বেতালপঞ্চবিংশতি/ষোড়শ উপাখ্যান

ষোড়শ উপাখ্যান

বেতাল কহিল মহারাজ

চন্দ্রশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে বণিক্‌ বাস করিত। তাহার উন্মাদিনী নামে পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। সে বিবাহযোগ্যা হইলে তাহার পিতা তত্রত্য নরপতির নিকটে গিয়া নিবেদন করিল মহারাজ আমার এক স্বরূপা কন্যা আছে যদি আপনকার ইচ্ছা হর গ্রহণ করুন নতুবা অন্য ব্যক্তিকে দিব।

রাজা শুনিয়া দুই তিন বয়োবৃদ্ধ প্রধান রাজপুরুষদিগকে উন্মাদিনীর লক্ষণপরীক্ষার্থে প্রেরণ করিলেন। তাহারা রাজকীয় আদেশ অনুসারে রত্নদত্তের আলয়ে উপস্থিত হইল এবং উন্মাদিনীকে ইন্দ্রের অপ্সরা অপেক্ষাও রূপবতী ও সর্ব্ব প্রকারে সুলক্ষণা দেখিয়া পরামর্শ করিল এই কন্যা মহিষী হইলে রাজা ইহার নিতান্ত বশতাপন্ন হইয়া এক বারেই রাজ্যচিন্তা পরিত্যাগ করিবেন॥ অতএব উত্তম কল্প এই রাজার নিকটে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া পরিচয় দেওয়া যাউক। অনন্তর তাহারা রাজসমীপে পরামর্শানুরূপ সংবাদ দিলে তিনি তাঁহাদের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া অস্বীকার করিলেন। তখন রত্নদত্ত সৈন্যাধ্যক্ষ বলভদ্রবর্ম্মার সহিত আপন কন্যার বিবাহ দিল।

এক দিবস রাজা নগরভ্রমণে নির্গত হইয়া সেনাপতির বাটীর নিকটে উপস্থিত হইলেন। তৎকালে উন্মাদিনী মনোহর বেশ ভূষা করিয়া অট্টালিকার উপরিভাগে দণ্ডায় মান ছিল। রাজা উন্মাদিনীকে নয়নগোচর করিয়া মোহিত ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া তৎক্ষণাৎ প্রত্যাগমন করিলেন। রাজাকে সহসা প্রত্যাগত ও বিচেতন দেখিয়া এক প্রিয় পার্শ্বচর জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ কি নিমিত্তে আজি আপনাকে চলচিত্ত দেখিতেছি। রাজা কহিলেন অদ্য বলভদ্রের ভবনে এক স্ত্রী দেখিলাম তাহার লোকাতীত রূপ লাবণ্য দর্শনে আমার মন মোহিত হইয়াছে ও আমি এইরূপ বিকল হইয়াছি।

পার্শ্বচর কহিল মহারাজ যাহাকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন সে রত্নদত্তের কন্যা। তাহার নাম উন্মাদিনী। আপনি অস্বীকার করতে সেনাপতি বলভদ্রের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে। রাজা কহিলেন আমি যাহাদিগকে ঐ কন্যার লক্ষণ দেখিতে পাঠাইয়াছিলাম বুঝিলাম তাহারা প্রতারণা করিয়াছে। অনন্তর দৌবারিক দ্বারা তাহাদিগকে আহ্বান করিয়া কহিলেন অদ্য আমি নগরভ্রমণে নির্গত হইয়া রত্নদত্তের কন্যাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। জন্মাবচ্ছিন্নে তাহার তুল্য সুরূপা সুলক্ষণা নারী নিরীক্ষণ করি নাই। তবে তোমরা কি নিমিত্ত তৎকালে কুরূপা ও কুলক্ষণা কহিয়া আমাকে তাদৃশ স্ত্রীরত্নলাভে বঞ্চিত করিলে।

রাজপুরুষেরা কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল মহারাজ যাহা আজ্ঞা করিতেছেন যথার্থ বটে। কিন্তু তৎকালে আমরা বিবেচনা করিয়াছিলাম যে এরূপ সুরূপা কন্যা মহিষী হইলে মহারাজ কাজকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া অহোরাত্র অন্তঃপুরে অবস্থিতি করিবেন। ভদ্দ্বারা রাজ্যভঙ্গসম্ভাবনা। এই আশঙ্কায় আমরা এরূপ কল্পিত বাক্য দ্বারা মহারাজের নিকট কুরূপা ও কুলক্ষণা কহিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদের যে অপরাধ হইয়াছে ক্ষমা করিতে আজ্ঞা হয়। রাজা তোমরা যাহা কহিলে যথার্থ বটে ইহা কহিয়া তাহাদিগকে বিদায় দিলেন। কিন্তু আপনি নিতান্ত বিচেতন হইয়া দিনযামিনী কেবল উন্মাদিনী চিন্তা করিতে লাগিলেন। রাজার এই অবস্থা কর্ণপরম্পরায় সমস্ত নগরমধ্যে প্রচারিত হইলে সেনাপতি বলভদ্রবর্ম্মা রাজার নিকটে উপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল মহারাজ বলভদ্র আপনকার দাস উন্মাদিনী দাসী। দাসীর নিমিত্তে এপর্য্যন্ত ক্লেশস্বীকারের আবশ্যকতা কি। মহারাজের আজ্ঞা হইলেই সে উপস্থিত হইতে পারে।

রাজা শুনিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন এবং কহিলেন আমার কি ধর্ম্মজ্ঞান নাই যে পরস্ত্রীস্পর্শ দ্বারা পাপসঞ্চয় করিব। শাস্ত্রকারেরা পরস্ত্রীতে মাতৃদৃষ্টি করিতে অনুমতি করিয়াছেন। বলভদ্র কহিল মহারাজ শাস্ত্রকারেরা ইহাও নির্দিষ্ট করিয়াছেন পত্নীর উপর পরিণেতার সর্ব্বতোমুখী প্রভুতা আছে। তদনুসারে আমি আপনাকে উন্মাদিনী দান করিতেছি তাহা হইলে আর মহারাজের পরস্ত্রীস্পর্শদোষের আশঙ্কা কি। রাজা কহিলেন যাহাতে সমস্ত সংসারে অপযশ হইবেক প্রাণান্তেও আমি এরূপ কর্ম্ম করিব না। যশোধনেরা এই পঞ্চীকৃত ভূতপঞ্চময় ক্ষণবিনশ্বর শরীরের অনুরোধে অবিনশ্বর যশঃশরীরের অপক্ষয় করেন না।

সেনাপতি কহিল মহারাজ আমি তাহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া অন্য স্থানে রাখিব তাহা হইলে সে সাধরণস্ত্রী হইবেক তখন আর অপযশের আশঙ্কা কি। রাজা শুনিয়া পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন যদি তুমি পতিব্রতা নারীকে কুলটা কর তাহা হইলে আমি তোমার গুরুতর দণ্ডবিধান করিব এবং জন্মাবচ্ছিন্নে আর মুখাবলোকন করিব না। তখন বলভদ্র ভীত ও নিতান্ত নিরুপায় হইয়া প্রণাম করিয়া বিদায় লইল। কিন্তু উন্মাদিনীচিন্তা কালস্বরূপিণী হইয়া দশম দিবসে রাজার প্রাণসংহার করিল।

প্রভুভক্ত বলভদ্র এবংবিধ ধর্ম্মশীল স্বামীর প্রাণবিনাশসংবাদ শ্রবণে অতিশয় শোক ও পরিতাপ প্রাপ্ত হইয়া মনে মনে বিবেচনা করিল এতাদৃশ প্রভুর লোকান্তরগমনের পর আর প্রাণধারণের প্রয়োজন কি। বিবেচনা করিলে আমার নিমিত্তই স্বামীর এই অকালমৃত্যু হইল। জানি না জন্মান্তরে এই পাপে আমাকে কত যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবেক। অতএব এক্ষণে প্রাণত্যাগরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া আত্মাকে বিশুদ্ধ করি। এইরূপ অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া প্রেতভূমিতে উপস্থিত হইল এবং চিতা প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া সূর্য্যাভিমুখে প্রার্থনা করিতে লাগিল ভগবন্‌ ভাস্কর আমি কৃতাঞ্জলি হইয়া একান্তচিত্তে প্রার্থনা করিতেছি যেন জন্মে জন্মে এইরূপ ধর্ম্মপরায়ণ প্রভু পাই।

এই বলিয়া বলভদ্র প্রজ্বলিত চিতায় আরোহণ করিলে তাহার পত্নী উন্মাদিনী মনে মনে বিবেচনা করিল আমার আর জীবনধারণ বৃথা বরং সহগমনপথ অবলম্বন করি পরকালে সদ্গতি পাইব। ধর্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তকেরা কহিয়াছেন সহগমন স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম্ম। নারী চির কাল দুশ্চরিত্রা ও নানাবিধদুষ্কৃতকারিণী হইলেও সহগমনবলে স্বামীর সহিত স্বর্গলোকে অনন্ত কাল সুখ সম্ভোগ করে এবং পতি যদি অতি দুরাচার ও পাপাত্মা হয়েন সহগমনপ্রভাবে নারী তাঁহারও উদ্ধারকারিণী হয়। এই ভাবিয়া সে সহগামিনী হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিল।

ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ এই তিন জনের মধ্যে কোন্‌ ব্যক্তির ভদ্রতা অধিক। বিক্রমাদিত্য কহিলেন রাজার। বেতাল কহিল কি নিমিত্তে। তিনি কহিলেন রাজা উন্মাদিনীর নিমিত্তে জীবন পরিত্যাগ করিলেন তথাপি অধর্ম্ম ও অপযশ ভয়ে পরস্ত্রীস্পর্শে প্রবৃত্ত হইলেন না। আর স্বামীর নিমিত্ত সেবকের প্রাণত্যাগ করা উচিত কর্ম্ম। স্ত্রীলোকেরও স্বামীর সহগামিনী হওয়া প্রধান ধর্ম্ম। অতএব রাজার ভদ্রতা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।