বেতালপঞ্চবিংশতি/প্রথম উপাখ্যান
প্রথম উপাখ্যান
বেতাল কহিল মহারাজ শ্রবণ কর
বারাণসী নগরীতে প্রতাপমুকুট নামে এক প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবীনাম্নী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে নন্দন ছিল। এক দিবস রাজকুমার অমাত্যপুত্ত্রকে সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ায় গমন করিলেন। ক্রমে ক্রমে নানা ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে কোন নিবিড় অরণ্যানী প্রবেশপূর্ব্বক তন্মধ্যবর্ত্তী পরম রমণীয় সুশোভিত সরোবর সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন ঐ সরসীর তীরে হংস বক চক্রবাক সারস প্রভৃতি নানাবিধ জলচর পক্ষিগণ কলরব করিতেছে। প্রফুল্ল কমলসমূহের সৌরভে চারি দিক্ আমোদিত হইয়া আছে। মধুকরেরা মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া গুন্ গুন্ ধ্বনি করত ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছে। তীরস্থিত তরুগণ অভিনব পল্লব ফল কুসুম সমূহে সুশোভিত আছে। তাহাদিগের ছায়া অতিস্নিগ্ধ বিশেষতঃ শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার দ্বারা পরম রমণীয় হইয়া আছে। তথায় প্রবেশমাত্রেই শ্রান্ত ও আতপতাপিত ব্যক্তির ক্লান্তি দূর হয়। ঐ সরসীর চারি দিকে চারি প্রস্তরময় ঘাট ছিল রাজকুমার অন্যতম দ্বারা অবতীর্ণ হইয়া হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিলেন।
অনতিদূরে এক মহাদেবের মন্দির ছিল। বজ্রমুকুট সমীপবর্ত্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ব বন্ধনপূর্ব্বক মন্দিরমধ্যে প্রবেশ ও দর্শনপ্রণামাদি করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন। ঐ সময়মধ্যে এক রাজকন্যাও স্বীয় সহচরীবর্গের সহিত সেই সরোবরের অপর পারে উপস্থিত হইয়া স্নান পূজা সমাপনপূর্ব্বক বৃক্ষের ছায়াতে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। দৈবযোগে তাঁহার ও নৃপতনয়ের চারি চক্ষু একত্র হইল। তদীয় নিৰুপম সৌন্দর্য্য সন্দর্শনে নৃপনন্দন মোহিত হইলেন। রাজপুত্ত্রীয় নৃপকুমারকে নয়নগোচর করিয়া কৃতার্থম্মন্যা হইয়া শিরঃস্থিত পদ্ম হস্তে লইলেন। অনন্তর কর্ণসংযুক্ত করিয়া দন্ত দ্বারা ছেদনপূর্ব্বক পদতলে নিক্ষেপ করিলেন। পুনর্বার গ্রহণ ও হৃদয়ে স্থাপন করিয়া বারংবার রাজতনয়ের প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে স্বীয় প্রিয়বয়স্যাগণের সহিত স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।
কুমারী ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে রাজকুমার বিরহবেদনায় অতিশয় ব্যাকুল হইলেন এবং সর্ব্বাধিকারিকুমারের নিকটে আসিয়া লজ্জানম্র মুখে কহিতে লাগিলেন মিত্র আজি আমি এক পরম সুন্দরী রমণী নিরীক্ষণ করিয়াছি। তাহার নাম ধাম কিছুই জানিতে পারি নাই। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি তাহাকে না পাইলে প্রাণত্যাগ করিব। আমাত্যপুত্ত্র সমস্ত শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে গৃহে প্রত্যানয়ন করিলেন। রাজকুমার দুঃসহ বিরহবেদনায় নিতান্ত অধীর হইয়া শাস্ত্রচিন্তা সদালাপ রাজকার্য্যপর্য্যালোচনা ও আবশ্যক স্নানভোজনাদি ক্রিয়া পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া একাকী নির্জনে বিষণ্ণ মনে কালযাপন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে চিত্তবিনোদনের কোন উপায় না দেখিয়া স্বহস্তে সেই কামিনীর প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করিলেন। দিন যামিনী কেবল সেই প্রতিমূর্ত্তি সন্দর্শন করেন। কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলেও উত্তর দেন না। সর্ব্বাধিকারিপুত্ত্র নৃপনন্দনের তাদৃশী দশা নিরীক্ষণ করিয়া উপদেশচ্ছলে অশেষপ্রকার ভর্ৎসনা করিলেন।
প্রিয় বয়স্যের উপদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজকুমার কহিলেন সখে আমি যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিয়াছি তখন আমার হিতাহিত চিন্তা ও সুখ দুঃখ বিবেচনা নাই। নিশ্চয় করিয়াছি মনোরথ সম্পন্ন না হইলে জীবন পরিত্যাগ করিব। বন্ধুর এইরূপ বাক্য শুনিয়া অমাত্যকুমার মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন আর এখন উপদেশ দ্বারা ধৈর্য্যসম্পাদনের সময় নাই। এ নিতান্ত অধীর হইয়াছে। অতঃপর কোন উপায় চিন্তা করা উচিত। এইরূপ নিশ্চয় করিয়া কুমারকে জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য প্রস্থানকালে সেই সীমন্তিনী তোমাকে কিছু কহিয়াছিল কিংবা তুমি তাহাকে কিছু কহিয়াছিলে। রাজপুত্ত্র কহিলেন না বয়স্য আমি তাহাকে কিছু কহি নাই এবং সেই সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরীও আমাকে কোন কথা কহে নাই। তখন অমাত্যপুত্ত্র কহিলেন তবে তাহার সমাগম দুঃসাধ্য বোধ হইতেছে। রাজপুত্ত্র কহিলেন যদি সেই সুলোচনা লোচনানন্দদায়িনী না হয় আমি প্রাণত্যাগ করিব। তখন তিনি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া পুনরায় কহিলেন ভাল বয়স্য জিজ্ঞাসা করি প্রস্থানসময়ে সে কোন সঙ্কেত করিয়াছিল কি না।
রাজকুমার কমলবৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। তখন অমাত্যপুত্ত্র কহিলেন সথে আর চিন্তা নাই আমি তৎকৃত সঙ্কেতের তাৎপর্য্যাগ্রহ করিয়াছি এবং তাহার নাম ধান জানিতে পারিয়াছি। এখন প্রতিজ্ঞা করিতেছি অল্পকালমধ্যেই তাহার সহিত সমাগম সম্পন্ন করিয়া দিব। অধিক ব্যাকুল হইলেই অভীষ্টসিদ্ধি হয় না ধৈর্য্য অবলম্বন কর। তখন রাজপুত্ত্র কহিলেন যদি বুঝিয়া থাক সমুদায় বিশেষ করিয়া বর্ণন কর শুনিলেও আপাততঃ স্থির হইতে পারি। তিনি কহিলেন বয়স্য শ্রবণ কর পদ্মপুষ্প মস্তক হইতে নামাইয়া কর্ণে সংলগ্ন করিয়াছিল তদ্দ্বারা তোমাকে এই কহিয়াছে আমি কর্ণাটনগরনিবাসিনী। দন্ত দ্বারা খণ্ডন করিয়া ইহা ব্যক্ত করিয়াছে আমি দন্তবাট রাজার কন্যা। তৎপরে পদতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া এই সঙ্কেত করিয়াছে আমার নাম পদ্মাবতী। আর হৃদয়ে স্থাপন করিয়া এই অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছে তুমি আমার হৃদয়বল্লভ।
বয়স্যের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কুমার অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন এবং ব্যগ্র হইয়া বারংবার কহিতে লাগিলেন বয়স্য ত্বরায় আমাকে কর্ণাট নগরে লইয়া চল। অনন্তর উভয়ে সমুচিত পরিচ্ছদ পরিধান ও অস্ত্র বন্ধনপূর্ব্বক অশ্বারোহণ করিলেন। কতিপয় দিবসের পরে কর্ণাট নগরে উপস্থিত হইয়া তাঁহারা রাজবাটীর নিকটে গিয়া দেখিলেন এক বৃদ্ধা আপন ভবনদ্বারে উপষিষ্টা আছে। উভয়ে অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া তাহার নিকটে গিয়া কহিলেন মা আমরা বাণিজ্যব্যবসায়ী বিদেশীয় লোক। দ্রব্যসামগ্রী সমগ্র পশ্চাৎ আসিতেছে। বাসা অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমরা অগ্রসর হইয়াছি। যদি কৃপা করিয়া স্থান দাও তবে থাকিতে পাই। বৃদ্ধা তাহাদিগের মনোহর রূপদর্শনে ও মধুর আলাপ শ্রবণে প্রীত হইয়া প্রসন্ন মনে কহিল এ তোমাদের গৃহ যত দিন ইচ্ছা সচ্ছন্দে অবস্থিতি কর।
এই রূপে উভয়ে সেই বর্ষীয়সীর সদনে আবাসগ্রহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বৃদ্ধা তাঁহাদের সন্নিধানে আগমন করিয়া কথোপকথন আরম্ভ করিলে সর্ব্বাধিকারিপুত্ত্র জিজ্ঞাসা করিলেন মা কয় জন তোমার পরিবার আর কি প্রকারে বা নির্বাহ হয়। বৃদ্ধা কহিল আমার পুত্ত্র রাজসংসারে কর্ম্ম করে রাজার অতি প্রিয় পাত্র। আর পদ্মাবতী নামে রাজার এক কন্যা আছেন আমি তাঁহার ধাত্রী ছিলাম। এক্ষণে বৃদ্ধা হইয়াছি গৃহে থাকি কিন্তু রাজা অনুগ্রহ করিয়া অন্ন বস্ত্র প্রদান করেন। আর রাজকন্যা অত্যন্ত ভাল বাসেন এজন্য প্রতিদিন এক এক বার তাঁহাকে দেখিতে যাই। ইহা শুনিয়া রাজপুত্ত্র কহিলেন কল্য যাইবার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া যাইবে আমি রাজকন্যার নিকট কোন সংবাদ পাঠাইব। বৃদ্ধা কহিল যদি প্রয়োজন থাকে বল আজিই আমি রাজকন্যাকে জানাইয়া আসি। তখন রাজকুমার হৃষ্ট হইয়া কহিলেন তুমি রাজকন্যাকে কহিবে জ্যৈষ্ঠশুক্লপঞ্চমীতে সরোবরের তীরে যে রাজপুত্ত্রকে দেখিয়াছিলে সে তোমার সঙ্কেতানুসারে উপস্থিত হইয়াছে। এই বাক্য কর্ণগোচর হইবামাত্র বৃদ্ধা যষ্টি গ্রহণপূর্ব্বক রাজভবনে গমন করিল। কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিল রাজকন্যা একাকিনী নির্জনে উপবিষ্টা আছেন। বৃদ্ধা সম্মুখবর্ত্তিনী হইবামাত্র রাজকন্যা সমাদরপূর্ব্বক বসিতে আসন প্রদান করিলেন। সে উপবিষ্টা হইয়া কহিল বৎসে বাল্যকালে অনেক যত্নে তোমাকে মানুষ করিয়াছি। এক্ষণে ভগবানের অনুগ্রহে তুমি তৰুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার অন্তঃকরণের অভিলাষ এই উপযুক্ত পাত্রের হস্তগতা হও। এইরূপ আড়ম্বরপূর্ব্বক ভূমিকা করিয়া কহিতে লাগিল জ্যৈষ্ঠশুক্লপঞ্চমীতে বাপীতটে যে রাজকুমারের মন হরণ করিয়া আনিয়াছিলে তিনি আমার গৃহে উত্তীর্ণ হইয়াছেন এবং আমার দ্বারা এই সংবাদ পাঠাইয়াছেন যে কমলসঙ্কেতে আমার নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে তাহা পূর্ণ কর আমি উপস্থিত হইয়াছি। আর আমিও কহিতেছি এই রাজপুত্ত্র তোমার যোগ্য বর তুমি যেরূপ রূপবতী সে ব্যক্তিও তদনুরূপ বটে।
রাজকন্যা শ্রবণমাত্র কোপ প্রকাশ করিয়া হস্তে চন্দন লেপনপূর্ব্বক বৃদ্ধার উভয় গণ্ডে চপেটাঘাত করিলেন এবং কহিলেন তুমি অতি ত্বরায় আমার অন্তঃপুর হইতে দূর হও। বৃদ্ধা এইপ্রকার তিরস্কার লাভ করিয়া বিরক্ত হইয়া বিষণ্ণ বদনে সদনে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক রাজকুমারের নিকটে পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিল। তিনি শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যাকূল ও হতাশ্বাস হইয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক পার্শ্ববর্ত্তী প্রিয় বয়স্যের প্রতি কহিতে লাগিলেন সখে এখন কি উপায় করি। নিতান্ত বুঝিলাম বিধি বাম হইয়াছে মনস্কামসিদ্ধির কোন সম্ভাবনা বোধ হইতেছে না। নতুবা সেই বামলোচনা কি নিমিত্ত তিরস্কার করিয়া বৃদ্ধাকে বিদায় করিল। অন্তঃকরণে প্রণয়সঞ্চার থাকিলে দূতীর প্রতি এত অনাদর হয় না। তখন তিনি কহিলেন বয়স্য মর্ম্মগ্রহ না করিয়া কেন অকারণে এত ব্যাকুল হও। শ্রীখণ্ডরসাভিষিক্ত দশ করশাখা প্রহারের তাৎপর্য্য এই যে শুক্ল পক্ষের দশ দিবস অবশিষ্ট আছে তদবসানে অন্ধকার পক্ষে তোমার সহিত সমাগম হইবেক।
শুক্ল পক্ষ অতিক্রান্ত হইল। বৃদ্ধা পুনর্বায় রাজকুমারীর নিকটে গিয়া কুমারের প্রার্থনা জানাইল। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত কোপ প্রকাশ করিলেন এবং গলহস্ত প্রদানপূর্ব্বক বৃদ্ধাকে অন্তঃপুরের খড়ক্কী দিয়া বাহির করিয়া দিলেন। সে তৎক্ষণাৎ রাজকুমারের নিকটে আসিয়া এই বৃত্তান্ত জানাইল। তিনি শুনিয়া নিরাশ্বাস হইয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। তখন সর্ব্বাধিকারীর পুত্ত্র কহিলেন বয়স্য কেন উৎকণ্ঠিত হইতেছ আর ভাবনা নাই। এ অনুকূল গলহস্ত অপ্রশস্ত নহে। তুমি পূর্ণমনোরথ হইয়াছ। অদ্য রজনীযোগে তোমাকে সেই দ্বার দিয়া তাহার অন্তঃপুরে যাইতে সঙ্কেত করিয়াছে। রাজপুত্ত্র আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া দিবাবসানপ্রতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
প্রদোষকাল উপস্থিত হইলে রাজকুমার বিহারযোগ্য বেশ ভুষা সমাধান করিয়া প্রিয় বয়স্যের সহিত অর্দ্ধরাত্র সময়ে নির্দ্ধারিত দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। সর্ব্বাধিকারীর পুত্ত্র দ্বারের বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিলেন তিনি তন্মধ্য দিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন রাজকুমারী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। নয়নে নয়নে সঙ্গতি হওয়াতে উভয়ে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলেন। রাজকন্যা পার্শ্ববর্ত্তিনী বয়স্যার প্রতি দ্বাররোধের আদেশ দিয়া রাজকুমারের কর গ্রহণপূর্ব্বক বিলাসভবনে প্রবেশ করিলেন এবং সুশোভিত স্বর্ণময় পল্যঙ্কে উপবেশনানন্তর বল্লভের কণ্ঠদেশে স্বহস্তসঙ্কলিত ললিত মালতীমালা সমর্পণ করিয়া স্বয়ং তালবৃন্ত সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।
তখন রাজকুমার কহিলেন প্রিয়ে তোমার বদনসুধাকরসন্দর্শনেই আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইয়াছে আর এরূপ পরিশ্রম স্বীকারের প্রয়োজন নাই। বিশেষতঃ তোমার কোমল করপল্লব শিরীষকুসুম অপেক্ষাও সুকুমার কোন ক্রমেই তালবৃন্তধারণের যোগ্য নহে। আমার হস্তে প্রদান কর আমি তোমার সেবা দ্বারা শ্রম সফল করি। পদ্মাবতী কহিলেন নাথ আমার নিমিত্ত তোমার অনেক পরিশ্রম ও ক্লেশ হইয়াছে অতএব তোমার সেবা করাই আমার উচিত হয়। উভয়ের এইরূপ বচনবৈদগ্ধী শ্রবণ করিয়া পার্শ্ববর্ত্তিনী সখী পদ্মাবতীর করতল হইতে তালবৃন্ত গ্রহণপূর্ব্বক বায়ু সঞ্চালন করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে উভয়ের সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব দেখিয়া সহচরীগণ কার্য্যান্তরব্যপদেশে গৃহ হইতে বহির্গত হইলে কান্ত ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন করিলেন।
রজনী অবসন্ন হইল। কুমার অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার মানস প্রকাশ করিলেন। তখন কুমারী কহিলেন নাথ আমার এই অন্তঃপুরে সখীগণ ব্যতিরেকে অন্যের প্রবেশাধিকার নাই তুমি নির্ভয়ে অবস্থিতি কর। আমি তোমাকে বিদায় দিয়া ক্ষণমাত্রও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। রাজকুমার প্রিয়তমার এতাদৃশ প্রণয়রসাভিষিক্ত মৃদুমধুর বচনপরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিয়া তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং তাহার সহচর হইয়া পরম সুখে নানা কৌতুকে কালযাপন করিতে লাগিলেন। এই রূপে কতিপয় দিবস অতীত হইলে রাজকুমার নিজ রাজধানী গমনের অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। রাজকন্যা কোন ক্রমেই সম্মত হইলেন না। ক্রমে ক্রমে প্রায় মাস অতীত হইল রাজকুমার তথাপি অনুমতি লাভ করিতে পারিলেন না। এখানে রাজা প্রতাপমুকুট এতাবৎ দিবস পর্য্যন্ত প্রাণাবিকপ্রিয় পুত্ত্রের কোন উদ্দেশ না পাইয়া শোকাকুল হইয়া দেশ বিদেশ অন্বেষণ করিতে দূত প্রেরণ করিলেন। রাজপুত্ত্র গমনবিষয়ে নিতান্ত নিৰুপায় হইয়া একান্ত চিন্তাকুল হইলেন। এক দিবস তিনি নির্জনে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন আমি অকিঞ্চিৎকর ইন্দ্রিয়সুখপরতন্ত্র হইয়া পিতা মাতা আত্মীয়গণ জন্মভূমি প্রভৃতি সকল পরিত্যাগ করিলাম। আর যে জীবিতাধিক বান্ধবের বুদ্ধিকৌশলে ঈদৃশ অসুলভ সুখসম্ভোগে কালহরণ করিতেছি মাসাবধি তাঁহারও কোন সংবাদ লইলাম না। বোধ করি বন্ধু আমারে স্বার্থপর ও অকৃতজ্ঞ ভাবিতেছেন।
রাজকুমার একাকী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন এমন সময়ে রাজকন্যা অকস্মাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে উৎকণ্ঠিত দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন নাথ আজি কি নিমিত্ত তুমি এমন বিমনা হইয়াছ। তোমার চন্দ্রবদন বিষণ্ণ দেখিলে আমি দশ দিক্ শূন্য দেখি। অসুখের কারণ বল ত্বরায় তাহার প্রতীকার করিতেছি। বজ্রমুকুট কহিলেন পিতার সর্ব্বাধিকারীর পুত্ত্র আমার সহচর হইয়া আসিয়াছেন। তিনি আমার পরম মিত্র মাসাবধি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ নহি এবং তৎসম্পর্কীয় কোন বার্ত্তাও শুনিতে পাই নাই জানি না কিপ্রকার আছেন। তিনি অতি চতুর সর্ব্বশাস্ত্রে পণ্ডিত ও নানা গুণরত্নে মণ্ডিত। তাঁহার বুদ্ধিকৌশলেই তোমার সমাগম লাভ করিয়াছি এবং এতাবৎ দিবস পর্য্যন্ত এই বাক্পথাতীত সুখসম্ভোগে কালহরণ করিতেছি। তিনিই তোমার সমুদায় সঙ্কেভের মর্ম্মোদ্ভেদ করিয়াছেন।
পদ্মাবতী কহিলেন অয়ি নাথ এরূপ বন্ধুর অদর্শনে চিত্ত অবশ্যই উৎকণ্ঠিত হইতে পারে। এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত তাঁহার কোন সংবাদ লওয়ায় তোমার অতি অভদ্রতা প্রকাশ হইয়াছে। রহস্যবিদ বন্ধু প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় হয়। বিবেচনা করিয়া দেখিলে তুমি তাঁহার নিকট অত্যন্ত অপরাধী হইয়াছ ও যার পর নাই, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছ। যাহা হউক এক্ষণে কর্ত্তব্য এই তাঁহার পরিতোষ জন্য আমি নানাবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া পাঠাই এবং তুমিও কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত তথায় গিয়া সমুচিত সদ্ভাব প্রদর্শন করিয়া আইস। রাজপুত্ত্র তৎক্ষণাৎ সেই গুপ্ত দ্বার দিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলেন এবং বহু দিবসের পর অকপটপ্রণয়পবিত্র মিত্র সহ সাক্ষাৎকারলাভে অশ্রুপূর্ণলোচন হইয়া তাঁহার নিকট অদর্শনদিনাবধি পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন।
রাজপুত্ত্রকে বন্ধুদর্শনে প্রেরণ করিয়া রাজকন্যা মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন এ কেবল বন্ধুর বুদ্ধিকৌশলেই কৃতকার্য্য হইয়াছে অতএব অবশ্যই সকল কথা তাহার নিকট ব্যক্ত করিবেক। আর সে ব্যক্তিও তাহার অন্যান্য বান্ধবের নিকট প্রকাশ করিবেক সন্দেহ নাই। এই রূপে আমার অযশ ক্রমে ক্রমে জগদ্ব্যাপ্ত হইবার সম্ভাবনা। অতএব এমন ব্যক্তিকে জীবিত রাখা কোম ক্রমেই উপযুক্ত নহে। এইরূপ ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ নানাবিধ বিষমিশ্রিত মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া সখী দ্বারা পাঠাইয়া দিলেন।
মিষ্টান্ন উপনীত হইলে মন্ত্রিপুত্ত্র জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য এ সকল কি। রাজপুত্ত্র বলিলেন মিত্র অদ্য আমি তোমার নিমিত্ত অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। রাজকন্যা আমার দিকে দৃষ্টিপতি করিয়া কারণজিজ্ঞাসু হইলে আমি তোমার অশেষবিধ প্রশংসা করিয়া কহিলাম প্রিয়ে আমি এই বন্ধুর অদর্শনে বিষণ্ণ হইতেছি। রাজকন্যা তোমার কথা শুনিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছেন এবং আমাকে অগ্রে পাঠাইয়া দিয়া স্বহস্তে এই সমস্ত প্রস্তুত করিয়া তোমার আহারের নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছেন। আমাকে কহিয়া দিয়াছেন তুমি আপন সমক্ষে তাঁহাকে ভোজন করাইয়া আসিবে। অতএব বয়স্য কিছু ভক্ষণ কর তাহা হইলে পরম সন্তোষ পাই এবং যাইয়া তাঁহার নিকট কহিতে চাই আমার বন্ধু মিষ্টান্ন আহার করিয়া তোমার শিল্পনৈপুণ্যের অশেষ প্রশংসা করিয়াছেন।
তখন অমাত্যপুত্ত্র রাজপুত্ত্রের নিকট পুনর্বার মনোযোগপূর্ব্বক পূর্ব্বাপর সমস্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন বয়স্য তুমি আমার নিমিত্ত কালকূট আনিয়াছ। এ মিষ্টান্ন নহে সাক্ষাৎ কৃতান্ত জিহ্বাস্পর্শমাত্রেই প্রাণসংহার করিবেক। যাহা হউক আমার পরম ভাগ্য এই যে তুমি খাও নাই। তুমি ঋজুস্বভাব কাহার কি ভাব কিছুই বুঝিতে চেষ্টা কর না। তোমাকে এক সার কথা কহি স্বৈরিণীরা স্বভাবতঃ আপন প্রিয়ের প্রিয়পাত্রের প্রতি অতিশয় বিষদৃষ্টি হয়। অতএব তুমি তাহার সমক্ষে আমার নাম গ্রহণ করিয়া বুদ্ধির কর্ম্ম কর নাই।
কুমার কহিলেন বয়স্য আমি তোমার এ কথায় বিশ্বাস করিতে পারি না। তুমি তাহার স্বভাব জান না এই নিমিত্ত এরূপ কহিতেছ। এমন সদাশয় স্ত্রীলোক আমি কখন দেখি নাই। তাহার নাম করিলে আমার রোমাঞ্চ হয়। বলিতে কি তুমি আর বার এপ্রকার কহিলে আমি তোমার উপর বিরক্ত হইব। ভাল কথায় প্রয়োজন নাই আমি তোমার সন্দেহ দূর করিতেছি। এই বলিয়া এক লাড়ু লইয়া বিড়ালকে ভক্ষণ করাইলেন। বিড়াল তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন রাজপুত্ত্র চমৎকৃত হইয়া কহিতে লাগিলেন এরূপ দুর্বৃত্তার সহিত পরিচয় রাখা উচিত নহে। আর আমি জন্মাবচ্ছিন্নে সেই পাপীয়সীর মুখ দর্শন করিব না। মন্ত্রিপুত্ত্র কহিলেন না বয়স্য তাহাকে এক বারেই পরিত্যাগ করা হইবেক না রাজধানীতে লইয়া যাইবার সুযোগ দেখিতে হইবেক। রাজপুত্ত্র কহিলেন তাহাও তোমার বুদ্ধিসাধ্য।
অমাত্যপুত্ত্র কহিলেন বয়স্য এক পরামর্শ বলি শুন। অদ্য তুমি পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া পূর্ব্বাপেক্ষায় অধিকতর প্রণয় প্রকাশ করিবে এবং কহিবে বন্ধু মিষ্টান্ন আহারের অব্যবহিত পর ক্ষণেই অচেতনপ্রায় হইয়া নিদ্রাগত হইলেন। আমি তোমাকে দেখিবার নিমিত্ত উৎসুক হইয়া তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে না পারিয়া তাঁহাকে না বলিয়াই চলিয়া আসিয়াছি। আমি এখন তোমাকে এক ক্ষণ নিরীক্ষণ না করিলে দশ দিক্ শূন্য দেখি। ফলতঃ আর আমি বন্ধুর অনুরোধে এক মুহূর্ত্তের নিমিত্তেও তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিব না। ইত্যাদি নানাবিধ কপট বাক্য দ্বারা তাহার বিশ্বাস জন্মাইয়া দিবা যাপন করিবে। পরে সে নিদ্রাগতা হইলে তদীয় সমস্ত আভরণ হরণপূর্ব্বক তাহার বাম জঙ্ঘাতে এক ত্রিশূলের চিহ্ন দিয়া চলিয়া আসিবে। রাজপুত্ত্র সহিত হইলেন এবং পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া পূর্ব্বাপেক্ষায় সমধিক প্রীতি প্রকাশ করিলেন। পরে রজনীযোগে উভয়ে শয়ন করিলে রাজকন্যা সে দিবস ত্বরায় নিদ্রাভিভূতা হইলেন। কুমার দেখিলেন পদ্মাবতী সুষুপ্তিপ্রাপ্তা হইয়াছেন। তখন মন্ত্রিপুত্ত্রের উপদেশানুরূপ সমস্ত সম্পাদন করিয়া বৃদ্ধার আবাসে উপস্থিত হইলেন।
পর দিন প্রভাতে মন্ত্রিপুত্ত্র সন্ন্যাসীর বেশ ধারণপূর্ব্বক এক শ্মশানে উপস্থিত হইলেন এবং স্বয়ং গুরু হইয়া রাজপুত্ত্রকে শিষ্য করিয়া কহিলেন তুমি নগরে গিয়া এই অলঙ্কার বিক্রয় কর। যদি কেহ তোমাকে চোর বলিয়া ধরে তাহাকে আমার নিকটে লইয়া আসিবে। রাজপুত্ত্র তাঁহার বচনানুসারে ভূষণগ্রহণপুরঃসর নগর প্রবেশ করিয়া রাজসদনের সমীপস্থিত স্বর্ণকারের নিকট বিক্রয়ার্থ উপস্থিত হইলেন। সে দর্শনমাত্র বিস্ময়াপন্ন হইয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল কিয়ৎ দিবস হইল আমি রাজকন্যার নিমিত্ত এই সকল অলঙ্কার গড়িয়া দিয়াছি ইহার হস্তে কি প্রকারে আইল। এ ব্যক্তিকে বৈদেশিকে দেখিতেছি। অনন্তর সন্দিহান হইয়া কারিকরদিগকে জিজ্ঞাসা করাতে তাহারা কহিল হাঁ এ সমস্ত রাজকন্যার অলঙ্কার বটে। তখন স্বর্ণকার রাজকুমারকে চোর নিশ্চয় করিয়া কহিল এ রাজকন্যার অলঙ্কার দেখিতেছি তুমি কোথায় পাইলে যথার্থ বল।
স্বর্ণকার ভয় প্রদর্শনপূর্ব্বক বার বার এইপ্রকার জিজ্ঞাসা করাতে রাজপথবাহী দশ দ্বাদশ উদাসীন ব্যক্তিও কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া তথায় উপস্থিত হইল। ফলতঃ অল্পকালমধ্যেই ঐ অলঙ্কার লইয়া অত্যন্ত আন্দোলন হইতে লাগিল। পরিশেষে নগররক্ষক এই সংবাদ পাইয়া রাজকুমার ও স্বর্ণকার উভয়কে রুদ্ধ করিল। পরে সে অলঙ্কারের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে কুমার কহিলেন শ্মশানবাসী গুরুদের আমারে এই অলঙ্কার বিক্রয় করিতে পাঠাইয়াছেন। তিনি কোথায় পাইয়াছেন আমি তাহার কিছুই জানি না। যদি তোমাদের সন্দেহ হয় তাঁহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা কর। পরিশেষে পুররক্ষী গুরু শিষ্য উভয়কে অলঙ্কারসমেত রাজসমক্ষে লইয়া গিয়া পূর্ব্বাপর সমস্ত বিজ্ঞাপন করিল।
রাজা অলঙ্কারদর্শনে নানা প্রকারে সন্দিহান হইয়া যোগীকে নির্জনে আনিয়া বিনয়বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন মহাশয় আপনি এই সমস্ত অলঙ্কার কোথায় পাইলেন। যোগী কহিলেন মহারাজ কৃষ্ণচতুর্দশীরজনীতে আমি নগরপ্রান্তবর্ত্তী শ্মশানে ডাকিনীমন্ত্র সিদ্ধ করিয়াছিলাম। মন্ত্রপ্রভাবে ডাকিনী স্বয়ং উপস্থিত হইয়া প্রসাদস্বরূপ স্বীয় অলঙ্কার উন্মোচন করিয়া দিয়াছেন এবং আমিও তাঁহার বাম জঙ্ঘাতে যোগসিদ্ধির প্রমাণস্বরূপ এক ত্রিশূলের চিহ্ন দিয়াছি। এ সমুদায় সেই অলঙ্কার। রাজা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া অবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন এবং নিজ মহিষীকে কহিলেন দেখ দেখি পদ্মাবতীর বাম জঙ্ঘাতে কোন চিহ্ন আছে কি না। রাজ্ঞী সবিশেষ অবগত হইয়া রাজার নিকটে আসিয়া কহিলেন এক ত্রিশূলের চিহ্ন আছে।
রাজা এইপ্রকার অঘটনঘটনা শ্রবণে হতবুদ্ধি ও লজ্জায় অধোমুখ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন এপ্রকার স্বৈরিণীকে গৃহে রাখা উচিত কর্ম্ম নহে ইহাতে অধর্ম্ম আছে। অতএব এখন কি কর্ত্তব্য। অথবা পণ্ডিতমণ্ডলী একত্র করিয়া সবিশেষ কহিয়া জিজ্ঞাসা করি তাঁহারা ধর্ম্মশাস্ত্র অনুসারে যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন তদনুরূপ কার্য্য করিব। কিন্তু গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিতে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। পণ্ডিতমণ্ডলী সংগ্রহ করিয়া ব্যবস্থা জিজ্ঞাসিলে আমার এই অপযশ ক্রমে ক্রমে দেশে বিদেশে প্রচার হইবেক। তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই সেই সন্ন্যাসীকেই ইহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। সন্ন্যাসী সবিশেষ অবগত আছেন শাস্ত্রজ্ঞও বটেন ধর্ম্মতঃ প্রশ্ন করিলে অবশ্যই যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিবেন। অনন্তর বিজন প্রদেশে আসিয়া সন্ন্যাসীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন মহাশয় ধর্ম্মশাস্ত্রে দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিষয়ে কিরূপ দণ্ড নিরূপিত আছে। সন্ন্যাসী কহিলেন মহারাজ ধর্ম্মশাস্ত্রে লিখিত আছে স্ত্রী বালক ও ব্রাহ্মণ ইহারা অভ্যন্ত অপরাধী হইলেও বধাহ নহে রাজা ইহাদের নির্বাসন করিবেন।
তখন রাজা অন্তঃপুরে গিয়া রাজ্ঞীকে কহিলেন পদ্মাবতী অতিদুশ্চরিত্রা এজন্য শাস্ত্রবিধানানুসারে আমি ইহাকে দেশবহিষ্কৃতা করিব। রাজ্ঞী কন্যার প্রতি অত্যন্ত স্নেহবতী ছিলেন কিন্তু পতিব্রতাত্ব প্রযুক্তি রাজার মতেই সম্মতা হইলেন। তদনন্তর নৃপতি কন্যাকে শিবিকারোহণের আদেশ দিয়া তাহার অগোচরে বাহকদিগকে আজ্ঞা দিলেন তোমরা পদ্মাবতীকে কোন অরণ্যানীতে পরিত্যাগ করিয়া ত্বরায় আমাকে সংবাদ দাও। বাহকেরা রাজাজ্ঞা সম্পাদন করিল। অমাত্যপুত্ত্রও তৎক্ষণাৎ রাজকুমারকে সঙ্গে লইয়া রাজকুমারীর উদ্দেশে চলিলেন এবং ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া পরিশেষে সেই অরণ্যে প্রবেশিয়া দেখিলেন পদ্মাবতী একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া যুথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায় বিষণ্ণ বদনে রোদন করিতেছেন। পরে অশেষবিধ আশ্বাস প্রদান দ্বারা তাঁহার শোকাবেগ নিবারণ করিয়া সঙ্গে লইয়া উভয়ে স্বদেশাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হইলে প্রজাগণ অতিশয় আনন্দিত হইল। রাজা প্রতাপমুকুট বধূসহিত পুত্ত্র পাইয়া আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া নগরে মহোৎসবের আদেশ করিলেন।
এই রূপে আখ্যায়িকা সমাপন করিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ রাজা ও মন্ত্রিপুত্ত্র এ উভয়ের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি নিরপরাধে রাজকুমারীর বসপ্রেষণজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন। বিক্রমাদিত্য কহিলেন আমার মতে রাজা। বেতাল কহিল কি নিমিত্তে। রাজা কহিলেন শাস্ত্রকারেরা আততায়ী ব্যক্তির বধ ও বিদ্রোহাচরণে দোষাভাব লিখিয়াছেন। অতএব বিষপ্রদায়িনী রাজকন্যার প্রতি এরূপ প্রতিকূলতাচরণে মন্ত্রিপ্রত্ত্রকে দোষী বলিতে পারা যায় না। কিন্তু রাজা যে অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির বাক্যে বিশ্বাস করিয়া প্রমাণাত্তরনিরপেক্ষ ও বিচারবিমুখ হইয়া অপত্যস্নেহ বিস্মরণপূর্ব্বক অকৃতাপরাধে কন্যাকে বনবাস দিলেন ইহাতে তাঁহার রাজধর্ম্মবিরুন্ধ কর্মের অনুষ্ঠানজন্য পাপস্পর্শ হইতে পারে।
ইহা শুনিয়া বেতাল পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞা অনুসারে শ্মশানে গিয়া পূর্ব্ববৎ বৃক্ষে লম্বমান হইল। রাজাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া তাহাকে বৃক্ষ হইতে অবতারণপূর্ব্বক স্কন্ধে করিয়া সন্ন্যাসীর আশ্রমাভিমুখে চলিলেন।