বীরজয় উপাখ্যান

শ্রীশ্রীজগদীশ্বরায় নমঃ।

বীরজয় উপাখ্যান।

খিদীরপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত আশুতোষ বিশ্বাস

কর্ত্তৃক গদ্য পদ্যে প্রণীত ।


কলিকাতা

বি. পি. এমস্ যন্ত্রে

১২৭৬ সাল।


মূল্য ৷৵৹ ছয় আনা মাত্র।

এই পুস্তক যাহার প্রয়োজন হইবেক তিনি খিদীরপুর দুষ্পাঠ্যরফেন গদুষ্পাঠ্য ডিসপেনসারিতে তত্ত্ব করিলে প্রাপ্ত হইবেন।

শ্রীশ্রীজগদীশ্বরায় নমঃ।

বীরজয় উপাখ্যান।

খিদীরপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত আশুতোষ বিশ্বাস

কর্ত্তৃক গদ্য পদ্যে প্রণীত ।


কলিকাতা

বি. পি. এমস্ যন্ত্রে

শ্রীকালীকুমার চক্রবর্ত্তী কর্ত্তৃক মুদ্রিত।

নং ২২ ঝামাপুকুর নেন।

১২৭৬ সাল।

বিজ্ঞাপন।


অন্যান্য পুস্তক অপেক্ষা উপন্যাসাদি পাঠ করিতে প্রায় সকলেরই মনে স্বভাবতঃ অনুরাগ জন্মিয়া থাকে এবং যে সকল মহাত্মারা কোন পুস্তকাদি পাঠ করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে ইচ্ছুক নহেন তাঁহারাও উক্ত প্রকার গ্রন্থের সমাদর করিয়া থাকেন। এতদ্বিবেচনায় এই অভিনব ক্ষুদ্র পুস্তক খানি রচিত হইল; ইহার তাৎপর্য্য কি, পাঠ করিলেই প্রকাশ হইবে; ইহাতে প্রথমোদ্যমে অবশ্য অনেক দোষ হইবার সম্ভাবন,পাঠকবর্গ অনুগ্রহ পুর্ব্বক ঐ সকল দোষ ক্ষমা করিয়া গ্রহণ করিলে আমি আত্মাকে চরিতার্থ জ্ঞান করির; কারণ আমি নূতন ব্রতী অতএব আমার এই পুস্তকটা মহোদয়গণের বিশেষ মনোরঞ্জন করিবে এরূপ প্রত্যাশ করি নাই।


শ্রীআশুতোষ বিশ্বাস।

বীরজয় উপাখ্যান।


 পূর্ব্বকালে গান্ধার দেশে রমাপতি নামে এক প্রবল প্রতাপান্বিত নরপতি বাস করিতেন। তাঁহার ইন্দুমতী নাম্নি এক প্রেয়সী ছিলেন; ঐ ইন্দুমতীর গর্ভে বীরজয় নামে এক পরম সুন্দর পুত্র জন্মিল। এই রাজপুত্র বাল্যকালেই নানাবিধ গ্রন্থ পাঠ করিয়া সর্ব্বশাস্ত্রে পারদর্শী হইয়া উঠিলেন। ইনি কখন কখন যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা করিতেন; কখন বা মৃগয়া করিতে যাইতেন; কখন কখন বন্ধুগণে পরিবৃত হইয়া কৌতুক করিতেন। এইরূপে রাজতনয় যৌবনের প্রারম্ভ অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। এক দিন রজনীযোগে রাজপুত্র নির্জনে বসিয়া নানা বিষয়িনী চিন্তা করিতে করিতে মনে মনে বিবেচনা করিলেন যে আমি নানা দেশ পর্যটন করিলে তত্তদ্দেশের রীতিনীতি ও আচার ব্যবহার শিক্ষা করিতে পারিব। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া পরদিন প্রভাতে বহুমূল্য রত্ন সমভিব্যাহারে একাকী অশ্বারোহন পূর্ব্বক বাটী হইতে বহিস্কৃত হইলেন। পরে নানা দেশ উত্তীর্ণ হইয়া পরিশেষে এক তপোবন সমীপে উপস্থিত হইলেন, এবং তপোবন শোভা সন্দর্শন করিয়া বিমুগ্ধ মনে উক্ত বনে প্রবেশ করিলেন।


তপোবন বর্ণন।
পয়ার।

রাজপুত্র উপস্থিত হয়ে তপোবনে।
অদ্ভুত সৌন্দর্য্য হেরে পুলকিত মনে॥
কোথায় মালতি পুষ্প কোথায় মল্লিকে।
কোথায় গোলাপ গাঁদা কোথা সেফালিকে॥
কোথা জাঁতি কোথা জুঁই কোথা বেলফুল।
নানাবিধ রঙ্গে আলো করে চারিকুল॥
কোথায় চম্পক পুষ্প আর গন্ধরাজ।
সৌরভেতে সুবাসিত করে বন মাঝ॥
বহিছে মলয়ানিল অতি মন্দ মন্দ।

চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয় নানা পুষ্পগন্ধ॥
শরতের চন্দ্র যেন খসিয়া পড়িছে।
ঋতুকুল পতি যেন সতত ভ্রমিছে॥
গুণ গুণ শব্দে তথা ভ্রমর ভ্রমরী।
নানাহর্ষে নৃত্যকরে মধুপান করি॥
পক্ষির নিনাদে বন উজ্জ্বল হইল।
রাজপুত্র স্তব্ধ হয়ে ক্ষণেক রহিল॥
চিন্তিত হইয়া মনে প্রবেশে সেবন।
কোথায় যাইব একা নাহি কোন জন॥
অরণ্যের প্রান্ত হতে করি দরশন।
একজন ঋষিপুত্র সুবেশ ধারণ॥
কঠিন তপস্বা করে বনের ভিতরে।
রাজসুত প্রীত অতি হইল অন্তরে॥

 পরে ঋষিপুত্রের তপভঙ্গ হইলে রাজতনয় যোড়করে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। ঋষিসুত অকস্মাৎ নিবিড় অরণ্যের মধ্যে পরম সুন্দর রাজপুত্র দেখিয়া অত্যন্ত বিস্ময় হইল। রাজপুত্র বলিলেন মহাশয়! আপনাকে ঋষিসুত প্রায় বোধ হইতেছে; ঋষিপুত্র আপন পরিচয় প্রদান করত রাজতনয়ের সঙ্গে সখ্যভাব করিলেন। রাজকুমার সে দিবস বন্ধুসহ তপোবনে কালযাপন করত পরদিন বন্ধুর নিকট বিদায় লইয়। তপোবন ত্যাগ করিলেন। তদনন্তর দেশ দেশান্তর ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কিছুদিন পরে একজন বণিক তাঁহার সমভিব্যাহার হইল। উক্ত বণিক অতি ধুর্ত্ত এবং চৌর্য্য ব্যবসায় বিলক্ষণ পরিপক্ক ছিল। সে রাজপুত্রকে ধনি ও সরলান্তঃকরণ দেখিয়া উহার সহিত কৃত্রিম মৈত্রতা করিল এবং কহিল প্রিয়বন্ধু আইস আমরা উভয়ে বণিয্যকরি তাহা হইলে আমাদের দেশ দেশান্তর পরিভ্রমণ করা হইবেক ও অর্থ উপার্জ্জন হইবে। এই বলিয় রাজপুত্রকে আপনার অর্ণবতরিতে লইয়া গেল। রাজকুমার বন্ধুর কপটভাব বুঝিতে না পারিয়া আপন সম্মতি প্রদান করত অর্ণবযান ছাড়িবার অনুমতি দিলেন। কিঞ্চিৎ দূর গিয়া বণিক রাজনন্দনের সর্ব্বস্ব হরণমানসে উহাকে নদীতে নিক্ষেপ করিয়া জাহাজ লইয়া বেগে প্রস্থান করিল।

 নৃপসুত স্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে এমন সময় এক মালিনী নদীতীরে স্বীয় মালঞ্চে পুষ্পচয়ন করিতেছিল, তাহার নেত্রদ্বয় উক্ত রাজপুত্রের উপর নিক্ষেপ হওয়াতে সন্তরণ দ্বারা তাঁহাকে স্রোত হইতে তুলিল। ক্ষণেক বিলম্বে, রাজপুত্র চৈতন্য প্রাপ্ত হইলেন।


মালিনী রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া আপন গৃহে লইয়া যায়।

দীর্ঘ ত্রিপদী।

কিনাম তোমার কহ, কোন স্থানে তুমি রহ,
এসঙ্কটে কেমনে পড়িলে।
না করিহ ভয় মনে, কহ মোর সন্নিধানে,
মাতৃ ভূমি কিৰূপে ত্যজিলে॥
দেখিয়া তোমার কান্তি, জন্মিয়ছে মমভ্রাস্তি,
হবে নৃপ—কিম্বা দেবসুত।
দেখিতে সুন্দর অতি, ৰূপে সমরতিপতি,
বিধির কি গঠন অদ্ভুত॥
কোথাতব পিতামাতা, কোথায় রহিল ভ্রাতা,
নাহি দয়া তাঁদের অন্তরে।
কিৰূপে তোমারে ছাড়ি, রহিয়াছে তাঁরা বাড়ী,
তব অন্বেষণ নাহি করে॥

শুনিবাক্য মালিনীর, নৃপসুত অতিধীর
দিলেন সমস্ত পরিচয়।
গান্ধার দেশাধিপতি, নামতার রমাপতি,
তারপুত্র নাম বীরজয়॥
ভ্রমণ মানস করি, পিতা মাতা পরিহরি,
সঙ্গে করি অনেক রতন।
ভ্রমিলাম নানাদেশ, কাহারো না করি দ্বেষ,
শুন বলি দৈবের ঘটন॥
চুরিতে বড়ই পাকা, মোর সঙ্গে দেখে টাকা,
একজন বণিক আইল।
কপট মৈত্রতা করি, সর্ব্বস্ব লইল হরি,
অবশেষে স্রোতে ভাসাইল॥
শুনি রাজসুত বাণী, তবে বলিল মালিনী,
শুনে বাছা বিপদ তোমার।
বিদরিছে মম বুক, কেমনে সয়েছ দুঃখ
যাহোক ভেবনা প্রাণে আর॥
তবমাসী আমি হয়ে, রাখি তোমা মমালয়ে,
পালিব যতনে আমি অতি।
নাহি কোন কষ্ট পাবে, সর্ব্বদুঃখ দূরে যাবে,
এস সঙ্গে হয়ে স্থিরমতি॥

রাজপুত্র তবে চলে, মালিনীরে এই বলে,
ও গো মাসী কতদূর ঘর।
চলিতে অশক্ত আমি, হয়ে তব অনুগামী,
অঙ্গমম কাঁপে থর থর॥
বলে তবে বারম্বার, দূর বড় নাহি আর,
মালিনী অত্যন্ত ব্যগ্রহয়ে।
চল বাছা শীঘ্রগতি, হৈওনা অস্থির মতি,
সত্বরে পৌঁছিবে মমালয়ে॥
আসি মালিনীর ঘরে, রাজস্থত মৃদুস্বরে।
কহে হাসি মধুর বচন।
তোমার আলয় ছাড়ি, যাইতে কাহার বাড়ী,
কভু নাহি সরে মোরমন॥
প্রীত হইয়া অন্তরে, মালিনী মাসীর ঘরে,
এইৰূপে রাজার তনয়।
নাহি কোন চিন্তা মনে, সর্ব্ব দুঃখ নিবারণে,
কিছুদিন হেন মতে রয়॥

 এইৰূপে রাজপুত্র মালিনীর গৃহে কিছুকাল অবস্থিতি করেন। মালিনী সর্ণাট দেশাধিপতি সুবাহুর গৃহে প্রতিদিন সায়ংকালে পুষ্প মাল্য দেয়। উক্ত রাজার কন্যা কামিনী এক দিবস মালিনীর বাটীর পশ্চিমাংশে এক মনোহর কুঞ্জবনে বিহার করিতে আসিয়াছেন, ইতিমধ্যে বীরজয় ঐ কানন দর্শন করিতে গিয়াছিলেন, তিনি কামনীর ৰূপলাবণ্য দেখিয়া অত্যন্ত মুগ্ধ হইলেন। অবিবাহিতা রাজকন্যা কুঞ্জবন ভ্রমণ করিতে করিতে ঘটনাক্রমে উক্ত রাজনন্দনের প্রতি নেত্রপাত করেন। পরম সুন্দর রাজতনয় দেখিয়া কন্যা একবারে মোহিত হইয়া রহিলেন। পরে ঐ সুন্দর পুরুষকে মালিনীর বাটিতে প্রবেশ করিতে দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন যদ্যপি আমার পিতা ঐ রাজপুত্রের সহিত পরিণয় সম্বন্ধ করেন তাহা হইলে বিবাহ করিব নচেৎ বিবাহ করিব না। নবীন বয়স্ক রাজসুতা ক্রমশ বিমর্ষ এবং মলিন হইতে লাগিল। সমভিব্যাহরি দাসীগণকে কোন ভাব প্রকাশ না করিয়া আপন গৃহে প্রবেশ করত দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। উন্মত্তা কামিনী অনীহারে ধরাসনে পতিতা আছেন এমন সময়ে দাসীগণ অশ্রুলোচন যোড় করে রাজমহিষীর নিকট বলিল! মহারাণী! আপনকার কন্যা বিমর্ষ হইয়া অদ্য ধরাসনে পতিতা আছেন। রাজরাণী অতি ব্যস্ত হইয়া কন্যাকে বারম্বার ডাকতে কোন উত্তর না পাইয়া দ্বার ভঞ্জন করিয়া ফেলিলেন। কন্যাকে ধুলায় লুণ্ঠিতা দেখিয়া রাজমহিষী জিজ্ঞাসা করিলেন, হে কন্যা! অদ্য তোমাকে এপ্রকার বিরূপ দেখিতেছি কেন? কামিনী লজ্জা প্রযুক্ত কোন উত্তর না করিয়। মৌনভাবে রহিলেন। রাজরাণী কন্যাকে উত্তোলন করিয়া গাত্র মার্জ্জন করত আহারাদি করাইলেন। পরে রাজমহিষীর ইঙ্গিতে দাসীগণ কামিনীকে আপন ঘরে লইয়া গেল।


কামিনীর মলিন রূপ দেখিয়া দাসীগণের জিজ্ঞাসা।

পয়ার।

মিলিয়া একত্রে পরস্পর দাসীগণ।
রাজসুতা সন্নিকটে বলিছে বচন॥
শুনরাজবালা মোরা করি নিবেদন।
তোমার সমীপে এক মনের কথন
বল দেখি বিধুমুখী কিসের কারণ।
আকৃতি বিকৃতি কেন ব্যাকুলিত মন॥

মলিন হইল ৰূপ শুষ্ক ওষ্ঠাধর।
হইতেছ দিনে দিনে শীর্ণ কলেবর॥
পূর্ব্বষত রঙ্গরস বাক্যের কৌশল।
হাস্য পরিহাস পরিহরিছ সকল॥
কি রোগ জন্মিয়া দেহ কৈল আচ্ছাদন|
প্রকাশ করিয়া বল শুনি বিবরণ॥
এখনি বলিব তব ময়ে সব কথা।
বৈদ্য চেষ্টা করিবেন না হবে অন্যর্থা॥


রাজ কন্যার উত্তর।
সমাক্ষর চৌপদী।

হইয়া লজ্জিতা, তাহেব্যাকুলিতা, রাজার দুহিতা,
বলে দাসীগণে।
কৈতে সেকথন, বুকবিদরণ, হতেছে এখন,
বলিবকেমনে॥
নকছিলে নয়, বলিতে সে হয়, না হলে আশয়,
কিৰূপে পূরিবে।
শুন দিয়া মন, ও গো দাসীগণ, মম সে কথন
গুপ্ত না রহিবে॥

হয়েছি যুবতী, বিবাহেতে মতি, হয়েছে সম্প্রতি
মাতারে বলগে।
বিলম্ব না সয়, যাতে শীঘ্র হয়, শুভ পরিণয়,
উপায় করগে॥
আছে এক বর, গঠন সুন্দর, ৰূপ মনোহর,
মলিনী সদনে।
যত্ন সহকারে, আনাইতে তারে, বলগে পিতারে
আপন ভবনে॥
শুনে দাসীগণ, হয়ে হৃষ্টমন, করিল গমন
নিকটে রাণীর।
বিনয় বচনে, রাণী সন্নিধানে, কহ সঙ্গোপনে
হয়ে মতি স্থির॥

 দাসীগণ বিনয় বচনে রাজমহিষীকে বলিল, মহারাণী! আপনকার কন্যা বিবাহযোগ্য হইয়ছেন, অবিলম্বে উহার সম্বন্ধ স্থির করিয়া পরিণয়কার্য্য সম্পাদন করুণ। রাণী দাসীদিগের প্রমুখাৎ কন্যার মনঃভাব জ্ঞাত হইয়া অত্যন্ত অনন্দচিত্তে রাজারে বলিলেন, মহারাজ! আপনি কেমনে মিশ্চিন্ত রহিয়াছেনক? আপনকার কন্যা বিবাহের উপযুক্ত হইয়াছে, সম্বন্ধ স্থির করিয়া বিবাহ দিউন। দাসীগণ রাজরাণীরে বলিল, মহারাণী! আপনকার কন্যার এক যোগ্যপাত্র আছে, উক্ত পাত্র মালিনীর গৃহে অবস্থিতি করে। পাত্রটি পরম সুন্দর রাজপুত্র এবং আপনকার কন্যা উহাকে মনোনীত করিয়াছেন। মহিষী কন্যার অভিপ্রায় নৃপতি সমীপে ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, মহারাজ! মালিনীর বাটীতে একজন সুপাত্র রাজপুত আছেন পাত্রটি দেখিতে অতি মনোহর এবং আপনকার কন্যার সম্পূর্ণ অভিলাষ যে উহাকে মাল্য প্রদান করে অতএব মালিনীরে ডাকাইয়া উক্ত পাত্রের সমস্ত পরিচয় গ্রহণ করুণ। মহারাজ তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তিকে মালিনীরে ডাকিতে আদেশ করিলেন। এখানে মালিনীর গৃহে রাজপুত্র বীরজয় কামিনীর পাণিগ্রহণভিলাষে প্রত্যহ মহাদেবী কালীর নিকটে করপুটে ও কায়মন চিত্তে স্তব করিতেছেন।


কালীকাদেবীর নিকটে বীর জয়ের স্তব।
পয়ায়

এখানেতে রাজসুত মালিনীর ঘরে।
একান্ত নিবিষ্ট চিত্তে কালীস্তব করে॥
বলে কালী মুণ্ডমালী কালহরা শ্যামা।
করাল বদনী তারা অসিধর বাম॥
কালদারা ভয়ঙ্করা মুক্তি প্রদায়িনী।
কাত্যায়নী দয়াময়ী কামরি কামিনী॥
কৃপাণধারিণী মাতা বিজয়ী সমরে।
সুবাহুর সুতা মোরে দেহ কৃপাকরে॥
নগ্রেন্দ্র নন্দিনী রক্ত বীজ বিনাশিনী।
মনোরথ পূর্ণ কর চন্দ্রাঙ্গভালিনী॥
কৈলাস বাসিনী মাতা কাল নিবারিণী।
কালকান্তি কপালিনী কঙ্কাল মালিনী॥
জয়দুর্গা জগদম্বা জগৎ কারিণী।
জগদ্ধাত্রী জয়াজীবে জীবন দায়িনী॥
দনুজদল দমনী দুঃখ দূর করা।
দীনে দয়া কর দুর্গা দুর্গ প্রাণ হরা॥
ভৈরবী ভবানী ভীমা ভবের ভাবিনী।

ভরসা কেবল তব ভবান্ধ বারিনী।
হরপ্রিয়ে হৈমবতী কাল কাদম্বিনী।
বিশালাক্ষী বিৰূপাক্ষ বক্ষ বিলাসিনী॥
সিদ্ধকর মম কাম এই নিবেদন।
কৃপাকরে সেবকেরে দিয়া শ্রীচরণ॥

 মালিনী যোড়করে নরপতি সমীপে দণ্ডায়মানা হইয়া বলিল, মহারাজ! কি নিমিত্ত আপনি আমাকে ডাকাইলেন। রাজা কহিলেন, মালিনী! তোর ঘরে কোন রাজতনয় আছে? মালিনী মস্তকাবনত করিয়া বলিল হাঁ মহারাজ একজন রাজপুত্র আমার বাটীতে আছেন। পরে রাজ জিজ্ঞাসিলেন ঐ রাজপুত্রের কিনাম ও উহার বাটী কোথায় এবং উহার পিতার নাম কি? মালিনী ধীরে ধীরে বলিল মহারাজ! গান্ধার দেশের রাজা রমাপতি তাঁহার পুত্র, নাম বীরজয়। নরপতি পুনশ্চ জিজ্ঞাস করিলেন মালিনী! ঐ রাজপুত্র কেমনে তোর গৃহে আসিল? মালিনী উত্তর করিল, মহারাজ! ঐ রাজপুত্র বাল্যকালে স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া কিছুদিন দেশ দেশান্তর ভ্রমণ করেন; অবশেষে একজন দস্যু বণিকের হস্তে পতিত হওয়াতে ঐ বণিক উহাকে এক অর্ণবযানে আরোহণ করাইয়া নদীতে নিক্ষেপ করে। রাজপুত্র স্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে এমন সময়ে আমি নদীতীরস্থ আপনার মালঞ্চে পুষ্পচয়ন করিতেছিলাম, দেখিলাম আমার মালঞ্চের নিকট দিয়া একটা পরমসুন্দর পুত্র ভাসিয়া যাইতেছে আমি সন্তরণ দ্বারা উহাকে স্রোত হইতে তুলিলাম, পরে চৈতন্য প্রাপ্ত হইলে বিশেষ পরিচয় গ্রহণে উহাকে আপন আলয়ে লইয়া আসিলাম। রাজা মালিনীর প্রমুখাৎ সমস্ত বিবরণ শ্রবণ করিয়া মলিনীরে বিদায় করিয়া দিলেন।

 মালিনী বাটীতে প্রত্যাগমন করিয়া রাজপুত্রেরে বলিল, বাছা! রাজা আমাকে অদ্য তোমার পরিচয় জিজ্ঞস করাতে আমি সমস্ত বিবরণ বলিলাম, রাজা কেন এৰূপ জিজ্ঞাসা করিলেন আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। বীরজয় কোন উত্তর না করিয়া মনে মনে ভাবিলেন বুঝি দেবী কালীর অনুগ্রহ নিকটবর্ত্তী হইল। পরে রাজতনয় মালিনীর বাক্যে বিশেষ প্রীতিলাভ করত সমস্ত দিবস সুখে যাপন করিয়া রজনীযোগে গাঢ় নিদ্রা যাইতেছেন এমন সময় দেবীকালী স্বপ্নেতে বলিলেন, রাজতনয়! তোর মনোভিলাষ পূর্ণ হইবে কোন চিন্তা নাই। এখানে উক্ত বিভোবরীতে রাজ সুবাহুর প্রতি কালীকা দেবীর এক স্বপ্ন হইল।




সুবাহুর প্রতি কালীক দেবীর স্বপ্ন।
হ্রস্ব ত্রিপদী।


তৃতীয় প্রহর, নিশি ঘোরতর
নিদ্রিত সর্ণাট পতি।
বসিয়া শিয়রে, দেবী মৃদুস্বরে,
বলে বাক্য নীত অতি॥
ও রে নরপতি, হৈওনা দুর্ম্মতি,
শুন মম পরামশ।
যাতে কুলরবে, সুমঙ্গল হবে
হইবে যাহাতে যশ॥
করছেন কার্য্য, যাতে তোর রাজ্য,
নাহি লোপ হবে।
এমন উপায়, বলিনৃপরায়,
যাহাতে সৌভাগ্য রবে॥

ঘরে মালিনীর, সুবোধ সুধীর,
সুন্দর সুপাত্র আছে।
কামিনীর বিয়া, তার সঙ্গে দিয়া,
রাখ তারে নিজ কাছে॥
বলি এই বীণা, চলিল ভবানী,
কৈলাস শিখর যথা।
নিদ্রা ভঙ্গ হয়, রাজা ভয় পায়,
ন্মরণে দেবীর কথা॥
নিশি পোহাইল, আসিয় বসিল,
নৃপ নিজ সিংহাসনে।
ডাকিয়া মন্ত্রীরে, বলে ধীরে ধীরে,
যাও মালিনী ভবনে॥
বীরজয় নাম, সর্ব্বগুণগ্রাম,
তথায় সুপাত্র আছে।
অতি যত্ন করে, তাঁহারে সত্বরে,
আনগে আমার কাছে॥

 মন্ত্রী রাজার আজ্ঞা পাইয়া মালিনীর বাটীতে উপস্থিত হইল। উক্ত সময়ে রাজপুত্র বীরজয় নিদ্রা যাইতেছিলেন। পরে নিদ্রাভঙ্গ হইলে মালিনী তাঁহার সমীপে আসিয়া বলিল, ওগো বাছা! রাজবাটী হইতে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তোমার নিকটে আসিয়াছে। বীরজয় মুখ প্রক্ষালন পূর্ব্বক মন্ত্রী নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! আপনি কোথা হইতে আসিয়াছেন? মন্ত্রী বলিল, আমি সুবাহু নামা নৃপতির নিকট হইতে আসিয়াছি। রাজপুত্র অনুমান করিলেন, বোধহয় শুভপরিণয় নিকটবর্ত্তী হইল। পরে মন্ত্রী রাজপুত্রের ৰূপলাবণ্য দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন এই সুপাত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতে মহারাজ আদেশ করিয়াছেন। কিয়ৎ বিলম্বে রাজপুত্রের পরিচয় গ্রহণ করিয়া মন্ত্রী সমাদর পূর্ব্বক বলিল, মহাশয়! আপনাকে মহারাজ সুবাহু অত্যন্ত যত্ন সহকারে আহ্বান করিয়াছেন। রাজতনয় বলিলেন, মহাশয় রাজা কি নিমিত্ত আমাকে আহ্বান করিয়াছেন ইহার বিশেষ বিবরণ না বলিলে কদাচ যাইব না। মন্ত্রী কহিলেন, হে রাজ পুত্র! রাজার মনোভাব আমি বিশেষৰূপে জানিনা কিন্তু অনুমান করি রাজার এক অবিবাহিতা পরম সুন্দরী কন্যা আছে, উক্ত কন্যার সহিত আপনকার পরিণয় সম্বন্ধ হইবে। রাজকুমার ছল পূর্ব্বক বললেন মহাশয়! আমি বাল্যাবস্থাবধি এই অঙ্গীকার করিয়াছি যে পরমসুন্দরী কামিনী ন হইলে বিবাহ করব না। মন্ত্রী অত্যন্ত আনন্দসহকারে কহিলেন, রাজতনয়া! সে কামিনীর ৰূপলাবণ্য আমি কিঞ্চিৎ বলিতেছি শ্রবণ কৱুণ।



কামিনীর রূপ বর্ণন।
দীর্ঘ ত্রিপদী।

সুনব যৌবনা অতি,  কন্যা তাহে ৰূপবতী,
তারে দেখে পদ্মিনী লুকায়।
দেখে তার মুখ শশী  অধোমুখে থাকে শশী,
মৃগ অঙ্ক লইয়া লজ্জায়॥
সদা বেণী বিনাইত,  ভুরু ধনু সুশোভিত,
কুরঙ্গ জিনিয়ে আঁখিদ্ধয়।
দাড়িম্ব জিনিয়ে শোভা,  কুচগিরি মনলোভা,
উরু দেশ মৃদু অতিশয়॥
দণ্ডপাতি মুক্তাহার,  পক্ক বিম্বসমাকার,
ওষ্ঠ তাহে মৃদু মৃদু হাস!
দীর্ঘকেশা সে সুন্দরী,  গমন জিনিয়া করী,
স্বর্ণবর্ণ করয়ে প্রকাশ॥

দেখতার ক্ষীণকটি,  কর নমস্কার কোটি,
পশুরাজ বনে পলাইল।
সুগভীর হেরি নাভি,  কমল কমল ভাবি,
ভুলে বাস কমলে করিল॥
নিতম্ব দেখিয়া তার,  মেদিনী মানিল হার,
অকণ্টক সে ভুজ মৃনাল।
তিলপুষ্প অগ্রসম,  নাশাতার মনোরম,
সুচিক্কণ সমতল ভাল॥

 পরে মন্ত্রী রাজপুত্রকে আপন সমভিব্যাহারে রাজ বাটীতে লইয়া গেলেন। রাজা সুবাহু যথেচিত সম্মান পুরঃসর রাজপুত্রকে আহ্বান করিয়া বসাইলেন। অতঃপর রাজতনয়ের সমস্ত পরিচয় গ্রহণ করিয়া অত্যন্ত আনন্দ-সাগরে মগ্ন হইলেন। রাজা আপন মনোগতভাব রাজকুমার সমীপে ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, হে রাজতনয়! আমার অবিবাহিতা কন্যা কামিনীর পাণিগ্রহণ তোমাকে করিতে হইবেক। রাজপুত্র কোন উত্তর না করিয়া আনন্দচিত্তে মৌনভাবে রহিলেন। সুৰাহু রাজতনয়ের মৌন-সম্মতি বুঝিতে পারিয়া মন্ত্রীও পাত্রগণকে অপরাপর ভূপতিদিগকে নিমন্ত্রণ করিতে আদেশ দিলেন। দেশ দেশান্তর পত্রবাহক প্রেরণ হইল। তদনন্তর নানা দেশ হইতে নৃপগণ মহা সমারোহ পূর্ব্বক উপস্থিত হইলেন। সুবাহু নরপতি তাঁহদের যথোচিত সম্মান করত কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। ভূপতিগণ স্ব স্ব মঙ্গল সমাচার প্রদান করিলে, সুবাহু তাঁহদের যথাযোগ্য বাসস্থান নিৰুপিত করিয়া দিলেন। ভৃত্যগণ মহীপালের আদেশানুসারে উচ্চস্থান নিম্ন, নিম্ন স্থান উচ্চ, ঘটস্থাপন, কদলী বৃক্ষরোপন এবং বাটীর চতুষ্পার্শে অম্বশাখা গ্রন্থি করিতে লাগিল।

 বিবাহের কোলাহল ধ্বনিক্রমশ দেশ বিদেশে প্রচারিত হইল। দীন হীন অন্ধ বধির ও খঞ্জ প্রভৃতি লোকদিগকে রাজা স্বীয় ভাণ্ডার হইতে বহুবিধ ধন বিতরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। নৃপতির যশসৌরভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হইতে লাগিল। রাজপুরোহিত বিবাহের শুভলগ্ন স্থির করিলে, কুলকামিনীগণ মঙ্গল আচারে আরম্ভ করিল।



বিবাহের সমারোহ।
পয়ার।

সুবাহু নৃপের গৃহে অদ্ভুত ব্যাপার।
দেখিয়া অন্তর প্রীত হৈল সভাকার॥
অত্যাশ্চর্য্য সমারোহ হৈল মহা গোল।
নানা দেশ হৈতে জড় হৈল নানা ঢোল॥
জয়ঢাক তূরীভেরী সানাই বাজিল।
বাদ্যের শব্দেতে দেশ কাঁপিতে লাগিল॥
কোথা বাজে জগঝম্প কোথা আর বাঁশী।
বাজিল রোসন-চৌকি আর ঢোল কাঁসী॥
বাদ্যের ধ্বনিতে তালি কর্ণেতে লাগিল।
তার সঙ্গে নানা বাজী আরম্ভ হইল॥
তুবড়ি হাউই আর পট্‌কা পুড়িল।
ফাটে বোম বজ্র শব্দে দীপক জ্বলিল॥
রংমশাল ছুঁচবাজী তারা বাজী যত।
পুড়িল চোরকি আর ভেলা বাজী কত॥
হেতায় আসর দেখে মুগ্ধ নৃপগণ।
পরম আশ্চর্য্য শোভা করেছে ধারণ॥

শালের তাকিয়া শয্যা অপূর্ব্ব শোভিছে।
পুষ্পের ঝালর পাখা কত্তই দুলিছে॥
অশেষ প্রকার কান্তি মধ্যে মধ্যে তার।
মনলোভা পুষ্প তোড়া পুষ্প মাল্য আর॥
আসরের চতুর্দিকে সৌরভ ছুটিছে।
আতর গোলাপদান কতই শোভিছে॥
নিমন্ত্রীত নৃপগণ বসি দিব্যাসনে।
অশেষ কৌতুক করে প্রফুল্লত মনে॥
লণ্ঠন দেয়ালগিরি সেজ জ্বলে কত।
অগণন ঝড় জ্বলে তথায় নিয়ত॥
নানালোকে হৈল সেই সভা দীপ্তিমান।
হৈল সেই সভা ইন্দ্রসভাসম জ্ঞান॥
মধ্যে মধ্যে গাঁথা বেল গেঁদা পুষ্প মালা।
দূর হৈতে শোভা দেখে যত কুলবালা॥
তার মাঝে মাঝে ঝুলে ছবি শত শত।
ব্যজন করণে নিয়োজিত দাস যত॥
খ্যাম্‌টানাচ বাইনাচ আর নাচ কত।
হইতেছে সে সভার মধ্যে অবিরত॥
সুমধুর বাদ্য আর সুরস সঙ্গীত।
শুনিয়া নৃপতিসব হইল মোহিত॥

বসিল আসিয়া বর সে সভার মাঝে।
তারাগণ মধ্যে যেন মৃগাঙ্ক বিরাজে॥
কিছুক্ষণ পরে নৃপ সুবাহু আসিয়া।
বরকে বিবহিস্থানে গেলেন লইয়া॥
হইল সঙ্কল্প অগ্রে, পরে স্ত্রীআচার।
স্ত্রীগণ কৌতুক করে অশেষ প্রকারণ॥
শুভপরিণয় মন্ত্র ভূপতি বলিল।
তদপরে বীরজয়ে কন্যা সমর্পিল॥
নিরাপদে শুভকার্য্য হৈল সম্পাদন।
বাসর গৃহেতে বরে কৈল আনয়ন॥
অতঃপরে বর কন্যা যাত্র যত ছিল।
সারি সারি সকলেতে আহারে বসিল॥
খায় কত লুচি মালপুয়া আর পূরী।
জিলিপী হালুয়া গজা মিঠাই কচুরি॥
ক্ষীরশর ছানা বড় রসগোল্লা কত।
বর্ফি রসকরা আর মুণ্ডি শত শত॥
সন্দেশ গোলবি পেড়া বোঁদে খাজাআর।
সুরস সুমিষ্ট দ্রব্য কতই প্রকার॥
হৈল পরিতৃপ্ত নিমন্ত্রিত নৃপগণ।
ভদ্র কি ইতর সবে আনন্দিত মন॥

ধন্য ধন্য হৈল যশ সুবাহুরাজার।
জগত ব্যাপিত হৈল প্রশংসা তাঁহার॥




বাসর সজ্জা।
সমাক্ষরু চৌপদী।
হেতায় বাসর, গৃহ মনোহর শোভাপ্রীতকর,
করেছে ধারণ।
লাগে চমৎকার, হেরে শোভাতার, আশ্চর্য্যপ্রকার,
মুগ্ধ নরগণ॥
কুসুমে রচিত, খাট মনোনীত, করে আমোদিত
সৌরভে যাহার।
তাহে শোভমানা, ফুলের বিছানা, পুষ্প মালানানা,
উপরে উহার॥
মধ্যে মধ্যে তার, আতর আধার, পুষ্পতোড়া আর,
রহে স্থানে স্থানে।
স্বর্ণবাটাভরি, যতসহচরী, রাখে পান করি,
তার বিদ্যমানে॥
বসে তদুপর, সুরসিক বর, মূর্ত্তি মনোহর,
অনঙ্গের সম।

বামে সুনয়না, রাজার নলনা, রতির তুলনা,
ৰূপ মনোরম॥
যত সখীগণ, সুবেশ ধারণ, করয়ে ব্যঞ্জন,
পার্শ্বেতে দোঁহার।
যেন জ্ঞানহয়, মারুতমলয়, বহে সুধাময়
মধ্যে সে সভার॥
দেখে বর অঙ্গ,কেহ করে ব্যঙ্গ, গুবরে পতঙ্গ
কেন পদ্মবনে।
তখন নাগর, দিলেন উত্তর, ফিরিছে ভ্রমর
মধু অন্বেষণে॥
কুলনারী যত, ঠাট্টা অভিমত, করে কতশত,
একত্রে মিলিয়া।
কেহ গান করে, সুমধুরস্বরে, কেহ নৃত্য করে,
রসিকে বেড়িয়া॥
নিশাপতি অস্ত, দেখে হৈল ব্যস্ত, যুবতী সমস্ত,
যেতে স্বস্বালয়ে।
কুমদী মুদিল, ভ্রমর যুটিল, কমলে মিলিল,
সুখের আশয়ে॥
অতি সুকৌশলে, যুবতী সকলে, রসিকেরে বলে,
দাওহে বিদায়।

বলে নারীগণে, রায়ক্ষুব্ধমনে যাইবে কেমনে,
ছড়িয়ে আমায়॥
পেয়ে লাজ আতি, সকল যুবতী, তবে রায়প্রতি
কহিছে বিনয়ে।
বঞ্চিব কেমনে, তোমাসন্নিধানে, মোর নারীগণে,
পরাধীন হয়ে॥
নাগর তখন, মৌনাবলম্বন, করি কতক্ষণ,
রহে চিন্তামনে।
দুঃখিত অন্তরে, গেলত্বরাকরে, নিজ নিজ ঘরে,
কুলনারীগণে॥

কুলকামিনীগণ আপন আপন ভবনে গমন করাতে নবীনবর গতরাত্রের আমোদ ও কৌতুকাদি স্মরণ করিয়া দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইলেন। পরে কিছুকাল শ্বশুরালয়ে অবস্থিতি করেন। নরপতি সুবাহুর কেবল একমাত্র কন্যা থাকাতে তিনি জামতাকে রাজ্য দিয়া বাণপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বন করিলেন। বীরজয় সিংহাসনে আৰূঢ় হইলে পাত্র মন্ত্রীগণ তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদান করিলেন। অপরাপর প্রজাবৰ্গ নৃপতি বীরজয় সমীপে করষোড়ে দণ্ডায়মান রহিল। বীরজয় পাত্রমৈত্রগণের সহিত সদ্ভাব, ভৃত্যাগণের উপর স্নেহ, ও প্রজাদিগের মনোরঞ্জন করত কিছুকাল রাজত্ব করিতে লাগিলেন। তাঁহার নম্বতা, সুশীলতা, শিষ্টতা ও প্রজাবৎসল্যের যশ-সৌরভ দেশ বিদেশে বিস্তারিত হইল। বীরজয় এইৰূপে রাজত্ব করিতে করিতে তাঁহার প্রণয়িনীর গৰ্বে এক পরমসুন্দর পুত্র হইল, তাহার নাম রমণীমোহন। উপযুক্ত সময়ে সন্তানের বিদ্যাভ্যাস জন্য শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দিলেন। কিছুদিনপরে বীরজয়ের সুখান্বেষণে বাঞ্চা হইল এবং এই মনোরথ সফল জন্য পুনর্ব্বার দেশভ্রমণে প্রবৃত্ত হইলেন। নানা নদ নদী উপত্যকা ও পর্ব্বত উত্তীর্ণ হইয়া অবশেষে একজনাকীর্ণ নগরে পৌঁছিলেন। অনুমান করিলেন, এই নগর অতি প্রসস্থ, চতুর্দিকে পুষ্প ও ফল বৃক্ষ, মধ্যে মধ্যে নির্ম্মল পুষ্করিণী নানা মৎসের দ্বারা ব্যাপ্ত, সুগন্ধিত মলয়ানিল নিয়ত বহন হইতেছে এবং যত ধনীব্যক্তিদের বশতি, অতএব যথার্থ সুখ এই স্থানেই আছে। এই মনে করিয়া বীরজয় ছদ্মবেশ ধারণকরত সুখন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন।

বীরজয়ের সুখান্বেষণ।
পয়ায়

বীরজয় ছদ্মবেশ করিয়া ধারণ।
বহুস্থানে স্থানে করে সুখ অন্বেষণ॥
দেখিল ধনাঢ্য ব্যক্তি কত শত শত।
তাদের আবাস গৃহ ইমারত যত॥
দেখিতে সুন্দর অতি স্থূল কলেবর।
বোধ হয় সুখী তারা পৃথিবী ভিতর॥
কিন্তু তাঁহাদের সদা অন্তরে গরল।
পরের অহিত বাঞ্ছা করয়ে সকল॥
পরস্পর অর্থে তারা করে টানাটানি।
ভুলে কভু নাহি মুখে বলে সত্যবাণী॥
পরের ভূমিতে তারা সদা লোভ করে।
মোকর্দ্দমা প্রায় তাঁহাদের ঘরে ঘরে॥
প্রায় ঝুলে ওয়ারেণ্ট সকলের ঘাড়ে।
বাবুদের অত্যাচার দিনে দিনে বাড়ে॥
নাহি দেখাযায় সুখ তাঁহাদের মনে।
সর্ব্বদা চিন্তিত পরঅহিতাচরণে॥
যদি গৃহস্তের বধূ দেখেন সুন্দরী।
অমনি হরিতে চেষ্টা করে ত্বরা করি॥

পুরের যুবতী কন্যা হেরিলে নয়নে।
কুপথে আনিতে তারে বাঞ্ছে মনে মনে॥
অর্থ প্রভাবেতে যাহা ইচ্ছা তাহা করে।
করিছে কুকাজ ইহা ভবেনা অন্তরে॥
স্বস্বস্ত্রী থাকিতে তারা তাদেরে রর্জিয়া।
বেশ্যালয়ে যায় সদা আমোদ ইচ্ছিয়া॥
মদ্যপান গাঞ্জা আর চরস প্রভৃতি।
হইয়াছে তাঁহাদের নিয়মিত বৃতি॥
করে কত ঢলা ঢলি নিজ ঘরে ঘরে।
কত মারামারি ঠেলা ঠেলি পরস্পরে॥
ধর্ম্মভয় নাহি রয় তাদের অন্তরে।
অশেষ কুকার্য্য করে নাহি মনে ডরে॥
অসুখেতে কাল তারা যাপন করয়।
বাজির্ঝক দৃশ্যেতে যেন সুখী বোধ হয়॥


বীরজয় সুখান্বেষণ করত অত্যন্ত হতাস হইয়া সে নগর পরিত্যাগ করিলেন। পথি মধ্যে যাইতে যাইতে সূর্য্যের কিরণ ক্রমশ প্রখর হইতে লাগিল। নৃপতি সমীপবর্ত্তী এক মনোহর উদ্যানে প্রবেশ করিলেন। উক্ত উদ্যান নানা ফলবৃক্ষের দ্বারা বেষ্ঠিত; অম্ব গোলাবজাম ও খর্জ্জুরাদি নানা ফল বৃক্ষশাখায় পক্ক হইয়া রহিয়াছে। কোন ব্যক্তিকে না দেখিতে পাইয়া নৃপতি চিন্তিত হইলেন। পরে অত্যন্ত ক্ষুধান্বিত হওয়াতে বৃক্ষ হইতে ফল আহরণ করিয়া ক্ষুধাশান্তি করিলেন। ক্ষণকাল বিশ্রাম লইয়া সে স্থান ত্যাগ করিলেন। তদনন্তর এক গ্রামে উপনীত হইয়া দেখিলেন উক্ত গ্রামে যতদীন দুঃখিদিগের বশতি এবং সর্ব্বদা দুঃখের শব্দই শুনা যাইতেছে। নৃপতি স্তব্ধ হইয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

বীর জয়ের পুনঃ সুখান্বেষণ।

নরপতি বীরজয় ছদ্ম বেশ ধরে।
করে সুখ অন্বেষণ সে গ্রামে ভিতরে॥
কোন স্থানে নাহি পায় সেই নিত্যসুখ।
যথা যায় তথা হেরে দরিদ্রের দুঃখ॥
সেই নগরেতে যত দীন বাস করে।
সবে করে হাহাকার উদরান্ন তরে॥
নাহি পায় খেতে কেহ নাপায় পরিতে।
কেহ বল শূন্য হয়ে না পারে নড়িতে॥

অসময়ে মরে তাহাদের মধ্যে কত॥
গড়াগড়ি যায় মাথা কতই নিয়ত।
হইয়া আশ্রয় হীন রহে কতজন।
বর্ষাশীত ক্লেশ তারা ভোগে অনুক্ষণ॥
সদা রোদনের ধনি হতেছে তথায়।
সে দুঃখ দেখিয়া কেহ নাহি ফিরেচায়।
কারমা কাঁদিছে নিজ পুত্র নাম ধরে।
কেহ উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে সহোদর তরে॥
কেহবা স্বামীর জন্যে করিছে রোদন।
হতেছে এৰূপ সে নগরে অনুক্ষণ॥
দেখিয়া ব্যাপার বীরজয় ভাবে মনে।
যথা যাই তথা হেরি এৰূপ নয়নে॥
নাহি পাই নিত্যসুখ এজগতে আর।
বুঝিলাম এত দিনে সকলি আসার॥

অনিত্য সংসার।

জগতের যত বস্তু সকলি অসার।
কৃত্রিম মায়াতে বদ্ধ অনিত্য সংসার॥
যাহেরি নয়নে বলি আমার আমার।
ভাবিয়া দেখিলে কিছু নহে আপনার॥
দুদিনের লীলা মাত্র শীঘ্র ফুরাইবে।
দুইদিন, গত হলে আর না রহিবে॥
পড়িলে কালের হস্তে সব দূরে যাবে।
আত্ম বন্ধুগণ কেহ নাহি দেখা পাবে॥
তখন কোথায় মাতা পিতা ভ্রাতা রবে।
সুখে সুখী দুঃখে দুঃখি আর নাহি হবে॥
কালের কিঙ্কর যবে পড়িবে আসিয়া।
তখনি যাইতে হবে সকলি ফেলিয়া॥
কোথাগাড়ী পাল্কি ঘোড়া থাকিবে পড়িয়া।
কে করিবে বাবুআনা যুড়িতে চড়িয়া॥
কে আর বেড়াবে লম্বা কোঁচা দোলাইয়া।
গোটুহেল কে বলিবে ঘড়ি ট্যাঁকে দিয়া॥
আসিলে সে যমদূত রজ্জু হস্তে করে।
গলে ফাঁস দিয়া লৈয়ে যাবে সবনরে॥

কোথারবে যুবা বৃদ্ধ কোথারবে ক্ষীণ।
কোথায় স্বাধীন রবে কোথা পরাধীন॥
খঞ্জ অন্ধ বধিরাদি কোথায় থাকিবে।
একে একে যমগৃহে যাইতে হইবে॥
অতএব বলি মন ধরহ বচন।
নিরন্তর ভাব সেই নিত্য নিরঞ্জন॥
পাবে মোক্ষ পদ চিন্তা না রহিবে আর।
অনায়াসে হবে পার এভব সংসার॥

 বীরজয় জগতের অনিত্যতা সম্পূর্ণৰূপে জ্ঞাত হইয়া সর্ণাট রাজ্যে প্রত্যাগমন করিলেন। কিছু দিবস তথায় কালযাপন করিলে পিতামাতাকে স্মরণ হইল। বীরজয় অশ্বগজদি সমভিব্যাহরে লইয়া মাতা পিতা ও ভ্রাতাদিকে আনয়ন করিতে গান্ধার দেশে যাত্রা করিলেন। কতক দুর যাইতে যাইতে অনতিদূরে এক তপোবন দেখিলেন। নৃপতি অনুভব করিলেন এই তপোবনে আমার ঋষি মৈত্র অবস্থিতি করেন অতএব উহার সহিত ত্বরায় সাক্ষাত করিতে হইবেক। এই ভাবিয়া তপোবনে গমন করত বন্ধুর সহিত দেখা করিলেন। ঋষিসুত বহুদিনের পর পরম সখী বীরজয়কে পাইয়। আনন্দমাগঢ় মগ্ন হইলেন। বীরজয় মৈত্রকে আপন সঙ্গে লইয়া স্বদেশে গমন করিলেন। তদনন্তর গ্রামে পৌঁছিয়া প্রজাদিগের প্রমুখাৎ বাটীর কুশলাদি শ্রবণ করিয়া বাটীতে প্রবেশ করিলেন। রাজা রমাপতি বহুদিবসের পর পুত্র বীরজয়কে দর্শন করিয়া মুখচুম্বন করত ক্রোড়ে বসাইলেন। পরে পুত্র নানাদেশ পরিভ্রমণ করিয়া বিবাহ ইত্যাদি যে সকল অদ্ভুত ব্যাপার সম্পাদন করিয়াছে তাহা শ্রবণ করিয়া রমাপতি আনন্দে মগ্ন হইলেন। কিছু দিনান্তে বীরজয় মাতা পিতা ও বন্ধুগণাদিকে সর্ণাট দেশে লইয়া গেল। তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তমা প্রেয়সী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছে। তখন শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া নানাবিধ বিলাপ করিতে লাগিলেন।

নৃপতি বীরজয়ের বিলাপ।
হ্রস্ব ত্রিপদী।
বারিদুনয়নে, বহে ঘনে ঘনে,
শুনেমৃত্যু প্রেয়সীর।

প্রিয়েকে তখন, করি সম্বোধন,
বলে নৃপতি সুধীর॥
কিদোষ পাইয়া, আমারে ত্যজিয়া,
কোথায় রহিলে প্রাণ।
বারেক আসিয়া, মোরে দেখদিয়া,
জুড়াও তাপিত প্রাণ॥
নাহেরে তোমায়, মুখশশী আর,
বিদারছে মম প্রাণ।
কেমনে এপ্রাণ, ধরিব হে প্রাণ,
বিহীনে তোমার প্রাণ॥
তোমার সে অঙ্গ, সুহাস্য সুরঙ্গ,
কোথায় এখন প্রিয়ে।
নাহি হেরি তার, একি অবিচার,
রাখ প্রাণ দেখাদিয়ে॥
কোথায় এখন, সেৰূপমোহন,
বল মোর সন্নিধানে।
কোথায় যাইব, কিৰূপে পাইব,
প্রাণপ্রিয়ে তোমাধনে॥
একাকী কেমনে, বঞ্চিব ভবনে,
ছেড়ে তব রসরঙ্গ।

না হয় নির্ব্বাণ, জ্বলিছে এ প্রা্ণ,
বিনে তব সুখসঙ্গ॥
হায় হায় হয়, কি করি উপায়,
এদুঃখ কহিব কারে।
কখন কি মনে, জীবন বিহীনে,
জীবন ধরিতে পারে॥
কেন ওরে প্রাণ, কর অবস্থান,
এখন দেহেতে আর।
যাতনা সহেনা, প্রবোধ মানেনা,
এ পোড় প্রাণে আমার॥
ভার্য্যার কারণে, করি খেদ মনে,
মহামতী বীরজয়।
পুত্রে রাজ্য দিল, বৈরাগ্য হইল,
ত্যজ্য করি নিজালয়।

বৈরাগ্য অবলম্বন পূর্ব্বক বীরজয়ের বন প্রস্থান।
পয়ার।

ভস্মমাখি বীরজয় চলিলেন বনে।
বৈরাগ্য বিষয় কিছু বলিছেন মনে॥

মায়ায় হইছে সৃষ্টিস্থিতি আর লয়।
পুনঃপুনঃ হইতেছে জীবের উদয়॥
মায়াতেমোহিত এই সংসার সকল।
মায়ার বসেতে জীব হয়েছে সকল॥
মায়ার নির্ম্মিত যদি হইল সংসার।
তবে আর ইথেবল আছে কিবা সার॥
যোগাসনে বসে স্থিতি কর দেখি মন।
চিন্তা কর চিন্তামনি মুদিয়া নয়ন॥
জীব আত্মা পরমাত্মা উভয় মিলনে।
প্রলয় কররে মন বসি যোগাসনে॥
সংসারে অনিত্য সুখ শুন ওরে মন।
নিত্য সুখ কর ভোগ ভাবি নিরঞ্জন॥
চল চল চল মন করিগে সন্ন্যাস।
ত্যাজিয়া বিষয় বন করি বন বাস॥
ঈশ্বরের পদে এসে সঁপি কর্ম্মফল।
হউক সফল আর হউক বিফল॥
আঁখিমুদি ঈশ্বরের নাম শাখী পরে।
পাখি হয়ে এস মন থাকি বাস করে॥
সদা সুখসুধাফল ভক্ষণ করিবে।
অবহেলে মুক্তপক্ষে স্বৰ্গেতে যাইবে॥

আশাশূন্য এইবার হও দেখি মন।
সুদ্ধ আশা কর ওরে সেই শ্রীচরণ॥
মুক্তি পাবে কিম্বা পরে হবে স্বৰ্গবাস
করনা করনা কভু হেন মনে আশ॥
কি ফল ফলিবে পরে ভেবনাক কভু।
তাহাই হইবে যাহা করিবেন প্রভু॥
ঋপুগণে করি বস কর দেখি দাস।
ধর্ম্মক্ষেত্রে পুণ্য বীজ কর দেখি চাস॥
সব হরি হরি হরি বল বলে মন।
ভজ ভজ মজ মজি সাজরে এখন॥
জপকর করে করে নিরাকার নাম।
জয় জয় জনার্দ্দন জয় জয় রাম॥
নমঃ নামঃ নারায়ণ নিত্য নিরঞ্জন।
জয় জয় জগদীশ সত্য সনাতন॥
এইৰূপে বীরজয় গিয়াতপোবনে।
পরাৎপর পরমাত্মা ভাবে মনে মনে॥


রাগিণী বাহার তাল আড়াঠেকা।

ভাবরে ভাবরে মন সেই নিত্য নিরঞ্জন।
সংসার বাসনা করে একবারে নিরঞ্জন॥
যিনি আদি নিরাকার, সর্ব্বব্যাপী নির্ব্বিকার,
অখিল সংসার যার, কৃপাতে হল সৃজন॥
যিনি পুরুষ প্রধান, পরম ব্রহ্ম সনাতন,
আছে যাতে বিরাজিত, সত্ব রজ তমগুণ॥


রাগিণী মূলতান তাল আড়াঠেকা।

কেনরে মন নিরন্তর ভাবন সেই পরাৎপরে।
আপন আপন করি, কেন ভ্রম এসংসারে॥
কেহ নহেরে আপন, যে ভাব ভাব এখন,
বিনে সেই সনাতন, কে আর তরাতে পারে॥
দেখরে মন মনে ভাবি, দারা পুত্র বান্ধবাদি,
কেহ নাহি সঙ্গে যাবে, অন্তকাল হলে পরে॥
তাই বলি ওরে মন, বিনে সেই নারায়ণ,
অনিত্য এসব দেখ, মনে বিবেচনা করে॥


রাগিণী বেহাগ তাল আড়াঠেকা।

বৃথা কায়া নিয়ে তবে এত গর্ব্ব কি কারণ।
অচিরে নিধন হবে শুন ওরে মৃঢ় মন॥
দেহেতে লাবণ্য শোভা, ক্ষণমাত্র মনলোভা,
ঢল ঢল করে অপ, কমল দলে যেমন॥
এই বেলা সাধনা কর, সেই ব্রহ্ম সরাৎসার,
নতুবা নাহি নিস্তার, যবে আসিবে শমন॥


রাগিণী পুরবী তাল আড়াঠেকা

মিছে কেন ভ্রম মন বিষম বিষয় বনে।
নাহি পাবে অন্য ফল খুঁজিলে অতি যতনে।
শুদ্ধমাত্র সুধাফল, সেইন্দ্রিয় সুখফল,
কিন্তু অন্তরে গরল, সুধাখেরে আস্বাদনে॥
তাই বলি শুনরে মন, ত্যজিয়া বিষয় বন,
জপ সেই নিত্যধন, সদগতি হবে মরণে॥


রাগিণী ভৈরবী, তাল আড়াঠেকা।

সদা সত্যাশ্রয় কর ওরে মূঢ় মন আমার।
শুদ্ধচারী হয়ে ভজ জগদীশ নিরন্তর॥
ষড় ঋপু পরিহরি, করজপ হরিহরি,
যিনি ভবের কাণ্ডারী, বিনে যিনি নাহি পার॥
যিনি হর্ত্তা কর্ত্তা ধাতা, জীবের জীবন দাতা,
দীপ্তিমান অবনীতে, অসামান্য কীর্ত্তি যার॥


সমাপ্ত।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।