বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি/৬
সন্ন্যাসীর চিঠি।
(৬)
সত্যি কথা বলিতে কি—বিলিতি সভ্যতার আড়ম্বর আমার একেবারে ভাল লাগে না। প্রকৃতিকে নিয়ে এত ঘাটাঘাটি আমার দুচক্ষের বিষ। হোতে পারে আমার স্বভাব একঘেয়ে হোয়ে গেছে তাই বুঝি মধুও পান্সে পান্সে লাগে। প্রকৃতিকে একেবারেই ছুঁতে নেই তবে না ছুঁলে চলে না—তাই বিধিনিষেধের অধীন হয়ে ওষুধ গেলার মত স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু এখানে বিধিও নাই নিষেধও নাই—রাস্তা খোলা। আর এড়াবারও জো নেই। প্রকৃতি গায়ে এসে পড়ে। সম্ভোগবহুল সভ্যতার আবর্ত্তে এসে পড়েছি। খুব ঘুরপাক নাকানি চোবানি খাচ্ছি। ঘুরপাকে মজা যে নাই তা বলিতে পারি না। বঙ্গবাসীর পাঠকদিগকে সেই মজাটুকু পাঠিয়ে দিতেছি।
গেল হপ্তায় লণ্ডনে গিয়েছিলাম। ইষ্টিশাণ থেকে ঘোড়ার গাড়ী চোড়ে যাচ্ছি আর হঠাৎ পুলিশ এসে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিলে। দেখি লোকে লোকারণ্য। ব্যাপার কি না রাজা সেই রাস্তা দিয়ে যাবেন। আমার পাশে একজন ইংরেজ-আরোহীকে বলিলাম যে আমার কপাল ভাল—আজ রাজদর্শন হবে—আমরা বিশ্বাস করি যে রাজদর্শনে পুণ্য হয়। সে বলিল তোমাদের অদ্ভুত ভক্তি। এই রকম বলাবলি কচ্ছি আর ব্রুহামগাড়ি কোরে রাজাধিরাজ ভারতসম্রাট্ সপ্তম এডওয়ার্ড পাপচোখের সামনে এসে উপস্থিত। গাড়ী দ্রুতবেগে চলেছে—কেবল চকিতের দেখা। কিন্তু তাতেই প্রাণমন পুলকিত হোয়ে গেল। মনে হোলাে যেন শক্তিরূপিণী মহামায়া বিজলী হাসি হেসে অন্তর্দ্ধান হয়ে গেলেন। মহা-শক্তি হিমগিরির সিংহত্যাগ কোরে যেন ব্রিটিশসিংহকে বাহনরূপে বরণ করেছেন। মাহেশ্বরীর মায়ার খেলা কে বুঝিতে পারে।
লণ্ডনে আমার একটি ছাত্র আছে। সে এখানে সওদাগরি করে। তার বেশ দুপয়সা রােজগারও হয়। ভারতবর্ষে বারাে বৎসর পূর্ব্বে আমার কাছে পােড়ে এন্ট্রেন্স পাস করেছিল। সে আমায় ভারি খাতির করে। সেই ছাত্র আমাকে ভােজনাদি যথারীতি করায় এবং সকল রকমে যত্ন করে। দক্ষিণহস্তের ব্যাপারটার সুবিধা থাকিলে খুব ফুর্ত্তি হয়। তাই লণ্ডনে খুব ঘুরে বেড়িয়েছি।
লণ্ডনের ভিতর ট্রামগাড়ি নাই। বাহিরে আশে পাশে যেতে গেলে ট্রাম পাওয়া যায়। সহরের মাঝে কেবল অমনিবস্। ইহা এক রকম প্রকাও গাড়ি। ভিতরে ২২ জন ও ছাদে ২৪ জন বসিতে পারে। বড় বড় দুটা ঘােড়ায় টানে। মাইল করা এক আনা ভাড়া। ভাড়াটে ঘােড়ার গাড়িও বিস্তর। ব্রুহমগাড়িকে আধ খানা কোরে কেটে ফেলিলে যে রকম হয় সেইরকম ইহার আকার। দুটি লােক বসিতে পারে। কোচুয়ান ছাদের পেছন দিকে কোচবাক্সে বসে ও প্রয়ােজন হােলে ছাদে একটি ছিদ্র দিয়ে আরােহীর সঙ্গে কথা কয়। ফি মাইলে ৸৹ আনা ভাড়া পড়ে। অধিক।৵৹ আনা করে বেশি লাগে। এখানে গাড়িওয়ালাদের সঙ্গে বকাবকি একেবারেই করিতে হয় না। রাস্তা ও বাড়ির নম্বর বােলে চক্ষু বুজে গাড়িতে উঠে পড়ো আর অনতিবিলম্বে নির্ভাবনায় গম্যস্থানে হাজির—যেন কলের খেলা। ভাড়া নিয়ে দরদস্তুর নেই। যা নিরীখ করা আছে তাই দিতে হবে। গৃহস্থ ও সাধারণ লােকে অম্নিবসেই চড়ে আর সৌখীন লােকে ভাড়াটে গাড়ি চড়ে। এই অশ্বযান ছাড়া তিন রকম বাষ্পযান আছে। এক সােজাসুজি রেলগাড়ি আর এক নীচভুঁই রেল আর তৃতীয় পাতাল গাড়ি। নীচভুঁই রেল বড় কিছু আশ্চর্য্য কারখানা নয়। রাস্তার দশ-বিশ হাত নীচে দিয়ে গাড়ি চলে। মাঝে মাঝে টনেল সুড়ঙ্গ আছে কিন্তু প্রায়ই মাথার দিক খােলা। রাস্তার লােক সাঁকো বা পুলের উপর দিয়ে সেই সব রেলরাস্তা পার হয়। কিন্তু আজব কারখানা সেই পাতাল গাড়ি। এ নামটি আমি রেখেছি। ইংরেজিতে টিউব অর্থাৎ সুড়ঙ্গ রেল বলে। এই পাতাল রেল আন্দাজ ১২ মাইল লম্বা হবে। জমির ৬০ হাত নীচে এক সুড়ঙ্গ কাটা আছে সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে রেলগাড়ি যাতায়াত করে। মাইলে মাইলে ইষ্টিশাণ। দু-আনা ভাড়া―তা এক মাইলই হােক আর দশ মাইলই হােক। ধনী-দরিদ্র বড়―ছােট সব এক শ্রেণী। টিকিট কিনে একটি কাচের বাক্সে ফেলে দিতে হয়। আর একটী লােহার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তারপর একজন কর্ম্মচারী এসে কি একটা কল টেপে আর অম্নি সুড় সুড় কোরে লােহার ঘরটি নীচে নামে। প্রায় পঞ্চাশ ৫০ হাত নীচে গিয়ে সেই ঘরটি আট্কে যায়। তার পর পাথরের সিড়ি দিয়ে বাকি ১০ হাত নেবে প্লাটফরম পাওয়া যায়। বৈদ্যুতিক আলােয় একেবারে কুরখুট্টি। সুড়ঙ্গের এক মুখ থেকে ক্রমাগত কলের দ্বারা হাওয়া চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাই হাঁপ ধরে না। কিন্তু হাওয়াটা যেন―একটু ঘন-ঘন বােধ হয়। দু মিনিট তিন মিনিট অন্তর গাড়ি। গাড়িও একবারে আলােয় ভরা। গাড়ি থেকে নেমে আবার লােহার ঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই সুড় সুড় কোরে উপরে উঠা যায়। ইহাকেই বলে পাতাল গাড়ি। এটা একটা সভ্যতার বাহাদুরি বা ডানপিটেগিরি। পাতাল দিয়ে রেল চালানাে কিছু আবশ্যক ছিল না। এজন্য এখানকার লােকে বড় জ্বালাতন হােয়েছে। যাদের বাড়ীর নীচে দিয়ে সুড়ঙ্গ গেছে তারা রাত্রিতে এক রকম গম্গমানি শব্দ শুনিতে পায়—ঘরদোর যেন টল্ছে—এইরকম তাদের বোধ হয়। আর যারা সুড়ঙ্গে কাজ করে তাদের স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়। কখন কখন কোন কোন বাড়ী ধোসে যায় আর রেল-কেম্পানিকে ক্ষতিপুরণ সহিতে হয়। ৬০ হাত নীচে সুড়ঙ্গ কেটে গাড়ি চালান একটা অলৌকিক ব্যাপারের মধ্যে বটে। তবে শেষ রক্ষা হোলেই ভাল। প্রকৃতি সভ্যতার এত অত্যাচার সহ্য করিতে না পেরে শেষে না প্রতিশোধ লয়।
লণ্ডনে আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দর জিনিষ একটি হাইড পার্ক—প্রকাণ্ড বাগান। কলিকাতার বিডনষ্ট্রীট সারকুলার রোড্ হারিসন রোড্ ও চিৎপুর রোড্ দিয়ে যতখানি জায়গা ঘেরা যায় হাইড্ পার্ক ততটা হবে― বেশী ত কম নয়। ইহা বৃক্ষলতাপুষ্পে সুশোভিত ও বড় বড় তৃণাচ্ছাদিত মাঠপূর্ণ—দেখিলে চক্ষু জড়িয়ে যায়। ইহার মধ্যে এক প্রকাণ্ড কৃত্রিম হ্রদ আছে। তাহাতে মরালাদি জলচর পক্ষী সকল ক্রীড়া করে। মাঝে মাঝে আবার মনোহর দ্বীপ। সন্ধ্যার সময় যখন সমস্ত পার্কটা ইলেক্ট্রিক আলোকমালায় ভূষিত হয় তখন মনে হয় যেন অমরাবতী ধরাধামে অবতীর্ণা। ইহা প্রণয়িজনের বিহারবন―ভাবুকের চিন্তাভবন—অলসের আরাম—গলাবাজি বক্তৃতার রঙ্গভূমি—চোরছেঁচড়ের আশ্রয়―কর্ম্মক্লিষ্ট কেরাণীর প্রাণ। মনে হয় লোকভারাক্রান্ত লণ্ডন যেন এই স্থান দিয়ে নিশ্বাস প্রশ্বাসক্রিয়া সম্পাদন করে।
লণ্ডনে চুরি-জুয়াচুরি-খুন লেগেই আছে। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক। পৃথিবীর সবজাতি এখানে বর্ত্তমান। তাই সবরকম দুষ্কর্ম্মও মূর্ত্তিমান্। সে দিন একটা বড় মজার চুরি হয়ে গেছে। বড় রাস্তার ধারে এক জহুরীর দোকান। বহুমূল্য আংটি সকল কাচের জানালার ভিতর সাজান রয়েছে। হাজার হাজার লোক সেইখান দিয়ে চলে যাচ্ছে আর একটা লোক একখান পাথর নিয়ে ধা করে জানালায় মার্লে। আংটি সব ছড়িয়ে পড়িল। টপাটপ্ সব কুড়িয়ে নিলে। জুয়াচোরের দলেরা সেইখানে ভিড় কোরে দাঁড়িয়েছিল। তারা কতকগুলা কুড়িয়ে দোকানদারকে দিলে কিন্তু অধিকাংশ পাচার কোরে ফেলিল। যে লোকটা পাথর মেরেছিল সে হৈ হৈ কোরে সরিয়া পালাবার যোগাড় করেছিল কিন্তু পুলিশ ভারি জবর―পাকড়াও করে ফেল্লে। চোর কিছু দুঃখিত নয়। ছমাস বা একবৎসর জেল খেটে এসে সে কিছু মেরে দেবে। এক একটা আংটি ১০০০৲ বা ১৫০০৲ টাকা দামের। জহুরী বেচারি একেবারে অবাক্। দিন দুপুরে সদর রাস্তায় চুরি।
আমি একজন বন্ধুর বাড়িতে দিন কয়েকের জন্য অতিথি হোয়ে রয়েছি। সেদিন গৃহিণীর বোন্ঝি ও তার সুইটহার্ট মিষ্টপ্রাণ অর্থাৎ প্রণয়ী এসেছিল। তারা দুদিন ছিল। এরা ভদ্র গৃহস্থ। প্রণয়ী বছর পঁচিশের হবে ও প্রণয়িনী বছর কুড়ি। আমি এদের গল্পচ্ছলে আমাদের দেশে স্বামি ও স্ত্রী কিরূপ ব্যবহার করে এবং পরস্পরের ভালবাসা কেমন আড়ালে লুকিয়ে রাখে—তাই বর্ণনা করেছিলাম। কুড়ি বছরের সেই যুবতী আমায় বলিল যে বোধ হয় আমাদের এই প্রণয়ব্যবহার তোমার ভাল লাগে না। বিবাহ-বদ্ধ না হইলেও তারা দুজনে সদাই মুখামুখি কোরে বোসে থাকে আর পরস্পরকে আদর কোরে। মেসো মহাশয় ঠাট্টা করে বল্লেন যে—ও প্রণয় দুদিনের―বিয়ের পর সব জুড়িয়ে যাবে। এ ঠাট্টা যুবতীর সইল না। তাই মেসো মহাশয় আরো চেপে ধরিলেন ও বলিলেন—মনে নেই―তোমার মাসীর সঙ্গে বিয়ে হবার আগে তুমি আমার সুইটহার্ট ছিলে। বোন্ঝি গ্রীবা বাঁকিয়ে বলিল যে ওরকম সুইটহার্ট আমার ঢের ছিল।
কত যুবক আমার প্রণয়ের ভিখারী হয়েছিল। মেসো মহাশয় ছাড়বার পাত্র নন―তিনি জবাব দিলেন —হ্যারি পাকিন্স্কে মনে আছে। হাঁ আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বটে কিন্তু আমার এই বর্ত্তমান সুইটহার্ট আমার ঠিক মনের মতন হয়েছে। সুইটহার্ট বেচারি বড় কথা টথা কয় না। তিনি প্রণয়িনীর জুতা বুরুস করিয়া দেন―কাপড় টাপড় ঝেড়ে দেন আর কেবল একদৃষ্টিতে সেই প্রণয়িনীর রূপমধু পান করেন। আর এদিকে প্রণয়িনীর মুখে খই ফোটে। আমার গল্প তার বড় ভাল লেগেছিল। অনেকক্ষণ ধরে আমার কাছে তারা বসে থাকত ও গল্প শুন্ত। আমিও মিষ্টি মিষ্টি কোরে মধুরে কেমন কোরে মঙ্গলভাব মিশাতে হয় তা আমাদের হিন্দু আচার ব্যবহারের গল্প কোরে বলেছিলাম। অক্ষফোর্ডে এক স্ত্রীলোকদের সভা আছে। আমাকে সেই সভায় হিন্দুগৃহস্থালী সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে হয়েছিল। এক অধ্যাপকের ঘরণী ভারি বিদুষী―সভাপতি (পত্নি) ছিলেন। মেয়ের পাল সভায় উপস্থিত আর দু দশজন পুরুষও ছিল। আমাদের ছোট মেয়েরা কি রকম পুণ্যপুকুরে যমপুকুরেরর ব্রত করে—গোলাপ টগর পাতায় বলেছিলাম। হিন্দুবিবাহের বিবরণ শুনে তারা ভারি খুসি। ঢেলাভাঙ্গানি শয্যাতোলানী বাসর ঘর ইত্যাদিও বল্তে হয়েছিল। ছালনাতলায় বর কানমলা ও কীল খায় শুনে রমণীদের কেবল হো হো হাসি। ঘাটে নাইতে গিয়ে মেয়েরা কি রকম কমিটি করে—শাশুড়ী কেমন কনে-বউকে সায়েস্তা করে স্বামী-স্ত্রী অন্যের সামনে বিশেষ গুরুজনের সমক্ষে দেখাদেখি বা কথা কইতে পারে না—আমরা ভালবেসে বিয়ে করিনি বিয়ে করে ভাল বাসি—এসব কথা বর্ণনা করেছিলাম। শেষ কথা যে আমরা তোমাদের মতন কেবল জুতার ফিতা বেঁধে দিয়ে বা জুতা বুরুষ করে স্ত্রীলোকের সম্মান করি না। কিন্তু আসলে করি। আমার ভ্রাতৃবধু যদি বিধবা হয় তাহলে সেই বিধবা ও তাহার পুত্র কন্যাকে আমার ভরণ পোষণ করিতে হয়। সেইরূপ বিধবা ভগিনী ও ভাগিনেয়দিগকে তাহার বসন যোগাইতে হয়। স্ত্রীলোক আমাদের নিকট অবশ্য প্রতিপাল্য। আমরা আমাদের স্ত্রীলোকের প্রতি দুর্ব্ব্যবহার করি—এরূপ নিন্দা তোমরা বিশ্বাস করিও না। বক্তৃতার শেষে বড় বড় ঘরের স্ত্রীলোকেরা এসে আমায় বল্লেন যে পাদরি ও জনানা-লেডিদের মুখে ভারতের নিন্দার কথা আমরা অগ্রাহ্য করিব। একজন সাহেব বল্লেন যে এই রকম বক্তৃতা বিলাতের সহরে সহরে হওয়া উচিত। ভারতের যাহাতে গৌরব রক্ষা হয় তাই একান্ত বাঞ্ছা।