বেতালপঞ্চবিংশতি/চতুর্থ উপাখ্যান
চতুর্থ উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
ভোগবতী নগরীতে অনঙ্গসেন নামে অতি প্রসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। চূড়ামণি নামে সর্ব্বগুণাকর শুকপক্ষী সর্ব্ব কাল তাঁহার সন্নিহিত থাকিত। এক দিবস রাজা প্রসঙ্গক্রমে চূড়ামণিকে জিজ্ঞাসিলেন শুক তুমি কি কি জান। সে কহিল মহারাজ আমি ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান কালত্রয়ের বৃত্তান্ত জানি। তখন রাজা কহিলেন যদি তুমি ত্রিকালজ্ঞ হও বল কোন্ স্থানে আমার উপযুক্ত রমণী আছে। চূড়ামণি নিবেদন করিল মহারাজ মগধদেশাধিপতি রাজা বীরসেনের চন্দ্রাবতী নামে এক কন্যা আছে সে পরম সুন্দরী ও অতিপণ্ডিতা তাহার সহিত মহারাজের বিবাহ হইবেক।
রাজা অনঙ্গসেন শুকের সর্ব্বজ্ঞত্বপরীক্ষার্থে চন্দ্রকান্তনামক সুপ্রসিদ্ধ দৈবজ্ঞকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসিলেন মহাশয় আপনি গণনা দ্বারা নির্দ্ধারিত করিয়া বলুন কোন্ কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হইবেক। তিনি জ্যোতির্বিদ্যাপ্রভাবে অবগত হইয়া কহিলেন মহারাজ চন্দ্রাবতী নামে এক অতিরূপবতী রমণী আছে। গণনা দ্বারা দৃষ্ট হইতেছে তাহার সহিত আপনকার পরিণয় হইবেক। রাজা শুনিয়া শুকের প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। পরে এক সদ্বক্তা চতুর বুদ্ধিমান্ কার্য্যসাধক ব্রাহ্মণকে অনাইয়া নানা উপদেশ দিয়া শুভসম্বন্ধস্থিরীকরণার্থে মগধেশ্বরের নিকট পাঠাইলেন।
চন্দ্রাবতীর নিকটেও মদনমঞ্জরী নামে এক শারিকা থাকিত। তাহারও সর্ব্বজ্ঞতাখ্যাতি ছিল। তিনি এক দিবস তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন শারিকে যদি তুমি ভূত ভবিখ্যৎ বর্ত্তমান সমুদায় বলিতে পার আমার যোগ্য পতি কোথায় আছেন বল। শারিকা কহিল রাজনন্দিনি আমি দেখিতেছি ভোগবতী নগরীর অধিপতি রাজা অনঙ্গসেন তোমার পতি হইবেন। ফলতঃ অনঙ্গসেন ও চন্দ্রাবতী উভয়েরই এই রূপে শ্রবণ দ্বারা অন্তরে অনুরাগ সঞ্চার হইল এবং সমাগমাভাব প্রযুক্ত উভয়েরই ক্রমে ক্রমে পূর্ব্বরাগসম্ভব স্মরদশার উদয় হইতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে অনঙ্গসেনের প্রেরিত ব্রাহ্মণ নগধেশ্বরের নিকট উপস্থিত হইয়া স্বীয় রাজার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং বাগ্দানের দ্রব্য সমুদায় সমভিব্যাহারে দিয়া এক ব্রাহ্মণকে ঐ ব্রাহ্মণের সহিত পাঠাইলেন। কহিয়া দিলেন তুমি তথা হইতে প্রত্যাগমন না করিলে আমি কোন উদ্যোগ করিতে পারিব না। বাগ্দানের দ্রব্য সামগ্রা লইয়া ব্রাহ্মণেরা অনঙ্গসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে তিনি আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন এবং সুবিজ্ঞ দৈবজ্ঞ দ্বারা বিবাহের দিন নির্দিষ্ট করিয়া মগধেশ্বরপ্রেরিত ব্রাহ্মণ দ্বারা তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। অনন্তর নির্দ্ধারিত দিবসে যথাসময়ে মগধেশ্বরের আলয়ে উপস্থিত হইয়া চন্দ্রাবতীর পাণিগ্রহণপূর্ব্বক নিজ রাজধানী প্রত্যাগমন করিয়া পরম সুখে কালক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রাবতী শ্বশুরালয়ে আগমনকালে মদনমঞ্জরী শারিকারে নিজ সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে সর্ব্বদা আপন সমক্ষে রাখিতেন। রাজাও ক্ষণ কালের নিমিত্ত চূড়ামণিকে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত করিতেন না। এক দিবস রাজা ও রাজমহিষী অন্তঃপুরে একাসনে উপবিষ্ট আছেন এবং পিঞ্জরস্থ শুক শারিকাও তাঁহাদের সম্মুখে আছে এমন সময়ে রাজা রাজ্ঞীকে কহিলেন দেখ একাকী থাকিলে অতি কষ্টে কালযাপন হয়। অতএব আমার অভিলাষ শুকের সহিত তোমার শারিকার বিবাহ দিয়া উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখি তাহা হইলে উহারা আনন্দে কালহরণ করিতে পারিবেক। রাজ্ঞী ঈষৎ হাসিয়া অনুমোদন প্রদর্শন করিলে রাজা পরম সমাদরে শুক শারিকার বিবাহ নির্বাহ করিয়া উভয়কে এক পিঞ্জরে স্থাপিত করিলেন।
এক দিবস রাজা নির্জনে রাজমহিষীর সহিত রসপ্রসঙ্গে কালযাপন করিতেছেন এই সময়ে শুক শারিকাকে কহিতে লাগিল দেখ এই অসার সংসার মধ্যে ভোগ অতি সার পদার্থ। যে ব্যক্তি এই জগতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভোগসুখে পরাঙ্মুখ থাকে তাহার বৃথা জন্ম। অতএব কি নিমিত্ত তুমি ভোগবিষয়ে নিরুৎসাহিনী হইতেছ। শারিকা কহিল পুরুষজাতি অত্যন্ত শঠ অধর্ম্মী ও স্ত্রীহত্যাকারী এজন্য পুরুষসংসর্গে আমার রুচি হয় না। শুক কহিল নারীও অতিশয় শঠ চপলা মিথ্যাবাদিনী ও পুরুষঘাতিনী। উভয়ের এইরূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন হে শুক হে শারিকে কেন তোমরা অকারণে কলহ করিতেছ। তখন শারিকা কহিল মহারাজ পুরুষ বড় অধর্ম্মী এই নিমিত্তে পুরুষজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও অনুরাগ নাই। আমি পুরুষের ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে এক উপাখ্যান কহিতেছি শ্ররণ করুন।
ইলাপুরে মহাধন নামে অতি ঐশ্বর্য্যশালী শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বহু কাল অতীত হইল তথাপি তাঁহার পুত্ত্র হয় না এ নিমিত্ত তিনি সর্ব্বদাই মনোদুঃখে কালযাপন করেন। কিয়ৎ দিন পরে জগদীশ্বরের কৃপায় তাঁহার সহধর্ম্মিণী এক কুমার প্রসব করিলেন। শ্রেষ্ঠী অধিক বয়সে পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং পুত্ত্রের নাম নয়নানন্দ রাখিয়া অতিযত্নপূর্ব্বক লালনপালন করিতে লাগিলেন। বালক পঞ্চমবর্ষীয় হইলে তিনি তাহাকে বিদ্যাভ্যাসের নিমিত্ত উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে সমর্পণ করিলেন। সে স্বভাবদোষবশতঃ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া কেবল দুর্বৃত্ত বালকগণের সহিত কুৎসিত ক্রীড়ায় আবিষ্ট হইয়া কালযাপন করে ক্ষণমাত্রও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করে না। ফলতঃ ক্রমে ক্রমে যত বয়োবৃদ্ধি হইতে লাগিল ততই তাহার কুক্রিয়াসক্তিও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
কিয়ৎ কাল পরে শ্রেষ্ঠী পরলোক প্রাপ্ত হইলেন। নয়নানন্দ সমস্ত পৈতৃক ধনের অধিকারী হইয়া দ্যূতক্রীড়া সুরাপান আদি ব্যসনে আসক্ত হইল এবং কয়েক বৎসরের মধ্যে দুষ্ক্রিয়া দ্বারা সমস্ত ধন নষ্ট করিয়া অত্যন্ত দুর্দশায় পড়িল। পরে সে ইলাপুর পরিত্যাগপূর্ব্বক মানা দেশ ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের নিকট উপস্থিত হইল এবং স্বনাম ও পিতৃনাম উল্লেখপূর্ব্বক আত্মপরিচয় প্রদান করিল। হেমগুপ্ত তাহার পিতার পরম বন্ধু ছিলেন উহাকে পাইয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলেন এবং যথোচিত সমাদর ও প্রীতি প্রদর্শনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন বৎস তুমি কি সংযোগে অকস্মাৎ এ স্থলে উপস্থিত হইলে।
নয়নানন্দ কহিল আমি কতিপয় অর্ণবপোত লইয়া সিংহলদ্বীপে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলাম। দৈবের প্রতিকূলতা প্রযুক্ত অকস্মাৎ প্রবল বাত্যা উত্থিত হওয়াতে সমস্ত অর্ণবপোত জলমগ্ন হইল। আমি কেবল ভাগ্যবলে একফলকমাত্র অবলম্বন করিয়া বহু কষ্টে প্রাণরক্ষা করিয়াছি। এ পর্য্যন্ত আসিয়া আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব এমন আশা ছিল না। আমার সমভিব্যাহারের লোক সকল কে কোন্ দিকে গেল বাঁচিয়া আছে কি মরিয়াছে কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দ্রব্য সামগ্রী সমুদায় জলমগ্ন হইয়াছে। এ অবস্থার দেশে প্রবেশ করিতে অত্যন্ত লজ্জা হইতেছে। কি করি কোথায় যাই কোন উপায় ভাবিয়া পাই না। পরিশেষে আপনকার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।
তদীয়বাক্যাবসানে হেমগুপ্ত মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি আপন কন্যার উপযুক্ত বরের নিমিত্ত নানা স্থান অন্বেষণ করিতেছি কোথায়ও মনোনীত হইতেছে না। বুঝি ভগবান্ কৃপা করিয়া গৃহে উপস্থিত করিয়া দিলেন। এ অতিসদ্বংশজাত পৈতৃক অতুল অর্থসম্পত্তির ন্যায় পৈতৃক অতুল গুণসম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হইয়াছে সন্দেহ নাই। অতএব ত্বরায় দিন স্থির করিয়া ইহার সহিত কন্যার বিবাহ দি। মনে মনে এইপ্রকার কল্পনা করিয়া শ্রেষ্ঠিনীর নিকটে গিয়া কহিলেন দেখ এক শ্রেষ্ঠীর পুত্ত্র উপস্থিত হইয়াছে সে সৎকুলোদ্ভব। তাহার পিতার সহিত আমার অতি আত্মীয়তা ছিল। যদি তোমার মত হয় তাহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দেওয়া যায়।
শ্রেষ্ঠিনী শুনিয়া সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন ভগবানের ইচ্ছা না হইলে এরূপ ঘটে না। বিনা চেষ্টায় মনস্কাম সিদ্ধ হওয়া অতি ভাগ্যের কথা। অতএব বিলম্বের প্রয়োজন নাই ত্বরায় পুরোহিত ডাকাইয়া দিন স্থির করিয়া শুভ কর্ম্ম সম্পন্ন কর। শ্রেষ্ঠী এই রূপে ভার্য্যার সম্মতি বুঝিয়া মহাধননন্দনের নিকটে গিয়া আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল। তখন তিনি পুরোহিত ডাকাইয়া শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্দ্ধারিত করিয়া মহাসমারোহে কন্যার বিবাহ দিলেন। বর কন্যা পরম কৌতুকে কালযাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে নয়নানন্দ মনোমধ্যে কোন অসৎ অভিসন্ধি করিয়া আপন পত্নীর নিকট কহিল দেখ অনেক কাল হইল আমি স্বদেশে যাই নাই এবং বন্ধুবর্গেরও কোন সংবাদ পাই নাই। তাহাতে অন্তঃকরণে কি পর্য্যন্ত উৎকণ্ঠা জন্মিয়াছে বলিতে পারি না। অতএব তোমার পিতা মাতার মত করিয়া আমারে বিদায় করিয়া দাও। আর যদি ইচ্ছা হয় তুমিও সমভিব্যাহারে চল। পতিব্রতা রত্নাবতী আপন জননীর নিকটে গিয়া স্বামীর অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া তদ্বিযয়ের সিদ্ধির নিমিত্ত অনেক অনুরোধ করিল।
শ্রেষ্ঠিনী শুনিয়া স্বামীর সন্নিধানে গিয়া কহিলেন তোমার জামাতা গৃহে যাইতে উদ্যত হইয়াছেন। শ্রেষ্ঠী কহিলেন ভাল ভাবনা কি বিদায় করিয়া দিব। তুমি কি জান না জন জামাতা ভাগিনেয় এই তিন কোন কালে আপন হয় না ও তাহাদের উপর বল প্রকাশ চলে না। জামাতা যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন তাহাই কর্ত্তব্য। তাহাকে বল ইতিমধ্যে ভাল দিন দেখিয়া বিদায় করিয়া দিতেছি। অনন্তর আপন তনয়াকে আহ্বান করিয়া হাস্যমুখে জিজ্ঞাসিলেন বৎসে তোমার অভিপ্রায় কি শ্বশুরালয়ে যাইরে কি পিতৃগৃহে থাকিবে।
রত্নাবতী লজ্জায় নম্রমুখী ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল। অনন্তর কার্য্যান্তরব্যপদেশে তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃতা হইয়া স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল দেখ পিতা মাতা সম্মত হইয়াছেন কহিলেন তুমি যাহাতে সন্তুষ্ট হও তাহাই করিবেন। অতএব আমি তোমাকে এই অনুরোধ করিতেছি তুমি কোন ক্রমে আমাকে ছাড়িয়া যাইও না। আমি তোমার অদর্শনে প্রাণধারণ করিতে পারিব না।
পরিশেষে শ্রেষ্ঠী জামাতাকে অনেক ঐশ্বর্য্য দিয়া মহাসমাদরপূর্ব্বক বিদায় করিলেন এবং কন্যাকেও সর্ব্বালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া তাহার সমভিব্যাহারিণী করিয়া দিলেন। নয়নানন্দ সাতিশয় আনন্দিত হইয়া শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের পাদবন্দনপূর্ব্বক বিদায় লইয়া প্রস্থান করিল এবং রত্নাবতীও শিবিকারোহণ করিয়া অতি আনন্দিত মনে তাহার সঙ্গে চলিল।
অনন্তর নয়নানন্দ এক নিবিড় জঙ্গলে উপস্থিত হইয়া শ্রেষ্ঠিকন্যাকে কহিল দেখ এই অরণ্যে অত্যন্ত দস্যুভয় আছে শিবিকায় আরোহণ ও অঙ্গে অলঙ্কারধারণ করিয়া যাওয়া উচিত নহে। খুলিয়া আমার হস্তে দাও আমি বস্ত্রাবৃত করিয়া রাখি নগর নিকটবর্ত্তী হইলে পুনরায় পরিবে। আর বাহকেরাও শিবিকা লইয়া এই স্থান হইতে ফিরিয়া যাউক কেরল আমরা দুই জনে দরিদ্রবেশে গমন করি। তাহা হইলে নিরুপদ্রবে এই দুর্গম বত্ম অতিক্রম করিতে পারিব।
রত্নাবতী তৎক্ষণাৎ অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া স্বামিহস্তে সমস্ত আভরণ সমর্পণ করিল এবং দাস দাসী ও বাহকদিগকে বিদায় করিয়া দিয়া একাকিনী সেই শঠের সমভিব্যাহারিনী হইয়া চলিল। নয়নানন্দ এই রূপে মহামূল্য অলঙ্কারসমূহ হস্তগত করিয়া ক্রমে ক্রমে অরণ্যের অতি নিবিড় ও অগম্য প্রদেশে প্রবেশ করিল এবং তাদৃশ পতিপরায়ণা হিতৈষিণী প্রণয়িনীকে অন্ধকূপে নিক্ষেপপূর্ব্বক পলায়ন করিয়া স্বদেশে উপস্থিত হইল। রত্নাবতী কূপে পতিত হইয়া হা তাত হ। মতঃ বলিয়া উচ্চৈঃ স্বরে রোদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে এক পথিক তথায় উপস্থিত হইয়া তাদৃশ নিবিড় অরণ্যমধ্যে অসম্ভাবিত রোদনশব্দ শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল এবং শব্দানুসারে গমন করিয়া কূপের সমীপবর্ত্তী হইয়া তন্মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপপূর্ব্বক অবলোকন করিল এক পরম সুন্দরী নারী অশ্রুমুখী নানাপ্রকার বিলাপ করিতেছে। পথিক দর্শনমাত্র অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া সেই স্ত্রীরত্নকে পরম যত্নে কূপ হইতে উদ্ধার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল তুমি কে কি নিমিত্ত একাকিনী এই ভয়ঙ্কর কাননে আসিয়াছিলে কি প্রকারেই বা তোমার ঈদৃশী দুর্দশা ঘটিল বল।
রত্নাবতী পতিনিন্দা অতি গর্হিত বুঝিয়া প্রকৃত ব্যাপার গোপনে রাখিয়া কহিল আমি চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের কন্যা। আমার নাম রত্নাবতী। আমি আপন পতির সহিত শ্বশুরালয়ে যাইতেছিলাম। এই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র অকস্মাৎ কয়েক জন দস্যু আসিয়া প্রথমতঃ অঙ্গ হইতে সমস্ত ভূষণ এ গ্রহণপূর্ব্বক আমাকে এই কূপে ফেলিয়া দিল এবং আমার পতিকে প্রহার করিতে করিতে লইয়া গেল। এক্ষণে তাঁহার কি দশা ঘটিয়াছে কিছুই জানি না। পান্থ শুনিয়া অতিশয় আক্ষেপ করিতে লাগিল এবং অশেষপ্রকার আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক রত্নাবতীকে সঙ্গে লইয়া তাহার পিত্রালয়ে পঁহুছাইয়া দিল।
রত্নাবতী পিতা মাতার অত্যন্ত স্নেহপাত্র ছিল। তাঁহারা তাহার ঈদৃশ অসম্ভাবিত দুরবস্থা দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসিলেন বৎসে তোমার এ কি দশা ঘটিয়াছে। সে কহিল এক অরণ্যমধ্যে অকস্মাৎ চারি দিক্ হইতে অস্ত্রধারী পুরুষেরা আসিয়া বলপূর্ব্বক আমার অঙ্গ হইতে সমুদায় অলঙ্কার খুলিয়া লইল এবং তাঁহাকে যত সম্পত্তি দিয়া বিদায় করিয়াছিলে সে সমুদায়ও অপহরণ করিল। অনন্তর আমাকে এক অন্ধকূপে ফেলিয়া দিয়া তাঁহার পৃষ্ঠে যষ্টিপ্রহার করিতে করিতে কহিতে লাগিল আর কোথা কি গোপন করিয়া রাখিয়াছিস্ বাহির করিয়া দে। তখন তিনি কাতর হইয়া বিনয় করিয়া কহিলেন আমাদের নিকট যাহা ছিল সমস্ত তোমাদের হস্তগত হইয়াছে আর কিছুমাত্র নাই। তোমাদের প্রহারে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে। চরণে ধরি ও কৃতাঞ্জলি হইয়া ভিক্ষা করি ছাড়িয়া দাও। বারংবার এইপ্রকার কাতরোক্তি প্রয়োগ করিতে লাগিলেন নির্দয় দস্যুরা তথাপি তাঁহাকে বন্ধন করিয়া লইয়া গেল। তৎপরে ছাড়িয়া দিল কি মারিয়া ফেলিল কিছুই জানিতে পারি নাই। তখন তাহার পিতা কহিলেন বৎসে তুমি উৎকণ্ঠিত হইও না। আমার অন্তঃকরণে লইতেছে তোমার পতি জীবিত আছেন। চোরেরা অর্থপিশাচ অর্থ হস্তগত হইলে আর অকারণে প্রাণনাশ করে না। এই রূপে অশেষবিধ আশ্বাস ও প্রবোধ দিয়া অবিলম্বে আর একপ্রস্থ অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া দিলেন।
এ দিকে নয়নানন্দ আপন ভবনে উপস্থিত হইয়া সেই অলঙ্কার বিক্রয় দ্বারা অর্থসংগ্রহ করিয়া দিবারাত্র দ্যূতক্রীড়া ও সুরাপান দ্বারা কালক্ষেপ করিতে লাগিল এবং কিয়ৎ দিনের মধ্যেই পুনর্বার নিঃস্বভাবাপন্ন ও অন্নবস্ত্রবিহীন হইয়া মনে মনে বিবেচনা করিল আমি যে কুব্যবহার করিয়াছি তাহা শ্বশুরালয়ে কোন প্রকারেই প্রকাশ পায় নাই। অতএব কোন ছল করিয়া তথায় উপস্থিত হই। পরে দুই চারি দিন অবস্থিতি করিয়া সুযোগক্রমে কিঞ্চিৎ অপহরণ করিয়া পলাইয়া আসিব। মনে মনে এই দুই সঙ্কল্প করিয়া শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল এবং প্রবেশ করিবামাত্র সর্ব্বাগ্রে স্বীয় পত্নী রত্নাবতীর দৃষ্টিপথে পতিত হইল। পতিপ্রাণা রত্নাবতী পতিকে সমাগত দেখিয়া অন্তঃকরণে চিন্তা করিল পতি অতিদুবাচার হইলেও নারীর পরম গুরু। তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই নারী ইহলোকে ও পরলোকে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হয়। আর যে নারী কুমতিপরতন্ত্র হইয়া পরমগুরু স্বামীর কাদাচিৎক কুব্যবহারকে অপরাধ গণ্য করিয়া তাঁহার প্রতি কোন প্রকারে অশ্রদ্ধা বা অনাদর প্রদর্শন করে সে আপন ঐহিক ও পারলৌকিক সকল সুখে জলাঞ্জলি দেয়। আর ইনি কেবল ভ্রান্তিক্রমেই সেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন সন্দেহ নাই। অতএব আমি সেই সামান্য দোষ ধরিয়া অপরাধিনী হইব না। যাহা হউক ইনি এক্ষণে বিশেষ না জানিয়াই এখানে আসিয়াছেন আমাকে দেখিতে পাইলেই নিঃসন্দেহ পলায়ন করিবেন। অতএব অগ্রে ভয়ভঞ্জন করিয়া দেওয়া উচিত।
রত্নাবতী অন্তঃকরণে এই সকল আলোচনা করিয়া ত্বরায় নিকটবর্ত্তিনী হইয়া কহিল নাথ তুমি অন্তঃকরণমধ্যে কোন শঙ্কা করিও না। আমি পিতা মাতার নিকট কহিয়াছি চোরেরা অলঙ্কার গ্রহণপূর্ব্বক আমাকে কূপে নিক্ষিপ্ত করিয়া তোমাকে বন্ধন করিয়া লইয়া গিয়াছে। অতএব সে সকল কথা স্মরণ করিয়া ভীত হইবার আবশ্যকতা নাই। আমার পিতা মাতা তোমার নিমিত্ত অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত আছেন তোমাকে দেখিলে অতিশয় আহ্লাদিত হইবেন। আর তোমার স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই। এই স্থানেই অবস্থিতি কর আমি চির কাল তোমার চরণ সেবা করিব।
এইরূপ উপদেশ দিয়া রত্নাবতী প্রস্থান করিলে পর সেই ধূর্ত্ত তৎক্ষণাৎ শ্বশুরের নিকটে গিয়া প্রণাম করিল। শ্রেষ্ঠী আলিঙ্গনপূর্ব্বক আশীর্বাদ করিয়া অশ্রুপূর্ণ লোচনে গদ্গদ বচনে জামাতাকে সবিশেষ সমস্ত জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। তখন সে স্বীয় সহধর্ম্মিণীর উপদেশানুরূপ পূর্ব্বাপর কল্পিত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া পরিশেষে কহিল মহাশয় যেরূপ বিপদে পড়িয়াছিলাম তাহাতে কোন ক্রমে প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা ছিল না। কেবল জগদীশ্বরের কৃপায় ও আপনাদিগের শ্রীচরণারবিন্দের অকৃত্রিমস্নেহসম্বলিত আশীর্বাদ প্রভাবে এ যাত্রা পরিত্রাণ পাইয়াছি। যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। অধিক কি কহিব শত্রুও যেন কখন এরূপ বিপদে পতিত না হয়। ইহা কহিয়া যেন যথার্থই পূর্ব্বাবস্থা স্মরণ হইল এইপ্রকার ভান করিয়া রোদন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে হেমগুপ্তের অন্তঃকরণে অত্যন্ত অনুকম্পা জন্মিল।
রজনী উপস্থিতা হইল। পতিপ্রাণা রত্নাবতী স্বামিসমাগমসৌভাগ্যমদে মত্তা হইয়া পূর্ব্বকৃত তদীয় নৃশংস ব্যবহার বিস্মরণপূর্ব্বক তৎসহবাসসুখসম্ভোগাভিলাষে মনের উল্লাসে সর্ব্বাঙ্গে সর্ব্বপ্রকার অলঙ্কার পরিধান করিয়া শয়নাগারে প্রবেশ করিল। নয়নানন্দ কিয়ৎ ক্ষণ কৃত্রিম কৌতুকের পর নিদ্রাবেশ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন রত্নাবতী কহিল আজি তুমি পথশ্রান্ত আছ আর অধিক ক্ষণ জাগরণক্লেশ সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। শয়ন কর আমি চরণ সেবা করি। সে কহিল তুমিও শয়ন কর চরণ সেবা করিতে হইবেক না।
অনন্তর উভয়ে শয়ন করিলে ধূর্ত্ত তৎক্ষণাৎ কপট নিদ্রার আশ্রয় লইয়া নাসিকাধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। রত্নাবতীও পতিকে নিদ্রাভিভূত জানিয়া অনতিবিলম্বে নিদ্রায় অচেতন হইল। পরে সেই দুরাত্মা অবসর বুঝিয়া গাত্রোত্থানপূর্ব্বক আপন কটিদেশ হইতে এক তীক্ষ্ণধার ছুরিকা বহিষ্কৃত করিল এবং অনায়াসে সেই স্ত্রীরত্ন রত্নাবতীর কণ্ঠনালীচ্ছেদনপূর্ব্বক সমস্ত আভরণ লইয়া পলাইল।
ইহা কহিয়া শারিকা কহিল মহারাজ যাহা বর্ণনা করিলাম সমুদয় স্বচক্ষে দেখিয়াছি। তদবধি আমার পুরুষের প্রতি অভ্যন্ত অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস জন্মিয়াছে। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি পুরুষের সহিত বাক্যালাপ করিব না এবং সাধ্যানুসারে পুরুষেয় সংসর্গপরিত্যাগে যত্নবতী থাকিব। পুরুষেরা অতি ধূর্ত্ত অতি নৃশংস অতি স্বার্থপর। মহারাজ অধিক কি কহিব পুরুষসহবাস সসর্পগৃহবাস অপেক্ষাও ভয়ানক এই নিমিত্ত আর আমার পুরুষের মুখাবলোকন করিতে ইচ্ছা নাই।
রাজা শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া শুককে কহিলেন কেমন হে চূড়ামণি তুমি স্ত্রীলোককে কি নিমিত্তে ঘৃণা কর তাহার সবিশেষ বর্ণন কর।
তখন শুক কহিল মহারাজ শ্রবণ করুন।
কাঞ্চনপুর নগরে সাগরদত্ত নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। তাঁহার শ্রীদত্ত নামে সুরূপ সুশীল শান্তস্বভাব এক পুত্ত্র ছিল। অনঙ্গপুরনিবাসী সোমদত্তশ্রেষ্ঠীর কন্যা জয়শ্রীর সহিত তাহার বিবাহ হয়। কিয়ৎ দিন পরে শ্রীদত্ত বাণিজ্যার্থে দেশান্তর প্রস্থান করিল। জয়শ্রী আপন পিত্রালয়ে বাস করিতে লাগিল। দীর্ঘ কাল অতীত হইল তথাপি শ্রীদত্ত প্রত্যাগমন করিল না।
এক দিবস জয়শ্রী আপন প্রিয়বয়স্যার নিকট কহিল দেখ সখি আমার যৌবন বৃথা হইল। আজি পর্য্যন্ত সংসারের সুখ কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বলিতে কি এ রূপে একাকিনী কালহরণ করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। তুমি কোন উপায় চিন্তা কর। তখন সখী কহিল প্রিয়সখি ধৈর্য্য ধর ভগবানের ইচ্ছা হয় ভ অবিলম্বে তোমার প্রিয়সমাগম হইবেক। জয়শ্রী ইচ্ছানুরূপ উত্তর না পাইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করিল এবং তৎক্ষণাৎ অট্টালিকায় আরোহণ করিয়া গবাক্ষদ্বার দিয়া রাজপথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
দৈবযোগে সেই স্থান দিয়া এক পরম সুন্দর যুবা পুরুষ গমন করিতেছিল। ঘটনাক্রমে তাহার ও জয়শ্রীর চারি চক্ষুঃ একত্র হইবাতে উভয়েই উভয়ের মন হরণ করিল। জয়শ্রী তৎক্ষণাৎ আপন সখীকে আহ্বান করিয়া কহিল দেখ যে রূপে পার ঐ হৃদয়চোর ব্যক্তির সহিত সংঘটন করিয়া দাও। জয়শ্রীর সখী তাহার নিকটে গিয়া কথাচ্ছলে তাহার অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিল সোমদত্তের কন্যা জয়শ্রী তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান সন্ধ্যার পর তুমি আমার বাটীতে আসিবে। এই বলিয়া তাহাকে আপন গৃহ দেখাইয়া দিল। তখন সে কহিল তোমার সখীর নিকটে কহ আমি অত্যন্ত অনুগৃহীত হইলাম। অবশ্যই সায়ংকালে তোমার আবাসে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
তদনন্তর সখী জয়শ্রীর নিকটে আসিয়া সবিশেষ সমুদায় আবেদন করিলে সে অত্যন্ত আহ্লাদিতা হইল এবং তাহাকে পারিতোষিক দিয়া প্রশংসা করিয়া কহিল যদি তুমি আমাকে তাহার সহিত মিলাইয়া দিতে পার তবে আমাকে চির কালের মত কিনিয়া রাখ আমি কোন কালে তোমার এ ধার শুধিতে পারিব না। এক্ষণে তুমি আপন আলয়ে গিয়া অবস্থিতি কর সে আসিবামাত্র আমাকে সংবাদ দিবে। এই বলিয়া সখীকে বিদায় করিয়া স্বয়ং প্রিয়সমাগমোচিত বেশ ভূষা করিতে লাগিল।
শুভ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে সেই যুবা রতিপতির আদেশানুরূপ বেশ পরিগ্রহ করিয়া সখীর আলয়ে উপস্থিত হইল। সে পরম সমাদরপূর্ব্বক বসিতে আসন দিয়া জয়শ্রীর নিকটে গিয়া প্রিয়তমের উপস্থিতিসংবাদ দিল। জয়শ্রী শুনিয়া আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া কহিল সখি কিঞ্চিৎ বিলম্ব কর গৃহজন নিদ্রিত হইলেই তোমার সহিত গিয়া প্রাণনাথের হস্তে যৌবনসম্পত্তি সমর্পণ করিয়া জন্ম সার্থক করিব। অনন্তর পরিবারস্থ সমস্ত লোক নিদ্রাগত হইলে জয়শ্রী সখীর সহিত তদীয় আবাসে উপস্থিত হইয়া অননুভূতপূর্ব্ব চিরাকাঙ্ক্ষিত রসাস্বাদ দ্বারা যৌবনের চরিতার্থতা লাভ করিয়া নিশাবসানসময়ে স্বীয় আবাসে প্রত্যাগমন করিল। সে এই রূপে প্রত্যই প্রিয়সমাগমসুখে কালযাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে তাহার স্বামীও বিদেশ হইতে প্রত্যাগত হইয়া প্রথমতঃ শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল। জয়শ্রী শ্রীদত্তের সমাগমনে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল এ আপদ আবার এত দিনের পর কোথা হইতে উপস্থিত হইল। কি করি কোথায় যাই প্রাণনাথের নিকটে যাইবার ব্যাঘাত জন্মিল। কত দিন থাকিবেক কত জ্বলাইবেক তাহাও জানি না। এইরূপ চিন্তায় পড়িয়া স্নানভোজনাদি সমস্ত পরিত্যাগপূর্ব্বক বিষণ্ণ মনে সখীর সহিত নানাপ্রকার পরামর্শ করিতে লাগিল।
রজনী উপস্থিত হইলে জয়শ্রীর মাতা জামাতাকে পরম সমাদর ও যত্ন পূর্ব্বক ভোজন করাইয়া দাসী দ্বারা শয়নাগারে গিয়া বিশ্রাম করিতে কহিলেন এবং আপন কন্যাকেও পতিশুশ্রূষার্থে গমন করিতে আদেশ দিলেন। জয়শ্রী প্রথমতঃ অসম্মত হওয়াতে তাহার মাতা নানাবিধ প্রবোধবাক্য ও ভৎসনা দ্বারা নিরুত্তরা করিয়া বলপূর্ব্বক গৃহপ্রবেশ করাইলেন। তখন সে বিবশা হইয়া গৃহপ্রবেশপূর্ব্বক পল্যঙ্কে আরোহণ করিয়া বিযুক্ত মুখে শয়ন করিয়া রহিল। শ্রীদত্ত প্রণয়িনীকে সপ্রেম সম্ভাষণ করিয়া প্রীতিবাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। সে তাহাতে অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন শ্রীদত্ত তাঁহার সন্তোষ জন্মাইবার নিমিত্ত নিজানীত নানাবিধ বহুমূল্য অলঙ্কার ও পট্টশাটী প্রভৃতি কামিনীজনকমনীয় দ্রব্য প্রদান করিলে জয়শ্রী অত্যন্ত কোপপ্রকাশপূর্ব্বক তদ্দত্ত সমস্ত বস্তু দূরে নিক্ষেপ করিল। তখন শ্রীদত্ত নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া ক্ষান্ত রহিল এবং অত্যন্ত পথশ্রান্ত ছিল তৎক্ষণাৎ নিদ্রাগত হইল। জয়শ্রী পতিকে নিদ্রায় অচেতন দেখিয়া মনে মনে আহ্লাদিতা হইল এবং পতিদত্ত বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিধান করিয়া গাঢ়তর অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনীতে একাকিনী নির্ভয়ে প্রিয়তমের উদ্দেশে চলিল। সেই সময়ে এক তস্কর ঐ পথে গমন করিতেছিল। সে সর্ব্বালঙ্কারভূষিতা কামিনীকে অর্দ্ধরাত্র সময়ে একাকিনী গমন করিতে দেখিয়া বিবেচনা করিতে লাগিল এই যুবতী অসহায়িনী হইয়া নিশীথ সময়ে নির্ভয়ে কোথায় যাইতেছে। যাহা হউক সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইল। এই বলিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।
এ দিকে জয়শ্রীর প্রিয় সখা সখীর আলয়ে একাকী শয়ন করিয়া তাহার আগমনপ্রতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতেছিল। দৈবযোগে এক কালসর্প আসিয়া দংশিয়া তাহার প্রাণসংহার করিয়া গেল। সে মৃত পতিত রহিল। জয়শ্রী তথায় উপস্থিত হইয়া মৃত প্রিয়তমকে কপটনিদ্রিত বোধ করিয়া নামগ্রহণপুরঃসর আহ্বান করিতে লাগিল কিন্তু কোনপ্রকার উত্তর না পাইয়া মনে মনে বিবেচনা করিল আমার আসিতে বিলম্ব হওয়াতে অভিমানে উত্তর দিতেছে না। অনন্তর তাহার পার্শ্বে শয়ন করিয়া প্রিয়সম্ভাষণপূর্ব্বক বারংবার আহ্বান করিতে আরম্ভ করিল। চোরও কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া সহাস্য আস্যে এই রহশ্য দর্শন করিতে লাগিল। নিকটবর্ত্তী বটবৃক্ষবাসী এক পিশাচও ঐ কৌতুক দেখিতেছিল। সে মনে মনে কল্পনা করিল এই সুযোগে এই দুশ্চরিত্রাকে সমুচিত দণ্ড দিতে হইল। এই বলিয়া তদীয় প্রিয়তমের মৃত শরীরে আবির্ভূত হইয়া দন্ত দ্বারা জয়শ্রীর নাসিকাচ্ছেদনপূর্ব্বক পুনরায় আপন আবাসবৃক্ষে আরোহণ করিল। চোর এই সমস্ত অবলোকন করিয়া চমৎকৃত হইতে লাগিল।
জয়শ্রীর জ্ঞানোদয় হইল। সে তৎক্ষণাৎ প্রিয়তমকে মৃত নিশ্চয় করিয়া সখীর নিকটে আসিয়া পূর্ব্বাপর সমস্ত বর্ণন করিয়া কহিল সখি আমি অকস্মাৎ এই আপদে পড়িয়াছি কি উপায় করি বল। গৃহে গিয়া পিতা মাতার নিকট মুখ দেখাইতে পারিব না। তাঁহারা কারণ জিজ্ঞাসিলে কি উত্তর দিব। বিশেষতঃ আজি আবার সেই সর্ব্বনাশিয়া আসিয়াছে সেই বা দেখিয়া শুনিয়া কি মনে করিবেক। সখি তুমি আমাকে বিষ আনিয়া দাও খাইয়া প্রাণত্যাগ করে তাহা হইলেই সকল আপদ্ ঘুচিয়া যায়। এই বলিয়া শিরে করাঘাত করিতে লাগিল। সখী শুনিয়া বিস্ময়াপন্না ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল।
কিয়ৎ ক্ষণ পরেই জয়শ্রী আপন উৎপন্নমতিত্ববলে এক উপায় স্থির করিয়া কহিল সখি আর চিন্তা নাই উত্তম উপায় স্থির করিয়াছি শুন দেখি সঙ্গত হয় কি না। আমি এই অবস্থায় গৃহে গিয়া শয়নমন্দিরে প্রবেশপূর্ব্বক চীৎকার করিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করি। গৃহজন রোদনশব্দে জাগরিত হইয়া কারণজিজ্ঞাসার্থ উপস্থিত হইলে কহিব আমার স্বামী ক্রোধে অন্ধ হইয়া বিনা অপরাধে বহু প্রহার করিয়া পরিশেষে নাসিকাচ্ছেদন করিয়া দিলেন। সখী কহিল উত্তম যুক্তি হইয়াছে ইহাতে সকল দিক্ রক্ষা পাইবেক। অতএব অবিলম্বে গৃহে গিয়া এইরূপ কর।
জয়শ্রী সত্বর হইয়া গৃহে গিয়া শয়নাগারে প্রবেশপূর্ব্বক উচ্চৈঃ স্বরে রোদন করিতে লাগিল। গৃহজন ক্রন্দনধ্বনিশ্রবণে ব্যাকুল হইয়া জয়শ্রীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিল তাহার নাসিকা নাই সমস্ত গাত্র ও বস্ত্র শোণিতে অভিষিক্ত হইয়াছে এবং সে নিজে ভূতলে পতিত হইয়া রোদন করিতেছে। অনন্তর বারংবার হেতু জিজ্ঞাসা করাতে জয়শ্রী আপন স্বামীর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ কহিল ঐ দুর্বৃত্ত দস্যু আমার এই দুর্দশা করিয়াছে। তখন সমস্ত পরিবার একবাক্য হইয়া শ্রীদত্তকে অশেষপ্রকার তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিল।
সুশীল শ্রীদত্ত পূর্ব্বাপর কিছুই জানে না। অকস্মাৎ এতাদৃশ বিরুদ্ধ বাক্য শ্রবণে চমৎকৃত হইয়া মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল আমি সবিশেষ না জানিয়া শ্বশুরালয়ে আসিয়া অতি গর্হিত কর্ম্ম করিয়াছি। ইহাকে অতি দুশ্চরিত্রা দেখিতেছি। প্রথমতঃ শত শত চাটু বচনেও আলাপ করে নাই এক্ষণে অনায়সে মিথ্যাপবাদ দিতেছে। এই নিমিত্তই নীতিজ্ঞেরা কহিয়াছেন যে মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক দেবতারাও স্ত্রীলোকের চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যের কথা বুঝিতে পারেন না। জানি না পরিশেষে কি বিপদ্ ঘটিবেক। ইত্যাদি নানাবিধ চিন্তা করিয়া মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক অধোমুখ হইয়া রহিল।
পর দিন প্রভাত হইবামাত্র জয়শ্রীর পিতা রাজদ্বারে সংবাদ দিয়া জামাতাকে বিচারালয়ে নীত করিল। রাজ। বাদী ও প্রতিবাদী উভয় পক্ষকে পরস্পর সম্মুখবর্ত্তী করিয়া প্রথমতঃ জয়শ্রীকে জিজ্ঞাসিলেন কে তোমার এ দুর্দশা করিয়াছে বল আমি তাহার সমুচিত দণ্ডবিধান করিতেছি। তখন জয়শ্রী পতি প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল মহারাজ ইনি আমার স্বামী ইহাঁ হইতেই আমার এই দুর্দশা ঘটিয়াছে। অনন্তর রাজা শ্রীদত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কি নিমিত্ত এমন দুষ্কর্ম্ম করিলে। সে কহিল মহারাজ আমি এ বিষয়ের বিন্দু বিসর্গও জানি না ইহাতে আপনকার বিচারে যেরূপ ব্যবস্থা হয় করুন। এই বলিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া অধোমুখে দণ্ডায়মান রহিল।
রাজা বাদী প্রতিবাদীর বাক্য পর্যালোচনা করিয়া পরিশেষে ঘাতকদিগকে ডাকাইয়া শ্রীদত্তকে শূলে দিতে আদেশ করিলেন। চোর পূর্ব্বাপর সমস্ত ব্যাপার অত্যন্ত সতর্কতাপূর্ব্বক দেখিতেছিল। সে অকারণে এক ব্যক্তির প্রাণবধের উপক্রম দেখিয়া রাজার সম্মুখে আসিয়া নিবেদন করিল মহারাজ সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া বিনা অপরাধে এক ব্যক্তির প্রাণদণ্ড করিতেছেন। আপনি ধর্ম্মাবতার যথার্থ বিচার করুন ব্যভিচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।
রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন এবং সবিশেষ জিজ্ঞাসাপূর্ব্বক তথ্যানুসন্ধান করিয়া লোক দ্বারা জয়শ্রীর মৃত পতিত প্রিয়তমের বক্ত্রমধ্য হইতে তদীয় ছিন্ন নাসিকা আনাইয়া দেখিলেন। তখন চোরকে যথার্থবাদী ও শ্রীদত্তকে নিরপরাধী বোধ করিয়া উভয়কে পারিতোষিক প্রদানপূর্ব্বক বিদায় করিলেন এবং জয়শ্রীর মস্তকমুণ্ডন ও তাহাতে তক্রসেচন তৎপরে তাহাকে গর্দ্দভে আরোহণ ও নগরে পরিভ্রমণ করা ইয়া আপন অধিকার হইতে বহিষ্কৃত করাইয়া দিলেন। এই বলিয়া চূড়ামণি কহিল মহারাজ নারী এইরূপ গুণে পরিপূর্ণা হয়।
উপক্রান্ত উপাখ্যান সমাপন করিয়া বেতাল জিজ্ঞাসিল মহারাজ নয়নানন্দ ও জয়শ্রী এই উভয়ের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি অধিক পাপী। রাজা কহিলেন আমার মতে দুই সমান।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।