বিবিধ প্রসঙ্গ/বসন্ত ও বর্ষা

বসন্ত ও বর্ষা।

 এক বিরহিনী আমাদের জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইয়াছেন, বিরহের পক্ষে বসন্ত গুরুতর কি বর্ষা গুরুতর? এ বিষয়ে তিনি অবশ্য আমাদের অপেক্ষা ঢের ভাল বুঝেন। তবে উভয় ঋতুর অবস্থা আলোচনা করিয়া যুক্তির সাহায্যে আমরা একটা সিদ্ধান্ত খাড়া করিয়া লইয়াছি। মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলিয়াছেন। মেঘকে দূত করিবেন বলিয়াই যে এমন কাজ করিয়াছেন, তাহা বোধ হয় না। বসন্ত কালেও দূতের অভাব নাই। বাতাসকেও দূত করিতে পারিতেন। একটা বিশেষ কারণ থাকাই সম্ভব।

 বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী। বসন্ত আমাদের মনকে চারদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষা তাহাকে এক স্থানে ঘনীভূত করিয়া রাখে। বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে; আমাদের মন বাতাসের মত, ফুলের গন্ধের মত, জ্যোৎস্নার মত লঘু হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তে বহির্জগত গৃহ-দ্বার উদ্ঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়। বর্ষায় আমাদের মনের চারিদিকে বৃষ্টিজলের যবনিকা টানিয়া দেয়, মাথার উপরে মেঘের চাঁদোয়া খাটাইয়া দেয়। মন চারিদিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই যবনিকার মধ্যে এই চাঁদোয়ার তলে একত্র হয়। পাখীর গানে আমাদের মন উড়াইয়া লইয়া যায়, কিন্তু বর্ষার বজ্র-সঙ্গীতে আমাদের মনকে মনের মধ্যে স্তম্ভিত করিয়া রাখে। পাখীর গানের মত এ গান লঘু, তরঙ্গময়, বৈচিত্র্যময় নহে, ইহাতে স্তব্ধ করিয়া দেয়, উচ্ছসিত করিয়া তুলে না। অতএব দেখা যাইতেছে বর্ষাকালে আমাদের “আমি” গাঢ়তর হয়, আর বসন্তকালে সে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।

 এখন দেখা যাক, বসন্ত কালের বিরহ ও বর্ষাকালের বিরহে প্রভেদ কি। বসন্তকালে আমরা বহির্জগৎ উপভোগ করি; উপভোগের সমস্ত উপাদান আছে, কেবল একটি পাইতেছি না; উপভোগের একটা মহা অসম্পূর্ণতা দেখিতেছি। সেই জন্যই আর কিছুই ভাল লাগিতেছে না। এত দিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল, আমার প্রিয়তম ছিল না; আমার আর কোন সুখের উপকরণও ছিল না। কিন্তু জ্যোৎস্না, বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া তুলিল; সে জাগিয়া দেখিল, তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই বসন্তের বিরহ। দুর্ভিক্ষের সময় শিশু মরিয়া গেলেও মায়ের মন অনেকটা শান্তি পায়, কিন্তু সে বাঁচিয়া থাকিয়া ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদিতে থাকিলে তাঁহার কি কষ্ট!

 বর্ষাকালে বিরহিণীর সমস্ত “আমি” একত্র হয়, সমস্ত “আমি”: জাগিয়া উঠে, দেখে যে বিচ্ছিন্ন “আমি” একক “আমি” অসম্পূর্ণ। সে কাঁদিতে থাকে। সে তাহার নিজের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিবার জন্য কাহাকেও খুঁজিয়া পায় না। চারিদিকে বৃষ্টি পড়িতেছে, অন্ধকার করিয়াছে; কাহাকেও পাইবার নাই, কিছুই দেখিবার নাই; কেবল বসিয়া বসিয়া অন্তর্দেশের অন্ধকারবাসী একটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গীহীন “আমি”-র পানে চাহিয়া চাহিয়া কাঁদিতে থাকে। ইহাই বর্ষাকালের বিরহ। বসন্তকালে বিরহিনীর জগৎ অসম্পূর্ণ, বর্ষাকালে বিরহিনীর “স্বয়ং” অসম্পূর্ণ। বর্ষাকালে আমি আত্মা চাই,বসন্তকালে আমি সুখ চাই। সুতরাং, বর্ষাকালের বিরহ গুরুতর। এ বিরহে যৌবন মদন প্রভৃতি কিছু নাই, ইহা বস্তুগত নহে। মদনের শর বসন্তের ফুল দিয়া গঠিত, বর্ষার বৃষ্টিধারা দিয়া নহে। বসন্তকালে আমরা নিজের উপর সমস্ত জগৎ স্থাপিত করিতে চাহি, বর্ষাকালে সমস্ত জগতের মধ্যে সম্পূর্ণ আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি। ঋতুসংহারে কালিদাসের কাঁচা হাত বলিয়া বোধ হয়, তথাপি তিনি এই কাব্যে বর্ষা ও বসন্তের যে প্রভেদ দেখাইয়াছেন, তাহাতে তাঁহাকে কালিদাস বলিয়া চিনা যায়। বসন্তের উপসংহারে তিনি বলেন,—

মলয়পবনবিদ্ধঃ কোকিলেনাভিরম্যাে
সুরভিমধুনিষেকাল্লব্ধগন্ধপ্রবন্ধঃ।

বিবিধ মধুপষূথৈর্বেষ্ট্যমানঃ সমন্তাদ্
ভবতু তব বসন্তঃ শ্রেষ্ঠ কালঃ সুখায়॥

 কবি আশীর্বাদ করিতেছেন, বাহ্য-সৌন্দর্য্য বিশিষ্ট বসন্তকাল তোমাকে সুখ প্রদান করুক। বর্ষায় কবি আশীর্ব্বাদ করিতেছেন—

“বহু গুণরমণীয়ো যোষিতাং চিত্তহারী,
তরু বিটপলতানাং বান্ধবো নির্ব্বিকারঃ,
জলদনময় এষ প্রাণিনাৎ প্রাণ হেতুর্
দিশতু তব হিতানি প্রায়সো বাঞ্ছিতানি।”

 বর্ষাকালে তোমাকে তোমার বাঞ্ছিত হিত অর্পণ করুক। বর্ষাকাল ত সুখের জন্য নহে, ইহা মঙ্গলের জন্য। বর্ষাকালে উপভোগের বাসনা হয় না, “স্বয়ং”-এর মধ্যে একটা অভাব অনুভব হয়, একটা অনির্দ্দেশ্য বাঞ্ছা জন্মে।