বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্মিদের কবচ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
একটা বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল জানবার। জানকীবাবুর সঙ্গে আমি জেলের মধ্যে দেখা করলাম। তখন তাঁর প্রতি দণ্ডাদেশ হয়ে গিয়েচে।
আমাকে দেখে জানকীবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—কেমন আছেন জানকীবাবু?
—ধন্যবাদ! কোনো কথা জিগ্যেস করতে হবে না আপনাকে।
—একটু বেশী রাগ করেচেন ব’লে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমায় কর্ত্তব্য পালন করতে হয়েচে, তা বুঝতেই পারচেন।
—থাক ওতেই হবে।
—দেখুন জানকীবাবু, মনের অগোচর পাপ নেই। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন, আপনি কতদূর হীন কাজ করেচেন। একজন অসহায়, সরল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ—যিনি আপনাকে গাঁয়ের জামাই জেনে আপনার প্রতি আত্মীয়ের মত—এমন কি, আপনার শ্বশুরের মত ব্যবহার করতেন, আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ক’রে তাঁর টাকাকড়ির হিসেব আপনাকে দিয়ে লেখাতেন— তাঁকে আপনি খুন করেচেন। পরকালে এর জবাবদিহি দিতে হবে যখন, তখন কি করবেন ভাবলেন না একবার?
—মশায়, আপনাকে পাদ্রি-সায়েবের মত লেক্চার দিতে হবে না। আপনি যদি এখনই এখান থেকে না যান—আমি ওয়ার্ডারকে ডেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেবো—বিরক্ত করবেন না।
লোকটা সত্যিই অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির। নররক্তে হাত কলুষিত করেচে, অথচ এখনও মনে অনুতাপের অঙ্কুর পর্য্যন্ত জাগে নি ওর।
আমি বল্লাম—আপনি সংসারে একা, ছেলেপুলে নেই, স্ত্রী নেই। তাঁরা স্বর্গে গিয়েচেন, কিন্তু আপনার এই কাজ স্বর্গ থেকে কি তাঁরা দেখবেন না আপনি ভেবেচেন? তাঁদের কাছে মুখ দেখাবেন কি ক’রে?
জানকীবাবু চুপ ক’রে রইলেন এবার। আমি ভাবলুম, ওষুধ ধরেচে। আগের কথাটা আরও সুস্পষ্টভাবে বললাম। জানি না আজও জানকীবাবুর হৃদয়ের নিভৃত কোণে তাঁর পরলোকগত স্ত্রী-পুত্রের জন্য এতটুকু স্নেহপ্রীতি জাগ্রত আছে কিনা! কিন্তু আমার যতদূর সাধ্য তাঁর মনের সে দিকটাতে আঘাত দেবার চেষ্টা করলাম—বহুদিনের মরচেপড়া হৃদয়ের দোর যদি এতটুকু খোলে!
বল্লাম—ভেবে দেখুন জানকীবাবু, আপনার কাছে কত পবিত্র স্মৃতির আধার হওয়া উচিত যে গ্রাম, সেই গ্রামে বসে আপনি নরহত্যা করেচেন—এ যে কত পাপের কাজ তা যদি আজও বোঝেন, তবুও অনুতাপের আগুনে হৃদয় শুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। অনুতাপে মানুষকে নিষ্পাপ করে, মহাপুরুষেরা বলেচেন। আপনি বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, মহাপুরুষদের বাণী তা ব'লে মিথ্যা হয়ে যাবে না।
জানকীবাৰু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লেন—মশায়, আপনি কি কাজ করেন? এই কি আপনার পেশা?
—খারাপ পেশা নয় তা স্বীকার করবেন বোধহয়!
—খারাপ আর কি?
—দোষীকে প্রায়শ্চিত্ত করবার সুবিধে ক’রে দিই, যাতে তার পরকালে ভালো হয়।
—আচ্ছা, এ আপনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন?
—নিশ্চয়ই করি।
—তবে শুনুন বলি, বসুন।
—বেশ কথা, বলুন।
—আমার দ্বারাই এ-কাজ হয়েচে।
—অর্থাৎ গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি...
—ও-কথা আর বলবেন না।
—বেশ। কেন করলেন?
—সে অনেক কথা। আমার উপায় ছিল না।
—কেন?
—আমি ব্যবসা করতুম শুনেচেন তো? ব্যবসা ফেল প’ড়ে কপর্দ্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলাম, চারিদিকে দেনা। লোভ সামলাতে পারলাম না।
—আপনার সান্ত্বনা আপনার কাছে। কিন্তু এটা লাগ্সই কৈফিয়ৎ হোলো না।
—আমি তা জানি। দুর্ব্বল মন আমাদের—কিন্তু আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করতে বড় ইচ্ছে হয়।
—স্বচ্ছন্দে বলুন।
—আপনি ওই কবচখানা পেয়েছিলেন যেদিন, সেদিন আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওখানা কি?
—না!
—কবে পারলেন?
—আমার শিক্ষাগুরু মিঃ সোমের কাছে কবচের বিষয় সব জেনেছিলাম। আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করবো?
—বলুন!
—আপনি কেন আবার এ-গ্রামে এসেছিলেন, খুনের পরে?
—আপনি নিশ্চয়ই তা বুঝেচেন।
—আন্দাজ করেছি। কবচখানা হারিয়ে গিয়েছিল খুনের রাত্রেই—সেখানা খুঁজতে এসেছিলেন।
—ঠিক তাই।
—সেদিন গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ীর পেছনের জঙ্গলে অন্ধকারে ওটা খুঁজছিলেন কেন, দিনমানে না খুঁজে?
—দিনেই খুঁজতে শুরু করেছিলাম, রাত হয়ে পড়লো।
—ওখানেই যে হারিয়েছিলেন, তা জানলেন কি ক’রে?
—ওটা সম্পূর্ণ আন্দাজি-ব্যাপার! কোনো জায়গায় যখন খুঁজে পেলাম না তখন মনে পড়লো, ওই জঙ্গলে দাঁতন ভেঙেছিলাম, তখন পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে! তাই—
আমি ওঁর মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন পরিস্ফুট হতে দেখলাম। বল্লাম—সব কথা খুলে বলুন। আমি এখনও আপনার সব কথা শুনিনি। তবে আপনার মুখ দেখে তা বুঝতে পারচি!
জানকীবাবু ফিস্ফিস ক’রে কথা বলতে লাগলেন, যেন তাঁর গোপনীয় কথা শুনবার জন্যে জেলে সেই ক্ষুদ্র কামরার মধ্যে কেউ লুকিয়ে ওৎ পেতে বসে রয়েচে। তাঁর এ ভাব-পরিবর্ত্তনে আমি একটু আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। ভয়ে দুঃখে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি?
আমায় বল্লেন—ওখানা এখন কোথায়?
—একজিবিট্ হিসেবে কোর্টেই জমা আছে।
—তার পর কে নিয়ে নেবে?
—আপনার সম্পত্তি, আপনার ওয়ারিশান কোর্টে দরখাস্ত করলে—
জানকীবাবু ভয়ে যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুকে দু'হাত দিয়ে ঠেলে দেবার ভঙ্গিতে হাত নাড়তে-নাড়তে বল্লেন—না না, আমি ও চাইনে, আমার ওয়ারিশান কেউ নেই, ও আমি চাইনে—ওই সর্ব্বনেশে কবচই আমাকে আজ এ-অবস্থায় এনেচে। আপনি জানেন না ও কি!
এই পর্য্যন্ত বলেই তিনি চুপ ক’রে গেলেন। যেন অনেকখানি বেশি ব’লে ফেলেচেন—যা বলবার ইচ্ছে ছিল তার চেয়েও বেশি। আর তিনি কিছু বলতে চান না বা ইচ্ছে করেন না।
আমি বল্লাম—আপনি যদি না নিতে চান, আমি কাছে রাখতে পারি।
আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে জানকীবাবু বল্লেন—আপনি সাহস করেন?
–এর মধ্যে সাহস করবার কি আছে? আমায় দেবেন।
—আপনি আমায় পুলিসে ধরিয়ে দিয়েচেন, আপনি আমার শত্রু—তবুও এখন ভেবে দেখচি, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা ক’রে দিয়েচেন আপনি! আপনার ওপর আমার রাগ নেই। আমি আপনাকে বন্ধুর মত পরামর্শ দিচ্চি—ও-কবচ আপনি কাছে রাখতে যাবেন না।—কেন?
—সে অনেক কথা। সংক্ষেপে বল্লাম—ও-জিনিসটা দূরে রেখে চলবেন।
আমি যেজন্যে আজ জানকীবাবুর কাছে এসেছিলাম, সে উদ্দেশ্য সফল হতে চলেচে। আমি এসেছিলাম আজ ওঁর মুখে কবচের ইতিহাস কিছু শুনবো ব’লে। আমার ওভাবে কথা পাড়বার মূলে ওই একটা উদ্দেশ্য ছিল। অনুনয়ের সুরে কোনো কথা ব’লে জানকীবাবুর কাছে কাজ আদায় করা যাবে না এ আমি আগেই বুঝেছিলাম। সুতরাং আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বল্লাম—আমার কোনো কুসংস্কার নেই জানবেন।
জানকীবাবু খোঁচা খেয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বল্লেন—কুসংস্কার কাকে বলেন আপনি?
—আপনার মত ওইসব মন্ত্র-তন্ত্র-কবচে বিশ্বাস—ওর নাম যদি কুসংস্কার না হয়, তবে কুসংস্কার আর কাকে বলবো?
জানকীবাবু ক্রোধের সুরে বল্লেন—আপনি হয়তো ভালো ডিটেক্টিভ হতে পারেন, কিন্তু দুনিয়ার সব জিনিসই তা ব’লে আপনি জানবেন?
আমি পূর্ব্বের মত তাচ্ছিল্যের সুরেই বল্লাম—আমার শিক্ষাগুরু একজন আছেন, তাঁর বাড়ীতে ওরকম একখানা কবচ আছে।
—কে তিনি?
—মিঃ সোম, বিখ্যাত প্রাইভেট্-ডিটেক্টিভ।
যিনিই হোন, আমার তা জানবার দরকার নেই। একটা কথা আপনাকে বলি। যদি আপনি তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হন, তবে অবিলম্বে তাঁকে বলবেন সেখানা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে। কতদিন থেকে তাঁর সঙ্গে সেখানা আছে, জানেন?
—তা জানিনে, তবে খুব অল্পদিনও নয়। দু’তিন বছর হবে।
—আর আমার সঙ্গে এ-কবচ আছে সাত বছর। কিন্তু থাক্গে।
ব’লেই জানকীবাবু চুপ করলেন। আর যেন তিনি মুখই খুলবেন না, এমন ভাব দেখালেন।
আমি বল্লাম—বলুন, কি বলতে চাইছিলেন?
—অন্য কিছু নয়, ও-কবচখানা আপনি আপনার গুরুকে টান মেরে ভাসিয়ে দিতে বলবেন—আর, এখানাও আপনি কাছে রাখবেন না।
—আমি তো বলেচি আমার কোনো কুসংস্কার নেই!
—অভিজ্ঞতা দ্বারা যা জেনেচি, তাকে কুসংস্কার ব’লে মানতে রাজী নই। বেশি তর্ক আপনার সঙ্গে করবো না। আপনি থাকুন কি উচ্ছন্ন যান, তাতে আমার কি?
—এই যে খানিক আগে বলছিলেন, আমার ওপর আপনার কোন রাগ নেই?
—ছিল না, কিন্তু আপনার নির্ব্বুদ্ধিতা আর দেমাক দেখে রাগ হয়ে পড়েছে।
—দেমাক দেখলেন কোথায়? আপনি তো কোনো কারণ দেখান নি। শুধুই ব’লে যাচ্ছেন—কবচ ফেলে দাও। আজকালকার কোনো দেশে এসব মন্ত্রে-তন্ত্রে বিশ্বাস করে ভেবেচেন? একখানা কাঠের পাত মানুষের অনিষ্ট করতে পারে ব’লে, আপনিও বিশ্বাস করেন?
—আমিও আগে ঠিক এই কথাই ভাবতাম, কিন্তু এখন আমি বুঝেছি। কিন্তু বুঝেছি এমন সময় যে, যখন আর কোনো চারা নেই।
—জিনিসটা কি, খুলে বলুন না দয়া ক’রে!
—শুনবেন তবে? ওই কবচই আমার এই সর্ব্বনাশের কারণ।
আমি বুঝেছিলাম এ-সম্বন্ধে জানকীবাবু কি একটা কথা আমার কাছে চেপে যাচ্ছেন। আগে একবার বলতে গিয়েও বলেন নি, হঠাৎ গুম্ খেয়ে চুপ ক’রে গিয়ে অন্য কথা পেড়েছিলেন। এবার হয়তো তার পুনরাবৃত্তি করবেন।
সুতরাং, আমি যেন তাঁর আসল কথার অর্থ বুঝতে পারি নি এমন ভাব দেখিয়ে বল্লাম—তা বটে। একদিক থেকে দেখতে হোলে, ওই কবচখানাই তো আপনার বর্ত্তমান অবস্থার জন্যে দায়ী!
জানকীবাবু আমার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লেন—আপনি কি বুঝেছেন, বলুন তো? কিভাবে দায়ী?
—মানে, ওখানা না হারিয়ে গেলে তো আপনি আজ ধরা পড়তেন না—যদি ওখানা পকেট থেকে না প’ড়ে যেতো?
—কিছুই বোঝেন নি।
—এ-ছাড়া আর কি বুঝবার আছে?
—আজ যে আমি একজন খুনী, তাও জানবেন ওই সর্ব্বনেশে কবচের জন্যে। কবচ যদি আমার কাছে না থাকতো তবে আজ আমি একজন মার্চ্চেণ্ট—হতে পারে ব্যবসাতে লোকসান দিয়েছিলাম—কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান কার না হয়? আমার বুকে সাহস ছিল, লোকসান আমি লাভে দাঁড় করাতে পারতাম। কিন্তু ওই কবচ তা আমায় করতে দেয় নি। ওই কবচ আমার ইহকাল পরকাল নষ্ট করেচে!
জানকীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম, গল্প বলবার আসন্ন নেশায় তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেচেন। চুপ ক’রে জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
জানকীবাবু বল্লেন—আজ প্রায় পঁচিশ বছর আমি সদিয়া-অঞ্চলে ব্যবসা করচি। পরশুরামপুর-তীর্থের নাম শুনেছেন?
—খুব।
—ঘন জঙ্গলের পাশে ওই তীর্থটা পড়ে। ওখান থেকে আরও সত্তর মাইল দূরে ভীষণ দুৰ্গম বনের মধ্যে আমি জঙ্গল ইজারা নিয়ে পাটের ব্যবসা শুরু করি। ওখানে দফ্লা, মিরি, মিস্মি এইসব নামের পার্বত্য-জাতির বাস। একদিন একটা বনের মধ্যে কুলিদের নিয়ে ঢুকেছি, জায়গাটার একদিকে ঝর্ণা, একদিকে উঁচু পাহাড়, তার গায়ে ঘন বাঁশবন। ওদিকে প্রায় সব পাহাড়েই বাঁশবন অত্যন্ত বেশি। কখনো গিয়েচেন ওদিকে?আমি বল্লাম—না, তবে খাসিয়া পাহাড়ে এমন বাঁশবন দেখেচি, শিলং যাওয়ার পথে।
জানকীবাবুর গল্পটা আমি আমার নিজের ধরণেই বলি।
সেই পাহাড়ী-বাঁশবনে বন কাটবার জন্যে ঢুকে তাঁরা দেখলেন, এক জায়গায় একটা বড় শালগাছের নীচে আমাদের দেশের বৃষ-কাষ্ঠের মত লম্বা ধরণের কাঠের খোদাই এক বিকটমূর্ত্তি দেবতার বিগ্রহ!
কুলিরা বল্লে—বাবু, এ মিস্মিদের অপদেবতার মূর্ত্তি, ওদিকে যাবেন না।
জানকীবাবুর সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, তাঁর শখ হোলো মূর্ত্তিটার ফটো নেবেন। কুলির বারণ করলে, জানকীবাৰু তাদের কথায় কর্ণপাত না ক’রে ক্যামেরা তেপায়ার উপর দাঁড় করিয়েছেন, এমন সময় একজন বৃদ্ধ মিস্মি এসে তাদের ভাষায় কি বল্লে। জানকীবাবুর একজন কুলি সে ভাষা জানতো। সে বল্লে—বাবু, ফটো নিও না, ও বারণ করচে।
অন্য-অন্য কুলিরাও বল্লে—বাবু, এরা জবর জাত—সরকারকে পর্য্যন্ত মানে না। ওদের দেবতাকে অপমান করলে গাঁ-সুদ্ধ তীর-ধনুক নিয়ে এসে হাজির হয়ে আমাদের সবগুলোকে গাছের সঙ্গে গেঁথে ফেলবে। ওরা দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না, কারো তোয়াক্কা রাখে না—ওদের দেবতার ফটো খিঁচ্বার দরকার নেই।
জানকীবাবু ক্যামেরা বন্ধ করলেন—এতগুলো লোকের কথা ঠেলতে পারলেন না। তারপর নিজের কাজকর্ম্ম সেরে তিনি যখন জঙ্গল থেকে ফিরবেন, তখন আর একবার সেই দেবমূর্ত্তি দেখবার বড় আগ্রহ হোলো।
সন্ধ্যার তখন বেশি দেরি নেই, পাহাড়ী-বাঁশবনের নিবিড় ছায়া-গহন পথে বন্য-জন্তুদের অতর্কিত আক্রমণের ভয়, বেণুবনশীর্ষে ক্ষীণ সূর্য্যালোক ও পার্ব্বত্য-উপত্যকার নিস্তব্ধতা সকলের মনে একটা রহস্যের ভাব এনে দিয়েচে, কুলিদের বারণ সত্ত্বেও তিনি সেখানে গেলেন।
সবাই ভীত ও বিস্মিত হয়ে উঠলো যখন সেখানে গিয়ে দেখলে, কোন্ সময় সেখানে একটি শিশু বলি দেওয়া হয়েচে! শিশুটির ধড় ও মুণ্ড পৃথক-পৃথক প’ড়ে আছে, কাঠে-খোদাই বৃষকাষ্ঠ জাতীয় দেবতার পাদমূলে! অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচা আধ-শুকনো রক্ত।
সেখানে সেদিন আর তাঁরা বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না...
জানকীবাবু বল্লেন—আমার কি কুগ্রহ মশায়, আর যদি সেখানে না যাই তবে সবচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু তা না ক’রে আমি আবার পরের দিন সেখানে গিয়ে হাজির হোলাম। কুলীদের মধ্যে একজন লোক আমায় যথেষ্ট নিষেধ করেছিল, সে বলেছিল, ‘বাবু, তুমি কলকাতার লোক, এসব দেশের গতিক কিছু জানো না। জংলী-দেবতা হোলেও ওদের একটা শক্তি আছে—তা তোমাকে ওদের পথে নিয়ে যাবে, তোমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে—ওখানে অত যাতায়াত কোরো না বাবু।’ কিন্তু কারো কথা শুনলাম না, গেলাম শেষ পর্য্যন্ত। লুকিয়েই গেলাম, পাছে কুলির টের পায়।
কেন যে জানকীবাবু সেখানে গেলেন, তিনি তা আজও ভালো জানেন না।
কিংবা হয়তো রক্ত-পিপাসু বর্ব্বর দেবতার শক্তিই তাঁকে সেখালে যাবার প্ররোচনা দিয়েছিল...কে জানে!
জানকীবাবু বল্লেন—ক্যামেরা নিয়ে যদি যেতাম, তাহোলে তো বুঝতাম ফটো নিতে যাচ্ছি—তাই বলছিলাম, কেন যে সেখানে গেলাম, তা নিজেই ভালো জানিনে!
আমি বল্লাম—সে-মূর্ত্তির ফটো নিয়েছিলেন?
—না, কোনোদিনই না। কিন্তু তার চেয়েও খারাপ কাজ করেছিলাম, এখন তা বুঝতে পারচি।
জানকীবাবু যখন সেখানে গেলেন, তখন ঠিক থম্থম্ করচে দুপুরবেলা, পাহাড়ী-পাখীদের ডাক থেমে গিয়েচে, বনতল নীরব, বাঁশের ঝাড়ে ঝাড়ে শুক্নো বাঁশের খোলা পাতা পড়বার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
দেবমূর্ত্তির একেবারে কাছে যাবার অত্যন্ত লোভ হোলো—কারণ, কুলিরা সঙ্গে থাকায় এতক্ষণ তা তিনি করতে পারেন নি।
গিয়ে দেখলেন, শিশুর শবের চিহ্নও সেখানে নেই। রাত্রে বন্যজন্তুতে খেয়েই ফেলুক, বা, জংলীরাই নিজেরা খাবার জন্যে সরিয়ে নিয়ে যাক্। অনেকক্ষণ তিনি মূর্ত্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন—কেমন এক ধরণের মোহ, একটা সুতীব্র আকর্ষণ! সত্যিকার নরবলি দেওয়া হয় যে দেবতার কাছে, এমন দেবতা কখনো দেখেন নি বলেই বোধ হয় আকর্ষণটা বেশি প্রবল হোলো, কিংবা অন্য-কিছু তা বলতে পারেন না তিনি।
সেই সময় ওই কাঠের কবচখানা দেবমূর্ত্তির গলায় ঝুলতে দেখে জানকীবাবু কিছু না ভেবে—চারিদিকে কেউ কোথাও নেই দেখে—সেখানা চট ক’রে মূর্ত্তিটার গলা থেকে খুলে নিলেন।...
আমি বিস্মিতসুরে বল্লাম—খুলে নিলেন! কি ভেবে নিলেন হঠাৎ?
—ভাবলাম একটা নিদর্শন নিয়ে যাবো এদেশের জঙ্গলের দেবতার, আমাদের দেশের পাঁচজনের কাছে দেখাবো! নরবলি খায় যে দেবতা, তার সম্বন্ধে যখন বৈঠকখানা জাঁকিয়ে ব’সে গল্প করবো তখন সঙ্গে-সঙ্গে এখানাও বার ক’রে দেখাবো। লোককে আশ্চর্য্য ক’রে দেবো, বোধহয় এইরকমই একটা উদ্দেশ্য তখন থেকে থাকবে। কিন্তু যখন নিলাম গলা থেকে খুলে, তখনই মশায় আমার সর্ব্বশরীর যেন কেঁপে উঠলো! যেন মনে হোলো একটা কি অমঙ্গল ঘনিয়ে আসচে আমার জীবনে। ও-ধরণের দুর্ব্বলতাকে কখনোই আমল দিই নি—সেটা খুলে নিয়ে পকেটজাত ক’রে ফেললাম একেবারে। মিস্মিদের অনেকে এ রকম কবচ গলায় ধারণ করে, সেটাও দেখেচি কিন্তু তারপরে। শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবার সময় বিশেষ ক'রে একবচ তারা পরবেই।
—তারপর?
—তারপর আর কিছুই না। সাতবছর কবচ আছে আমার কাছে। জংলী-জাতের —বলুন না।
—না। আমার ঘাড় থেকে এখন ভূত নেমে গিয়েচে, আর সে ছবি মনে করতে পারব না। এখন করলে ভয় হয়। নিজের কাজ করেই কবচ সরে পড়লো সে-রাত্রেই। আমার সর্ব্বনাশ ক’রে ওর প্রতিহিংসা পূর্ণ হোলো বোধহয়—কে বলবে বলুন! স্টীমারে আমায় একজন বারণ করেছিল কিন্তু। আসাম থেকে ফিরবার পথে ব্রহ্মপুত্রের ওপর স্টীমারে একজন বৃদ্ধ আসামী-ভদ্রলোককে ওখানা দেখাই। তিনি আমায় বল্লেন, ‘এ কোথায় পেলেন আপনি? এ মিরি আর মিস্মিদের কবচ, পশু এখানে মানুষের স্থান নিয়েচে, ওরা যখন অপরের গ্রাম আক্রমণ করতে যেতো—অপরকে খুন-জখম করতে যেতো—তখন দেবতার মন্ত্রপূত এই কবচ পরতো গলায়। এ আপনি কাছে রাখবেন না, আপনাকে এ অমঙ্গলের পথে নিয়ে যাবে।’ তখনও যদি তাঁর কথা শুনি তাহোলে কি আজ এমন হয়? তাই আপনাকে আমি বলচি, আমি তো গেলামই—ও কবচ আপনি আপনার কাছে কখনো রাখবেন না।
জানকীবাবু চুপ করলেন। যে উদেশ্য নিয়ে এসেছিলাম তা পূর্ণ হয়েচে। জানকীবাবুর মুখে কবচের ইতিহাসটা শুনবার জন্যেই আসা।
বল্লাম—আমি যা করেচি, কর্ত্তব্যের খাতিরে করেচি। আমার বিরুদ্ধে রাগ পুষে রাখবেন না মনে। আমায় ক্ষমা করবেন। নমস্কার!
বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওঁর কাছ থেকে।
যতদূর জানি—এখন তিনি আন্দামানে।