বীরবলের হালখাতা/হালখাতা
বীরবলের হালখাতা
হালখাতা
আজ পয়লা বৈশাখ। নূতন বৎসরের প্রথম দিন অপর দেশের অপর জাতের পক্ষে আনন্দ-উৎসবের দিন। কিন্তু আমরা সেদিন চিনি শুধু হালখাতায়। বছরকার দিনে আমরা গত বৎসরের দেনাপাওনা লাভলোকসানের হিসেবনিকেশ করি, নূতন খাতা খুলি, এবং তার প্রথম পাতায় পুরনো খাতার জের টেনে আনি।
বৎসরের পর বৎসর যায়, আবার বৎসর আসে; কিন্তু আমাদের নূতন খাতায় কিছু নূতন লাভের কথা থাকে না। আমরা এক হালখাতা থেকে আর-এক হালখাতায় শুধু লোকসানের ঘরটা বাড়িয়ে চলেছি। এভাবে আর কিছুদিন চললে যে আমাদের জাতকে দেউলে হতে হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। লাভেব দিকে শূন্য ও লোকসানের দিকে অঙ্ক ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে, তবে আমরা ব্যাবসা গুটিয়ে নিই নে কেন। কারণ ভবের হাটে দোকানপাট কেউ স্বেচ্ছায় তোলে না, তার উপর আবার আশা আছে। লোকে বলে, আশা না মলে যায় না।
আমরা স্বজাতি সম্বন্ধে যে একেবায়েই উদাসীন, তা নয়। গেল বৎসর, জাতিহিসেবে কায়স্ত বড়ো কি বৈদ্য বড়ো এই নিয়ে একটা তর্ক ওঠে। যেহেতু আমরা অপরের তুলনায় সকল হিসেবেই ছোটো, সেইজন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে কে ছোটো কে বড়ো এ নিয়ে বিবাদবিসম্বাদ করা ছাড়া আর উপায় নেই। নিজেকে বড়ো বলে পরিচয় দেবার মায়া আমরা ছাড়তে পারি নে। কায়স্থ বলেন, আমি বড়ো; বৈদ্য বলেন, আমি বড়ো। শাস্ত্রে যখন নানা মুনির নানা মত, তখন সূক্ষ্ম বিচার করে এ বিষয়ে ঠিকটা সাব্যস্ত করা প্রায় অসম্ভব। বৈদ্যের ব্যবসায় চিকিৎসা - প্রাণরক্ষা করা; ক্ষত্রিয়ের ব্যবসায় প্রাণবধ করা। অতএব ক্ষত্রিয় নিঃসন্দেহ বৈদ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সুতরাং বৈদ্য অপেক্ষা বড়ো হতে গেলে ক্ষত্রিয় হওয়া আবশ্যক, এই মনে করে জনকতক কায়স্থ-সমাজের দলপতি ক্ষত্রিয় হবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। এ শুভ সংবাদ শুনে আমি একটু বিশেষ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলুম।
কারণ, প্রথমত আমি উন্নতির পক্ষপাতী; কোনো লোকবিশেষ কিংবা জাতিবিশেষ আপন চেষ্টায় আপনার অবস্থার উন্নতি করতে উদ্যোগী হয়েছে দেখলে কিংবা শুনলে খুশি হওয়া আমার পক্ষে স্বাভাবিক। বিশেষত বাংলার পক্ষে যখন জিনিসটে এতটা নূতন। নৃতনের প্রতি মন কার না যায়, অন্তত দুদণ্ডের জন্যও। অবনতির জন্য কাউকেই আয়াস করতে হয় না। ও একটু ঢ়িলে দিলে আপনা হতেই হয়। জড়পদার্থের প্রধান লক্ষণ নিশ্চেষ্টতা, আর জড়পদার্থের প্রধান ধর্ম অধোগতি- গ্র্যাভিটেশন। সম্প্রতি প্রোফেসর জে. সি. বোস, শুনতে পাই, বৈজ্ঞানিকসমাজে প্রমাণ করেছেন যে, জড়ে ও জীবে আমাদের ভেদজ্ঞান শুধু ভ্রান্তিমাত্র। সে ভ্রান্তির মূল আমাদের চর্মচক্ষুর স্থূলদৃষ্টি। তিনি ইলেকট্রিসিটির আলোকের সাহায্যে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, অবস্থা অনুসারে জড়পদার্থের ভাবভঙ্গি ঠিক সজীব পদার্থের অনুরূপ। প্রোফেসর বোস নিজে বলেন যে, ভারতবাসীর পক্ষে এ কিছু নতুন সত্য বা তথ্য নয়; এ সত্য আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে বহুপূর্বে ধরা পড়েছিল, তাদের দিব্য চক্ষু এড়িয়ে যেতে পারে নি; এক কথায় এটা আমাদের খানদানী সত্য। আমি বলি, তার আর সন্দেহ কী। এ সত্যের প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানের সাহায্যও আবশ্যক নয়, এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছেও যাবার দরকার নেই। আমরা প্রতিদিনের সমগ্র জীবনের কাজে নিত্য প্রমাণ দিচ্ছি যে, আমাদের দেশে জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। সুতরাং কেউ যদি কার্যত ওর উলটোটা প্রমাণ করতে উদ্যত হয়, তা হলে নূতন জীবনের স্মৃতির একটু আভাস পাওয়া যায়।
আমাদের বাঙালিজাতির চিরলজ্জার কথা, আমাদের দেশে ক্ষত্রিয় নেই। এর জন্য আমরা অপর বীরজাতির ধিক্কার লাঞ্ছনা গঞ্জনা চিরকাল নীরবে সহ্য করে আসছি। ঘোষ বোস মিত্র দে দত্ত গুহ প্রভৃতিরা যে আমাদের এই চিরদিনের লজ্জা দূর, এই চিরদিনের অভাব মোচন করবার জন্য কোমর বেঁধেছিলেন, তার জন্য তারা স্বদেশহিতৈষী ও স্বজাতিপ্রিয় লোকমাত্রেরই কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। দুঃখের বিষয় এই যে, কায়স্থের ক্ষত্রিয় হবার জন্য ঠিক পথটা অবলম্বন করেন নি, কাজেই অকৃতকার্য হয়েছেন। তাদের প্রথম ভুল, শাস্ত্রের প্রমাণের উপর নির্ভর করতে যাওয়া। কী ছিলুম সেইটে স্থির করতে হলে পুরনো পাজিপুঁথি খুলে বসা আবশ্যক, কিন্তু কী হব তা স্থির করতে হলে ইতিহাসের সাহায্য অনাবশ্যক। ভবিষ্যতের বিষয় অতীত কী সাক্ষি দেবে? বিশেষত বিষয়টা হচ্ছে যখন ক্ষত্রিয় হওয়া, তখন গায়ের জোরই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের এমনি অভ্যাস খারাপ হয়েছে যে, আমরা শাস্ত্রেৱ দোহাই না দিয়ে একপদ ও অগ্রসর হতে পারি নে।
পৃথিবীতে মানুষের উপর মানুষ অত্যাচার করবার জন্য দুটি মারাত্মক জিনিসের সৃষ্টি করেছে, অস্ত্রশস্ত্র ও শাস্ত্র। আমবা অন্যন্ত নিরীহ, কারো সঙ্গে মুখে ছাড়া ঝগড়াবিবাদ করি নে, যেখানে লড়াই হচ্ছে সে পাড়া দিয়ে হাঁটি নে— এই উপায়ে যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রকে বেবাক ফাঁকি দিয়েছি। যা-কিছু বাকি আছে ডাক্তারের হাতে। আমরা চিররুগ্ণ, সুতরাং ডাক্তারকে ছেড়ে আমরা ঘর করতে পারি নে — এই উভয় সংকটে আমরা হোমিয়োপ্যাথি ও কবিরাজির শরণাপন্ন হয়ে সে অস্ত্রশস্ত্রেরও সংস্পর্শ এড়িয়েছি। আমাদের যখন এত বুদ্ধি, তখন শাস্ত্রের হাত থেকে উদ্ধার পাই, এমন কি কিছু উপায় বার করতে পারি নে?কিন্তু ক্ষত্রিয় হওয়া কায়স্থের কপালে ঘটল না। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব একে কায়ন্থের দলপতি, তার উপর আবার গোষ্ঠীপতি, সুতরাং তিনি যখন এ ব্যাপারে বিরোধী হলেন তখন অপর পক্ষ ভয়ে নিরস্ত হলেন। যাঁরা ক্ষত্রিয় হতে উদ্যত, তাঁদের ভয় জিনিসটে যে আগে হতেই ত্যাগ করা নিতান্ত আবশ্যক, এ কথা বোঝা উচিত ছিল। ভীরুতা ও ক্ষাত্রধর্ম যে একসঙ্গে থাকতে পারে না, এ কথা বোধ হয় তারা অবগত ছিলেন না। তবে হয়তো মনে করেছিলেন, যখন মুর্খ ব্রাহ্মণে দেশ ছেয়ে গেছে, তখন ভীরু ক্ষত্রিয়ে আপত্তি কী। জড়পদার্থেরও একটা অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, তার কার্য হচ্ছে চলৎশক্তি রহিত করা। আমাদের সমাজকে যে নাড়ানো যায় না তার কারণ এই জড়শক্তিই আমাদের সমাজে সর্বজয়ী শক্তি।
রাজা বিনয়কৃষ্ণ যে কায়স্থ-সমাজের সংস্কারের উদ্যোগে বাধা দিয়েছেন শুধু তাই নয়, তিনি এবার সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয় সমাজসংস্কার-মহাসভার সভাপতির আসন থেকে এই মত ব্যক্তি করেছেন যে, হিন্দুসমাজে অনেক দোষ থাকতে পারে, এবং সে দোষ না থাকলে সমাজের উপকার হতে পারে, অতএব সমাজসংস্কারের চেষ্টা করা অকর্তব্য। সমাজের সৃষ্টি ও গঠন হয়েছে অতীতে, সুতরাং তার সংস্কার ও পরিবর্তন হবে ভবিষ্যতে; বর্তমানের কোনো কর্তব্য নেই, কোনো দায়িত্ব নেই। সমাজ গড়ে মানুষে, ইচ্ছে করলে ভাঙতে পারে মানুষে; অতএব মানুষে তার সংস্কার করতে পারে না, সে ভার সময়ের হাতে, অন্ধ প্রকৃতির হাতে। এ মত যে অস্বীকার করে, সে বার্ক পড়ে নি।
আজকাল একশ্রেণীর লোক আছেন যাঁরা সমাজের অবস্থা, দেশের অবস্থা, নিজেদের অবস্থা এই-সব বিষয়েই একটু-আধটু চিন্তা করে থাকেন এবং শেষে এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হন যে, সাবধানের মার নেই। এরা সব জিনিসই ধীরেসুস্থে ঠাণ্ডাভাবে করবার পক্ষপাতী। এঁরা রোখ্ করে সুমুখে এগুতে চান না বলে কেউ যেন মনে না ভাবেন যে এঁরা পিছনে ফিরতে চান। যেখানে আছি সেখানে থাকাই এরা বুদ্ধির কাজ মনে করেন। বরং একটু অগ্রসর হওয়াই এরা অনুমোদন করেন, কিন্তু সে বড়ো আস্তে, বড়ো সন্তর্পণে। যে হাড়বাঙালিভাব অধিকাংশ লোকের ভিতর অব্যক্তভাবে আছে, এঁরা কেউ কেউ পরিষ্কার সুন্দর ইংরেজিতে তা ব্যক্ত করেন। সংক্ষেপে এঁদের বক্তব্য এই যে, জীবনের গাধাবোট উন্নতির ক্ষীণ স্রোতে ভাসাও, সে একটু-একটু করে অগ্রসর হবে, যদিচ চোখে দেখতে মনে হবে চলছে না। কিন্তু খবরদার, লগি মেরো না, দাঁড় ফেলো না, গুণ টেনো না, পাল খাটিয়ো না— শুধু চুপটি করে হালটি ধরে বসে থেকো। এই মতের নাম হচ্ছে বিজ্ঞতা। বিজ্ঞতার আমাদের দেশে বড়ো আদর, বড়ো মান্য। গাধাবোট চলে না দেখে লোকে মনে করে না-জানি তাতে কত অগাধ মাল বোঝাই আছে।
বিজ্ঞতা-জিনিসটে আমাদের বর্তমান অবস্থার একটা ফল মাত্র। এ অবস্থাকে ইংরেজিতে বলে transition period, অর্থাৎ এখন আমাদের জাতির বয়ঃসন্ধি উপস্থিত। বিদ্যাপতি ঠাকুর বয়ঃসন্ধির এই ব’লে বর্ণনা করেছেন যে 'লখইতে না পার জেঠ কি কনেঠ’— এ জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ চেনা যায় না। কাজেই আমরা কাজে ও কথায় পরিচয় দিই হয় ছেলেমির, নয় জ্যাঠামির, নাহয় একসঙ্গে দুয়ের। এই জ্যাঠাছেলের ভাবটা আমাদের বিশেষ মনঃপূত। ছোটোছেলের দুরন্ত ভাব আমরা মোটেই ভালোবাসি নে। তার মুখে পাক-পাক কথা শোনাই আমাদের পছন্দসই। এই জ্যাঠামিরই ভদ্র নাম বিজ্ঞতা।
ধরাকে সরা জ্ঞান করা আমরা সকলেই উপহাসের বিষয় মনে করি, কিন্তু সরাকে ধরা জ্ঞান করা আমাদের কাছে একটা মহৎ জিনিস। কারণ ও মনোভাবটি না থাকলে বিজ্ঞ হওয়া যায় না। বার্ক French Revolution-রূপ বিপুল রাজ্যবিপ্লবের সমালোচনাসূত্রে যে মতামত ব্যক্তি করেছেন, সেই মতামত বাল্যবিধবাকে জোর করে বিধবা রাখবার সপক্ষে ও কৌলীন্য প্রথা বজায় রাখবার সপক্ষে প্রয়োগ করলে যে আর-পাঁচজনের হাসি পাবে না কেন, তা বুঝতে পারি নে।
আমাদের সমাজ ও সামাজিক নিয়ম বহুকাল হতে চলে আসছে, আচারে ব্যবহারে আমরা অভ্যাসের দাস। আমাদের শিক্ষা নূতন, সে শিক্ষায় আমাদের মনের বদল হয়েছে। আমাদের সামাজিক ব্যবহারে ও আমাদের মনের ভাবে মিল নেই। যাঁরা, মনকে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ বলে বিশ্বাস করেন, তাদের সহজেই ইচ্ছা হয় যে ব্যবহার মনের অনুরূপ করে আনি। অপর পক্ষে যাঁরা দুর্বল ভীরু ও অক্ষম অথচ বুদ্ধিমান, তাঁরা চেষ্টা করেন তর্কযুক্তির সাহায্যে মনকে ব্যবহারের অনুরূপ করে আনি। এই উদ্দেশ্যে যে তর্কযুক্তি খুঁজেপেতে বার করা হয়, তারই নাম বিজ্ঞভাব। আমরা বাঙালিজাতি সহজেই দুর্বল ভীরু ও অক্ষম, সুতরাং স্বভাবের বলে আমরা না ভেবেচিন্তে বিজ্ঞের পদানত হই— এই হচ্ছে সার কথা।
বৈশাখ ১৩০৯