বুড়ো আংলা/চকা-নিকোবর
চকা-নিকোবর
সুবচনীর খোঁড়া হাঁস এই সব বুনো-হাঁসদের দলে ভিড়ে উড়তে, আর এ-গ্রামের সে-গ্রামের সব সরাল, ঘেংরালদের দেখে হাসি-মস্করা করতে পেয়ে, ভারি খুশি হয়েছে। সে ভুলে গেছে যে নিজেই সে এত-কাল পালা-হাঁসই ছিল—ঐ সরাল-ঘেংরালের মতো ঘর আর পুকুর করে কাটিয়েছে। তার উপর সে আজন্ম-খোঁড়া, সবে আজ নূতন উড়ছে। বুনো হাঁসের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে চলা তার কর্ম নয়! খোঁড়ার ডানার তেজ ক্রমেই কমছে আর দমও ক্রমে ফুরিয়ে আসছে, সে হাঁপাতে-হাঁপাতে তাড়াতাড়ি ডানা ঝাপটেও আর পেরে উঠছে না মধ্যে থেকে এক-এক-করে প্রায় আটহাঁস পিছিয়ে পড়েছে। সেথো হাঁসরা যখন দেখলে খোঁড়া পিছিয়ে পড়ে, আর পারে না, তখন পাণ্ডা-হাঁসকে ডাক দিয়ে জানালে—“চকা-নিকোবর, চকা-নিকোবর!”
চকা উড়তে-উড়তেই শুধোলে—“ক্যেঁন্-ক্যেঁন্ কও ক্যেঁন্?”
সেথোরা বললে—“পিছিয়ে পোলো খোঁড়া-ঠ্যাং!”
আগের মতো সোঁ-সোঁ করে চলতে-চলতেই চকা বলে উঠল— জোরে চলায় নাই কোনো দায়,
আস্তে গেলেই হাঁপ লেগে যায়!
অমনি সব হাঁস একসঙ্গে বলে উঠল—“চলে চল, চলে চল, ভাই, চলে চল।”
চকার কথা-মাফিক খোঁড়া হাঁস জোরে চলতে চেষ্টা করতে দুগুণ হাঁপিয়ে পড়ল; আর সে আস্তে-আস্তে ক্রমে মাঠের ধারে-ধারে নারকোল গাছের প্রায় মাথা পর্যন্ত নেমে পড়বার মতো হল। তখন সেথো হাঁসরা আবার ডাক দিলে—“চকা-নিকোবর—চকা-চকা-চকা!”
এবার চকা গরম হয়ে বললে—“ক্যেঁন্ কর ভ্যেঁন ভ্যেঁন?”
সেথোরা বলে উঠল—“খোঁড়া হাঁস তলিয়ে যায়!”
চকা একবার চেয়েও দেখলে না, যেমন বেগে চলেছিল তেমনি পুরো দমে যেতে-যেতে বললে—“বল ওকে হাল্কা হাওয়ায় উঠে আসতে।”
নিচের বাতাস ঠেলা মুশকিল,
ডানা নেড়ে-নেড়ে লাগে ঘাড়ে খিল।
উপর বাতাস পাতলা ভারি,
এক ঝাপটে বিশ হাত মারি।
খোঁড়া হাঁস চকার কথায় উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল; কিন্তু এবার বাতাস ঠেলে উঠতে বেচারার দম নিকলে যাবার যোগাড় হল।
আবার সেথোরা ডাক দিলে—“চকা! চকা!”
“কেনে? চলতে দিবে না নাকি!”—বলে চকা গোঁ হয়ে উড়ে চলল।
সেথোরা বললে—“খোঁড়া-বেচারার প্রাণসংশয়!”
চকা রেগে উত্তর দিলে— উড়তে না পারে ঘরে যাক,
খাক-দাক বসে থাক।
কে বলেছে উড়তে ওরে,
ভিড়তে দলে রঙ্গ করে?
খোঁড়া হাঁসের জানতে বাকি রইল না যে বুনো হাঁসরা কেবল তামাশা দেখবার জন্যে তাকে এতটা সঙ্গে এনেছে—মানস-সরোবরে নিয়ে যেতে নয়। আঃ কি আপশোষ! ডানা যে তার আর চলছে না! না হলে খোঁড়া হাঁসও যে উড়তে পারে, সেটা একবার বুনো হাঁসদের সে দেখিয়ে দিত। তা ছাড়া এই চকা-নিকোবর—এমন হাঁস নেই যে একে জানে না; এই একশো বছরের বুড়ো হাঁস, যার সঙ্গে পয়লানম্বর হাঁসও উড়ে পেরে ওঠে না, পড়বি তো পড় তারি পাল্লায়! যে চকা পোষা হাঁসকে হাঁসের মধ্যেই ধরে না, লজ্জা পেতে হল কিনা তারি সামনে! এ দুঃখু সে রাখবে কোথায়!
খোঁড়া সবার পিছনে ভাবতে-ভাবতে চলল—বাড়ি ফিরবে, কি, প্রাণ যায় তবু সমানে বুনো হাঁসের সঙ্গে চলে সে দেখিয়ে দেবে যে সেও জানে উড়তে! রিদয় এই সময় খোঁড়াকে বললে—“সুবচনীর কৃপায় এতদূর এসেছ, আর কেন? এইবার ফের। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে শেষে দম-ফেটে মরবে নাকি! আমি তো ওদের মতলব ভালো বুঝছিনে!”
রিদয় কিছু না বললে, হয়তো খোঁড়া আপনা-হতেই বাড়ি-মুখো হত; কিন্তু এই বুড়ো-আংলা, এও ভাবছে তাকে কমজোর! খোঁড়া বিষম রেগে ধমকে উঠল—“ফের কথা কইলে মাটিতে ঝেড়ে-ফেলে চলে যাব।” বলেই রেগে ডানা আপসে খোড়া এমনি তেজে উড়ে চলল যে বুনো হাঁসরাও একেবারে অবাক হয়ে গেল। রাগের মুখে গোঁ-ভরে যেমন তেজে খোঁড়া চলেছিল, রাগ পড়লে সে তেজ থাকত কিনা সন্দেহ। কিন্তু ঠিক সেই সময় সূর্য পাটে বসতে চললেন। দেখতে-দেখতে বেলা পড়ে এল। অমনি হাঁসরা সবাই জমি-মুখো হয়ে ঝুপ-ঝাপ আকাশ থেকে চাঁদপুরের সামনে মেঘনার মাঝে বাগদী চরে নেমে পড়ল। চরে উড়ে বসতেই রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ল।
তখন চরের উপর থেকে সবেমাত্র জল সরে গেছে, ভিজে কাদা তখনো কালো প্যাচ-প্যাচ করছে—মাঝে-মাঝে ডোবায় এখনো জল বেধে আছে। এবড়ো-খেবড়ো ভাঙা-চোরা পিছল চর; খানা, ডোবা, নালা, এখানে-ওখানে, এরি উপরে সন্ধ্যের হিম হাওয়া বইছে। রিদয়ের গা কাঁটা দিয়ে উঠল শীতে। নদীর কিনারায় যেদিকে হাঁসরা নেমেছে, সেদিকে খানিক জঙ্গল অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলা মাঠ, সেদিকে মানুষ কি গরু কিছুই নেই। চারদিক সুনসান! মেঘনার মাঝে লাল ফানুসের মতো রাঙা সুয্যি পশ্চিম-আকাশে রামধনুকের রঙ টেনে দিয়ে আস্তে-আস্তে জলে ডুবছে।
রিদয়ের মনে হল সে যেন কোথায় কতদূরে মানুষের বসতি ছেড়ে পৃথিবীর শেষে এসে পড়ছে! বেচারা সমস্ত-দিন খেতে পায়নি। তার কেবলি কান্না আসতে লাগল। এই একলা চরে কেউ কোথাও নেই—কোথায় খায়, কোথায় যায়? আর যদি বাঘ আসে, কে তাকে বাঁচায়? আর যদি বিষ্টি আসে, কোথায় সে মাথা গুঁজবে? কোথা রইলেন বাপ-মা, কোথা রইল ঘর-বাড়ি! সূর্য লুকিয়ে গেছেন; জল থেকে উঠছে কুয়াশা; আকাশ থেকে নামছে অন্ধকার; চারদিকে ঘনিয়ে আসছে ভয়! ওধারে বনের তলাটা যেন নিঝুম হয়ে আসছে! ঝিমঝিম সেখানে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, আর লতায়-পাতায় খুসখাস শব্দ উঠছে।
রিদয়ের মনে আকাশে উঠে যে ফুর্তিটা হয়েছিল, এখানে নেমে সেটুকু একবারে নিভে গেল। এখন এই হাঁসগুলো ছাড়া সঙ্গী আর কেউ নেই। রিদয় দেখলে সুবচনীর হাঁস একেবারে কাবু হয়ে পড়েছে। বেচারা মাটিতে পা দিয়েই শুয়ে পড়েছে! কাদার উপর গলা বাড়িয়ে দুই-চোখ বুজে সে কেবলি জোরে-জোরে শ্বাস টানছে—যেন আধ-মরা!
রিদয় তার সঙ্গের সাথী খোঁড়া হাঁসকে বললে—“একটু জল খেয়ে নাও —এই তো দু’পা গেলেই নদী!” কিন্তু খোঁড়া সাড়া-শব্দ দিলে না। রিদয় আর এখন দুষ্টু নেই। এই খোঁড়া হাঁস এখন আর শুধু হাঁস নয়—তার বন্ধু, সাথী সবই। সে আস্তে-আস্তে তার গলাটি ধরে উঠিয়ে জলের ধারে নিয়ে চলল। রিদয় ছোট, হাঁস বড়; কিন্তু প্রাণপণে সে হাঁসকে টেনে নিয়ে জলের কাছে নামিয়ে দিলে। হাঁস জলে কাদায় খানিক মুখ ডুবিয়ে চুক-চুক-করে জল খেয়ে নিয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে জলে নেমে শর-বেণার ঝাড় ঠেলে সাঁতরে-সাঁতরে খাবারের সন্ধান করতে লাগল।
বুনো হাঁসগুলো নেমেই জলে গিয়ে পড়েছিল; খোঁড়া হাঁসের কোনো খবরই নেয়নি; দিব্যি চান করে ডানা ঝেড়ে গুগলী-শামুক শাক-পাত খেয়ে বেড়াচ্ছে। রিদয়ের হাঁস জলে নেমেই সুবচনীর কৃপায় একটা পাঁকালমাছ পেয়ে গেল। সে সেইটে মুখে নিয়ে ডাঙায় এসে রিদয়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললে—“এই নাও, মাছটা তোমায় দিলুম। আমার যে উপকার করেছ, তা চিরদিন মনে থাকবে। খেয়ে নাও মাছটা।”
হাঁসের কাছে দুটো মিষ্টি কথা পেয়ে রিদয় একেবারে গলে গেল। তার মনে হল সেই খোঁড়া-হাঁসের গলা ধরে তার দু’ঠোঁটে দুটো চুমু খায়। রিদয় কাদা থেকে মাছটি তুলে একবার ভাবলে—রাঁধি কিসে? অমনি মনে পড়ল—সে যে এখন আর মানুষ নেই, যক্ হয়েছে; হয়তো কাঁচা মাছ খেতে পারবে। রিদয়ের ট্যাঁকে এটা-ওটা কাটতে একটা ছুরি থাকত; সে সেইটে টেনে বার করে মাছটা কুটতে বসল। ছুরিটা এখন একটা খড়কে-কাঠির মতো ছোটো হয়ে গেছে, কিন্তু তাতেই কাজ চলে গেল। মাছটা ছোট-ছোট করে বানিয়ে কতক-কতক হাঁসকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেতে বসল। তার যকের মুখে কাঁচা মাছ নেহাত মন্দ লাগল না। রিদয়ের খাওয়া হলে খোঁড়া তাকে চুপি-চুপি বললে যে চক-নিকোবরের দল পোষা হাঁসকে হাঁসের মধ্যে গণ্য করে না। রিদয় চুপি-চুপি বললে—“তা তো দেখতে পাচ্ছি।”
খোঁড়া হাঁস গলা-ফুলিয়ে বললে—“মজা হয়, যদি একবার এদের সঙ্গে সমানে আমিও মানস-সরোবর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারি। পোষা হাঁস কি করতে পারে তবে ওরা টের পায়।”
“তা তো বটেই!” বলে রিদয় চুপ করলে।
খোঁড়া বলে চলল—“আমার মনে হয় একলা আমি অতটা যেতে পারি কি না! কিন্তু তুমি যদি সঙ্গে চল, তবে আমি সাহস করি।”
রিদয় ভেবেছিল এখান থেকেই সে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু হাঁসের ইচ্ছে শুনে সে একটু তা-না-না করে বললে—“দ্যাখো, আমার সঙ্গে তোমার বনবে কি? আমি তোমাকে আগে কত জালাতন করেচি।” কিন্তু রিদয় দেখলে হাঁস আগের কথা ভুলে গেছে, রিদয় যে তার প্রাণ বাচিয়েছে—জল খাইয়ে যত্ন করে, সেই কথাই সে খোঁড়া হাঁস মনে রেখেছে। একবার বাপ-মায়ের কথা তুলে রিদয় হাঁসকে বাড়ি ফেরাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হাঁস বললে—“কোনো ভাবনা নেই, আসছে-শীতে তোমায় আমি ঠিক বাড়িতে পৌছে দেব। তোমাকে ঘরের দরজায় নামিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি। তার মধ্যে তোমায় একলা ছেড়ে আমি কোথাও নড়ব না—প্রতিজ্ঞা করছি!”
রিদয় ভাবছে—মন্দ না! এই যক্ হয়ে মা-বাপের কাছে এখন না যাওয়াই ভালো! কি জানি, মানস-সরোবর থেকে হয়তো কৈলাসেও গণেশের সন্ধান করা যেতে পারবে। এই ভেবে রিদয় খোঁড়া হাঁসকে জবাব দেবে এমন সময় পিছনে অনেকগুলা ডানার ঝটাপট শোনা গেল। এককুড়ি বুনো হাঁস একসঙ্গে জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে গায়ের জল ঝাড়ছে। তারপরে মাঝে চকা-নিকোবরকে রেখে সারিবন্দী সব হাঁস তাদের দিকে এগিয়ে আস্তে লাগল। খোঁড়া হাঁস বুনো হাঁসদের চেহারা দেখে একটু ভয় খেলে। সে ভেবেছিল হাঁস-মাত্রে পোষা হাঁসের মতো দেখতে; আর ধরন-ধারণও সেই রকম। কিন্তু এখন দেখলে বুনো হাঁসগুলো বেঁটে-খাটো গাঁট্টা-গোঁট্টা-কাটখোট্টা-গোছের। এদের রঙ তার মতো শাদা নয়, কিন্তু ধুলো-বালির মতো ময়লা, পালক এখানে খয়েরী, ওখানে খাকির ছোপ। আর তাদের চোখ দেখলে ভয় হয়—হলুদবর্ণ—যেন গুলের আগুন জ্বলছে! খোঁড়া বরাবর দেখে এসেছে হাঁস চলে হেলতে-দুলতে—পায়ে-পায়ে; কিন্তু এরা চলছে খটমট চটপট-যেন ছুটে বেড়াচ্ছে। আর এদের পাগুলো বিশ্রী—চ্যাটালো, কেটো-কেটো, ফটা-চটা—হতকুৎসিত! দেখলেই বোঝা যায় যেখানে-সেখানে শুধু-পায়ে এরা ছুটে বেড়ায়—জল কাদা কিছুই বাছে না। তাদের ডানার পালক, গাঁয়ের পালক, ল্যাজের পালকগুলো পরিষ্কার ঝকঝক করছে বটে কিন্তু ধরণ-ধারণ দেখলে বোঝা যায় এগুলো একেবারে বুনো আর জংলি! খোঁড়া তাড়াতাড়ি রিদয়কে সাবধান করে দিলে—যেন সে কে, কি বৃত্তান্ত, এসব কথা বুনো হাঁসদের না বলে। তার পর সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এগিয়ে গেল। চকা-নিকোবর, খোঁড়াহাঁস আর বুনোহাঁসদের মধ্যে খানিক্ষণ ঘাড়-নেড়ে নমস্কার প্রতি-নমস্কার চলল। তারপর চকা শুধোলে—“এখন বল তো, তোমরা কে? কোন জাতের পাখি?”
খোঁড়া আস্তে-আস্তে বললে—“কি আর পরিচয় দেব? গেল-বছর ফাগুন মাসে হরিংঘাটায় আমি ডিম-ভেঙে বার হই। জন্মাবধি পা-টি খোঁড়া। এই শীতে আমতলির হাটে আমি বিকোতে আসি; সেখান থেকে রিদয়ের বাপ আমায় সাত-সিকেতে কিনে আনে; তারপর তোমাদের দলে ভিড়েছি।”
চকা-নিকোবর নাক তুলে বললে—“তুমি তবে নেহাত সাধারণ-হাঁস দেখছি! খেতাব, মানসন্ত্রম, বোল্বোলা—কিছুই নেই! কোন সাহসে আমাদের দলে আসতে চাও শুনি?”
খোঁড়া হাঁস খোঁড়া পাটি নাচিয়ে বললে—“আমি দেখাতে চাই যে সাধারণ হাঁসও কাজের হতে পারে।”
চকা হেসে বললে—“সত্যি নাকি? কই, দেখাও দেখি কেমন কাজের কাজী তুমি?”
এক হাঁস অমনি বললে—“ওড়ার কাজে কেমন যে তুমি মজবুত তাতো দেখিয়েচ!”
অন্যে বললে—“হয়তো তুমি সাঁতারে পাকা।”
খোঁড়া ঘাড়-নেড়ে বললে—“না, আমি সাঁতারু মোটেই নয়। আমি বর্ষার সময় নালাগুলো এপার-ওপার করতে পারি, তার বেশি নয়।” খোঁড়া হাস ভাবছিল, চকা তো তাকে আমতলিতে ফিরে পাঠাবেই স্থির করেছে, তবে কেন মিছে-কথা বলা? পষ্ট জবাব দেওয়াই ভালো—যা থাকে কপালে!
চকা শুধোলে—“সাতার জানো না, তবে দৌড়তে মজবুত বোধ হয়?” বলেই চকা একবার তার খোঁড়া পায়ের দিকে চেয়ে চোখ মটকালে।
খোঁড়া হাস গম্ভীর হয়ে বললে—“রাজহাঁস কোনো দিন ছুটে চলে না, তাই ছোটা আমার অভ্যেসই হয়নি।” বলে সে খোঁড়া-পা আরো খুঁড়িয়ে রাজহাঁস কেমন চলে একবার দেখিয়ে দিলে। তার মনে হচ্ছিল এইবার চকা বললে বুঝি—“তোমায় আমাদের দরকার নেই, ঘরে যাও।” কিন্তু ঠিক তার উল্টোটা হল। চক-নিকোবর দু’চারবার ঘাড়-নেড়ে বলল— “তুমি তো বেশ সাফ-সাফ জবাব দিলে—একটুও ভয় না করে! ভালো, ভালো, তোমার সাহস আছে—সময়ে লায়েক হতে পারবে—‘বুকের পাটা শক্ত, সকল কাজে পোক্ত’। দু’দিন এদলে থাক, দেখি তোমার হিম্মৎ কতটা, তারপর যা হয় বিবেচনা করা যাবে। কি বল?”
খোঁড়া হাঁস মাথা নেড়ে বললে—“আমি তো তাই চাই। এতেই আমি খুশি!”
এইবার চকা-নিকোবর বুড়ো-আংলা রিদয়ের দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে বললে—“একি, এ কোন জানোয়ার? ভারি তো অদ্ভুত।”
খোঁড়া হাঁস তাড়াতাড়ি বললে—“এটি আমার দেশের লোক, হাঁস চরাবার কাজ করে, সঙ্গে থাকলে কাজে লাগতে পারে।”
চকা নাক তুলে উত্তর করলে—“বুনো হাঁসের কোনে কাজে লাগবে না।—পোষা হাঁসের কাজে লাগবে বটে! ওর নাম কি?”
মানুষের নাম বললে পাছে বুনো হাঁসরা ভয় খায়, সেইজন্যে খোঁড়া হাঁস অনেক ভেবে বললে—“ওর নাম অনেকগুলো। আমরা ওকে ডাকি বুড়ো-আংলা বলে। আঃ, বড় ঘুম পাচ্ছে।” বলেই খোঁড়া দুবার হাই তুলে চোখ বুজলে; পাছে চকা আর-কিছু প্রশ্ন করে তাই খোঁড়া আগে থাকতেই সাবধান হচ্ছে—“মাগো, চোখ আপনা-হতেই ঢুলে আসছে! চল্রে বুড়ো-আংলা, ঘুমোবি চল।”
চকা-নিকোবর বড় পাকা হাঁস; বুড়ো হয়ে তার মাথা থেকে ল্যাজের পালক পর্যন্ত রুপোর মতো শাদা হয়ে গেছে; মাথাটা যেন চূনের হাঁড়ি; পা-দুটো যেন চ্যালা-কাঠ—বাঁকা, ফাটা-চটা; ডানা-দুটো যেন দুখানা ঝরঝরে বাঁশের কুলো; ঠোট ভোঁতা; গলা ছিনে-পড়,; কিন্তু চোখ এখনো জোয়ান-হাঁসের চেয়েও ঝকঝকে—যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে! চকা দেখলে খোঁড়া পাশ-কাটাবার চেষ্টায় আছে, সে এগিয়ে এসে বুক-ফুলিয়ে খোঁড়াকে বললে—“আমি কে, জানো তো? আমার নাম—চকা-নিকোবর! আর এই আমার ডাইনের হাঁস দেখেছ, ইনি আমার ডান-হাত বললেও চলে, এঁর নাম পাঁপড়া নান্কৌড়ি! আর এই আমার বাঁ-হাত, এঁর নাম নেড়োল-কাটচাল। তারপর ডাইনে হলেন লালসেরা আণ্ডামানি; বাঁয়ে হলেন—চোক-ধলা ডানকানি। তারপরে পাটাবুকো হামস্ত্রি, মারগুই চাপড়া, তিরশুলী আকায়ব, সনদ্বীপের বাঙাল, ধনমানিকের কাওয়াজি, রাবণাবাদের রাজহাঁস, রায়-মঙ্গলার ঘেংরাল, চব্বিশ-পরগনার সরাল। আরো ডাইনে-বাঁয়ে দেখ—লুসাই, তিব্বতি, তাতারি—এমনি সব বড়-বড় খেতাবি হাঁস—কেতাবে যাদের নাম উঠেছে! আমরা কি যার-তার সঙ্গে আলাপ করি, না যাকে-তাকে দলে ভিড়তে দিই? আমাদের সঙ্গে যদি ওঠা-বসা করতে চাও তো পষ্ট করে ওই বুড়ো-আংলাটির গাঁই-গোত্তর পদবী-উপাধি বল, নয় তো নিজের পথ দেখ!”
চকার দেমাক দেখে রিদয় আর চুপ করে থাকতে পারলে না; সে বুক-ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বললে—“আমার নাম ছিল—ছিযুক্ত রিদয়নাথ পুততুণ্ড, ফুলুরী গাঁই, কাশ্যপ গোত্র—পুষ্যিপুত্র; ডিহি বাখরগঞ্জ, মোকাম আমতলি—হাসপুকুর, তেঁতুলতলা। জাতে আমি মানুষ ছিলেম, সকলে এখন—” আর বলতে হল না; মানুষ শুনেই চকা-নিকোবরের দল দশহাত পিছিয়ে গিয়ে গলা বাড়িয়ে খ্যাঁক-খ্যাঁক্ করে বললে—“যা ভেবেছি তাই! সরে পড়। মানুষ আমরা দলে নিইনে। ভারি বজ্জাত তারা!”
খোঁড়া হাঁস আমতা-আমতা-করে বললে—“এইটুকু মানুষ, ওকে আবার ভয় কি? কাল ওতো আপনিই বাড়ি চলে যাবে; আজ রাতটা এখানে থাক না! এইটুকু টিকটিকির মতো ওকে এই অন্ধকারে শেয়াল-কুকুরের মুখে ছেড়ে দেওয়া তো চলে না। তা ছাড়া ও আর এখন মানুষ নেই—যক হয়ে গেছে!”
চকা ‘যক্’ শুনে সাহস পেয়ে এগিয়ে এলে বললে—“বাপু, মানুষ-জাত খারাপ, বরাবর দেখে এসেছি। ওদের বিশ্বাস নেই। তবে তুমি যদি জামিন থাক, তবে রাতের মতো ওকে আমরা থাকতে দিই। এই হিমে চড়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে ও যদি অসুখে পড়ে, তার দায়ী আমরা হব না—এইবেলা বুঝে দেখ!”
খোঁড়া হাঁস পিছবার পাত্র নয়; সে বললে—“সে ভয় নেই। চড়ায় এক রাত কেন, সাত রাত কাটালেও ওর কিছু হবে না। এমন সৎসঙ্গ, ভালো জায়গা বনে আর পাবে কোথা? ওর বড় জোর-কপাল যে চকা-নিকোবরের সঙ্গে এক-চরে শুতে পেয়েছে চকার বাছা বাগদী-চর; এতে শুয়ে আরাম কর।” বলে খোঁড়া রিদয়কে চোখ টিপলে।
চকা খোশমোদে খুশি হয়ে বললে—“তাহলে কাল কিন্তু ওর বাড়ি ফের চাই—কেমন?”
খোঁড়া বললে—“ওর সঙ্গে তাহলে আমাকেও ফিরতে হয়। আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি—ওকে ছাড়ব না!”
চকা-নিকোবর উত্তর দিলে—“তুমি যেমন বোঝো। ইচ্ছে হয় আমাদের সঙ্গে থাকতে পার, ইচ্ছে হয় ফিরতে পার।” এই বলে চকা চরের মধ্যিখানে উড়ে বসল।
একে-একে বুনো হাঁস চরে গিয়ে ডানায় মুখ গুজে শুয়ে পড়েছে। খোঁড়া হাঁস রিদয়ের কানে-কানে বললে—“চরে বড় হিম; যত পার শুকনো ঘাস কুড়িয়ে নিয়ে আমার সঙ্গে এস।” রিদয় দু বোঝা শুকনো কুটো-কাটা হাঁসের পিঠে দিয়ে চেপে বসল। হাঁস তাকে চরের একটা গর্তে নামিয়ে বললে—“ঘাসগুলো বালির উপর বিছিয়ে দাও; আমি ওর উপর বসি, তুমি আমার ডানার মধ্যে ঢুকে পড়, আর ঠাণ্ডা লাগবে না।” রিদয়কে ডানার মধ্যে নিয়ে সুবচনীর খোঁড়া হাঁস—“এই আমায় তুমি আরামে রাখ, আমি তোমায় গরমে রাখি”—বলে খড়ের উপরে আরামে বসে ঘুম দিতে লাগল। রিদয়ের মনে হল যেন সে পালকের তোশকে শুয়েছে। সেও একটিবার হাই তুলেই চোখ বুজলে।