্রাণ ক্রমশঃ মানুষে আসিয়া পরিণত হয়। জগতের নিকৃষ্টতম প্রাণীর মধ্যে উৎকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হইবার চেষ্টা কার্য্য করিতেছে। অভিব্যক্তি-বাদকে প্রাণীজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিলে চলিবে কেন? অভিব্যক্তি-বাদ আমাদিগকে কি শিক্ষা দিতেছে? না, কিছুই আকাশ হইতে পড়িয়া হয় না, প্রকৃতিতে কিছুরই হঠাৎ মাঝখানে আরম্ভ নাই। তাহা যদি হয়, তাহা হইলে নিতে হয় যে, তামরা যাহাকে প্রাণ বলি তাহারো হঠাৎ আরম্ভ নাই। আমরা যাহাকে জড় বলি, তাহা হইতেই সে অভিব্যক্ত হইয়াছে। এ কথা যদি না মান, তবে “ঈশ্বর বলিলেন, পৃথিবী হউক্, অমনি পৃথিবী হইল” এ কথা মানিতেও আপত্তি করা উচিত নহে। অতএব দেখা যাইতেছে, প্রত্যেক জড় পরমাণু প্রাণ হইয়া উঠিতে চেষ্টা করিতেছে; প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম প্রাণ পূর্ণতর জীব হইতে চেষ্টা করিতেছে; প্রত্যেক পূর্ণতর জীব, (যেমন মনুষ্য) অপূর্ণতার হাত এড়াইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্ট। করিতেছে। বিশাল জগতের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে অভিব্যক্তির চেষ্টা অনবরত কার্য্য করিতেছে।
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, রোগের অর্থ অস্বাস্থ্য, কিন্তু সেই অস্বাস্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যের ভাব কার্য্য করিতেছে। জগতের প্রত্যেক পরমাণু পীড়া, কিন্তু সেই প্রত্যেকে পরমাণুর মধ্যে স্বাস্থ্যের নিয়ম সঞ্চারিত হইতেছে। এই নিয়ম বর্ত্তমান না থাকিলে জীবন থাকিতে পারে না। অতএব এই জগতের যে চেতনা, তাহা পীড়ার চেতনা। আমাদের যে অঙ্গে পীড়া হয়, সেই অঙ্গ যেমন একটি বিশেষ চেতনা অনুভব করে, তেমনি জগতের যে চেতনা, তাহা পীড়ার চেতনা। তাহার প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, প্রত্যেক পরমাণু অনবরত অভাব-বোধ অনুভব করিতেছে। আমরা যে পীড়ার বেদনা অনুভব করি, তাহা আসলে খারাপ নহে, তাহার অর্থই এই, যে, এখনো আমাদের স্বাস্থ্য আছে, এখনো সে নিরুদ্যম হইয়া পড়ে নাই। সেইরূপ সমস্ত জগতের যে একটি বেদনা বোধ হইতেছে, তাহার প্রত্যেক পরমাণুতে যে অভাব অনুভূত হইতেছে, তাহার অর্থই এই যে, অভিব্যক্ত হইবার ক্ষমতা তাহার সর্ব্ব শরীরে কাজ করিতেছে। সুস্থ হইবার শক্তি জয়ী হইবার চেষ্টা করিতেছে। আপনাকে ধ্বংশ করিবার উদ্যোগই পীড়ার জীবন। সেই আত্মহত্যা পরায়ণতাই পীড়া। জগতও সেইরূপ। জগৎ, জগৎ হইতে চায় না। তাহার উন্নতির শেষ সীমা আত্মহত্যা। তাহার চেষ্টারও শেষ লক্ষ্য তাহাই। জগৎ সম্পূর্ণ হইতে চায়, আর এক কথায় জগৎ আরোগ্য হইতে চায়, অর্থাৎ জগৎ,জগৎ হইয়া থাকিতে চায় না। এই নিমিত্ত সমস্ত জগতের মধ্যে এবং জগতের ক্ষুদ্রতম পরমাণুর মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করিতেছে, সমস্ত জগৎ নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট নয়, এবং জগতের একটি পরমাণুও নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট নয়। এই অসন্তোষই বিশাল জগতের প্রাণ। বিজ্ঞান শাস্ত্র কাহাকে বলে? না, যে শাস্ত্র, জগৎরূপ একটি মহাপীড়ার সমস্ত লক্ষণ, সমস্ত নিয়ম আবিষ্কার করিতে চেষ্টা করিতেছে। মনুষ্য দেহের একটি পীড়ার সমস্ত তথ্য জানিতে পারি না, আমরা জগৎ পীড়ার সমস্ত লক্ষণ জানিতে চাই। আমাদের কি আশা! আমাদের নিজ দেহের একটি পীড়াকে আমরা যদি সর্ব্বতোভাবে জানিতে পারি, তাহা হইলে আমরা সমস্ত জগৎ পীড়ার নিয়ম অবগত হইতে পারি। কারণ, এই নিয়ম সমস্ত জগৎ-সমষ্টিতে ও জগতের প্রত্যেক পরমাণুতে কার্য্য করিতেছে! এই নিমিত্তই কবি টেনিস্ন্ কহিয়াছেন—Flower in the crannied wall,
I pluck you out of the crannies;—
Hold you here, root and all, in my hand
Little flower—but if I could understand,
What you are, r0ot and all, and all in all,
I should know what God and man is.
ইহার অর্থ এই যে, জগৎকে জানাও যা, একটি তৃণকে জানাও তাই, জগতের প্রত্যেক পরমাণুই এক একটি জগৎ।