বিবিধ সমালোচন/বিদ্যাপতি ও জয়দেব
বিদ্যাপতি ও জয়দেব।
বাঙ্গালা সাহিত্যের আর যে দুঃখই থাকুক, উৎকৃষ্ট গীতি কাব্যের অভাব নাই। বরং অন্যান্য ভাষার অপেক্ষা বাঙ্গালায় এই জাতীয় কবিতার আধিক্য। অন্যান্য কবির কথা না ধরিলেও, একা বৈষ্ণব কবিগণই ইহার সমুদ্র বিশেষ। বাঙ্গালার সর্ব্বোৎকৃষ্ট কবি—জয়দেব—গীতিকাব্যের প্রণেতা। পরবর্ত্তী বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, এবং চণ্ডী দাসই প্রসিদ্ধ, কিন্তু আরও কতকগুলিন এই সম্প্রদায়ের গীতিকাব্যপ্রণেতা আছেন, তাঁহাদের মধ্যে অন্যূন চারি পাঁচজন উৎকৃষ্ট কবি বলিয়া গণ্য হইতে পারেন। ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরীকে এই শ্রেণীয় কাব্য বলিতে হয়। রামপ্রসাদ সেন, আর একজন প্রসিদ্ধ গীতি-কবি। তৎপরে কতকগুলি, “কবিওয়ালার” প্রাদুর্ভাব হয়, তন্মধ্যে কাহারও কাহারও গীত অতি সুন্দর। রাম বসু, হরু ঠাকুর, নিতাই দাসের এক একটি গীত এমত সুন্দর আছে, যে ভারতচন্দ্রের রচনার মধ্যে তত্তুল্য কিছুই নাই। কিন্তু কবিওয়ালাদিগের অধিকাংশ রচনা, অশ্রদ্ধেয় ও অশ্রাব্য সন্দেহ নাই। আধুনিক কবিদিগের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক জন অত্যুৎকৃষ্ট। হেম বাবুর গীতিকাব্যের মধ্যে এমত অংশ অনেক আছে, যে তাহা বাঙ্গালা ভাষায় তুলনা রহিত।
সকলই নিয়মের ফল। সাহিত্যও নিয়মের ফল। বিশেষ বিশেষ কারণ হইতে, বিশেষ বিশেষ নিয়মানুসারে, বিশেষ বিশেষ ফলোৎপত্তি হয়। জল উপরিস্থ বায়ু এবং নিম্নস্থ পৃথিবীর অবস্থানুসারে, কতকগুলি অসংখ্য নিয়মের অধীন হইয়া, কোথাও বাষ্প, কোথাও বৃষ্টিবিন্দু, কোথাও শিশির, কোথাও হিমকণা বা বরফ, কোথাও কুজ্ঝটিকা রূপে পরিণত হয়। তেমনি সাহিত্যও দেশভেদে, দেশের অবস্থা ভেদে, অসংখ্য নিয়মের বশবর্ত্তী হইয়া রূপান্তরিত হয়। সেই সকল নিয়ম অত্যন্ত জটিল, দুর্জ্ঞেয়, সন্দেহ নাই; এ পর্য্যন্ত কেহ তাহার সবিশেষ তত্ত্ব নিরূপণ করিতে পারেন নাই। কোম্ৎ বিজ্ঞান সম্বন্ধে যেরূপ তত্ত্ব আবিষ্কৃত করিয়াছেন, সাহিত্য সম্বন্ধে কেহ তদ্রূপ করিতে পারেন নাই। তবে ইহা বলা যাইতে পারে, যে সাহিত্য দেশের অবস্থা এবং জাতীয় চরিত্রের প্রতিবিম্ব মাত্র। যে সকল নিয়মানুসারে দেশভেদে, রাজবিপ্লবের প্রকার ভেদ, সমাজবিপ্লবের প্রকার ভেদ ধর্ম্মবিপ্লবের প্রকারভেদ ঘটে, সাহিত্যের প্রকার ভেদ সেই সকল কারণেই ঘটে। কোন কোন ইউরোপীয় গ্রন্থকার সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরিক সম্বন্ধ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। বক্ল ভিন্ন কেহ বিশেষ রূপে পরিশ্রম করেন নাই, এবং হিতবাদ মতপ্রিয় বক্লের সঙ্গে কাব্য সাহিত্যের সম্বন্ধ কিছু অল্প। মনুষ্যচরিত্র হইতে ধর্ম্ম এবং নীতি মুছিয়া দিয়া, তিনি সমাজতত্ত্বের আলোচনায় প্রবৃত্ত। বিদেশ সম্বন্ধে যাহা হউক, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এ তত্ত্ব কেহ কখন উত্থাপন করিয়াছিলেন এমত আমাদের স্মরণ হয় না। সংস্কৃত সাহিত্য সম্বন্ধে মক্ষমূলরের গ্রন্থ বহুমূল্য বটে, কিন্তু প্রকৃত সাহিত্যের সঙ্গে সে গ্রন্থের সামান্য সম্বন্ধ!
ভারতবর্ষীয় সাহিত্যের প্রকৃত গতি কি? তাহা জানি না, কিন্তু তাহার গোটাকত স্থূল স্থূল চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রথম ভারতীয় আর্য্যগণ অনার্য্য আদিম বাসীদিগের সহিত বিবাদে ব্যস্ত; তখন ভারতবর্ষীয়েরা অনার্য্যকুলপ্রমখনকারী, ভীতিশূন্য, দিগন্তবিচারী, বিজয়ী বীর জাতি। সেই জাতীয় চরিত্রের ফল রামায়ণ। তারপর ভারতবর্ষের, অনার্য্য শত্রু সকল ক্রমে বিজিত, এবং দূরপ্রস্থিত; ভারতবর্ষ আর্য্যগণের করস্থ, আয়ত্ত, ভোগ্য এবং মহা সমৃদ্ধিশালী। তখন আর্য্যগণ বাহ্য শত্রুর ভয় হইতে নিশ্চিন্ত, আভ্যন্তরিক সমৃদ্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট, হস্তগত অনন্তরত্নপ্রসবিনী ভারতভূমি অংশীকরণে ব্যস্ত। যাহা সকলে জয় করিয়াছে, তাহা কে ভোগ করিবে? এই প্রশ্নের ফল আভ্যন্তরিক বিবাদ। তখন আর্য্য পৌরুষ চরমে দাঁড়াইয়াছে— অন্য শত্রুর অভাবে সেই পৌরুষ পরস্পরের দমনার্থ প্রকাশিত হইয়াছে। এই সময়ের কাব্য মহাভারত। বল যাহার, ভারত তাহার হইল। বহু কালের রক্তবৃষ্টি শমিত হইল। স্থির হইয়া, উন্নতপ্রকৃতি আর্য্যকুল শান্তিসুখে মন দিলেন। দেশের ধন বৃদ্ধি, শ্রী বৃদ্ধি, ও সভ্যতা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। রোমক হইতে ববদ্বীপ ও চৈনিক পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের বাণিজ্য ছুটিতে লাগিল; প্রতি নদীকুলে অনন্তসৌধমালাশোভিত মহানগরী সকল মস্তক উত্তোলন করিতে লাগিল। ভারতবর্ষীয়েরা সুখী হইলেন। সুখী এবং কৃতী। এই সুখ ও কৃতিত্বের ফল, কালিদাসাদির নাটক ও মহাকাব্য সকল। কিন্তু লক্ষ্মী বা সরস্বতী কোথাও চিরস্থায়িনী নহেন। উভয়েই চঞ্চলা। ভারতবর্ষ ধর্ম্ম শৃঙ্খলে এরূপ নিবদ্ধ হইয়াছিল, যে সাহিত্যরস-গ্রাহিণী শক্তিও তাহার বশীভূতা হইল। প্রকৃতাপ্রকৃত বোধ বিলুপ্ত হইল। সাহিত্যও ধর্ম্মানুকারী হইল। কেবল তাহাই নহে, বিচার শক্তি ধর্ম্ম মোহে বিকৃত হইয়াছিল—প্রকৃত ত্যাগ করিয়া অপ্রকৃত কামনা করিতে লাগিল। ধর্ম্মই তৃষ্ণা, ধর্ম্মই আলোচনা, ধর্ম্মই সাহিতোর বিষয়। এই ধর্ম্মমোহের ফল পুরাণ।
ভারতবর্ষীয়েরা শেষে আসিয়া একটি এমন প্রদেশ অধিকার করিয়া বসতি স্থাপনা করিয়াছিলেন, যে তথাকার জল বায়ুর গুণে তাঁহাদিগের স্বাভাবিক তেজোলুপ্ত হইতে লাগিল। তথাকার তাপ অসহ্য, বায়ু জল বাষ্পপূর্ণ, ভূমি নিম্না, এবং ঊর্ব্বরা, এবং তাহার উৎপাদ্য অসার, তেজোহানিকারক ধান্য। সেখানে আসিয়া আর্য্যতেজঃ অন্তর্হিত হইতে লাগিল, আর্য্য প্রকৃতি কোমলতাময়ী, আলস্যের বশবর্ত্তিনী, এবং গৃহ সুখাভিলাষিণী হইতে লাগিল। সকলেই বুঝিতে পারিতেছেন, যে আমরা বাঙ্গালার পরিচয় দিতেছি। এই উচ্চাভিলাষশূন্য, অলস, নিশ্চেষ্ট, গৃহসুখপরায়ণ চরিত্রের অনুকরণে এক বিচিত্র গীতিকাব্য সৃষ্ট হইল। সেই গীতিকাব্যও উচ্চাভিলাষশূন্য, অলস, ভোগাসক্ত, গৃহসুখপরায়ণ। সে কাব্যপ্রণালী অতিশয় কোমলতা পূর্ণ, অতি সুমধুর, দম্পতী প্রণয়ের শেষ পরিচয়। অন্য সকল প্রকারের সাহিত্যকে পশ্চাতে ফেলিয়া, এই জাতি চরিত্রানুকারী গীতিকাব্য সাত আট শত বৎসর পর্য্যন্ত বঙ্গদেশে জাতীয় সাহিত্যের পদে দাঁড়াইয়াছে। এই জন্য গীতিকাব্যের এত বাহুল্য।
বঙ্গীয় গীতিকাব্য লেখকদিগকে দুই দলে বিভক্ত করা যাইতে পারে। একদল, প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে মনুষ্যকে স্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি দৃষ্টি করেন; আর একদল, বাহ্য প্রকৃতিকে দূরে রাখিয়া কেবল মনুষ্য হৃদয়কেই দৃষ্টি করেন। একদল মানব হৃদয়ের সন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া বাহ্যপ্রকৃতিকে দীপ করিয়া তদালোকে অন্বেষ্য বস্তুকে দীপ্ত এবং প্রস্ফুট করেন; আর এক দল, আপনাদিগের প্রতিভাতেই সকল উজ্জ্বল করেন, অথবা মনুষ্য চরিত্র খণিতে যে রত্ন মিলে, তাহার দীপ্তির জন্য অন্য দীপের আবশ্যক নাই, বিবেচনা করেন। প্রথম শ্রেণীর প্রধান জয়দেব, দ্বিতীয় শ্রেণীর মুখপাত্র বিদ্যাপতি। জয়দেবাদির কবিতায়, সতত মাধবী যামিনী, মলয়সমীর, ললিতলতা, কুবলয়দল শ্রেণী, স্ফুটিত কুসুম, শরচ্চন্দ্র, মধুকরবৃন্দ, কোকিলকুজিত কুঞ্জ, নবজলধর, এবং তৎসঙ্গে কামিনীর মুখমণ্ডলভ্রূবল্লী, বাহুলতা বিম্বৌষ্ঠ, সরসীরুহলোচন, অলসনিমেষ, এই সকলের চিত্র, বাতোন্মথিত তটিনীতরঙ্গবৎ সতত চাকচিক্য সম্পাদন করিতেছে। বাস্তবিক এই শ্রেণীর কবিদের কবিতায় বাহ্য প্রকৃতির প্রাধান্য। বিদ্যাপতি যে শ্রেণীর করি, তাঁহাদিগের কাব্যে বাহ্য প্রকৃতির সম্বন্ধ নাই এমত নহে—বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়ের নিত্য সম্বন্ধ সুতরাং কাব্যেরও নিত্য সম্বন্ধ, কিন্তু তাহাদিগের কাব্যে বাহ্য প্রকৃতির অপেক্ষাকৃত অস্পষ্টতা লক্ষিত হয়, তৎপরিবর্ত্তে মনুষ্য হৃদয়ের গূঢ় তলচারী ভাব সকল প্রধান স্থান গ্রহণ করে। জয়দেবাদিতে বহিঃপ্রকৃতির প্রাধান্য, বিদ্যাপতি প্রভৃতিতে অন্তঃপ্রকৃতির রাজ্য। জয়দেব, বিদ্যাপতি উভয়েই রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কথা গীত করেন। কিন্তু জয়দেব যে প্রণয় গীত করিয়াছেন, তাহা বহিরিন্দ্রিয়ের অনুগামী। বিদ্যাপতির কবিতা, বিশেষতঃ চণ্ডীদাসাদির কবিতা বহিরিন্দ্রিয়ের অতীত। তাহার কারণ কেবল এই বাহ্যপ্রকৃতির শক্তি। স্কুল প্রকৃতির সঙ্গে স্থূল শরীরেরই নিকট সম্বন্ধ, তাহার আধিক্যে কবিতা একটু ইন্দ্রিয়ানুসারিণী হইয়া পড়ে। বিদ্যাপতির দল মনুষ্য হৃদয়কে বহিঃপ্রকৃতি ছাড়া করিয়া, কেবল তৎপ্রতি দৃষ্টি করেন, সুতরাং তাঁহার কবিতা, ইন্দ্রিয়ের সংশ্রব শূন্য, বিলাস শূন্য, পবিত্র হইয়া উঠে। জয়দেবের গীত, রাধাকৃষ্ণের বিলাস পূর্ণ; বিদ্যাপতি গীত রাধাকৃষ্ণের প্রণয় পূর্ণ। জয়দেব ভোগ; বিদ্যাপতি, আকাঙ্ক্ষা ও স্মৃতি। জয়দেব সুখ, বিদ্যাপতি দুঃখ। জয়দের বসন্ত বিদ্যাপতি বর্ষা। জয়দেবের কবিতা, উৎফুল্ল কমলজালশোভিত, বিহঙ্গমাকুল, স্বচ্ছ বারিবিশিষ্ট সুন্দর সরোবর; বিদ্যাপতির কবিতা দূরগামিনী বেগবতী তরঙ্গসঙ্কুলা নদী। জয়দেবের কবিতা স্বর্ণহার, বিদ্যাপতির কবিতা রুদ্রাক্ষমালা। জয়দেবের গান, মুরজবীণাসঙ্গিনী স্ত্রীকণ্ঠগীতি, বিদ্যাপতির গান, সায়াহ্ণ সমীরণের নিশ্বাস।
আমরা জয়দেব ও বিদ্যাপতির সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি তাহাদিগকে এক এক ভিন্নশ্রেণীর গীতিকবির আদর্শস্বরূপ বিবেচনা করিয়া তাহা বলিয়াছি। যাহা জয়দের সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা ভারতচন্দ্র সম্বন্ধে বর্ত্তে, যাহা বিদ্যাপতি সম্বন্ধে বলিয়াছি তাহা গোবিন্দদাস চণ্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের সম্বন্ধে তদ্রূপই বর্ত্তে।
আধুনিক বাঙ্গালি গীতিকাব্য লেখকগণকে একটি তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করা যাইতে পারে। তাঁহারা আধুনিক ইংরাজি গীতিকবিদিগের অনুগামী। আধুনিক ইংরাজি কবি ও আধুনিক বাঙ্গালি কবিগণ সভ্যতা বৃদ্ধির কারণে স্বতন্ত্র একটি পথে চলিয়াছেন। পূর্ব্ব কবিগণ, কেবল আপনাকে চিনিতেন, আপনার নিকটবর্ত্তী যাহা তাহা চিনিতেন। যাহা আভ্যন্তরিক, বা নিকটস্থ, তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ সন্ধান জানিতেন, তাহার অননুকরণীয় চিত্র সকল রাখিয়া গিয়াছেন। এক্ষণকার কবিগণ জ্ঞানী—বৈজ্ঞানিক, ইতিহাসবেত্তা, আধ্যাত্মিকতত্ত্ববিৎ। নানা দেশ, নানা কাল, নানা বস্তু তাঁহাদিগের চিত্তমধ্যে স্থান পাইয়াছে। তাঁহাদিগের বুদ্ধি বহুবিষয়িণী বলিয়া তাঁহাদিগের কবিতা বহুবিষয়িণী হইরাছে। তাঁহাদিগের বুদ্ধি দূরসম্বন্ধগ্রাহিণী বলিয়া তাঁহাদিগের কবিতাও দূরসম্বন্ধ প্রকাশিকা হইয়াছে। কিন্তু এই বিস্তৃতিগুণ হেতু প্রগাঢ়তা গুণের লাঘব হইয়াছে। বিদ্যাপতি প্রভৃতির কবিতার বিষয় সঙ্কীর্ণ, কিন্তু কবিত্ব প্রগাঢ়; মধুসূদন বা হেমচন্দ্রের কবিতার বিষয় বিস্তৃত, কিন্তু কবিত্ব তাদৃশ প্রগাঢ় নহে। জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, কবিত্বশক্তির হ্রাস হয় বলিয়া যে প্রবাদ আছে, ইহা তাহার একটি কারণ। যে জল সঙ্কীর্ণ কুপে গভীর; তাহা তড়াগে ছড়াইলে আর গভীর থাকে না।
মানস বিকাশ এই কথা প্রমাণ করিতেছে। আমরা মানস বিকাশ পাঠ করিয়া আহ্লাদিত হইরাছি —“মিলন” ও “কাল” নামক দুইটি কবিতা উৎকৃষ্ট। “কাল” হইতে জাগরা কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি।
সহসা যখন বিধির আদেশে,
সুধাংশু কিরণ শোভি নভোদেশে
রজত ছটায় ধাইল হরষে,
ভুবনময়,
নর নারী কীট পতঙ্গ সহিত
বসুন্ধরা ঘরে ইইল সৃজিত
গ্রহ উপগ্রহ হইল শোভিত
হলো উদয়।
তখন ত কাল প্রচণ্ড শাসনে,
রাখিতে সকলে আপন অধীনে
সব সময়॥
দুরন্ত দংশন কালরে তোমার,
তব হাতে কারও নাহিক নিস্তার,
ছোট বড় তুমি কর না বিচার,
বধ সকলে।
রাজেন্দ্র মুকুট করিয়া হরণ,
দুঃখ নীরে কর নিমগন,
পদযুগে পরে কররে দলন,
আপন বলে॥
সুখের আগারে বিষাদ আনিয়া
কতশত নরে যাও ভাসাইয়া,
নয়নজলে।
এ কবিতা উত্তম, কিন্তু ইহাতে বড় ইংরেজি ইংরেজি গন্ধ কয়। প্রাচীন বাঙ্গালি গীতিকাব্য লেখকেরা এ পথে যাইতেন না; কালের কথা গায়িতে গেলে, সৃষ্টির আদি, রাজেন্দ্রের মুকুট, সমগ্র মনুষ্য জাতির নয়নজন তাঁহাদিগের মনে পড়িত না; এসকল জ্ঞান ও বুদ্ধি বিস্তৃতির ফল। প্রাচীন কবি, কালের গতি ভাবিতে গেলে, আপনার হৃদয়ই ভাবিতেন; নিজ হৃদয়ে কালের “দুরন্ত দংশন” কি প্রকার, তাহার বিষ কেমন, তাহাই দেখিতেন। কাল সম্বন্ধে একটি প্রাচীন কবিতা তুলনার জন্য আমরা উদ্ধৃত করিলাম।
এখন তখন করি, দিবস গোয়াঙনু
দিবস দিবস করি মাসা।
মাস মাস করি বরিখ গোয়াঙনু
খোয়ানু এ তনুয়াক আশা॥
বরিখ বরিখ করি, সময় গোয়াঙনু
খোয়াঙনু এ তনু আশে।
হিমকর কিরণে নলিনী যদি জারব
কি করবি মাধবি মাসে॥
অঙ্কুর তপন তাপে তনু যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
ইহ নব যৌবন বিরহে গোঙায়ব
কি করব সোপিয়া লেহে॥
কব্যে অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে যথার্থ সম্বন্ধ এই যে, উভয়ে উভয়ের প্রতিবিম্ব নিপতিত হয়। অর্থাৎ বহিঃপ্রকৃতির গুণে হৃদয়ের ভাবান্তর ঘটে, এবং মনের অবস্থাবিশেষে বাহ্য দৃশ্য সুখকর বা দুঃখকর বোধ হয়—উভয়ে উভয়ের ছায়া পড়ে। যখন বহিঃপ্রকৃতি বর্ণনীয়, তাহা অন্তঃপ্রকৃতির সেই ছায়া সহিত চিত্রিত করাই কাব্যের উদ্দেশ্য। যখন অন্তঃপ্রকৃতি বর্ণনীয়, তখন বহিঃ প্রকৃতির ছায়া সমেত বর্ণনা তাহার উদ্দেশ্য। যিনি, ইহা পারেন, তিনিই সুকবি। ইহার ব্যতিক্রমে এক দিকে ইন্দ্রিয়পরতা, অপর দিকে আধ্যাত্মিকতা দোষ জন্মে। এ স্থলে শারীরিক ভোগাশক্তিকেই ইন্দ্রিয়পরতা বলিতেছি না চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে আনুরক্তিকে ইন্দ্রিয়পরতা বলিতেছি। ইন্দ্রিয়পরতা দোষের উদাহরণ, কালিদাস ও জয়দেব। আধ্যাতিকতা দোষের উদাহরণ, পোপ ও জন্সন।
ভারতচন্দ্রাদি বাঙ্গালি কবি, যাঁহারা কালিদাস ও জয়দেবকে আদর্শ করেন, তাঁহাদের কাব্য ইন্দ্রিয়পর। কোন মূর্খ না মনে করেন, যে ইহাতে কালিদাসাদির কবিত্বের নিন্দা হইতেছে—কেবল কাব্যের শ্রেণী নির্ব্বাচন হইতেছে মাত্র। আধুনিক, ইংরেজি কাব্যের অনুকারী বাঙ্গালি কবিগণ, কিয়দংশে আধ্যাতিকতা দোষে দুষ্ট। মধুসূদন, যেরূপ ইংরেজি কবিদিগের শিষ্য, তেমনি কতকদূর জয়দেবাদির শিষ্য, এই জন্য তাঁহাতে আধ্যাত্মিক দোষ তাদৃশ স্পষ্ট নহে। হেমচন্দ্র, নিজের প্রতিভা শক্তির গুণে নূতন পথ খনন করিতেছেন, তাঁহারও আধ্যাতিকতা দোষ অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট; কিন্তু অবকাশরঞ্জিনীয় লেখক, এবং মানস বিকাশ লেখকের এ দোষ বিলক্ষণ প্রবল। নিম্নশ্রেণীর কবিদিগের মধ্যেও ইহা প্রবল। যাঁহারা নিত্য পয়ার রচনা করিয়া বঙ্গদেশ প্লাবিত করিতেছেন, তাঁহারা যেন না মনে করেন, তাঁহাদিগের প্রতি আমরা এ দোষ আরোপিত করিতেছি। অন্তঃপ্রকৃতি বা বহিঃপ্রকৃতি কোন প্রকৃতির সঙ্গে তাঁহাদিগের কোন সম্বন্ধ নাই, সুতরাং তাঁহাদিগের কোন দোষই নাই।
মানস বিকাশের কবিতার মধ্যে সর্ব্বোৎকৃষ্ট কবিতা “মিলন” কিন্তু তাহার অধিকাংশ উদ্ধৃত না করিলে তাহার উৎকর্ষ অনুভূত করা যায় না। তাহা কর্ত্তব্য নহে, এবং তদুপযুক্ত স্থানও আমাদিগের নাই। এজন্য “প্রেম প্রতিমা” হইতে কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছি।
আইল বসন্ত বিজন কাননে,
অমনি তখনি সহাস্য বদনে,
তরুলতা যথা বিবিধ ভূষণে,
সাজায় কায়,
তুমিও যেখানে কর পদার্পণ,
সুখচন্দ্র তথা বিতরে কিরণ,
বিষাদ, হতাশ, জনম মতন
চলিয়া যায়।
তব আবির্ভাবে, ভুবন মোহিনি,
মরুভূমে বহে গভীর বাহিনী,
ফোটে পারিজাত আসিয়া আপনি
ধরণী তলে,
আঁধার আকাশে হিমাংশু কিরণ
হাসি হাসি করে কর বিতরণ,
ভাসে যেন, মরি অখিল ভূবন,
সুখ সলিলে।
কে বলে কেবল নন্দন কাননে,
ফোটে পারিজাত? ফোটেনা এখানে
দেখ চেয়ে এই সংসার কাননে
ফুটেছে কত!
গৃহস্থের ঘরে, রাজার ভবনে,
রোগীর শিয়রে, বিজন কাননে,
কতশত ফুল প্রফুল্ল বদনে
ফোটে নিয়ত!
ইংরেজ শিষ্য, এইরূপে প্রেম বর্ণন করিলেন, ইহার সঙ্গে কণ্ঠীধারী বৈরাগিগণ কৃত প্রেমবর্ণন তুলনা করুন, কিন্তু তৎপূর্ব্বে আর একজন হাফ ইংরেজ হাফ জয়দেব চেলার কৃত কবিতা শুনুন; এ কবিতারও উদ্দেশ্য প্রেমোচ্ছাস বর্ণনা।
মানস সরসে সখি ভাসিছে মরালরে
কমল কাননে।
কমলিনী কোন ছলে, ডুবিয়া থাকিবে জলে,
বঞ্চিয়া রমণে।
যে যাহারে ভাল বাসে, সে যাইবে তার পাশে,
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিব কেমনে।
যদি অবহেলা করি, রুষিবে নস্বর-অরি,
কে সম্বরে স্মরশরে, এ তিন ভুবনে॥
ওই শুন পুন বাজে মজাইয়া মনরে
মুরারির বাঁশী।
সুমন্দ মলর আনে, ও নিনাদ মোর কানে
আমি শ্যামদাসী।
জলদ গরজে যবে, ময়ূরী নাচে সে রবে,
আমি কেন না কাটিব শরমের ফাশী?
সৌদামিনী ঘন সনে, নাচে সদানন্দ মনে
রাধিকা কেন ত্যজিবে রাধিকা বিলাসী॥
সাগর উদ্দেশে নদী ভ্রমে দেশে দেশে রে
অবিরাম গতি!
গগনে উদিলে শশী, হাসি যেন পড়ে খসি,
নিশি রূপবতী॥
আমার প্রেম সাগর, দুয়ারে মোর নাগর,
তারে ছেড়ে রব আমি? ধিক্ এ কুমতি!
আমার সুধাংশু নিধি, আমারে দিয়াছে বিধি,
বিরহ আঁধারে আমি? ধিক্ এ যুকতি!”
একণে বৈষ্ণবের দলের দুই একটা গীত—
সই, কি না সে বঁধুর প্রেম।
আঁখি পালটিতে নহে পরতীতে
যেন দরিদ্রের হেম।
হিয়ায় হিয়ায়, লাগিবে লাগিয়ে,
চন্দন না মাখে অঙ্গে।
গায়ের ছায়া, রাইয়ের দোসর,
সদাই ফিরয়ে সঙ্গে॥
তিলে কত বেরি, মুখ নিহারয়ে,
আঁচরে মোছয়ে ঘাম।
কোরে থাকিতে কত দূর মানয়ে,
তেঁই সদাই নয় নাম॥
জাগিতে ঘুমাইতে, আন নাহি চিতে
রসের পসরা কাছে।
জ্ঞানদাস কহে, এমতি পীরিতি,
আর কি জমতে আছে॥
পুনশ্চ,
সোই পীরিতি পিয়া সে জানে।
যে দেখি যে শুনি, চিতে অনুমানি,
নিছনি দিবে পরাণে॥
মো যদি সিনান, আগিলা ঘাটে,
পিছিলা ঘাটে সে নায়।
মোর অঙ্গের জল পরশ লাগিয়ে,
বাহু পশারিয়া রয়॥
বসনে বসন লাগিবে লাগিয়ে
একই রজকে দেয়।
মোর নামের আধ আখর পাইলে
হরিষ হইয়ে নেয়॥
ছায়ায় ছায়ায় লাগিবে লাগিয়ে
ফিরয়ে কতেক পাকে॥
আমার অঙ্গের বাতাস, যেদিকে যেদিন
সেদিকে সেদিন থাকে॥
মনের আকুতি বেকত[১] করিতে
কত না সন্ধান জানে।
পায়ের সেবক রায় শেখর
কিছু বুঝে অনুমানে॥
পরিশেষে আমাদের গীতিকাব্যের আদিপুরুষ, এ শ্রেণীর সকল কবির আদর্শ, জয়দেব গোস্বামীর একটি গীত উদ্ধৃত করিব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জয়দের যেমন সুকবি, ডেমনি রসিক—তাঁহার কবিতার রস বড় গাঢ়। তবে যাত্রাকর দিগের কৃপায়, অনেকে তাঁহার দুই একটি গীত, বুঝুন না বুঝুন, শুনিয়া রাখিয়াছেন। যাঁহারা বুঝিয়াছেন, বা গীত পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা জয়দেবের একটি গীত স্মরণ করুন—“বদসি যদি কিঞ্চিদপি” ইত্যাদি গীত স্মরণ করিলেও চলিবে। এই কয়টি কবিতা তুলনা করিয়া দেখিলে দেখিবেন,
প্রথম, জয়দেবে বহিঃপ্রকৃতি ভক্তি ইন্দ্রিয় পরতায় দাঁড়াইয়াছে।
দ্বিতীয়, জ্ঞানদাস ও রায় শেখরে বহিঃপ্রকৃতি অন্তঃপ্রকৃতির পশ্চাদ্বর্ত্তিনী এবং সহচরী মাত্র। আর কবিতার গতি অতি সঙ্কীর্ণ পথে—নিকট সম্বন্ধ ছাড়িয়া দূর সম্বন্ধ বুঝাইতে চায় না —কিন্তু সেই সঙ্কীর্ণ পথে গতি অত্যন্ত বেগবতী।
তৃতীয়, মধুসূদনের কবিতার, সেই গতি পরিসরপথবর্ত্তিনী হইয়াছে—দুর সম্বন্ধে ব্যক্ত করিতে শিখিয়াছে—কিন্তু কবিতার আর সে পাষাণভেদিনী শক্তি নাই। নদীর স্রোতের ন্যায়, বিস্তৃতিতে যাহা লাভ হইয়াছে, বেগে তাহার ক্ষতি হইয়াছে।
চতুর্থ, মানস ধিকাশে, আধ্যাত্মিকতা দোষ ঘটিয়াছে।
- ↑ ব্যক্ত