বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্মিদের কবচ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আমার মামার বাড়ীর পাশে সুরেশ ডাক্তারের বাড়ী। সে আমার সমবয়সী—গ্রামে প্র্যাক্টিশ করে। মোটামুটি যা রোজগার করে, তাতে তার চলে যায়। ওর কাছে ক্ষতস্থান ধুইয়ে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে আবার শ্রীগোপালদের গ্রামেই ফিরলাম। জানকীবাবুর সঙ্গে পথে দেখা। তিনি বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েচেন। আমায় বল্লেন—আজই ফিরলেন?
তাঁর কথার উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ আমার মনে পড়লো, মিস্মিদের কবচখানা আমার পকেটেই আছে এখনও—সামনে রাত আসচে আবার, ও-জিনিসটা সঙ্গে এনে ভালো করিনি, মামার বাড়ি রেখে আসাই উচিত ছিল বোধ হয়।
জানকীবাবুর পরামর্শটা একবার নিলে কেমন হয়, জিনিসটা দেখিয়ে?
কিন্তু ভাবলাম, এ-জিনিসটা ওঁর হাতে দিতে গেলে এখন বহু কৈফিয়ৎ দিতে হবে ওই সঙ্গে। হয়তো তিনি জিনিসটার গুরুত্ব বুঝবেন না—দরকার কি দেখানোর?
জানকীবাবুর শ্বশুরবাড়ী শ্রীগোপালের বাড়ীর পাশেই।
ওঁর বৃদ্ধা শাশুড়ী, দেখি বাইরের রোয়াকে ব’সে মালা জপ করচেন। আমি তাঁকে আরও কিছু জিগ্যেস করবার জন্তে সেখানে গিয়ে বসলাম।
বুড়ী বল্লে—এসো দাদা, বসো।
—ভালো আছেন, দিদিমা?
—আমাদের আবার ভালোমন্দ—তোমরা ভালো থাকলেই আমাদের ভালো।
—আপনি বুঝি একাই থাকেন?
—আর কে থাকবে বলো—আছেই-বা কে? এক মেয়ে ছিল, মারা গিয়েচে।
—তবে তো আপনার বড় কষ্ট, দিদিমা!
—কি করবো দাদা, অদেষ্টে দুঃখ থাকলে কেউ ঠ্যাকাতে পারে?
আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বুড়ীর সামনের গোয়ালের ছিটেবেড়ায় একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েচে–জিনিসটা হচ্চে, খুব বড় একটা পাতার টোকা। পাতাগুলো শুকনো তামাক-পাতার মত ঈষৎ লাল্চে। পাতার বোনা ও রকম টোকা, বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে কখনো দেখি নি।
জিগ্যেস করলাম—দিদিমা, ও জিনিসটা কি? এখানে তৈরি হয়?
বৃদ্ধা বল্লেন—ওটা এ-দেশের নয় দাদা।
—কোথায় পেয়েছিলেন ওটা?
—আমার জামাই এনে দিয়েছিল।
—আপনার জামাই? জানকীবাবু বুঝি?
—হ্যাঁ দাদা। ও আসামের চা-বাগানে থাকতো কিনা, ও-ই আর বছর এনেছিল।
হঠাৎ আমার মনে কেমন একটা খট্কা লাগলো...আসাম!...চা বাগান! এই ক্ষুদ্র গ্রামের সঙ্গে সুদুর আসামের যোগ কিভাবে স্থাপিত হতে পারে—এ আমার নিকট একটা মস্ত-বড় সমস্যা। একটা ক্ষীণ সূত্র মিলেচে।আমি বল্লাম—জানকীবাবু বুঝি আসামে থাকতেন?
—হ্যাঁ দাদা, অনেকদিন ছিল। এখন আর থাকে না। আমার সে মেয়ে মারা গিয়েচে কিনা! তবুও জামাই মাঝে-মাঝে আসে। গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে বড় ভাব ছিল। এলেই ওখানে বসে গল্প, চা খাওয়া—
—ও!
—বুড়ো খুন হয়েছে শুনে জামাইয়ের কি দুঃখু!
—গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর ক’দিন পরে এলেন উনি?
—তিন-চার দিন পরে দাদা!
—আপনার মেয়ে মারা গিয়েচেন কতদিন হোলো দিদিমা?
—তা, বছর-তিনেক হোলো—এই শ্রাবণে।
—মেয়ে মারা যাওয়ার পর উনি যেমন আসছিলেন, তেমনই আসতেন, না, মধ্যে কিছুদিন আসা বন্ধ ছিল?
—বছর-দুই আর আসে নি। মন তো খারাপ হয়, বুঝতেই পারো দাদা! তারপর এলো একবার শীতকালে। এখানে রইলো মাসখানেক। বেশ মন লেগে গেল। সেই থেকে প্রায়ই আসে।
আমি বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেদিন আর কোথাও বেরুলাম না। পরদিন সকালে উঠে স্থির করলাম একবার থানায় দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। বিশেষ আবশ্যক।
পথেই জানকীবাবুর সঙ্গে দেখা। আমায় জিগ্যেস করলেন—এই যে! বেড়াচ্ছেন বুঝি?
আমি বল্লাম—চলুন, ঘুরে আসা যাক একটু। আপত্তি আছে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন না যাই।
—আচ্ছা জানকীবাবু, আপনি মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করেন?
—হ্যাঁ, খানিকটা করিও বটে, খানিকটা না-ও বটে। কেন বলুন তো?
—আমার নিজের ওতে একেবারে বিশ্বাস নেই। তাই বলচি। আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেচেন, আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি।
হঠাৎ জানকীবাবু আমার চোখের সামনে এমন একটা কাণ্ড করলেন, যাতে আমি স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্যে।