বেওয়ারিশ লাস/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলে সঙ্গে সঙ্গে বালকবালিকা কয়েকটীর সঙ্গে স্ত্রীলোকটীও গাড়ি হইতে নামিল, এবং আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিল।
যে স্থানে মৃতদেহটী রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে গমন করিয়া সেই মৃতদেহটী আমি তাহাকে দেখাইয়া দিলাম ও কহিলাম, “দেখ দেখি, তুমি উহাকে চিনিতে পার কি না?”
স্ত্রীলোেকটী মৃতদেহের নিকট গমন করিয়া একটু স্থির হইয়া দাঁড়াইল, এবং অনিমিষ-লোচনে অতি অল্পক্ষণ মাত্র নিরীক্ষণ করিয়া বিনা-বাক্যব্যয়ে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।
সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকটী আসিয়াছে, এ সে স্ত্রীলোেক নহে; এ যেন অপর আর কোন স্ত্রীলোক। এত অল্প সময়ের মধ্যে মনুষ্যের বর্ণ, মুখশ্রী প্রভৃতির যে এত পরিবর্ত্তন হইতে পারে, ইহা আমি এই প্রথম দেখিলাম; ইহার পূর্ব্বে এরূপ দৃশ্য আমি আর কখনও দেখি নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই স্থানে যে কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল, সকলেই বুঝিতে পারিল যে, ইহার অন্তরে বিষম আঘাত লাগিয়াছে।
সেই সময় আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই মৃতদেহ কাহার, তাহা কি তুমি চিনিতে পারিয়াছ?”
আমার কথায় স্ত্রীলোেকটী কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।
আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহা কি তোমার স্বামীর মৃতদেহ?”
এ কথারও কোন উত্তর পাইলাম না।
সেই স্ত্রীলোেকটীর সহিত যে কয়েকটী বালক-বালিকা আসিয়াছিল, তাহাদিগের মাতার এই অবস্থা দেখিয়া, তাহারাও যেন হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। কেবল একটী নিতান্ত ছোট বালিকা তাহার মাতার মুখ ধরিয়া কহিল, “মা,—বাবা?”
বালিকার এই কথা সকলেরই হৃদয়ে শেলসম প্রবেশ করিল। তখন সকলেই বুঝিতে পারিলেন, সেই মৃতদেহ তাহার পিতার।
সেই বালক-বালিকাগণের মধ্যে যেটী সকলের বড়, তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই কি তোমার পিতা?”
উত্তরে সে কহিল, “ইনিই আমার পিতা।”
আমি। ইহারই নাম কি রব্বানি?
বালক। হাঁ।
আমি। মেহের আলি তোমার কে হয়?
বালক। নানা।
আমি। তুমি জান, তিনি কোথায় কায করেন?
বালক। জানি।
আমি। সে সাহেবের নাম কি?
বালক। তাহা জানি না।
আমি। কোন্ স্থানে, কোন্ রাস্তায়?
বালক। তাহাও জানি না। সেটা একটা স্কুল।
আমি। যেখানে তোমার নানা কায করেন, সেটী স্কুল?
বালক। হাঁ।
আমি। সে স্কুল তুমি চিন?
বালক। চিনি।
আমি। কিরূপে চিনিলে?
বালক। আমি অনেকবার নানার সঙ্গে ও বাবার সঙ্গে সেই স্থানে গিয়াছি।
আমি। তুমি আমাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারিবে?
বালক। পারিব, কিন্তু এখান হইতে আমি চিনিতে পারিব না।
আমি। কোথা হইতে চিনিতে পারিবে?
বালক। আমি আমাদিগের বাড়ী হইতে চিনিয়া সেই স্থানে গমন করিতে পারি।
আমি। আমি যদি তোমাকে সঙ্গে লইয়া তোমার নানার বাড়ীতে লইয়া যাই, তাহা হইলে তুমি সেই স্থান হইতে তোমার নানা যে স্কুলে কায করে, সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিবে?
বালক। পারিব।
আমি। তবে আমার সঙ্গে আইস।
বালক। আমার মা?
আমি। তিনি এখন এখানে থাকুন, আমরা এখনই ফিরিয়া আসিব।
এই বলিয়া আমি বালকটীকে সঙ্গে লইয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। রব্বানির স্ত্রী একরূপ অন্ধ-অচেতন অবস্থায় সেই স্থানে বসিয়া রহিল। সেই স্থানে আরও অনেক কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহবা সেই স্ত্রীলোকটীর নিকটেই রহিলেন, কেহবা বালক-বালিকাগণের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, আর কেহবা আমার সহিতই গমন করিলেন।
গাড়িতে উঠিয়া গাড়িবানকে দ্রুতগতি চালাইতে কহিলাম। ক্রমে গাড়ি আসিয়া মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইল।
মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গিয়া গাড়ি উপস্থিত হইলে, সেই বালকটী কহিল, “আমি গাড়ির ভিতর বসিয়া রাস্তা ঠিক পাইব না, গাড়ির উপর গিয়া বসিলে যে রাস্তা দিয়া আমি সর্ব্বদা গমন করিয়া থাকি, সেই রাস্তা দিয়া অনায়াসেই এই গাড়ি সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিব।”
বালকের কথায় আমি সম্মত হইলাম। বালক গাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া কোচবাক্সের উপর গিয়া উপবেশন করিল।
বালকের নির্দ্দেশ মত গাড়ি চলিতে লাগিল। ক্রমে দেখিলাম, গাড়ি গিয়া পার্ক স্ট্রীটের একটী প্রকাণ্ড বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই প্রকাণ্ড বাড়ী আমরা চিনিতাম। উহা প্রকৃতই একটী প্রকাণ্ড স্কুল। ইহাতে ইংরাজ বালকের সংখ্যাই অধিক, এবং তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই সেই স্কুলের ভিতর রাত্রিদিন বাস করিয়া থাকেন।
সেই স্থানে বালকটী গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া আমাকে কহিল “আমার সঙ্গে আসুন, এই স্কুলে আমার নানা কর্ম্ম করিয়া থাকেন।”
বালকের কথা শুনিয়া আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম, এবং বালকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই প্রকাণ্ড বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।
সেই স্কুলে যে সকল চাকর কর্ম্ম করিত, উহার এক পার্শ্বে তাহাদিগের থাকিবার উপযোগী কয়েকটী ঘর আছে। মেহের আলির থাকিবার নিমিত্ত উহার মধ্যে একটী ঘর নির্দ্দিষ্ট ছিল।
বালক আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একবারে সেই ঘরের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, ঘরের সম্মুখে একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে, তাহাকে দেখিয়াই বালকটী কহিল, “নানা! ইঁহারা তোমাকে খুঁজিতেছেন। বাবা মরিয়া গিয়াছেন।”
বালকের কথা শুনিয়া মেহের আলি আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আপনারা কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?”
আমি। মেহের আলির। তোমারই নাম কি মেহের আলি?
মেহের আলি। হাঁ, আমার নামই মেহের আলি। আপনারা যে একবারে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এ কথা আমাদিগের বড় সাহেব জানেন কি?
আমি। না, তোমাদের বড় সাহেব কে?
মেহের আলি। তিনি এই কুঠীতেই থাকেন, তাঁহার অনুমতি ব্যতীত বাহিরের কোন লোকের এই কুঠীর ভিতর প্রবেশ করিবার অধিকার নাই। তিনি না দেখিতে দেখিতে, আপনারা এখনই বাহিরে গমন করুন।
আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে, আমরা এখনই বাহিরে গমন করিব; কিন্তু তোমাকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া যাইতে পারি না। তোমাকে যাহা যাহা আমরা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহার উত্তর প্রদান কর, আমরা এখনই তোমার সাহেবের কুঠী হইতে বাহির হইয়া যাইতেছি।
মেহের আলি। সাহেবের অনুমতি না লইলে আমি আপনাদিগের কোন কথার উত্তর দিতে পারিব না।
আমি। ইচ্ছা হয় ত তোমার সাহেবকে সংবাদ প্রদান কর, বা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাও যে, পুলিশের কয়েকজন লোক এখানে আসিয়াছে, তাঁহারা আমাকে কোন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, আমি তাঁহাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিব কি না?
মেহের আলি। সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিবার আমার কোন প্রয়োজন নাই। ইচ্ছা হয়, আপনারা গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে পারেন।
মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার অতিশয় ক্রোধের উদ্রেক হইল, এবং সর্ব্বশরীর যেন কাঁপিতে লাগিল। একবার মনে করিলাম যে, ও যেরূপ ভাবে আমাদিগের সহিত কথা কহিতেছে, তাহাতে উহার সহিত আমাদিগের সেইরূপ ব্যবহার করাই কর্ত্তব্য। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, সাহেব, দিগের কুঠীর ভিতর কোন গোলযোগ করিলে আমার কার্য্যের সুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, তিনি ক্রোধান্বিত হইলে তাঁহার চাকরদিগের নিকট হইতে আমাদিগের অধিক কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা থাকিবে না কিন্তু যদি তিনি ইচ্ছা করিয়া আমাদিগের সহায়তা করেন, তাহা হইলে তাঁহার ভৃত্যগণ তাঁহার নিকট কোন কথা গোপন করিতে পারিবে না, বা যদি কেহ গোপন করে, তাহা হইলে অপরের নিকট হইতেও তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এরূপ অবস্থায় মেহের আলির উপর ক্রোধান্বিত না হইয়া, তাহার মনিবের সহিতই আমার প্রথম দেখা করা কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ, আমি বিলক্ষণরূপে অবগত আছি যে, ভাল ভাল ইংরাজগণের নিকট সরকারী কার্য্য উপলক্ষে যদি কোনরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা যায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাঁহারা তাঁহাদের সাধ্যমত সাহায্য প্রদান করিয়া থাকেন।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া একজন কর্ম্মচারীকে সেই স্থানে রাখিয়া আমি সেই স্কুলের সর্ব্ব প্রধান সাহেবের উদ্দেশে গমন করিলাম। যে গৃহে সাহেব থাকেন, সেই গৃহের সম্মুখে তাঁহার চাপরাশি বসিয়াছিল। একখানি কার্ডে আমার নাম, আমি কে, এবং কি নিমিত্ত আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি, তাহা সেই কার্ডে লিখিয়া চাপরাশির হাতে প্রদান করিলাম, ও আমি যে কে, তাহা চাপরাশিকেও বলিয়া দিলাম। চাপরাশি কার্ড লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিবার অতি অল্পক্ষণ পরেই, সেই কার্ড হস্তে সাহেব বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, “আমি আপনাকে কিরূপ সাহায্য করিতে পারি?”
আমি। আপাততঃ অপর সাহায্যের কিছু প্রয়োজন নাই, কেবলমাত্র আপনার খানসামাকে আমি একবার চাহি। একঘণ্টার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া যাইব মাত্র।
সাহেব। তাহাকে প্রয়োজন?
আমি। আমরা একটা ভয়ানক হত্যার অনুসন্ধান করিতেছি। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, এখন বোধ হইতেছে যে, সে আপনার খানসামার জামাতা। এই নিমিত্ত তাহাকে লইয়া গিয়া একবার সেই মৃতদেহ দেখাইব। তাহা হইলে সেই ব্যক্তি তাহার জামাতা কি না, তাহা অনায়াসেই সে চিনিতে পারিবে। তখন কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, এবং আপনার সাহায্যের আবশ্যক হইলে, পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিব।
সাহেব। কিরূপে খানসামার জামাতা হত হইয়াছে?
আমি। কিরূপে হত হইয়াছে, বা কে হত্যা করিয়াছে, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। সেই মৃতদেহ যে কাহার, এখন তাহারই অনুসন্ধান চলিতেছে।
সাহেব। সেই মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গেল?
আমি। বড় একটা টীনের বাক্সের মধ্যে একখানি চটের দ্বারা আবৃত সেই মৃতদেহ রাস্তার ধারে পাওয়া গিয়াছে।
সাহেব। আচ্ছা বাবু! আপনি আমার খানসামাকে লইয়া যান। আপনার কার্য্য শেষ হইয়া গেলে, অমনি তাহাকে ছাড়িয়া দিবেন।
আমাকে এই বলিয়া সাহেব তাঁহার চাপরাশিকে কহিলেন, “আমার খানসামাকে আমার নিকট ডাকিয়া আন।”
সাহেবের আদেশ পাইবামাত্র, চাপরাশি দ্রুতগতি গমন করিয়া মেহের আলিকে তাঁহার সম্মুখে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে দেখিবামাত্রই সাহেব কহিলেন, “তুমি এই বাবুর সহিত গমন কর, এবং ইঁহারা তোমার নিকট হইতে যেরূপ সাহায্য প্রার্থনা করেন, সেইরূপ সাহায্য প্রদান কর।”
সাহেবের কথা শুনিয়া মেহের আলি আর কোন কথা কহিল না; স্থিরভাবে অথচ নিতান্ত ক্ষুণ্ণ মনে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিল।
আমি মেহের আলিকে সেই স্থানে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই বাড়ী হইতে তাহাকে বাহিরে আনিলাম। কিন্তু তাহাকে আমার গাড়িতে তুলিবার পূর্ব্বে তাহাকে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করা কর্ত্তব্য মনে করিলাম।
আমি। রব্বানি তোমার জামাতা?
মেহের আলি। হাঁ মহাশয়! রব্বানি আমার জামাতা হয়।
আমি। রব্বানি এখন কোথায়?
মেহের আলি। তাহা আমি জানি না।
আমি। তোমার সহিত তাহার কয়দিবস সাক্ষাৎ হয় নাই?
মেহের আলি। এক সপ্তাহের মধ্যে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই।
আমি। তোমার বেশ মনে আছে যে, এক সপ্তাহকাল তোমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই?
মেহের আলি। আমার বেশ মনে আছে।
আমি। তোমার মনিবের কুঠীতে সে কতদিবস আইসে নাই?
মেহের আলি। প্রায় পনর দিবস হইল, সে এখানে আইসে নাই।
আমি। অদ্য তিন দিবস হইল, সে এখানে আসিয়াছিল যে?
মেহের আলি। মিথ্যা কথা, এ কথা আপনাকে কে বলিল?
আমি। যেই আমাকে বলুক না কেন, তোমাকে আমি যে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহারই উত্তর প্রদান কর?
মেহের আলি। আমি ত তাহা বলিয়াছি যে, সে এখানে পনর দিবসের মধ্যে আইসে নাই।
মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার মনে কেমন একটু সন্দেহ হইল। অপর একজন কর্ম্মচারীর নিকট তাহাকে রাখিয়া আমি পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেই সম্মুখে বড় সাহেবের সেই চাপরাশিকে দেখিতে পাইলাম। আমাকে পুনরায় বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া, চাপরাশি আমার নিকট আগমন করিল ও কহিল, “কি মহাশয়! পুনরায় ফিরিয়া আসিলেন যে?”
আমি। তোমাকে একটী কথা জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া, ফিরিয়া আসিয়াছি।
চাপরাশি। আমাকে?
আমি। হাঁ।
চাপরাশি। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।
আমি। মেহের আলি তোমার নিকট কত দিবস হইতে পরিচিত?
চাপরাশি। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমি আমার সাহেবের নিকট কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই সময় হইতেই আমি মেহের আলিকে চিনি।
আমি। তাহার একটী জামাতা আছে, তাহা তুমি জান?
চাপরাশি। জানি, তাহার নাম রব্বানি। সম্প্রতি খোলার ওই ছোট ঘরখানি সে বাঁধিয়াছিল।
আমি। তুমি তাহাকে কয়দিবস হইতে দেখ নাই?
চাপরাশি। তিন চারি দিবস হইল, আমি তাহাকে দেখিয়াছি। কি পাওনা টাকার নিমিত্ত সে তাহার শ্বশুরের সহিত বকাবকি করিতেছিল।
আমি। কোথায়?
চাপরাশি। এই কুঠীর ভিতর তাহার শ্বশুর যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের সম্মুখে।
আমি। সে যে তিন চারি দিবসের ঘটনা, তাহা তোমার বেশ মনে আছে কি?
চাপরাশি। আমার বেশ মনে হইতেছে যে, উহা চারি দিবসের অধিক কোনরূপেই হইবে না।
আমি। পাওনা টাকার নিমিত্ত উহারা কতক্ষণ পর্য্যন্ত বকাবকি করিয়াছিল?
চাপরাশি। তাহা আমি জানি না। কোন কার্য্য বশতঃ আমি সেই স্থানে গিয়াছিলাম, তাহাতেই জানি। আমি তখনই সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম।
আমি। তখন বেলা কত?
চাপরাশি। বৈকালে; কিন্তু বেলা তখন অতি অল্পই ছিল।
আমি। তাহার পর, রব্বানি কখন চলিয়া গিয়াছে, তাহা বলিতে পার?
চাপরাশি। আমি তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখি নাই।
আমি। তুমি আমার সহিত একবার গমন করিতে পার কি? কারণ, যে লাসটী পাওয়া গিয়াছে, তাহাকে দেখিলে, তুমি বেশ চিনিতে পারিবে, সেই লাসটা রব্বানির কি না?
চাপরাশি। আপনি এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি। তাঁহার আদেশ পাইলে, আমি এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।
এই বলিয়া চাপরাশি আমাকে সেই স্থানে রাখিয়া সে তাহার সাহেবের নিকট গমন করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া কহিল, “চলুন, সাহেব অনুমতি দিয়াছেন।”
চাপরাশিকে আর কোন কথা না বলিয়া, তাহার সহিত আমি বাহিরে আসিলাম, ও মেহের আলির সহিত আপন গাড়িতে উঠিলাম। সেই বালকটীও গাড়ির উপর উঠিয়া বসিল।
চাপরাশি আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা আমি মেহের আলিকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া মেহের আলি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, এবং পরিশেষে কহিল, “চাপরাশি কখনই এ কথা বলে নাই। আর যদি বলিয়াই থাকে, তাহা হইলে সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। পনর দিবসের মধ্যে রব্বানি এ কুঠীতে আইসে নাই।”
মেহের আলির কথা শুনিয়া চাপরাশি কহিল, “আমি মিথ্যা বলিতেছি, না তুই মিথ্যা বলিতেছিস্! তিন চারিদিবস হইল, সন্ধ্যার পূর্ব্বে যে সে আসিয়া টাকার জন্য, তোর সহিত বকাবকি করিয়াছিল, সে কথা তোর মনে নাই কি?”