বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/পঞ্চবিংশ প্রবাহ

পঞ্চবিংশ প্রবাহ

 মানবের ভাগ্যবিমানে দুঃখময়-কালমেঘ দেখা দিলে, সে দিকে কাহারও দৃষ্টি পড়ে না, ভ্রমেও কেহ ফিরিয়া দেখে না। ভাল মুখে দু’টি ভাল কথা বলিয়া তাহার তাপিত প্রাণ শীতল করা দুরে থাকুক, মুখ ফুটিয়া কথা বলিতেও আমাদের ঘৃণা জন্মে, সে দিকে চক্ষু তুলিয়া চাহিতেও অপমান জ্ঞান হয়। সে উপযাচক হইয়া মিশিতে আসিলেও নানা কৌশলে তাহাকে তাড়াইতে ইচ্ছা করে। আত্মীয়-স্বজন-পরিজন-জ্ঞাতি-কুটুম্বের চক্ষেও দুর্ভাগার আকৃতি চক্ষুশূল-বোধ হয়। এক প্রাণ, এক আত্মা, হৃদয়ের বন্ধুও সে সময় সহজ দোষ দেখাইয়া ক্রমে সরিতে থাকেন। দুঃখের সময় জীবন কাহার না ভালবোধ হয়? শনিগ্রস্ত জীবের কোথায় না অনাদর! রাহুগ্রস্ত বিধুর কতই না অপবাদ! ভবের ভাব বড়ই চমৎকার! কালে আবার সেই আকাশে,—সেই মানবের ভাগ্যাকাশে, মৃদু মৃদু ভাবে সুবাতাস বহিয়া, কালমেঘগুলি ক্রমে সরাইয়া, সৌভাগ্য-শশীর পুনরুদয় দেখাইয়া দিলে আর কথাটি নাই! তখন কত হৃদয় হইতে প্রেম, প্রণয়, ভালবাসা, আদর, স্নেহ, যত্ন এবং মায়ার স্রোত, প্রবাহ-ধার,যাহা বল, ছুটিতে থাকে—বহিতে থাকে। —কত মনে দয়ার সঞ্চার, মিলনের বাসনা এবং ভক্তির উদয় হইতে থাকে। —কত চক্ষুষ্মানের বঙ্কিমে দেখিতে ইচ্ছা করে!—শতমুখে সুযশ, সুখ্যাতি গাহিতে ইচ্ছা করে, শতমুখে সুকীর্ত্তির গুণ বর্ণনা হইতে থাকে। তখন আর যাচিয়া প্রেম বাড়াইতে হয় না, ডাকিয়াও কাছে কাহাকেও বসাইতে হয় না। পরিচয় না থাকিলেও পরিচয়ের পরিচয় দিয়া লোকে দাবিয়া, চাপিয়া বসিয়া থাকে। আজ এজিদের ভাগ্য-বিমান হইতে কালমেঘ সরিয়া সৌভাগ্যশশীর উদয় হইয়াছে—ওমর আলী বন্দী! শত শত ঘোষণা করিয়া দ্বিগুণ বেতনের আশা দেখাইয়াও এজিদ আশার অনুরূপ সৈন্যসংগ্রহ করিতে সমর্থ হন নাই। আজ অমর আলী বন্দী; তাঁহার শূলদণ্ডে প্রাণবধ—এই ঘোষণা শুনিয়া লোকে দলে দলে সৈন্যদলে নাম লিখাইতেছে, স্বার্থের আশায়, অর্ধের লালসায় কত লোক বিনা বেতনে এজিদ পক্ষে মিশিতেছে। অপরিচিত বিদেশী বোধে যাহাদিগকে গ্রহণ করিতে মারওয়ানের অমত হইতেছে, তাহাদের কেহ কেহ স্ব স্ব গুণ দেখাইয়া, কেহ বা বাহুবলের পরিচয় দিয়া সৈন্যশ্রেণীতে প্রবেশ করিতেছে। কেহ বা কোন সৈন্যাধ্যক্ষকে অর্থে বশীভূত করিয়া তাহার উপরোধে প্রবেশপথ পরিষ্কার করিয়া লইতেছে। সকলেই যে সমরক্ষেত্রে শত্রুর সম্মুখীন হইবে, তাহা নহে। জয়ের ভাগ, যশের অংশ গ্রহণ করাই অনেকের অন্তরের নিগূঢ় আশা। আজ ওমর আলীয় জীবনশেষ, কাল হানিফার পরমায়ু-শেষ, যুদ্ধের শেষ—এই বিশেষ তত্ত্বেই স্বদেশী বিদেশী বহু লোকের সৈন্যদলে প্রবেশ! আবার ইহাও অনেকের মনে,—যদি বিপদের সূচনা হয়, পরাজয়ের লক্ষণ দেখা যায়, তবে ভবের ভাব, প্রকৃতির স্বভাব, সময়ের তাৎপর্য্য দেখাইয়া তাহারা ক্রমে সরিতে থাকিবে। কিন্তু জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। ওমর আলীর প্রাণবধ ও হানিফার দক্ষিণ বাহু ভগ্ন,—একই কথা। একা হানিফার এক হস্ত কি করিবে? তাই জয়ের আশাই অধিক। এজিদের ভাগ্যবিমানে সুবায়ু-প্রতিঘাতে কালমেঘের অন্তর্দ্ধান অতি নিকট। এজিদ-শিবিরের চতুষ্পার্শ্বে বিষম জনতা—সকলের দৃষ্টিই শূলদণ্ডের সূক্ষ্ম অগ্রভাগে।

 ওদিকে মোহাম্মদ হানিফার প্রাণ ওষ্ঠাগত, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনের কণ্ঠ শুষ্ক, সৈনিক-দলে মহা আন্দোলন —“হায়! হায়!! এমন বীর বিপাকে মারা পড়িল!—ভ্রাতৃআজ্ঞা প্রতিপালন করিতে অকালে কালের হস্তে নিপতিত হইল! কি সর্ব্বনাশ। ‘এজিদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিও না’—এই কথাতেই ওমর আলী কিশোর বয়সে শত্রুহস্তে শূলে বিদ্ধ হইতে চলিলেন। ধন্য রে ভ্রাতৃভক্তি। ধন্য রে স্থির প্রতিজ্ঞা! ধন্য আজ্ঞাপালন! ধন্য ওমর আলী!”

 সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া সৈন্য সংগ্রহ করা বড় বিষম ব্যাপার। বিপদকালেই দূরদর্শিতার পরিচয়, ভবিষ্যৎ জ্ঞানের পরিচয়ের পরীক্ষা হয়। সুখের সময় দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যৎ ভাবনা প্রায় কোন মস্তকই বহন করিতে ইচ্ছা করে না।

 মোহাম্মদ হানিফা শুধু আক্ষেপ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। গাজী রহ্‌মানও কেবল বিলাপ-বাক্য শুনিয়াই নিশ্চিন্ত হন নাই। তাঁহাদের মস্তিষ্ক-সিন্ধু আজ বিশেষরূপে আলোড়িত হইয়াছে,—সহসা এজিদ-শিবির আক্রমণ করিবেন না, অথচ ওমর আলীকে উদ্ধার করিবার আশা তাঁহাদের অন্তরের এক কোণে বিশেষ গোপনভাবে রহিয়াছে। বিনা বেতনের চাকরে গৃহকার্য্যের সুবিধা নাই, তাহাতে আবার যুদ্ধকাণ্ডে! অবৈতনিক সৈন্য—কি ভয়ানক কথা! কি সাংঘাতিক ভ্রম! এ ভ্রম কাহার?—

 এজিদ বস্ত্রমণ্ডপে দরবার আহ্বান করিয়া স্বর্ণময় আসনে মহাগর্ব্বিতভাবে বসিয়া আছেন। রাজমুকুট শিরে শোভা পাইতেছে। মন্ত্রীপ্রবর মারওয়ান দক্ষিণ পার্শ্বে দণ্ডায়মান। সৈন্যশ্রেণী দরবার-সীমা ঘিরিয়া গায় গায় মিশিয়া, অসিহস্তে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পঞ্চবিংশতি রথী নিষ্কোষিত কৃপাণহস্তে ঘিরিয়া বন্ধনদশায় ওমর আলীকে দরবারে উপস্থিত করিল।

 মারওয়ান ওমর আলীকে বলিল, “ওমর আলী! তুমি যে বন্দী, এ জ্ঞান তোমার আছে?”

 ওমর আলী বলিলেন, “এক্ষণে তোমাদের হস্তে বন্দী—সে জ্ঞান আমার বেশ আছে।”

 “বন্দীর এত অহঙ্কার কেন? নতশিরে করজোড়ে রাজ-সমীপে দণ্ডায়মান হওয়া কি তোমার এ সময়ে উচিত নহে?—রাজাকে অভিবাদন করা কি এ অবস্থায় কর্ত্তব্য নহে? মুহূর্ত্ত পরে তোমার কি দশা ঘটিবে, তাহা কি তুমি মনে করিতেছ না?”

 “আমি সকলই মনে করিতেছি। তোমাদের যাহা ইচ্ছা হয় কর, অনর্ধক বাগবিতণ্ডায় প্রয়োজন নাই। আমি এমন কোন অনুগ্রহের প্রত্যাশা করি যে, নতশিরে ন্যূনতা স্বীকারে দণ্ডায়মান হইব।”

 “সাবধান! সতর্ক হইয়া জিহ্বা চালনা করিও। নম্রভাবে কথা কহা কি তোমাদের কাহারও অভ্যাস নাই? এ রাজ-দরবার, সমরপ্রাঙ্গণ নহে।”

 “আমি প্রথমেই তোমাকে বলিয়াছি, বাগবিতণ্ডায় প্রয়োজন নাই। আমাকে জ্বালাতন করিও না। আমি তোমার সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করি না।”

 এজিদ হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, আমার সহিত কথা বল।”

 ওমর আলী বলিলেন, “তুমি এমন পবিত্র শরীর ভবধামে অধিষ্ঠান করিয়াছ যে, নিজের গৌরব নিজেই প্রকাশ করিতেছ, তোমার সহিত কথা বলিলে কি আমার গৌরব বৃদ্ধি হইবে?”

 “গৌরব বৃদ্ধি হউক, বা না হউক, অতি অল্প সময়ও যদি জগতের মুখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে ক্ষতি কি? তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার কর, আমাকে প্রভু বলিয়া মান্য কর, আমি তোমাকে প্রাণদণ্ড হইতে মুক্ত করিতেছি।”

 “কি ঘৃণা! কি লজ্জা! এজিদের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা! এজিদের আশ্রয়-গ্রহণ। মাবিয়ার পুত্রের নিকট বশ্যতা স্বীকার! ছিঃ! ছিঃ! তুমি আমার প্রভু হইতে ইচ্ছা কর? তোমার বংশাবলীর কথা, তোমার পিতার কথা, একবার মনে কর। ছিঃ ছিঃ! বড় ঘৃণার কথা! এজিদ, এত আশা তোমার—তুমি আবার মহারাজ!”

 এজিদ রোষে অধীর হইয়া বলিলেন,—“জানো, আমি তোমার গর্দ্দান লইতে পারি, তোমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া শৃগাল-কুকুরের উদরস্থও করিতে পারি। তুমি আমার নিকট প্রার্থনা জানাও: “মহারাজ! মহাকষ্টে যেন আমাকে বধ না করা হয়।”

 ওমর আলী ক্রোধে বলিলেন, “ধিক্ তোমার কথায়। আর শত ধিক্ আমার জীবনে। ' সহজে প্রাণবধ করা যেন না হয়—ইহাই আমার প্রার্থনা। তোমার যাহা করিবার ক্ষমতা থাকে, কর; আমি প্রস্তুত আছি।”

 “মরণের পূর্ব্বে যে, লোকে বিকারগ্রস্ত হয়, এ কথা সত্য। তোমার কপাল নিতান্ত মন্দ, আমি কি করিব?”

 “তুমি আর কি করিবে? যাহা করিবে, তাহার দ্বিগুণ ফলভোগ করিবে।”

 এজিদ সক্রোধে বলিলেন, “মারওয়ান! ইহার কথা আমার সহ্য় হয় না। প্রকাশ্য স্থানে, যাহাতে সর্ব্বসাধারণে দেখিতে পারে এবং বিপক্ষগণও দেখিতে পারে, এমন স্থানে শূলে চড়াইয়া এখনই ইহার প্রাণবধ কর। কার্য্যশেষে আমায় সংবাদ দিও।”

 ওমর আলী বলিলেন, “কার্য্য শেষ হইলে তোমাকে আর সংবাদ শুনিতে হইবে না। তোমারই সংবাদ অনেকে শুনিবে।”

 মহাক্রোধে এজিদ বলিলেন, “আর সহ্য হয় না। মারওয়ান! শীঘ্র ইহাকে শূলে চড়াও।” মারওয়ান নতশিরে সম্ভাষণ করিয়া বন্দীসহ দরবার গৃহ হইতে বহির্গত হইল।

 শিবিরের বাহিরে লোকে লোকারণ্য। নির্দ্দিষ্ট বধ্যভূমিতে বন্দীসহ গমন করা বড়ই কঠিন। মারওয়ান শিবির-দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া চিন্তা করিতে লাগিল: দর্শকগণের মনে যেন কোন প্রকার কষ্ট না হয়, এদিকে রাজাও যেন প্রতিপালিত হয়। আবার ওদিকে শত্রুপক্ষ অতি নিকট। তাহারাই বা কখন কি কাণ্ড করিয়া বসে, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? প্রকাশ্য স্থানে শূলে চড়াইয়া প্রাণবধ করিতে হইবে,—এ কথাও তাহারা শুনিয়াছে। শূলদণ্ড যে দণ্ডায়মান রহিয়াছে, তাহাও তাহারা স্পষ্টভাবেই দেখিতেছে। ইহাতে যে তাহারা একেবারে নিশ্চিন্ত থাকিবে, নিঃশব্দে দণ্ডায়মান হইয়া ওমর আলীর বধ-ক্রিয়া স্বচক্ষে দেখিবে,—ইহা ত কখনই বিশ্বাস হয় না। হয় ত কোন নূতন কাণ্ড করিয়া বসিবে!

 মারওয়ান বিশেষ চিন্তা করিয়া আদেশ করিল, “বধ্যভূমি পর্য্যন্ত যাইবার সুপ্রশস্ত পথের উভয় পার্শ্বে সৈন্যশ্রেণী দণ্ডায়মান থাকিবে। প্রহরী ও প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ ব্যতীত সাধারণ সৈন্য, কি কোন প্রাণী, আমার বিনানুমতিতে এ পথে বধ্যভূমিতে যাইতে পারিবে না।”

 আদেশমাত্র নিষ্কোষিত অসিহস্তে সৈন্যগণ গায় গায় মিশিয়া বধ্যভূমি পর্য্যন্ত গমনোপযোগী প্রশস্ত স্থান রাখিয়া দুই শ্রেণীতে পরস্পর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তখন শিবির-দ্বার হইতে শূলদণ্ডের সমগ্রভাগ স্পষ্টভাবে দেখা যাইতে লাগিল। মারওয়ান পুনরায় আজ্ঞা করিল, “শূলদণ্ডের চতুষ্পার্শ্বে চক্রাকারে কতক স্থান রাখিয়া শূলদণ্ডসহ ঐ চক্রাকার স্থান সজ্জিত সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হইবে। এক শ্রেণীতে চক্রাকারে ঐ স্থান বেষ্টন করিলে শঙ্কা দূর হইবে না। সপ্তচক্র সৈন্য দ্বারা ঐস্থান বেষ্টন করিতে হইবে। চতুর্দ্দিকে প্রহরী নিযুক্ত থাকিবে। বিপক্ষদল হইতে সামান্য একটি প্রাণীও আমাদের নির্দ্দিষ্ট সীমা যেন অতিক্রম করিয়া না আসিতে পারে— সে বিষয়েও বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আবার এদিকেও শিবিরদ্বার চতুষ্টয়ে এবং সীমান্ত স্থানে রক্ষীদিগের উপরও সজ্জিত সৈন্য দ্বারা বিশেষ সতর্কে শিবির রক্ষা করিতে হইবে।”

 মারওয়ান সৈন্যাধ্যক্ষগণকে আহ্বান করিয়া আরও আজ্ঞা করিল, “যে সকল সৈন্য বিশেষ শিক্ষিত ও পুরাতন, তাহাদের দ্বারা শিবির এবং শিবির দ্বার চতুষ্টয় রক্ষা করিতে হইবে। উত্তর, পূর্ব্ব ও দক্ষিণ সীমার প্রত্যেক সীমায় সহস্র সহস্র সৈন্য তীর, বর্শা ও তরবারিহস্তে রক্ষীরূপে দণ্ডায়মান থাকিবে। শিবিরের মধ্যে যেখানে যেখানে প্রহরী নিযুক্ত আছে, সেই সেই স্থানে দ্বিগুণ প্রহরী নিযুক্ত করিতে হইবে ও সৈন্যাধ্যক্ষগণ আপন সৈন্যদলের প্রতি সম্ভবমত বিশেষ সতর্কভাবে দৃষ্টি রাখিবেন।

 ওমর আলীর বধসাধন হইতে কলা প্রভাত পর্য্যন্ত সাধ্য মত সতর্কতার সহিত থাকিতে হইবে। সৈন্যাধ্যক্ষগণ অশ্বারোহী হইয়া মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে শিবিরের চতুষ্পার্শ্ব পরিবেষ্টন করিবেন। ওমর আলীর বধসাধনে হর্ষ, বিপদ, বিষাদ সকলই রহিয়াছে; সকল দিকেই দৃষ্টি রাখিতে হইবে। সাবধান! আমার এই আজ্ঞার অণুমাত্রও যেন অন্যথা না হয়। যে সকল নূতন সৈন্য গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহাদিগকে কখনই শিবির-রক্ষার কার্য্যে, কি সীমারক্ষার কার্য্যে, কি প্রহরীর কার্য্যে—কোনরূপ কার্য্যে নিযুক্ত করা হইবে না। এমন কি, আমার দ্বিতীয় আদেশ না হওয়া পর্য্যন্ত তাহারা শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। প্রকাশ্যভাবে তাহাদিগকে এ সকল কথা না বলিয়া বাহিরের অন্য কোন কার্য্যে,—কি শূলদণ্ড যে প্রণালীতে রক্ষা করার আদেশ হইয়াছে, তাহাতেই নিযুক্ত করিতে হইবে। কিন্তু সে সপ্তচক্রের সীমাচক্রে, কি ষষ্ঠ বা পঞ্চম চক্রে তাহাদিগকে নিযুক্ত করা হইবে না। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক্রেই তাহাদের স্থান,—শূলদণ্ডের নিকট হইতে উপরোক্ত চক্রত্রয় ভিন্ন অন্য কোন চক্রে তাহারা যেন না যাইতে পারে— সে বিষয়ে বিশেষ সাবধান হইতে হইবে।”

 মারওয়ান এই সকল আদেশ করিয়া বন্দীসহ বধ্যভূমিতে যাইতে উদ্যত হইল। বন্দী ওমর আলী চতুর্দ্দিকে চাহিয়া বধ্যভূমিতে যাইতে অসম্মত হইলেন।

 মারওয়ান বলিল, “ওমর আলী! তুমি জানিয়া শুনিয়া বিহ্বল হইতেছে? বন্দী-দশায়ও রাজ-আজ্ঞা অবহেলা? তুমি স্বেচ্ছাপূর্ব্বক বধ্যভূমিতে না গেলে, আমি কি তোমাকে শূলে চড়াইয়া মারিতে পারিব না? তুমি এখনও যদি মহারাজ এজিদের বশ্যতা স্বীকার কর, প্রভু বলিয়া তাঁহাকে মান্য কর,—তোমার অপরাধ মার্জ্জনাহেতু জোড়করে ক্ষমাপ্রার্থনা কর, তবে এখনও তোমার প্রাণরক্ষা হইতে পারে। আমি মহারাজের রোষাগ্নি নির্ব্বাণ করিতে চেষ্টা করিব। বধ্যভূমিতে যাইবে না,এ কি কথা? সাধ্য কি যে, তুমি না যাইয়া পার? তোমাকে নিশ্চয়ই ঐ শূলদণ্ডের নিকটে যাইতে হইবে,—নিশ্চয়ই ঐ শূলে আরোহণ করিতে হইবে,—বিদ্ধ হইতে হইবে,—মরিতে হইবে। মহারাজ এজিদের আজ্ঞা অলঙ্ক্ষনীয়।”

 ওমর আলী বলিলেন, “তুমি যদি আমাকে লইয়া যাইতে পার, লইয়া যাও,—শূলে দাও। কিন্তু আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক শূলদণ্ডের নিকট যাইব না, শূলে আরোহণ করা ত দূরের কথা। আমার প্রাণবধ করাই ত তোমাদের ইচ্ছা; তরবারি আছে, আঘাত কর —তীর আছে, বক্ষোপরি লক্ষ্য কর—বর্শা আছে, বিদ্ধ কর—গদা আছে, মস্তক চুর্ণ কর—ফাঁস আছে, গলায় দিয়া শ্বাস বন্ধ কর—যে প্রকারে ইচ্ছা হয়, প্রাণ বাহির কর। আমি শূলে চড়িব না।”

 “আমি তোমাকে শূলেই চড়াইব; মহারাজ এজিদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিব। তুমি তোমার প্রাণ বাহির করিবার দশটি উপায় বাহির করিলেও তাহা গ্রাহ্য হইবে না। ঐ একমাত্র শূলদণ্ডেই তোমার জীবন শেষ—কেন আমাকে বিরক্ত কর?”

 “তোমার ক্ষমতা থাকে তো আমাকে লইয়া যাও।”

 “কেন? শূলে চড়িয়া প্রাণ দিতে কি লজ্জাবোধ হইতেছে। হায় য়ে লজ্জা! এমন অমূল্য জীবনই যদি গেল, তবে সে লজ্জায় ফল কি?”

 “আমি তোমার কথা শুনিতে ইচ্ছা করি না। তোমার কার্য্য তুমি কর, আমি আর এক পদও অগ্রসর হইব না।”

 “মুহূর্ত্ত পরে যাহার জীবন-কাণ্ডের শেষ অভিনয় হইয়া জীবনের মত যবনিকা পতন হইবে, তাহার আবার স্পর্ধা?”

 “দেখ্ মারওয়ান! সাবধান হইয়া কথা বলিস্। আমার হস্ত কঠিন বন্ধনে বাঁধা আছে, নতুবা তোর মুখের শাস্তি দিতে ওমর আলীকে বেশী দূর যাইতে হইত না।”

 মারওয়ান মহাক্রোধে ওমর আলীকে পশ্চাদ্দিক হইতে সরোষে ধাক্কা দিয়া বলিল, “চল্, তোকে পায়ে হাঁটাইয়া লইয়া শূলে চড়াইব।”

 ওমর আলী নীরব। মারওয়ান অনেক চেষ্টা করিল, তিল পরিমাণ স্থানও ওমর আলীকে সরাইতে পারিল না;—লজ্জিত হইয়া বলিল, “সকলে একত্রে একযোগ হইয়া তোকে শূন্যে তুলিয়া লইয়া যাইব।”

 ওমর আলী হাস্য করিয়া বলিলেন, “মারওয়ান, তুমি ত পারিলে না! সকলে একত্র হইয়া আমাকে শূলদণ্ডের নিকট লইয়া যাইবে, ইহাতে তোমার গৌরব কি? তুমি সুখী হও কোন্ মুখে?”

 “আমি সুখী হই বা না হই, তোকে শূলে চড়াইবই।”

 “এখান হইতে লইয়া যাইতে পারিলে ত শূল?”

 মারওয়ান প্রহরিগণকে বলিল, “তোমরা অস্ত্রশস্ত্র রাখিয়া সকলে ইহাকে ধরিয়া, শূন্যে লইয়া আমার সঙ্গে আইস।”

 প্রহরিগণ প্রভু-আজ্ঞা প্রতিপালন করিল বটে, কিন্তু ওমর আলী সেইরূপ পাষণ—পাষাণবৎ অচল। যিনি যে পদ যেখানে রাখিয়াছিলেন, সেই পদ সেইখানেই রহিয়া গেল! প্রহরিগণ লজ্জিত—মারওয়ান রোষে অধীর।

 মারওয়ান পুনরায় মনে মনে বলিতে লাগিল, “মহাবিপদ! এখান হইতে বধ্যভূমি পর্যন্ত লইতেই এত কষ্ট, শূলের উপর চড়ান ত সহজ কথা নহে।”

 ওমর আলী বলিলেন, “মারওয়ান, চিন্তা কি? তুমি যদি আমাকে বধ্যভূমি পর্য্যন্ত লইয়া যাইতে পার, তাহা হইলে আমি ইচ্ছা করিয়াই শূলে চড়িব। তুমি চিন্তা করিও না। যতক্ষণ থাকি, জগতে হাসি-তামাসা করিয়া চলিয়া যাই। মরণ কাহার না আছে? আজ আমার এই প্রকার মরণ হইতেছে; কাল না হউক, কালে তোমাকেও অন্য প্রকারে মরিতে হইবে।

 মারওয়ান মনে মনে বলিতে লাগিল, “এখান হইতে ধরাধরি করিয়া লইয়া গেলেও ত শূলে চড়ান মহাবিপদ দেখিতেছি। আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে ডাকি। এই স্থির করিয়া সে প্রকাশ্যে আদেশ করিল, “আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে ডাকিয়া আন, আর তাহার অধীনে যে কয়েকজন বলবান্ সৈন্য গতকল্য সৈন্যদলে নাম লিখাইয়াছে, তাহাদিগকেও এখানে আসিতে বল।”

 ওমর আলী বলিলেন, “ওহে মন্ত্রি! কোন্ আবদুল্লাহ্ জেয়াদ? কুফা নগরের জেয়াদ?—সেই নিমকহারাম জেয়াদ? —বিশ্বাসঘাতক জেয়াদ? —না অন্য কেহ?”

 “তাহাতে তোমার প্রয়োজন কি?”

 “প্রয়োজন কিছুই নাই—তবে পাপাত্মার মুখখানা চক্ষে দেখিবার ইচ্ছা অনেক দিন হইতেই আছে। তাহাকে শীঘ্র আসিতে বল, মরণকালে দেখিয়া যাই।”

 “তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত—এ সময়েও তোমার হাসি-তামাসা—এ সময়েও আমাদিগকে ঘৃণা?”

 “কাহার অন্তিমকাল কোন্ সময় উপস্থিত হয়, তাহা তুমি বলিতে পার,—না, আমি বলিতে পারি?”

 “আমি ত আর তোমার মত নাই যে, কারণ, কার্য্য ও যুক্তি অবহেলা করিয়া কেবল ঈশ্বরের প্রতি চাহিয়া থাকিব? তুমি মনে করিয়াছ যে, আমরা তোমার প্রাণবধ করিতে পারিব না,—আমাদের হস্তে তুমি মরিবে না। ওমর! অঙ্গার যদি হরিদ্রার কান্তি পায়, মশকও যদি সমুদ্র শুষিয়া ফেলে, অচলও যদি সচলভাব ধারণ করে, সূর্য্যদেবও যদি পশ্চিমে উদিত হয়, তথাপি তোমার জীবন কখনই রক্ষা হইতে পারে না। মারওয়ানের হস্ত হইতে বাঁচিয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারিবে না! মুহূর্ত্ত পরেই তোমার চক্ষের পাতা ইহকালের জন্য বন্ধ হইবে। শূলদণ্ড তোমার মস্তক ভেদ করিয়া বহির্গত হইবে। এখনও বাঁচিবার আশা—জেয়াদকে দেখিবার আশা?”

 “অত বক্তৃতা করিও না, অত দৃষ্টান্ত দিয়াও আমাকে বুঝাইও না। ঈশ্বরের মহিমার পার নাই। তিনি হরজত ইব্রাহিমকে অগ্নি হইতে, ইউসুফকে কূপ হইতে, নুহ্‌কে তুফান হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন;—কত জনকে কত বিপদ, কত কষ্ট, কত দুঃখ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, করিতেছেন এবং করিবেন। আর আমাকে এই সামান্য বন্ধন হইতে, এজিদের আদেশ হইতে, আর নিতান্ত আহাম্মক মন্ত্রী মারওয়ানের হস্ত হইতে উদ্ধার করা তাঁহার কতক্ষণের কার্য্য?”

 “তোমার ঈশ্বর, যুক্তি ও কারণের নিকট পরাস্ত। আমি যদি তোমার এ বন্ধন না খুলিয়া দিই, তোমার ঈশ্বর অদৃশ্যভাবে খুলিয়া দিন দেখি? কারণ ব্যতীত কোন কালে কোন কার্য্য হইয়াছে? দৈব কথা, দৈবশক্তি ছাড়িয়া দাও,—না হয়, তোমার বস্ত্রাঞ্চলে বাঁধিয়া রাখ, ও কথায় মারওয়ানের মন টলিবে না।”

 “মন টলিবে না বটে, কিন্তু টলিতেও ত পারে।”

 “পূর্ব্বেই বলিয়াছি—মারওয়ান তোমার মত পাগল নহে।”

 এদিকে বীরবর আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কয়েকজন সজ্জিত সৈন্যসহ মারওয়ানের নিকট উপস্থিত হইয়া উপস্থিত ঘটনা দেখিল—শুনিয়া আরও চমৎকৃত হইল। ক্ষণকাল পরে জেয়াদ গম্ভীরস্বরে বলিল, “আমি ওমর আলীকে বধ্যভূমিতে লইতেছি। কি আশ্চর্য্য! ওমর আলীকে মৃত্তিকা হইতে শূন্যে উত্তোলন করা যায় না,—এ কি কথা? অস্ত্রের সাহায্যে সকলেই সকল কাজই করিতে পারে।”

 জেয়াদ ওমর আলীর নিকট যাইয়া তাঁহাকে মৃত্তিকা হইতে শূন্যে তুলিতে অনেক চেষ্টা করিল—কিন্তু পারিল না। লজ্জা রাখিবার আর স্থান কোথায়? বিরক্তভাবে সে বলিল, “বাহ্‌রাম! তুমি ত আপন বাহুবলের ক্ষমতা অনেক দেখাইয়াছ—উঠাও।”

 মারওয়ান বলিল, “বাহ্‌রামের বাহুবল দেখিয়া আমিও চমৎকৃত হইয়াছি; সত্য কথা বলিতে কি, ঐ গুণেই আমি বাহ্‌রামকে সৈন্যদলে সাদরে গ্রহণ করিয়াছি। এখন পদোন্নতি পুরস্কার, সকলই—যদি ওমর আলীকে—”

 বাহ্‌রাম, মারওয়ান ও জেয়াদকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “গোলাম এখনই হুকুম তামিল করিবে।”

 ওমর আলী আড়নয়নে বাহ্‌রামকে দেখিয়া বলিলেন, “জেয়াদ! কত জনকে ঠকাইতে চাও? স্বপ্ন-বিবরণে প্রভু হোসেনকে ঠকাইয়াছ, মদিনাবিখ্যাত বীর মোস্‌লেমকে ঠকাইয়াছ, আজ আবার কাহাকে ঠকাইবে?”

 জেয়াদ বলিল, “তোমার অস্ত্রের ধার বন্ধ হইয়াছে, কিন্তু কথার ধাটুকু এখনও আছে। এখনই সে ধার বন্ধ হইবে। উপযুক্ত লোকই আনিয়াছি।”

 “উপযুক্ত লোক হইলে অবশ্যই পরাভব স্বীকার করিব, যে যাহা বলিবে, বিনা বাক্যব্যয়ে শুনিব। কিন্তু মরা-বাঁচা ঈশ্বরের হাত।”

 “আরে মূর্খ। এখনও মরা-বাঁচা ঈশ্বরের হাত? তোমর ঈশ্বর এখনও তোমাকে বাঁচাইবেন,—ভরসা আছে? ইচ্ছা করিলে কেবল মহারাজ এজিদ তোমাকে চাইলে বাঁচাইতে পারেন।”

 “রে বর্ব্বর জেয়াদ! তুই ঈশ্বরের মহিমা কি বুঝিবি পামর?”

 “তোমার হিতোপদেশ আর শুনিতে ইচ্ছা করি না। এখন গাত্রোখান কর, যমদূত শিয়রে দণ্ডায়মান।”

 ওমর আলী জেয়াদের কথার কোন উত্তর করিলেন না; একইরূপে দণ্ডায়মান রহিলেন—একেবারে অটল-অচল।

 জেয়াদ বাহ্‌রামকে পুনরায় বলিল, “আর দেখ কি? উহাকে বধ্যভূমিতে লইয়া চল।”

 বাহ্‌রাম সিংহ-বিক্রমে ওমর আলীকে ধরিল এবং ‘জয় মহারাজ এজিদ’ শব্দ করিয়া একেবারে শূন্যে উঠাইয়া বলিল, “হুকুম হইলেই ত এই স্থানে ইহার বধ-ক্রিয়া সমাধা করিয়া দিই।—এক আছাডেই অস্থি চূর্ণ করিয়া মজ্জা বাহির করি।”

 বাহ্‌রামের বাহুবল দেখিয়া মারওয়ানও জেয়াদ শতমুখে প্রশংসা করিতে লাগিল। মারওয়ান উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “বাহ্‌রাম, ওমর আলীকে মারিয়া ফেলিও না। রাজাজ্ঞা তাহা নহে। শূলে চড়াইয়া হইকে মারিতে হইবে। শিবিরের মধ্যে প্রাণবধের ইচ্ছা থাকিলে অনেক উপায়ই ছিল। শূলদণ্ড পর্য্যন্ত ইহাকে শূন্যে তুলিয়া লইয়া যাইতে হইবে।

 “যে হুকুম” বলিয়া বাহ্‌রাম এজিদের জয়-ঘোষণা করিতে করিতে ওমর আলীকে তৃণবৎ লইয়া চলিল। মারওয়ান ও জেয়াদও হাসিতে হাসিতে আর আর সঙ্গীসহ চলিল। দৃশ্য বড় ভয়ানক! সকলের চক্ষেই ভীম-দর্শন। শূলদণ্ডের চতুষ্পার্শে চক্রাকারে সৈন্যশ্রেণী দণ্ডায়মান। দর্শকগণের চক্ষু,—শূলের অগ্রভাগে। কাহারও মুখে কথা নাই। সকলেই নীরব। প্রান্তর নীরব।

 বাহ্‌রামের প্রশংসাবাদ করিতে লাগিল,—“বীরবর বাহ্‌রাম। তুমি ওমর আলীকে শূলদণ্ডে চড়াইয়া রাজাজ্ঞা প্রতিপালন কর।”

 জেয়াদ মারওয়ানকে বলিল, “আমার ইচ্ছা, যে পর্য্যন্ত যুদ্ধ শেষ না হয়, সে পর্য্যন্ত ওমর আলী শূলদণ্ডেই বিদ্ধ থাক।”

 মারওয়ান বলিল, “এ কথাটা বড় গুরুতর। মহারাজের অভিপ্রায় জানা আবশ্যক। শত্রুর মনে কষ্ট দিতে তোমার এ যুক্তি সর্ব্বপ্রধান বটে কিন্তু রাজাজ্ঞা তাহা নহে। আমার মতে মৃতদেহে শত্রুতা নাই। কিন্তু শূলদণ্ডে বিদ্ধ রাখিলে ইহা হানিফার বিশেষ মনোকষ্টের কারণ হইবে, তাহাতেও সন্দেহ নাই। শত্রুকে জব্দ করাই ত কথা। তোমার মত প্রকাশ করিয়া মহারাজের নিকট হইতে ইহার মীমাংসা করিয়া আসিতেছি। তুমি এদিকের কার্য্য শেষ কর। আমার প্রতি ভার অর্পিত হইয়াছিল, আমি সে ভার তোমাকে অর্পণ করিলাম। তুমি ওমর আলীকে মহারাজের আজ্ঞামত বধ কর। আমি মহারাজের নিকট হইতে ঐ কথার মীমাংসা করিয়া এখনই আসিতেছি।”

 জেয়াদ বাহ্‌রামকে বলিল, “বাহ্‌রাম। বন্দীকে জিজ্ঞাসা কর, এখন তার আর কথা কি? এখনও মহারাজ এজিদ দয়া করিলেও করিতে পারেন!”

 বাহ্‌রাম জিজ্ঞাসা করিল, “ওমর আলী! তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত। কোন কথা বলিবার থাকে ত বল,—আর বিলম্ব নাই।”

 ওমর আলী বলিলেন, “এতক্ষণ অনেক বলিয়াছি, আর কোন কথাই নাই। তবে ইচ্ছা যে, যাইবার সময় একবার ঈশ্বরের উপাসনা করিয়া যাই। কিন্তু আমার হস্তপদ কঠিনবন্ধনে বাঁধা আছে, ইহাতে সম্পূর্ণরূপে উপাসনা ব্যাঘাত হইতেছে। যদি তোমাদের সাহস হয়, তবে আমার হস্তের বন্ধন খুলিয়া দাও; আমি অন্তিম সময়ে একবার পরম কারুণিক পরমেশ্বরের যথার্থ নাম উচ্চারণ করিয়া আমার জাতীয় উপাসনায় অন্তরকে পরিতৃপ্ত করি।”

 জেয়াদ বলিল, “ওমর! আমি তোমার বন্ধন খুলিয়া দিতেছি। তুমি স্বচ্ছন্দে তোমার ইষ্টদেবতার নাম কর, ঈশ্বরকে যথাবিধি আরাধনা কর। মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম করিতে আমি কখনই বাধা দিব না। ঈশ্বর তোমাকে যে, কখনও রক্ষা করিতে পারেন,—এ ভ্রমও তুমি পরীক্ষা কর। আমি তোমাকে তোমার ইষ্টদেবতার শপথ দিয়া বলিতেছি, তোমার উদ্ধারের জন্য তুমি কায়মনে তোমার নিরাকার নির্ব্বিকার দয়াল প্রভুর নিকট আরাধনা কর।” এই বলিয়া জেয়াদ স্বহস্তে ওমর আলীর বন্ধন মোচন করিয়া দিল।

 ওমর আলী মৃত্তিকা দ্বারা[] “অজু” ক্রিয়া সমাপন করিয়া, যথারীতি ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। উপাসনার পর দুই হস্ত তুলিয়া তিনি প্রভু গুণানুবাদ করিতে করিতে শূলদণ্ডের চতুর্দ্দিকে চাহিয়া দেখিলেন এবং বীরত্বের সহিত ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। ওমর আলীর সঙ্গে সঙ্গে বাহ্‌রাম বলিয়া উঠিলেন, “জেয়াদ! বিশ্বাসঘাতকতার ফল গ্রহণ কর। মোস্‌লেম-হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ কর। ওমর আলীকে উদ্ধার করিতে আসিয়া তোমাকে সুযোগমত পাইয়াছি—ছাড়িব না।” এই বলিয়া সজোর আঘাতে জেয়াদ-শির দেহবিচ্ছিন্ন করিলেন। সেই শিরসংযুক্ত কেশগুচ্ছে ধরিয়া, শিরহস্তে বাহ্‌রাম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্ম্মী এজিদ! দেখ্, কি কৌশলে বাহ্‌রাম ওমর আলীকে লইয়া চলিল। কেবল ওমর আলীকে উদ্ধার করিবার জন্যই বাহ্‌রাম ছদ্মবেশে তোর প্রিয় সেনাপতি জেয়াদের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। আমি মোহাম্মদ হানিফার দাস। যুদ্ধ-সময়ে আগন্তুক সৈন্য-গ্রহণ করার এই প্রতিফল—সৈন্য-বৃদ্ধি লালসায় ভবিষ্যৎ চিন্তা ভুলিয়া যাওয়ার এই ফল। দেখ্‌—এই দেখ্—আজ কি ঘটিল। আগন্তুক সেনায় বিশ্বাস নাই বলিয়া, তোর মন্ত্রিপ্রবর শূলদণ্ডের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক্রে নূতন সেনা সন্নিবেশিত করিয়াছে। ইহারা বাহির-চক্রে থাকিলে কি জানি কি বিপদ ঘটায়—তাহার এই দুশ্চিন্তায় ঈশ্বর আমাদেরই মঙ্গল করিয়াছেন। এখন দেখ, বাহ্‌রাম জেয়াদের শির লইয়া বীরের মত ওমর আলীকে সঙ্গে লইয়া চলিল।”

 ওমর আলী জেয়াদের কটিবন্ধ হইতে তরবারি সজোরে টানিয়া লইয়া বলিতে লাগিলেন “মোহাম্মদীয় ভ্রাতৃগণ! আর কেন? প্রভুর নাম ঘোষণা করিয়া ঈশ্বরের গুণগান করিতে করিতে শিবিরে চল। ওমর আলী সহজেই উদ্ধার হইল। আর আত্মগোপনে প্রয়োজন কি? প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক্রের সেনাগণ সমস্বরে “আল্লাহু আক্‌বর। জয় মোহাম্মদ হানিফা! জয় মোহাম্মদ হানিফা!” বলিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে দেখিতে তাহারা চতুর্থ এবং পঞ্চম চক্র ভেদ করিয়া ষষ্ঠ চক্রে গিয়া পড়িল। ঘোর সংগ্রাম। অবিশ্রান্তে অসি চলিতে লাগিল। এজিদের বিশ্বাসী সৈন্যগণ, যাহারা ষষ্ঠ এবং সপ্তম চক্রে ছিল, হঠাৎ স্বপক্ষীয় সৈন্যদিগের বিদ্রোহিতা দেখিয়া মহা ভীত হইল। বাহিরের শত্রু ওমর আলীকে যেন না লইয়া যাইতে পারে,—ইহাই তাহাদের লক্ষ্য,—তাহাতেই মনঃসংযোগ ও সতর্কতা। হঠাৎ বিপরীত ভাব দেখিয়া তাহারা কিছুই স্থির করিতে পারিল না;—কোথা হইতে কি ঘটিল, কি কারণে সৈন্যগণ বিদ্রোহী হইল, কিছুই সন্ধান করিতে পারিল না। জেয়াদের খণ্ডিত শির অপরিচিত সৈন্যহস্তে দেখি, মহারাজ এজিদ বাঁচিয়া আছেন কি না, ইহাই তাহাদের সমধিক শঙ্কার কারণ ইইল। চক্র টিকিল না। মুহুর্ত্ত মধ্যে চক্র ভগ্ন করিয়া ওমর আলী এবং বাহ্‌রাম সঙ্গীগণসহ বাহিরে আসিলেন। যাহারা সম্মুখে পড়িল, তাহারাই মৃত্তিকাশায়ী হইল।

 আশা ছিল কি—ঘটিল কি? কোথায় ওমর আলীর শূলবিদ্ধ শরীর সকলের চক্ষে পড়িবে, তাহা না হইয়া জেয়াদের খণ্ডিতদেহ দেখিতে হইল। মারওয়ানের দুঃখের সীমা নাই। ওদিকে হানিফা-শিবিরে শত সহস্র বিজয়নিশান উড়িতেছে, সন্তোষসূচক বাজনায় দামেস্ক-প্রান্তর কাঁপাইয়া তুলিতেছে। এজিদ এ সংবাদে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া বধ্যভূমিতে আগমন করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, “হায়! হায়!! কার বধ কে করিল? যাহা হউক, হানিফার কূট চিন্তার বলে ওমর আলী কৌশল করিয়া প্রাণ বাঁচাইল। আমাদেরও শিক্ষা হইল। সমরক্ষেত্রে আগন্তুক সৈন্যকে বিশ্বাস করিয়া সৈন্যশ্রেণীতে গ্রহণ করার ফল, প্রত্যক্ষ প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে দেখাইয়া দিল। আমাদের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতার কার্য্যফল হাতে হাতে প্রাপ্ত হইতে হইল। আমার ইহাতে দুঃখ নাই। কিন্তু জেয়াদের শিরশূন্য দেহ দেখিয়া কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিতেছি না। জেয়াদের শির আজ হানিফার শিবিরে যাইবে, একথা কাহার মনে ছিল?—কে ভাবিয়াছিল?—কিন্তু চিন্তা কি? এখনই প্রতিশোধ, এখনই ইহার প্রতিশোধ লইব। ঐ শূলদণ্ড যে ভাবে আছে, সেই ভাবেই রাখিব। ভবিষ্যৎ বিপদ গণনা করিয়া আর বিরত হইব না, আর কাহারও কথা শুনিব না। যাও—এখনই নগরে যাও। জয়নাল আবেদীনকে বাঁধিয়া আন। ঐ শূলদণ্ডে তাহাকে চড়াইয়া প্রিয়বন্ধু জেয়াদের শোক নিবারণ করিব, মনের দুঃখ দূর করিব। জয়নালবধে শত শত বাধা আসিলেও এজিদ আজ ক্ষান্ত হইবে না। শূলে চড়াইয়া শত্রুবধ করিতে পারি কি না, হানিফাকে দেখাইতে এজিদ কখনই ভুলিবে না। বন্দীকে ধরিয়া আনিয়া শূলে চড়াইব, ইহাতে আর আশঙ্কা কি? শঙ্কা থাকিলেও আজ এজিদ কিছুতেই সঙ্কুচিত হইবে না। এখন যাও মারওয়ান। এখনই যাও, জয়নালকে ধরিয়া আন—এজিদ এই বধ্যভূমিতেই রহিল। ভেরীর বাজনার সহিত, ডঙ্কার ধ্বনির সহিত নগরে, প্রান্তরে, সমরক্ষেত্রে, হানিফার শিবিরের নিকটে ঘোষণা করিয়া দাও যে, ওমর আলীর জন্য যে শূলদণ্ড স্থাপিত করা হইয়াছিল, সেই শূলদণ্ডে জয়নালকে চড়াইয়া জেয়াদের প্রতিহিংসা লওয়া হইবে।”

মারওয়ান আর দ্বিরুক্তি করিল না; রাজাদেশ মত ঘোষণা প্রচারের আজ্ঞা করিয়া সপ্তবিংশ অশ্বারোহী সৈন্যসহ অশ্বারোহণে তখনই নগরাভিমুখে ছুটিল।

  1. জলাভাবে মৃত্তিকা দ্বারাও শরীর পবিত্র করিবার বিধি আছে, তাহার নাম তৈয়ন্মুম