বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্মিদের কবচ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(পৃ. ১৮৪-১৮৬)
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলে আমি মামাকে বললাম—আপনি মাছ নিলেন না কেন? উনি দুঃখিত হলেন নিশ্চয়।
মামা হেসে বল্লেন—তুমি জানো না, নিলেই দুঃখিত হতেন—উনি বড় কৃপণ।
—তা কথার ভাবে বুঝেচি।
—কি ক’রে বুঝলে?
—অন্য কিছু নয়—বৌ-ছেলেরা কলকাতায় থাকে, উনি থাকেন দেশের বাড়ীতে। একটা চাকর কি রাঁধুনী রাখেন না, হাত পুড়িয়ে এ-বয়সে রেঁধে খেতে হয় তাও স্বীকার। অথচ হাতে দু’পয়সা বেশ আছে।
—আর কিছু লক্ষ্য করলে?
—বড় গল্প বলা স্বভাব! আমার ধারণা, একটু বাড়িয়েও বলেন।
—ঠিক ধরেচো। মাছ নিইনি তার আর-একটা কারণ, উনি মাছ দিয়ে গেলে সব জায়গায় সে গল্প ক’রে বেড়াবেন, আর লোকে ভাববে আমরা কি চামার—পুকুরে মাছ ধরেছে ব’লে ওঁর কাছ থেকে মাছ নিইচি।
—না মামা, এটা আপনার ভুল। এ-কথা ভাববার কারণ কি লোকদের? তা কখনো কেউ ভাবে?
—তা যাই হোক, মোটের ওপর আমি ওটা পছন্দ করিনে।
—উনি একটা বড় ভুল করেন মামাবাবু। টাকার কথা অমন ব’লে বেড়ান কেন?
—ওটা ওঁর স্বভাব। সর্ব্বত্র ওই করবেন। যেখানে বসবেন, সেখানেই টাকার গল্প। ক’রেও আজ আসচেন বহুদিন। দেখাতে চান, হাতে দু’পয়সা আছে।
—আমার মনে হয় ও-স্বভাবটা ভালো নয়—বিশেষ করে এইসব পাড়াগাঁয়ে। একদিন আপনি একটু সাবধান করে দেবেন না?
—সে হবে না। তুমি ওঁকে জানো না। বড্ড একগুঁয়ে। কথা তো শুনবেনই না—আরও ভাববেন, নিশ্চয়ই আমার কোনো মতলব আছে।
আমি সেদিন কলকাতায় চলে এলাম বিকেলের ট্রেনে। আমার ওপর-ওয়ালা নিবারণবাবু লিখেছেন, খুব শীগ্গির আমায় একবার এলাহাবাদে যেতে হবে বিশেষ একটা জরুরী কাজে। অপিসে যেতেই খবর পেলাম, তিনি আর-একটা কাজে দু’দিনের জন্য পাটনা গিয়েচেন চলে—আমার এলাহাবাদ যাবার খরচের টাকা ও একখানা চিঠি রেখে গিয়েচেন তাঁর টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে।
আমার কাছে তাঁর ড্রয়ারের চাবি থাকে। ড্রয়ার খুলে চিঠিখানা প’ড়ে দেখলাম, বিশেষ কোনো গুরুতর কাজ নয়—এলাহাবাদ গভর্নমেণ্ট থাম্ব-ইম্প্রেশন-বুরোতে যেতে হবে, কয়েকটি দাগী বদমাইশের বুড়ো-আঙুলের ছাপের একটা ফটো নিতে।
মিঃ সোম বুড়ো-আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
এলাহাবাদের কাজ শেষ করতে আমার লাগলো মাত্র একদিন, আট-দশদিন রয়ে গেলাম তবুও।
সেদিন সকালবেলা হঠাৎ মিঃ সোমের এক টেলিগ্রাম পেলাম। একটা জরুরী কাজের জন্য আমায় সেইদিনই কলকাতায় ফিরতে লিখেচেন। আমি যেন এলাহাবাদে দেরি না করি।
ভোরে হাওড়ায় ট্রেন এসে দাঁড়াতেই দেখি, মিঃ সোম প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, কারণ, এরকম কখনো উনি আসেন না।
আমায় বল্লেন—সুশীল, তুমি আজই মামার বাড়ী যাও। তোমার মামা কাল দু’খানা আর্জেণ্ট্-টেলিগ্রাম করেছেন তোমায় সেখানে যাবার জন্যে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম—মামার বাড়ী কারো অসুখ? সবাই ভালো আছে তো?
—সে-সব নয় বলেই মনে হলো। টেলিগ্রামের মধ্যে কারও অসুখের উল্লেখ নেই।
—কোনো লোক আসে নি সেখান থেকে?
—না। আমি তার করে দিয়েচি, তুমি এলাহাবাদে গিয়েচো। আজই তোমার ফিরবার তারিখ তাও জানিয়ে দিয়েচি।
আমি বাসায় না গিয়ে সোজা শেয়ালদ’ স্টেশনে চলে এলাম মামার বাড়ি যাবার জন্যে।
মিঃ সোম আমার সঙ্গে এলেন শেয়ালদ’ পর্যন্ত—বার-বার ক’রে ব’লে দিলেন, কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটলে তাঁকে যেন খবর দিই—তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে রইলেন।
মামার বাড়ি পা দিতেই বড় মামা বল্লেন—এসেছিস সুশীল? যাক্, বড্ড ভাবছিলাম।
—কি ব্যাপার মামাবাবু? সবাই ভালো তো?
—এখানকার কিছু ব্যাপার নয়। শ্যামপুরের হরিশ গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছেন। সেখানে এখুনি যেতে হবে।
আমি ভীত ও বিস্মিত হয়ে বল্লাম—গাঙ্গুলিমশায়! সেদিন যিনি মাছ ধরে গেলেন! খুন হয়েচেন?
—হ্যাঁ, চলো একবার সেখানে। শীগ্গির স্নানাহার করে নাও। কারণ, সারাদিনই হয়তো কাটবে সেখানে।
বেলা দুটোর সময় শ্যামপুরে এসে পৌঁছুলাম। ছোট্ট গ্রাম। কখনো সেখানে কারও একটা ঘটি চুরি হয়নি—সেখানে খুন হয়ে গিয়েচে, সুতরাং গ্রামের লোকে দস্তুরমত ভয় পেয়ে গেছে। গ্রামের মাঝখানে বারোয়ারি-পূজা-মণ্ডপে জড়ো হয়ে সেই কথারই আলোচনা করছে সবাই।
আমার মামা এখানে এর পূর্ব্বে অনেকবার এসেছিলেন এই ঘটনা উপলক্ষে, তা সকলের কথাবার্ত্তা থেকে বোঝা গেল। আমার কথা বিশেষ কেউ জিগ্যেস করলে না বা আমার সম্বন্ধে কেউ কোনো আগ্রহও দেখালে না। কেউ জানে না, আমি প্রাইভেট-ডিটেক্টিভ মিঃ সোমের শিক্ষানবিশ ছাত্র—এ-সব অজ পাড়াগাঁয়ে ওঁর নামই কেউ শোনে নি—আমাকে সেখানে কে চিনবে?
মামা জিগ্যেস করলেন—লাশ নিয়ে গিয়েছে?
ওরা বল্লে—আজ সকালে নিয়ে গেল। পুলিস এসেছিল।
আমি ওদের বল্লাম—ব্যাপার কি ভাবে ঘটলো? আজ হোলো শনিবার। কবে তিনি খুন হয়েচেন?
গ্রামের লোকে যেরকম বল্লে তাতে মনে হোলো, সে-কথা কেউ জানে না। নানা লোক নানা কথা বলতে লাগলো। পুলিসের কাছেও এরা এইরকমই ব’লে ব্যাপারটাকে রীতিমত গোলমেলে ক’রে তুলেচে।
আমি আড়ালে মামাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম—আপনি কি মনে ক’রে এখানে এনেচেন আমায়?
মামা বললেন—তুমি সব ব্যাপার শুনে নাও, চলো, অনেক কথা আছে। এই খুনের রহস্য তোমায় আবিষ্কার করতে হবে—তবে বুঝবো মিঃ সোমের কাছে তোমায় শিক্ষানবিশ করতে দিয়ে আমি ভুল করিনি। এখানে কেউ জানে না তুমি কি কাজ করো—সে তোমার একটা সুবিধে।
—সুবিধেও বটে, আবার অসুবিধেও বটে।
—কেন?
—বাইরের বাজে লোককে কেউ আগ্রহ ক’রে কিছু বলবে না। গোলমাল একটু থামলে একজন ভালো লোককে বেছে নিয়ে সব ঘটনা খুঁটিয়ে জানতে হবে। গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে কোথায়?
—সে লাশের সঙ্গে মহকুমায় গিয়েছে। সেখানে লাশ কাটাকুটি করবে ডাক্তারে, তারপর দাহকার্য্য করে ফিরবে।
—লাশ দেখলে বড্ড সুবিধে হোতো। সেটা আর হোলো না।
—সেইজন্যেই তো বলছি, তুমি কেমন কাজ শিখেচো, এটা তোমার পরীক্ষা। এতে যদি পাশ করো তবে বুঝবো তুমি মিঃ সোমের উপযুক্ত ছাত্র। নয়তো তোমাকে আমি আর ওখানে রাখবো না—এ আমার এক-কথা জেনো।