বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্‌মিদের কবচ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গজেন্দ্রকুমার মিত্র, চণ্ডীদাস চট্টোপাধ্যায়, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত
(পৃ. ১৮৭-১৮৯)

তৃতীয় পরিচ্ছেদ


তারপর গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ী গেলাম।

 গিয়ে দেখি, যেখানটাতে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ী—তার দু’দিকে ঘন-জঙ্গল। একদিকে দূরে একটা গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা, একদিকে একটি হচ্ছে বাড়ী।

 আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের কথা জিগ্যেস ক’রে জানলাম, সে এখনও মহকুমা থেকে ফেরে নি। তবে একটি প্রৌঢ়ার সঙ্গে দেখা হলো—শুনলাম তিনি গাঙ্গুলিমশায়ের আত্মীয়া।

 তাঁকে জিগ্যেস করলাম—গাঙ্গুলিমশায়কে শেষ দেখেছিলেন কবে?

 —বুধবার।

 —কখন?

 —বিকেল পাঁচটার সময়।

 —কিভাবে দেখেছিলেন?

 —সেদিন হাটবার ছিল—উনি হাটে যাবার আগে আমার কাছে পয়সা চেয়েছিলেন।

 —কিসের পয়সা?

 —সুদের পয়সা। আমি ওঁর কাছে দুটো টাকা ধার নিয়েছিলাম ও-মাসে।

 —আপনার পর আর কেউ দেখেছিল?

 গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ীর ঠিক পশ্চিম গায়ে যে বাড়ী, সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে প্রৌঢ়া বললেন—ওই বাড়ীর রায়-পিসি আমার পরও তাঁকে দেখেছিলেন।

 আমি বৃদ্ধা রায়-পিসির বাড়ী গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতেই বৃদ্ধা আমায় আশীর্বাদ করে একখানা পিঁড়ি বার ক’রে দিয়ে বললেন—বোসো বাবা।

 আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম—আপনি একা থাকেন নাকি এ বাড়ীতে।

 —হ্যাঁ বাবা। আমার তো কেউ নেই—মেয়ে-জামাই আছে, তারা দেখাশুনো করে।

 —মেয়ে-জামাই এখানে থাকেন?

 —এখানেও থাকে, আবার তাদের দেশ এই এখান থেকে চার ক্রোশ দূর সাধুহাটি গাঁয়ে, সেখানেও থাকে।

 —গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি বুধবার কখন দেখেন?

 —রাত্তিরে যখন উনি হাট থেকে ফিরলেন—তখন আমি বাইরের রোয়াকে বসে জপ করছিলাম। তারপর আর চোখে না দেখলেও ওঁর গলার আওয়াজ শুনেচি রাত দশটা পর্য্যন্ত—উনি ওঁর রান্নাঘরে রাঁধছিলেন আলো জ্বেলে, আমি যখন শুতে যাই তখন পর্য্যন্ত।

 —তখন রাত কত হবে?

 —তা কি বাবা জানি? আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক—ঘড়ি তো নেই বাড়ীতে। তবে তখন ফরিদপুরের গাড়ী চলে গিয়েচে। আমরা শব্দ শুনে বুঝি কখন কোন্ গাড়ী এল গেল।

 —একা থাকতেন, আর রাত পর্য্যন্ত রান্না করছিলেন—এত কি রান্না?

 —সেদিন মাংস এনেছিলেন হাট থেকে। মাংস সেদ্ধ হতে দেরি হচ্ছিল।

 —আপনি কি ক’রে জানলেন?

 —পরে আমরা জেনেছিলাম। হাটে যারা ওঁর সঙ্গে একসঙ্গে মাংস কিনেছিল—তারা বলেছিল। তাছাড়া যখন রান্নাঘর খোলা হলো—বাবাগো!

 ব’লে বৃদ্ধা যেন সে দৃশ্যের বীভৎসতা মনের পটে আবার দেখতে পেয়ে শিউরে উঠে কথা বন্ধ করলেন। সঙ্গে যে প্রৌঢ়া আত্মীয়াটি ছিলেন গাঙ্গুলিমশায়ের, তিনিও বললেন—ও বাবা, সে রান্নাঘরের কথা মনে হোলে এখনও গা ডোল দেয়!

 আমি আগ্রহের সঙ্গে ব’লে উঠলাম—কেন? কেন?—কি ছিল রান্নাঘরে?

 বৃদ্ধা বল্লেন—থালার চারদিকে ভাত ছড়ানো—মাংসের ছিবড়ে আর হাড়গোড় ছড়ানো।

 বাটিতে তখনও মাংস আর ঝোল রয়েচে—ঘরের মেঝেতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন—তিনি খেতে বসেছিলেন এবং তাঁর খাওয়া শেষ হবার আগেই যারা তাঁকে খুন করে তারা এসে পড়ে।

 প্রৌঢ়াও বল্লেন—হ্যাঁ বাবা, এ সবাই দেখেচে। পুলিসও এসে রান্নাঘর দেখে গিয়েচে। সকলেরই মনে হোলো, ব্রাহ্মণের খাওয়া শেষ হবার আগেই খুনেরা এসে তার ওপর পড়ে।

 —আচ্ছা বেশ, এ গেল বুধবার রাতের ব্যাপার। সেদিনই হাট ছিল তো?

 —হ্যাঁ বাবা, তার পরদিন সকালে উঠে আমরা দেখলাম, ওঁর ঘরের দরজা বাইরের দিকে তালা-চাবি দেওয়া। প্রথম সকলেই ভাবলে উনি কোথাও কাজে গিয়েচেন, ফিরে এসে রান্নাবান্না করবেন। কিন্তু যখন বিকেল হয়ে গেল, ফিরলেন না—তখন আমরা ভাবলাম, উনি ওঁর ছেলেদের কাছে কলকাতায় গেছেন।

 —তারপর?

 —বিষ্যুদবার গেল, শুক্রবার গেল, শুক্রবার বিকেলের দিকে বন্ধ-ঘরের মধ্যে থেকে কিসের দুর্গন্ধ বেরুতে লাগলো—তাও সবাই ভাবলে, ভাদ্রমাস, গাঙ্গুলিমশায় হয়তো তাল কুড়িয়ে ঘরের মধ্যে রেখে গিয়েছিলেন, তাই পচে অমন গন্ধ বেরুচ্চে।

 —শনিবার আপনারা কোন্ সময় টের পেলেন যে, তিনি খুন হয়েচেন?

 —শনিবারে আমি গিয়ে গ্রামের ভদ্রলোকদের কাছে সব বললাম। অনেকেই জানতো না যে, গাঙ্গুলিমশায়কে এ ক’দিন গাঁয়ে দেখা যায়নি। তখন সকলেই এল। গন্ধ তখন খুব বেড়েচে! পচা তালের গন্ধ ব’লে মনে হচ্ছে না!

 —কি করলেন আপনারা?

 —তখন সকলে জানলা খোলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু সব জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। দোর ভাঙাই সাব্যস্ত হোলো। পরের ঘরের দোর ভেঙে ঢোকা ঠিক নয়—এরপর যদি তা নিয়ে কোনো কথা ওঠে। তখন চৌকিদার আর দফাদার ডেকে এনে তাদের সামনে দোর ভাঙা হোলো।

 —কি দেখা গেল?

 —দেখা গেল, তিনি ঘরের মধ্যে মরে প’ড়ে আছেন! মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে মারার দাগ। মেজে খুঁড়ে রাশীকৃত মাটি বার করা, ঘরের বাক্স-প্যাঁট্‌রা সব ভাঙা, ডালা খোলা—সব তচ্‌নচ্ করেচে জিনিসপত্র। . . . তারপর ওঁর ছেলেদের টেলিগ্রাম করা হোলো।

 —এ-ছাড়া আর কিছু আপনারা জানেন না?

 —না বাবা, আর আমরা কিছু জানিনে।

 গাঙ্গুলিমশায়ের প্রতিবেশিনী সেই বৃদ্ধাকে জিগ্যেস করলাম—রাত্রে কোনোরকম শব্দ শুনেছিলেন? গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ী থেকে?

 —কিছু না। অনেক রাত্তিরে আমি যখন শুতে যাই—তখনও ওঁর রান্নাঘরে আলো জ্বলতে দেখেচি। আমি ভাবলাম, গাঙ্গুলিমশায় আজ এখনও দেখি রান্না করচেন!

 —কেন, এরকম ভাবলেন কেন?

 —এত রাত পর্য্যন্ত তো উনি রান্নাঘরে থাকেন না; সকালরাত্তিরেই খেয়ে শুয়ে পড়েন। বিশেষ ক’রে সেদিন গিয়েছে ঘোর অন্ধকার রাত্তির—অমাবস্যা, তার ওপর টিপ্-টিপ্ বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছিল সন্ধ্যে থেকেই।

 —তখন তো আর আপনি জানতেন না যে, উনি হাট থেকে মাংস কিনে এনেচেন?

 —না, এমন কিছুই জানিনে। . . . হ্যাঁ বাবা, . . . যখন এত ক’রে জিগ্যেস করচো, তখন একটা কথা আমার এখন মনে হচ্চে—

 —কি, কি, বলুন?

 —উনি ভাত খাওয়ার পরে রোজ রাত্তিরে কুকুর ডেকে এঁটো পাতা, কি পাতের ভাত তাদের দিতেন, রোজ-রোজ ওঁর গলার ডাক শোনা যেত। সেদিন আমি আর তা শুনি নি।

 —ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো।

 —না বাবা, বুড়ো-মানুষ—ঘুম সহজে আসে না। চুপ ক’রে শুয়ে থাকি বিছানায়। সেদিন আর ওঁর কুকুরকে ডাক দেওয়ার আওয়াজ আমার কানেই যায়নি।

 ভালো ক’রে জেরা করার ফল অনেক সময় বড় চমৎকার হয়। মিঃ সোম প্রায়ই বলেন—লোককে বারবার করে প্রশ্ন জিগ্যেস করবে। যা হয়তো তার মনে নেই, বা, খুঁটিনাটির ওপর সে তত জোর দেয় নি—তোমার জেরায় তা তারও মনে পড়বে। সত্য বার হয়ে আসে অনেক সময় ভালো জেরার গুণে।