বিবিধ সমালোচন।

উত্তরচরিত।


 ভবভূতি প্রসিদ্ধ কবি, এবং তাহার প্রণীত উত্তরচরিত উৎকৃষ্ট নাটক, ইহা অনেকেই শ্রুত আছেন; কিন্তু অল্প লোকেই তাঁহার প্রতি ভক্তি প্রকাশ করেন। শকুন্তলার কথা দূরে থাকুক, অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট নাটক রত্নাবলীর প্রতি এতদ্দেশীয় লোকের যেরূপ অনুরাগ, উত্তরচরিতের প্রতি তাদৃশ নহে। অন্যের কথা দূরে থাকুক, পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়, ভবভূতি সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে, “কবিত্বশক্তি অনুসারে গণনা করিতে হইলে, কালিদাস, মাঘ, ভারবি, শ্রীহর্ষ ও বাণভট্টের পর তদীয় নামনির্দ্দেশ বোধ হয়, অসঙ্গত হয় না।”

 বাস্তবিক, যত কবি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন, ভবভূতি তাহাব মধ্যে একজন প্রধান। বিদ্যাসাগর মহাশয় যে সকল কবিদিগের নাম করিয়াছেন, তন্মধ্যে শকুন্তলার প্রণেতা ভিন্ন কেহই ভবভূতির সমকক্ষ হইতে পারেন না। পৃথিবীর নটিক প্রণেতৃগণ মধ্যে যে শ্রেণীতে সেক্ষপীয়র, এস্কিলস, সফোক্লস্, কাল্‌দেরণ, এবং কালিদাস, ভবভূতি সে শ্রেণীভুক্ত নহেন বটে কিন্তু তাঁহাদের নিকটবর্ত্তী।

 উত্তরচরিতের উপাখ্যান ভাগ রামায়ণ হইতে গৃহীত। ইহাতে রামকর্ত্তৃক সীতার প্রত্যাখ্যান ও সৎসঙ্গে পুনর্ম্মিলন বর্ণিত হইয়াছে। স্থূল বৃত্তান্ত রামায়ণ হইতে গৃহীত বটে, কিন্তু উপাখ্যান বর্ণন কার্য্যাদি সকল ভবভূতির স্বকপোলকল্পিত। রামায়ণে যেরূপ বাল্মীকির আশ্রমে সীতার বাস, এবং যেরূপ ঘটনায় পুনর্ম্মিলন, এবং মিলনান্তেই সীতার ভূতলপ্রবেশ ইত্যাদি বর্ণিত হইয়াছে, উত্তরচরিতে সে সকল সেরূপ বর্ণিত হয় নাই। উত্তরচরিতে সীতার রসাতলবাস, লবের যুদ্ধ এবং তদন্তে সীতার সহিত রামের পুনর্ম্মিলন ইত্যাদি বর্ণিত হইয়াছে। এইরূপ ভিন্ন পন্থায় গমন করিয়া, ভবভূতি রসজ্ঞতার এবং আত্মশক্তিজ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন। কেন না যাহা একবার বাল্মীকিকর্ত্তৃক বর্ণিত হইয়াছে, পৃথিবীর কোন কবি তাহা পুনর্ব্বর্ণন করিয়া প্রশংসাভাজন হইতে পারেন? ভবভূতি অথবা ভারতবর্ষীর অন্য কোন কবি ঈদৃশ শক্তিমান্ নহেন যে, তদপেক্ষা সরসতা বিধান করিতে পারিতেন। যেমন ভবভূতি এই উত্তরচরিতের উপাখ্যান অন্য কবির গ্রন্থ হইতে গ্রহণ করিয়াছেন, তেমনি সেক্ষপীয়র তাঁহার রচিত প্রায় সকল নাটকেরই উপাখ্যান ভাগ অন্য গ্রন্থকারের গ্রন্থ হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ভবভূতির ন্যায় পূর্ব্ব কবিগণ হইতে ভিন্ন পথে গমন করেন নাই। ইহারও বিশেষ কারণ আছে। সেক্ষপীয়র অদ্বিতীয় কবি। তিনি স্বীয় শক্তির পরিমাণ বিলক্ষণ বুঝিতেন —কোন মহাত্মা না বুঝেন? তিনি জানিতেন যে, যে সকল গ্রন্থকারদিগের গ্রন্থ হইতে তিনি আপন নাটকের উপাখ্যান ভাগ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা কেবল তাঁহার সঙ্গে কবিত্বশক্তিতে সমকক্ষ নহেন। তিনি যে আাকাশে আপন কবিত্বের প্রোজ্জ্বল কিরণমালা বিস্তার করিবেন, সেখানে পূর্ব্বগামী নক্ষত্রগণের কিরণ লোপ পাইবে। এজন্য ইচ্ছাপূর্ব্বকই পূর্ব্বলেখকদিগের অনুবর্ত্তী হইয়াছিলেন। তথাপি ইহাও বক্তব্য, যে কেবল একখানি নাটকের উপাখ্যান ভাগ তিনি হোমর হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন, এবং সেই ত্রৈলস্ ও ক্রেসিদা নাটক প্রণয়ন কালে, ভবভূতি যেরূপ রামায়ণ হইতে ভিন্ন পথে গমন করিয়াছেন, তিনিও তেমনি ইলিয়দ হইতে ভিন্ন পথে গিয়াছেন।

 ভবভূতিও সেক্ষপীয়রের ন্যায় আপন ক্ষমতার পরিমাণ জানিতেন। তিনি আপনাকে, সীতানির্ব্বাসন বৃত্তাত্ত অবলম্বন করিয়া, একখানি অত্যুৎকৃষ্ট নাটক প্রণয়নে সমর্থ বলিয়া, বিলক্ষণ জানিতেন। তিনি ইহাও বুঝিতেন যে, কবিগুরু বাল্মীকির সহিত কদাচ তুলনাকাঙ্ক্ষী হইতে পারেন না। অতএব তিনি কবিগুরু বাল্মীকিকে প্রণাম[১] করিয়া তাঁহা হইতে দূরে অবস্থিতি করিয়াছেন। ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে, অস্মদ্দেশীয় নাটকে মৃত্যুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ[২] বলিয়া, ভবভূতি স্বীয় নাটকে সীতার পৃথিবী প্রবেশ বা তদ্বৎ শোকাবহ ব্যাপার বিন্যস্ত করিতে পারেন নাই।

 উত্তরচরিতের চিত্রদর্শন নামে প্রথমাঙ্ক বঙ্গীয় পাঠক সমীপে বিলক্ষণ পরিচিত; কেন না শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এই অঙ্ক অবলম্বন করিয়া, স্বপ্রণীত সীতার বনবাসের প্রথম অধ্যায় লিখিয়াছেন। এই চিত্রদর্শন কবিসুলভকৌশলময়। ইহাতে চিত্রদর্শনোপলক্ষে রামসীতার পূর্ব্ববৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। ইহার উদ্দেশ্য এমত নহে যে কবি সংক্ষেপে পূর্ব্বঘটনা সকল বর্ণন করেন। রামসীতার অলৌকিক, অসীম, প্রগাঢ় প্রণয় বর্ণন করাই ইহার উদ্দেশ্য। এই প্রণয়ের স্বরূপ অনুভব করিতে না পারিলে, সীতানির্ব্বাসন যে কি ভয়ানক ব্যাপার তাহা হৃদয়ঙ্গম হয় না। সীতার নির্ব্বাসন সামান্য স্ত্রী বিয়োগ নহে। স্ত্রীবিসর্জ্জন মাত্রই ক্লেশকর—মর্ম্মভেদী। যে কেহ আপন স্ত্রীকে বিসর্জ্জন করে, তাহারই হৃদয়োদ্ভেদ হয়। যে বাল্যকালের ক্রীড়ার সঙ্গিনী, কৈশোরে জীবন সুখের প্রথম শিক্ষাদাত্রী, যৌবনে যে সংসার সৌন্দর্য্যের প্রতিমা, বার্দ্ধক্যে যে জীবনাবলম্বন—ভাল বাসুক বা না বাসুক, কে সে স্ত্রীকে ত্যাগ করিতে পারে? গৃহে যে দাসী, শয়নে যে অপ্সরা, বিপদে যে বন্ধু, রোগে যে বৈদ্য, কার্য্যে যে মন্ত্রী, ক্রীড়ায় যে সখী, বিদ্যায় যে শিষ্য, ধর্ম্মে যে গুরু;—ভাল বাসুক বা না বাসুক কে সে স্ত্রীকে সহজে বিসর্জ্জন করিতে পারে? আশ্রমে যে আরাম, প্রবাসে যে চিন্তা,—স্বাস্থ্যে যে সুখ, রোগে যে ঔষধ,—অর্জ্জনে যে লক্ষ্মী, ব্যয়ে যে যশঃ—বিপদে যে বুদ্ধি, সম্পদে যে শোভা—ভাল বাসুক বা না বাসুক, কে সে স্ত্রীকে সহজে বিসর্জ্জন করিতে পারে? আর যে ভাল বাসে, পত্নী বিসর্জ্জন তাহার পক্ষে কি ভয়ানক দুর্ঘটনা! আবার যে রামের ন্যায় ভাল বাসে? যে পত্নীর স্পর্শমাত্রে অস্থিরচিত্ত, —জানে না যে,

———“সুখমিতি বা দুঃখমিতি বা,
প্রবোধো নিদ্রা বা কিমু বিষবিষর্পঃ কিমু মদঃ।
তব স্পর্শেস্পর্শে মম হি পরিমূঢ়েন্দ্রিয়গণ্বো,
বিকারশ্চৈতন্যং ভ্রময়তি সমুন্মীলয়তি চ।”[৩]

 যাহার পক্ষে—

ম্লানস্য জীবকুসুমস্য বিকাশনানি,
সন্তর্পণানি সকলেন্দ্রিয়মোহনানি।
এতানি তানি বচনানি সরোরুহাক্ষ্যা,
কর্ণামৃতানি মনসশ্চ রসায়নানি॥[৪]

 যাহার বাহু সীতার চিরকালের উপাধান,—

আবিবাহ সময়াদ্‌গৃহে বনে,
শৈশবে তদনু যৌবনে পুনঃ।
স্বাপহেতু রনুপাশ্রিতোঽন্যয়া,
রামবাহুরুপধানমেষ তে॥[৫]

 যার পত্নী—

———“গেহে লক্ষ্মীরিয় মমৃতবর্ত্তিনয়নয়োরসাবস্যাঃ স্পর্শো বপুষি বহুলশ্চন্দনরসঃ।
অয়ং কণ্ঠে বাহুঃ শিশিরমসৃণো মৌক্তিকসরঃ॥[৬]

 তাহার কি কষ্ট, কি সর্ব্বনাশ, কি জীবনসর্ব্বস্বধ্বংসাধিক যন্ত্রণা! তৃতীয়াঙ্কে সেই যন্ত্রণার উপযুক্ত চিত্র প্রণয়নের উদ্যোগেই প্রথমাঙ্কে কবি এই প্রণয় চিত্রিত করিয়াছেন। এই প্রণয় সর্ব্ব প্রফুল্লকর মধ্যাহ্নসূর্য্য—সেই বিরহ যন্ত্রণা ইহার ভাবী করালকাদম্বিনী,—যদি সে মেঘের কালিমা অনুভব করিবে, তবে আগে এই সূর্য্যের প্রখরতা দেখ। যদি সেই অনন্ত বিস্তৃত অন্ধকারময় দুঃখসাগরের ভীষণ স্বরূপ অনুভব করিবে, তবে এই সুন্দর উপকূল,—প্রাসাদশ্রেণীসমুজ্জল, ফলপুষ্প পরিশোভিত বৃক্ষবাটিকা পরিমণ্ডিত, এই সর্ব্বসুখময় উপকূল দেখ। এই উপকূলেশ্বরী সীতাকে রামচন্দ্র নিদ্রিতাবস্থায় ঐ অতলস্পর্শী অন্ধকার সাগরে ডুবাইলেন।

 আমরা সেই মনোমোহিনী কথার ক্রমশঃ সমালোচনা করিব।

 অঙ্কমুখে, লক্ষ্মণ রাম সীতাকে একখানি চিত্র দেখাইতেছেন। জনকাদির বিচ্ছেদে দুর্ম্মনায়মানা গর্ভিণী সীতার বিনোদনার্থ এই চিত্র প্রস্তুত হইয়াছিল। তাহাতে সীতার অগ্নিশুদ্ধি পর্য্যন্ত রামসীতার পূর্ব্ব বৃত্তান্ত চিত্রিত হইয়াছিল। এই “চিত্রদর্শন” কেবল প্রেমপরিপূর্ণ—স্নেহ যেন আর ধরে না। কথায়২ এই প্রেম। যখন অগ্নিশুদ্ধির কথা উল্লেখমাত্রে রাম, সীতাবমাননা ও সীতার পীড়ন জন্য আত্মতিরস্কার করিতেছিলেন— তখন সীতার কেবল “হোদু অজ্জউত্ত হোদু—এহি প্রেক্‌খহ্ম দাব দে চরিদং”—এই কথাতেই কত প্রেম! যখন মিথিলাবৃত্তান্তে সীতা রামের চরিত্র দেখিলেন, তখন কত প্রেম উছলিয়া উঠিল! সীতা দেখিলেন,

“অন্মহে দলন্তনবনীলুপ্‌পলসামলসিনিদ্ধমসিণসোহমাণমংসলেণ দেহমোহগ্‌গেণ বিহ্মঅত্থিমিদতাদদীসমাণসোম্মসুন্দরসিরী অনা— দরক্‌খুড়িদসঙ্করসরাসণো সিহণ্ডমুগ্ধমুহমণ্ডলো অজ্জ-উত্তো আলিহিদো।[৭]

 যখন রাম সীতার বধূবেশ মনে করিয়া বলিলেন,

প্রতনুবিরলৈঃপ্রান্তোল্মীলন্মনোহর কুন্তলৈ
দর্শন মুকুলৈর্মুগদ্ধালোকং শিশুর্দধতীমুখম্।
ললিতললিতৈর্জ্যোৎস্নাপ্রায়ৈরকৃত্রিয়বিভ্রমৈ—
রকৃতমধুরৈরস্বানাংমে কুতুহলমঙ্গকৈঃ।—[৮]

 যখন গোদাবরীতীর স্মরণ করিয়া কহিলেন,

কিমপি কিমপি মন্দং মন্দমাসত্তিযোগা
দধিবলিতকপোলং জলতোরক্রমেণ।
অশিথিলপরিবম্ভব্যাপৃতৈকৈকদোেষ্ণো
ববির্দিতগতযামা রাত্রিরেব ব্যরংসীৎ॥[৯]

 যখন যমুনাতটস্থ শ্যামবট স্মরণ করিয়া রামচন্দ্র কহিলেন,

অলসলুলিতমুগ্ধান্যধ্বসঞ্জাতখেদা
দশিথিলপরিরম্ভৈর্দত্তসংবাহনানি।
পরিমৃদিতমৃণালীদুর্ব্বলান্যঙ্গকানি
ত্বমুরসি মম কৃত্বা যত্রনিদ্রামবাপ্তা।[১০]

 যখন নিদ্রাভঙ্গান্তে রামকে দেখিতে না পাইয়া কৃত্রিম কোপে সীতা বলিলেন,

ভোদু মে কুবিস্মংজই মে পেক্‌খমাণা অত্তোণো পহবিস্মং।[১১]

 তখন কত প্রেম উছলিয়া উঠিতেছে! কিন্তু এই অতি বিচিত্র কবিত্বকৌশলময় চিত্রদর্শনে আরও কতই সুন্দর কথা আছে! লক্ষ্মণের সঙ্গে সীতার কৌতুক, “বচ্ছ ইঅং বি অবরা কা?”—মিথিলা হইতে বিবাহ করিয়া আসিবার কথায় দশরথকে রামের স্মরণ—“স্মরামি! হন্ত স্মরামি!” মন্থরার কথায় রামের কথা অন্তরিত করণ ইত্যাদি। সুর্পনখার চিত্র দেখিয়া সীতার ভয় আমাদের অতি মিষ্ট লাগে,—

 সীতা। হা অজ্জউত্ত এত্তিঅং দে দংসণং

 রামঃ। অরি বিপ্রয়োগত্রস্তে! চিত্রমেতৎ।

 সীতা। যথাতথা হোদু দুজ্জণো অসুহংউপ্পাদেই।[১২]

 স্ত্রীচরিত্র সম্বন্ধে এটি অতি সুমিষ্ট বাঙ্গ; অথচ কেবল ব্যঙ্গ নহে।

 কালিদাসের বর্ণনাশক্তি অতি প্রসিদ্ধ, কিন্তু ভবভূতির বর্ণনাশক্তি তদপেক্ষা হীনা নহে—বরং অনেকাংশে তাঁহার প্রাধান্য আছে। কালিদাসের বর্ণনা, তাঁহার অতুল উপমা প্রয়োগের দ্বারা অত্যন্ত মনোহারিণী হয়। ভবভূতির উপমা প্রয়োগ অতি বিরল; কিন্তু বর্ণনীয় বস্তু তাঁহার লেখনীমুখে স্বাভাবিক শোভার অধিক শোভা ধারণ করিয়া বসে। কালিদাস, একটী২ করিয়া বাছিয়া২ সুন্দর সামগ্রী গুলির একত্রিত করেন; সুন্দর সামগ্রী গুলির সঙ্গে তদীয় মধুর ক্রিয়া সকল ধ্বনিত করেন, তাহার উপর আবার উপমাচ্ছলে আরও কতকগুলিন সুন্দর সামগ্রী আনিয়া চাপাইয়া দেন। এজন্য তাঁহার কৃত বর্ণনা, যেমন স্বভাবের অবিকল অনুরূপ, তেমনি মাধুর্য্য পরিপূর্ণ হয়; বীভৎসাদি রসে কালিদাস সেই জন্য সফল হয়েন না। ভবভূতি বাছিয়া বাছিয়া মধুর সামগ্রী সকল একত্রিত করেন না; যাহা বর্ণনীয় বস্তুর প্রধানাংশ বলিয়া বোধ করেন, তাহাই অঙ্কিত করেন। দুই চারিটা স্থূল কথায় একটা চিত্র সমাপ্ত করেন— কালিদাসের ন্যায় কেবল বসিয়া বসিয়া তুলি ঘসেন না। কিন্তু সেই দুই চারিটা কথায় এমন একটু রস ঢালিয়া দেন, যে তাহাতে চিত্র অভ্রান্ত সমুজ্জ্বল, কখন মধুর, কখন ভয়ঙ্কর, কখন বীভৎস হইয়া পড়ে। মধুরে কালিদাস অদ্বিতীয়—উৎকটে ভবভূতি।

 উপরে উত্তরচরিতের প্রথমাঙ্ক হইতে উদাহরণস্বরূপ কতকগুলিন বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে,—যথা রামচন্দ্র ও জানকীর পরস্পরের বর্ণিত বরকন্যা রূপ। ভবভূতির বর্ণনাশক্তির বিশেষ পরিচয় দ্বিতীয় ও তৃতীয়াঙ্কে জনস্থান এবং পঞ্চবটী, এবং ষষ্ঠাঙ্কে কুমারদিগের যুদ্ধ। প্রথমাঙ্ক হইতে আমরা একটা সংক্ষিপ্ত উদাহরণ উদ্ধৃত করি।

 “বচ্ছএসো কুসমিদকঅম্বতরুতণ্ডবিদবরহিণো কিণ্ণামহেআে গিরি, জত্‌থ, অনুভাবসোহগ্‌গমেত্তপরিসেসধুসরসিরী মুহুত্ত্ং মুচ্ছন্তো তুএ পরুণ্ণেণ অবলম্বিদো তরুঅলে অজ্জউত্তো আলিহিদো।[১৩]

 দুইটিমাত্র পদে কবি কত কথাই ব্যক্ত করিলেন! কি করুণ রসচরমস্বরূপ চিত্র সৃজিত করিলেন!

 চিত্র দর্শনান্তে সীতা নিদ্রা গেলেন। ইত্যবসরে দুর্ম্মুখ আসিয়া সীতাপবাদ সম্বাদ রামকে শুনাইল। রাম সীতাকে বিসর্জ্জন করিবার অভিপ্রায় করিলেন।

 রামচন্দ্রের চরিত্র নির্দ্দোষ, অকলঙ্ক, দেবোপম বলিয়া ভারতে খ্যাত, এবং সেই জন্যই ভারতে তাঁহার দেবত্বে প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বস্তুতঃ বাল্মীকি কখন রামচন্দ্রকে নির্দ্দোষ বা সর্ব্বগুণবিভূষিত বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে ইচ্ছা করেন নাই। রামায়ণগীত শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রের অনেক দোষ; কিন্তু সে সকল দোষ গুণাতিরেকমাত্র। এই জন্য তাঁহার দোষ গুলিনও মনোহর। কিন্তু গুণাতিরেকে যে সকল দোষ, তাহা মনোহর হইলেও দোষ বটে। পরশুরাম অতিরিক্ত পিতৃভক্ত বলিয়া মাতৃহন্তা, তাই বলিয়া কি মাতৃবধ দোষ নহে? পাণ্ডবেরা মাতৃ কথার অতিরিক্ত বশ বলিরা এক পত্নীর পঞ্চ স্বামী, তাই বলিয়া কি অনেকের একপত্নীত্ব দোষ নয়?

 রামচন্দ্রও অনেক নিন্দনীয় কর্ম্ম করিয়াছেন।—যথা বালিবধ। কিন্তু তিনি যে সকল অপরাধে অপরাধী, তন্মধ্যে এই সীতা বিসর্জ্জনাপরাধ সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। শ্রীরামের চরিত্র কোন্ দোষে কলুষিত করিয়া কবি তাঁহাকে এই অপরাধে অপরাধী করিয়াছেন, তাহার আলোচনা করা যাউক।

 যাঁহারা সাম্রাজ্য শাসনে ব্রতী হয়েন, প্রজারঞ্জন তাঁহাদিগের একটি মহদ্ধর্ম্ম! গ্রীক ও রোমক ইতিবৃত্তে ইহার অনেক উদাহরণ প্রকাশিত আছে। কিন্তু ইহার সীমাও আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে, ইহা দোষরূপে পরিণত হয়। যে রাজা প্রজার হিতার্থ আপনার অহিত করেন সে রাজার প্রজারঞ্জন প্রবৃত্তি গুণ। ব্রূটস কৃত আত্ম পুত্ত্রের বধ দণ্ডাজ্ঞা, এই গুণের উদাহরণ। যে রাজা প্রজার প্রিয় হইবার জন্য হিতাহিত সকল কার্য্যেই প্রবৃত্ত, সেই রাজার প্রজারঞ্জন প্রবৃত্তি দোষ। নাপোলেয়নদিগের যুদ্ধে প্রবৃত্তি ইহার উদাহরণ। রোবস্পীয় ও দাঁতোকৃত বহু প্রজাবধ উহার নিকৃষ্টতর উদাহরণ।

 ভবভূতির রামচন্দ্র এই প্রজারঞ্জন প্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া সীতাকে বিসর্জ্জন করেন। অনেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রজারঞ্জক ছিলেন। কিন্তু বামচন্দ্রের চরিত্রে স্বার্থপরতামাত্র ছিল না। সুতরাং তিনি স্বার্থ জন্য প্রজারঞ্জনে ব্রতী ছিলেন না। প্রজারঞ্জন রাজাদিগের কর্ত্তব্য বলিয়াই, এবং ইক্ষাকু বংশীয়দিগের কুলধর্ম্ম বলিয়াই তাহাতে তাঁহার এতদূর দার্ঢ্য। তিনি অষ্টাবক্রের সমক্ষে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলেন,

স্নেহং দয়াং তথাসৌখ্যং যদি বা জানকীমপি,
আরাধনায় লোকস্য, মুঞ্চতো নাস্তি যে ব্যথা।[১৪]

 এবং দুর্ম্মুখের মুখে সীতার অপবাদ শুনিয়াও বলিলেন,

সতাং কেনাপিকার্য্যেণ লোকস্যারাধনম্ ব্রতং
যৎ পূজিতং হি তাতেন মাঞ্চ প্রাণাংশ্চমুঞ্চতা।[১৫]

 ভবভূতির রামচন্দ্র এই বিষম ভ্রমে ভ্রান্ত হইয়া কুলধর্ম্ম এবং রাজধর্ম্ম পালনার্থ, ভার্য্যাকে পবিত্রা জানিয়াও ত্যাগ করিলেন। রামায়ণের রামচন্দ্র সেরূপ নহেন। তিনিও জানিতেন যে সীতা পবিত্রা,—

অন্তরাত্মা চ মে বেত্তি সীতাৎ শুদ্ধাং যশস্বিনীম্।

তিনি কেবল রাজকুলসুলভ অকীর্ত্তিশঙ্কা বশতঃ পবিত্রা পতিমাত্র জীবিতা পত্নীকে ত্যাগ করিলেন। “আমি রাজা শ্রীরামচন্দ্র ইক্ষাকুবংশীয়, লোকে আমার মহিষীর অপবাদ করে! আমি এ অকীর্ত্তি সহিব না—যে স্ত্রীর লোকাপবাদ, আমি তাহাকে ত্যাগ করিব।” এইরূপ রামায়ণের রামচন্দ্রের গর্ব্বিত চিত্তভাব।

 বাস্তবিক সর্ব্বত্রই, রামায়ণের রামচন্দ্র হইতে ভবভূতির রামচন্দ্র অধিকতর কোমল প্রকৃতি। ইহার এক কারণ এই, উভর চরিত্র, গ্রন্থ রচনার সময়োপযোগী। রামায়ণ প্রাচীন গ্রন্থ। কেহ কেহ বলেন যে উত্তরাকাণ্ড বাল্মীকি প্রণীত নহে। তাহা হইক বা হউক, ইহা যে প্রাচীন রচনা তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। তখন আর্য্যজাতি বীরজাতি ছিলেন। আর্য্য রাজগণ বীরস্বভাবসম্পন্ন ছিলেন। রামায়ণের রাম মহাবীর, তাঁহার চরিত্র গাম্ভীর্য্য এব ধৈর্য্য পরিপূর্ণ। ভবভূতি যৎকালে কবি—তখন ভারতবর্ষীয়েরা আর সে চরিত্রের নহেন। ভোগাকাঙ্ক্ষা, অলসাদির দ্বারা, তাঁহাদের চরিত্র কোমলপ্রকৃত হইয়াছিল। ভবভূতির রামচন্দ্রও সেইরূপ। তাঁহার চরিত্রে বীর লক্ষণ কিছুই নাই। গাম্ভীর্য্য এবং ধৈর্যের বিশের অভাব। তাঁহার অধীরতা দেখিয়া কখন২ কাপুরুষ বলিয়া ঘৃণা হয়। সীতার অপবাদ শুনিয়া, ভবভূতির রামচন্দ্র যে প্রকার বালিকাসুলভ বিলাপ করিলেন, তাহাই ইহার উদাহরণ স্থল। তিনি শুনিয়াই মূর্চ্ছিত হইলেন। তাহার পর দুর্ম্মুখের কাছে অনেক কাঁদাকাটা করিলেন। অনেক সুদীর্ঘ বক্তৃতা করিলেন। তন্মধ্যে অনেক সকরুণ কথা আছে বটে, কিন্তু এত বাগাড়ম্বরে করুণরসের একটু বিঘ্ন হয়। এত বালিকার মত কাঁদিলে রামচন্দ্রের প্রতি কাপুরুষ বলিয়া ঘৃণা হয়। নিম্নলিখিত উক্তি শুনিলে বা পাঠ করিলে, বোধ হয় যেন কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের কোন অধ্যাপক বা ছাত্রের রচনা—শব্দের বড় ঘটা, কিন্তু অন্তঃশূন্য—)

 “হা দেবি দেবর জনসম্ভবে! হা স্বজন্মানুগ্রহপবিত্রিতবসুন্ধরে! হা নিমিজনকবংশনন্দিনি! হা পাবকবশিষ্ঠারুন্ধতী প্রশস্তশীনশালিনি। হা রামময়জীবিতে! হা মহারণ্যবাসপ্রিয়সখি! হা প্রিয়স্তোকবাদিনি! কথমেবংবিধায়াস্তবায়মীদৃশঃ পরিণামঃ![১৬]

 এইরূপ রচনা ভবভূতির ন্যায় মহাকবির অযোগ্য—কেবল আধুনিক বিদ্যালঙ্কারদিগের যোগ্য। এইরূপস্থলে রামায়ণের রামচন্দ্র কি করিয়াছেন? কত কাঁদিয়াছেন? কিছুই না। মহাবীরপ্রকৃত শ্রীরাম সভামধ্যে সীতাপবাদের কথা শুনিলেন। শুনিয়া সভাসদগণকে কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন সকলে কি এইরূপ বলে?” সকলে তাহাই বলিল। তখন ধীরপ্রকৃতি, রাজা আর কাহাকে কিছু না বলিয়া সভা হইতে উঠিয়া গেলেন। মূর্চ্ছাও গেলেন না,—মাতাও কুটিলেন না—ভূমে গড়াগড়ি দিলেন না। পরে নিভৃত হইয়া, কাতরতাশূন্যা ভাষায় ভ্রাতৃবর্গকে ডাকাইলেন। ভ্রাতৃগণ আসিলে, পর্ব্বতবৎ অবিচলিত থাকিয়া, তাহাদিগকে আপন অভিপ্রায় জানাইলেন। বলিলেন, “আমি সীতাকে পবিত্রা জানি—সেই জন্যই গ্রহণ করিয়াছিলাম—কিন্তু এক্ষণে এই লোকাপবাদ! অতএব আমি সীতাকে ত্যাগ করিব।” স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া, লক্ষ্মণের প্রতি রাজাজ্ঞা প্রচার করিলেন, “তুমি সীতাকে বনে দিয়া আইস।” যেমন অন্যান্য নিত্যনৈমিত্তিক রাজকার্য্যে রাজানুচরকে রাজা নিযুক্ত করেন, সেইরূপ লক্ষ্মণকে সীতাবিসর্জ্জনে নিযুক্ত করিলেন। চক্ষে জল, কিন্তু একটিও শোকশূচক কথা ব্যবহার করিলেন না। “মর্ম্মাণি কৃন্ততি” ইত্যাদি বাক্য সীতাবিয়োগাশঙ্কায় নহে— অপবাদ সম্বন্ধে। তথাপি তাঁহার এই কয়টি কথায় কত দুঃখই আমরা অনুভূত করিতে পারি! এইস্থল উত্তরকাণ্ড হইতে উদ্ধৃত এবং অনুবাদিত করিলাম।

তস্যৈবং ভাষিত শ্রুত্বা রাঘবঃ পরমার্ত্তবৎ।
উবাচ সুহৃদঃ সর্ব্বান্ কথমেতদ্বদন্তি মাম্॥
সর্ব্বেভু শিরসাভূমাবভিবাদ্য প্রণম্য চ।
প্রত্যূচু রাঘবং দীনমেবমেতরসংশয়ঃ॥
শ্রুত্বাতুবাক্যংকাকুৎস্থঃ সর্ব্বেবাং সমুদীরিতম্।
বিষর্জ্জয়ামাস তদা বয়স্যান শত্রুসূদনঃ॥

বিসৃজ্য তু সুহৃদ্বর্গং বুদ্ধ্যানিশ্চিত্য রাঘবঃ।
সমীপে দ্বাস্থমাসীনমিদং বচনমব্রবীৎ॥
শীঘ্রমানয় সৌমিত্রিং লক্ষ্মণং শুভলক্ষণং।
ভরতং চ মহাভাগং শত্রুঘ্নং চা পরাজিতঃ॥

* * * *

তে তু দৃষ্টা মুখং তস্য সগ্রহং শশিনং যথা।
সন্ধ্যাগতমিবাদিত্যং প্রভয়াপরিবর্জিতং॥
বাষ্পপূর্ণে চ নয়নে দৃষ্ট্বা রামস্য ধীমতঃ।
হতশোভং যথা পদা মুখম্বীক্ষ্য চ তস্য তে॥
ততোভিবাদ্য ত্বরিতাঃ পাদৌ রামস্য মুর্দ্ধভিঃ।
তস্থূঃ সমাহিতাঃ সর্ব্বে রামস্ত্বশ্রুণ্যবর্ত্তয়‍ৎ॥
তান পরিষ্বজ্য বাহুভ্যামুত্থাপ্য চ মহাবলঃ।
আসনেষ্বাসতেত্যুক্ত্বা ততোবাক্যং জগাদ হ॥
ভবন্তো মম সর্ব্বস্বং ভবন্তোজীবিতং মম।
ভবদ্ভিশ্চকৃতং রাজ্যং পালয়ামি নরেশ্বরাঃ॥
ভবন্তঃকৃতশাস্ত্রার্থাবুদ্ধ্যাচ পরিনিষ্ঠিতাঃ।
সং ভূয়চ মদর্থোয় মন্বেষ্টব্যোনরেশ্বরাঃ॥
তথা বদতি কাকুৎস্থে অবধানপরায়ণাঃ।
উদ্বিগ্নমনসঃ সর্ব্বে কিন্নুরাজাভিধাস্যতি॥
তেষাং সমুপবিষ্টানাং সর্ব্বেষাং দীনচেতসাম্।
উবাচ বাক্যং কাকুৎস্থো মুখেন পরিশুষ্যতা॥
সর্ব্বে শূণুত ভদ্রম্বো মাকুরুধ্বং মনোন্যথা।
পৌরাণাং মম সীতায়া যাদৃশী বর্ত্ততে কথা॥
পৌরাপবাদঃ সুমহান্ তথাজনপদসাচ।
বর্ত্ততে ময়ি বীভৎসা মম মর্ম্মাণি কৃন্ততি॥
অহং কিল কুলে জাত ইক্ষ্বাকুনাং মহাত্মনাম্।
সীতাপি সৎকুলে জাতা জনকানাং মহাত্মনাম্॥

* * * *

অন্তরাত্মা চ মে বেত্তি সীতাং শুদ্ধাং যশস্বিনীম্‌।
ততো গৃহীত্বা বৈদেহী মযোধ্যামহযাগতঃ॥
অয়ং তু মে মহান্বাদঃ শোকশ্চ হৃদি বর্ত্ততে।
পৌৱাপবাদঃ সুমহাংস্তথা জনপদস্‌চে।

অকীর্ত্তিস্য গীয়েত লোকে ভূতস্য কসয়চিৎ॥
পতত্যেবাধমায়োল্লোকান্ যাবচ্ছব্দ প্রকীর্ত্ততে।
অকীর্ত্তির্নিন্দ্যতে দেবৈঃকীর্ত্তির্লোকেষু পূজ্যতে॥
কীর্ত্ত্যর্থং ত সমারম্ভঃ সর্বেষাং সুমহাত্মনাম্।
অথাহং জীবিতং জহ্যাং যুষ্মান্বা পুরুষর্ষভাঃ॥
অপবাদভয়াদ্ভীতঃ কিং পুনর্জনকাত্মজাম্।
তস্মাদ্ভবন্তঃ পশান্ত পতিতং শোকসাগরে॥
নহি পশ্যাম্যহং ভূতে কিঞ্চিদ্দূঃখমতোধিকং।
স ত্বং প্রভাতে সৌমিত্রে সুমন্ত্রাধিষ্ঠিতং রথং॥
আরুহ্য সীতামারোপ্য বিষয়ান্তে সমুৎসৃজ।
গঙ্গায়ান্তপরে পারে বাল্মীকেস্তু মহাত্মনঃ॥
আশ্রমোদিব্যসঙ্কাশ স্তমসাতীরমাশ্রিতঃ।
তত্রৈনাম্বিজনে দেশে বিসৃজ্য রঘুনন্দন॥
শীঘ্রমাগচ্ছ সৌমিত্রে কুরুষ্ব বচনং মম।
নচাস্মিন প্রতিবক্তব্যং সীতাং প্রতি কথঞ্চন॥
তস্মাত্বং গচ্ছ সৌমিত্রে নাত্র কার্য্যবিচারণা।
অপ্রীতির্হি পরা মহ্যং ত্বস্যেতৎপ্রতিবারিতে॥
শাপিতা হি ময়াযুয়ং পাদাভ্যাংজীবনেন চ।
যেষাং বাক্যান্তরে ব্রুয়ুরনুনেতুং কথঞ্চন॥
অহিতানাম তে নিত্যংমদভিষ্ট বিঘাতনাৎ।
মানয়স্তুভবস্তুো মাং যদি মচ্ছাসনেস্থিতাঃ।
ইতোদ্য নীয়তাং সীতাং কুরুষ্ব বচনং মম॥[১৭]

 এই রচনা অতি মনোমোহিনী। রামায়ণের রাম, ক্ষত্রিয় মহোজ্জ্বলকুলসম্ভূত, মহাতেজস্বী। তিনি পৌরাপবাদ শ্রবণে, অবিদ্ধ সিংহের ন্যায় রোষে দুঃখে গর্জন করিয়া উঠিলেন।

ভবভূতির রামচন্দ্র তৎপরিবর্ত্তে স্ত্রীলোকের মত পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিলেন। তাঁহার ক্রন্দনের কিয়দংশ পূর্ব্বেই উদ্ধত করিয়াছি। রামায়ণের সঙ্গে তুলনা করিবার জন্য অবশিষ্টাংশ ও উদ্ধৃত করিলাম।

রাম। হা কষ্টমতিবীভৎসকর্ম্মা নৃশংসোস্মি সংবৃত্তঃ
শৈশবাৎ প্রভৃতি পোষিতাং প্রিয়াং
সৌহৃদাদ পৃথগাশয়ামিমা।

ছদ্মনা পরিদদামি মৃত্যবে
যৌনিকো গৃহশকুন্তিকামিব॥
তৎকিমস্পর্শনীয়ঃ পাতকী দেবীং দূষযামি।
সীতায়াঃ শিরঃ স্বৈরমুন্নমযা বাহুমাকর্ষন্
অপূর্ব্বকর্ম্মচাণ্ডাল ময়ি মুগ্ধে বিমুঞ্চমাম্।
শ্রিতাসি চন্দনভ্রান্ত্যা দুর্বিপাকং বিষদ্রূমম্।

 উত্থায়। হস্ত বিপর্য্যন্তঃ সম্প্রতি জীবলোকঃ পর্যাবসিতং জীবিতপ্রয়োজনং রামস্য শূন্যমধুনা জীর্ণারণ্যং জগৎ অসারঃ সংসারঃ কষ্টপ্রায়ং শরীরম্ অশরণোস্মি কিংকরোমি কা গতিঃ।

অথবা।

দুঃখসংবেদনায়ৈব রামে চৈতন্যমাহিতম্।
মর্ম্মোপঘাতিভিঃ প্রাণৈর্বজ্র কীলায়িতংস্থিরৈঃ॥

 হা অম্ব অরুন্ধতি হা ভগবন্তৌ বশিষ্টবিশ্বামিত্রৌ হা ভগবন্ পাবক হা দেবি ভূতধাত্রি হা তাত জনক হা তাত হা মাতরঃ হা পরমোপকারিন লঙ্কাধিপতে বিভীষণ হা প্রিয়সখ সুগ্রীর হা সৌম্য হনুমন্ হা সখি ত্রিজটে মুষিতাস্থ পরিভূতাস্থ রামহতকেন। অথবা কশ্চতেষামহমিদানীমাহ্বানে।

তেহি মন্যে মহাত্মানঃ কৃতঘ্নেন দুরাত্মনা।
ময়াগৃহীতনামানঃ স্পৃশ্যন্ত ইব পাপ্ননা। যোহম্।

যোহম্

বিস্রম্ভাদুরসি নিপত্য লন্ধনিদ্রা
মুন্মুচ্য প্রিয়গৃহিণীং গৃহসা শোভাম॥
আতঙ্কস্ফূরিত কঠোরগর্ভগুর্ব্বীং
ক্রব্যাদ্ভ্যো বলিমিব নির্ঘৃণঃ ক্ষিপামি॥
সীতায়াঃ পাদৌ শিরসি কত্বা। দেবি দেবি অয়ং
পশ্চিমস্তে রামসা শিরসা পাদপঙ্কজস্পর্শঃ

ইতি রোদিতি।[১৮]

 ইহার অনেকগুলিন কথা সকরুণ এটে, কিন্তু ইহা আর্য্য বীর্যপ্রতিম মহারাজ রামচন্দ্রের মুখ হইতে নির্গত না হইয়া, আধুনিক কোন বাঙ্গালি বাবুর মুখ হইতে নির্গত হইলে উপযুক্ত হইত। কিন্তু ইহাতের বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মন উঠে নাই। তিনি সীতার বনবাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে আরও কিছু বাড়াবাড়ি করিয়াছেন, তাহা পাঠকালে রামের কান্না পড়িয়া আমাদিগের মনে হইয়াছিল যে, বাঙ্গালির মেয়েরা স্বামী বা পুত্রকে বিদেশে চাকরি করিতে পাঠাইয়া এইরূপ করিয়া কাঁদে বটে।

 ভবভূতির পক্ষে ইহা বক্তব্য যে উত্তর চরিত নাটক নাটকের উদ্দেশ্য হৃচ্চিত্র; রামায়ণ প্রভৃতি উপাখ্যান, কাব্যের[১৯] উদ্দেশ্য ভিন্নপ্রকার। সে উদ্দেশ্য কার্য্যপরম্পরার সরস বিবৃতি। কে কি করিল, তাহাই উপাখ্যান কাব্যে লেখকেরা প্রতীয়মান করিতে চাহেন; সে সকল কার্য্য করিবার সময়ে কে কি ভাবিল, তাহা স্পষ্টীকৃত করিবার প্রয়োজন তাদৃশ বলবৎ নহে। কিন্তু নাটকে সেই প্রয়োজনই বলবৎ। নাট্যকারের নিকট আমরা নায়কের হৃদয়ের প্রকৃত চিত্র চাহি। সুতরাং তাঁহাকে চিত্তভাব ভাব অধিকতর স্পষ্টীকৃত করিতে হয়। অনেক বাগাড়ম্বর আবশাক হয়। কিন্তু তথাপি উত্তর চরিত্রের প্রথমাঙ্কের রামবিলাপ মনোহর নহে। সে কথা গুলিন বীরবাক্য নহে—নবপ্রেমমুগ্ধ অসারবান্ যুবকের কথা।

 প্রথমাঙ্ক ও দ্বিতীয়াঙ্কের মধ্যে দ্বাদশবৎসর কাল ব্যবধান। উত্তরচরিতের একটা দোষ এই যে, নাটকবর্ণিত ক্রিয়া সকলের পরস্পর কালগত নৈকট্য নাই। এ সম্বন্ধে উইণ্টর্সটেল নামক সেক্ষপীয়রকৃত বিখ্যাত নাটকের সঙ্গে ইহার বিশেষ সাদৃশ্য আছে।

 এই দ্বাদশবৎসর মধ্যে সীতা যমল সন্তান প্রসব করিয়া স্বয়ং পাতালে অবস্থান করিলেন, তাঁহার পুত্রেরা বাল্মীকির আশ্রমে প্রতিপালিত এবং সুশিক্ষিত হইতে লাগিল। রামচষ্ট্রের পূর্ব্ব প্রদত্ত বরে দিব্যাস্ত্র তাহাদের স্বতঃসিদ্ধ হইল। এদিকে রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। লক্ষ্মণের পুত্ত্র চন্দ্রকেতু সৈন্য লইয়া যজ্ঞের অশ্বরক্ষণে প্রেরিত হইলেন। কোন দিন রামচন্দ্র দৈবাদেশে জানিলেন যে শম্বূক নামক কোন নীচজাতীয় ব্যক্তি তাঁহার রাজ্যমধ্যে তপশ্চারণ করিতেছে। ইহাতে তাঁহার রাজ্যমধ্যে অকাল মৃত্যু উপস্থিত হইতেছে। রামচন্দ্র ঐ শূদ্র তপস্বীর শিরচ্ছেদ মানসে সশস্ত্রে তাহার অনুসন্ধানে নানা দেশ ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। শম্বূক পঞ্চবটীর বনে তপঃ করিতেছিল।

 দ্বিতীয়াঙ্কের বিষ্কম্ভকে মুনিপত্নী আত্রেয়ী এবং বনদেবতা বাসন্তীর প্রমুখাৎ এই সকল বৃত্তান্ত প্রকাশ হইয়াছে। যেমন প্রথমাঙ্কের পূর্ব্বে প্রস্তাবনা, সেইরূপ অন্যান্য অঙ্কের পূর্ব্বে একটি২ বিষ্কম্ভক আছে। এগুলি অতি মনোহর। কখন বিদুষী ঋষিপত্নী, কখন প্রেমময়ী বনদেবী, কখন তমসা মুরলা নদী, কখন বিদ্যাধর বিদ্যাধরী, এইরূপে সৌন্দর্য্যময়ী সৃষ্টির দ্বারা ভবভূতি বিষ্কম্ভক সকল অতি রমণীয় করিয়াছেন। দ্বিতীয়াঙ্কের আরম্ভই সুন্দর। যথা;—

 “অধ্বগবেশা তাপসী। অয়ে বন দেবতেয়ং ফলকুসুমপল্লবার্ষেণ সামুপতিষ্ঠতে।[২০]

 শিক্ষা সম্বন্ধে আজেরীর কথা বড় সুন্দর—

“বিতরতি গুরুঃপ্রাজ্ঞে বিদ্যাং যথৈবতথা জড়ে নচখলু
তয়োর্জ্ঞানে শক্তিং করোতাপহন্তিচ।
ভবতি চ তয়োর্ভূয়ান্ ভেদঃফলংপ্রতি তদযথা প্রভবতি
শুচির্বিম্বোদ্‌গ্রাহে মণির্ন মৃদাং চরঃ।[২১]

 হয়েস্ হেমান উইলসন্ বলেন যে, উত্তরচরিতে কতকগুলি এমত সুন্দর ভাব আছে যে তদপেক্ষা সুন্দর ভাব কোন ভাষাতেই নাই। উপরে উদ্ধৃত কবিতা এই কথার উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করিয়াছেন।

 রামচন্দ্র শম্বূকের সন্ধান করিতে২ পঞ্চবটীর বনে শম্বূককে পাইলেন। এবং খড়্গদ্বারা তাহাকে প্রহার করিলেন। শম্বূক দিব্য পুরুষ; রামের প্রহারে শাপমুক্ত হইয়া রামকে প্রণিপাত করিল। এবং জনস্থানাদি রামচন্দ্রের পূর্ব্বপরিচিত স্থান সকল দেখাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথনে বনবর্ণনা অতি মনোহর।

স্নিগ্ধশ্যামাঃকচিদপরতো ভীষণাভোগরূক্ষাঃ
স্থানে স্থানে মুখরককুভো ঝাঙ্কৃতৈনির্ঝরাণাস্।
এতে তীর্থাশ্রমগিরিসরিদ্গর্ব্ভকান্তারমিশ্রাঃ
সন্দৃশ্যন্তে পরিচিতভূবো দণ্ডকারণ্যভাগাঃ।

* * * *

এতানি খলু সর্ব্বভূতলোমহর্ষণানি উন্মত্তচণ্ড
শ্বাপদকুলসঙ্কুলগিরিগহ্বরাণি জনস্থান পর্য্যন্ত—
দীর্ঘারণ্যানি দক্ষিণাং দিশমভিবর্ত্তন্তে।
তথাহি 
নিষ্কূজস্তিমিতাঃ ক্বচিৎ ক্বচিদপি প্রোচ্চণ্ডসত্ত্বস্বনাঃ
স্বেচ্ছাসুপ্তগভীরথোষভুজগশ্বাস প্রদীপ্তাগ্নয়ঃ।
সীমানঃপ্রদরোদরেষু বিলসৎস্বল্পান্তসো যান্বয়ং
তৃষ্যদ্ভিঃ: প্রতিসূর্য্যকৈরজগরস্বেদদ্রবঃ পীয়তে।

* * * *

অথৈতানি মদকলময়ূরকণ্ঠকোমলচ্ছবিভিরবকীর্ণানি
পর্ব্বতৈরবিরলনিবিষ্টনীলবহুলচ্ছায়তরুষণ্ডমণ্ডিতানি
অসম্ভ্রান্ত বিবিধ মৃগ যূথানি
পশ্যতু মহানুভাবঃ প্রশান্তগম্ভীরাণি মধামারণ্যকানি।
ইহ সমদশকুন্তাক্রান্তবানীরবীরূৎ
প্রসবসুরভিশীতস্বচ্ছতোয়াঃ বহন্তি।
ফলভয়পরিণামশ্যামজম্বূনিকুঞ্জ
স্খলনমুখরভূরিস্রোতসো নির্ঝরিণ্যঃ
অপিচ 
দবতি কুহরভাজামত্র ভল্লূকযুনা
মনুরসিতগুরূণি স্ত্যানমম্বূকৃতানি।
শিশিরকটুকষায়ঃ স্ত্যায়তে শল্লকীনা
মিভদলিতবিকীর্ণগ্রন্থিনিষ্যন্দগন্ধঃ।[২২]

 প্রবন্ধের অসহ্য দৈর্ঘ্যাশঙ্কায় আর অধিক উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না।

 শম্ভূক বিদায় পরে পুনরাগমন পূর্ব্বক রামকে জানাইলেন যে, অগস্ত্য রামাগমন শুনিয়া তাঁহাকে আশ্রমে আমন্ত্রিত করিতেছেন। শুনিয়া রাম তথায় চলিলেন। গমনকালীন ক্রৌঞ্চাবত পর্ব্বতাদির বর্ণনা অতি মনোহর। আমরা সচরাচর অনুপ্রাসালঙ্কারের প্রশংসা করি না, কিন্তু এরূপ অনুপ্রাসের উপর বিরক্ত হওয়াও যায় না।

গুঞ্জৎকুঞ্জকুটীরকৌশিকঘটাঘুৎকারবৎ কীচক
স্তম্বাড়ম্বর মুকসৌকুলিকুলঃক্রৌঞ্চাবতোয়ং গিরিঃ।
এতস্মিন্ প্রচলাকিনাৎ প্রচলতামুদ্বেজিতাঃ কুজিতৈ
রূদ্বেল্লন্তি পুরাণরোহিণতরুস্কন্ধেষুকুম্ভীনসাঃ।

এতেতে কুহরে গদ্গ‌দনদ্গোদাবরীবারয়ো
মেঘালঙ্কৃতমৌলিনীলশিখরাঃ ক্ষৌণীভূতো দক্ষিণাঃ।
অন্যোন্যপ্রতিঘাতসঙ্কুলচলৎকল্লোলকোলাহলৈ
রুস্তালাস্ত ইমে গভীরপয়সঃ পুণ্যাঃ সরিৎসঙ্গমাঃ।[২৩]

 তৃতীয়াঙ্ক অতি মনোহর। সত্য বটে যে, এই উৎকষ্ট নাটকে ক্রিয়াপারম্পর্য্য বড় মনোহর নহে, এবং তৃতীয়াঙ্ক সেই দোষে বিশেষ দুষ্ট। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম অঙ্ক যেরূপ বিস্তৃত, তদনুরূপ বহুল ক্রিয়াপরম্পরা নায়ক নায়িকাগণ কর্ত্তৃক সম্পন্ন হয় নাই। যিনি মাক্‌বেথ পাঠ করিয়াছেন, তিনি জানেন যে নাটকে বর্ণিতা ক্রিয়া সকলের বাহুল্য, পারম্পর্ঘ্য, এবং শীঘ্র সম্পাদন, কি প্রকার চিত্তকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। কার্য্যগত এই গুণ নাটকের একটি প্রধান গুণ। উত্তরচরিতে তাহার বিরলপ্রচার; বিশেষতঃ প্রথম ও তৃতীয়াঙ্কে। তথাপি ইহাতে কবি যে অপূর্ব্ব কবিত্বশক্তি প্রকাশ করিয়াছেন, সেই গুণে আমরা সে সকল দোষ বিস্মৃত হই।

 দ্বিতীয়াঙ্কের বিষ্কন্তক যেমন মধুর তৃতীয়াঙ্কের বিষ্কন্তক ততোদিক। গোদাবরীসংমিলিতা, তমসা ও মুরলা নাম্নী দুইটি নদী রূপ ধারণ করিয়া রামসীতা বিষয়িণী কথা কহিতেছে।

 অদ্য দ্বাদশ বৎসর হইল, রামচন্দ্র সীতাকে বিসর্জ্জন করিয়াছেন। প্রথম বিরহে তাঁহার যে গুরুতর শোক উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে। কালসহকারে সে শোকের লাঘব জন্মিবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তাহা ঘটে নাই; সর্ব্বসন্তাপহর্ত্তা কাল এই সম্ভাপের শমতা সাধিতে গারে নাই।

অনির্ভিন্নগভীরত্বাদত্তর্গূঢ়ঘন ব্যর্থঃ।
পূটপাকপ্রতীকাশো রামস্য করুণোরসঃ[২৪]

 এইরূপ মর্ম্ম মধ্যে রুদ্ধ সন্তাপে দগ্ধ হইয়া রাম, পরিক্ষীণ শরীরে রাজকর্ম্মানুষ্ঠান করিতেন। রাজকর্ম্মে ব্যাপৃত থাকিলে, সে কষ্টের তাদৃশ বাহ্য প্রকাশ পায় না; কিন্তু আজ পঞ্চবটীতে আসিয়া রামের ধৈর্য্যাবলম্বনের সে উপায়ও নাই! এ আবার সেই জনস্থান; পদে২ সীতাসহবাসের চিহ্নপরিপূর্ণ। এই জনস্থানে কতকাল, কত সুখে, সীতার সহিত বাস করিয়াছিলেন, তাহা পদে২ মনে পড়িতেছে। রামের সেই দ্বাদশ বৎসরের রুদ্ধ শোক প্রবাহ ছুটিয়াছে—সে প্রবাহবলে, এই গোদাবরী স্রোতঃস্খলিত শিলাচয়ের ন্যায় রামের হৃদয়পাষাণ আজি কোথায় যাইবে, কে বলিতে পারে?

 জনস্থানবাহিনী করুণাদ্রাবিতা নদীগুলিন দেখিল যে আজি বড় বিপদ। তখন মুরলা কলকল করিয়া গোদাবরীকে বলিতে চলিল, “ভগবতি! সাবধান থাকিও—আজ রামের বড় বিপদ। দেখিও রাম যদি মূর্চ্ছা যান, তবে তোমার জলকণাপূর্ণ শীতল তরঙ্গের বাতাসে মৃদু২ তাঁহার মূর্চ্ছা ভঙ্গ করিও।” রঘুকুলদেবতা ভাগীরথী এই শোকতপনাতপসন্তাপ হইতে রামকে রক্ষা করিবার জন্য এক সর্ব্বসন্তাপসংহারিণী ছায়াকে জনস্থানে পাঠাইলেন। সেই ছায়ার স্নিগ্ধতায় অদ্যাপি ভারতবর্ষ মুগ্ধ রহিয়াছে। সেই ছায়া হইতে কবি এই তৃতীয়াঙ্কের নাম রাখিয়াছিলেন “ছায়া।” এই ছায়া, সেই বহুকালবিস্মৃতা, পাতাল প্রবিষ্টা, শীর্ণ দেহমাত্র বিশিষ্টা হতভাগিনী রামমনোমোহিনী সীতার ছায়া।

 সীতা লবকুশকে প্রসব করিলে পর ভাগীরথী এবং পৃথিবী বালক দুইটিকে বাল্মীকির আশ্রমে রাখিয়া সীতাকে পাতালে লইয়া গিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য কুশলবের জন্মতিথি—সীতাকে স্বহস্তাবচিত কুসুমাঞ্জলি দিয়া পতিকুলাদিপুরুষ সূর্য্যদেবের পূজা করিতে ভাগীরথী এই জনস্থানে পাঠাইলেন। এবং আপন দৈবশক্তিপ্রভাবে রঘুকুলবধূকে অদর্শনীয়া করিলেন। ছায়ারূপিণী সীতা সকলকে দেখিতে পাইতেছিলেন। সীতাকে কেহ দেখিতে পাইতেছিল না।

 সীতা তখন জানেন না যে, রাম জনস্থানে আসিয়াছেন। সীতাও আসিয়া জনস্থানে প্রবেশ করিলেন। তখন তাঁহার আকৃতি কিরূপ? তাঁহার মুখ “পরিপাণ্ডুদুর্ব্বল কপোলসুন্দর”—কবরী বিলোল—শারদাতপসন্তপ্ত কেতকী কুসুমান্তর্গত পত্রের ন্যায়, বন্ধনবিচ্যুত কিসলয়ের মত, সীতা সেই অরণ্যে প্রবেশ করিলেন। জনস্থানে তাঁহার গভীর প্রেম! পূর্ব্বসুখের স্থান দেখিয়া বিস্মৃতি জন্মিল—আবার সেই দিন মনে পড়িল। যখন সীতা রামসহবাসে এই বনে থাকিতেন, তখন জনস্থান বনদেবতা বাসন্তীর সহিত তাঁহার সখীত্ব হইয়াছিল। তখন সীতা একটি করিশাবককে স্বহস্তে শল্লকীর পল্লবাগ্রভাগ ভোজন করাইয়া পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিয়াছিলেন। এখন সেই করিশাবকও ছিল। এইমাত্র সে বধূসঙ্গে জলপানে গিয়াছে। এক মত্ত যূথপতি আসিয়া অকস্মাৎ তৎপ্রতি আক্রমণ করিল। সীতা তাহা দেখেন নাই। কিন্তু অন্যত্রস্থিতা বাসন্তী দেখিতে পাইয়াছিলেন। বাসন্তী তখন উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলেন, “সর্ব্বনাশ হইল, সীতার পালিত করিকরভকে মারিয়া ফেলিল!” রব সীতার কর্ণে গেল। সেই জনস্থান, সেই পঞ্চবটী! সেই বাসন্তী! সেই করিকরভ! সীতার ভ্রান্তি জন্মিল। পুত্ত্রীকৃত হস্তিশাবকের বিপদে বিহ্বলচিত্ত হইয়া তিনি ডাকিলেন, “আর্য্যপুত্ত্র! আমার পুত্ত্রকে বাঁচাও!” কি ভ্রম! আর্য্যপুত্ত্র? কোথায় আর্য্যপুত্ত্র? আজি বার বৎসর সে নাম নাই! অমনি সীতা মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িলেন। তমসা তাঁহাকে আশ্বস্তা করিতে লাগিলেন। এ দিকে রামচন্দ্র লোপামুদ্রার আহ্বানুসারে অগস্ত্যাশ্রমে যাইতেছিলেন। পঞ্চবটী বিচরণ করিবার মানসে সেই খানে বিমান রাখিতে বলিলেন। সে কথার শব্দ মুর্চ্ছিতা সীতার কানে গেল। অমনি সীতার মুর্চ্ছাভঙ্গ হইল—সীতা ভয়ে, আহ্লাদে, উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, “একি এ? জলভরা মেঘের স্তনিতগম্ভীর মহাশব্দের মত কে কথা কহিল? আমার কর্ণবিবর যে ভরিয়াগেল! আজি কে আমা হেন মন্দভাগিনীকে সহসা আহ্লাদিত কলিল?” দেখিয়া তমসার চক্ষু জ্বলে ভরিয়া গেল। তমসা বলিলেন, “কেন বাছা একটা অপরিস্ফুট শব্দ শুনিয়া মেঘের ডাকে ময়ূরীর মত চাকিয়া উঠিলি?” সীতা বলিলেন, “কি বলিলে ভগবতি? অপরিস্ফুট? আমি যে স্বরেই চিনেছি আমার সেই আর্য্যপুত্ত্র কথা কহিতেছেন।” তমসা তখন দেখিলেন, আর লুকান বৃথা—বলিলেন, “শুনিয়াছি মহারাজ রামচন্দ্র কোন শূদ্র তাপসের দণ্ড জন্য এই জনস্থানে আসিয়াছেন।” শুনিয়া সীতা কি বলিলেন? বার বৎসরের পর স্বামী নিকটে, নয়নের পুত্তলীর অধিক প্রিয়, হৃদয়ের শোণিতেরও অধিক প্রিয়, সেই স্বামী আজি বার বৎসরের পর নিকটে, শুনিয়া সীতা কি বলিলেন? শুনিয়া সীতা কিছুই আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন না—“কই স্বামী—কোথায় সে প্রাণাধিক?” বলিয়া দেখিবার জন্য তমসাকে উৎপীড়িতা করিলেন না, কেবল বলিলেন—

 “দিঠ্‌ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মোক্‌ খুসো রাআ।”—“সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্ম পালনে ত্রুটি হইতেছে না।”

 যে কোন ভাষায় যে কোন নাটকে যাহা কিছু আছে, এতদংশ সৌন্দর্য্যে তাহার তুল্য, সন্দেহ নাই। “দিঠ্‌ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মোক্ খু সো রাআ।” এই রূপ বাক্য কেবল সেক্ষপীয়রেই পাওয়া যায়। রাম আসিয়াছেন শুনিয়া সীতা আহ্লাদের কথা কিছুই বলিলেন না, কেবল বলিলেন, “সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্ম পালনে ত্রুটি হইতেছে না।” কিন্তু দূর হইতে রামের সেই বিরহক্লিষ্ট প্রভাতচন্দ্রমণ্ডলবৎ আকার দেখিয়া, “সখি, আমায় ধর” বলিয়া তমসাকে ধরিয়া বসিয়া পড়িলেন। এ দিকে রাম পঞ্চবটী দেখিতে২, সীতাবিরহপ্রদীপ্তানলে পুড়িতে২, “সীতে! সীতে!” বলিয়া ডাকিতে২, মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। দেখিয়া সীতাও উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া তমসার পদ প্রান্তে পতিত হইয়া ডাকিলেন, “ভগবতি তমসে! রক্ষা কর! রক্ষা কর! আমার স্বামীকে বাঁচাও!”

 তমসা বলিলেন, “তুমিই বাঁচাও। তোমার স্পর্শে উনি বাঁচিতে পারেন। শুনিয়া সীতা বলিলেন, “যা হউক তা হউক, আমি তাহাই করিব!” এই বলিয়া সীতা রামকে স্পর্শ করিলেন।[২৫] রাম চেতনা প্রাপ্ত হইলেন।

 পরে সীতার পূর্ব্বকালের প্রিয়সখী, বনদেবতা বাসন্তী, সীতার পুত্ত্রীকৃত করিশাবকের সহায়ান্বেষণ করিতে২ সেইখানে উপস্থিত হইলেন। রামের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হওয়ায়, রাম করিশিশুর রক্ষার্থ গেলেন। সেই হস্তিশিশু স্বয়ং শত্রুজয় করিয়া করিণীর সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল। তদ্বর্ণনা অস্তি মধুর।

যেনোদ্গচ্ছদ্বিসকিশসয়স্নিগ্ধ দন্তাঙ্কুরেণ
ব্যারূষ্টস্তে সুতনু লবলীপল্লবঃ কর্ণপূবাৎ।
সোয়ং পুত্ত্রস্তব মদমুচাং বারণানাং বিজেতা
যং কল্যাণং বয়সি তরুণে ভাজনং তস্য জাতঃ।
সখি বাসন্তি পশ্য পশ্য কান্তানুবৃত্তিচাতুর্য্য মপি শিক্ষিতং বৎসেন।
লীলোৎখাতমৃণালকাণ্ডকবলচ্ছেদেষু সম্পাদিতাঃ
পুষ্পেৎ পুষ্করবাসিতস্য পয়সো গণ্ডূসসংক্রান্তঃ।

সেকঃ শীকরিণা করেণ বিহিতং কামং বিরামে পুনর্যৎস্নেহাদনরালনালনলিনী পত্রাতপত্রং ধৃতম্।[২৬]

 এদিকে পুত্ত্রীকৃত করী দেখিয়া সীতার গর্ভজপুত্ত্রদিগকে মনে পড়িল। কেবল স্বামিদর্শনে বঞ্চিতা নহেন,—পুত্ত্রমুখ দর্শনেও বঞ্চিতা। সেই মাতৃমুখনির্গত পুত্ত্রমুখস্মৃতিবাক্য উদ্ধৃত করিয়া অদ্য বিরত হইব।

মমপুত্তকাণং ইসিবিরলকোমলধঅলদসণুজ্জল কবোলং অণুবদ্ধ মুদ্ধকাঅলিবিহসিদং ণিবন্ধকাঅসিহন্তঅং অমলমূহপুণ্ডরীঅজুঅলং ণ পরিচুম্বিদং অজ্জউত্তেণ।[২৭]

 সেই গোদবরীশীকরশীতল শঞ্চবটী বনে, রাম, বাসন্তীর আহ্বানে উপবেশন করিলেন। দূরে, গিরিগহ্বরগত গোদাবরীর বারিরাশির গদ্গদ নিনাদ শুনা যাইতেছে। সম্মুখে পরস্পর প্রতিঘাতসঙ্কুল উত্তাল তরঙ্গ সরিৎসঙ্গম দেখা যাইতেছে। দক্ষিণে শ্যামচ্ছবি অনন্ত কাননশ্রেণী চলিয়া গিয়াছে। চারিদিকে সীতার পূর্ব্বসহবাসচিহ্ন সকল বিদ্যমান রহিয়াছে। তথায়, একটি কদলীবনমধ্যবর্ত্তী শীলাতলে, পূর্ব্বপ্রবাসকালে, রাম সীতার সঙ্গে শয়ন করিতেন; সেইখানে বসিয়া সীতা হরিণশিশুগণকে তৃণ খাওয়াইতেন; এখনও হরিণেরা সেই প্রেমে সেইখানে ফিরিয়া বেড়াইতেছে। বাসন্তী সেইখানে রামকে বসিতে বলিলেন। রাম সেখানে না বসিয়া, অন্যত্র উপবেশন করিলেন। সীতা, পূর্ব্বে পঞ্চবটী বাসকালে একটি ময়ূরশিশু প্রতিপালন করিয়াছিলেন। একটি কদম্ববৃক্ষ সীতা স্বহস্তে রোপণ করিয়া, স্বয়ং বর্দ্ধিত করিয়াছিলেন। রাম দেখিলেন, যে সেই কদম্ববৃক্ষে দুই একটি নবকুসুমোদ্গম হইয়াছে। তদুপরি আরোহণ করিয়া সীতাপালিত সেই ময়ূরটি নৃত্যান্তে ময়ূরী সঙ্গে রব করিতেছিল। বাসন্তী রামকে সেই ময়ূরটী দেখাইলেন। দেখিয়া রামের মনে পড়িল, সীতা তাহাকে করতালী দিয়া নাচাইতেন, নাচাইবার সময়ে তালের সহিত সীতার চক্ষুও পল্লবমধ্যে ঘুরিত। এইরূপে বাসন্তী রামকে পূর্ব্বস্মৃতিপীড়িত করিয়া,—সখীনির্ব্বাসনজনিত রাগেই এইরূপে পীড়িত করিয়া, প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! কুমার লক্ষ্মণ ভাল আছেন ত?” কিন্তু সেকথা রামের কানে গেল না—তিনি সীতাকরকমলবিকীর্ণ জলে পরিবর্দ্ধিত বৃক্ষ, সীতাকরকমলবিকীর্ণ নীবারে পুষ্ট পক্ষী, সীতাকরকমলবিকীর্ণ তৃণে প্রতিপালিত হরিণগণকেই দেখিতেছিলেন। বাসন্তী আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! কুমার লক্ষ্মণ কেমন আছেন?” এবার রাম কথা শুনিতে পাইলেন, কিন্তু ভাবিলেন, বাসন্তী “মহারাজ!” বলিয়া সম্বোধন করিলেন কেন? এ ত নিষ্প্রণয় সম্বোধন। আর কেবল কুমার লক্ষ্মণের কথাই জিজ্ঞাসিলেন, তবে বাসন্তী সীতাবিসর্জ্জনবৃত্তান্ত জানেন। রাম প্রকাশ্যে কেবল বলিলেন, “কুমারের কুশল,” এই বলিয়া নীরবে রোপন করিতে আসিলেন। বাসন্তী তখন মুক্তকণ্ঠা হইয়া কহিলেন, “দেব! কঠিন হইলে কি প্রকারে?

ত্বং জীবিতং ত্বমসি মে হৃদয়ং দ্বিতীয়ং
ত্বং কৌমুদী নয়নয়োরমৃতং ত্বমঙ্গে।

 তুমি আমার জীবন, তুমি আমার দ্বিতীয় হৃদয়, তুমি নয়নের কৌমুদী, অঙ্গে তুমি আমার অমৃত,—এইরূপ শত২ প্রিয় সম্বোধনে যাহাকে ভুলাইতে তাহাকে—” বলিতে২ সীতাস্মৃতিমুগ্ধা বাসন্তী আর বলিতে পারিলেন না। অচেতন হইলেন। রাম তাঁহাকে আশ্বস্তা করিলেন। চেতনা পাইয়া বাসন্তী কহিলেন “আপনি কেমন করিয়া একাজ করিলেন?”

 রাম। লোকে বুঝে না বলিয়া।

 বাসন্তী। কেন বুঝে না!

 রাম। তাহারাই জানে।

 তখন বাসন্তী আর সহিতে পারিলেন না। বললেন, “নিষ্ঠুর। দেখিতেছি, কেবল যশঃ তোমার অত্যন্ত প্রিয়!”

 এই কথোপকথনের প্রশংসা করা বৃথা। সীতাবিসর্জ্জন জন্য বাসন্তী রামপ্রতি ক্রোধযুক্তা হইয়াছিলেন, তিনি মানসিক যন্ত্রণাস্বরূপ সেই অপরাধের দণ্ড প্রণীত করিলেন; সহজেই রামের শোকসাগর উছলিয়া উঠিল। রামের যে একমাত্র শোকোপশমের উপায় ছিল—আত্মপ্রসাদ,—তাহাও বিনষ্ট করিলেন। রাম জানিতেন যে তিন প্রজারঞ্জনরূপ কুলধর্ম্মের রক্ষার্থই সীতাবিসর্জ্জনরূপ মর্ম্মচ্ছেদী কার্য্য করিয়াছেন।— মর্ম্মচ্ছেদ হউক, ধর্ম্ম রক্ষা হইয়াছে। বাসন্তী দেখিলেন যে সে ধর্ম্মরক্ষা কেবল স্বার্থপরতার পৃথক্ একটি নামমাত্র। সে কুলধর্ম্ম রক্ষার বাসনা কেবল রূপান্তরিত যশোলিপ্সা মাত্র। কেবল যশোলাভের স্বার্থপর বাসনার বশবর্ত্তী হইয়া রাম এই কাজ করিয়াছেন। বাসন্তী আরও লেখিলেন যে, যে যশের আকাঙ্ক্ষায় তিনি এই নিষ্ঠুর কার্য্য করিয়াছিলেন, সে আকাঙ্ক্ষাও ফলবতী হয় নাই। তিনি এই প্রকার যশের লাভ লালসার পত্নীবধরূপ গুরুতর অপযশের ভাগী হইয়াছেন। বনমধ্যে সীতার কি হইল, তাহার স্থিরতা কি? ইহার অপেক্ষা গুরুতর অপযশ আর কি হইতে পারে?

 তখন রামের শোকপ্রবাহ আবার অসম্বরণীয় বেগে ছুটিল। সীতার সেই জ্যোৎস্নাময়ী মৃদুমুগ্ধমৃণালকল্প দেহলতিকা কোন হিংস্র পশু কর্ত্তৃক বিনষ্ট হইয়াছে, সন্দেহ নাই। এই ভাবিয়া বাম “সীতে! সীতে!” বলিয়া সেই অরণ্যমধ্যে রোদন করিতে লাগিলেন। কখন বা, যে কলঙ্ককুৎসাকারক পৌরজনের কথায় সীতাবিসর্জ্জন করিয়াছিলেন, তাহাদিগের উদ্দেশে বলিতে লাগিলেন, “আমি অনেক সহ্য করিয়াছি, আমার প্রতি প্রসন্ন হও।” বাসন্তী, ধৈর্য্যবলম্বন করিতে বলিলেন। রাম বলিলেন, “সখি, আবার ধৈর্য্যের কথা কি বল? আজি দ্বাদশ বৎসর সীতাশূন্য জগৎ—সীতা নাম পর্য্যন্ত লুপ্ত হইয়াছে—তথাপি বাঁচিয়া আছি—আবার ধৈর্য্য কাহাকে বলে?” রামের অত্যন্ত যন্ত্রণা দেখিয়া বাসন্তী তাঁহাকে জনস্থানের অন্যান্য প্রদেশ দেখিতে অনুরোধ করিলেন। রাম উঠিয়া পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বাসন্তীর মনে সখীবিসর্জ্জন দুঃখ জ্বলিতেছিল—কিছুতেই ভুলিলেন না। বাসন্তী দেখাইলেন;—

অস্মিশ্নেব লতাগৃহে ত্বমভবন্তন্মার্গ দত্তেক্ষণঃ
সা হংসৈঃ কৃতকৌতুকা চিরমভূদ্গোদাবরী সৈকতে।
আয়ান্ত্যা পরিদুর্ম্মনাম্বিতমিব ত্বাং বীক্ষ্য বদ্ধ স্তয়া
কাতর্ধাদরবিন্দকুট্নর্ণানঙ্কোমুগ্ধঃপ্রণামাঞ্জলিঃ।[২৮]

 আর রাম সহ্য করিতে পারিলেন না। ভ্রান্তি জন্মিতে লাগিল। তখন উচ্চৈঃস্বরে রাম ডাকিতে লাগিলেন, “চণ্ডি জানকি, এই যে চারিদিকে তোমাকে দেখিতেছি—কেন দয়া কর না? আমার বুক ফাটিতেছে। দেহবন্ধ ছিঁড়িতেছে, জগৎ শূন্য দেখিতেছি। নিরন্তর অন্তর জ্বলিতেছে; আমার বিকল অন্তরাত্মা অবসন্ন হইয়া অন্ধকারে ডুবিতেছে; মোহ আমাকে চারিদিক্ হইতে আচ্ছন্ন করিতেছে; আমি মন্দভাগ্য—এখন কি করিব?” বলিতে২ রাম মুর্চ্ছিত হইলেন।

 ছায়ারূপিণী তমসার সঙ্গে আদ্যোপান্ত নিকটে ছিলেন। বাসন্তী রামকে সীতা পীড়িত করিতেছেন দেখিয়া, সীতা পুনঃ২ তাঁহাকে তিরস্কার করিতেছিলেন—কতবার রামের রোদন শুনিয়া আপনি মর্ম্মপীড়িত হইতেছিলেন, আবার সীতা রাম চন্দ্রের দুঃখের কারণ হইলেন বলিয়া, কত কাতরোক্তি করিতেছিলেন। আবার রামকে মুর্চ্ছিত দেখিয়া সীতা কাঁদিয়া উঠিলেন, “আর্য্যপুত্র। তুমি যে সকল জীবলোকের মঙ্গলাধার! তুমি এ মন্দভাগিনীকে মনে করিয়া বার২ সংশয়িতজীবন হইতেছ? আমি যে মলেম।” এই বলিয়া সীতাও মুর্চ্ছিতা প্রায়। তমসা এবং বাসন্তী তাঁহাকে উঠাইলেন। সীতা সসম্ভ্রমে রামের ললাট স্পর্শ করিলেন। কি স্পর্শসুখ! রাম যদি মৃৎপিণ্ড হইয়া থাকিতেন, তাহা হইলেও তাঁহার চেতনা হইত। আনন্দনিমিলিতলোচনে স্পর্শসুখ অনুভব করিতে লাগিলেন, তাহার শরীরধাতু অন্তরে বাহিরে অমৃতময় প্রলেপে যেন লিপ্ত হইল—জ্ঞান লাভ করিলেও আনন্দেতে আর এক প্রকার মোহ তাঁহাকে অভিভূত করিল। রাম বাসন্তীকে বলিলেন, “সখি বাসন্তি। বুঝি অদৃষ্ট প্রসন্ন হইল!”

 বাসন্তী। কিসে?

 রাম। আর কি সখি! সীতাকে পাইয়াছি।

 বাসন্তী। কৈ তিনি?

 রাম। এই যে আমার সম্মুখেই রহিয়াছেন।

 বাসন্তী। মর্ম্মভেদী প্রলাপ বাক্যে আমি একে প্রিয়সখীর দুঃখে জ্বলিতেছি, তাহাতে আবার এমনতর এ হতভাগিনীকে কেন জ্বালাইতেছেন?

 রাম বলিলেন, “সখি, প্রলাপ কই? বিবাহকালে বৈবাহিক মঙ্গল সূত্রযুক্ত যে হাত আমি ধরিয়াছিলাম— আর যে হাতে অমৃতশীতল স্বেচ্ছালব্ধ সুখস্পর্শে চিনিতে পারিতেছি, এ ত সেই হাত! সেই তুহিন সদৃশ, বর্ষাকরকতুল্য শীতল কোমল লবলী বৃক্ষের নবাঙ্কুর তুল্য হস্তই আমি পাইয়াছি!

 এই বলিয়া রাম তাঁহার ললাটস্থ সীতার অদৃশ্য হস্ত গ্রহণ করিলেন। সীতা ইতিপূর্ব্বেই রামের আনন্দমোহ দেখিয়া অপসৃত হইবেন বিবেচনা করিয়াছিলেন; কিন্তু সেই চিরসদ্ভাবসৌম্য শীতল স্বামিস্পর্শে তিনিও মুগ্ধা হইলেন; অতি যত্নে সেই রামললাটস্থিতহস্তকে ধরিয়া রাখিলেও সে হস্ত কাঁপিতে লাগিল, ঘামিতে লাগিল, এবং জড়বৎ হইয়া অবশ হইয়া আসিতে লাগিল! যখন রাম, সীতার হস্তের চিরপরিচিত অমৃতশীতল সুখস্পর্শের কথা বলিলেন, সীতা মনে২ বলিলেন, “আর্য্যপুত্ত্র, আজিও তুমি সেই আর্য্যপুত্ত্রই আছ!” শেষে যখন রাম সীতার কর গ্রহণ করিলেন, তখন সীতা দেখিলেন স্পর্শ মোহে প্রমাদ ঘটিল। কিন্তু রাম সে হাত ধরিয়া রাখিতে পারিলেন না, আনন্দে তাঁহার ইন্দ্রিয় সকল অবশ হইয়া আসিয়াছিল, তিনি বাসন্তীকে বলিলেন, “সখি, তুমি একবার ধর।” সীতা সেই অবকাশে হাত ছাড়াইয়া লইলেন। লইয়া, স্পর্শসুখজনিত স্বেদরোমাঞ্চকম্পিতকলেবরা হইয়া পবনকম্পিত নবজলকণাসিক্ত স্ফুটকোরক কদম্বের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। মনে করিলেন, “কি লজ্জা, তমসা দেখিয়া কি মনে করিতেছেন। ভাবিতেছেন, এই ইহাকে ত্যাগ করিয়াছেন, আবার ইহার প্রতি এই অনুরাগ।”

 রাম ক্রমে জানিতে পারিলেন, যে কই, কোথা সীতা— সীতা ত নাই। তখন রামের শোকপ্রবাহ দ্বিগুণ ছুটিল। রোদন করিয়া, ক্রমে শান্ত হইয়া বাসন্তীকে বলিলেন, “আর কতক্ষণ তোমাকে কাঁদাইব? আমি এখন যাই।” শুনিয়া সীতা উদ্বেগের সহিত তমসাকে অবলম্বন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভগবতি তমসে! আর্য্যপুত্ত্র যে চলিলেন?” তমসা বলিলেন, “চল, আমরাও যাই।” সীতা বলিলেন, “ভগবতি ক্ষমা কর! আমি ক্ষণকাল এই দুর্ল্লভ জনকে দেখিয়া লই।” কিন্তু বলিতে২ এক বজ্রতুল্য কঠিন কথা সীতার কানে গেল, রাম বাসন্তীর নিকট বলিতেছেন, “অশ্বমেধের জন্য আমার এক সহধর্ম্মিণী আছে—” সহধর্ম্মিণী! সীতা কম্পিতকলেবরা হইয়া মনে২ বলিলেন, “আর্য্যপুত্ত্র! কে সে?” এই অবসরে রামও কথা সমাপ্ত করিলেন, “সে সীতার হিরণ্ময়ী প্রতিকৃতি।” শুনিয়া সীতার চক্ষের জল পড়িতে লাগিল; বলিলেন, “আর্য্যপুত্ত্র! এখন তুমি তুমি হইলে। এতদিনে আমার পরিত্যাগ লজ্জাশল্য বিমোচন করিলে!” রাম বলিতেছেন, “তাহারই দ্বারা আমার বাষ্পদিপ্ত চক্ষুর বিনোদন করি।” শুনিয়া সীতা বলিলেন, “তুমি যার এত আদর কর, সেই ধন্য। তোমার যে বিনোদন করে সেই ধন্য। সে জীবলোকের আশানিবন্ধন হইয়াছে।”

 রাম চলিলেন। দেখিয়া সীতা করযোড়ে, “ণমো ণমো অপূর্ব্বপুণ্ণজণিদদংসণাণং অজ্জউত্তচরণকমলাণং” এই বলিয়া প্রণাম করিতে মুর্চ্ছিতা হইয়া পড়িলেন। তমসা তাঁহাকে আশ্বস্ত করিলেন। সীতা বলিলেন, “আমার এ মেঘান্তরে ক্ষণকালজন্য পুর্ণিমাচন্দ্র দেখা মাত্র!”

 তৃতীয়াঙ্কের সার মর্ম্ম এই। এই অঙ্কের অনেক দোষ আছে। ইহা নাটকের পক্ষে নিতান্ত অনাবশ্যক। নাটকের যাহা কার্য্য, বিসর্জ্জনান্তে রাম সীতার পুনর্ম্মিলন, তাহার সঙ্গে ইহার কোন সংশ্রব নাই। এই অঙ্ক পরিত্যক্ত হইলে নাটকের কার্য্যের কোন হানি হয় না। সচরাচর এরূপ একটি সুদীর্ঘ নাটকাঙ্ক নাটক মধ্যে সন্নিবেশিত হওয়া, বিশেষ রসভঙ্গের কারণ হয়। যাহা কিছু নাটকে প্রতিকৃত হইবে, তাহা উপসংহতির উদ্যোজক হওয়া উচিত। এই অঙ্ক কোন অংশে তদ্রূপ নহে। বিশেষ, ইহাতে রামবিলাপের দৈর্ঘ্য এবং পৌনঃপুন্য অসহ্য। তাহাতে রচনাকৌশলের বিপর্য্যয় হইয়াছে। কিন্তু অনেকেই মুক্তকণ্ঠে বলিবেন, যে অন্য অনেক নাটক একবারে বিলুপ্ত হয়, বরং তাহাও স্বীকর্ত্তব্য, তথাপি উত্তরচরিতের এই তৃতীয়াঙ্ক ত্যাগ করা যাইতে পারে না। নাটকাংশে ইহা যতই দুষ্য হউক না কেন, কাব্যাংশে ইহার তুল্য রচনা অতি দুর্ল্লভ

 উত্তরচরিত সমালোচন ক্রমে এত দীর্ঘায়ত হইয়া উঠিয়াছে, যে আর ইহাতে অধিক স্থান নিয়োগ করা কর্ত্তব্য নহে। অতএর অবশিষ্ট কয় অঙ্কের সমালোচনা অতি সংক্ষেপে করিব।

 এদিকে বাল্মীকি প্রচার করিলেন যে তিনি এক অভিনব নাটক রচনা করিয়াছেন। তদভিনয় দর্শন জন্য সকল লোককে নিমন্ত্রিত করিলেন। তদ্দর্শনার্থ বশিষ্ঠ, অরুন্ধতী, কৌশল্যা, জনক, প্রভৃতি বাল্মীকির আশ্রয়ে আসিয়া সমবেত হইলেন। তথায় লবের সুন্দর কান্তি এবং রামের সহিত সাদৃশ্য দেখিয়া কৌশল্যা অত্যন্ত ঔৎসুক্যপরবশ হইয়া, তাঁহার সহিত আলাপ করিলেন। দুহিতৃবিয়োগে জনকের শোক ক্লিষ্টদশা, কৌশল্যার সহিত তাঁহার আলাপ, লবের সহিত কৌশল্যার আলাপ, ইত্যাদি অতি মনোহর, কিন্তু সে সকল উদ্ধৃত করিবার আর অবকাশ নাই।

 চন্দ্রকেতু, অশ্বমেধের অশ্বরক্ষক সৈন্য লইয়া বাল্মীকির আশ্রম সন্নিধানে উপনীত হইলেন। তাঁহার অবর্ত্তমানে সৈন্যদিগের সহিত লবের বচসা হওয়ায় লব অশ্ব হরণ করিলেন, এবং যুদ্ধে চন্দ্রকেতুর সৈন্যদিগকে পরাস্ত করিলেন। চন্দ্রকেতু আসিয়া তাহাদিগের রক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। চন্দ্রকেতু এবং লব পরস্পরের প্রতি বিপক্ষতাচরণ কালে এত দূর উভয়ে উভয়ের প্রতি সৌজন্য এবং সদ্ব্যবহার করিলেন যে ইহা, নাটকের এতদংশ পড়িয়া বোধ হয় যে, সভ্যতার চূড়াপদবাচ্য কোন ইউরোপীয় জাতি কর্ত্তৃক প্রণীত হইয়াছে। ভবভূতির সময়ে ভারতবর্ষীয়েরা সামাজিক ব্যবহার সম্বন্ধে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করিরাছিলেন, ইহা তাহার এক প্রমাণ।

 আকাশে যেরূপ নক্ষত্র ছড়ান, ভবভূতির রচনা মধ্যে সেইরূপ কবিরত্ন ছড়ান আছে। চতুর্থ এবং পঞ্চম অঙ্ক হইতে এই সকল রত্ন আহরণ করিতে পারিলাম না, তথাপি পঞ্চম হইতে দুই একটি উদাহরণ না দিয়া থাকিতে পারা যায় না। লব চন্দ্রকেতুর সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন, এমন সময়ে চন্দ্রকেতু তাঁহাকে যুদ্ধে আহ্বান করাতে তাহাদিগকে ত্যাগ করিয়া চন্দ্রকেতুর দিকে ধাবমান হইলেন, “তনয়িত্নুরবাদিভাবলীনামবমর্দ্দাদিব দৃপ্ত সিংহশাবঃ।”[২৯] তিনি চন্দ্রকেতুর দিকে আসিতেছেন, পরাজিত সৈন্যগণ তখন তাঁহার পশ্চাৎ ধাবিত হইতেছে;—

দর্পেণ কৌতুকবতা ময়ি বদ্ধলক্ষ্যঃ
পশ্চাদ্বলৈরনুসূতোঽয়মুদীর্ণধন্বা।
দ্বেধা সমুদ্ধতমরুত্তরলস্য ধত্তে
মেঘস্য মাঘবতচাপধরস্য লক্ষ্মীম্॥[৩০]

 নিঃসহায় পাদচারী বালকের প্রতি বহুসেনা ধাবমান দেখিয়া চন্দ্রকেতু তাহাদিগকে নিবারণ করিলেন। দেখিয়া লব ভাবিলেন, “কথমনুকম্পতে মাম্‌?” ভারতবর্ষীয় কোন গ্রন্থে এরূপ বাক্য প্রযুক্ত আছে, এ কথা অনেক ইউরোপীয় সহজে বিশ্বাস করিবেন না।

 লব কর্ত্তৃক জৃম্ভকাস্ত্র প্রয়োগ বর্ণনা অস্বাভাবিক, অতিপ্রাকৃত, এবং অস্পষ্ট হইলেও, আমরা তাহা উদ্ধৃত না করিয়া থাকিতে পারিলাম না;—

পাতালোদর কুঞ্জ পুঞ্জিততমঃশ্যামৈর্নভোজৃম্ভকৈ
রুত্তপ্তস্ফুরদার কূটকপিলজ্যোতির্জ্জলদ্দীপ্তিভিঃ।
কল্পাক্ষেপ কঠোরভৈরবমরুদ্ব্যস্তৈরবাকীর্য্যতে
মীলন্মেঘতড়িৎকড়ারকুহরৈর্বিন্ধ্যাদ্রিকূটৈরিব॥[৩১]

 লবের সহিত রামের রূপসাদৃশ্য দেখিয়া, সুমন্ত্রের মনে এক বার আশা জন্মিয়াই, সীতা নাই, এই কথা মনে পড়াতে সে আশা তখনই নিবারিত হইল। ভাবিলেন, “লতায়াং পূর্ব্বলূনায়াং প্রসূনস্যাগমঃ কুতঃ!” বৃদ্ধ সুমন্ত্রের মুখে এই বাক্য শুনিয়া, সহৃদয় পাঠকের রোমিও সম্বন্ধে বৃদ্ধ মণ্টাগুর মুখে কীটদংশিত কুসুমকোরকের উপমা মনে পড়িবে।

 ষষ্ঠাঙ্কের বিষ্কম্ভকটি বিশেষ মনোহর। বিদ্যাধরমিথুন গগনমার্গে থাকিয়া লবচন্দ্রকেতুর যুদ্ধ দেখিতেছিলেন। যুদ্ধে তাঁহাদিগের কথোপকথনে বর্ণিত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় লিখিয়াছেন যে, ভবভূতির কাব্যের “মধ্যে২ সংস্কৃতে এবং প্রাকৃতে এমত দীর্ঘ সমাসঘটিত রচনা আছে, তাহাতে অর্থ বোধ ও রসগ্রহ সম্বন্ধে ব্যাঘাত ঘটিয়া উঠে।” ভবভূতির অসাধারণ দোষ নির্ব্বাচনকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় এই কথা বলিয়াছেন।

 আমরা পূর্ব্বে যাহা উত্তরচরিত হইতে উদ্ধৃত করিয়াছি, তন্মধ্যে এইরূপ দীর্ঘ সমাসের অনেক উদাহরণ পাওয়া যাইবে। এই বিষ্কম্ভকমধ্যে ঐরূপ দীর্ঘ সমাসের বিশেষ আধিক্য। আমরা কয়েকটি উদ্ধৃত করিতেছি, যথা পুষ্পবৃষ্টি;—

 “অবিরলললিতবিকচকনককমল কমনীয় সন্ততিঃ অমরতরুতরুণ মণিমুকুলনিকরমকরন্দসুন্দরঃ পুষ্পনিপাতঃ।”

 পুনশ্চ, বাণসৃষ্ট অগ্নি;—

 “উচ্চণ্ডবজ্রখণ্ডাবস্ফোটপটুতরস্ফুলিঙ্গবিকৃতিঃ উত্তালতুমুললেলিহানজ্বালাসম্ভারভৈরবো ভগবান্ উষর্ব্বুধঃ।”

 পুনশ্চ, বারুণাস্ত্র সৃষ্ট মেঘ;—

 “অবিরলবিলোলধুম্মন্তবিজ্জুল্লদাবিলাসমণ্ডিদেহিং মত্তমোরকণ্ঠসামলেহিং জলহরেহিং।”

 এবং তৎকালে সৃষ্টির অবস্থা;—

 “প্রবলবাতাবলিক্ষোভগম্ভীরগুণগুণায়মানমেঘমেদুরান্ধকারনীরন্ধ্রনিবদ্ধম্ একবারবিশ্বগ্রসনবিকচবিকরালকালকণ্ঠকণ্ঠকন্দরবিবর্ত্তমানমিব যুগান্তযোগনিদ্রানিরুদ্ধসর্ব্বদ্বারনারায়ণোদরনিবিষ্টমিব ভূতজাতং প্রবেপতে।”

 ঈদৃশ দীর্ঘ সমাস যে রচনা দোষমধ্যে গণ্য, তাহা আমরা স্বীকার করি। যাহা কিছুতে অর্থ বোধের বিঘ্ন হয়, তাহাই দোষ। ঈদৃশ সমাসে অর্থবোধের হানি, সুতরাং ইহা দোষ। নাটকে ইহা যে বিশেষ দোষ, তাহাও স্বীকার করি; কেন না ইহাতে নাটকের অভিনয়োপযোগিতার হানি হয়। তথাপি ভবভূতির এই কয় সমাসের মধ্যে যে কবিত্ব শক্তি আছে, রত্নাওলী নাটকের একটি সমগ্র অঙ্কমধ্যে তাহা আছে কি না, সন্দেহ।

 লব ও চন্দ্রকেতু যুদ্ধ করিতেছিলেন, এমন সময়ে রাম সেই স্থানে উপনীত হইলেন। তিনি উভয়কে যুদ্ধ করিতে নিরস্ত করিলেন। লব তাঁহাকে রাজা রামচন্দ্র বলিয়া জানিতে পারিয়া, ভক্তিভাবে প্রণাম ও নম্রভাবে তাঁহার সহিত আলাপ করিলেন। কুশও যুদ্ধসম্বাদ শুনিয়া সে স্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং লব কর্ত্তৃক উপদিষ্ট হইয়া রামের সহিত সেইরূপ ব্যবহার করিলেন। রাম উভয়কে সস্নেহে আলিঙ্গন এবং পিতৃযোগ্য প্রণয়সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। পরে সকলে, বাল্মীকির আশ্রমে, তৎপ্রণীত নাটকাভিনয় দেখিতে গেলেন।

 তথায় রামানুজ্ঞাক্রমে লক্ষ্মণ দ্রষ্টৃবর্গকে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, পৌরগণ, জনপদবাসী প্রজা, ও দেবাসুর এবং ইতর জীব স্থাবর জঙ্গম সকলে ঋষিপ্রভাববলে সমাগত হইয়া, লক্ষ্মণ কর্ত্তৃক যথা স্থানে সন্নিবেশিত হইলেন। পরে অভিনয়ারম্ভ হইল। রাম ও লবকুশ দ্রষ্টৃ বর্গ মধ্যে ছিলেন।

 সীতা বিসর্জ্জন বৃত্তান্তই এই অদ্ভুত নাটকের প্রথমাংশ। সীতা লক্ষ্মণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইলে, তাঁহার কাতরতা, গঙ্গাপ্রবাহে দেহসমর্পণ, তন্মধ্যে যমলসন্তান প্রসব, গঙ্গা এবং পৃথিবী কর্ত্তৃক তাঁহার ও শিশুদিগের রক্ষা ও তৎসঙ্গে সীতার প্রস্থান ইত্যাদি অভিনীত হইল। দেখিয়া রাম মুর্চ্ছিত হইলেন। তখন লক্ষ্মণ উচ্চৈঃস্বরে বাল্মীকিকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভগবন! রক্ষা করুন! আপনার কাব্যের কি মর্ম্ম?” নটদিগকে বলিলেন, “তোমরা অভিনয় বন্ধ কর।”

 তখন সহসা দেবর্ষি কর্ত্তৃক অন্তরীক্ষ ব্যপ্ত হইল। গঙ্গার বারিরাশি মথিত হইল। ভাগীরথী এবং পৃথিবীর সহিত জল মধ্য হইতে উঠিলেন—কে? স্বয়ং সীতা। দেখিয়া লক্ষণ বিস্মিত এবং আহ্লাদিত হইয়া রামকে ডাকিলেন, “দেখুন! দেখুন!” কিন্তু রাম তখনও অচেতন। তখন সীহা অরুন্ধতী কর্ত্তৃক আদিষ্টা হইয়া রামকে স্পর্শ করিলেন। বললেন, “উঠ আর্য্য পুত্ত্র!”

 রাম চেতনা প্রাপ্ত হইলেন। পরে যাহা ঘটিল, বলা বাহুল্য। সেই সর্ব্বলোক সমারোহ সমক্ষে সীতার সতীত্ব দেবগণকর্ত্তৃক স্বীকৃত হইল। দেববাক্যে প্রজাগণ বুঝিল। সীতা লবকুশকেও পাইলেন। রামও তাঁহাদিগকে পুত্ত্র বলিয়া চিনিলেন। পরে সপুত্ত্রা ভার্য্যা গৃহে লইয়া গিয়া সুখে রাজ্য করিতে লাগিলেন।

 নাটকের ভিতর এই নাটকখানি যিনি অভিনীত দেখিবেন বা পাঠ করিবেন, তিনিই যে অশ্রুপাত করিবেন, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। কিন্তু আমরা এতদংশ উদ্ধৃত করিলাম না। এই উপসংহার অপেক্ষা রামায়ণের উপসংহার অধিকতর মধুর এবং করুণ রসপূর্ণ। আমরা পাঠকের প্রীত্যর্থে তাহাই উদ্ধৃত করিতে বাসনা করি। বাল্মীকি কর্ত্তৃক সীতা অযোধ্যায় আনীত হয়েন। যে সূচনায় ঋষি সীতাকে আনয়ন করেন, তদ্বিশেষ বঙ্গীয় পাঠকমাত্রেই “সীতার বনবাস” পাঠ করিয়া অবগত আছেন।—সতীত্ব সম্বন্ধে শপথ করিলে সীতাকে গ্রহণ করিবেন, রাম এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। এই কথা প্রচার হইলে পর, সীতাশপথ দর্শনার্থ বহুলোকের সমাগম হইল।

১০৯ সর্গ।

তস্যাং রজন্যাং ব্যুষ্টায়াং যজ্ঞবাটং গতোনৃপঃ
ঋষীন্ সর্ব্বান্ মহাতেজাঃ শব্দাপয়তি রাঘবঃ॥
বশিষ্ঠো বামদেবশ্চ জাবালিরথকাশ্যপঃ।
বিশ্বামিত্রোদীর্ঘতপা দুর্ব্বাসাশ্চ মহাতপাঃ॥
পুলস্ত্যোপিতথা শক্তির্ভার্গব শ্চৈব বামনঃ।
মার্কণ্ডেয়শ্চদীর্ঘায়ুমৌদ্গল্যশ্চ মহাযশাঃ॥
গর্গশ্চ চাবনশ্চৈব শতানন্দশ্চ ধর্ম্মবিৎ।
ভরদ্বাজশ্চ তেজস্বী অগ্নিপুত্ত্রশ্চসুপ্রভঃ॥
নারদঃ পর্ব্বতশ্চৈব গৌতমশ্চ মহাযশাঃ।
এতেচান্যেচবহবো মুনয়ঃ সংশিতব্রতাঃ॥
কৌতূহলসমাবিষ্টাঃ সর্ব্ব এব সমাগতাঃ।
রাক্ষসাশ্চ মহাবীর্য্যা বানরাশ্চ মহাবলাঃ॥
সর্ব্বএব সমাজগ্মু, মহাত্মানঃ কুতূহলাৎ।
ক্ষত্রিয়াযেচ শূদ্রাশ্চ বৈশ্যাশ্চৈব সহস্রশঃ॥
নানাদেশগতাশ্চৈব ব্রাহ্মণাঃ সংশিতব্রতাঃ।
সীতাশপথ বীক্ষার্থং সর্ব্বএব সমাগতাঃ॥
তদাসমাগতৎ সর্ব্ব মশ্মভূতমিবাচলং।
শ্রুত্বা মুনিবরন্তুর্ণং সসীতঃ সমুপাগমৎ॥
তমৃষিং পৃষ্ঠতঃ সীতা অন্বগচ্ছদবাঙ্মুখী।
কৃতাঞ্জলির্বাষ্পাকুলা কৃত্বা রামং মনোগতং॥

তাংদৃষ্টাশ্রুতিমায়াতীং ব্রহ্মণামনুগামিনীং।
বাল্মীকে পৃষ্ঠতঃসীতাং সাধুবাদোমহানভূৎ॥
ততোহলাহলশব্দঃ সর্ব্বেযামেবমাবভৌ।
দুঃখজন্মবিশালেন শোকেনাকুলিতাত্মনাং॥
সাধুরামেতি কেচিত্ত্র সাধুসীতেতি চাপরে।
উভাবেবচতত্রান্যে প্রেক্ষকাঃ সংপ্রচুক্রুশুঃ॥
ততোমধ্যেজনৌঘস্য প্রবিশ্য মুনিপুঙ্গবঃ।
সীতাসহারো বাল্মীকি রিতিহোবাচ রাঘবং॥
ইয়ং দাশরথে সীতা সুব্রতা ধর্ম্মচারিণী।
অপবাদাৎপরিত্যক্তা মমাশ্রম সমীপতঃ॥
লোকাপবাদ ভীতস্য তব রাম মহাব্রত।
প্রত্যয়ং দাস্যতে সীতা তামনুজ্ঞাতুমর্হসি॥
ই মৌতু জানকীপুত্ত্রা বুতৌচ যমজাতকৌ।
সুতৌ তবৈব দুর্দ্ধর্ষৌ সত্যমেতদ্ব্র বীমি তে॥
প্রচেতসোহং দশমঃ পুত্ত্রোরাঘবনন্দন।
নস্মরাম্যনৃতং বাক্যমিমৌতু তব পুত্ত্রকৌ॥
বহুবর্ষ সহস্রাণি তপশ্চর্য্যা ময়াকৃতা।
নোপাশ্নীরাংফলন্তস্যাদুষ্টেয়ং যদিমৈথিলী॥
মনসাকর্ম্মণা বাচা ভূতপূর্ব্বং নকিল্‌বিষং।
তস্যাহং ফলমশ্নামি অপাপা মৈথিলী যদি॥
অহং পঞ্চসু ভূতেষু মনঃ ষষ্ঠেষু রাঘব।
বিচিন্ত্য সীতাশুদ্ধেতি জগ্রাহ বননির্ঝরে॥
ইয়াশুদ্ধসমাচরা অপাপা গতিদেবতা।
লোকাপবাদ ভীতস্য প্রত্যয়ন্তব দাস্যতি॥
তস্মাদিয় নববরাত্মজ শুদ্ধভাবা।
দিব্যেনদৃষ্টি বিষয়েণ ময়া প্রদিষ্টা॥
লোকাপবাদ কলুষীকৃতচেতসা যৎ।
ত্যক্তাত্বয়া প্রিয়তমা বিদিতাপি শুদ্ধা॥

১১০ সর্গ।

বাল্মীকে নৈব মুক্তস্থ রাঘবঃ প্রত্যভাভাষত।
প্রাঞ্জলির্জগতো মধ্যে দৃষ্ট্বাতাং দেববর্ণিনীং॥

এবমেতন্মহাভাগ যথাবদসি ধর্ম্মবিৎ।
প্রত্যয়ন্তমমব্রহ্মংন্তববাক্যৈরকল্‌ময়ৈঃ॥
প্রত্যয়শ্চ পুরাদত্তো বৈদেহ্যা সুরসন্নিধৌ।
শপথশ্চকৃতস্তত্র তেন বেশ্ম প্রবেশিতা।
লোকাপবাদোবলবান্ যেন ত্যক্তাহিমৈথিলী।
সেয়ংলোকভয়াদ্ব্র ব্রহ্মন্নপাপেত্যভিজানতা
পরিত্যক্তা ময়া সীতা তদ্ভবান ক্ষন্তুমর্হতি।
জানামিচেমৌপুত্ত্রৌ মে যমজাতৌকুশীলবৌ॥
শুদ্ধায়াংজগতোমধ্যে বৈদেহ্যাং প্রীতিরস্তুমে।
অভিপ্রায়ন্তু বিজ্ঞায় রামস্য সুরসত্তমাঃ
সীতায়াঃ শপথে তস্মিন সর্ব্বএব সমাগতাঃ।
পিতামহং পুরস্কৃত্য সর্ব্বএব সমাগতাঃ॥
আদিত্যা বসবো রুদ্রা বিশ্বেদেবা মরুদ্গণাঃ।
সাধ্যাশ্চ দেবাঃ সর্ব্বে তে সর্ব্বেচ পরমর্ষয়ঃ।
নাগাঃসুপর্ণাঃ সিদ্ধাশ্চ তে সর্ব্বে হৃষ্টমানসাঃ
দৃষ্ট্বাদেবানৃষীংশ্চৈব রাঘবঃ পুনরব্রবীৎ।
প্রত্যয়োমে মুনিশ্রেষ্ঠ ঋধিবাকৈরকল্‌মসৈঃ॥
শুদ্ধায়াংজগতো মধ্যে বৈদেহ্যাংপ্রীতিরস্তমে।
সীতা শপথ সংভ্রান্তাঃ সর্ব্বএব সমাগতাঃ।
ততোবায়ুঃ শুভঃ পুণ্যো দিব্যগন্ধো মনোরমঃ!!
তংজননৌঘং সুরশ্রেষ্ঠো হ্লাদয়ামাস সর্ব্বতঃ॥
তদদ্ভুত মিবাচিন্ত্যং নিরৈক্ষন্ত সমাহিতাঃ।
মানবাঃ সর্ব্বরাষ্ট্রেভাঃপূর্ব্বং কৃতযুগে যথা॥
সর্ব্বান্ সমাগতান্ দৃষ্ট্বা সীতা কাষায়বাসিনী।
অব্রবীৎপ্রাঞ্জলি বাক্যমধোদৃষ্টিরবাঙ্মুখী
যথাহং রাখবাদন্যং মনসাপি নচিন্তয়ে।
তথা মে মাধবীদেবী বিবরং দাতুমর্হতি॥
মনসা কর্ম্মণা বাচা যথা রামং সমর্চ্চয়ে।
তথামে মাধবীদেবী বিবরং দাতুমর্হতি।
মথৈতৎসত্যমুক্তং মে বেদ্মি রামাৎপরং নচ।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি॥
তথাশপন্ত্যাং বৈদেহ্যাং প্রাদুরাসীত্তদদ্ভুতং।

ভূতলাদুত্থিতং দিব্যং সিংহাসনমনুত্তমং॥
ধ্রিরমানং শিরোভিস্তু নাগৈরমিতবিক্রমৈঃ।
দিব্যং দিব্যেন বপুষা দিব্যরত্ন বিভূষিতৈঃ॥
তস্মিংস্তু ধরণীদেবী বাহুভ্যাং গৃহ্যমৈথিলীং।
স্বাগতে নাভিনন্দৈানামাসনে চোপবেশয়ৎ॥
ভামাসনগতাং দৃষ্ট্বা প্রবিশন্তীং রসাতলং।
পুষ্পবৃষ্টিরবিছিন্না দিব্যা সীতামবাকিরৎ॥
সাধুকারশ্চ সুমহান্দেবানাং সহসোত্থিতঃ।
সাধুসাধ্বিতিবৈসীতে যস্যান্তে শীলমীদৃশং॥
এবং বহুবিধাবাচোহ্যন্তরীক্ষগতাঃ সুরাঃ।
ব্যাজহ্রুর্হৃষ্ট্র মনসো দৃষ্ট্বা সীতা প্রবেশনং॥
যজ্ঞবাট গতাশ্চাপি মুনয়ঃ সর্ব্বএবতে।
রাজানশ্চ নরব্যাঘ্রা বিস্মান্নোপরেমিরে॥
অন্তরীক্ষেচ ভূমৌচ সর্ব্বেস্থাবর জঙ্গমাঃ।
দানবাশ্চ মহাকায়াঃ পাতালে পন্নগাধিপাঃ॥
কেচিদ্বিনেদুঃসংহৃষ্টাঃ কেচিদ্ধ্যান পরায়ণাঃ।
কেচিদ্রামং নিরীক্ষন্তে কেচিৎ সীতামচেতসঃ॥
সীতা প্রবেশনং দৃষ্ট্বাতেষামাসীৎ সমাগমঃ।
তন্মুহূর্ত্ত মিবাত্যর্থং সমং সম্মোহিতংজগৎ॥[৩২]

 আমরা উত্তরচরিত নাটকের প্রকৃত সমালোচন করি নাই। পাঠকের সহিত আনুপূর্ব্বক নাটক পাঠ করিয়া যেখানেই ভাল লাগিয়াছে, তাহাই দেখাইয়া দিয়াছি। গ্রন্থের প্রত্যেক অংশ

পৃথক২ করিয়া পাঠককে দেখাইয়াছি। এরূপে গ্রন্থের প্রকৃত দোষগুণের ব্যাখা হয় না। এক২ খানি প্রস্তর পৃথক্২ করিয়া দেখিলে তাজমহলের গৌরব বুঝিতে পারা যায় না। একটি২ বৃক্ষ পৃথক্‌২ করিয়া দেখিলে উদ্যানের শোভা অনুভূত করা যায় না। এক একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করিয়া মনুষ্যমূর্ত্তির অনির্ব্বচনীয় শোভা বর্ণন করা যায় না। কোটি কলস জলের আলোচনায় সাগরমাহাত্ম্য অনুভূত করা যায় না। সেইরূপ কাব্যগ্রন্থের। এস্থান ভাল রচনা, এইস্থান মন্দ রচনা, এইরূপ তাহার সর্ব্বাংশের পর্য্যালোচনা করিলে প্রকৃত গুণাগুণ বুঝিতে পারা যায় না। যেমত অট্টালিকার সৌন্দর্য্য বুঝিতে গেলে সমুদয় অট্টালিকাটি এককালে দেখিতে হইবে, সাগর গৌরব অনুভূত করিতে হইলে, তাহার অনন্তবিস্তার এক কালে চক্ষে গ্রহণ করিতে হইবে, কাব্য নাটক সমালোচনও সেইরূপ। মহাভারত এবং রামায়ণের অনেকাংশ এমন অপকৃষ্ট, যে তাহা কেহই পড়িতে পারে না। যে আণুবীক্ষণিক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইবে, সে কখনই এই দুই ইতিহাসের বিশেষ প্রশংসা করিবে না কিন্তু মোটের উপর দেখিতে গেলে বলিতে হইবে, যে এই দুই ইতিহাসের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাব্য পৃথিবীতে বুঝি আর নাই।

 সুতরাং উত্তরচরিত সম্বন্ধে মোটের উপর দুই চারিটা কথা না বলিলে নয়। অধিক বলিবার স্থান নাই।

 কবির প্রধান গুণ, সৃষ্টিক্ষমতা। যে কবি সৃষ্টিক্ষম নহেন, তাঁহার রচনায় অন্য অনেক গুণ থাকিলেও বিশেষ প্রশংসা নাই। কালিদাসের ঋতুসংহার, এবং টমসনের তদ্বিষয়ক কাব্যে, উৎকৃষ্ট বাহ্য প্রকৃতির বর্ণনা আছে। উভয় গ্রন্থই আদ্যোপান্ত সুমধুর, প্রসাদগুণ বিশিষ্ট, এবং স্বভাবানুকারী। তথাপি এই দুই কাব্য প্রধান কাব্য বলিয়া গণ্য হইতে পারে না— কেন না তদুভয় মধ্যে সৃষ্টিচাতুর্য্য কিছুই নাই।

 সৃষ্টিক্ষমতা মাত্রই প্রশংসনীয় নহে। রেনল্‌ডস্ নামক ইংরাজি আখ্যায়িকালেখকের রচনা মধ্যে নূতন সৃষ্টি অনেক আছে। তথাপি ঐ সকলকে অতি অপকৃষ্ট গ্রন্থ মধ্যে গণনা করিতে হয়। কেন না সেই সকল সৃষ্টি স্বভাবানুকারিণী এবং সৌন্দর্য্যবিশিষ্টা নহে। অতএব কবির সৃষ্টি স্বভাবানুকারী এবং সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট না হইলে, কোন প্রশংসা নাই।

 সৌন্দর্য্য এবং স্বভাবানুকারিতা, এই দুয়ের একটি গুণ থাকিলেই, কবির সৃষ্টির কিছু প্রশংসা হইল বটে, কিন্তু উভয়গুণ না থাকিলে কবিকে প্রধান পদে অভিষিক্ত করা যায় না। আরব্য উপন্যাস বলিয়া যে বিখ্যাত আরব্য গ্রন্থের প্রচার হইয়াছে, তাল্লখকের সৃষ্টির মনোহারিত্ব আছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহাতে স্বভাবানুকারিতা না থাকায় “আলেফ লায়লা” পৃথিবীর অত্যুৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ মধ্যে গণ্য নহে।

 কেবল স্বভাবানুকারিণী সৃষ্টিরও বিশেষ প্রশংসা নাই। যেমন জগতে দেখিয়া থাকি, কবির রচনা মধ্যে তাহারই অবিকল প্রতিকৃতি দেখিলে কবির চিত্রনৈপুণ্যে প্রশংসা করিতে হয়, কিন্তু তাহাতে চিত্রনৈপুণ্যেরই প্রশংসা, সৃষ্টিচাতুর্য্যের প্রশংসা কি? আর তাহাতে কি উপকার হইল? যাহা বাহিরে দেখিতেছি, তাহাই গ্রন্থে দেখিলাম; তাহাতে আমার লাভ হইল কি? যথার্থ প্রতিকৃতি দেখিয়া আমোদ আছে বটে—কেবল স্বভাবসঙ্গতি গুণবিশিষ্টা সৃষ্টিতে সেই আমোদ মাত্র জন্মিয়া থাকে। কিন্তু আমোদ ভিন্ন অন্য লাভ যে কাব্যে নাই, সে কাব্য সামান্য বলিয়া গণিতে হয়।

 অনেকে এই কথা বিস্ময়কর বলিয়া বোধ করিবেন। কি এ দেশে, কি অসভ্য ইউরোপীয় জাতি মধ্যে, অনেক পাঠকেরই এইরূপ সংস্কার যে, ক্ষণিক চিত্তরঞ্জন ভিন্ন কাব্যের অন্য উদ্দেশ্য নাই। বস্তুতঃ অধিকাংশ কাব্যে (বিশেষতঃ গদ্য কাব্যে বা আধুনিক নবেলে) এই চিত্তরঞ্জন প্রবৃত্তিই লক্ষিত হয়—তাহাতে চিত্তরঞ্জন ভিন্ন গ্রন্থকারের অন্য উদ্দেশ থাকে না; এবং তাহাতে চিত্তরঞ্জনোপযোগিতা ভিন্ন আর কিছু থাকেও না। কিন্তু সে সকলকে উৎকৃষ্ট কাব্য বলিয়া গণা যাইতে পারে না।

 যদি চিত্তরঞ্জনই কাব্যের উদ্দেশ্য হইল, তবে বেন্থামের তর্কে দোষ কি?[৩৩] কাব্যের চিত্তরঞ্জন হয়, শতরঞ্চ খেলারও চিত্তরঞ্জন হয়। বরং অনেকেরই ঐবান্‌হো অপেক্ষা একবাজি শতরঞ্চ খেলায় অধিক আমোদ হয়। তবে তাঁহাদের পক্ষে কাব্য হইতে শতরঞ্চ উৎকৃষ্ট বস্তু? এবং স্কট্ কালিদাসাদি অপেক্ষা একজন পাকা খেলোয়ার বড় লোক? অনেকে বলিবেন যে, কাব্যপ্রদত্ত আনন্দ বিশুদ্ধ আনন্দ—সেই জন্য কাব্যের ও কবির প্রাধান্য। শতরঞ্চের আমোদ অবিশুদ্ধ কিসে?

 এরূপ তর্ক যদি অযথার্থ না হয়,তবে চিত্তরঞ্জন ভিন্ন কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য আর কিছু অবশ্য আছেই আছে। সেটি কি?

 অনেকে উত্তর দিবেন, “নীতিশিক্ষা।” যদি তাহা সত্য হয়, তবে, “হিতোপদেশ” রঘুবংশ হইতে উৎকৃষ্ট কাব্য। কেন না বোধ হয়, হিতোপদেশে রঘুবংশ হইতে নীতি বাহুল্য আছে। সেই হিসাবে কথামালা হইতে শকুন্তলা কাব্যাংশে অপকৃষ্ট।

 কেহই এ সকল কথা স্বীকার করিবেন না। যদি তাহা না করিলেন, তবে কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য কি? কি জন্য শতরঞ্চ খেলা ফেলিয়া শকুন্তলা পড়িব?

 কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে— কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য। কাব্যের গৌণ উদ্দেশ্য মনুষ্যের চিত্তোৎকর্ষ সাধন—চিত্তশুদ্ধি জনন। কবিরা জগতের শিক্ষাদাতা—কিন্তু নীতিনির্ব্বাচনের দ্বারা তাঁহারা শিক্ষা দেন না। কথাচ্ছলেও নীতিশিক্ষা না। তাঁহারা সৌন্দর্য্যের চরমোৎকর্ষ সৃজনের দ্বারা জগতের চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। এই সৌন্দর্য্যের চরমোৎকর্ষের সৃষ্টি কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রথমোক্তটি গৌণ উদ্দেশ্য, শেষোক্তটি মুখ্য উদ্দেশ্য।

 কথাটা পরিষ্কার হইল না। যদিও উত্তরচরিত সমালোচন পক্ষে এ কথা আর অধিক পরিষ্কার করিবার প্রয়োজন নাই, তথাপি প্রস্তাবের গৌরবানুরোধে আমরা তাহাতে প্রবৃত্ত হইगाম।

 চোর চুরি করে। রাজা তাহাকে বলিলেন, “তুমি চুরি করিও না; আমি তাহা হইলে তোমাকে অবরুদ্ধ করিব।” চোর ভয়ে প্রকাশ্য চুরি হইতে নিবৃত্ত হইল, কিন্তু তাহার চিত্তশুদ্ধি জন্মিল না। সে যখনই বুঝিবে, চুরি করিলে রাজা জানিতে পরিবেন না, তখনই চুরি করিবে।

 তাহাকে ধর্ম্মোপদেশক বলিলেন, “তুমি চুরি করিও না—চুরি ঈশ্বরাজ্ঞাবিরুদ্ধ।” চোর বলিল, “তাহা হইতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর যখন আমার আহারের অপ্রতুল করিয়াছেন, তখন আমি চুরি করিয়াই খাইব।” ধর্ম্মোপদেশক বলিলেন, “তুমি চুরি করিলে নরকে যাইবে।” চোর বলিল, “তদ্বিষয়ে প্রমাণাভাব।”

 নীতিবেত্তা কহিতেছেন, “তুমি চুরি করিও না, কেননা চুরিতে সকল লোকের অনিষ্ট, যাহাতে সকল লোকের অনিষ্ট, তাহা কাহারও কর্ত্তব্য নহে।” চোর বলিবে, “যদি সকল লোক আমার জন্য ভাবিত, আমি তাহা হইলে সকলের জন্য ভাবিতে পারিতাম। লোকে আমার খেতে দিক্‌, আমি চুরি করিব না। কিন্তু যে খানে লোকে আমায় কিছু দেয় না, সে খানে তাহাদের অনিষ্ট হয় হউক, আমি চুরি করিব।”

 কবি চোরকে কিছু বলিলেন না, চুরি করিতে নিষেধ করিলেন না। কিন্তু তিনি এক সর্ব্বজনমনোহর পরিত্র চরিত্র সৃজন করিলেন। সর্ব্বজনমনোহর, তাহাতে চোরেরও মন মুগ্ধ হইবে। মনুষ্যের স্বভাব, যে যাহাতে মুগ্ধ হয়, পুনঃ পুনঃ চিত্তপ্রীত হইয়া তদালোচনা করে। তাহাতে আকাঙ্ক্ষা জন্মে —কেননা লাভাকাঙ্ক্ষার নামই অনুরাগ। এইরূপে পবিত্রতার প্রতি চোরের অনুরাগ জন্মে। সুতরাং চুরি প্রভৃতি অপবিত্র কার্য্যে সে বীতরাগ হয়।

 “আত্মপরায়ণতা মন্দ—তুমি আত্মপরায়ণ হইও না।” এই নৈতিক উক্তি রামায়ণ নহে। কথাচ্ছলে এই নীতি প্রতিপন্ন করিবার জন্য রামায়ণের প্রণয়ন হয় নাই। কিন্তু রামায়ণ হইতে পৃথিবীর আত্মপরায়ণতা দোষ যতদূর পরিহার হইয়াছে, ততদূর, ঈশা এবং বুদ্ধ ভিন্ন কোন নীতিবেত্তা, ধর্ম্মবেত্তা, সমাজকর্ত্তা, বা রাজা বা রাজকর্ম্মচারীকর্ত্তৃক হয় নাই। সুবিবেচক পাঠকের এতক্ষণ বোধ হইয়া থাকিবেক, যে উদ্দেশ্য এবং সফলতা উভয় বিবেচনা করিলে, রাজা, রাজনীতিবেত্তা, ব্যবস্থাপক, সমাজতত্ত্ববেত্তা ধর্ম্মোপদেষ্টা, নীতিবেত্তা, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক সর্ব্বাপেক্ষাই কবির শ্রেষ্ঠত্ব। কবিত্ব পক্ষে যেরূপ মানসিক ক্ষমতা আবশ্যক, তাহা বিবেচনা করিলেও কবির সেইরূপ প্রাধান্য। করিয়া জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা, এবং উপকারকর্ত্তা, এবং সর্ব্বাপেক্ষা অধিক মানসিক শক্তিসম্পন্ন।

 কি প্রকারে কাব্যকারেরা এই মহৎ কার্য্য সিদ্ধ করেন? যাহা সকলের চিত্তকে আকৃষ্ট করিবে, তাহার সৃষ্টি দ্বারা। সকলের চিত্তকে আকৃষ্ট করে সে কি? সৌন্দর্য; অতএব সৌন্দর্য্য সৃষ্টিই কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য। সৌন্দর্য্য অর্থে কেবল বাহ্যপ্রকৃতির বা শারীরিক সৌন্দর্য্য নহে। সকল প্রকারের সৌন্দর্য্য বুঝিতে হইবেক। যাহা স্বাভাবানুকারী নহে, তাহাতে কুসংস্কারাবিষ্ট লোক ভিন্ন কাহারও মন মুগ্ধ হয় না। এ জন্য স্বভাবানুকারিতা সৌন্দর্য্যের একটি গুণ মাত্র—স্বভাবানুকারিতা ছাড়া সৌকর্য্য জন্মে না। তবে যে আমরা স্বভাবানুকারিতা এবং সৌন্দর্য্য দুইটি পৃথক গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছি, তাহার সৌন্দর্য্যের অনেক অর্থ প্রচলিত আছে।

 আর একটি কথা বুঝাইলেই হয়। এই জগৎ ত সৌন্দর্যময় —তাহার প্রতিকৃতি মাত্রই সৌন্দর্য্যময় হইবে। তবে কেন আমরা উপরে বলিয়াছি যে, যাহা প্রকৃতির প্রতিকৃতি মাত্র সে সৃষ্টিতে কবির তাদৃশ গৌরব নাই? তাহার কারণ, সে কেবল প্রতিকৃতি—অনুলিপি মাত্র—তাহাকে “সৃষ্টি” বলা যায় না। যাহা সতের প্রতিকৃতি মাত্র নহে—তাহাই সৃষ্টি। যাহা স্বভাবানুকারী, অথচ স্বভাবাতিরিক্ত, তাহাই কবির প্রশংসনীয় সৃষ্টি। তাহাতেই চিত্ত বিশেষরূপে আকৃষ্ট হয়। যাহা প্রাকৃত,তাহাতে তাদৃশ চিত্ত আকৃষ্ট হয় না। কেন না, তাহা অসম্পূর্ণ, দোষ সংস্পৃষ্ট, পুরাতন, এবং অনেক সময়ে অস্পষ্ট। কবির সৃষ্টি তাঁহার স্বেচ্ছাধীন—সুতরাং সম্পূর্ণ, দোষশূন্য, নবীন, এবং স্পষ্ট হইতে পারে।

 এইরূপ যে সৌন্দর্য্যসৃষ্টি কবির সর্ব্বপ্রধান গুণ—সেই অভিনব, স্বভাবানুকারী, স্বভাবাতিরিক্ত সৌন্দর্য্য সৃষ্টিগুণে, ভারতবর্ষীয় কবিদিগের মধ্যে বাল্মীকি প্রধান। তৎপরেই মহাভারতকারের নাম নির্দ্দিষ্ট হইবে। এক এক কাব্যে ঈদৃশ সৃষ্টিবৈচিত্র্য প্রায় জগতে দুর্লভ।

 মহাভারতের পর, বোধ হয়, শ্রীমদ্ভাগবতের উল্লেখ করিতে হয়। তৎপরে শকুন্তলা। ভারতবর্ষের আর কোন কবিকে এ সম্বন্ধে অত্যুচ্চশ্রেণী মধ্যে গণা যাইতে পারে না।

 এ সম্বন্ধে তবভূতির স্থান কোথায়? তাহা তাঁহার তিনখানি নাটক পর্য্যালোচিত না করিলে অবধারিত করা যায় না। তাহা আমাদিগের উদ্দেশ্যও নহে। কেবল উত্তরচরিত দেখিয়া তাঁহাকে অতি উচ্চাসন দেওয়া যায় না। উত্তরচরিতে ভবভূতি অনেক দূর পর্য্যন্ত বাল্মীকির অনুবর্ত্তী হইতে বাধ্য হইয়াছেন, সুতরাং তাঁহার সৃষ্টিমধ্যে নবীনত্বের অভাব, এবং সৃষ্টিচাতুর্য্যের প্রচার করিবার পথও পান নাই। চরিত্র সৃজন সম্বন্ধে ইহা বলা যাইতে পারে, যে রাম ও সীতা ভিন্ন কোন নায়ক নায়িকার প্রাধান্য নাই। সীতা, রামায়ণের সীতার প্রতিকৃতি মাত্র। রামের চরিত্র, রামায়ণের রামের চরিত্রের উৎকট প্রতিকৃতিও নহে—ভবভূতির হস্তে সে মহচ্চিত্র যে বিকৃত হইয়া গিয়াছে, তাহা পূর্ব্বেই প্রতিপন্ন করা গিয়াছে। সীতাও তাঁহার কাছে, অপেক্ষাকৃত পরসাময়িক স্ত্রীলোকের চরিত্র কতকদুর পাইয়াছেন।

 তাই বলিয়া এমত বলা যায় না যে, উত্তরচরিতে চরিত্রসৃষ্টি-চাতুর্য্য কিছুই লক্ষিত হয় না। বাসন্তী ভবভূতির অভিনব সৃষ্টি বটে, এবং এ চরিত্র অত্যন্ত মনোহর। আমরা বাসন্তীর চরিত্রের সবিশেষ পরিচয় দিয়াছি, সুতরাং তৎসম্বন্ধে আর বিস্তারের আবশ্যক নাই। এই পরদুঃখকাতরহৃদয়া, স্নেহময়ী, বনচারিণী যে অবধি প্রথম দেখা দিলেন, সেই অবধিই তাঁহার প্রতি পাঠকের প্রীতি সঞ্চার হইতে থাকিল।

 তদ্ভিন্ন চন্দ্রকেতু ও লবের চিত্রও প্রশংসনীয়। প্রাচীন কবিদিগের ন্যায় ভবভূতি জড়পদার্থকে রূপবান্ করণে বিলক্ষণ সুচতুর। তমসা, মুরলা, গঙ্গা, এবং পৃথিবী এই নাটকে মানবরূপিণী। সেই রূপ গুলিন যে মনোহর হইয়াছে, তাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি।

 কবির সৃষ্টি—চরিত্র, রূপ, স্থান, অবস্থা কার্য্যাদিতে পরিণত হয়। ইহার মধ্যে কোন একটির সৃষ্টি কবির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে। সকলের সংযোগে সৌর্য্যের সৃষ্টিই তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য। চরিত্র, রূপ, স্থান, অবস্থা, কার্য্য, এ সকলের সমবায়ে যাহা দাঁড়াইল, তাহা যদি সুন্দর হইল, তবেই কবি সিদ্ধকাম হইলেন।

 ভবভূতির চরিত্রসৃজনের ক্ষমতার পরিচয় দিয়াছি। অন্যান্য বিষয়ে তাঁহার সৃজনকৌশলের পরিচয় ছায়া নামে উত্তরচরিতের তৃতীয়াঙ্ক। আমাদিগের পরিশ্রম যদি নিষ্ফল না হইয়া থাকে, তবে পাঠক সেই ছায়ার মোহিনীশক্তি অনুভূত করিয়াছেন। ঈদৃশ রমণীয়া সৃষ্টি অতি দুর্লভ।

 সৃষ্টি-কৌশল কবির প্রধান গুণ। কবির আর একটি বিশেষ গুণ রসোদ্ভাবন। রসোদ্ভাবন কাহাকে বলে, আমরা বুঝাইতে বাসনা করি, কিন্তু রস শব্দটি ব্যবহার করিয়াই আমরা সে পথে কাঁটা দিয়াছি। এ দেশীয় প্রাচীন আলঙ্কারিক দিগের, কেবল নিয়ম গুলিই অগ্রাহ্য এমত নহে, তাঁহাদিগের ব্যবহৃত শব্দ গুলিও পরিহার্য্য। ব্যবহার করিলেই বিপদ ঘটে। আমরা সাধ্যানুসারে তাহা বর্জ্জন করিয়াছি, কিন্তু এই রস শব্দটী ব্যবহার করিয়া বিপদ ঘটিল। নয়টি বৈ রস নয়, কিন্তু মনুষ্য চিত্তবৃত্তি অসংখ্য। রতি, শোক, ক্রোধ, স্থায়িভাব; কিন্তু হর্ষ, অমর্ষ প্রভৃতি ব্যভিচারী ভাব। স্নেহ, প্রণয়, দয়া ইহাদের কোথাও স্থান নাই;—না স্থায়ী, না ব্যভিচারী—কিন্তু একটি কার্য্যানুপযোগী কদর্য্য মানসিক বৃত্তি আদিরসের আকারস্বরূপ স্থায়ী ভাবে প্রথমে স্থান পাইয়াছে। স্নেহ, প্রণয়, দয়াদিপরিজ্ঞাপক রস নাই। কিন্তু শান্তি একটি রস। সুতরাং এবম্বিধ পারিভাষিক শব্দ লইয়া সমালোচনার কার্য্য সম্পন্ন হয় না। আমরা যাহা বলিতে চাহি, তাহা অন্য কথায় বুঝাইতেছি— আলঙ্কারিকদিগকে প্রণাম করি।

 মনুষ্যের কার্য্যের মূল তাহাদিগের চিত্তবৃত্তি। সেই সকল চিত্তবৃত্তি অবস্থানুসারে অত্যন্ত বেগবতী হয়। সেই বেগের সমুচিত বর্ণনদ্বারা সৌন্দর্য্যের সৃজন, কাব্যের উদ্দেশ্য। অস্মদ্দেশীয় আলঙ্কারিকেরা সেই বেগবতী মনোবৃত্তিগণকে “স্থায়ীভাব” নাম দিয়া এ শব্দের এরূপ পরিভাষা করিয়াছেন যে, প্রকৃত কথা বুঝা ভার। ইংরাজী আলঙ্কারিকেরা তাহাকে (Passions) বলেন। আমরা তাহার কাব্যগত প্রতিকৃতিকে রসোদ্ভাবন বলিলাম।

 রসোদ্ভাবনে ভবভূতির ক্ষমতা অপরিসীম। যখন যে রস উদ্ভাবনের ইচ্ছা করিয়াছেন, তখনই তাহার চরম দেখাইয়াছেন। তাঁহার লেখনী মুখে স্নেহ উছলিতে থাকে—শোক দহিতে থাকে, দম্ভ ফুলিতে থাকে। ভবভূতির মোহিনীশক্তি প্রভাবে আমরা দেখিতে পাই যে, রামের শরীর ভাঙ্গিতেছে; মর্ম্ম ছিঁড়িতেছে; মস্তক ঘুরিতেছে; চেতনা লুপ্ত হইতেছে— দেখিতে পাই,সীতা কখন বিস্ময়স্তিমিতা; কখন আনন্দোত্থিতা; কখন প্রেমাভিভূতা, কখন অভিমানকুণ্ঠিতা; কখন আত্মাবমাননা সঙ্কুচিতা; কখন অনুতাপবিবশা; কখন মহাশোকে ব্যাকুলা। কবি যখন যাহা দেখাইয়াছেন, একবারে নায়ক নারিকার হৃদয় যেন বাহির করিয়া দেখাইয়াছেন, যখন সীতা বলিলেন, অস্মহে—জলভরিদমেহ থণিদগম্ভীর মংসলো কুদোণু এসো ভারদী নিগম্বোসো! ভরিজ্জমাণকণ্ণবিবরং মং বি মন্দভাইণিং ঝত্তি উস্মায়েদি!” তখন বোধ হইল, জগৎসংসার সীতার প্রেমে পরিপূর্ণ হইল। ফলে রসোদ্ভাবনী শক্তিতে ভবভূতি পৃথিবীর প্রধান কবিদিগের সহিত তুলনীয়। একটী মাত্র কথা বলিয়া মানবমনোবৃত্তির সমুদ্রবৎ সীমাশূন্যতা চিত্রিত করা, মহাকবির লক্ষণ। ভবভূতির রচনা সেই লক্ষণাক্রান্ত। পরিতাপের বিষয় এই যে, সে শক্তি থাকিতেও ভবভূতি রাম বিলাপের এত বাহুল্য করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার যশের লাঘব হইয়াছে।

 আমাদিগের ইচ্ছা ছিল যে, এই রামবিলাপের সহিত, আর কয় খানি প্রসিদ্ধ নাটকের কয়েকটি স্থান তুলিত করিয়া তারতম্য দেখাই। কিন্তু স্থানাভাবে পারিলাম না। সহৃদয় পাঠক, শকুন্তলার জন্য দুষ্মন্তের বিলাপ, দেসদিমোনার জন্য ওথেলোর বিলাপ, এবং ইউরিপিদিসের নাটকে আল্‌কেস্তিষের জন্য আদ্‌মিতসের বিলাপ, এই রামবিলাপের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিবেন।

 বাহ্য প্রকৃতির শোভার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ভবভূিতর আর একটি গুণ। সংসারে যেখানে যাহা সুদৃশ্য, সুগন্ধ, বা সুখকর ভবভূতি অনবরত তাহার সন্ধানে ফিরেন। মালাকার যেমন পুষ্পোদ্যান হইতে সুন্দর২ কুসুমগুলি তুলিয়া সভামণ্ডল রঞ্জিত করে, ভবভূতি সেইরূপ সুন্দর বস্তু অবকীর্ণ করিয়া এই নাটক খানি শোভিত করিয়াছেন। যেখানে সুদৃশ্য বৃক্ষ, প্রফুল্লকুসুম, সুশীতল সুবাসিত বারি,—যেখানে নীল মেঘ, উত্তঙ্গ পর্ব্বত, মৃদুনিনাদিনী নির্ঝরিণী, শ্যামল কানন, তরঙ্গসঙ্কুলা, নদী— যেখানে সুন্দর বিহঙ্গ, ক্রীড়াশীল করিশাবক, সরল স্বভাব কুরঙ্গ—সেই খানে কবি দাঁড়াইয়া একবার তাহার সৌন্দর্য্য দেখাইয়াছেন! কবিদিগের মধ্যে এই গুণটি সেক্ষপীয়র ও কালিদাসের বিশেষ লক্ষণীয়। ভবভূতিরও সেই গুণ বিশেষ প্রকাশমান।

 ভবভূতির ভারা অতিচমৎকারিণী! তাঁহার রচনা সমাসবহুলতা ও দুর্ব্বোধ্যতা দোষে কলঙ্কিতা বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় কর্ত্তৃক নিন্দিত হইয়াছে। সে নিন্দা সমূলক হইলেও সাধারণতঃ যে ভবভূতির ব্যবহৃত সংস্কৃত ও প্রাকৃত অতিমনোহর, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। উইলসন বলিয়াছেন যে, কালিদাস ও ভবভূতির ভাষার ন্যায় মহতী ভাষা কোন দেশের লেখকেই দৃষ্ট হয় না।

 উত্তরচরিতের যে সকল দোষ, তাহা আমরা যথাস্থানে বিবৃত করিয়াছি—পুনরুল্লেখের আবশ্যক নাই। আমরা এই নাটকের সমালোচনা সমাপন করিলাম। অন্যান্য দোষের মধ্যে দৈর্ঘ্য দোষে এই সমালোচন বিশেষ দূষিত হইয়াছে। এজন্য আমরা কুণ্ঠিত নহি। যে দেশে তিন ছত্রে সচরাচর গ্রন্থ সমালোচনা সমাপ্ত করা প্রথা, সে দেশে একখানি প্রাচীন গ্রন্থের সমালোচন দীর্ঘ হইলে দোষটি মার্জ্জনাতীত হইবে না। যদি ইহার দ্বারা একজন পাঠকেরও কাব্যানুরাগ বর্দ্ধিত হয়, বা তাঁহার কাব্যরসগ্রাহিণী শক্তির কিঞ্চিন্মাত্র সহায়তা হয়, তাহা হইলেই এই দীর্ঘ প্রবন্ধ আমরা সফল বিবেচনা করিব।


  1. ইদং গুরুভ্যঃ পূর্ব্বেভ্যো নমোবাকং প্রশাসৃহে।
    প্রস্তাবনা 
  2. দুরাহ্বানং বধো যুদ্ধং রাজ্যদেশাদিবিপ্লবঃ।
    বিবাহো ভোজনং শাপোৎসর্গৌ মৃত্যুরতস্তথা।

    সাহিত্যদর্পণে। 
  3. “এক্ষণে আমি সুখভোগ করিতেছি, কি দুঃখভোগ করিতেছি; নিদ্রিত আছি, কি জাগরিত আছি; কিম্বা কোন বিষ প্রবাহ দেহে রক্তপ্রবাহের সহিত মিশ্রিত হইয়া, আমার এরূপ অবস্থা ঘটাইয়া দিয়াছে; অথবা মদ (মাদক দ্রব্য সেবন) জনিত মত্ততাবশতঃ এরূপ হইতেছে, ইহার কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না।” নৃসিংহ বাবুর অনুবাদ, ৩০ পৃষ্ঠা।
  4. “কমলয়নে! তোমার এই বাক্যগুলি, শোকাদিসন্তপ্ত জীবনরূপ কুসুমের বিকাশক, ইন্দ্রিয়গণের মোহন ও সন্তর্পণ স্বরূপ, কর্ণের অমৃত স্বরূপ, এবং মনের গ্লানিপরিহারক (রসায়ন) ঔষধ স্বরূপ।” ঐ ৩১ পৃষ্ঠা।
  5. “রামবাহু বিবাহের সময় হইতে, কি গৃহ, কি বনে, সর্ব্বত্রই শৈশবাবস্থায় এবং পরে যৌবনাবস্থাতেও তোমার উপাধানের (মাথার দিবার বালিসের) কার্য্য করিয়াছে।” ঐ-ঐ পৃষ্ঠা
  6. “ইনিই আমার গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপ, ইনিই আমার নয়নের অমৃত-শলাকাস্বরূপ, ইঁহারই এই স্পর্শ গাত্রলগ্ন চন্দনস্বরূপ সুখপ্রদ, এবং ইঁহারই এই বাহু আমার কণ্ঠস্থ শীতল এবং কোমল মুক্তাহার স্বরূপ।” ঐ—ঐ পৃষ্ঠা।
  7. আহা। আর্য্যপুত্ত্রের কি সুন্দর চিত্র! প্রফুলপ্রায় নবনীলোৎপলবৎ শ্যামল স্নিগ্ধ কোমল শোভা বিশিষ্ট কি দেহসৌন্দুর্য্য! কেমন অবলীলাক্রমে হরধনু ভাঙ্গিতেছেন, মুখমণ্ডল কেমন শিখণ্ডে শোভিত! পিতা বিস্মিত হইয়া এই সুন্দর শোভা দেখিতেছেন! আহা কি সুন্দর!
  8. “মাতৃগণ তৎকালে বালা জানকীর অঙ্গ সৌষ্টবাদি দেখিয়া কি সুখীই হইয়াছিলেন, এবং ইনিও অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ও অনতিনিবিড় দন্তগুলি, তাহার উভয়পার্শ্বস্থ মনোহর কুন্তল মনোহর মুখশ্রী, আর সুন্দর চন্দ্রকিরণ সদৃশ নির্ম্মল এবং কৃত্রিমবিলাস রহিত ক্ষুদ্র২ হস্ত পদাদি অঙ্গদ্বারা তাঁহাদিগের আনন্দের একশেষ করিয়াছিলেন।” নৃসিংহ বাবুর অনুবাদ। এই কবিতাটি বালিকা বর্ণনার চূড়ান্ত।
  9. “একত্র শয়ন করিয়া পরস্পরের কপোলদেশ পরস্পরের কপোলের সহিত সংলগ্ন করিয়া এবং উভয়ে উভয়কে এক এক হস্ত দ্বারা গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া অনবরত মৃদুস্বরে ও যদৃচ্ছাক্রমে বহুবিধ গল্প করিতে২ অজ্ঞাতসারে রাত্রি অতিবাহিত করিতাম।” ঐ
  10. “যেখানে তুমি পথজনিত পরিশ্রমে ক্লান্তা হইয়া ঈষৎ কম্পবান্ তথাপি মনোহর এবং গাঢ় আলিঙ্গন কালে অত্যন্ত মর্দ্দনদায়ক আর দলিত মৃণালিনীর ন্যায় ম্লান ও দুর্ব্বল হস্তাদি অঙ্গ আমার বক্ষঃস্থলে রাখিয়া নিদ্রা গমন করিয়াছিলে।” ঐ বাবুর অনুবাদ।
  11. হৌক—আমি রাগ করিব—যদি তাঁহাকে দেখিয়া না ভুলিয়া যাই।
  12.  সীতা। হা আর্য্যপুত্র, তোমার সঙ্গে এই দেখা।
     রাম। বিরহের এত ভয়—এ যে চিত্র।
     সীতা। যাহাই হউক না—দুর্জ্জন হলেই মন্দ ঘটায়।
  13. বৎস, এই যে পর্ব্বত, যদুপরে কুসুমিত কদম্বে ময়ূরেরা পুচ্ছ ধরিতেছে—উহার নাম কি? দেখিতেছি, তরুতলে আর্য্য পুত্ত্র লিখিত—তাঁহার পূর্ব্ব সৌন্দর্য্যের পরিশেষমাত্র ধূষরশ্রীতে তাঁহাকে চেনা যাইতেছে। তিনি মুহুর্মুহুঃ মূর্চ্ছা যাইতেছেন,—কাঁদিতে২ তুমি তাঁহাকে ধরিয়া আছ।
  14. “প্রজারঞ্জনের অনুরোধে স্নেহ, দয়া, আত্মসুখ, কিম্বা জানকীকে বির্জ্জন করিতে হইলেও আমি কোনরূপ ক্লেশ বোধ করিব না।” নৃসিংহ বাবুর অনুবাদ।
  15. “লোকের আরাধনা করা সাধু ব্যক্তিদিগের পক্ষে সর্ব্বতোভাবেই বিধেয়, এবং এইটি তাঁহাদের পক্ষে সহ মহৎব্রতস্বরূপ। কারণ পিতা আমাকে এবং প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াও তাহা প্রতিপালন করিয়াছিলেন।”—ঐ
  16. হা দেবি যজ্ঞভূমিসম্ভবে! হা জন্মগ্রহণ পবিত্রিতবসুন্ধরে! হা নিমি এবং জনকবংশের আনন্দদাত্রি! হা অগ্নি বশিষ্টদেব এবং অরুন্ধতী সদৃশ প্রশংসনীয় চরিতে! হা রামময় জীবিতে! হা মহাবনবাসপ্রিয়সহচরি! হা মধুরভাষিণি! হা মিতবাদিনি! এইরূপ হইয়াও শেষে তোমার অদৃষ্টে এই ঘটিল।
    নৃসিংহ বাবুর অনুবাদ।
  17. অনুবাদ। তাহার এই যত কথা শুনিয়া রাম, পরম দুঃখিতের ন্যায় সুহৃৎ সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, এইরূপ কি আমাকে বলে?” সকলে ভূমিতে মস্তক নত করিয়া অভিবাদন ও প্রণাম করিয়া, দুঃখিত রাঘবকে প্রত্যুত্তরে কহিল, “এইরূপই বটে—সংশয় নাই।” তখন শত্রুদমন রামচন্দ্র সকলের এই কথা শুনিয়া বয়স্যবর্গকে বিদায় দিলেন। বন্ধু বর্গকে বিদায় দিয়া, বুদ্ধির দ্বারা অবধারিত করিয়া সমীপে আসীন, দৌবারিককে এই কথা বলিলেন যে শুভলক্ষণ সুমিত্রা নন্দন লক্ষ্মণকে ও মহাভাগ ভরতকে ও অপরাজিত শত্রুঘ্নকে শীঘ্র আন। * * * তাঁহারা রামের মুখ, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায় এবং সন্ধ্যকালীন আদিত্যের ন্যায় প্রভাহীন দেখিলেন। ধীমান রামচন্দ্রের নয়নযুগল বাষ্পপূর্ণ এবং মুখ হতশোভ পদ্মের ন্যায় দেখিলেন। তাঁহারা ত্বরিত তাঁহার অভিবাদন করিয়া এবং তাঁহার পদযুগল মস্তকে ধারণ করিয়া সকলে সমাহিত হইয়া রহিলেন। রাম অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। পরে বাহুযুগলের দ্বারা তাহাদিগকে আলিঙ্গন ও উত্থাপন পূর্ব্বক মহাবল রামচন্দ্র তাঁহাদিগকে “আসনে উপবেশন কর;” এই বলিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে নরেশ্বরগণ! আমার সর্ব্বস্ব তোমরা; তোমরা আমার জীবন; তোমাদিগের কৃত রাজ্য আমি পালন করি। তোমরা শাস্ত্রার্থ অবগত; এবং তোমাদেব বুদ্ধি পরিমার্জ্জিত করিয়াছ। হে নরেশ্বরগণ, তোমরা মিলিত হইয়া, যাহা বলি তাহার অর্থানুসন্ধান কর। রামচন্দ্র এই কথা বলিলে অবধানপরায়ণ ভ্রাতৃগণ, “রাজা কি বলেন” ইহা ভাবিয়া উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া রহিলেন।
     তখন সেই দীনচেতা উপবিষ্ট ভাতৃগণকে পবিশুষ্কমুখে রামচন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “তোমাদিগের মঙ্গল হউক! আমার সীতার সম্বন্ধে পৌজ্জনমধ্যে যেরূপ কথা বর্ত্তিয়াছে, তাহ —মন অন্যথা করিও না। জনপদে এবং পৌরজন মধ্যে আমার সুমহান্ অপবাদরূপ বীভৎস কথা রটিয়াছে, আমার তাহাতে মর্ম্মচ্ছেদ করিতেছে। আমি মহাত্মা ইক্ষাকুদিগের কুলে জন্মিয়াছি, সীতাও মহাত্মা জনকরাজার সৎকলে জন্মিয়াছেন। আমার অন্তরাত্মাও জানে যে, যশস্বিনী সীতা শুদ্ধচরিত্রা।
    * * * *

    তখন আমি বৈদেহীকে গ্রহণ করিয়া অযোধ্যায় আসিলাম। এক্ষণে এই মহান অপবাদে আমার হৃদয়ে শোক বর্ত্তিতেছে। পৌরজন মধ্যে এবং জনপদে সুমহান্ অপবাদ হইয়াছে। লোকে যাহার অকীর্ত্তিগান করে যাবৎ সেই অকীর্ত্তি লোকে প্রকীর্ত্তিত হইবে তাবৎ সে অধমলোকে পতিত থাকিবে। দেবতারা অকীর্ত্তির নিন্দা করেন, এবং কীর্ত্তিই সকল লোকে পূজনীয়॥ সকল মহাত্মা ব্যক্তিদের যত্ন কীর্ত্তিরই জন্য। হে পুরুষর্ষভগণ, আমি অপবাদভয়ে ভীত হইয়া জীবন ত্যাগ করিতে পারি তোমাদিগের ত্যাগ করিতে পারি, সীতার ত কথাই নাই।
     অতএব তোমরা দেখ আমি কি শোকসাগরে পতিত হইয়াছি! আমি ইহার অধিক দুঃখ জগতে আর দেখি না। অতএব হে সৌমিত্রে! তুমি কল্য প্রভাতে সুমন্ত্রাধিষ্ঠিত রথে সীতাকে আরোপণ করিয়া স্বয়ং আরোহণ করিয়া, তাঁহাকে দেশান্তরে ত্যাগ করিয়া আইস। গঙ্গার অপর পারে তমসা নদীর তীরে মহাত্মা বাল্মীকি মুনির স্বর্গতুল্য আশ্রম। হে রঘুনন্দন! বিজনদেশে তুমি ইঁহাকে ত্যাগ করিয়া শীঘ্র আইস,—আমার বচন রক্ষা কর— সীতা পরিত্যাগ বিষয়ে তুমি ইহার প্রতিবাদ কিছুই করিও না। অতএব হে সৌমিত্রে! যাও—এবিষয়ে আর কিছু বিচার করিবার প্রয়োজন নাই। তুমি যদি ইহার বারণ কর, তবে আমার পরমাপ্রীতিকর হইবে। আমি চরণের স্পর্শে এবং জীবনের দ্বারা তোমাদিগকে শপথ করাইতেছি— যে যে ইহাতে আমাকে অনুনয় করিবার জন্য কোনরূপ কোন কথা বলিবে, আমার অভীষ্টহানি হেতুক তাহার শত্রু খ্যাতি নিতা বর্ত্তিবে। যদি আমার আজ্ঞাবহ থাকিয়া, তোমরা আমাকে সম্মান করিতে চাও, তোমরা তবে আমার বচন রক্ষা কর, অদ্য সীতাকে লইয়া যাও।

  18. হায় কি কষ্ট! নিষ্ঠুরের মত, কি ঘৃণাজনক কর্মই করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি! বাল্যাবস্থা হইতে যাঁহাকে প্রিয়তমা বলিয়া প্রতিপালিত করিয়াছি; যিনি গাঢ় প্রণয় বশতঃ কোন রূপেই আপনাকে আমা হইতে ভিন্ন বোধ করেন না, আজি আমি সেই প্রিয়াকে মাংস বিক্রয়ী যেমন গৃহপালিতা পক্ষিণীকে অনায়াসে বধ করে, সেইরূপ ছল ক্রমে করাল কাল গ্রাসে নিপাতিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। অতএব পাতকী সুতরাং অস্পৃশ্য আমি দেবীকে আর কেন কলঙ্কিত করি? (ক্রমে ক্রমে সীতার মস্তক আপনার বক্ষঃস্থল হইতে নামাইয়া বাহু আকর্ষণ পূর্ব্বক) অয়ি মুগ্ধে! এ অভাগাকে পরিত্যাগ কর। আমি অদৃষ্টচর এবং অশ্রুতপূর্ব্ব পাপ কর্ম্ম করিয়। চণ্ডালত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি! হায়! তুমি চন্দনবৃক্ষভ্রমে এই ভয়ানক বিষবৃক্ষকে (কি কুক্ষণেই) আশ্রয় করিয়াছিলে? (উঠিয়া) হায় এক্ষণে জীবলোক উচ্ছিন্ন হইল। রামেরও আর জীবিত থাকিবার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে পৃথিবী শূন্য এবং জীর্ণ অরণ্য সদৃশ নীরস বোধ হইতেছে। সংসার অসার হইয়াছে। জীবন কেবলমাত্র ক্লেশের নিদানস্বরূপ বোধ হইতেছে। হায়! এতদিনে আশ্রয়বিহীন হইলাম। এখন কি করি (কোথায় যাই) কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না (চিন্তা করিয়া) উঃ! আমার এখন কি গতি হইবে? অথবা (সে চিন্তায় আর কি হইবে?) যাবজ্জীবন দুঃখভোগ করিবার নিমিত্তই (হতভাগ্য) রামের দেহে প্রাণবায়ুর সঞ্চার হইয়াছিল, নতুবা নিজে জীবন পর্য্যন্ত কেন বজ্রের ন্যায় মর্ম্মভেদ করিতে থাকিবে? হা মাতঃ অরুন্ধতি! হা ভগবন্ বশিষ্ঠদেব! হা মহাত্মন্ বিশ্বামিত্র হা ভগবন্ অগ্নে! হা নিখিল ভূত ধাত্রি ভগবতি বসুন্ধরে! হা তাত জনক! হা পিতঃ (দশরথ!) হা কৌশল্যা প্রভৃতি মাতৃগণ! হা পরমোপকারিন্ লঙ্কাপতি বিভীষণ! হা প্রিয়বন্ধো সুগ্রীব! জা সৌম্য হনুমন্। হা সখি ত্রিজটে! আমি হতভাগ্য পাপিষ্ঠ রাম তোনাদিগের সর্ব্বনাশ (সর্ব্বস্বাপহরণ) এবং অবমাননা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। (চিন্তা করিয়।) অথবা এই হতভাগ্য এখন তাঁহাদিগের নামোল্লেখ করিবারও উপযুক্ত নহে। কারণ, এই পাপাত্মা কৃতঘ্ন পামর কেবলমাত্র সেই সকল মহাত্মাদিগের নাম গ্রহণ করিলেও তাঁহারা পাপদৃষ্ট হইবার সম্ভাবনা। যেহেতুক আমি দৃঢ়বিশ্বাস বশতঃ বক্ষঃস্থলে নিদ্রিতা প্রেয়সীকে স্বপ্নাবস্থায় উদ্বেগ বশতঃ ঈষৎ কম্পিত গর্ভভরে মন্থরা দেখিয়াও অনায়াসেই উন্মোচন পূর্ব্বক দিদার হৃদয়ে মাংসাশী রাক্ষসদিগকে উপহারের ন্যায় নিক্ষেপ করিতে সমর্থ হইয়াছি। (সীতার চরণদ্বয় মস্তকদ্বারা গ্রহণপূর্ব্বক) দেবি! দেরি! রামের দ্বারা তোমার পদপঙ্কজের এই শেষ স্পর্শ হইল! (এই বলিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।)
  19. আলঙ্কারিকেরা রামায়ণকে কাব্য বলেন না—ইতিহাস বলেন।
  20. অহো! এই বনদেবতা ফলপুষ্প পল্লবার্ঘের দ্বারা আমার অভ্যর্থনা করিতেছেন।
  21. গুরু বুদ্ধিমানকে যেয়ন শিক্ষা দেন, জড়কেও তদ্রূপ দিয়া থাকেন। কাহারও জ্ঞানের বিশেষ সাহায্য বা ক্ষতি করেন না। কিন্তু তথাপি তাহাদের মধ্যে ফলের তারতম্য ঘটে। কেবল নির্ম্মল মণিই প্রতিবিম্ব গ্রহণ করিতে পারে; মৃত্তিকা তাহা পারে না।
  22. এই যে পরিচিতভূমি দণ্ডকারণ্য ভাগ দেখা যাইতেছে। কোথাও স্নিগ্ধশ্যাম, কোথাও ভয়ঙ্কর রূক্ষদৃশ্য, কোথাও বা নির্ঝরগণের ঝরঝরশব্দে দিক্ সকল শব্দিত হইতেছে; কোথাও পুণ্যতীর্থ, কোথাও মুণিগণের আশ্রমপদ, কোথাও পর্ব্বত, কোথাও নদী এবং মধ্যে২ অরণ্য।
     ঐ যে জনস্থান পর্য্যন্ত দীর্ঘ অরণ্য সকল দক্ষিণদিগে চলিতেছে? এ সকল সর্ব্বলোক লোমহর্ষণ—অত্রস্থ গিরিগহ্বর উন্মত্ত প্রচণ্ড হিংস্র পশুগণে সমাকুল। কোথাও বা একবারে নিঃশব্দ; কোথাও পশুদিগের প্রচণ্ড গর্জ্জন পরিপূর্ণ; কোথাও বা স্বেচ্ছাসুপ্ত গভীর গর্জ্জনকারী ভুজঙ্গের নিশ্বাসে অগ্নি প্রজ্বলিত। কোথাও গর্ত্তে অল্প জল দেখা যাইতেছে। তৃষিত কৃকলাসেরা অজগরের ঘর্ম্মবিন্দু পান করিতেছে।
     * * * দেখুন, এই মধ্যমারণ্য সকল কেমন প্রশান্ত গম্ভীর! মদকল ময়ূরের কণ্ঠের ন্যায় কোমলচ্ছবি পর্ব্বতে অবকীর্ণ; ঘননিবিষ্ট, নীল প্রধান কান্তি, অনতিপ্রৌঢ় বৃক্ষ সমূহে শোভিত; এবং ভয়শূন্য বিবিধ মৃগযূথে পরিপূর্ণ। স্বচ্ছতোয়া নির্ঝরিণী সকল বহুস্রোতে বহিতেছে, আনন্দিত পক্ষী সকল তত্রস্থ বেতসলতার উপর বসিতেছে, তাহাতে বেতসের কুসুম বৃন্তচ্যুত হইয়া সেই জলে পড়িয়া জলকে সুগন্ধি এবং সুশীতল করিতেছে; স্রোতঃ পরিপক্বফলময় শ্যামজম্বূবনান্তে স্খলিত হওয়াতে শব্দিত হইতেছে। গিরিবিবরবাসী যুবা ভল্লূকদিগের খুৎকার শব্দ প্রতিধ্বনিতে গম্ভীর হইতেছে। এবং গজগণের দ্বারা ভগ্ন শল্লকী বৃক্ষের বিক্ষিপ্ত গ্রন্থি হইতে শীতল কটু, কষায় সুগন্ধ বাহির হইতেছে।
  23. এই পর্ব্বত ক্রৌঞ্চাবত। এখানে অব্যক্তনাদীকুঞ্জকুটীরবাসী পেচককুলের ফুৎকার শব্দিত বায়ুযোগ ধ্বনিত বংশবিশেষের গুচ্ছে ভীত হইয়া কাকেরা নিঃশব্দে আছে। এবং ইহাতে সর্পেরা, চঞ্চল ময়ূরগণের কেকারবে ভীত হইয়া পুরাতন বটবৃক্ষের স্কন্ধে লুকাইয়া আছে। আর এই সকল দক্ষি‌ণ পর্ব্বত। পর্ব্বত কুহরে গোদাবরী বারিরাশি গদ্গ‌দনিনাদ করিতেছে; শিরোদেশ মেঘ মালায় অলঙ্কৃত হইয়া নীল শোভা ধারণ করিয়াছে; আর এই গভীরজয়শালিনী পবিত্রা নদীগণের সঙ্গম পরস্পরের প্রতিঘাতসঙ্কুল চঞ্চল তরঙ্গকোলাহলে দুর্দ্ধর্ষ হ‍ইয়া রহিয়াছে।
  24. অবিচলিত গভীরত্ব হেতুক হৃদর মধ্যে রুদ্ধ, এজন্য গাঢ়ব্যথা রামের সন্তাপ মুখবদ্ধ পাত্র মধ্যে পাকের সন্তাপের ন্যায় বাহিরে প্রকাশ পায় না।
  25. “যা হউক তা হউক।” এই কথার কত অর্থগাম্ভীর্য্য! বিদ্যাসাগর মহাশয় এই বাক্যের টীকায় লিখিয়াছেন যে “আমার পানিস্পর্শে আর্য্যপুত্ত্র বাঁচিবেন কি না, জানি না, কিন্তু ভগবতী বলিতেছেন বলিয়া আমি স্পর্শ করিব।” ইহাতে এই বুঝিতে হইতেচে যে পাণিস্পর্শ সফল হইবে কি না, এই সন্দেহেই সীতা বলিলেন, “যা হউক। তা হউক!” কিন্তু আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধ হয় যে সে সন্দেহে সীতা বলেন নাই যে, “যা হবার হউক!” সীতা ভাবিয়াছিলেন, “রামকে স্পর্শ করিবার আমার কি অধিকার? রাম আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমাকে বিনাপরাধে বিসর্জ্জন করিয়াছেন—বিসর্জ্জন করিবার সময়ে এক বার আমাকে ডাকিয়াও বলেন নাই যে আমি তোমাকে ত্যাগ করিলাম—আজি বার বৎসর আমাকে ত্যাগ করিয়া সম্বন্ধ রহিত করিয়াছেন, আজি আবার তাঁহার প্রিয়পত্নীর মত তাঁহার গাত্রস্পর্শ করিব কোন্ সাহসে? কিন্তু তিনি ত মৃতপ্রায়! যা হউক তা হউক, আমি তাঁহাকে স্পর্শ করিব।” তাই ভাবিয়াই সীতাস্পর্শে রাম চেতনা প্রাপ্ত হইলে, সীতা বলিলেন “ভঅবদি তমসে! অৌসরহ্ম জইদাবং মং পেক্‌খিস্মদি তদো অণব্তণুণ্ণাদসণ্ণিধাণেণ অহিঅদরং মম মহারাঅো কুবিস্মদি।” তবু “মম মহারাঅো!”
  26. যে নবোদ্গত মৃণাল পল্লবের ন্যায় কোমল দন্তদ্বারা তোমার কর্ণদেশ হইতে ক্ষুদ্র২ লবলী পল্লব টানিয়া লইত, সেই তোমার পুত্ত্র মদমত্ত বারণগণকে জয় করিল, সুতরাং এখনই সে যুবাবয়সের কল্যাণভাজন হইয়াছে। * * সখি বাসন্তি দেখ, বাছা কেমন নিজ কান্তার মনোরঞ্জন নৈপুণ্যও শিখিয়াছে। খেলা করিতে২ মৃণালকাণ্ড উৎপাটিত করিয়া তাহার গ্রাসের অংশে সুগন্ধি পদ্মসুবাসিত জলের গণ্ডূষ মিশাইরা দিতেছে; এবং শুণ্ডের দ্বারা পর্য্যাপ্ত জলকণায় তাহাকে সিক্ত করিয়া, স্নেহে অবক্রদণ্ড নলিনী পত্রের আতপত্র ধরিতেছে।
  27. আমার সেই পুত্ত্রদুটির অমলমুখপদ্মযুগল, যাহাতে কপোলাদেশ ঈষদ্বিরল এবং কোমল ধবল দশনে উজ্জ্বল, যাহাতে মৃদুমধুর হাসির অব্যক্তধ্বনি অবিরল লাগিয়া রহিয়াছে, যাহাতে কাকপক্ষ নিবদ্ধ আছে, তাহা আর্য্যপুত্ত্র কর্ত্তৃক পরিচুম্বিত হইল না!
  28. গীতা গোদাবরী সৈকতে হংস লইয়া কৌতুক করিতে করিতে বিলম্ব করিতেন। তখন তুমি এই লতাগৃহে থাকিয়া তাঁহার পথ চাহিয়া থাকিতে। সীতা আসিয়া তোমাকে বিশেষ **নায়মান দেখিয়া, তোমাকে প্রণাম করিবার জন্য পদ্মকলিকা তুল্য অঙ্গুলির দ্বারা কি সুন্দর অঞ্জলিবদ্ধ করিতেন।
  29. যেমন মেঘের শব্দ শুনিয়া, দৃপ্ত সিংহশিশুও হস্তি বিনাশ হইতে নিবৃত্ত হয়, সেইরূপ।
  30. সকৌতুক দর্পে আমার প্রতি বদ্ধলক্ষ্য হইয়া ধনু উত্থিত করিয়া, সৈন্যের দ্বারা পশ্চাতে অনুসৃত হইয়া, ইনি দুই দিগ্‌ হইতে বায়ুসঞ্চালিত এবং ইন্দ্রধনু শোভিত মেঘের মত দেখাইতেছেন।
  31. পাতালাভ্যন্তরবর্ত্তী কুঞ্জমধ্যে রাশীকৃত অন্ধকারের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ এবং উত্তপ্ত, প্রদীপ্ত পিত্তলের পিঙ্গলবৎ জ্যোতির্বিশিষ্ট জৃম্ভকাস্ত্রগুলির দ্বারা আকাশমণ্ডল ব্রহ্মাণ্ড প্রলয়কালীন দুর্নিবার ভৈরব বায়ুর দ্বারা বিক্ষিপ্ত এবং মেঘমিলিত বিদ্যুৎ কর্ত্তৃক পিঙ্গলবর্ণ এবং গুহাযুক্ত বিন্ধ্যাদ্রিশিখর ব্যাপ্তবৎ দেখাইতেছে।
  32. সেই রজনী অতিবাহিত হইলে, মহাতেজা রাজা রামচন্দ্র যজ্ঞস্থল গমন পূর্ব্বক ঋষি সকলকে আহ্বান করাইলেন। অনন্তর যশিষ্ঠ, বামদেব, কশ্যপ বংশোদ্ভব জাবালি, দীর্ঘতপা বিশ্বামিত্র, মহাতপা দুর্ব্বাসা, পুলস্ত্য, শক্তি, ভার্গব বামন, দীর্ঘায়ু মার্কণ্ড, মহাযশা মৌদ্গল্য, গর্গ, চ্যবন, ধর্ম্মজ্ঞ শতানন্দ, তেজস্বী ভরদ্বাজ, অগ্নিপুত্র সুপ্রভ, নারদ, পর্ব্বত, ও মহাযশা গৌতম, এবং অন্যান্য সংশিতব্রত মুনিগণ কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সকলেই সমাগত হইলেন। মহাবীর্য্য রাক্ষসগণ ও মহাবল বানরগণ মহাত্মা ক্ষত্রিয়গণ, এবং সহস্র২ বৈশ্য ও শূদ্রগণ এবং নানা দেশাগত ব্রতধারী ব্রাহ্মণ সকল কুতূহল বশতঃ সীতাশপথ দর্শন জন্য সকলেই সমাগত হইলেন।
     মহর্ষি বাল্মীকি তৎকালে সমাগত জনমণ্ডণী কৌতূকদর্শনার্থ পর্ব্বতবৎ নিশ্চলভাবে দণ্ডায়মান, ইহা শ্রবণ করিয়া সীতাসহিত শীঘ্র আগমন করিলেন। সীতাও কৃতাঞ্জলি, বাষ্পাকুল নয়না এবং অধোমুখী হইয়া মনোমধ্যে রামকে চিন্তা করিতে২ সেই ঋষির পশ্চাৎ২ গমন করিতে লাগিলেন। ব্রহ্মের অনুগামিনী শ্রুতির ন্যায় বাল্মীকির পশ্চাদ্বর্ত্তিনী সেই সীতাকে দেখিবামাত্র সেই স্থলে অতি মহৎ সাধুবাদ হইতে লাগিল। তৎপরে দুঃখজ অতিমহৎ শোক হেতু ব্যথিতান্তঃকরণ জন সকলের বিপুল হলহলা শব্দ উত্থিত হইল। দর্শকবৃন্দমধ্যে কতকগুলি সাধু রাম, কতকগুলি সাধু জানকী ও কতকগুলি উভয়ই সাধু, এই প্রকার কহিতে লাগিল।
     তদনন্তর মুনিশ্রেষ্ঠ বাল্মীকি সীতা সহিত জনবৃন্দমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া, রামকে এইরূপ বলিতে লাগিলেন। হে দাশরথি! ধর্ম্ম চারিণী, সুব্রতা, এই সীতা লোকাপবাদ হেতু আমার আশ্রম সমীপে পরিত্যক্তা হইয়াছিলেন। হে মহাব্রত রাম! ইনি এক্ষণে লোকাপবাদভীত তোমার নিকট প্রত্যয় প্রদান করিবেন; তুমি অনুজ্ঞা কর। এই দুই দুর্দ্ধর্ষ যমল জানকীপুত্ত্র তোমারই পুত্ত্র, ইহা আমি তোমাকে সত্য বলিতেছি। হে রাঘব নন্দন! আমি প্রচেতার দশম পুত্ত্র, আমি মিথ্যা বাক্য স্মরণও করি না; ইহারা তোমারই পুত্ত্র। আমি বহু সহস্র বর্ষ তপস্যা করিয়াছি; যদ্যপি এই জানকী দুশ্চারিণী হয়েন তাহা হইলে আমি যেন তাহার ফলপ্রাপ্ত না হই। কায়োমনে এবং কর্ম্মদ্বারা আমি পূর্ব্বে কখনই পাপাচরণ করি নাই; যদ্যপি জানকী নিষ্পাপা হয়েন তবে আমি যেন তাহার ফলভোগ করিতে পারি। হে রাঘব! আমি পঞ্চভূত ওষষ্ঠ স্থানীয় মনেতে সীতাকে বিশুদ্ধা বিবেচনা করিয়াই বননির্ঝরে গ্রহণ করিয়াছিলাম। এই অপাপা পতিপরায়ণা শুদ্ধচারিণী, লোকাপবাদভীত তোমার নিকট প্রত্যয় প্রদান করিবেন। হে রাজনন্দন! যে হেতু তুমি তোমার এই প্রিয়তমাকে বিশুদ্ধা জানিয়াও লোকাপবাদ ভয়ে পরিত্যাগ করিয়াছিলে, তজ্জন্যই দিব্যজ্ঞানে বিশুদ্ধা জানিয়াও আমি এই সরলাকে শপথার্থ আদেশ করিয়াছি!
     রাম বাল্মীকি কর্ত্তৃক এইরূপ কথিত হইয়া এবং সেই দেববর্ণিনী জনকীকে দেখিয়া, কৃতাঞ্জলি পূর্ব্বক জগৎস্থ জনগণের সমীপে এইরূপ বলিতে লাগিলেন। হে ধর্ম্মজ্ঞ! হে মহাভাগ! আপনি যাহা বলিতেছেন তাহাই সত্য। হে ব্রহ্মন্! আপনার পবিত্র বাক্যেতেই আমার প্রত্যয় হইয়াছে; এবং বৈদেহীও লঙ্কামধ্যে পূর্ব্বকালে দেবগণ সমীপে প্রত্যয় প্রদান ও শপথ করিয়াছেন তজ্জন্যই আমি ইঁহাকে গৃহে প্রবিষ্ট করাইয়াছিলাম। হে ব্রহ্মন্! এই জানকীকে আমি পবিত্রা জানিয়াও শুদ্ধ লোকাপবাদ ভয়ে ত্যাগ করিয়াছি। আর এই যমল কুশীলব আমারই পুত্ত্র, আমি তাহা জানি; কিন্তু আপনি আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি যে কারণে জানকীকে ত্যাগ করিয়াছি সেই লোকাপবাদ আমার পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা বলবান্। জগন্মধ্যে পবিত্রা জানকীতে আমার প্রীতি থাকুক।
     অনন্তর সীতাশপথ বিষয়ে রামের অভিপ্রায় জানিয়া দেবগণ ব্রহ্মাকে পুরোবর্ত্তী করিয়া সেই স্থলে সমাগত হইলেন এবং আদিত্যগণ বসুগণ রুদ্রগণ বিশ্বদেবগণ বায়ুগণ সকল সাধ্যগণ দেবগণ সকল পরমর্ষিগণ নাগ গণ পক্ষিগণ সিদ্ধগণ সকলেই হৃষ্টান্তঃকরণ হইয়া সেস্থলে আগমন করিলেন। রাম সমাগত সেই সকল দেবগণ ঋষিগণকে দেখিয়া পুনর্ব্বার বাল্মীকিকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন।
     হে মুনিশ্রেষ্ঠ! পবিত্র ঋষিবাক্যে আমার প্রতায় আছে। জগতে বিশুদ্ধশালিনী সীতার প্রতি আমার প্রীতি থাকুক; কিন্তু সীতাশপথ দর্শনজন্য কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া সকলে সমাগত হইয়াছেন।
     তখন দিব্য গন্ধবিশিষ্ট মনোহর এবং সর্ব্ব পাপ পুণ্য সাক্ষী পবিত্র বায়ু প্রবাহিত হইয়া সেই জনবৃন্দকে আহ্লাদিত করিল। পূর্ব্বকালে সত্যযুগের ন্যায় সেই আশ্চর্য্য অচিন্তনীয় ব্যাপার, সকল রাষ্ট্র হইতে সমাগত জনমণ্ডলী সমাহিত হইয়া দেখিতে লাগিল। কাষায় বস্ত্র পরিধানা সীতা সকলকে সমাগত দেখিয়া অধোমুখী, অধোদৃষ্টি এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া এই রূপ কহিতে লাগিলেন। যদি আমি মনেতেও রাম ভিন্ন অন্য চিন্তা না করিয়া থাকি, তবে পৃথিবীদেবী আমাকে বিবর প্রদান করুন। যদি আমি কায়মনোবাক্যে রামার্চ্চন করিয়া থাকি তবে পৃথিবীদেবী আমাকে বিবর প্রদান করুন। “আমি রাম ভিন্ন জানি না,” আমার এই বাক্য যদি সত্য হয় তবে পৃথিবীদেবী আমাকে বিবর প্রদান করুন।
     বৈদেহী এইরূপ শপথ করিলে, তখন অমিত বিক্রম দিব্য রত্নালঙ্কৃত নাগগণ কর্ত্তৃক মস্তকে বাহিত, দিব্যকান্তি, দিব্য সিংহাসন রসাতল হইতে সহসা আবির্ভূত হইল এবং সেই স্থলে পৃথিবীদেবী দুই বাহুদ্বারা সীতাকে গ্রহণ করিয়া এবং স্বাগত প্রশ্নে অভিনন্দন করিয়া সেই উত্তমাসনে উপবেশন করাইলেন।
     সিংহাসনারূঢ়া সেই সীতাকে রসাতলে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তদুপরি স্বর্গ হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল এবং দেবগণের অতি বিপুল সাধুবাদ হঠাৎ উত্থিত হইল। সীতার রসাতল প্রবেশ দেখিয়া অন্তরীক্ষ গত দেবগণ হৃষ্টান্তঃকরণ হইয়া, “সীতা সাধু সীতা সাধু যাঁহার এইরূপ চরিত্র” ইত্যাদি নানা প্রকার বাক্য কহিতে লাগিলেন। যজ্ঞস্থলগত সেই সকল মুনিগণ ও মনুষ্যশ্রেষ্ঠ রাজগণ এই অদ্ভুত ঘটনাহেতু বিস্ময় হইতে বিরত হইতে পারিলেন না। তৎকালে আাকাশে ভূতলে স্থাবর জঙ্গম পদার্থ, ও মহাকায় দানবগণ এবং পাতালে নাগ গণ সকলেই হৃষ্টান্তঃকরণ হইয়াছিলেন। তাঁহারা হৃষ্টমনে শব্দ করিতে লাগিলেন; কাহারা বা ধ্যানস্থ হইলেন, কাহারাও বা রামকে দেখিতে লাগিলেন এবং কেহ কেহ বা নিঃসংজ্ঞ হইয়া সীতাকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। এইরূপে সমাগত সেই সকল ঋষি প্রভৃতির সীতার রসাতল প্রবেশ দেখিয়া এই প্রকার সমাগম হইয়াছিল এবং সেই মুহুর্ত্তে সমুদায় জগৎ সমকালেই মোহিত হইয়াছিল।
  33. বেন্থাম বলেন, আমোদ সমান হইলে কাব্যের এবং ‘পুস্পিন্’ খেলার একই দর।