বিশ্বকোষ/বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—বঙ্গের প্রতিভাশালী অদ্বিতীয় ঔপন্যাসিক, চিন্তাশীল কবি এবং একজন প্রধান দার্শনিক। ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে ২৭এ জুন, নৈহাটী ষ্টেসনের পার্শ্বস্থ কাঁটালপাড়া গ্রামে সাহিত্যরথী বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। (কোষ্ঠীঅনুসারে শকাব্দা ১৭৬০ǀ২ǀ১২ǀ৩৯ǀ৩০ তাঁহার জন্মকাল।)
বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা যাদবচন্দ্র লর্ড হার্ডিঞ্জের শাসনকালে ডিপুটি-কলেক্টর ছিলেন। তাঁহার চারিপুত্র—শ্যামাচরণ, সঞ্জীবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও পূর্ণচন্দ্র।
বাল্যকাল হইতেই বঙ্কিমচন্দ্রের মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। পঞ্চম বর্ষ বয়ঃক্রম কালে একদিনেই তাঁহার বর্ণজ্ঞান জন্মিয়াছিল! কাঁটালপাড়ার পাঠশালায় তাঁহার প্রথম শিক্ষা। তাঁহার যখন অষ্টবৰ্ষ বয়ঃক্রম, সেই সময়ে তাঁহার পিতা মেদিনীপুরের ডেপুটি কলেক্টর। বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা পুত্রকে কাছে রাখিয়া লেখাপড়া শেখান, এই তাঁহার বরাবর ইচ্ছা ছিল। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে মেদিনীপুরের ইংরাজী স্কুলে দিলেন। এ সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র যেরূপ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহাও অসাধারণ। প্রতিবর্ষে দুইবার তিনি উচ্চ শ্রেণিতে উঠিতেন, অথচ সর্ব্বোচ্চ স্থান অধিকার করিতেন। মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত শোভন নদীতটের দৃশ্যাবলী—স্বচ্ছ, বিরলতরু, সিকতাভূমির নির্জ্জন স্বভাব-সম্পৎ বঙ্কিমচন্দ্রের হৃদয়ে চিরদিন অঙ্কিত ছিল, তাঁহার অপূর্ব্ব কপালকুণ্ডলার দৃশ্যাবলীতে সেই আলেখ্যের ছায়া সুস্পষ্টভাবে পতিত হইয়া তাহা পরম সুন্দর করিয়া তুলিয়াছে।
১৮৫১ খৃষ্টাব্দে যাদবচন্দ্র ২৪ পরগণায় বদলি হইলেন। বঙ্কিমচন্দ্র এ সময়ে হুগলীকলেজে প্রবেশ করিলেন। কলেজেও তাঁহার গবেষণা ও শিক্ষার পরিচয় পাইয়া অধ্যাপকমণ্ডলী বিস্মিত হইতেন! তিনি কেবল পাঠ্য পুস্তক পাঠ করিয়া তৃপ্তিবোধ করিতেন না। কলেজের পুস্তকালয়ে গিয়া সর্ব্বদাই তিনি ভাল পুস্তক লইয়া পাঠ করিতেন। হুগলীকলেজ হইতে তিনি সিনিয়র-স্কলারসিপ্ পরীক্ষায় বিশেষ প্রশংসার সহিত উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। এই সময়ে তিনি কোন অধ্যাপকের নিকট চারিবৎসর কাল সংস্কৃতগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। কলেজে পাঠকালে তাঁহার প্রশংসা সকল অধ্যাপকের মুখেই শুনা যাইত। সাহিত্য বলিয়া নহে, অঙ্কশাস্ত্রেও তাঁহার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি হইয়াছিল।
হুগলীকলেজে অধ্যয়ন শেষ করিয়া তিনি কলিকাতায় আসিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়িতে আরম্ভ করেন। এই সময় ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বি, এ, পরীক্ষা প্রচলিত হয়। তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স ২০ বর্ষ। তিনি আইন পড়িতে পড়িতেই বি, এ, পরীক্ষা দিলেন এবং বিশেষ প্রশংসার সহিত উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বৎসরের বি, এ। বি, এ উপাধি তখন এ দেশে এমন অপূর্ব্ব সামগ্রী বলিয়া গণ্য হইয়াছিল যে বঙ্কিমবাবুকে দেখিবার জন্য বহু ক্রোশ পর্য্যটন করিয়া লোকজন আসিত, এবং বঙ্কিমবাবু শিক্ষিতমণ্ডলীর মুখোজ্জ্বল “বি, এ বঙ্কিম” বলিয়া সর্ব্বত্র পরিচিত হইয়াছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের বি, এ পাশ করিবার অব্যবহিত পরেই ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব তাঁহাকে ডেপুটি মাজিষ্ট্রেট করিয়া পাঠাইলেন। কাজেই তাঁহার আইন পাশ দেওয়া হইল না।
স্বদেশের প্রতি তাঁহার বরাবর অনুরাগ ছিল। পরের জিনিষ হইতে যে ঘরের জিনিষ ভাল, এ কথা তিনিই সর্ব্বপ্রথম শিক্ষিতসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করেন। উচ্চ রাজকার্য্যে নিযুক্ত হইয়াও তিনি মাতৃভাষার সেবাই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষ্য বলিয়া গণ্য করিয়াছিলেন।
বালককাল হইতে তাঁহার বঙ্গভাষার প্রতি অনুরাগ লক্ষিত হয়। তিনি ঈশ্বরগুপ্তের কবিতামালা আনন্দের সহিত পাঠ করিতেন। ত্রয়োদশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে তিনি “মানস ও ললিত” নামধেয় কবিতা রচনা করেন। ঈশ্বরগুপ্ত তাঁহার কবিতা শুনিয়া বড়ই প্রীতিলাভ করেন এবং প্রভাকরে প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে উৎসাহিত করেন। সেই দিন হইতে বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য হইলেন।
১৮৬১ খৃষ্টাব্দে তাঁহার প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী বিরচিত ও তৎপর বর্ষে প্রকাশিত হইল। যদিও ইংরাজী আদর্শ লইয়া দুর্গেশনন্দিনী রচিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাঁহার এই প্রথম উদ্যমেই তিনি বঙ্গভাষার উপর অসাধারণ আধিপত্য ও চরিত্রচিত্রণে অপূর্ব্ব দক্ষতা দেখাইয়াছেন, উপন্যাস লিখিয়া কাহারও ভাগ্যে এরূপ সাফল্যলাভ ঘটে নাই। তৎপূর্ব্বে তিনি Indian field নামক পত্রিকায় “রাজমোহনের স্ত্রী” (Rajmohan wife) নামে একখানি উপন্যাস লিখিতে আরম্ভ করেন, কিন্তু ঐ পত্রিকাখানি বন্ধ হইয়া যাওয়ায় তাঁহার ইংরাজী উপন্যাসখানিও অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়।
পূর্ব্বেই পরিচয় দিয়াছি যে, ইংরাজীভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি হইয়াছিল। ষ্টেট্স্ম্যান্ পত্রিকায় জেনেরল এসেম্ব্লির ভূতপূর্ব্ব প্রিন্সিপাল হেষ্টি সাহেবের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের যে মসিযুদ্ধ চলিয়াছিল, তাহাতে তাঁহার ইংরাজী লেখা পড়িয়া সকলেই বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন। এমন কি, তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী হেষ্টি সাহেবও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছিলেন, “এতদিন পরে বাঙ্গালায় একজন উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পাইয়াছি।”
সরকারী চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণের কয়েক বৎসর পূর্ব্বে বঙ্কিমচন্দ্র বেঙ্গল গবর্মেণ্টের সহকারী সেক্রেটারীর পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তাঁহাকে সে পদ পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল।
দুর্গেশনন্দিনী প্রচারের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের খ্যাতি সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িল। তৎপরে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে কপালকুণ্ডলা ও ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে মৃণালিনী বাহির হইল। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে বঙ্গদর্শন বাহির হইল। বঙ্গদর্শন প্রকাশের সহিত যেন বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর উপস্থিত হইল! বঙ্গীয় লেখকগণের রুচিও পরিবর্ত্তিত হইল। শিক্ষিত বঙ্গবাসীর নিকট বঙ্গদর্শনের যেরূপ আদর হইয়াছিল, এরূপ কোন সাময়িক পত্রের সমাদর দৃষ্টিগোচর হয় না। বঙ্গদর্শনের সম্পাদকরূপে বঙ্কিমচন্দ্র আজকালকার শ্রেষ্ঠ অনেক লেখককেই লিখিবার রীতি শিখাইয়া ছিলেন এবং নিজেও বঙ্গদর্শনে বহু প্রবন্ধ ও উপন্যাস লিখিয়া সাহিত্যজগতে একাধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন। যাঁহারা বঙ্গভাষাকে স্বীয় মাতৃভাষা বলিয়া স্বীকার করিতে লজ্জাবোধ করিতেন, বটতলার পুঁথি দেখিয়া যাঁহারা নাসাকুঞ্চন করিতেন, ইংরাজীভাষায় লিখিত পুস্তকই যাঁহাদের একমাত্র বেদস্বরূপ ছিল, বিদেশীর অনুকরণকেই যাঁহারা জীবনের একমাত্র কৃতকৃতার্থতার কারণ বলিয়া গণ্য করিতেন—সেই পরম উদ্ধত প্রাজ্ঞমানী নব্যবঙ্গকে বঙ্কিমবাবুই বঙ্গভারতীর মন্দিরে উপস্থিত করিয়া তচ্চরণে অর্ঘ্যপ্রদান করিতে বাধ্য করেন, তদবধি ইংরাজীশিক্ষিত যুবকমণ্ডলীই বঙ্গভাষার সেবকগণের নেতা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন,—বঙ্কিমবাবুর এই কার্য্য মাতৃভাষা-চর্চাকল্পে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সার্থকতা বলিয়া গণ্য হইতে পারে, এই জন্যই তিনি “বঙ্গভাষার সম্রাট্” পদবাচ্য। তিনি বঙ্গদর্শনে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি প্রকাশ করেন:—
১২৭৯ সালে বিষবৃক্ষ ও ইন্দিরা; ১২৮০ সালে চন্দ্রশেখর ও যুগলাঙ্গুরীয়; ১২৮১ সালে রজনী; ১২৮০ǀ৮১ ও ৮২ সালে কমলাকান্তের দপ্তর, ১২৮৪ সালে কৃষ্ণকান্তের উইল, ১২৮৬ সালে রাজসিংহ, ১২৮৭ ও ৮৯ সালে আনন্দমঠ, ১২৮৭ সালে মুচীরামগুড়ের জীবনচরিত, ১২৮৮ সালে দেবী চৌধুরাণী। দেবী চৌধুরাণী বঙ্গদর্শনে কিয়দংশ বাহির হইয়া শেষে পুস্তকাকারে সমগ্র পুস্তক প্রকাশিত হয়। ১২৮৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের সম্পাদকতা ছাড়িয়া দিলে তাঁহার জ্যেষ্ঠ সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদক হন। সঞ্জীবচন্দ্রের মৃত্যুর পর বঙ্গদর্শন উঠিয়া যায়।
কএক বর্ষ পরে সাধারণী-সম্পাদক শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়ের চেষ্টায় নবজীবন প্রকাশিত হয়। নবজীবনের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র যেন নবজীবন লাভ করিলেন। আনন্দমঠের শেষে এবং দেবী চৌধুরাণীতে তিনি যে জ্ঞান ও কর্ম্মযোগের সূত্রপাত করেন, সীতারামে তাহার পরিণতি।
বঙ্গের শেষ গৌরবরবি সীতারামের প্রকৃত আলেখ্য তাঁহার তুলিকায় একটু ভিন্নরূপে চিত্রিত হইলেও, তাঁহার জীবনে যে সন্ন্যাসিরূপী মহাপুরুষের প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল, সীতারামে বঙ্কিমচন্দ্র সেই চিত্রই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। ঐ সময় বঙ্কিমচন্দ্রের জামাতা রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রচার” নামক এক মাসিক পত্র প্রচার করেন। এই মাসিক পত্র খানি যে বঙ্কিম বাবুর সম্পূর্ণ পরামর্শানুসারে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রচারে তিনি কৃষ্ণচরিত্র ও গীতামর্ম্ম এবং নবজীবনে ধর্ম্মতত্ত্ব প্রকাশ করিয়া তাঁহার নবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য সাধারণের চিত্তগোচর করিয়াছিলেন।
ডেপুটীকার্য্যে ও বৃটীশগবর্মেণ্টের নিকট তাঁহার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। যথাকালে তিনি পেন্সন্ গ্রহণ করিয়া অবসর লইলেন। বৃটীশগবর্মেণ্ট তাঁহার কার্য্যদক্ষতায় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে রায় বাহাদুর ও সি, আই, ই, উপাধি প্রদান করেন। অবসরের পর তিনি অধিকাংশ সময় সাহিত্যসেবা, ধর্ম্মচর্চ্চা, ও জ্যোতিঃশাস্ত্রালোচনায় কালাতিপাত করিতেন।
তাঁহার পুত্র হয় নাই; দুইটী মাত্র কন্যা জন্মে। অবসরগ্রহণের পর তাঁহার শরীরও অপটু হইয়া পড়ে। অবশেষে ১৩০০ সালের ২৬এ চৈত্র অপরাহ্ণ ৩টা ২৩ মিনিটের সময় বহুমূত্রজনিত জ্বর ও মূত্রনালীর বিস্ফোটক রোগে বঙ্গের সাহিত্যরথী মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র দেহ বিসর্জ্জন করিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে বঙ্গসাহিত্যের যে ক্ষতি হইল, তাহা আর পূরণ হইবার নহে।
তৎকালে বাঙ্গালার অধিকাংশ সাময়িক ও সংবাদ-পত্রসম্পাদক দুঃখ প্রকাশ করিয়া লিখিয়াছিলেন যে, বঙ্কিম বাবুর মৃত্যুতে বাঙ্গালার সাহিত্যরাজ্য রাজহীন হইল। বাঙ্গালীর হৃদয়-গঠনে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা বিশেষ কার্য্যকারী হইয়াছিল। জাতীয় জীবনের সম্যক্ পরিণতির কালে অপর সুসভ্য জাতির মধ্যেও কদাচিৎ এরূপ মহীয়সী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিম বাবু সর্ব্বতোমুখী প্রতিভার অসাধারণ দৃষ্টান্ত। ইতিহাস, গণিত, সাহিত্য সকল বিষয়েই তিনি সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাঁহার প্রকৃতির প্রধান লক্ষণ স্বাতন্ত্র্য, বাঙ্গালায় এরূপ জীবনের নিতান্ত অসদ্ভাব। কি স্বদেশী, কি বিদেশী সকলের কাছেই তিনি সমান স্বাধীন চিত্তের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। স্বাতন্ত্র্য বা জাতীয়তা না হারাইয়া বাঙ্গালী কিরূপে ইংরাজী শিক্ষার উপকারিতা লাভ করিতে পারে, বঙ্কিমচন্দ্র তাহার আদর্শ। বাঙ্গালীর নিতান্ত দুর্ভাগ্য যে তাঁহার ধর্ম্ম ও সামাজিক মত সর্ব্বাঙ্গীন পূর্ণতা লাভ করিবার পূর্ব্বেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করিলেন। তাঁহার ধর্ম্মতত্ত্ব তাঁহার ধর্ম্মজীবনের অনুক্রমণিকা মাত্র! তাঁহার ধর্ম্মমত গীতার অনুরূপ। নিষ্কাম ভক্তি বা সকল বৃত্তির অফলাকাঙ্ক্ষী ঈশ্বরমুখিতা তাঁহার প্রচারিত ধর্ম্মানুশীলনের মুখ্য সাধন। বঙ্গের ভাবী আশায় উৎফুল্ল হইয়া তিনি যে “বন্দে মাতরম্” গাইয়াছিলেন, তাঁহার তিরোভাবের দ্বাদশবর্ষ পরে আজ তাহা ভারতবাসীর জাতীয় সঙ্গীতরূপে কোটি কোটি কণ্ঠে নিনাদিত হইতেছে।
বঙ্গমাতার যে মূর্ত্তি বঙ্কিমের মনশ্চক্ষে প্রভাসিত ছিল, তাহার আভাষ ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ “আমার দুর্গোৎসব” প্রবন্ধে সূচিত হইয়াছে; বঙ্কিমবাবু বাঙ্গালা দেশকে দীন হীন বলিয়া জানিতেন না,—তাঁহার “বন্দে মাতরম্” গানে জাতীয় হীনতাসূচক কাতরোক্তি নাই, তাহাতে সুদূর অতীত গৌরবের স্মৃতিতে শক্তিহীন নিশ্চেষ্ট স্পর্দ্ধা নাই—তাহাতে বঙ্গমাতাকে তিনি ভগবতীর ন্যায় মহীয়সী শক্তিশালিনী স্বরূপে কল্পনা করিয়াছেন,—এই হিসাবে “বন্দে মাতরম্” গান জাতীয় সঙ্গীতগুলির মধ্যে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাইবার যোগ্য। বাঙ্গালী জাতির অভ্যন্তরে যে মহাশক্তি লুক্কায়িত, ‘বন্দে মাতরম্’ গানে বঙ্কিমবাবুই তাহা আবিষ্কার করেন, সেই জাতীয় শক্তি এখন আমাদের চক্ষে স্ফুরমাণ হইয়া উঠিয়াছে।
বঙ্কিমবাবু নিজে তাঁহার একখানি “আত্মচরিত” লিখিয়া গিয়াছেন, তাঁহার মৃত্যুর দ্বাদশ বৎসরের মধ্যে যেন তাঁহার জীবনী প্রকাশিত না হয়,—তাঁহার আত্মীয় স্বজন এবং বাঙ্গালীমাত্রের নিকট তিনি এই প্রার্থনা করিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার স্বজীবন-কাহিনী অবলম্বন করিয়া তদীয় মৃত্যুর দ্বাদশ বৎসর পরে যেন একখানি বিস্তৃত জীবনী প্রকাশিত হয়, তাঁহার সুযোগ্য দৌহিত্রগণের প্রতি এই অনুজ্ঞা আছে। এই বৎসর সেই দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হইল, এই বৎসর “বন্দে মাতরম্” গান নূতনভাবে ভারতবর্ষের কোটিকণ্ঠ হইতে নববল সঞ্চয় করিয়া বঙ্কিমবাবুর জাতীয় অনুরাগকে সমুজ্জ্বল করিয়া দেখাইতেছে। এই বৎসরের পূর্ব্বে জীবনচরিত রচিত হইলে তাঁহার একটা প্রধান কীর্ত্তির কথা অকথিত থাকিত। তিনি কি দিব্য চক্ষুতে তাহা দেখিতে পাইয়া সেই দ্বাদশবর্ষের গণ্ডী প্রদান করিয়াছিলেন। যতদিন বঙ্কিম বাবুর আত্ম-জীবনী প্রকাশিত না হইবে, ততদিন সেই মহাপুরুষের প্রকৃত জীবনীর সমালোচনার সুবিধা হইবে না। বঙ্গবাসী বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মকাহিনীসমন্বিত বিস্তৃত জীবনীর প্রতীক্ষা করিতেছেন।