বিবিধ প্রসঙ্গ/বধিরতার সুখ
বধিরতার সুখ।
অদ্বিতীয় রমণী ও অসাধারণ পুরুষ জর্জ্ এলিয়ট্ তাঁহার একটি উপন্যাসে লিখিয়াছেন যে, আমরা জীবনে অনেক ছোট ছোট দুঃখ ঘটনা দেখিতে পাই, কিন্তু তাহা এত সাধারণ ও সামান্য কারণজাত যে, তাহাতে আর আমাদের করুণা উদ্রেক করিতে পারে না, তাহা যদি পারিত, তবে জীবন কি কষ্টেরই হইত। যদি আমরা কাঠ-বিড়ালীর হৃদয়-স্পন্দন শুনিতে পাইতাম, যখন একটি ঘাস মৃত্তিকা ভেদ করিয়া গজাইতেছে, তখন তাহার শব্দ টুকুও শুনিতে পাই- তাম, তবে আমাদের কানের পক্ষে কি দুর্দ্দশাই হইত। আমরা যেমন দিগন্ত পর্যন্ত সমুদ্রে প্রসারিত দেখিতে পাই, কিন্তু সমুদ্রের সীমা সেই খানেই নয়, তাহা অতিক্রম করিয়াও সমুদ্র আছে; তেমনি আমরা যাহাকে স্তব্ধতার দিগন্ত বলি, তাহার পরপারেও শব্দের সমুদ্র আছে, তাহা আমাদের শ্রবণের অতীত। পিপীলিকা যখন চলে, তখন তাহারো পদশব্দ হয়, ফুল হইতে শিশির যখন পড়ে, তখন সেও নীরব অশ্রু জল নহে, সেও বিলাপ করিয়া ঝরিয়া পড়ে।
জর্জ্ এলিয়ট অন্যের সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, আমরা নিজের সম্বন্ধেও তাহাই প্রয়োগ করিয়া দেখিব। মনে কর, আমাদের নিজের হৃদয়ের মধ্যে যাহা চলে তাহা সমস্তই আমরা যদি দেখিতে পাইতাম, শুনিতে পাইতাম তাহা হইলে আমাদের কি দুর্দ্দশাই হইত! জর্জ্ এলিয়ট্ দৃষ্টান্ত স্বরূপে কাঠবিড়ালীর হৃদয় স্পন্দন ও তৃণ-উদ্ভেদের শব্দ উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু আমরা যদি নিজের দেহের ক্ষীণতম হৃদয় স্পন্দন, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস পতন, রক্ত চলাচলের শব্দ, নখ ও কেশ বৃদ্ধি, এবং বয়োবৃদ্ধি সহকারে দেহায়তন বৃদ্ধির শব্দটুকুও অনবরত শুনিতে পাইতাম, তবে আমাদের কি দশাই হইত। যখন আমরা প্রাণ খুলিয়া হাসিতেছি, তখনো আমাদের হৃদয়ের মর্ম্ম স্থলে অতি প্রছন্ন ভাবে বসিয়া যে একটি বিষাদ, একটি অভাব নিঃশ্বাস ফেলিতেছে, তাহা যদি শুনিতে পাইতাম, তবে কি আর হাসি বাহির হইত? যখন আমরা দান করিতেছি, ও সেই সঙ্গে “নিস্বার্থ পরেপকার করিতেছি” মনে করিয়া মনে মনে অতুল আনন্দ উপভোগ করিতেছি, তখন যদি আমরা আমাদের সেই পরোপচিকীর্ষার অতি প্রচ্ছন্ন অন্তর্দেশে যশোলিপ্সা বা আর একটা কোন ক্ষুদ্র স্বার্থপরতার বক্রমূর্ত্তি দেখিতে পাই, তবে কি আর আমরা সেরূপ বিমলানন্দ উপভোগ করিতে পারি? আার আর এক দিকে দেখ। যেমন, এমন শব্দ আছে, যাহা আমাদের কাছে নিস্তব্ধতা, তেমনি এমন স্মৃতি আছে, যাহা আমাদের কাছে বিস্মৃতি। আমরা যাহা একবার দেখিয়াছি, যাহা একবার শুনিয়াছি, তাহা আমাদের হৃদয়ে চিরকালের মত চিহ্ন দিয়া গিয়াছে। কোনটা বা স্পষ্ট, কোনটা বা অস্পষ্ট, কোনটা বা এত অস্পষ্ট যে, আমাদের দর্শন শ্রবনের অতীত। কিন্তু আছে। আমাদের স্মৃতিতে যত জিনিস, আছে,তাহা ভাবিয়া দেখিলে অবাক্ হইয়া যাইতে হয়। আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া যে শত সহস্র অচেনা লোককে চলিয়া যাইতে দেখিলাম, তাহারা প্রত্যেকেই আমাদের মনের মধ্যে রহিয়া গেল। উপরি উপরি যদি অনেক বার তাহাদের দেখিতাম, তবে তাহারা আমাদের স্মৃতিতে স্পষ্টতর ছাপ নিতে পারিত এই মাত্র। এই রূপে বাল্যকাল হইতে যাহা কিছু দেখিয়াছি, যাহা কিছু শুনিয়াছি, যাহা কিছু পড়িয়াছি, সমস্তই আমার হৃদয়ে আছে, তিলার্দ্ধও এড়াইতে পারে নাই। ছেলে বেলা হইতে কত গ্রন্থের কত হাজার হাজার পাত পড়িয়াছি, যদিও তাহা আওড়াইতে পারি না, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের মুদ্রাকর তাহার প্রত্যেক অক্ষর আমার স্মৃতির পটে মুদ্রিত করিয়া রাখিয়াছে। ইহা মনে করিলে একেবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িতে হয়। যদি আমরা আমাদের এই অতি বিশাল স্মৃতির স্পষ্ট ও অস্পষ্ট সমস্ত কণ্ঠস্বর একেবারেই শুনিতে পাইতাম, কিছুতেই নিবারণ করিতে পারিতাম না, তাহা হইলে আমরা কি একেবারে পাগল হইয়া যাইতাম না? ভাগ্যে আমাদের স্মৃতি তাহার সহস্র মুখে একেবারে কথা কহিতে আরম্ভ করে না, তাহার সহস্র চিত্র একেবারে উদঘাটন করিয়া দেয় না, তাই আমরা বাঁচিয়া আছি। আমরা আমাদের হৃদয়ের সমস্ত কার্য্য দেখিতে পাই না বলিয়াই রক্ষা। আমাদের হৃদয়-রাজ্যের অনেক বিস্তৃত প্রদেশ আমাদের নিজের কাছেই যদি অনাবিষ্কৃত না থাকিত; কখন্ আমাদের অনুরাগের প্রথম সূত্রপাত হইল, কখন্ আমদের অনুরাগের প্রথম অবসানের দিকে গতি হইল, কখন্ আমাদের বিরাগের প্রথম আরম্ভ হইল, কখন্ আমাদের বিষাদের প্রথম অঙ্কুর উঠিল, তাহা সমস্ত যদি আমরা স্পষ্ট দেখিতাম তাহা হইলে আমারে মায়া মোহ অনেকটা ছুটিয়া যাইত বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সুখ শান্তিও অবসান হইত।