বিষম বুদ্ধি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

◇◇◇◇◇◇

 এখন আমরা যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত, তাহা একটী সঙ্গিন হত্যাপরাধ, সুতরাং অনুসন্ধানও সেইরূপ ভাবে চলিতে লাগিল। রসিক যে বাসায় বাস করিত, সেই বাসার অপর ব্যক্তিগণের মধ্যে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন, তাহার কিছুই বাকী রহিল না; কিন্তু ঐ সমস্ত লোকের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রমাণ পাওয়া গেল না। যখন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাদিগের উপর আমাদিগের সন্দেহ হউক বা না হউক, তাঁহাদিগের বিপক্ষে আমরা বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না, তখন তাঁহারাও আমাদিগের সহিত যোগ দিয়া যাহাতে এই হত্যারহস্যের নিগূঢ় তত্ত্ব বাহির করিতে সমর্থ হন, সাধ্যমতে তাহার চেষ্টা করিতে ত্রুটি করিলেন না।

 রসিক যে আফিসে কার্য্য করিত, যাহার যাহার সহিত তাহার একটু বিশেষরূপ মেসামিসি ছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধেও বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম, ও তাহাদিগের মধ্যে যাহাদিগের নীচ স্থানে গমনাগমন আছে, রসিককে লইয়া যে সকল স্থানে তাহার যাতায়াত করিয়া থাকে, সেই সকল স্থানে বিশেষ রূপ অনুসন্ধান করিলাম কিন্তু কাহারও বিপক্ষে কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না, বা কাহারা ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া শবদাহ করিবার ঘাটে লইয়া গিয়াছিল, তাহারও কিছুমাত্র সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

 যে স্থানে রসিক হত হইয়াছিল বলিয়া রাজচন্দ্র দাস আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়াছিল, সেই স্থানের প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহারা কেহই ঐ স্থানে রসিকের মৃতদেহ দর্শন করে নাই বা কোনরূপ গোলযোগও শ্রবণ করে নাই। সুতরাং আমরা একরূপ স্থির করিয়াই লইয়াছিলাম যে, রাজচন্দ্রের কথা মিথ্যা, ঐ স্থানে কোনরূপ গোলযোগ হয় নাই বা রসিকের মৃত্যুও ঐ স্থানে হয় নাই। কিন্তু ইহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস এই হত্যা-রহস্যের কিছু কিছু অবগত আছে, ও কোনরূপ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করিবার মানসে সে থানায় গিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। কিন্তু তাহার সেই উদ্দেশ্য যে কি, তাহা কিছুতেই অবগত হইতে পারিলাম না।

 রাজচন্দ্র দাস সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তিনি যাঁহার যাঁহার নিকট পরিচিত, তাঁহারা সকলেই একবাক্যে কহিলেন, রাজচন্দ্র দাস অতি নিরীহ ভদ্রলোক, কাহারও সহিত তাঁহার কোনরূপ কলহ বিবাদ কেহ কখন দেখে নাই, বা তাঁহার যে কোন শত্রু আছে, তাহাও কেহ অবগত নহেন, তিনি সকলের নিকট প্রিয় ও সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিয়া থাকে।

 রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীতে স্ত্রীলোকের মধ্যে কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী বাস করিয়া থাকেন। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে গোপনভাবে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তাঁহার বিপক্ষে কাহারও মুখ দিয়া একটী কথাও বাহির হইল না; অধিকন্তু তাঁহার চরিত্র সমস্ত স্ত্রীলোকের আদর্শস্থানীয় বলিয়া সকলেই তাঁহার ভূরি ভূরি প্রশংসা করিতে লাগিল। যে পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান চলিতে লাগিল, রাজচন্দ্র দাস সেই পর্য্যন্ত হাজত-গৃহে আবদ্ধ রহিল, সেই সময় যে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তাহাকেই সে উত্তর প্রদান করিল যে, সে কিছুই অবগত নহে, পুলিস তাহাকে ধরিয়া নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছে, তাহার বাড়ীর নিকট রসিক বাস করিত বলিয়াই তাহাকে এইরূপ অবমাননা সহ্য করিতে হইতেছে। “তিনি যদি নিরর্থক ধৃত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে নিজে থানায় গিয়া তাহার আত্মসমর্পণ করিবার প্রয়োজন কি ছিল, ও কেনই বা তিনি স্বীকার করিয়াছিলেন যে, তাহার চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে।” একথা যিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহাকেই রাজচন্দ্র দাস পরিশেষে এই উত্তর প্রদান করিলেন যে, তিনি কোন থানায় গিয়া কাহারও নিকট আত্মসমর্পণ করেন নাই বা কাহার নিকট স্বীকার করেন নাই যে, তাঁহারই চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। রাজচন্দ্রের নিকট হইতে এইরূপ উত্তর পাইবার পর তাহাকে আর কেহই কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না কিন্তু তাহার বিপক্ষে যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। এইরূপে প্রায় পনের দিবস অনুসন্ধানের পর যখন দেখা গেল যে, রাজচন্দ্রের বিরুদ্ধে আর কোন প্রমাণই সংগ্রহ হইল না, তখন অনন্যোপায় হইয়া রাজচন্দ্রকে ছাড়িয়া দিতে হইল। তিনি জামিনে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া আপন বাড়ীতে গমন করিলেন। রাজচন্দ্রকে জামিনে ছাড়িয়া দিবার পর যে ঐ অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইয়া গেল, তাহা নহে; তাহার বিপক্ষে, ও কিরূপে ও কাহার হস্তে রসিক হত হইয়াছে, সেই সম্বন্ধে আরও দুইমাস কাল অনুসন্ধান চলিতে লাগিল, কিন্তু কোনরূপ ফলই ফলিল না। প্রায় তিন মাসকাল অনুসন্ধানের পর ঐ অনুসন্ধান বন্ধ হইয়া গেল।