বেতালপঞ্চবিংশতি/অষ্টাদশ উপাখ্যান
অষ্টাদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
কুবলয়পুরে ধনপতি নামে বণিক্ ছিলেন। তিনি ধনবতীনাম্নী নিজ কন্যার গৌরীকালে গৌরীদত্তনামক ধনাঢ্য বণিকের সহিত বিবাহ দিলেন। কিয়ৎ কাল পরে ধনবতীর এক কন্যা জন্মিল। গৌরীদত্ত কন্যার নাম মোহিনী রাখিলেন। কালক্রমে তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে তাঁহার জ্ঞাতিবর্গ ধনবতীকে অসহায়িনী দেখিয়া তদীয় সর্ব্বস্ব অপহরণ করিল। তখন সে নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া কন্যা লইয়া এক তমিস্রা রজনীতে পিত্রালয়ে পলায়ন করিল।
কিয়ৎ দূর গমন করিয়া পথ ভুলিয়া উহারা এক শ্মশানে উপস্থিত হইল। তথায় এক চোর রাজদণ্ডনুসারে তিন দিবস শূলোপরি আরোহিত ছিল বিধিবিপাকে সে পর্য্যন্ত তাহার প্রাণপ্রয়াণ হয় নাই। দৈবযোগে ধনবতীর দক্ষিণ হস্ত সেই চোরের চরণে লগ্ন হইলে সে অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া কহিল তুমি কে কি নিমিত্ত এমন সময়ে আমাকে মর্ম্মান্তিক যাতনা দিলে। ধনবতী কহিল আমি জ্ঞানপূর্ব্বক তোমাকে যন্ত্রণা দি নাই। যাহা হউক আমার অপরাধ ক্ষমা কর। অনন্তর আত্মপরিচয় দিয়া চোরকে জিজ্ঞাসা করিল তুমি কে কি নিমিত্তে শ্মশানে আছ ও কি দুঃখ ভোগ করিতেছ বল।
চোর কহিল আমি বণিগ্জাতি চৌর্য্যাপরাধে শূলে আরোহিত হইয়াছি। অদ্য তৃতীয় দিবস তথাপি প্রাণ নির্গত হইতেছে না তাহাতেই অত্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। জন্মকালে জ্যোতির্বিদেরা গণনা দ্বারা স্থির করিয়াছিলেন অবিবাহিত অবস্থায় আমার মৃত্যু হইবেক না। তদনুসারে যাবৎ বিবাহ না হইবেক তাবৎ এই অবস্থায় এই দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবেক। যদি তুমি কৃপা করিয়া কন্যাদান কর তবেই এই অসহ্য যাতনা হইতে পরিত্রাণ পাই। আমার চিরসঞ্চিত সুবর্ণরাশি আছে যদি আমার প্রার্থনা সিদ্ধ কর সমুদায় তোমাকে দি।
ধনবতী অর্থলোভে বিমূঢ় হইয়া মনে মনে মলিম্লুচের প্রার্থনায় সম্মতপ্রায় হইল এবং কহিল বহুকালাবধি আমার দৌহিত্রমুখদর্শনের বাসনা আছে তোমাকে কন্যাদান করিলে আমার সে বাসনা সম্পন্ন হয় না নতুবা আমার আর কোন আপত্তি নাই। চোর কহিল তুমি এক্ষণে কন্যাদান করিয়া আমাকে যন্ত্রণা হইতে মুক্ত কর। আমি অনুমতি করিতেছি তোমার কন্যা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে কোন ব্রাহ্মণকুমারকে ধনদান দ্বারা সম্মত করিয়া তদ্দ্বারা ক্ষেত্রজ পুত্ত্র উৎপন্ন করিয়া লইবে। তাহা হইলে তোমারও বাসনা পূর্ণ হইল এবং আমিও এই দুঃসহ যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ পাইলাম।
ধনবতী কন্যা প্রদান করিল। তখন চোর কহিল ঐ পূরোবর্ত্তী গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমার গৃহ। গৃহের পূর্ব্ব ভাগে কূপের নিকট এক বটবৃক্ষ আছে তাহার মূলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিহিত আছে যাইয়া গ্রহণ কর। ইহা কহিবামাত্র চোরের প্রাণবিয়োগ হইল এবং ধনবতীও চৌরনির্দিষ্ট ন্যগ্রোধবৃক্ষের মূল খননপূর্ব্বক সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা হস্তগত করিয়া পিত্রালয়ে প্রস্থান করিল। পরে সে পিতাকে পূর্ব্বাপর সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত করাইয়া তাঁহার হস্তে সমস্ত সম্পত্তি সমর্পণপূর্ব্বক তদীয় আবাসে বাস করিতে লাগিল।
কিয়ৎ কাল পরে মোহিনী যৌবনবতী হইল। সে এক দিবস স্বীয় সহচরীগণ সঙ্গে লইয়া গবাক্ষদ্বার দিয়া রথ্যা নিরীক্ষণ করিতেছে দৈবযোগে সেই সময়ে এক পরম সুন্দর বিংশতিবর্ষীয় ব্রাহ্মণতনয় তথায় উপস্থিত হইল। তাহাকে অবলোকন করিয়া মোহিনীর মন মোহিত হইল। তখন সে আপন এক সহচরীকে কহিল তুমি এই ব্রাহ্মণকে আমার মার নিকটে লইয়া যাও। সখী তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণতনয়কে লইয়া তাহার জননীর নিকট উপস্থিত করিলে সে চৌরবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া তাহাকে প্রার্থনানুরূপ অর্থ দিয়া নিয়োগ প্রদান করিল।
মোহিনী গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্ত্রবতী হইল। সূতিকাষষ্ঠীরজনীতে সে স্বপ্নে দেখিল দুই হস্ত পঞ্চ মস্তক প্রতিমস্তকে তিন তিন চক্ষুঃ ও এক এক অর্দ্ধচন্দ্র অতি দীর্ঘ জটাভার পৃষ্ঠদেশে লম্বমান দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল বাম হস্তে নরকপাল ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধান ভুজঙ্গের মেখলা উজ্জ্বলরজতগিরিতুল্য কলেবর অতিশুভ্র নাগযজ্ঞোপবীত ভস্মভূষিতসর্ব্বাঙ্গ এবংবিধ আকার ও বেশবিশিষ্ট বৃষভারূঢ় এক পুরুষ তাহার সম্মুখে আসিয়া কহিতেছেন বৎসে মোহিনি তোমার পুত্ত্র জন্মিয়াছে আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি। এই বালক ক্ষণজন্মা। তুমি আমার আজ্ঞানুসারে ঐ শিশুকে সহস্র সুবর্ণ সহিত পেটকমধ্যগত করিয়া কল্য অর্দ্ধরাত্র সময়ে রাজদ্বারে রাখিয়া আসিবে। রাজা তাহাকে পুত্ত্রবৎ প্রতিপালন করিবেক। রাজার স্বর্গারোহণের পর তোমার পুত্ত্র তদীয় সিংহাসনের অধিকারী হইয়া ক্রমে ক্রমে নিজ প্রতাপ ও নীতিবিদ্যা প্রভাবে সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হইবেক।
এমন কালে মোহিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইলে সে আপন জননীর নিকটে গিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিল। ধনবতী শুনিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইল এবং পর দিবস নিশীথসময়ে ঐ শিশুকে সহস্র সুবর্ণমুদ্রা সহিত পেটকমধ্যস্থ করিয়া রাজদ্বারে রাখিয়া আসিল। সেই সময়ে রাজাও স্বপ্নে দেখিতেছেন যে পূর্ব্বোক্তপ্রকার পুৰুষ তাঁহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া কহিতেছেন মহারাজ গাত্রোত্থান কর এক চক্রবর্ত্তিলক্ষণাক্রান্ত সন্তান পেটকমধ্যশায়ী তোমার দ্বারদেশে উপনীত। অবিলম্বে আনয়ন করিয়া পুত্ত্রনির্বিশেষে প্রতিপালন কর। উত্তর কালে সেই তোমার উত্তরাধিকারী হইবেক এবং পুত্ত্রকার্য্য করিবেক।
রাজার তৎক্ষণাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন তিনি আপন মহিষীকে জাগরিত করিয়া স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণ করাইলেন। অনন্তর উভয়ে দ্বারদেশে আসিয়া পেটক পতিত দেখিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ পেটকের মুখোদ্ঘাটন করিয়া দেখিলেন বালকের রূপে পেটক আলোকময় করিয়াছে। রাজ্ঞী পুত্ত্রকে ক্রোড়ে লইয়া অগ্রগামিনী হইলেন রাজা স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণপূর্ব্বক পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
প্রভাত হইবামাত্র রাজা আপন সভার সামুদ্রিকবেত্তা পণ্ডিতগণকে আহ্বান করিয়া দেবপ্রসাদলব্ধ বালকের লক্ষণপরীক্ষার্থে আজ্ঞা প্রদান করিলেন। তাঁহারা দৃষ্টিগোচর করিয়া কহিলেন মহারাজ আপাততঃ তিন স্পষ্ট সুলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছে উন্নত ললাট বিস্তৃত বক্ষঃস্থল ও দীর্ঘ অকার। পরে শাস্ত্রানুসারে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন সামুদ্রিক শাস্ত্রে পুরুষের দ্বাত্রিংশৎ শুভ লক্ষণ নির্দিষ্ট আছে মহারাজ সেই সমুদায় এই একাধারে লক্ষিত হইতেছে। অতএব এই বালক সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট হইবেন সন্দেহ নাই।
রাজা পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়া পারিতোষিক প্রদানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণদিগকে বিদায় করিয়া দীন দরিদ্র অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক অর্থদান করিলেন। ষষ্ঠ মাসে অন্নপ্রাশন দিয়া বালকের নাম হরদত্ত রাখিলেন। বালক অল্পকালমধ্যে চতুর্দশ বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন এবং রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে তদীয় সিংহাসনে আরোহণ করিয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত ভূমণ্ডলে আপন আধিপত্য স্থাপন করিলেন।
কিয়ং কাল পরে হরদত্ত তীর্থযাত্রায় নির্গত হইয়া প্রথমতঃ পিতৃকৃত্যসম্পাদনার্থে গয়াধামে উপস্থিত হইলেন। ফল্গুতীরে যথাবিধি শ্রাদ্ধ করিয়া রাজা পিতৃপিণ্ডপ্রদানে উদ্যত হইলে নদীমধ্য হইতে পিণ্ডগ্রহণার্থে তিন জনের তিন দক্ষিণ হস্ত যুগপৎ নির্গত হইল এক ক্ষেত্রিক চোরের দ্বিতীয় বীজী ব্রাহ্মণের তৃতীয় প্রতিপালক রাজার।
ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ এক্ষণে ইহাদিগের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে হরদত্তদত্তপ্রিণ্ডগ্রহণে অধিকারী হইতে পারে। রাজা বলিলেন চোর। বেতাল কহিল অন্যেরা কি অপরাধ করিয়াছে। রাজা বলিলেন ব্রাহ্মণ অর্থ লইয়া বীজ বিক্রয় করিয়াছেন। রাজাও সহস্র সুবর্ণ লইয়া প্রতিপালনাদি করিয়াছেন। অতএব তাঁহাদের পিণ্ডগ্রহণে অধিকার হইতে পারে না।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।