বেতালপঞ্চবিংশতি/দ্বাদশ উপাখ্যান
দ্বাদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ
চূড়াপুরে দেবস্বামী নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি রূপে রতিপতি বিদ্যায় বৃহস্পতি ও ঐশ্বর্য্যে ধনপতি ছিলেন। কিয়ৎ দিন পরে দেবস্বামী লাবণ্যবতী নামে এক গুণবতী ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করিয়া আনিলেন। ঐ কন্যা রূপলাবণ্যে ভুবনবিখ্যাত ছিল। উভয়ে প্রণয়ে কালষাপন করিতে লাগিলেন।
একদা বিপ্রদম্পতী গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব প্রযুক্ত অট্টালিকার উপরিভাগে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন। সেই সময়ে এক গন্ধর্ব্ব বিমানারোহণে আকাশপথে ভ্রমণ করিতেছিল। দৈবযোগে বিপ্রকামিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে সে তাহার রূপে মোহিত হইল এবং বিমান কিঞ্চিৎ অবতীর্ণ করিয়া নিদ্রাম্বিতা লাবণ্যবতীকে লইয়া পলায়ন করিল।
কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেবস্বামী স্বীয় প্রেয়সীকে পার্শ্ববর্ত্তিনী না দেখিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া ইতস্ততঃ বিস্তর অন্বেষণ করিতে লাগিলেন কিন্তু কোন সন্ধান না পাইয়া সাতিশয় বিষণ্ণ ভাবে নিশা যাপন করিলেন। পর দিন প্রভাত হইবামাত্র তিনি অতিমাত্র ব্যগ্র ও চিন্তাকুল চিত্তে পুনরায় বিশেষ করিয়া অশেষপ্রকার অনুসন্ধান করিলেন। পরিশেষে নিতান্ত নিরাশ্বাস ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া সংসারাশ্রম পরিত্যাগপূর্ব্বক সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।
এক দিবস দেবস্বামী দিবা দ্বিপ্রহরের সময় অতিশয় ক্ষুধার্ত্ত হইয়া এক ব্রাহ্মণের আলয়ে অতিথি হইলেন এবং কহিলেন আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছি কিছু ভোজনীয় দ্রব্য দিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর। গৃহস্থ ব্রাহ্মণ তৎক্ষণাৎ এক পাত্র দুগ্ধে পরিপূর্ণ করিয়া অতিথি ব্রাহ্মণের হস্তে ভক্ষণার্থে সমর্পণ করিলেন। গৃহস্থ ব্রাহ্মণের গ্রহবৈগুণ্য প্রযুক্ত পূর্ব্বে এক কৃঞ্চসর্প ঐ দুগ্ধে মুখার্পণ করাতে তাহা অত্যন্ত বিষাক্ত হইয়া ছিল। পান করিবামাত্র সেই বিষ সর্ব্বাঙ্গব্যাপী হইয়া অতিথি ব্রাহ্মণকে ক্রমে ক্রমে কাতর ও অচেতন করিতে লাগিল। তখন তিনি গৃহস্থ ব্রাহ্মণকে তুমি বিষভ ক্ষণ করাইয়া ব্রহ্মহত্যা করিলে ইহা কহিয়া ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। ব্রাহ্মণ অকস্মাৎ ব্রহ্মহত্যা দেখিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলেন এবং বাটীর মধ্যে প্রবেশিয়া আপন পত্নীকে তুই দুগ্ধ বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছিলি তাহাতেই ব্রহ্মহত্যা হইল তুই অতি দুর্বৃত্তা আর ভোর মুখাবলোকন করিব না ইত্যাদি নানাপ্রকার তিরস্কার ও বহু প্রহার করিয়া গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।
ইহা কহিয়া বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ এই স্থলে কোন্ ব্যক্তি দোষভাগী হইবেক। রাজা কহিলেন সর্পের মুখে স্বাভাবিক বিষ থাকে সুতরাং সে দোষী হইতে পারে না। আর গৃহস্থ ব্রাহ্মণ ও তাঁহার ব্রাহ্মণী সেই দুগ্ধকে বিষাক্ত বলিয়া জানিতেন না সুতরাং তাঁহারাও ব্রহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইবেন না। আর অতিধি ব্রাহ্মণ সবিশেষ না জানিয়া পান করিয়াছেন অতএব তিনিও আত্মঘাতী নহেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ যে সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া অকারণে নিরপরাধা সহধর্ম্মিণীকে পরিত্যাগ করিলেন তাহাতে তিনি অকারণপরিত্যাজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইতাদি।